Monday, May 28, 2012

ছাড়

আমি এই দ্বীপে আসার সুযোগ খুঁজছিলাম অনেক বছর ধরে। অবশেষে দ্বীপটিতে আমার একটা অভাবিত আশ্রয় মিললো। তুমি আসতে চাইতে না। আধুনিক সুযোগ সুবিধা রহিত কোন দ্বীপে তুমি থাকতে চাও না। এ যেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। পৃথিবীর একমাত্র গাড়িবিহীন দ্বীপ। তুমি তোমার শখের ফিয়াট গাড়িটা রেখে আসতে হচ্ছিল বলে তিনদিন তিন রাত কেঁদেছিলে। আর আমি গাড়ি যন্ত্রনা থেকে মুক্তিলাভের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলাম। মনে আছে তুমি কতোবার দূর্ঘটনায় পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছো? সেই কুফা গাড়িটাকে তুমি এত ভালোবাসতে আমি ভাবতে পারি না। গাড়িটা তোমার জন্মদিনের উপহার হলেও ওটার কাছ থেকে মুক্তি লাভের জন্য আমি হন্যে হয়ে সুযোগ খুঁজছিলাম যেদিন গাড়িটা প্রথম নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পাহাড় থেকে গড়িয়ে সমুদ্রের দিকে যেতে যেতে জলপাই গাছটার সাথে আটকে দাড়িয়ে গেল। আমি ওখানেই ফেলে আসতাম। কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না। ক্রেন এনে গাড়িটাকে উদ্ধার করলে। তারপর আবার মেরামত করে রাস্তায়। রঙ চটে গেছে গাড়িটার অনেক জায়গায়। তবু তুমি নতুন রঙের প্রলেপ দিতে চাও না। গাড়িটাকে তুমি এত ভালোবাসতে মাঝে মাঝে আমার ঈর্ষা হতো। আমার দেয়া গাড়ি অথচ তুমি আমার চেয়েও গাড়িটাকে বেশী ইজ্জত করতে শুরু করেছো। গাড়িটা ফেলে দেবার আমার সকল যুক্তি তর্ককে তুমি স্তব্ধ করে দিতে সেই একটা বাক্য দিয়ে, গাড়িটা আমার প্রেমের প্রথম উপহার। তাই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রেমের উপহারকে আদিরূপে রাখতে চাও। অথচ ওরকম একরোখা কোন সেন্টিমেন্টে আমি গাড়িটা তোমাকে দেই নি। ভালোবাসার জন্য বছর বছর নতুন উপহার দেয় মানুষ। তুমি একটা উপহারকে আজীবনের মওকা ধরে নিয়ে বসে থাকলে জীবনের বাকী থাকলো কি। তবু তোমার প্রেমের অটল সিদ্ধান্তে তুমি অনড় থাকতে চেয়েছিলে।

--------------------

আমাদের বিয়ের তিন বছর পেরিয়েছে তখন। আমাদের প্রেমের কোথাও চিড় ধরেনি। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। তবু একদিন বাসায় একটা টেলিফোন এলো রং নাম্বারে। দুঃখ প্রকাশ করে লাইন কেটে দিল ওপার থেকে। পরের সপ্তাহে সেই নাম্বার থেকে আবারো টেলিফোন। এবার ভুল নয়। সচেতন ভাবে। বললো, কথা বলতে চায় আপত্তি আছে কিনা। তুমি জানো আমি টেলিফোনে পারদর্শী নই। যেসব মানুষ রাতের পর রাত প্রেয়সীর সাথে কথা বলতে পারে আমি তাদের দলে নই। আমি দশ মিনিটের বেশী গেলে হাপিয়ে উঠি। তুমি বারবার অভিযোগ করতে। আমি জানাতাম এ আমার সীমাবদ্ধতা।

সেই অচেনা কন্ঠটি যখন জানতে চাইল আপত্তি আছে কিনা, আমি 'না' উচ্চারণ করেছিলাম। তুমি বিশ্বাস করো, আমি 'না' বলেছিলাম, কথা বলবো না বলার জন্যই। কিন্তু ওই 'না' এর অর্থ যে হ্যাঁ সেটা বুঝতে কয়েক মিনিট লেগেছিল আমার। ততক্ষণে অপর পক্ষ কথা বলতে শুরু করেছে। এবং দেখা গেল শুনতে আমার খারাপ লাগছে না। কারণ ওই পক্ষ শোনার চেয়ে বলতে পছন্দ করছে। আর শোনার ব্যাপারে আমার জুড়ি নেই তা তো জানোই। আমি চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলাম। অবাক হচ্ছো চোখ বন্ধ করেছি কেন? কারণ কন্ঠটি এমন একটা সুরে কথা বলছিল যা আমার কৈশোরের প্রথম প্রেমে পড়া মেয়েটির কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। আমি কথা শুনতে শুনতে ফিরে গেলাম কৈশোরে। যে মুখটা আমি কখনোই ভুলি না সেই মুখটা ভেসে উঠলো টেলিফোন কন্ঠে। সেদিন থেকে আমাদের অনর্গল কথা বলার সুত্রপাত হয়। আমি নিজেও কখন যে কথা বলতে শিখে গেলাম জানি না। দিনের পর দিন মাসের পর মাস আমাদের কথা চলেছে। অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো? আমি মেয়েটার নাম জানি না। মেয়েটাও আমার নাম জানে না। আমরা কেউ কারো সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইনি। আমরা কেবল সময় নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলাম কথা বলার। আমি চাইতাম এমন একটা সময় যখন আমি বাসায় থাকি না। কিংবা তুমি যখন বাসায় থাকো না। সেও বোধহয় তেমন একটা সময় বেছে নিতো যখন সে একা থাকে। আমাদের ফোনালাপের সময়গুলো ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর সময়। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলার পরও আমাদের একবিন্দু ক্লান্তি আসতো না।

তুমি টের পাওনি বলে অবাক হচ্ছো? আমিও অবাক হতাম। তোমাকে ঠকাচ্ছি ভেবে প্রথম কদিন আক্ষেপে ভুগেছি। পরে ভেবে দেখলাম তোমাকে যতটুকু দেবার ততটুকু দেবার পরেই আমি ওকে সময় দিচ্ছি। তোমার কাছ থেকে কোন সময় চুরি করিনি। তোমার কাছ থেকে ভালোবাসার কোন ভাগ ওকে দিতে হয়নি। সে তার নিজের অংশটাই নিয়েছে। হ্যাঁ সে তার নিজের একটা অংশ সৃষ্টি করে নিয়েছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের হৃদয়টা একটা অদ্ভুত জায়গা। এটা অসীম স্থিতিস্থাপক রাবারের মতো। যতগুলো মানুষকে তুমি ভালোবাসতে চাও ততগুলোকে বাসতে পারবে। যখন তুমি একজনকে ভালোবাসছো তখন মনে হবে তুমি একজনের জন্যই সৃষ্ট। যখন দুজনকে বাসতে শুরু করবে তখন দুজনের জন্য জায়গা তৈরী হয়ে যাবে। মানুষ, পোষা প্রাণী, গাছপালা, সবকিছুর জন্য ভালোবাসার আলাদা আলাদা খুপড়ি আছে হৃদয়ে। সেরকম একটা খুপড়ি বানিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিল সে। তোমার সাম্রাজ্যের কোন ক্ষতি হয়নি তাই।

তোমাকে না ঠকিয়েও ওই নারীর সাথে আমার বন্ধুতা নিরুপদ্রপ ছিল কয়েকটা বছর। একদিন যাদুকর লোকটা স্বপ্নে হানা দিল আমার। মনে আছে লোকটার কথা? তোমার দ্বিতীয় গাড়ি দুর্ঘটনার পর একদিন রাস্তায় হাত দেখিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছিল। তারপর গল্প করছিল জেবেল পাহাড়ের চুড়ার পাথরের মাথাটি ভুমধ্যসাগরে খসে পড়ার। দাবী করছিল সংবাদে যদিও আসেনি কিন্তু ওই ঘটনার জন্য দায়ী তার যাদুদণ্ডটি। সে বলছিল তোমাকে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করার পেছনেও আছে সেই যাদুদণ্ড। আমি লোকটাকে অবিশ্বাস করেছিলাম বলে সে কেমন একটা অদ্ভুত হাসি দিয়েছিল। সেদিন সেই যাদুকর স্বপ্নে হানা দিয়ে বললো, সে তোমাকে সবকিছু বলে দেবে এবং শুধু তাই নয় তোমাকে নাকি আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। আমি চমকে গেলাম। জেগে উঠলাম ধড়ফড় করে। পাশে শুয়ে তুমি কিছুই জানো না।

কয়েকদিন পর আবারো একই স্বপ্ন। যাদুকরটি এই শহরেই থাকে। শহরের নাড়ি নক্ষত্র সব জানা তার। আমার পিছু নিয়েছে, বলা যায় তোমার। অথবা তোমার আমার দুজনেরই। এতদিন পর তোমাকে হারাবার ভয় পেয়ে বসলো আমাকে। অথবা ধরা পড়ার। আমি তোমাকে হারাতে চাই না আবার ধরাও পড়তে চাই না। কৌশলে তাই আমি শহর ছেড়ে পালাবার জন্য রাস্তা খুঁজতে শুরু করি। এমন একটা শহর যেখানে আধুনিকতা নেই, গাড়ি নেই, দালানকোটা নেই। আছে কেবল বিরল এক নৈঃশব্দ, যেখানে দিনের বেলায়ও ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ পাওয়া যায়। এই পরিচিত গণ্ডী ছেড়ে বহুদূরের দেশে।

----------------------------

অবশেষে আমি এই দ্বীপে পৌঁছালাম তোমাকে নিয়ে। এখানে একদম আনকোড়া নতুন জীবন। এই দ্বীপে তৈরি কিছুই নেই। থাকার একটি ঘর বাদে সবকিছু তৈরী করে নিতে হবে। প্রশান্ত মহাসাগরে পথ হারা জাহাজের নাবিকেরা এখানে নির্মান করেছিল সাময়িক আবাস তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই ফরাসী দ্বীপের নাগরিক সমাজ। মাত্র দেড়শো ঘর মানব বসতি নিয়ে কখনো একটা শহর হয়? এটি হয়েছে। সভ্য সমাজ থেকে বহুদূরে এই দ্বীপের সাথে একমাত্র যোগাযোগ বাহন একটা যান্ত্রিক নৌযান যেটা সপ্তাহে একবার নিকটস্থ বৃহৎ দ্বীপটা থেকে রসদপত্র যোগাড় করে আনে। প্রতি শনিবার এই দ্বীপটা খালি হয়ে যায়। তখন সমস্ত দ্বীপে আমরা দুজন বাদে আর কেউ থাকে না। কী অদ্ভুত ব্যাপার বলতো, প্রতি সপ্তাহে কয়েক ঘন্টার জন্য আমরা একটা দ্বীপের মালিকানা পেয়ে যাবো। এখানে তোমাকে আমাকে কেউ বিরক্ত করবে না স্বপ্নে হানা দিয়েও। এই দ্বীপে পা রাখার পরদিন থেকে আমার সেই দুঃস্বপ্নটা নির্বাসনে গেছে।

আমি সত্য গোপন না করে সব খুলে বললাম। তুমি কি আমাকে ঘৃনা করবে এখন?

==============================================================
- ভয় পেয়ো না। এটা একটা গল্প।
- গল্প?
- হ্যাঁ। একটা বিদেশী ম্যাগাজিনে পড়া গল্প।
- এই গল্প আমাকে শোনালে কেন? এই দ্বীপে আসার সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে একটা রহস্য আছে বলেছিলে। এটাই কি সেই রহস্য?
- না। তবে আমাদের প্রত্যেকের কিছু না কিছু 'না বলা গল্প' থাকে। সেই গল্পগুলো বলা হলে জীবনের ছক একরকম থাকে, না বলা হলে জীবন অন্যরকম। তুমি কি চাও 'না বলা গল্পগুলো' সব বলা হয়ে যাক?
-না!
-আমার সেই টেলিফোন নিয়ে কোন কৌতুহল আছে?
-না, নেই।
-গুড। তোমার বন্ধুর চিঠির ব্যাপারটা নিয়েও আমি কিছু বলবো না।
-থ্যাংকু।
-জীবনে এরকম ছোট ছোট ছাড় দিয়েই টিকে থাকতে হয়।
-নিঃসন্দেহে
-তাহলে চলো বিকেলের কফি পর্বটা সেরে ফেলি। একটু পরেই আঁধার নামবে দ্বীপে।

No comments: