Saturday, April 18, 2015

জীবন অগাধ নয়, অসীমও নয়

১. প্রযুক্তি ও মানুষ
প্রযুক্তি সভ্যতার একটি ক্ষতিকর দিক মানবিকতার অবনতি। মানুষ প্রযুক্তির উপর এত বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে  মানুষের চেয়ে প্রযুক্তিকে বেশী বিশ্বাস করে। করবে না কেন? আমাকে যদি বলা হয় মুখে মুখে ৪৩৮৮৯৮x৫৬৭৮৯ এর গুনফল বলতে, আমি সারাদিন মাথা ঘামিয়েও সঠিক উত্তর দিতে পারবো না। কিন্তু একটা ক্যালকুলেটরকে বলা হলে সে এক সেকেণ্ডের কম সময়ে উত্তরটা হাজির করে দেবে। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বিলাতে একটা চিঠি যেতে কমপক্ষে দশ দিন সময় লাগবে। অথচ  ইন্টারনেটে বসে আমরা এক মিনিটের কম সময়ে চিঠি পৌঁছে দিতে পারি বিলাতে। কী চমৎকার ব্যাপার না? নিঃসন্দেহে। যোগাযোগ মাধ্যমে এটা একটা বিপ্লব। পৃথিবীকে অনেক ছোট করে দিয়েছে, মানুষকে অনেক কাছে এনে দিয়েছে। মানুষ এখন তথ্যের জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করে না। কিছু জানতে হলে চট করে গুগল সার্চ দিয়ে বের করে নেয়। বন্ধুর কাছ থেকে জবাব পাওয়া যায় এক সেকেণ্ডেও(যদি চ্যাট জাতীয় কিছু হয়)। তবে মুশকিলও আছে একটা। কোন টেকি কারণে সেই বার্তাটা যদি দেরীতে পৌঁছায়, অন্যপক্ষ ধরে নেয় এখানে তাকে ফাঁকি দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই সে চিঠি দেয়নি। যে তথ্য চাওয়া হয়েছে সেটা দিতে বিলম্ব করেছে, অবহেলা করেছে, এড়িয়ে গেছে। দুই পক্ষের মধ্যে লেগে যায় ধুন্ধুমার যুদ্ধ। সম্পর্ক অবনতি, কখনো কখনো কাটাকাটি। এই ব্যাপারটার জন্য দায়ী প্রযুক্তির উপর নিরংকুশ বিশ্বাস। পরে পত্রদাতা এসে যতই বোঝাক যে আমি ঠিক সময়ে দিয়েছি, তুমি পেতে দেরী করেছো কেন প্রযুক্তি সমস্যার কারণে। পত্রগ্রাহক সেটা কিছুতেই মেনে নেয় না। তার বিশ্বাস প্রযুক্তির উপর অটুট। বন্ধুকে সে বিশ্বাস করতে পারে না। সে যতই জানের দোস্ত হোক। মানবিকতার এই অবনতি মেনে নেয়া কঠিন হলেও মানুষ এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এমনকি যাদের মধ্যে একদা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে পরে ঠিক হয়ে গেছে, তাদের মনের গভীরেও একটা সুক্ষ্ণ অবিশ্বাস জেগে থাকে সবসময়। প্রযুক্তি সম্পর্কে যেমন গভীর করেছে, তেমনি করেছে ঠুনকো। নৈকট্যের মতো দূরত্ব রচনাতেও প্রযুক্তির তুলনা হয় না।

২. কুজন্মা/অজন্মা জারজ
কিছু বেজন্মা জারজের বাচ্চা পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা করেছে তা জানতে দুদিন লেগে গেছে নেট থেকে একটু দূরে থাকার কারণে। ফেসবুক ব্লগে না থাকলে আজকাল দেশের অনেক খবর পাই না। আমি এতদিন ভাবতাম ২০০০ সালের বাঁধনের ঘটনাটার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরকম ঘটনা আর কোনদিন কেউ ঘটাবার সাহস পাবে না। আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে এবছর আবারো ঘটলো আরো জঘন্যতম ঘটনা, এবং তাও ঘটেছে হাজারো লোকের মধ্যে প্রকাশ্যে, প্রায় দিনের আলোতেই। রাগে দুঃখে অক্ষম দাঁত কিড়মিড় করা ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনে হয় দেশের আইনে কিছু মানুষ খুন করার বৈধতা থাকা উচিত। তাহলে সেই বেজন্মা জারজদের অন্তত একজনকে খুন করে শান্ত্বনা দিতাম নিজেকে।

৩. উচ্চ ও তুচ্ছ
খুব ছোট ছোট কাজ নিয়ে দিন কাটে আজকাল। এতই ছোট যে বলার মতো না। বইপত্রের কাজ কারবার কোন কালেই বড় ছিল না। বড় বড় কাজে টাকাপয়সা বেশী হলেও ছোট কাজে একদম ফাঁকা। অথচ যে কাজে অর্থ নেই সেই কাজে আমার আগ্রহ বেশী। তাই আমার আর্থিক উন্নতি হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। এটা জানলে আমার বন্ধু সংখ্যা অনেক কমে যাবে। তবে বন্ধুসংখ্যা কম থাকলেও বইয়ের সংখ্যা বাড়ানো যাবে। অপড়ুয়া বন্ধুর সংখ্যা কম থাকাই ভালো আমার জন্য। অপড়ুয়া বন্ধুর সাথে আড্ডা মেরেও সুখ পাই না আজকাল। কপালগুনে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি পড়ুয়া। নইলে জীবনটা দুর্বিসহ হতো।  উচ্চ লোকরে বর্জন করিয়া তুচ্ছ হইয়া কাটাইব জীবন।

৪. স্বেচ্ছামৃত্যু
জীবন কী? একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ মাত্র? কতগুলো বছর মাস দিনের সমষ্টি? শৈশব কৈশোর যৌবন বার্ধক্যের যোগফল শেষে সবচেয়ে গুরুতর প্রয়োজনীয় মানুষটিও একদিন পরিণত হয় অকার্যকর হাড় মাংস সর্বস্ব একটি পরিচিত জীবে। মানুষের এই পরিণতিটা খুব মর্মান্তিক লাগে। আমি বৃদ্ধ হবার আগেই জীবনের মেয়াদ শেষ করতে চাই। এই চাওয়া পূরণ হবে কিনা তা বলার উপায় নেই। মানুষ জীবনে আরামপ্রিয় হলে মরণেও আরাম চায়। আমার কাছে সবচেয়ে আরামের মৃত্যু মনে হয় ঘুমন্ত অথবা অজ্ঞান অবস্থায় মৃত্যু। যেন কিছুই টের পেলাম না নিঃশব্দে চলে গেলাম। এরকম কোন প্রস্তুতির সুযোগ নেই পৃথিবীতে। শুধু ইচ্ছেটাই সার। তবে ইচ্ছেটা বলতে দোষ নেই। ধরা যাক আমি একজন ডাক্তারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলাম। আমার সকল প্রস্তুতি শেষ করে, সবার সাথে লেনদেন শেষ করে একটা তারিখ ঠিক করবো। ডাক্তার সেই তারিখে আমার ঘরে আসবে। চুক্তিমতন ডাক্তার আমার কাছ থেকে আগাম টাকা বুঝে নিয়ে আমাকে ইনজেকশান দিয়ে চেতনাহীন করে ফেলবে। চেতনা হারাবার পর আরেকটি বিষযুক্ত অ্যামপুল নিয়ে আমার বাহুতে পুশ করে দেবে। যেন এক মিনিটের মধ্যে আমার প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়। ডাক্তার কাজ শেষ করে চলে যাবে। তারপর চুক্তি অনুসারে নির্দিষ্ট একটা নাম্বারে ফোন করে জানাবে আমার মৃত্যু ঘটেছে। ব্যাপারটা যত সহজে বলছি তত সহজে হবে না। কেননা সেই ডাক্তার খুনের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলতে পারেন। কেউ বিশ্বাস করবে না কোন মানুষ নিজের ইচ্ছেয় এভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে। এই পৃথিবীটা এমন নিষ্ঠুর একটা জায়গা এখানে প্রবল ভালোবাসাকেও অবিশ্বাস করে দূরে ঠেলে দেয়া যায়। তাই ডাক্তারকে আগে ভাগে আমার কাছ থেকে লিখিত কিছু ডকুমেন্ট নিতে হবে যাতে বলা থাকবে আমি স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছি। তবু হয়তো সেই ডাক্তার নিরাপদ হবেন না। ভাড়াটে খুনীর সাহায্য নিলে ব্যাপারটা সহজ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে খুনীরাও মাঝে মাঝে মানবিক হয়ে ওঠে, সেটা আরেকটা বিপদ। পৃথিবীতে  বিনা কারণে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়, কত যুদ্ধ, কত দুর্ঘটনায় হাজার মানুষ মরে যায়, কিন্তু একজন স্বেচ্ছায় মরতে চাইলে তার জন্য বাধা হয়ে দাড়াবে তথাকথিত সভ্য আইন। কী অদ্ভুত এই সভ্যতা। আনন্দের সাথে, সফলতা নিয়ে, নিজের সময়মত মরার কোন উপায় নেই। অথচ অপাঘাতে মৃত্যুতে সভ্যতার কোন বিধিনিষেধ নেই।

No comments: