Wednesday, April 30, 2014
এপ্রিল ৩০, ২০১৪ অসংলগ্ন
Tuesday, April 29, 2014
জীবনের বিকেল অথবা সন্ধ্যা
আজকাল বলি জীবনের দুপুর শেষ হয়ে বিকেলও গড়ানোর পথে। আগের কাজ, নতুন আসা বাকী কাজ সবগুলোই কি শেষমেষ অসমাপ্ত থেকে যাবে? কাজ না হয় অসমাপ্ত থাকলো। বইগুলোও কি না পড়া থেকে যাবে? ছাত্রজীবনে মাসে একটা বই কিনতে পারলেও ধন্য হয়ে যেতাম। তখন একটা বই পড়ে হা করে থাকতাম কখন আরেকটা বই কিনতে পারবো। একবার সস্তায় জলের দরে প্রায় বিশ পঁচিশখানা বই কিনে ফেলেছিলাম। সেদিন আমার ঈদ। পরবর্তী এক মাস কোন বই ভাবনা ছিল না। গোগ্রাসে গিলে গেছি সব।
জীবনের সন্ধ্যাবেলা কারো কারো দীর্ঘ হয়, কারো কারো খুবই অল্প। আমি জানি না আমার কতটা সময় হাতে থাকবে। কিন্তু ওই সময়টা খুব বেদনাদায়ক। শ্যামল বন্দোপাধ্যায়ের ডুমুর গাছের গল্পটার কথা ভেবে শিউরে উঠি যেখানে একজন দীর্ঘ পয়ত্রিশ বছর ধরে জীবনের সন্ধ্যাবেলায় ধুঁকেছিল। ওই মানুষকে নিজের কন্যা আর জামাই মিলে একটা ট্রেনে তুলে নিরুদ্দেশ যাত্রায় পাঠিয়ে পত্রিকায় একটা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি আর একটা পুলিশে একটা ডায়েরী লিখে নিজেদের বোঝা হালকা করেছিল।
Monday, April 28, 2014
কৃতঘ্নের একদিন
কমলাপুর পৌঁঁছে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে আমার প্রাক্তন ঘুমাবার জায়গাগুলো দেখতে দেখতে ভাবছি। ওরা এতক্ষণে প্যাকেট খুলে চিঠি পড়তে শুরু করেছে-
আপা, আমি লতু। আপনি আমাকে অন্ততঃ নামে চিনবেন। বহুবছর আগে আমি আপনাদের বাড়িতে কাজ করতাম। পালাবার সময় আমি অনেক জিনিসের সাথে একটা ছবিও চুরি করি সোনার ফ্রেমের লোভে। আমি জানি চাচা আমাকে কোনদিন ক্ষমা করেননি, আপনিও করবেন না। আমি জীবনে অনেক অপরাধ করেছি, আপনাদের কাছ থেকে চুরি করা অনেক জিনিস বিক্রি করেছি, কিন্তু আপনার ভাইয়ের ছবিটা কিছুতেই বিক্রি করতে পারিনি। আমার আর কোন অপরাধ আমাকে এতটা পোড়ায়নি যতটা পুড়িয়েছে এই ছবিটা। আমি আপনার বাবাকে সারা জীবনের জন্য বঞ্চিত করেছি এই ছবি থেকে। আপনার বাবা হয়তো বেঁচে নেই। তবু আমার ইচ্ছে এই ছেলের ছবিটা অন্ততঃ তার বোনের কাছে থাকুক।
Wednesday, April 23, 2014
ভয়কেতু
আমি নিজেই কাজটা নিয়েছি। আমার প্রাণটা কৈ মাছের প্রাণের চেয়ে শক্ত এবং টাকার অংকটা বেশ মোটা বলেই সিদ্ধান্ত নেয়া।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চমকে উঠলাম। ঘড়িতে এখনো সোয়া দশটা! মানে কী? রাতের খাবারের সময মুরগীর হাড় চিবোতে গিয়ে যখন আক্কেল দাঁতটা ক্যাচ করে উঠেছিল তখনো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম পৌনে দশ। এরপর কমপক্ষে দুঘন্টা বসে বসে 'সবজি' টেনেছি। তবু এখনো বাজে সোয়া দশ - ব্যাপারটা গোলমেলে তো! কাছে গিয়ে আবছা আলোতে কয়েক মিনিট ভালো করে তাকিয়ে থেকে বুঝলাম এই ঘড়ির ঘন্টার কাঁটাটা অচল হয়ে গেছে। মিনিটের কাঁটাটাই ঘুরে ঘুরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এখন তাহলে সময় বোঝার উপায় কি?
এই গ্রামে কোন বিদ্যুত নেই। ঘরের এক কোনে টিমটিম করে যে হারিক্যানটা জ্বলছে, সেটাও নিভে যাবার সময় হয়ে এসেছে। হারিক্যান নিভে গেলে টর্চলাইট ভরসা। কিন্তু ওই জীবটা টর্চলাইট দেখলে এমন তোলপাড় করে সেটা আরো ভয়ানক ব্যাপার, তাই টর্চ ছাড়া কাজ করতে হবে।
আমাকে বলা হয়েছিল ঠিক আড়াইটায় ওটা আসবে। প্রতিদিন আসে। দরোজার নীচ দিয়ে বুকে হেঁটে বসার ঘর পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। রান্নাঘরের যে হাড়িতে দুধ জ্বাল দেয়া থাকে সেই হাড়ির ঢাকনা খুলে নিঃশব্দে দুধগুলো খায়, তারপর কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে আবারো বসার ঘর পার হয়ে দরোজার তলা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
বাড়ি দেখাশোনার জন্য একের পর তিনজন পাহারাদার নিয়োগ দিয়েছে গত এক বছরে, কিন্তু সবাই মারা পড়েছে সেই অজানা জীবের হাতে। তারা পাহারা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল হয়তো। প্রতিবারই দেখা গেছে চোখ দুটো তুলে নিয়ে গেছে। কোন সাপের পক্ষে এটা সম্ভব না। এর পর আমাকে খুঁজে বের করার আগ পর্যন্ত আর কেউ পাহারার দায়িত্বটা নিতে রাজী হয়নি।
বাড়ির মালিক পালিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু প্রতিদিন তাকে আধাকেজি গরুর দুধ রেখে যেতে হয় রান্নাঘরের ডেকচিতে। তাকে স্বপ্নে বলে দেয়া হয়েছিল, যদি কোনদিন দুধ না রাখা হয় তাহলে তাকে দৈনিক একটা করে খেসারত দিতে হবে। হয় পোষা প্রাণী নয়তো সন্তান। মালিকের মতে, স্বপ্নের সেই বিকট চেহারার তুলনায় যমদূতকে নিরীহ শিশু বলা যায়।
প্রথমবার হুমকিটাকে উপেক্ষা করে দুধ রাখেনি মালিক। পরদিন তার সবচেয়ে সুন্দর ছাগলটাকে মাঠের পাশে মরে থাকতে দেখা গেল। ছাগলের চোখের জায়গায় কেবল দুটো গর্ত ছিল। এরপর দুধ রাখা নিয়ে আর কেউ কোন প্রশ্ন তোলেনি।
আমার তিনকুলে কেউ নেই। এতিমখানায় বড় হবার পর বখে গেলে একবার কে যেন ধরে আমাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে দিল। ওখানে গিয়ে অবশ্য লাভ হলো। ওরা আমাকে নানান জাতের ওষুধ দিয়ে টেস্ট করলো, ইনজেকশান দিল কয়েক রকম। ওখানে একটা ইনজেকশানে সবজি খাওয়ার আমেজ পেলাম। সেই ইনজেকশানের নাম টুকে রাখলাম। তারপর ভাণ করতে লাগলাম ভালো হয়ে গেছি। কদিন পর আমাকে চেকটেক করে ডাক্তার বললো সুস্থ হয়ে গেছি।
ছেড়ে দেয়া হলো আমাকে। আমি বেরিয়েই আবার নতুন নেশার জগতে ঢুকে গেলাম। এবার সবজির সাথে যোগ হলো ইনজেকশানও।
আমার তেমন কোন কাজ করতাম না। কিন্তু আয় খারাপ না। গঞ্জের জুয়ার আসরে লিডার ছিলাম। জুয়া খেলে আমি কোন কোনদিন দু চার হাজার টাকা কামিয়ে ফেলতাম। এই কামানো টাকা যে শুধু নিজে খাই তা না, মাঝে মাঝে আর্তমানবতার সেবায়ও লাগাতাম। বুঝতেই পারছেন আমি লোক হিসেবে একেবারে খারাপ না।
একবার এক বড় দুর্ঘটনার পর লেগে গেলাম উদ্ধার কাজে। একজন বললো, প্রচুর রক্ত লাগবে, চলো হাসপাতালে যাই। আমি হাসপাতালে যাই রক্ত দিতে। আমার রক্তের স্যাম্পল নিয়ে টেষ্ট করার পর আমাকে হাসপাতালের একজন ডাক্তার তার রুমে ডাকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বললেন, আপনার রক্ত লাগবে না। আপনি যেতে পারেন।
আমি অবাক। কেন, আমি রক্ত দিলে সমস্যা কী? ডাক্তার অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনার রক্তে যে পরিমান বিষ আছে তাতে আপনাকে যদি কোন কালসাপও কামড় দেয়, আপনার কিছু হবে না কিন্তু সেই সাপের মৃত্যু অনিবার্য। এই ঘটনা চাউর হবার পর চেনা লোকেরা আমাকে বিষধর সাপ ঠেঙাতে ডেকে পাঠাতো। সত্যি সত্যি কিন্তু সাপেরা আমাকে দেখা মাত্র পালাবার পথ খোঁজে।
কিন্তু এই কাজটা করতে এসে প্রথমে যতটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলাম রাত নামার পর থেকে সেটা কমতে কমতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি জায়গা করে নিচ্ছিল। আগে কখনো এমন হয়নি। এটা ঠিক ভয় বলবো না। ভয় ব্যাপারটা আমার ছিলই না। এটা একরকমের গা শিউরে ওঠার মতো একটা ব্যাপার।
সারাদিন এখানে বসে আছি। দুপুরে ভাত আর বিকেলে চা খেলাম। রাতেও ভাত খেলাম মুরগীর ঝোল মাংস দিয়ে। মালিক সব ব্যবস্থা করে গেছে। আমি কোথায় শোবো তাও দেখিয়ে দিয়েছে। হাতে লাঠি আছে, বড় একটা ছোরা আছে। টর্চ লাইট আছে। আর কি চাই। তবু চামড়ার নীচে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে সন্ধ্যার আলো নেভার পর পর। রোমকূপগুলো ক্ষণে ক্ষণে সোজা হচ্ছে, আবার বসে যাচ্ছে। এটা কি রোমাঞ্চ না ভয়?
মেঘের গর্জন আর বাতাসের আর্তনাদ মিলে মিশে পরিস্থিতির উপর আরেকদফা কালিমা লেপে দিল যখন হারিক্যানটা দপ করে নিভে গেল। কটা বাজে এখন? দেয়ালের ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে না। জীবটা ঢুকেছে কিনা, ঢুকে বেরিয়ে গেল কিনা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরে বসে আছি। টর্চ জ্বালানো কঠিনভাবে নিষেধ করা আছে। টর্চের আলো দেখলে নাকি জীবটা সোজা উড়ে আসে, ঘরের মালিক জানিয়েছিল। শিরশিরে অনুভুতিটা আবারো চেপে বসেছে। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে পা দুটো তুলে খাটের উপর বসলাম।
হঠাৎ দমকা বাতাসে রান্নাঘরের জানালাটা বোধহয় খুলে গেল। জানালার দুটো পাল্লা বাড়ি খাচ্ছে দেয়ালে। তখনি রান্নাঘরে কিছু একটা ঘটলো। ঝনঝন করে খালি ডেকচি কলসিসহ নানান তৈজসপত্র গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। বাতাসের তাণ্ডব আর মেঘের গর্জনের সাথে অনুনাদ ঘটিয়ে একটা নারকীয় সিম্ফোনি তৈরী হলো ঘরের ভেতর।
ওটা কি এসে গেছে? আমি ডানহাতে লাঠি আর বামহাতে ছুরিটা বাগিয়ে বসে থাকলাম শক্ত হয়ে। চোখ কান সতর্ক। রাত শেষ না হওয়া অবধি আর চোখ বন্ধ করা যাবে না।
আমি কখনো সাপের চোখ দেখিনি, কিন্তু নিশ্চিত যে এই জীবটা আর যাই হোক, সাপ না। সাপ হতেই পারে না। এটা সাপের মতো লম্বাটে, কিন্তু কাঁকড়ার মতো দুটো দাড় আছে। আমি নিশ্চিত এটা সরাসরি নরক থেকে আসা কোন প্রাণী। বজ্র বিদ্যুতের এক সেকেণ্ডের আলোটা নিভে গেলে আমি টের পেলাম প্রাণীটা লকলকে জিব বের করে আমার কপালে ভীষণ ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ দিল। এবং পরমুহুর্তেই অতিশীতল একটা দড়ি আমার গলার চারপাশে জড়িয়ে গেল। টানটান একটা বরফের লেজ আমার কন্ঠনালীকে চাপতে চাপতে চাপতে............
এর পরের আর কোন দৃশ্য আমার মনে নেই। শেষ দৃশ্যটা এত গভীর অন্ধকারে চিত্রায়িত হয়েছিল যখন একটা বিজলির চমকও ছিল না। ফলে আমি জীবনের শেষ দৃশ্য বলে কোন কিছুর স্মৃতি নিয়ে যেতে পারছি না মনে হচ্ছিল।
*****
আমাকে পরদিন অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ওই ঘরের ধ্বংসস্তুপ থেকে। আমি মৃত্যুমুখে জ্ঞান হারাবার পর কী ঘটেছিল জানি না। কিন্তু সেই রাতে ওই গ্রামে যে ভয়ংকর টর্নেডো বয়ে গিয়েছিল তাতেই ওই ঘরটির চাল সম্পূর্ণ উড়ে গিয়ে ঘরটি একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। আমাকে খুঁজে বের করা হয় অনেক কষ্টে।
ওই জীবটির কী হয়েছিল কেউ জানে না। কিন্তু সে এসেছিল এটা খুব সত্যি। পৃথিবীতে জীবিত মানুষদের মধ্যে একমাত্র আমিই তাকে দেখেছিলাম এবং এখনো এক যুগ পরও সেই দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার সকল নেশা ছুটে গিয়েছিল সেই ঘটনার পর। প্রচণ্ড বেপরোয়া এক মানুষ বদলে গিল ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ হয়ে গেল। আমি এখন যে কোন প্রাণীর চোখের দিকে তাকাতেই ভয় পাই। এমনকি সেটা টিকটিকি হলেও।
Monday, April 21, 2014
ফিরে যাবার গল্প
সে একদিন চলে যাবে জানতাম। আমাদের গন্তব্য বরাবরই আলাদা ছিল। আমি যে ট্রেনের টিকেট কেটেছিলাম, সেও একই ট্রেনের টিকেট নিয়েছিল, কিন্তু ভিন্ন স্টেশানে। আমরা আলাদা বগিতে উঠেছিলাম। বসার জন্য সিট খুঁজতে খুঁজতে এই বগি সেই বগি ঘুরতে ঘুরতে একটা বগিতে হাজির হলাম দুজন প্রায় একসাথে।
পাশাপাশি দুটো সিট খালি পড়ে ছিল সেটাও কাকতাল হলেও এত মানুষের ভিড়ে দুজনের যে এত গল্প জমে উঠেছিল সেটা কিন্তু কাকতাল নয় মোটেও।
ব্যাপারটা খুব সহজ। আমার কিছু কথা ছিল। তাহার শোনার সময় ছিল। এবং কাংখিত সুত্রের গল্পে মজে যাবার পর আমরা ট্রেন থেকে নামার কথা ভুলেই গেলাম। ফলাফল, দুজনই গন্তব্য ফেলে পার হয়ে গেলাম।
অনেকদূর যাবার পর, অনেক অনেক কথা শেষ হবার পর গল্পের মধ্যে একটা বিতর্কের সুত্রপাত হলো। বিতর্ক থেকে বাকযুদ্ধ, বাকযুদ্ধের পর বাকহীনতা, অতঃপর দুজনেরই সম্বিত ফিরে পাওয়া। অনেক দেরীতে বুঝলাম, আমাদের নির্ধারিত স্টেশন পার হয়ে গেছে! এখন উপায়?
কোন উপায় নেই। হঠাৎ জাগা টর্নেডো রাগের কোন পূর্বপশ্চিম থাকে না। 'তোমার সাথে এই বগিতে থাকার চেয়ে আমি অচেনা স্টেশানে নেমে যাবো'। এই ভাবনায়, পরবর্তী স্টেশান আসতেই সে নেমে গেল। একবারো পেছনে ফিরে তাকালো না।
আমি ভ্রু কুঁচকে কয়েক মিনিট ভাবলাম এবং পরবর্তী স্টেশানে নামার জন্য প্রস্তুত হলাম। দশ মিনিট পরেই পরের স্টেশান। আমিও নেমে গেলাম অনির্ধারিত স্টেশানে।
এবার আমি পেছনে ফিরে যাবার উপায় খুঁজতে থাকলাম। ট্রেন ছাড়ার সময় তাকিয়ে দেখি সেই বগির খালি সিট দুটোতে অন্য দুজন মানুষ বসে কথা বলতে শুরু করেছে। ভাবছি -কিছুক্ষণ পর ওরাও কি গন্তব্য ভুলে যাবে?
মনে হয় না। পৃথিবীতে খুব অল্প পরিমান গল্প আছে যাতে দুজন মানুষ একই সাথে নিজের গন্তব্য ভুলে যেতে পারে। আমরা ছিলাম সেই গল্পের দুটো আলাদা খণ্ড। এখন ফিরে যাচ্ছি দুজনেই। আলাদা স্টেশান থেকে, আলাদা গন্তব্যে। আমাদের এখন কেবল একটাই মিল, দুজনের হাতে দুটো মেয়াদোত্তীর্ণ টিকেট।
Sunday, April 20, 2014
একটি বেরসিক সন্ধ্যার গল্প
রাখী একটা বাটিতে মুড়ি তেল পিয়াজ মরিচ মাখিয়ে বসে আছে শাহ গোলাপের জন্য। শাহ গোলাপ আজ ডিউটি শেষ করে আসলে সিনেমায় যাবার কথা ছিল। একটা ড্যাশিং সিনেমা লাগাইছে আলমাসে। অগ্নিশর্মা নাম তার। নায়ক বুরুজ খান। নায়িকা হাসি ঝিলমিল। পোষ্টার দেখেই মাথা খারাপ হবার যোগাড়। আজ কোন ব্যবসা করার রুচি নাই। আজকে শুধু শাহ গোলাপ থাকবে বসে।
সুস্থ হবার পর শাহ গোলাপের প্রতি কৃতজ্ঞতা বশে তাকে একদিন ঘরে ডেকে শরীর দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মানুষটা অদ্ভুত। তাকে ছুঁয়েও দেখলো না। খাটের ওই পাশে বসে কথা বলে চলে গেল। যাবার সময় শুধু কাঁধে একবার হাত রেখে বলেছিল, তুমি খুব সুন্দর!
সেই থেকে রাখির মাথায় ঝিমঝিম এক সুখ বাজতে থাকে। শাহ গোলাপ তাকে কি চোখে দেখে রাখী ঠিক জানে না। কিন্তু যখনই রাখী তার মোবাইলে মিসকল দেয়, শাহ গোলাপ সাড়া দেয়। কিন্তু রাস্তায় দেখা হলে অচেনা মানুষের মতো আচরণ করে। এটা তাকে কষ্ট দেয়। তবু শাহ গোলাপকে ভুলতে পারে না। সময় পেলেই মিসকল দেয়। শাহ গোলাপ উত্তর দেয় সময় করে। রাখীর জানতে ইচ্ছে করে সে বিয়ে করেছে কিনা। কিন্তু সংকোচ এসে জড়ো হয়। সে কাস্টমারদের সাথে দুনিয়ার ফটফট করতে পারলেও শাহ গোলাপের ফোন পেলে বাকহীন হয়ে যায়। বুকের মধ্যে কিরকম ছমছম করে। এই ছমছমের নাম কি প্রেম? দেহের আবেদনহীন এই অনুভুতি রাখীর কাছে অজানা ছিল। এই প্রথম একজন পুরুষের জন্য তার এরকম হচ্ছে।
অনেক কথা বললেও কোনদিন প্রেম ভালোবাসার কথা বলে না। অথচ জাউরা কাস্টমারদের কেউ কেউ শরীর গরমের আবেগে অনেক সময় তার উপর ঝাপিয়ে পড়ার সময় লাভ ইউ বলে ফেলে রাখী জানে সেই ভালোবাসার মেয়াদ আধাঘন্টারও কম।
চা মুড়ি খেয়ে দুজনে বেরিয়ে যায়। আলমাসের টিকেট কাটে। অন্ধকারে পাশাপাশি গিয়ে বসে। এখনো শো শুরু হয় নাই। লোকজন ঢুকছে আস্তে আস্তে। অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে পথ দেখাচ্ছে টিকেট চেকার। সবাই বসে পড়লে সিনেমা শুরু হলো। অ্যাকশান রোমান্টিক সিনেমা। সিনেমা দেখার সময় রাখী তার মাথাটা শাহগোলাপের কাঁধে এলিয়ে দেয়। হাতের উপর হাত রাখে।
ওদিকে সিনেমায় জটিলতা শুরু। এক পর্যায়ে বুরুজ খানের সাথে ঝিলমিলের প্রেম যখন সংকটে পড়ে দর্শককূলকে টেনশানে ঘামিয়ে ফেলেছে, তখনই দুম করে ইন্টারভেল। বাতি জ্বলে উঠলো হল জুড়ে। চানাচুর চিপস কোকের বোতল নিয়ে টুংটাং শব্দে ঘুরতে থাকে বিক্রেতারা।
Saturday, April 19, 2014
২০ এপ্রিল ২০১৪: এই শনিবারে
ইতিহাস পাঠে একটা ঝামেলা থাকে। যিনি ইতিহাস লিখেন তিনি সচরাচর নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। এর মধ্যেও গ্রহনযোগ্য ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে। পাঠককে একটু সতর্ক থাকতে হবে, মাথাটা সজাগ রাখতে হবে। যিনি ইতিহাস লিখেছেন তাঁর খানিক ইতিবৃত্ত জেনে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। এটা সবসময় সম্ভব হয় না, তাই মগজের যুক্তিবাদী কোষগুলোর সঠিক ব্যবহার দরকার। আশ্চর্য হলেও সত্য যে এদেশের গত কয়েকশো বছরের ইতিহাসের অধিকাংশ বই লেখা হয়েছে ভিনদেশী লেখকের হাতে। অষ্টাদশ শতকের উপনিবেশ যুগের সূচনার ইতিহাস পড়তে গিয়ে টের পেলাম বিদেশী লেখকরা যেভাবে বিস্তারিত তথ্য সহকারে ইতিহাস লিখেছেন, এই দেশের কেউ অত বিস্তারিত ইতিহাস লেখেননি। নাকি আমিই তেমন বই খুঁজে পাইনি, কে জানে। আলীবর্দী খাঁর আমল কিংবা তার আগে আরো একশো বছর আগের ইতিহাস ইংরেজ লেখকের বইতে যতটা বিস্তারিত পেয়েছি আর কোথাও পাইনি। ফলে তিনশো বছর আগের কোন ব্যাপারে বিশদ তথ্যের জন্য আমাকে নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে ভিনদেশী লেখকের উপর। মুশকিল হলো একজন ইংরেজ স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখবে। লর্ড ক্লাইভের জীবনী পড়তে গিয়েও একই কাহিনী। ক্লাইভ স্বভাবতই তাদের কাছে হিরো, সিরাজউদ্দৌলা ভিলেন। জগতশেঠ তাদের কাছে একজন মহৎ ধনকুবের। মীরজাফর, ঘসেটি বেগম আলীবর্দী খাঁর সুবিধাবঞ্চিত বিক্ষুব্ধ আত্মীয় মাত্র। তবু ওই ইংরেজ লেখককের জবানী থেকেই ছেঁকে ছেঁকে কিছু তথ্য বের করা যায়। পলাশীর ঘটনা নিয়ে একাধিক ইউরোপীয়ান লেখকের বই আছে। আছে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ইতিহাস নিয়েও। সেখানে খুব সতর্কভাবে চোখ বুলালে আমাদের দেশীয় রাজরাজড়াতের কিছু দুর্বলতা বের হয়ে আসে। রাজরাজড়াদের অনৈক্য, লোভ, ঈর্ষাপরায়নতা এই তিনটা দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজ খুব সহজেই জয়লাভ করেছে বাংলায়। তারপর তারা ধীরে ধীরে সমগ্র ভারতবর্ষে তাদের থাবা বিস্তার করেছে। ভারতের মতো একটা বিশাল দেশকে করায়ত্ত করা, উপনিবেশে পরিণত করার কথা কোন ইউরোপীয় শক্তি কল্পনাও করেনি তার পঞ্চাশ বছর আগেও। তারা শুধু বাণিজ্য করার জন্যই প্রথমে এদেশে এসেছিল। ভাস্কো দা গামার হাত ধরে প্রথমে পূর্তগীজরা পা রাখলো ভারতে, তারপর অন্যন্য ইউরোপীয়ান জাতি এদিকে ছুটে আসতে থাকে বাণিজ্য লোভে। সর্বশেষ আসে ইংরেজ। কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশী সফলতা অর্জন করে। তারাই সক্ষম হয় সমগ্র ভারতের অধীশ্বর হয়ে যেতে। সামান্য কয়েক হাজার সাদা চামড়ার হাতে বন্দী হয়ে গেল কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষ।
৪.
এই শনিবারটা একটু অন্যরকম হবার কথা ছিল। হলো না। মানুষের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না। ইতিহাসের খাতায় আরেকটি ব্যর্থ শনিবারের নাম যুক্ত হয়ে গেল। স্পেস স্পেস স্পেস.......
Tuesday, April 15, 2014
১৫ এপ্রিল ২০১৪ উত্তাপে বাংলাদেশ
প্রচণ্ড উত্তাপে দিনগুলো তড়পাচ্ছে। চৈত্রের শেষ ভাগে বাতাস উত্তাল হয়, এবার তেমন কিছু দেখা যায়নি। বসন্ত শেষ হয়ে গেল কোনরকম হাওয়ার মাতন ছাড়াই। বৈশাখে বাঙালী খুব উৎসবে মাতে। শহুরে মধ্যবিত্ত ঘরে থাকে না। এই বিরাট জনসংখ্যার চাপ আমাদের রাস্তাগুলো সহ্য করতে পারে না। পথঘাট স্থবির হয়ে থাকে কোথাও কোথাও। ডিসি হিল আর সিআরবিতে উৎসবের আমেজ। আশপাশের কয়েক কিলোমিটারে লাল সাদা পোষাকে মাতোয়ারা নারী পুরুষ। এই অসহ্য গরমকে তুচ্ছ করে বাঙালী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। এই উৎসাহ দশ বছর আগেও খুব বেশী ছিল না। এখন হঠাৎ করে যেন বেড়ে গেল। পহেলা বৈশাখে আমার আনন্দ নেই গত সতের বছর। এই দিনে আমরা ঘর থেকে বের হই না তেমন। বড়জোর গ্রামে যাই। বাবাকে দেখে আসি। এই টুকুই আমার কার্যক্রম। এবার অফিসে কাটিয়েছি সারাদিন। অফিস ফেরার পথে হেঁটে হেঁটে মানুষের আনন্দিত মুখ দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, যদি এই সময়টা গ্রীষ্ম না হয়ে হেমন্ত হতো। আনন্দটা আরো অনেক উপভোগ্য হতো। আমি একবার লিখেছিলাম, নববর্ষের সময়টা বদলে ফাল্গুনে বা অঘ্রানে নিয়ে যেতে। আমার ক্ষমতা থাকলে তাই করতাম। তোমার থাকলে কী তাই করতে?