আমার প্রিয় জায়গা পড়ার টেবিলটা। শুনে মনে হতে পারে আমি খুব পড়ুয়া লোক, ভালো ছাত্র, জ্ঞানের সন্ধানে নিবেদিত প্রাণ। ঘটনা একদম বিপরীত। কিন্তু টেবিলটাতে বসতে আমার ভালো লাগে। পড়ন্ত দুপুরে টেবিলে বসলে পাশের জানালা দিয়ে সবুজ বাগান থেকে ভেসে আসে মাটির ঘ্রাণ, গাছের শাখাপ্রশাখার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশের টুকরো আলো, আর পুবালী বাতাস। এই টেবিলটা অনেক বড়। এক পাশে ক্যাসেট প্লেয়ার, তারপাশে ভাঁজ করা কিছু বইয়ের স্তুুপ, এলোমেলো খাতা, ডায়েরী, কলম, পেন্সিল। টেবিলের উপর বিছানো মসৃণ কাপড়ের কাভারটার উপর অসতর্ক কলমের আঁচড়। পেছনের বুকশেলফে থরে ধরে সাজানো বইগুলো হাতড়ে চোখ বন্ধ করে একটা প্রিয় বই নিয়ে বসি। দুই পাতা পড়ে জানালার বাইরে চোখ চলে যায়।
দুপুরবেলাটা পড়া হয় না আমার। ভাবতে ভাবতে কেটে যায় সময়। আবার লেখার খাতাটা খুলে, কলমের ঢাকনি তুলে যখন লিখতে শুরু করি তখন শব্দগুলো ফেরারী আসামীর মতো উধাও। "প্রত্যেক মানুষের...." শব্দ দুটো লেখার পর তিনদিন আর কোন শব্দ আসে নাই। কি লিখতে চেয়েছিলাম? ভুলে গেছি। এরকম হয় অনেক সময়। পুরোনো ডায়েরীতে এরকম অসমাপ্ত বাক্যের ছড়াছড়ি। দুটো ড্রয়ার আমার। একটা উন্মুক্ত, আরেকটা তালাবদ্ধ। উন্মুক্ত ড্রয়ারে থাকে কলম পেন্সিল রাবার নোটপ্যাড স্কেল আইডিকার্ড ইত্যাদি হাবিজাবি। আর তালাবদ্ধ ডায়েরীতে থাকে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু জিনিস। খুব মূল্যবান কিছু না। ব্যক্তিগত আলাপ লেখার ডায়েরীটা, পুরো কিছু দামী কয়েন, একটা খামে কিছু আপদকালীন সময়ের টাকা, যে ছবিগুলো হারাতে চাইনা সেই অ্যালবাম, আরো টুকিটাকি কিছু আপাত অপ্রয়োজনীয় বস্তু। তালাবদ্ধ ড্রয়ারের চাবিটা আবার জমা থাকে খোলা ড্রয়ারে। অর্থাৎ কেউ চাইলে তালাটা খুলে দেখতে পারে পাশের ড্রয়ার। কিন্তু আমি চাই না সরাসরি টেনে খুলে ফেলুক। এই হলো আমার প্রাইভেসী সংক্রান্ত সচেতন অবস্থা। আমার জীবনটাও তেমন। এখানে একটা অংশ প্রকাশ্য আরেকটা গোপন। কিন্তু কেউ চাইলে গোপন অংশটাও বের করে ফেলতে পারে, পাশের ড্রয়ার থেকে চাবিটা নিয়ে। তবু চাই, কিছু জিনিস জীবদ্দশায় না দেখুক। আমার টেবিলটা জুড়েই আমার পৃথিবী। এটা সৌরজগতের পৃথিবী না। এটা সেই পৃথিবী যা প্রত্যেক মানুষের বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে। আমার টেবিলটা সেই পৃথিবীর প্ল্যাটফর্ম। এখানে আমার প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে। এত সমৃদ্ধ পৃথিবী খুব কম মানুষেরই থাকে। তবু মাঝে মাঝে কেন শূন্যতার হাহাকার বাজে বুঝি না। আজ সকালেও হঠাৎ করে বেজে উঠলো একটা বিষন্নতার গান। কাল রাতে দেখা দুঃস্বপ্নের একটা বিপরীত অনুভুতি জেগে ওঠার পর যে আনন্দ দিয়েছিল, সেটা ভেজা বৃষ্টিতে মিইয়ে গিয়ে একটা অন্ধকার আশংকা আবারো কেমন একটা ঠেলে দেয়া কষ্টের মতো বাজলো। তারপর আমি চোখ মেলে সমৃদ্ধ টেবিলে সাজানো উপকরণের দিকে তাকালাম। সেখানে অন্য সবই আছে। আর কিছুই হারায়নি। মানুষ একটা অদ্ভুত প্রাণী। আমি ওই টেবিলে তাকিয়ে খুব সামান্য একটা জিনিসের অভাবকে বড় করে ভাবছিলাম, অথচ ওখানে থাকা জিনিসগুলো তার চেয়েও মূল্যবান। তার একটিও আমি হারাতে চাই না। তবু ছোট্ট একটা ভুলের কারণে ঘটনাটা ঘটলো।
রাতে কারেন্ট চলে যাবার পর অভ্যস্ত হাতে মোমবাতি আর লাইটার নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম একটা ক্যাসেটের প্লাষ্টিক কাভারের উপর। উঠে খাবার ঘরে খেয়ে আসতে আসতে মোমটা জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে কখন যেন গোড়ার ক্যাসেটে আগুন দিল, প্লাস্টিক পোড়া গন্ধে ছুটে এসে দেখি টেবিলটা অল্পের জন্য রক্ষা, ক্যাসেটটি নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আগুন নিভলে কুড়িয়ে ভেতর থেকে ক্যাসেট বের করে দেখি একপাশের স্পুলের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। ফিতাগুলো খুলে নিয়ে যে অংশটা বেঁচেছে সেটা আরেকটা ক্যাসেটের খোপে ঢুকিয়ে নবজন্ম দিলাম। এই ক্যাসেটটা আমার খুব প্রিয়, এখানে খুব প্রিয় একটা গান আছে, সেটাকে রক্ষা করতেই এত কায়দা। পরদিন নবজন্ম দেয়া ক্যাসেটটা নিয়ে বাজাতে গিয়ে দেখলাম, একদিকের প্রথম গান এবং অন্যপিঠের শেষ গানটা নেই, কাটা অংশে চলে গেছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খারাপ ছিল বেশ কিছুদিন, কেননা ওই গানটি দোকানে খোঁজ করে পাই না আর। ক্যাসেটটি এসেছিল কোলকাতা থেকে, এখানে আর পাওয়া যাবে না। সেই তখন থেকে গানটার জন্য মন কেমন করতো।
অনেক বছর পর ইন্টারনেটের কল্যানে ভুলে যাওয়া গানটি আবারো পাওয়া গেল। এই গানটার জন্য কতোবার উদাস হয়েছি গানটা কি কখনো জানবে? গানটা নিজেও ভুলে গেছে একদিন সে বেজেছিল আমার কানের কাছে।
সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।
যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা।।
সুখ-আশে দিশে দিশে বেড়ায় কাতরে–
মরীচিকা ধরিতে চায় এ মরুপ্রান্তরে।।
ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে–
কাঁদে তখন আকুল-মন, কাঁপে তরাসে।।
কী হবে গতি, বিশ্বপতি, শান্তি কোথা আছে–
তোমারে দাও, আশা পূরাও, তুমি এসো কাছে।।
https://www.youtube.com/watch?v=LmCZk74wCco
দুপুরবেলাটা পড়া হয় না আমার। ভাবতে ভাবতে কেটে যায় সময়। আবার লেখার খাতাটা খুলে, কলমের ঢাকনি তুলে যখন লিখতে শুরু করি তখন শব্দগুলো ফেরারী আসামীর মতো উধাও। "প্রত্যেক মানুষের...." শব্দ দুটো লেখার পর তিনদিন আর কোন শব্দ আসে নাই। কি লিখতে চেয়েছিলাম? ভুলে গেছি। এরকম হয় অনেক সময়। পুরোনো ডায়েরীতে এরকম অসমাপ্ত বাক্যের ছড়াছড়ি। দুটো ড্রয়ার আমার। একটা উন্মুক্ত, আরেকটা তালাবদ্ধ। উন্মুক্ত ড্রয়ারে থাকে কলম পেন্সিল রাবার নোটপ্যাড স্কেল আইডিকার্ড ইত্যাদি হাবিজাবি। আর তালাবদ্ধ ডায়েরীতে থাকে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু জিনিস। খুব মূল্যবান কিছু না। ব্যক্তিগত আলাপ লেখার ডায়েরীটা, পুরো কিছু দামী কয়েন, একটা খামে কিছু আপদকালীন সময়ের টাকা, যে ছবিগুলো হারাতে চাইনা সেই অ্যালবাম, আরো টুকিটাকি কিছু আপাত অপ্রয়োজনীয় বস্তু। তালাবদ্ধ ড্রয়ারের চাবিটা আবার জমা থাকে খোলা ড্রয়ারে। অর্থাৎ কেউ চাইলে তালাটা খুলে দেখতে পারে পাশের ড্রয়ার। কিন্তু আমি চাই না সরাসরি টেনে খুলে ফেলুক। এই হলো আমার প্রাইভেসী সংক্রান্ত সচেতন অবস্থা। আমার জীবনটাও তেমন। এখানে একটা অংশ প্রকাশ্য আরেকটা গোপন। কিন্তু কেউ চাইলে গোপন অংশটাও বের করে ফেলতে পারে, পাশের ড্রয়ার থেকে চাবিটা নিয়ে। তবু চাই, কিছু জিনিস জীবদ্দশায় না দেখুক। আমার টেবিলটা জুড়েই আমার পৃথিবী। এটা সৌরজগতের পৃথিবী না। এটা সেই পৃথিবী যা প্রত্যেক মানুষের বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে। আমার টেবিলটা সেই পৃথিবীর প্ল্যাটফর্ম। এখানে আমার প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে। এত সমৃদ্ধ পৃথিবী খুব কম মানুষেরই থাকে। তবু মাঝে মাঝে কেন শূন্যতার হাহাকার বাজে বুঝি না। আজ সকালেও হঠাৎ করে বেজে উঠলো একটা বিষন্নতার গান। কাল রাতে দেখা দুঃস্বপ্নের একটা বিপরীত অনুভুতি জেগে ওঠার পর যে আনন্দ দিয়েছিল, সেটা ভেজা বৃষ্টিতে মিইয়ে গিয়ে একটা অন্ধকার আশংকা আবারো কেমন একটা ঠেলে দেয়া কষ্টের মতো বাজলো। তারপর আমি চোখ মেলে সমৃদ্ধ টেবিলে সাজানো উপকরণের দিকে তাকালাম। সেখানে অন্য সবই আছে। আর কিছুই হারায়নি। মানুষ একটা অদ্ভুত প্রাণী। আমি ওই টেবিলে তাকিয়ে খুব সামান্য একটা জিনিসের অভাবকে বড় করে ভাবছিলাম, অথচ ওখানে থাকা জিনিসগুলো তার চেয়েও মূল্যবান। তার একটিও আমি হারাতে চাই না। তবু ছোট্ট একটা ভুলের কারণে ঘটনাটা ঘটলো।
রাতে কারেন্ট চলে যাবার পর অভ্যস্ত হাতে মোমবাতি আর লাইটার নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম একটা ক্যাসেটের প্লাষ্টিক কাভারের উপর। উঠে খাবার ঘরে খেয়ে আসতে আসতে মোমটা জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে কখন যেন গোড়ার ক্যাসেটে আগুন দিল, প্লাস্টিক পোড়া গন্ধে ছুটে এসে দেখি টেবিলটা অল্পের জন্য রক্ষা, ক্যাসেটটি নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আগুন নিভলে কুড়িয়ে ভেতর থেকে ক্যাসেট বের করে দেখি একপাশের স্পুলের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। ফিতাগুলো খুলে নিয়ে যে অংশটা বেঁচেছে সেটা আরেকটা ক্যাসেটের খোপে ঢুকিয়ে নবজন্ম দিলাম। এই ক্যাসেটটা আমার খুব প্রিয়, এখানে খুব প্রিয় একটা গান আছে, সেটাকে রক্ষা করতেই এত কায়দা। পরদিন নবজন্ম দেয়া ক্যাসেটটা নিয়ে বাজাতে গিয়ে দেখলাম, একদিকের প্রথম গান এবং অন্যপিঠের শেষ গানটা নেই, কাটা অংশে চলে গেছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খারাপ ছিল বেশ কিছুদিন, কেননা ওই গানটি দোকানে খোঁজ করে পাই না আর। ক্যাসেটটি এসেছিল কোলকাতা থেকে, এখানে আর পাওয়া যাবে না। সেই তখন থেকে গানটার জন্য মন কেমন করতো।
অনেক বছর পর ইন্টারনেটের কল্যানে ভুলে যাওয়া গানটি আবারো পাওয়া গেল। এই গানটার জন্য কতোবার উদাস হয়েছি গানটা কি কখনো জানবে? গানটা নিজেও ভুলে গেছে একদিন সে বেজেছিল আমার কানের কাছে।
সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।
যা-কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা।।
সুখ-আশে দিশে দিশে বেড়ায় কাতরে–
মরীচিকা ধরিতে চায় এ মরুপ্রান্তরে।।
ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে–
কাঁদে তখন আকুল-মন, কাঁপে তরাসে।।
কী হবে গতি, বিশ্বপতি, শান্তি কোথা আছে–
তোমারে দাও, আশা পূরাও, তুমি এসো কাছে।।
https://www.youtube.com/watch?v=LmCZk74wCco
No comments:
Post a Comment