Tuesday, February 28, 2017

Inglourious Basterds মগজে রক্তে স্নায়ুতে তোলপাড় করা হিম ঝড়

ছবিটার নাম নানান জায়গায় দেখলেও দেখা হয়নি আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে Inglourious Basterds এর অবস্থানটা কোন র‍্যাংকিং বা রেটিং এর ধার ধারে না। একটি অনন্য সাধারণ চলচ্চিত্র হয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে। এই ছবির দেখার চোখ অন্য সবার চেয়ে আলাদা। রক্ত হিম করা থ্রিলারের মধ্যে এই ছবিটার সাথে তুল্য ছবি আপাততঃ মনে আসছে না।  না দেখলে বোঝানো অসম্ভব ছবির প্রতিটি পর্বে অপ্রত্যাশিত মোচড়গুলো দর্শকের হাড়ে কিভাবে কাঁপুনি তোলে, কিভাবে স্নায়ুতে রক্তকনিকার চলাচলের গতিবেগ ঘুর্ণিঝড় ডেকে আনে। যুদ্ধের ছবি তবু যুদ্ধ তেমন নেই, কিন্তু থ্রিলিং এর পরিমান এত বেশী যে দুর্বল চিত্তের না দেখাই ভালো। পরিচালক Quentin Tarantino এর ভক্ত হয়ে গেলাম ছবিটা দেখে।

যে সিনেমায় ভ্রমণের আনন্দ

পৃথিবীর অনেক দৃশ্য অদেখা থেকে যাবে শেষমেষ। কোথাও বেড়াতে গেলে ফিরে আসার পর সঞ্চয় থাকে স্মৃতিগুলো। কিছু দৃশ্য ধরা থাকে ক্যামেরার চোখে, কিছু জমা থাকে নিজের দৃষ্টি স্মৃতিতে। প্রযুক্তির যুগটাকে খুব পছন্দ করি একটা কারণে। যেখানে যাইনি, যাওয়া হবে না- সেখানকার ঝকঝকে দৃশ্য চোখের সামনে হাজির করছে প্রতিদিন আধুনিক হতে থাকা প্রযুক্তি। কম্পিউটার, চলচ্চিত্র ইত্যাদি যত উন্নত হবে আমাদের দেখার সুযোগ তত বেশী। সিনেমা কেন পছন্দ করে মানুষ? শুধু কিছু গল্প উপন্যাসের দৃশ্যরূপ দেখার জন্য নয় নিশ্চয়ই। আরো বহুবিধ কারণ আছে, অনুভূতির অনুরণন আছে।

সেই সাথে আমার আছে আরো একটি বিশেষ কারণ। সিনেমা দেখার আনন্দ আমার কাছে শুধু একটি ঘটনা বা গল্পের দৃশ্যরূপ অবলোকন নয়। চিত্রায়িত দৃশ্যাবলীর ভূগোলেরও একটা ভূমিকা আছে তাতে। কোন কোন সিনেমার গল্প ভালো না হলেও তার দৃশ্যায়ন অসাধারণ হতে দেখেছি। যদি সেই দৃশ্য অদেখো কোন ভূগোলের চিত্র ধারণ করে তাহলে গল্পটি যাই হোক সেই সিনেমা আমি দেখবো। আমার কাছে প্রতিটি নতুন সিনেমা শুধু একটি গল্প শোনা নয়, একটি নতুন পৃথিবীও দেখা। অদেখা ভূখণ্ডে চিত্রিত নির্মিত অখাদ্য চলচ্চিত্রও আমি দেখতে রাজী যদি তার ক্যামেরার কাজ ভালো হয়, যদি এই গ্রহের একটি নতুন দৃশ্য আমার চোখের সামনে উপস্থিত করে।

যেখানে যত বেশী নতুন ভৌগলিক দৃশ্য সেখানে তত বেশী আনন্দ। নতুন নতুন দেশের সিনেমার প্রতি বাড়তি আগ্রহ এই কারণেই। একেকটা সিনেমা যেন একেকটি নতুন দেশ ভ্রমণের তৃপ্তি। প্রতিটি ভ্রমণের আনন্দ বেদনার মিশেল একেকটি ভ্রমণ একেকটি নতুন আনন্দ দুয়ার খুলে দেয় চোখের সামনে।

নীচের সিনেমাগুলো সেরকম কয়েকটি উদাহরণ। 


Tanna প্রশান্ত মহাসাগরের ভানুয়াতু দ্বীপপুঞ্জের অখ্যাত একটা দ্বীপ তান্না। সেই দ্বীপের প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক আদিবাসী সমাজের একটি ট্র্যাজিক প্রেমের সত্যি ঘটনার গল্প নিয়ে অসাধারণ চিত্রায়ণ সমৃদ্ধ একটি সিনেমা।  সিনেমাটি তৈরী করার জন্য অষ্ট্রেলিয়ান পরিচালক ছয় মাসের জন্য তান্না দ্বীপের আদিবাসীদের সাথে বসবাস করেছিলেন এবং সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো সিনেমাতে ওই দ্বীপের আদিবাসীরাই অভিনয় করেছে যারা কখনো সভ্য সমাজের সংস্পর্শে আসেনি। ২০১৭ সালে অস্কারের বিদেশী সিনেমা ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিল ছবিটা।


Kon-Tiki - গতকালের আগে আমিও জানতাম না  Thor Heyerdal নামের এক সুইডিশ স্কলার নিজের গবেষণাকে সত্য প্রমাণ করার জন্য দুনিয়ার সবার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ৮০০০ কিমি দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের একটা দ্বীপের উদ্দেশ্যে কাঠের ভেলা নিয়ে দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে। সেই অভিযানের নাম Kon Tiki. প্রতিষ্ঠিত ধারণার বিপরীতে তিনি জানিয়েছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের আদিবাসীরা এশিয়া থেকে আসেনি, এসেছিল দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। আদিবাসীদের দেয়া তথ্য মতে ১৫০০ বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষ সূর্যোদয়ের দিক থেকে সূর্যাস্তের দিকে পাড়িয়ে দিয়েছিল কাঠের ভেলায় চড়ে। চমৎকার থ্রিলিং এই সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন Joachim Rønning এবং Espen Sandberg

কয়েক বছর আগে দেখা Amelia ছবির কথা মনে পড়ে গেল। 'এমেলিয়া' নামের এক নারী পাইলট একাকী একটা ছোট্ট প্লেন নিয়ে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন ১৯৩২ সালে। সেই ছবির দৃশ্যায়ন চিত্রায়িত হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার ইরিয়ান জায়া প্রদেশের দুর্গম রেইন ফরেস্ট এলাকায়। 'এমেলিয়া' তৈরী করেছিলেন মীরা নায়ার ২০০৯ সালে।


Patagonia দেখার সিদ্ধান্ত নেই নামটি দেখে। ছাত্রজীবনে ফার্ডিন্যাণ্ড ম্যাগিলানের সেই অভিযানের গল্পটি পড়ার পর থেকে দক্ষিণ আমেরিকার ওই অঞ্চল সম্পর্কে কৌতুহল। তখন থেকেই নামটা চেনা। আর্জেন্টিনার দক্ষিণ সীমান্তের ওই প্রদেশটি ঘুরেই ম্যাগেলান প্রশান্ত মহাসাগর আবিষ্কার করেছিলেন ১৫২০ সালে এবং আধুনিক যুগের প্রথম মানুষ হিসেবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার গৌরব অর্জন করেছিলেন মাঝপথে আদিবাসীদের হাতে নিহত হবার পরও। এই সিনেমাটি সেই ঘটনা নিয়ে নয় বরং বিপরীত যাত্রার দুটো চমকপ্রদ গল্প নিয়ে। দুটো গল্পে মোট চারজন মানুষ। এক নারী শেকড় খুঁজতে যায় প্যাটাগোনিয়া থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ওয়েলসে, আরেক পুরুষ ওয়েলস থেকে অন্য এক তথ্য তালাশে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে প্যাটাগনিয়া পৌঁছায়। পথে পথেই ঘটনা আগাতে থাকে। দুটো গল্প একসাথে যাত্রা করে কিন্তু তাদের কোথাও দেখা না হয়েও গল্পটি দর্শকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। বৃটিশ-আর্জেনটিনার যৌথ উদ্যোগের সিনেমাটি বানিয়েছেন Marc Evans

এই সিনেমাগুলোতে ভ্রমণের তৃপ্তি পাওয়া গেল। পজ বাটন টিপে একেকটি দৃশ্যে মিনিট খানেক ব্যয় করা গেছে কোথাও কোথাও। যেমন ছিল এন্টার্কটিকার ডকুমেন্টারীতে।

Saturday, February 18, 2017

দুটি রাবীন্দ্রিক অনুভূতি



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছিন্নপত্রাবলী-৮
১০ অক্টোবর ১৮৯০, লণ্ডন





রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছিন্নপত্রাবলী-৭
৩ অক্টোবর ১৮৯০, লণ্ডন


ষাট বছর বয়সেও যিনি তরুণ ছিলেন, তিরিশ বছর বয়সে তিনি নিশ্চয়ই আরো তারুণ্যে দীপ্ত ছিলেন। তিরিশ তারুণ্যের উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথের এই সাদামাটা উপলব্ধি দুটো দেশ কিংবা ব্যক্তিভেদে কালজয়ী বলে ধরা যায়। এই দুটো উপলব্ধিকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে যা পেলাম-

১. সংবেদনশীল মানুষ অনুভূতি প্রকাশে যদি দ্বিধাগ্রস্থ কিংবা বাধাপ্রাপ্ত হয় তার প্রতিক্রিয়া হৃদয়নদীকে বন্ধ্যা করে তোলার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

২. প্রবাসী মাত্রেই হয়তো এমন দেশপ্রেমে ভেসে যায় না, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে দূরত্ব মানুষের ভেতরকার চেতনাকে অনেক বেশী স্পষ্ট করে তোলে যা নৈকট্যের কাছে দূর্লভ।


Tuesday, February 14, 2017

Antarctica: A Year on Ice.... সিনেমা নয়, দুর্লভ এক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়

এন্টার্কটিকার সাথে আমার তথ্যগত পরিচয় বহুদিনের। এক যুগ আগের একটা সময়ে আমি এন্টার্কটিকা ভ্রমণের স্বপ্নে বুঁদ হয়েছিলাম। আমার আরো অনেক অবাস্তবায়িত স্বপ্নের মতো এন্টার্কটিকাও হিমঘরে রয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগে তারেক অনুর একটা টেড টকে এন্টার্কটিকা ভ্রমণের একটা পরিকল্পনা শুনে সাথে সাথে সেই সুপ্ত ইচ্ছেটা জেগে উঠলে আপ্লুত হয়ে অনুকে বলেই ফেলি, আমাকেও সাথে নিও ভাই।

সেই দিন আসতে এখনো অনেক দেরী। আদৌ কতটা বাস্তবায়িত হবে এখন বলা যাচ্ছে না। কিন্তু স্বপ্নটা জেগে থাকতে থাকতে হাতে এসে গেল অসাধারণ একটা এন্টার্কটিকা চলচ্চিত্র Antarctica: A Year on Ice. পরিচালনা-গবেষণা-ক্যামেরা সবকিছু সব্যসাচীর দক্ষতা নিয়ে চালিয়েছেন নিউজিল্যাণ্ডের Anthony B. Powell, (অচেনা অজানা পাওয়েল ভাইয়ের কাছে আমার অসীম কৃতজ্ঞতা।)

বিবিসির Frozen Planet যারা দেখেছেন কিংবা জিওগ্রাফিক চ্যানেলের এন্টার্কটিকা বিষয় ডকুমেন্টারী যারা দেখেছেন তারা শুধু তথ্য জেনেছেন এন্টার্কটিকা বিষয়ে। এই চলচ্চিত্রেও তথ্য আছে কিন্তু তথ্যের চেয়েও বেশী যা দেখবেন অসাধারন অপার্থিব কিছু দৃশ্য যা আর কোথাও দেখেননি। আমি নিশ্চিত এই গ্রহের ৯৯ ভাগ মানুষের পরিচয় নেই এই অসাধারণ দৃশ্যের সাথে। time-lapse photography দিয়ে মাসের পর মাস ধরে তোলা ছবি আর ভিডিওচিত্রের অপূর্ব সমন্বয়।

ইংরেজির Breathtaking শব্দটির যথার্থ অনুবাদ উপলব্ধি করেছি এইসব দৃশ্যমালা প্রাণ ভরে চোখ ভরে দেখতে দেখতে। রাতের আকাশ যে এতটা বিচিত্র বর্ণের, বিচিত্র রূপের, বিচিত্র চরিত্রের আলোক বাগানে পরিণত হতে পারে সেটা এন্টার্কটিকাবাসী ছাড়া আর কেউ জানে না। আকাশ এখানে নেমে এসেছে অনেক কাছাকাছি, হাত বাড়ালেই মুঠো মুঠো তারা। মেরু জ্যোতির অনেক ছবি দেখেছি আগে, কিন্তু এমন জীবন্ত চলমান দৃশ্যে কখনো দেখা হয়নি। এই দৃশ্য আমার পক্ষে বর্ণনাতীত। শেলী কীটস কিংবা রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ দাশের হাতেই এই চিত্ররূপ অক্ষরে ধারণ করা সম্ভব ছিল। আফসোস, তাঁরা কেউ দেখেনি এই দৃশ্য। তবু জীবননানন্দ দাশ অদেখা অনেক দৃশ্যকে তাঁর কবিতায় ধারণ করেছেন অলৌকিক ভাবে। তাঁর কবিতার অবোধ্য কোন ছত্রের সাথে এইসব অপার্থিব নীহারিকা দৃশ্যের সাদৃশ্য খোঁজে যেতে পারে।




বিশাল এই মহাদেশে গড়ে মাত্র ৫০০০ মানুষের অস্থায়ী বাস, যারা গবেষণা ইত্যাদিতে ব্যস্ত। শীতকালে যা নেমে আসে ৭০০ জনে। শীতকালে দীর্ঘ ৪ মাস সভ্য পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে এন্টার্কটিকাবাসী। এই চলচ্চিত্রটি সেই সব অধিবাসীর দৈনিক জীবন যাপনের গল্প, বলা যায় এন্টার্কটিকাবাসীর এক বছরের বরফ-যাপিত সংসার নিয়ে।

আর দশটি ডকুমেন্টারীর সাথে এই ছবির পার্থক্য হলো এখানে প্রতিটি দৃশ্য, এত চমৎকার টানা শ্বাসরুদ্ধকর আনন্দে চোখ ভরিয়ে দিয়েছে যে দেড় ঘন্টা সময় দশ মিনিটে কেটে গেছে। বহুবার দেখেও মুগ্ধতা কাটবে না আমার।

আমার যদি এন্টার্কটিকা ভ্রমণ নাও হয় এখন আর আক্ষেপ নেই। এই ছবি আমাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে। আমি নিজে ভ্রমণ করে এত কিছু দেখা সম্ভব ছিল না। কিছু চলচ্চিত্র আছে যা দেখা কেবলমাত্র বিনোদন না, একটা দুর্লভ অভিজ্ঞতাও। এই ছবিটা দেখে সেই বিচিত্র দুর্লভ অভিজ্ঞতার আনন্দই যুক্ত হলো থলিতে।

Monday, February 13, 2017

টুকরো একাত্তর

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে মাইজদী হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষের উপর দাড়িয়ে থাকা চৌকিদার আলম আগস্টের নৃশংশ পাকিস্তানী গনহত্যার স্মৃতিচারণ করছিলেন রেডক্রসকর্মী তাদামাসা হুকিউরার কাছে।

পাকিস্তানী সৈন্যরা ডাক্তার নার্স রোগীসহ ৫৯ জনকে পাটের দড়িতে বেঁধে একসাথে গুলি করে হত্যা করেছিল হাসপাতালের ভেতরেই। কাঁধে গুলি খেয়েও অল্পের জন্য বেঁচে যান আলম। তিনি  বলছিলেন-

- আমি নুরুন নাহার আপার কথা ভুলতে পারি না। পাকিস্তানীরা গুলি করার আগ মুহূর্তে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে তিনি চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন - "জয় বাংলা!"

নুরুন নাহার ওই হাসপাতালের একজন নার্স ছিলেন।
----------------------------------------------------------------------------------

আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাবার বদলে রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল অজানা অদেখা সেই নারীর অন্তর্গত এক সুগভীর চেতনার কথা ভেবে।

[সুত্র: রক্ত ও কাদা, তাদামাসা হুকিউরা]

Monday, February 6, 2017

ভ্রমণপিপাসু বাঙালী: শতবর্ষ আগে এবং শতবর্ষ পরে

আমাকে অনেকেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, "তুমি য়ুরোপে ভ্রমণ করিতে যাইতেছে কেন।' এ কথার কী জবাব দিব ভাবিয়া পাই না। ভ্রমণ করাই ভ্রমণ করিতে যাইবার উদ্দেশ্য, এমন একটা সরল উত্তর যদি দিই তবে প্রশ্নকর্তারা নিশ্চয় মনে করিবেন কথাটাকে নিতান্ত হাল্কারকম করিয়া উড়াইয়া দিলাম। ফলাফল বিচার করিয়া লাভ-লোকসানের হিসাব না ধরিয়া দিতে পারিলে, মানুষকে ঠাণ্ডা করা যায় না।

প্রয়োজন না থাকিলে মানুষ অকস্মাৎ কেন বাহিরে যাইবে, এ প্রশ্নটা আমাদের দেশেই সম্ভব। বাহিরে যাইবার ইচ্ছাটাই যে মানুষের স্বভাবসিদ্ধ, এ কথাটা আমরা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছি। কেবলমাত্র ঘর আমাদিগকে এত বাঁধনে এমন করিয়া বাঁধিয়াছে, চৌকাঠের বাহিরে পা বাড়াইবার সময় আমাদের এত অযাত্রা, এত অবেলা, এত হাঁচি- টিক্‌টিকি, এত অশ্রুপাত যে, বাহির আমাদের পক্ষে অত্যন্তই বাহির হইয়া পড়িয়াছে; ঘরের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন হইয়াছে। আত্মীয়মণ্ডলী আমাদের দেশে এত নীরন্ধ্র নিবিড় যে, পরের মতো পর আমাদের কাছে আর-কিছুই নাই। এইজন্যই অল্প সময়ের জন্যও বাহির হইতে হইলেও সকলের কাছে আমাদের এত বেশি জবাবদিহি করিতে হয়। বাঁধা থাকিয়া থাকিয়া আমাদের ডানা এমনি বদ্ধ হইয়া গিয়াছে যে, উড়িবার আনন্দ যে একটা আনন্দ, এ কথাটা আমাদের দেশের বিশ্বাসযোগ্য নহে।

অল্প বয়সে যখন বিদেশে গিয়াছিলাম তখন তাহার মধ্যে একটা আর্থিক উদ্দেশ্য ছিল, সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের বা বারিস্টার হাওয়ার চেষ্টা একটা ভালো কৈফিয়ত-- কিন্তু, বাহান্ন বৎসর বয়সে সে কৈফিয়ত খাটে না, এখন কোনো পারমার্থিক উদ্দেশ্যের দোহাই দিতে হইবে।

আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ভ্রমণের প্রয়োজন আছে, এ কথাটা আমাদের দেশের লোকেরা মানিয়া থাকে। সেইজন্য কেহ কেহ কল্পনা করিতেছেন, এ বয়সে আমার যাত্রার উদ্দেশ্য তাহাই। এইজন্য  তাঁহারা আশ্চর্য হইতেছেন, সে উদ্দেশ্য য়ুরোপে সাধিত হইবে কী করিয়া। এই ভারতবর্ষের তীর্থে ঘুরিয়া এখানকার সাধু-সাধকদের সঙ্গ লাভ করাই একমাত্র মুক্তির উপায়।

আমি  গোড়াতেই বলিয়া রাখিতেছি, কেবলমাত্র বাহির হইয়া পড়াই আমার উদ্দেশ্য। ভাগ্যক্রমে পৃথিবীতে আসিয়াছি, পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় যথাসম্ভব সম্পূর্ণ করিয়া যাইব, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট। দুইটা চক্ষু পাইয়াছি, সেই দুটা চক্ষু বিরাটকে যত দিক দিয়া যত বিচিত্র করিয়া দেখিবে ততই সার্থক হইবে।

তবু এ কথাও আমাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, লাভের প্রতিও আমার লোভ আছে; কেবল সুখ নহে, এই ভ্রমণের সংকল্পের মধ্যে প্রয়োজনসাধনেরও একটা ইচ্ছা গভীরভাবে লুকানো রহিয়াছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'যাত্রার পূর্বাপর' প্রবন্ধের এই অংশটিতে  যা লিখেছিলেন এদেশে তার বাস্তবতা এখনো সততই বিদ্যমান। অথচ এই যুগে লক্ষ লক্ষ বাঙালী নানান কাজে বিশ্বজগত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তবু বৈষয়িক সচেতন মানুষের চরিত্র একশো বছর আগে যা ছিল তা থেকে খুব বেশী আগায়নি। রবীন্দ্রনাথ যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন আমরা এখনো সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হই যদি না ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার একটি 'কার্যকর' কারণ দর্শানো না হয়। কার্যকর শব্দটাকে বিশ্বাসযোগ্য শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় অনায়াসে। বিদেশ এ ভ্রমণ কেবলই একটি ভ্রমণ অথবা বিশ্বজগতের রূপরস দেখাটাই একটা কারণ হতে পারে তা এখনো অধিকাংশ বাঙালী মানতে নারাজ। তাই অন্যন্য কার্যকর কিংবা বিশ্বাসযোগ্য কারণকে উপস্থাপন করতে হয় অনেক ক্ষেত্রেই।

তারেক অনুদের মতো মুষ্টিমেয় কজন বিশ্বপরিব্রাজকের ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা না খাটলেও সাধারন আম জনতা এখনো বিদেশ ভ্রমণ করে চাকরী, ব্যবসা, শিক্ষা কিংবা চিকিৎসার জন্য। শুধু ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের সামর্থ্য সবার নেই। কিন্তু আমার চেনা জানাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তাদের ক্ষেত্রেও দেখি কেবল আনন্দের জন্য, পৃথিবীর রূপ বৈচিত্র্যকে নিজের চোখে দেখার জন্য ভ্রমণ করে না। সাথে একট 'কাজ' নিয়ে যেতে হয়। কাজের অজুহাতেই অল্পকিছু ঘুরাঘুরি হয়, সেই ঘুরাঘুরির বিরাট একটা অংশ জুড়ে থাকে কেনাকাটা। অধিকাংশ বাঙালীর গন্তব্য কাছের দেশ ভারত, নেপাল, থাইল্যাণ্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর। সেই দেশগুলো ভ্রমণ গন্তব্যের তালিকায় অতি অবশ্যই প্রকৃতির চেয়ে শপিং মলই প্রাধান্য পায়। কোন দেশে কী কিনতে পাওয়া যায় কিংবা কোন শহরে 'নাইট লাইফ' ভালো সেটা যাত্রার পূর্বে প্রধান অনুসন্ধিৎসু বিষয়।

বাঙালী প্রধানতঃ একটি কার্যকর জাতি। অকাজে কোথাও ভ্রমণ করে না। অপ্রয়োজনে সময় নষ্ট করে না।

Sunday, February 5, 2017

শৈশবের শীতঘ্রাণ

কলোনীর একদম শেষ প্রান্তে এসে যে তিনতলা দালানটা ছিল ঘরটা ছিল তার একতলায়। ঘরের সামনে ছোট্ট এক চিলতে বারান্দা। দুদিকে দেয়াল এক দিক খোলা পশ্চিম প্রান্তে। পশ্চিমে একটা রাস্তা বাঁয়ে মোড় নিয়ে চলে গেছে আরো পশ্চিমের পাড়ায় যেদিকে আমাদের যাওয়া হতো না। তখনো কলোনীতে সীমানা প্রাচীর ওঠেনি। একটা ছোট্ট নালা পেরিয়ে ছুট দেয়া যেতো পশ্চিমের রাস্তায়। রাস্তার ওপাশে ব্যাংক কলোনি, বাংলাদেশ ব্যাংকের আবাসিক এলাকা। ব্যাংক কলোনী পেরিয়ে সিডিএ আবাসিক এলাকা, তার পরে আর কী তখনো জানা হয়নি। আমাদের যাতায়াত ছিল পুবদিকে। পুবদিকে অল্প গেলেই খেলার মাঠ। ক্রিকেট ফুটবল সাংস্কৃতিক উৎসবের আখড়া। শৈশবে সেই মাঠের চেয়ে ঘরের সামনে থাকা ঘাসের উঠোনেই আমাদের বিচরণ। তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ুয়া বালকের দৌড় সেই ঘাসের বাগান পর্যন্ত। ঘাসের বাগানে দাগ কেটে টেনিস বল দিয়ে সাতচাড়া, দাড়িয়াবান্দা, ডাংগুলি, মার্বেল, রঙিন লাঠিমের ঘুরপাক। কলোনীটা এক হলেও সমাজটা তিন ভাগে বিভক্ত। পশ্চিমে সবচেয়ে দরিদ্র এলাকা নিন্মমধ্যবিত্ত, তারপর মধ্যবিত্ত, একদম পুবে উচ্চবিত্ত সরকারী কর্তাদের বাস। আমাদের বাস ছিল সবচেয়ে নিন্মবিত্ত পাড়ায়। ফুটবল ক্রিকেটের চেয়ে ডাংগুলি মার্বেলই বেশী জনপ্রিয়। নয় নম্বর মাঠ তখনো আমাদের জন্য দূর গন্তব্য। প্রথম ফুটবলে লাথি দেয়া হয়েছিল ঘরের সামনের ঘাসের মাঠেই। ছোট্ট সেই মাঠ। দুপাশে দুটো সরু মাঠ চিরে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে কলোনীর প্রধান গেটে। সেই গেটের একটু ভেতরে ছিল আমাদের স্কুল। রাস্তাগুলোতে গাড়ি চলতো না, শুধু রিকশা। কদাচিত একেকটা টেক্সি আসতো।

চোখ বন্ধ করতেই ঠুশ করে একটা বাজি ফুটলো। শবে বরাতের আগমন টের পেতাম বাজি ফোটার শব্দে। হানিফ নোমান বা সোলেমানরা রিকশার স্পোক বাঁকিয়ে লাল সাদা সুতোর মধ্যে একটি পেরেক বেঁধে, স্পোকের গর্তে খানিক  বারুদ দিয়ে রাস্তার উপর টোকা মারলেই ঠাশ, ঠাশ শব্দে বাজি ফাটাতো। হাতে তৈরী যন্ত্রপাতির কলাকৌশলে সেই বাজির শব্দ সঙ্গীতের মতো মধুর শোনাতো। আরেকটু যারা বড় তারা তক্তার টুকরোতে নাট বল্টু দিয় তার পেঁচিয়ে আরো জোরালো শব্দের বাজি তৈরী করতো। বেশী বারুদে ভর্তি সেই নাট বল্টু বাজি রাস্তায় হাতুড়ির মতো আঘাত করলে ভয়াবহ শব্দে কানে তালা লেগে যেতো। তখন আমাদের রিকশা-স্পোক বাজির শব্দ করুণ লাগতো। হানিফ নোমানের সাথে তখন বসে ভাবতাম, আরেকটু বড় হয়ে নেই, তারপর আমরাও......। বড় হতে সময় লাগে। বড় হতে হতে একদিন এই পাড়া বদলে আরেকটু পুবে চলে যেতে হয়। হাইস্কুলে উঠে গেলে বাজি ফোটানো বন্ধ হয়ে হাতে উঠে যায় ব্যাডমিন্টন আর ক্রিকেটের ব্যাট। ফেলে আসি মার্বেল, লাটিম, ডাংগুলিও। শৈশব সমাজ বদলে গিয়ে নতুন খেলায় মেতে ওঠা। নতুন বন্ধু। নতুন জগত। কিন্তু চোখ  বন্ধ করলেই সেই বাজির শব্দ ভেসে আসে তখনো। পুরোনো পাড়ার পুরোনো সমাজে বাজিগুলো ফুটছে এখনো। নতুন পাড়ায় তা নিতান্তই অচল। এভাবে একই কলোনীরই একেক সমাজ পেরিয়ে শৈশব মাড়িয়ে কৈশোরে উত্তীর্ণ। ফেলে আসা দিন তখন আর টানছে না। হাইস্কুলের শেষ ধাপে এসে আবারো পাড়া  বদলে যায়। আবারো নতুন সমাজ, নতুন বন্ধু। নয় নম্বর মাঠ তখন আমার নাগালে। এই মাঠে যতটা খেলা তার চেয়ে বেশী আড্ডা। দক্ষিণ পশ্চিম কোনের সবুজ ঘাসে পা ছড়িয়ে সকাল সন্ধ্যে কেটে যায়। আড্ডার সাথে চলে আসে রোমাঞ্চ, এডভেঞ্চারের আনন্দ। একদিন কলোনী ছেড়ে সিনেমায় দৌড়। সেই আমাদের প্রথম স্কুল ফাঁকি। চোখের জলে স্কুল ছেড়ে কলেজের করিডোরে। দীর্ঘ হয় গন্তব্যগুলো। কোন উচ্চাশা ছাড়াই বড় হতে থাকা।

মিছিলে যোগ দেবার আগেই পুলিশের হাতকড়া। প্রথম কলেজ দিবসের সূচনা সামরিক শাসনের আপ্যায়নে। বড় হওয়া সহজ নয়, বুঝে যাই। প্রবাসী পিতার অবর্তমানে বড় হতে হতে শিখে যাওয়া হয় আরো অনেক কিছু। কলেজে কেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন জীবনে। কঠিন জীবন, কঠিন যাপন। কঠিনেরে ভালোবেসে আরো বড় হওয়া। অনিশ্চিতের চোরাবালিতে ডুব দিয়ে সকাল দুপুর রাত। সহজ ছিল না বড় হওয়া। কবিতা আসে, কবিতা যায়। প্রেম আসে, ফসকে যায়। দীর্ঘ হয় অপেক্ষার দিনরাত। কত বড় হতে হবে কিছুই জানা হয় না। দশটায় বাড়ি ফিরে পড়ায় আমার মন বসে না কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে। ভালো হতে চাই না, খারাপ হতে পারি না। বই ডাকে, বই আসে, বই আকড়ে ধরে, পিছু নেয়। কার প্রেমে পড়ে থাকি জানি না। কবিতা আসে, কবিতা যায়। যে ডাকে, তাকে বুঝি না। সেও বোঝে কিনা জানি না। ধোঁয়াশা কালচক্র। কালের চাকায় খাবি খেতে খেতে একদিন মুক্তি আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ট্রেন যেদিন ক্যাম্পাস স্টেশান ছেড়ে আসে, তখন জানালা দিয়ে সবচেয়ে সুখী দীর্ঘশ্বাস ছিল, স্বাধীনতার। আর কোন পরীক্ষা বাকী নেই।

তখন চোখ বন্ধ করে ঢাকার বাসে উঠে পড়ি বন্ধুর সাথে। পালাতে চাই, পালাতে চাই চেনাজগত ছেড়ে নতুন পথে। বন্ধুর বাড়িতে পা রেখে অন্ধকারে শুয়ে প্রথম শুনি 'ও গানঅলা, আরেকটা গান গাও, আমার আর কোথাও যাবার নেই....কিচ্ছু করার নেই।' আমার কিচ্ছু করার ছিল না বন্ধু অফিসে চলে গেলে। তবু বন্ধুর আশ্রয়ে মুক্তির আনন্দ সীমাহীন। আগামীকাল জানি না, আজকে আমি সুখী। অফিস থেকে ফিরে বন্ধু বন্ধুদলের সুদূর অচেনা উত্তরবঙ্গ যাত্রার প্রস্তাবে নিখাদ 'হ্যাঁ'। কোথায় যাবো, কেন যাবো, কোন প্রশ্ন নেই। যেদিকে বন্ধু ডাকে সেদিকে যেতে হবে। বলার প্রয়োজন হয় না - বাসার অনুমতি নিতে হবে, জানাতে হবে। রাতের বাসে যমুনা পেরিয়ে যেতে কানে হেডফোন গুঁজে দেয় বন্ধু - 'ছলাত ছল ছলাত ছল নদীর কাছে গল্প বলি...' আমার দুচোখ রাত যমুনায় ধুয়ে যায়।

একদিন অন্ধকার কেটে যায়। ধোঁয়াশা মুছে যায়। হাত থেকে বালি ঝেড়ে সাফ করে নিজেকে জুতোর মধ্যে খাপ খাইয়ে নেই। জুতোর মাপে দাঁড়িয়ে থাকি, হাঁটতে শিখি। আমি এখন বড় হয়ে গেছি অবশেষে। বড় হতে হতে সব পেছনে ফেলে অন্য কোথাও চলে এসেছি। যেখানে থাকার, সেখানে নেই। যেখানে যাবার, সেখানে যাইনি। আমি যেখানে তার ঠিকানাও জানি না। অথচ এখনো ভুলি না এফ নাইন বাই এইট, জি ওয়ান বাই সিক্স, এইচ ফোর বাই টুয়েলভ। যে ঠিকানা ভোলার তা রয়ে গেছে, যে ঠিকানা দরকার সেই ঠিকানা মনে নেই। বাজি পোড়ার শব্দ এখনো কানে বাজে। উৎসবের বাজি, উড়ে যাওয়া আতশ বাজি, হাতে ধরা নিঃশব্দ আলোকোজ্জল তারাবাজি, যাকে আমার একেকটা নীহারিকা মনে হতো। আমি সেই নীহারিকা বাজি, সেই ছায়াপথ আজো ভুলতে পারি না। স্মৃতির সমীকরণগুলো কখনো মেলানো যায় না।