কৈশোরে গুগলপ্লেক্স নামের একটা বই হাতে পেয়েছিলাম। বইটি তিন টাকায় কিনেছিলাম সম্ভবতঃ। প্রকাশক ছিল মুক্তধারা। সেই বইটির একটি কাহিনী গুগলপ্লেক্স, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংখ্যাটি কিভাবে আবিষ্কৃত হলো। সেই থেকে গুগল শব্দটি মাথায় গেঁথে থাকে। তার বহুবছর পর একদিন পত্রিকায় পড়লাম গুগল নামের একটা ওয়েবসাইটের কথা যেখানে পৃথিবীর তাবৎ তথ্যের খোঁজ মেলে।
১৯৯৮ সালে ইন্টারনেট ঘরে ঘরে ছিল না। একটা অফিসে সাধারণত একটা ডায়াল আপ কানেকশান থাকলেই ধরে নেয়া হতো অফিসটা আইটি সচেতন। আমাদেরও একটা পিসিতেই ইন্টারনেট কানেকশান ছিল। টেলিফোন ফ্যাক্স বাদ দিলে ওই পিসিটাই বৈশ্বিক যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা। ওটার কোন মালিক ছিল না, বলা চলে সরকারী। কিন্তু সরকারী হলেও ওটার উপর খবরদারি করার ক্ষমতা ছিল আমারই। যে বনে বাঘ নেই সেখানে শেয়ালই রাজা, আমিও ইন্টারনেট গুতানোর অভিজ্ঞতাবলে কোম্পানীর আইটি কর্তাও হয়ে বসি। নিজের পিসি ছাড়াও ওই পিসিতে বসে গুতোগুতি করার স্বাধীনতা পেয়ে যাই পদাধিকার বলে। তখন ইয়াহু ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন। আমি হটমেইল এবং ইয়াহুতে একাউন্ট করি, তবে খোজখবরের জন্য ইয়াহুকে প্রাধান্য দেই। তখন সম্ভবতঃ হটমেইল দিত ২ মেগা, ইয়াহু দিচ্ছিল ৪ মেগা স্পেস। তাতেই যথেষ্ট মনে হতো।
যেদিন গুগলের খোঁজ পেলাম, সাদাসিধে পাতাটা খুলে প্রথম দর্শনেই ভালো লাগায় জড়িয়ে গেলাম। তারপর থেকে ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলে গুগলে ঢুঁ মারি। ইয়াহু গুগল দুটোতে খোজাখুজি চলে। প্রথম প্রথম সার্চ দিতাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নিয়ে কিছু দেখতে কেমন একটা অনুভুতি হতো। কোন সুদুর বিদেশে বাংলাদেশ নিয়ে এত কিছু লেখা হচ্ছে, ভেবে অবাক হতাম। কিছুদিন পর দেখা গেল আমি আর ইয়াহুতে কিছু সার্চ করছি না। সবকিছু খোঁজার জন্য গুগলে যেতে শুরু করেছি। কোন জিনিস খুঁজতে গুগল বা ইয়াহু দুটোকে কাজে লাগাতাম প্রথমদিকে। কিন্তু দেখা গেল ইয়াহুর চেয়ে গুগলের রেজাল্টেই প্রাসঙ্গিক উত্তর মেলে। আমি একটা শব্দ টাইপ করে দিলে গুগল কি করে যেন বোঝে আমি কি খুঁজছি। এটা যেন মনের কথা জেনে ফেলা। সে জন্য গুগলের দিকে ঝুঁকে পড়ি। তবু তখনো হটমেইল বা ইয়াহুকে দরকার হয়, মেইলের জন্য, চ্যাটের জন্য।
আরো কয়েক বছর কেটে গেছে। আমাদের অফিস আরো বড় হয়েছে। কম্পিউটার ইউজার পঞ্চাশ ছুয়ে গেছে। সবার জন্য ইমেল আইডি, ইন্টারনেট কানেকশান, নিজস্ব ডোমেন, সব হয়ে গেছে। একদিন গুগল ঘোষণা দিল এবার ওরা আসছে জিমেইল নিয়ে। সেদিন আমার মতো খুশী বোধহয় আর কোন ইউজার হয়নি। হটমেইল ইয়াহুর বিজ্ঞাপনের যন্ত্রনায় ওখানে মেইল খুলতে বিরক্ত লাগতো। তবু মেনে নিয়েছিলাম প্রযুক্তির যন্ত্রনাই নিয়তি বলে। গুগল এসে সে যন্ত্রনা থেকে সম্পূর্ন মুক্তি দিল। পেয়ে গেলাম ছিমছাম সুবিধাজনক একটি ওয়েব মেইল যাতে গ্রাফিক্স বিজ্ঞাপনের কোন উৎপাত নেই। তার উপর এই মেইলের তাক লাগানো ১ গিগা লিমিট। ইয়াহু হটমেইলের কাহিল অবস্থা দাঁড়ায় তখন। প্রথমদিকে জিমেইল পাওয়া সহজ ছিল না। ইনভাইটেশন পেলেই একাউন্ট খুলতে দিত। আমি ইনভাইটেশান চেয়ে আনলাম একটা ফোরামে গিয়ে। অচেনা এক বিদেশী আমাকে দয়া করে ইনভাইটেশান পাঠালো। রেজিষ্ট্রেশান করার পর দেখি আমিও আরো দশজনকে ইনভাইট করতে পারি। এভাবে বাড়তে থাকে জিমেইল গ্রাহক। কদিন পরে আমার ইনভাইটেশন লিমিট বাড়ানো হলো ১০০তে। মানে আমি একশো বন্ধুকে ইনভাইট করতে পারি। জিমেলের পর পেলাম ব্লগস্পট। নিজের ইচ্ছেমতো লেখালেখি করার জন্য একটা অনলাইন ডায়েরী।
স্কুল বয়স থেকে ম্যাপের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল। আমার টেবিলে ছোট্ট একটা গ্লোব ছিল, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওটাও মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। পৃথিবীর কোথায় কোন দেশ, কোন সমুদ্রের গভীরতা কতো, কোন পর্বতের উচ্চতা কতো, এরকম হাবিজাবি সাধারণ জ্ঞান আয়ত্বে এসে গিয়েছিল গ্লোবটা দেখে দেখেই। বড় হবার পর আরো ভালো বিকল্প খুঁজছিলাম। বড় কোন ম্যাপ যাতে সবগুলো দেশের নগর বন্দরের রাস্তার ম্যাপ থাকে। কিন্তু অতবড় ম্যাপ পাওয়া অসাধ্য প্রায়। যেদিন প্রথম গুগল আর্থে ঢুকলাম সেদিন আমার চোখে নতুন এক বিস্ময়। এটা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। এ শুধু ম্যাপ নয়। সমস্ত পৃথিবীটা আমার হাতের মুঠোয় পুরে দেয়া হয়েছে। নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ মনে হলো। সামান্য একটা মাউস নেড়ে সমস্ত পৃথিবীর সবগুলো নগরে ঘুরে বেড়াতে পারি আকাশ পথে।
অনায়াসে এবং বিনামূল্যে। একেক দিন একেকটা দেশে যাই, ওই দেশের অখ্যাত বিখ্যাত সবগুলো শহরের রাস্তা ধরে ঘুরে বেড়াতে থাকি। বিস্ময়ের পর বিস্ময়। বিশ্বভ্রমণের আজীবনের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো গেল।
নতুন কোন জায়গায় গিয়েছি। চিনতে কষ্ট হচ্ছে, মোবাইল খুলে গুগল ম্যাপে ক্লিক করি। টিক টিক করে নীল বোতাম দেখিয়ে দেয় আমি কোন এলাকায় দাঁড়িয়ে। আশেপাশের রাস্তার নাম্বার দেখে ঠিকানা বের করে ফেলতে পারি খুব সহজেই। সেদিন উত্তরায় এক আত্মীয়ের বাড়ি খুজে পাচ্ছিলাম না। আমি এমনিতেই ঢাকার রাস্তাঘাট কম চিনি। উত্তরাতো আরো বহুদূরের কথা। তবু সাহস করে হাজির হলাম উত্তরায়। রাস্তার নম্বার জানা ছিল, আর জানা ছিল ওই বাড়ির কাছে একটা পার্ক আর মাঠ আছে। আমি রাস্তার নম্বর টাইপ করে ক্লিকাইলাম, স্যাটেলাইট ভিউতে দেখলাম ওই রাস্তার মাথায় একটা মাঠ আর পার্কমতো। আমি গিয়ে মাঠের কাছটায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফোন দিলাম। অমনি আমার হোস্টকে দেখা গেল সামনের বাড়ির বারান্দায় এসে আমাকে ইশারায় ডাকছে। কি চমৎকার ব্যাপার না?
দরকারী ফাইলপত্র লেখালেখি জমা রাখি হার্ডডিস্কে, কিছুদিন পরপর হার্ডডিস্ক বদলালে কিংবা ক্রাশ করলে ফাইলপত্র নিয়ে বিপদে পড়ি। গুগল এসে জানালো সমস্যা নাই, গুগল ডকস আছে। ওখানে জরুরী ফাইলগুলি ব্যাকাপ রাখতে শুরু করি। কদিন আগে দেখি গুগল ডকস এখন গুগল ড্রাইভ হয়ে গেছে। খুব চমৎকার করে ফাইলপত্র গুছিয়ে ফোল্ডারে রেখে দিতে পারছি এবং ডেক্সটপ থেকে ফাইল আপডেট করা যাচ্ছে খুব সহজেই।
আর কিসের কথা বলি, গান খোজার জন্য, মুভি খোজার জন্য, বিশেষ কোন ডকুমেন্টারীর খোজ করার জন্য ইউটিউবের বিকল্প নেই। তাও সেই গুগল।
সব মিলিয়ে হিসেব করলে দেখা যাবে আমার নেট জীবনটা গুগল নির্ভর হয়ে গেছে। গুগল আছে আমি আছি, গুগল নাই আমি নাই।
আরো অর্ধযুগ আগে একবার খুব শখ হলো, গুগলের দুই বন্ধুর সাথে আলাপ করবো। ল্যারি পেজ আর সের্গেই ব্রাউন। খোঁজ করতে করতে সের্গেই'র যে ওস্তাদ মানে ওর ভার্সিটির যে শিক্ষক তাকে এসব বিষয়ে প্রাথমিক হাতে খড়ি দিয়েছিল তার সাথে যোগাযোগ হয়ে যায়। সের্গেই সম্পর্কে সে বলে। তারপর....
.....নাহ, বাকীটুকু আরেকদিন বলি।
No comments:
Post a Comment