১.
ইতিমধ্যে সৌরজগত ঘিরে পাঁচবার চক্কর খেয়েছে পৃথিবীটা। তবু পৃথিবী বা চাঁদ বা সূর্যের ওঠানামায় কোন তারতম্য হয়নি। পৃথিবীর ওজোন স্তরের ফুটোটা আরো একটু বড় হয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধে, উষ্ণতা বেড়েছে নগর ও গ্রামের। পার্থক্য বলতে এটুকুই। আর সব ঠিকঠাক। কিন্তু নিশাতের পৃথিবী অবিচল, অপরিবর্তনীয়। সৌর আলোর আগুনে বৃষ্টিতে ঝলসে যাচ্ছে দিগন্ত বিস্তৃত রানওয়ে। শীতাতপ এয়ারপোর্টে বসে বাইরের উষ্ণতার তেজ টের পাওয়া মুশকিল। ভেতরের কাঁচঘেরা জগতটার সাথে বাইরের কোন মিল নেই। নিশাতের এই যাত্রাটা কারো জন্য বিশেষ কোন ঘটনা নয়।
দেড় দশক আগে যখন এরকম একটা বিশাল হলঘর পেরিয়ে রাস্তায় অপেক্ষমাণ ফোর হুইলের গাড়িটায় চড়ে বসেছিল, তখন ছিল একরকম শূন্যতা, দেশ ছেড়ে আসার নির্বাক শোক। আজ দেড় দশক পর আবারো একটা হলঘর পেরিয়ে বিশাল একটা উড়ুক্কু তিমির পেটে ঢুকে যাবার সময়ও একরকম শূন্যতা। কী ফেলে যাচ্ছে সে এই দেশে? কী এমন অর্জন করেছিল এখানে এসে? নিশাত আজ কোন হিসেব মেলাতে যায় না। পনের বছরের সবকিছু তার মনে থাকলেও, পাঁচ বছর আগের পর্বটা ভুলতে চেয়েছিল। কিন্তু স্মৃতি মুছে ফেলার কোন ক্ষমতা মানুষকে দেয়নি প্রকৃতি। ওটা যন্ত্রণা দেয়না এখন আর, কিন্তু ক্ষতটা রয়ে গেছে। নিশাত বরং আনন্দিত হবার চেষ্টা করে। দেশে ফিরছে সে। কতোগুলো বছর দেশের ঘ্রাণ পায়নি! আকুল করা ঘ্রাণ "ওমা অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতের হাসি"। গান দিয়ে মাথাটা ভরিয়ে রাখবে আগামী ২৮ ঘণ্টা।
২.
আবীরের কথা মনে আছে? নিশাতের পুরোনো বন্ধু। নিশাত আমেরিকায়, সে বাংলাদেশে। কখনো মুখোমুখি দেখা হয়নি। হ্যাঁ সেই আবীর ঘনিষ্ঠতার চূড়ান্তে এসে যে নিশাতকে পাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। কিন্তু নিশাত একটা পর্যায়ে এসে আবীরকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভীষণ একটা কারণ ছিল সেটা চেপে গিয়েছিল সে। কিন্তু আবীর পাগলের মতো দেশ ছেড়ে ওর কাছে চলে যাবে বলে ঘোষণা দেবার পর নিশাত ওর সাথে সম্পর্কটাই ছিন্ন করে। তারপর আবীর কেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পাঁচ বছর পর আজ রাত বারোটায় সে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে কানাডা যাচ্ছে বিজনেস ভিসায়। তার ছয় ঘণ্টার একটা ট্রানজিট আছে সিঙ্গাপুরে। সেখানে ওই ছয়ঘন্টায় কি করবে তার একটা খসড়া করে ফেলেছে মনে মনে। সময় কাটাবার জন্য কনসার্ট লাউঞ্জটা তার খুব প্রিয় জায়গা। কিন্তু খসড়া চূড়ান্ত করার সময় ইমিগ্রেশানের লাইনে তার ডাক এসে গেল। এই প্রথম তার বিদেশ যাওয়া নয়, কিন্তু যতবার ইমিগ্রেশান পার হয় বুকের ভেতর একটা ধুকপুক করে। এই লোকগুলো কেমন করে যেন তাকায়। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পাসপোর্ট ইত্যাদি চেক করে। একবার এক অফিসার কিছু না পেয়েও তার কাছ থেকে ভিক্ষুকের মতো ১০০ টাকা কেড়ে নিয়েছিল। টাকাটা দেয়া কঠিন ছিল না। কিন্তু মানুষ অত সস্তায় নিজেকে বিকোয় দেখে অবাক লেগেছিল। দুঃখও। সে নিজে খুব সস্তা হয়ে গিয়েছিল। ছুঁড়ে ফেলবার মতো সস্তা হয়ে গিয়েছিল একজনের কাছে। ভুলতে চায় সেই ঘটনাটা। সেই পর্বটা। পারেনি। এবার ইমিগ্রেশান পার হওয়াটা অন্যরকম। তার ভিসা এক মাসের। কিন্তু সে জিন্দেগীতে ফিরবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
৩.
আপনারা ঠিকই ধরেছেন। এখানে খুব চেনা একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটবে। কারণ একই দিনে সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট দিয়ে নিশাত বাংলাদেশে আসছে। ওর ট্রানজিট চার ঘণ্টার। সেই চার ঘণ্টা কিভাবে কাটাবে সে জানে না। তবু কনসার্ট লাউঞ্জে চলে আসবে নিয়তির নির্দেশে। জায়গাটা সময় কাটাবার জন্য আদর্শ। সব ঠিকঠাক থাকলে আবীরের সাথে নিশাতের দেখা হয়ে যেতে পারে। দুজনের ট্রানজিট টাইম প্রায় কাছাকাছি সময়ে।
৪.
নিয়তির প্ল্যানমতোই এগোচ্ছিল। কিন্তু ইমিগ্রেশান অফিসারের সাথে লেগে গেল আবীরের। তার সাথে ছোটলোকের মতো ব্যবহার করেছে ওরা। অপমান করেছে যেন সে পাচারকৃত চোরাই আদম। তাকে দেখেই বললো, দেশ থেকে ভাগছেন নাকি। কথাটা সত্য বলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতে হলো তাকে। মুখ দিয়ে কু কথা বেরিয়ে যায় রেগে গেলে। ইংরেজিতে গালি দিয়ে উঠতে তাকে ধরে ফেললো একজন। পুলিশে দেবে অবস্থা। পরে মাফ চেয়ে সমস্যার সমাধান করলো। কারণ তাকে দেশ ত্যাগ করতেই হবে। ফেরার কোন উপায় নেই। জীবনে কারো কাছে এতটা অপমানিত হয়নি সে। সেই অপমানের যন্ত্রণায় তার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল। সিঙ্গাপুরে গিয়ে যখন পৌঁছেছে তখন সে কনসার্ট লাউঞ্জের কথা ভুলে গিয়ে বারে গিয়ে কয়েক পেগ হুইস্কি খাবে। তারপর সোফায় গিয়ে ঘুম।
৫.
নিশাত কারো জন্য অপেক্ষা করছে না। কনসার্ট শুনছে একা বসেই। সে জানেই না নিয়তির একটা নির্ধারিত খেলা থেকে সে বঞ্চিত হলো। মাত্র তিনশো গজ দূরেই অনেক লোকের ভিড়ে ঘুমাচ্ছে আবীর। নিয়তি নিশাতকে কিছু না জানালেও দেশের কথা ভাবলেই তার আবীরের কথা মনে পড়ে। পাঁচ বছরে কতো কিছু হয়ে গেছে। বিয়ে করে সংসারী হয়েছে ছেলেটা এদ্দিনে। চুলে পাক আসবে? কতো বয়স হবে ওর এখন? চল্লিশ? চল্লিশে কারো চুল পাকে? মন খারাপকে ছুটি দিয়েছিল আমেরিকাতেই। তবু এই কথাটা মনে পড়তে কেমন আনমনা হয়ে গেল। আবীরকে সে যে কারণে প্রত্যাখ্যান করেছে সেটা সফল হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু নিশাতের সফলতা কোথায়? বাকী জীবনও তার একাই কাটবে? চল্লিশের কোন নারীকে কেউ বিয়ে করে না। বাঙালী নারী কুড়িতেই বুড়ি নাকি। কি সব কুসংস্কার। তাকে তো এখনো কেউ বুড়ি বলেনি। বিয়ে ব্যাপারটা ভাবলেই তার হাসি পায়। লোকজন কেন এই যুগে ওরকম একটা নাছোড় বাঁধনে জড়ায়!
৬.
নিশাতের খিদে পেয়ে গেছে। দু-ঘণ্টা পার হলো মাত্র। সময় যেন কাটছেই না। একটা ফাস্ট ফুড কর্নারের খোঁজে বেরুলো সে।
৮.
মাথা ধরে গেছে আবীরের। সোফাটার মাথায় চকচকে স্টিলের রড। ওটায় মাথা চেপে ঘুমিয়েছিল এতক্ষণ। ব্যথা ব্যথা লাগছে। কাছের টয়লেটে গিয়ে মাথায় পানি দিয়ে একটু ভালো লাগতে সে ভাবলো কনসার্টের দিকে যাবে। ব্যাগটা টানতে টানতে এগিয়ে গেল।
৯.
নিয়তি আবারো ফাজলামি করলো। আবীর যখন কনসার্টে গিয়ে বসেছে, নিশাত তখন দেড়শো গজ দূরের একটা ফাস্টফুড কর্নারে একটা স্যান্ডউইচ গেলার চেষ্টা করছে এক গ্লাস কোক দিয়ে।
১০.
ঘড়ি দেখলো আবীর। এখনো বাংলাদেশের সময় দেখাচ্ছে। মনে নেই লোকাল টাইম করতে। করে লাভও নেই। খানিক বাদেই তো আবার বদলে যাবে সময়। খিদে পেয়েছে তারও। এই ব্যাগ বোঁচকা টানতে টানতে খাওয়া দাওয়া যন্ত্রণা লাগে। সে লাউঞ্জের ডানপাশের সারির একটা চেয়ারে ব্যাগগুলো রেখে খাবার উদ্দেশ্যে বেরুলো।
১১.
না, সে নিশাতের ওই ফুড কর্নারের দিকে গেল না। তার পরিচিত চমৎকার একটা সিঙ্গাপুরি ফুড শপ আছে উল্টোদিকে। ওখানে গিয়ে চাওমিন খাবে।
১২.
নিশাত খাওয়া সেরে ভাবলো আরো দেড় ঘণ্টা! এদিকে আসার পথে অর্কিডের বাগান দেখেছিল কোথায় যেন। খুঁজতে গেল সেটা। অর্কিড খুব প্রিয় তার।
১৩.
পেটপুরে চাওমিন খেয়ে আবীর ভাবলো আরো তিন ঘণ্টা বাকী। সময় কাটাবার উপায় কি। মনে পড়লো, ব্রাউজিং কর্নারের কথা। নেট ব্রাউজিং করে নেয়া যাক কিছুক্ষণ। ব্রাউজিং সেন্টারে গিয়ে ঢুকলো সে।
১৪.
অর্কিড দেখে মন ভরে গেল নিশাতের। এখানেও যদি সঙ্গীতের ব্যবস্থা থাকতো। কনসার্টের বাদ্যগুলো কি যে মিষ্টি লেগেছে। এই প্রথম উপভোগ করতে শুরু করেছে সময়টা। অর্কিড দেখা শেষে কনসার্টের দিকে গেল আবার। শেষ সময়টা এখানেই কাটুক। পকেটের ছোট্ট নোটবুক বের করে হাতের নীল পেন্সিলটা দিয়ে গুটিগুটি পায়ে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ বিবরণ লিখতে বসলো। এটা অনেক দিনের পুরোনো অভ্যেস। কোথাও গেলে নোট লেখে সে।
১৫.
নেট সার্ফিং করতে বসে চ্যাটে ঢুকে পুরোনো বন্ধু আরিফকে পেয়ে গেল আবীর। জানা গেল গত বছর দুবাই থেকে কানাডা চলে গেছে সে। একই শহরে আবীরও আসছে জেনে অসম্ভব খুশী হলো এবং গিয়ে তার ওখানে ওঠার জন্য চাপাচাপি করতে লাগলো। এক ঘণ্টার বেশী আড্ডা শেষে ওর ঠিকানা লিখে নিতে গিয়ে খেয়াল হলো কলম নেই। ব্যাগে রয়ে গেছে। আরিফকে অপেক্ষা কতে বলে সে কলমের খোঁজে গেল।
১৬.
নিশাতের ফ্লাইট কল করছে। বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহ করতে হবে। গেট নাম্বারটা দেখে নীল মনিটরের পর্দায়। ডানদিকের চেয়ারে একটা মালিকবিহীন ব্যাগ দেখে বহুবছর আগের ওরকম একটা ব্যাগের কথা মনে পড়লো। নিজের হাতব্যাগটা নিয়ে বামদিকের প্যাসেজ ধরে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলো।
ঠিক একমিনিট পর ডানদিকের প্যাসেজ থেকে দ্রুতপায়ে হেঁটে এলো আবীর। এসে ব্যাগ রাখার জায়গায় গিয়ে ব্যাগের সাইড পকেট থেকে কলমটা বের করে নিল। খেয়াল করলো পাশের সারির একটা চেয়ারে কে যেন একটা নীল পেন্সিল ফেলে গেছে। কলম নিয়ে সে আবার দ্রুত চলে গেল সার্ফিং লাউঞ্জের দিকে।
বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে আজকের একমাত্র ফ্লাইটটি উড়াল দেবার এক ঘণ্টা পরে আবীরের ফ্লাইট কল এলো বোর্ডিং কার্ড সংগ্রহের জন্য। নিশাতের ফ্লাইট যখন বঙ্গোপসাগরেরর প্রান্ত ছুঁয়েছে, আবীরের ফ্লাইট তখন মালয়েশিয়ার আকাশ পেরিয়ে আরো পূর্বদিকের গন্তব্যে। এই প্রথম প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দেবে আবীর।
৩১শে মে ২০১২