Sunday, May 20, 2012

মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি কালজয়ী চলচ্চিত্রের অপেক্ষায়

দেখছিলাম Battle of Algiers। ১৯৬৬ সালের এই ছবিটা কেউ কেউ দেখেছেন হয়তো। ছবিটার সাথে আমাদের উপনিবেশ আমলের বেশ কিছু মিল আছে। কিন্তু ছবিটা দেখে আমার মাথায় একটা বাক্য খেলছিল - 'ব্যাট্ল্ অব বাংলাদেশ'। না, এই নামে কোন ছবি বাংলাদেশে নেই। কিন্তু এরকম একটা ছবি দেখার স্বপ্ন দেখছি আমি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত এন্তার ছবি দেখেও আমার তৃপ্তি মেটেনি। আলজেরিয়ার ছবিটা সেই অতৃপ্তিটা আবারো জানান দিতে শুরু করেছে। হুমায়ূন আহমেদের দেয়ালের কয়েক পাতা পড়ে সেই ইচ্ছেটা ঘোরতর যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা এসেছে বলে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে সস্তা জ্ঞান করে। তাদের কাছে রক্তের ঘনত্বের কোন আপেক্ষিক গুরুত্ব নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সমস্ত পৃথিবীর সবগুলো পরাশক্তির সম্মিলিত অস্ত্রপাতেও এত রক্তের বান ডাকেনি। এমনকি মহাযুদ্ধের মারণাস্ত্রের লক্ষ্যের তালিকায় সরাসরি নিরীহ মানুষ ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানী অস্ত্রের একমাত্র লক্ষ্যবস্তু ছিল নিরীহ মানুষ, ২৫ মার্চের অপারেশান সার্চলাইটের টার্গেট মধ্যরাতের ঘুমন্ত মানুষ। বস্তুতঃ পাকিস্তানীদের আগে একা একটা জাতির এত রক্ত ঝরানোর রেকর্ড আর কারো নেই। পাকিস্তান আগামী একশো বছর প্রায়শ্চিত্ত করলেও সেই রক্তের দেনা শোধ হবে না। ক্ষমা চাওয়া তো সেই তুলনায় নস্যি।

সেই আমাদের রক্তে ধোয়া স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে পূর্নাঙ্গ কোন চলচ্চিত্র নেই!! ভাবা যায়? Battle of Algiers দেখতে বসে এ কথাটাই মনে পড়ছিল। ইতালির পরিচালক Gillo Pontecorvo ছবিটায় আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের কৃতিত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে ছবিটা বানিয়েছিলেন। ছবিটা দেখে সংক্ষেপে ওদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা টাইম লাইন খুঁজে পাবেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখ্য চরিত্র গুলো খুঁজে পাবেন। দ্য গলের ফরাসী সরকারকে আলজেরিয়ার মাটি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য FLN (জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট) নামে দলটির মুষ্টিমেয় সদস্যের সশস্ত্র আন্দোলন/আত্মত্যাগ কিভাবে গনআন্দোলনে পরিণত করে সেটা বুঝতে পারবেন। ঘটনার বিস্তার ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২। ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৬২ সালে। আরো দুই যুগ আগে আমাদের সূর্যসেন-প্রীতিলতারা ঠিক এরকম কাজই করতে চেয়েছিল। স্বাধীনতা আসতে আরো দুটো ধাপ পেরোতে হলেও, প্রেরণার অনেকটা ভিত সূর্যসেনরাই গড়ে দিয়েছিল।

স্বাধীনতার জন্য আলজেরিয়া বা অন্য যে কোন দেশের তুলনায় আমাদের অনেক বেশী রক্ত ঢালতে হলেও সেটা নিয়ে এখনো একটি পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারিনি কেন? এই ভাবনাটা খুব পোড়ায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব চলচ্চিত্র এ যাবৎ নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে এমন কোন সিনেমা আছে যেটায় মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতা আছে? এমন কোন ছবি আছে যাতে সবগুলো প্রধান ঘটনার বিবরণ আছে, মুক্তিযুদ্ধে সব নায়ক খলনায়কদের কথা আছে? নেই!! মুক্তিযুদ্ধের সকল প্রধান উপাদান উপস্থিত আছে সেরকম একটি কালজয়ী চলচ্চিত্রও আমাদের নেই!

অথচ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্তিকর ইতিহাস পাঠ থেকে রক্ষা করার জন্য ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবরণী নিয়ে একটা চলচ্চিত্র থাকা জরুরী। চলচ্চিত্রটি নিয়মিত দৈর্ঘ্যের বদলে যদি তিনগুণ বেশীও হয় তবু এমন একটা চলচ্চিত্র আমাদের বানাতে হবে। যারা যুদ্ধ করেছেন, কিংবা যারা যুদ্ধের সময়ের স্মৃতি ধারণ করার মতো বয়ঃপ্রাপ্ত ছিলেন, তেমন মানুষেরা এখনো বেঁচে আছেন। আর দশ বছর পর অনেকেই থাকবেন না। তাই জরুরী ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। এখনই সময়।

আশার কথা দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে, আবার আশংকার কথা- বাড়ছে জ্ঞানপাপীদের সংখ্যাও। নানা বর্নের খল ইতিহাসবিদ এদেশে সুক্ষ্ণভাবে সক্রিয়। তারা খুব সুশীলতার সাথে আমাদের ইতিহাসের মূল আবেগ অথবা পাকি নৃশংসতার চিত্রগুলো মুছে সেখানে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করছে অর্ধসত্য রকমের বানোয়াট ইতিহাস। লেখনীর কৌশলে কিংবা শিল্পের সৌকর্যে ইতিহাস কোথাও কোথাও পরিণত হচ্ছে পরিহাসে।

মেহেরজান ও দেয়াল - এই দুটো জিনিসই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দ্বারা চালিত অপ ইতিহাস বর্ণনার প্রয়াস।

গেল সপ্তাহে লেখাটি মগজে থাকা অবস্থায় ভাবা হয়েছিল সেই ছবিটি নির্মাণ উপাদানের মধ্যে ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১ এই বছরগুলোই থাকবে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের দেয়ালের আগমন বার্তা দেখে মনে হচ্ছে একাত্তরের পর ১৯৭৫কেও আনতে হবে তথ্যচিত্র ভিত্তিক এই চলচ্চিত্র নির্মাণে। ইতিহাসের মহানায়কের মর্মান্তিক প্রস্থানকে সঠিক ইতিহাসের আলোতে ধারণ করা এবং স্বাধীনতা পরবর্তী খলনায়কদের চিহ্নিত করা খুব প্রয়োজন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে নায়ক মহানায়কের চেয়ে খলনায়কেরাই বেশী সক্রিয়। নিরপেক্ষতার ভণ্ডামিতে না গিয়ে সেই সব খলনায়ককেও স্পষ্ট আলোয় চিহ্নিত করতে হবে। তা না হলে সুশীল ইতিহাস খাদকেরা খুবলে খুবলে খেয়ে ফেলবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। আগাছায় ভরে যাবে ইতিহাসের পাতা। আমরা তা হতে দিতে পারি না!

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র চাই! ইতিহাস নষ্টকীটের খাদ্য হবার আগেই!!

==============================

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্রের সম্ভাব্য উপাদান-

১. বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে উনসত্তরের গন অভ্যুত্থান পর্যন্ত ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
২. শেখ মুজিবের ছয় দফা আন্দোলন থেকে সত্তরের নির্বাচন।
৩. একাত্তরের মার্চ মাস বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক মাস। শুধু মার্চের ঘটনাবহুল দিনগুলির বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে একটা পর্ব থাকতে পারে। স্বাধীনতার ঘোষনা বিষয়ক ইতিহাসটা স্পষ্ট করে প্রমাণ সহকারে উপস্থাপন করা হবে।
৪. পঁচিশে মার্চের পর থেকে শুরু হওয়া গনহত্যা, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার, প্রবাসী সরকার গঠন ইত্যাদি।
৫. ভারতে শরনার্থী জীবনের চিত্র
৬. মুক্তিবাহিনীর গঠন, সেক্টরসমূহের জন্ম ও কর্মকান্ড।
৭. মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সুবিধাবাদী নেতাকর্মী ও ষড়যন্ত্রকারীদের কার্যক্রম
৮. মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের ভূমিকা
৯. জাতিসংঘ ভারত সহ পরাশক্তিসমূহের ভূমিকা
১০. ভারতের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং পাকিস্তানের আত্মসমর্পন।
১১. গেরিলাযুদ্ধের বিশেষ কয়েকটা অপারেশন

যেসব ঘটনা বা ব্যক্তিদের ভূমিকা স্পষ্ট করে দেখাতে হবে
১. শেখ মুজিবুর রহমান
২. তাজউদ্দিন ও প্রবাসী সরকার
৩. সেক্টর কমান্ডারগনের ভূমিকা
৪. বিশেষ বীরত্ব বা ভূমিকা পালনকারী রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
৫. রাজাকার আলবদরের পাশাপাশি খন্দকার মুশতাক সহ অপরাপর দলীয় বিশ্বাসঘাতকগন
৬. পাকি বাহিনী আর তা সহযোগীতের নৃশংসতা
৭. বুদ্ধিজীবি হত্যা
৮. বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা


No comments: