Monday, February 8, 2016

মনুষ্যত্ব এবং অমনুষ্যত্ব

জীবিকার জন্য খুবই ক্ষুদ্রতম সময় ব্যয় করছি বেশ কিছুকাল যাবত। কয়েক বছর আগেও যা ছিল অকল্পনীয়। দিবসের এক পঞ্চমাংশ মাত্র ব্যয় করে যদি টিকে থাকা যায়, তাহলে বাকী সময়টা পছন্দের জগতে ব্যয় করা যেতে পারে। এক বছর আগেও ১২-১৪ ঘন্টার মতো ব্যয় করতে হতো জীবিকার জন্য। ওই পথে চলমান থাকলে আর্থিক উন্নতি হয়তো হতো, কিন্তু আত্মাটা শুকিয়ে মরতো। আমি যে জগত থেকে দুই দশক বঞ্চিত ছিলাম সেটা পুষিয়ে নেবার জন্য আর্থিক উন্নতির প্রয়োজনটাকে সংকুচিত করতে হয়েছে। মোটামুটি চলনসই জীবন হলেই চলে আমার। গাড়িবাড়ি দরকার নেই।

মানব জীবনের দুটো সত্ত্বা আছে। একটা হলো তার প্রাণী সত্ত্বা, অন্যটি হলে তার মনুষ্যত্ব। এই মনুষ্যত্বটাই অন্য প্রাণীদের চেয়ে আমাদের আলাদা করে পরিচয় করায়। সেই সত্ত্বাটির সন্ধান করার কথা আমরা প্রায়ই ভুলে থাকি। জীবিকাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ভেবে সারা জীবন কাটিয়ে দেই। যেদিন প্রথম মোতাহার হোসেন চৌধুরীর রচনাসমগ্র হাতে আসলো, সেদিন মনুষ্যত্ব পর্বটি পড়ে আমাকে নিজের ভাবনার সাথে মেলাতে হলো তাঁর দর্শনটিকে। তাঁর সাথে ভাবনার মিল পেয়ে ভীষণ ভালো লেগেছিল। গতানুগতিক জীবিকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে ওই ভাবনাটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

তিনি বলেছেন এভাবে-
মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীবসত্তা সেই ঘরের নিচের তলা আর মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানবসত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য জীবসত্তার ঘরেও সে কাজ করে; ক্ষুৎপিপাসার ব্যাপারটি মানবিক করে কথায়, তার অন্যতম কাজ। কিন্তু তার আসল কাজ হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্বলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
এই অংশটি আমার খুবই পছন্দের।

তাঁর বইটি প্রায় পুরোটাই কোট করার মতো। তবু প্রিয় বাক্যগুলোই লিখবো শুধু। তিনি একজায়গায় লোভের বিষয়ে বলেছেন - লোভের ফলে যে মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে- অনুভুতির জগতে সে ফতুর হয়ে পড়ে.......ছোট জিনিসের মোহে বড় জিনিস হারাতে যে দুঃখবোধ করে না, সে আর যাই হোক, শিক্ষিত নয়।

আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন - আত্মার জগতের সন্ধান পাওয়া যায় সাহিত্যে, শিল্পে। তাই শিল্প-সাহিত্যের সহায়তায়ই মানুষের মনের উন্নয়ন করা সম্ভব হয়

সুতরাং আত্মিক উন্নতির জন্য কিছুটা আর্থিক ছাড় দিতে আমার আর দ্বিধা রইলো না। মাত্র এক বছর কেটেছে নতুন জগতে। এর মধ্যে অবশ্য আত্মিক উন্নতি বিশেষ হয়নি কিছু বইপত্র পড়া ছাড়া। দীর্ঘকাল ধরে স্বার্থের জগতে বসবাস করে আত্মিক চেতনার উপর মরচে ধরে গিয়েছে। আরো কিছুকাল সময় লাগবে সেই মরচে সরিয়ে শুদ্ধ হয়ে উঠতে।

সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এসব নিয়ে গঠিত নাগরিক পরিমণ্ডলে আমার যাতায়াত নেই। যেখানে লোকের ভিড় আমি সেটা এড়িয়ে থাকি। আমি খুব আড্ডবাজ মানুষ। কিন্তু বইপত্রের দোকানে গিয়ে কারো সাথে দেখা হলে আমার সব ভেস্তে যায়। আড্ডাও হয় না, বইও কেনা যায় না। আমি বইয়ের দোকানে গেলে তাই সতর্কতার সাথে পরিচিত মুখ এড়িয়ে থাকি। সেই কারণে অতি সামাজিক মানুষদের সাথে আমার ঠিক বনিবনা হয় না। আমার আলাপ আড্ডা সবকিছু নিঃসঙ্গ মানুষদের সাথে। বিশেষত বইপত্র জগতে। অন্যদের মতো দশজনের সাথে জ্ঞানী আলাপ করার মতো সাহস হয় না আমার। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও একটা কারণ হয়তো। মানুষ সামাজিক প্রাণী হলেও আমি এক্ষেত্রে একটু অসামাজিক, হয়তো কিছুটা অমানুষও। সেই কারণে আমার আরো বেশী জ্ঞানের আলো দরকার। এখন আমি সেই আলোর সন্ধানে সকাল সন্ধ্যা ব্যয় করি।



No comments: