Monday, April 27, 2015

চেনা ঢাকার অচেনা রাস্তায়: দীর্ঘশ্বাসের অক্ষরসমূহ

১.
অনেকদিন পর ঢাকা গিয়ে এতটা সময় কাটালাম। বহুবছর পর। চাকরীজীবনের গত বিশ বছরে তো নয়ই। গত বিশ বছরের ঢাকা যাওয়াটা ছিল জেলখানা থেকে পেরোলে মুক্তি পাওয়া আসামীদের মতো। বছরে ছমাসে একবার গেলেও অধিকাংশ সময়ে এয়ারপোর্ট/বাসস্টপ থেকে কর্মক্ষেত্র সেখান থেকে হোটেল কিংবা চট্টগ্রাম। এর বাইরে দুয়েকবার বইমেলা, দুয়েকজন বন্ধুর সাথে আসা যাওয়ার পথে দেখা করেছি। কিন্তু কোথাও গিয়ে পা ছড়িয়ে আলসে ঝরিয়ে কোথাও আড্ডা মারা হয়নি। ফলে ঢাকার পরিচিত অনেক দৃশ্য, অনেক রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, ইমারত বদলে গেছে আমার অজান্তেই। কতটা বদলাতে পারে একটা শহর এবার ঢাকা গিয়েই বুঝতে পারলাম। চেনাপথগুলো খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়ে গেল। অনভ্যাসে একা কোথাও যেতে পারি না। কথা ছিল সময় নিয়ে ঢাকা গেলে পুরোনো মুখগুলোকে বের করে ইচ্ছে মতো আড্ডা দেবো। অনেক দিন না দেখা বন্ধু স্বজনদের বাসায় যাবো। কিন্তু হলো না। চারদিন নিজের রুটিনে নিজেই আটকে ছিলাম। যে কাজে গিয়েছি সেই কাজে এমন একটা ঝামেলা লাগলো মুডই নষ্ট হয়ে গেল। আর ঠিক সেরকম মুড না হলে আমি কারো সাথে কথা বলে আড্ডা দিয়ে যুত পাই না। আমার একটা বড় ধরণের সীমাবদ্ধতা এটা। ওই চার দিনে মুষ্টিমেয় খুব ঘনিষ্ট অফলাইন বা অনলাইন দুয়েকজন বন্ধু ছাড়া কারো সাথেই যোগাযোগ ছিল না। ঢাকার পরিচিত কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করে নি। কারো বাসায় যেতে ইচ্ছে করেনি। নিজের কাজের ঝামেলা ছাড়াও একটা অনাকাংখিত দুর্ঘটনায়ও মনটা বেজার হয়ে পড়েছিল। পুরোনো একটা ভুলের বড় খেসারত দিলাম। তবুও বলবো অনেক ভালো আছি এখনো। নেপালে যা ঘটেছে সেরকম কিছু এদেশে ঘটলে আমাদের কী অবস্থা হবে কেউ জানে না। এখনো বাকী আছে অনেক দুঃসময়ের। এখনো দেখিনি চুড়ান্ত পতন। প্রকৃতি আমাদের জন্য আরো শাস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে? গরীব দেশের উপর যেন প্রকৃতির আক্রোশ একটু বেশীই।

২.
তবু দুটো জায়গা ঘুরতে পেরেছি বন্ধুর কল্যাণে। ৩২ নাম্বার গেলাম এক সন্ধ্যায়, লেকের মধ্যে চমৎকার একটা রেস্তোরার খোলা চত্বরে বসে আড্ডা দিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় কাজের মধ্যে দু ঘন্টার ব্রেক নিয়ে গেলাম টিএসসি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় চেনা জায়গাও অচেনা লাগছিল। উদ্যানে ঢুকলাম ছবির হাট দিয়ে। এই জায়গাটা আগে কখনোই এরকম ছিল না। শিখা অনির্বান দেখলাম, স্বাধীনতার স্তম্ভ দেখলাম। মুগ্ধ হলাম উন্নয়ন সৌন্দর্যে। প্রকৃতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে। কিন্তু সভ্যতার খাতিরে এটুকু ছাড় দেয়া যা। স্বাধীনতার আলোক স্তম্ভটাকে অন্ধকারে এক শুদ্ধ বাতিঘরের মতো দণ্ডায়মান দেখে বেশ লাগলো। এই সৌন্দর্য খালি চোখেই বোঝা সম্ভব। একটু অবাক হলাম এরকম একটা সুন্দর প্রতীকের ছবি আগে দেখিনি। ফেসবুকে লোকজন এত জিনিসের ছবি তুল আপ করে, কিন্তু এটা কেন দেখিনি। আমি কয়েকটা ক্লিক করলাম মোবাইল ক্যামেরায়। ক্যামেরা মোবাইলে যেটুকু ধরা যায়, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। ফেরার পথে পার্কে কিছু অপ্রিয় দৃশ্য দেখতে হলো। অবিশ্বাস্য। এত সৃংখলার সাথে, নীরব অন্ধকারে ধোঁয়ার গন্ধ ছড়াচ্ছে দলবদ্ধ নেশাখোরের দল। হ্যাঁ এত সুন্দর একটা পার্কের একাংশ দখল করে রেখেছে শিক্ষিত গঞ্জিকাসেবিদের দল। তাদের অনেকে দেশের সংস্কৃতি জগতের অংশীদারও বটে। শিল্পের জন্য ছাড় দিতে গিয়ে সরকারও বোধকরি ওই জায়গাটাকে আলো থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। পার্কের অধিকাংশ জায়গা অন্ধকার, ওই জায়গাটা যেন একটু বেশীই। প্রদীপের নীচের অন্ধকারকে মেনে নেয়াই মনে হয় নিয়ম।

৩.
দুঃসময় আমাদের হাতের নাগালেই, অথচ সুসময় কত দ্রুত সরে যায় নাগালের বাইরে!
ভুল বোঝা সবচেয়ে সহজ, আপনজনকে ভুল বোঝা তো রীতিমত জরুরী। নইলে আক্ষেপে আশ্লেষে মরার সুযোগ হবে কী করে। সুসময়ের জন্য জমিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাস, নিষ্ঠুরতম আঘাতের স্মৃতিতেও এন্টিবায়োটিক মলম লাগিয়ে যায়। এটা শান্ত্বনা নয়, স্বস্তি।


No comments: