১.
একদম ছেলেবেলা থেকেই আমি যাকে বলে আন-এসমাট। সাদাসিদে জামাকাপড়ে সাদাসিদে চালচলন। ফটফটাং করে ফ্যাশান করা হয়নি কখনো। এশমাট শব্দটার উৎপত্তি বলা যাক। আমার পৌঁনে পাঁচ বছরের কন্যা এখনো 'স্মার্ট' শব্দটা উচ্চারণে হিমশিম খায়। এশমাটই চলতে হয়। ওকে শুদ্ধ করতে গিয়ে আক্রান্ত হবার চেয়ে ওর অশুদ্ধ উচ্চারণগুলো আমি চর্চা করি নিরাপত্তার স্বার্থে। এ বয়সী বাচ্চাদের চড়চাপড়খামচিগুলো প্রাণঘাতি না হলেও চেহারার মানচিত্র সাময়িক বদলে দিতে পারে।
বাড়িতে নিজের আর বোনদের সব মিলিয়ে গন্ডাখানেক বাচ্চার সাথে আমার নিয়মিত উঠবস করতে হয়। তাতে দেখেছি। সুবোধ শিশু শব্দটা সোনার পাথরবাটি হয়ে গেছে আজকাল। সবগুলো সাধ্যমতো ইচড়ে পাকা।
সেদিন আমার কন্যা হঠাৎ করে বলে বসলো, "বাবা, তুমি তো ভাইয়ার বউয়ের শ্বশুর হবা, তাই না? মা হবে শাশুড়ি, আর আমি ননদ।" আমার হেঁচকি ওঠার দশা ওর কথা শুনে। ওর ভাইয়া, মানে আমার কনিষ্ঠ সন্তানের বয়স এখনো দুবছর হয়নি, তার বিয়েশাদি সংসার নিয়ে চিন্তা করছে তার তিন বছরের বড় বোনটা।
এই বিচ্ছুগুলোর আগ্রাসী তৎপরতার কারণে বাসায় আমাকে চেহারাটা কঠিন ব্যক্তিত্বের মুখোশে ঢেকে রাখতে হয়। ল্যাপিতে কোন কমেডি ছবি দেখছি, প্রবল হাসি পাচ্ছে, কিন্তু বিচ্ছুগুলো আশেপাশে থাকলে মোটেও হাসিটা বাইরে আনা যাবে না। তলপেটের প্রবল কাঁপুনিতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। নইলে ওরা বুঝে যাবে আমি হালকা মুডে আছি, এসে গলায় ঝুলে একটা খামচি দিয়ে সৌজন্য বিনিময় করবে।
এরকম আপ্যায়ন আমাকে প্রায়ই করে বলে কৃত্রিম ব্যক্তিত্বের দেয়াল তুলে রাখতে হয় সময় সময়। তবু ওরা বিশ্বাস করে না। মাঝে মধ্যেই এসে কেউ না কেউ পেটে একটা খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। এটা হলো উস্কানি টেস্ট। আমাকে চেয়ার থেকে তুলে ওদের পেছনে ছোটার ফাঁদ। কিন্তু আমি ফাঁদে পা দেই না। সাবধানে থাকি। যখন ভাবি ছবিটা না দেখে ওঠা যাবে না, তখন বিরাট ঝাড়ি, যা ভাগ, আমি অফিসের কাজ করছি।
সবচেয়ে ফাজিল হলো আমার কন্যা। একথা শুনে ও গিয়ে বাকীদের কানে কানে বলবে, বাবা অফিসের কাজ না, মুভি দেখছে কিন্তু।
এরপর বাকী দলবল মিছিল করে পেছনে দাড়িয়ে বলবে, আমাদের জন্যও মুভি ছাড়ো, আমরাও দেখবো।
আমাকে তখন ল্যাপির ডালা নামিয়ে বলতে, হয়, টিভিতে কার্টুন নাই? ওখানে গিয়ে দেখ। ত্যাঁদড়গুলো তবু যাবে না। তারপর আমাকে খরখর কন্ঠে ঝাড়তে হয়, ঐ গেলি!!! এরকম ঝাড়ির পর মুভি দেখার মুড থাকে আর?
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন শিশুদের প্রতি আমি মোটেও দয়াশীল না, তবু বিচ্ছুগুলো আমাকে পাত্তা দেয় না। প্রায়ই ছোটখাট যুদ্ধ লেগে থেকে। ওরা ভাবে আমি লোকটা আসলে ততটা নির্মম না। সমস্তটাই ভাণ। আমার কানটা মুচড়ে দিলে ব্যক্তিত্বের রোগ সেরে যাবে। একদম কনিষ্ঠজন এসে সত্যি সত্যি কানটা মুচড়ে ধরে।
২.
কিন্তু দিন এরকম ছিল না চিরকাল। শিশুরা একসময় সত্যি সুশীল ছিল। বড়দের প্রতি দয়ালু ও সহনশীল ছিল। আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসা পেয়েছি শিশুদের কাছ থেকেই। আমি যখন ইন্টার শেষ করেছি, তখন আমার সবচেয়ে কনিষ্ঠ বোন দিশার জন্ম। ওর মতো বুদ্ধিমতি অথচ সুবোধ শিশু খুব কমই দেখেছি। বোনদের মধ্যে একদম ছেলেবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত ও আমার সবচেয়ে প্রিয়। সেদিনের পিচ্চি দিশাটা এই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দেবে, ভাবা যায়? আমাদের বয়সের ব্যবধান ১৮ বছরের। কিন্তু পিচ্চিকাল থেকে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব। আমি যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকি, অফিসে খুব কষ্টকর সময়। প্রায় চোদ্দ পনের ঘন্টা ডিউটি শেষ করে ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম, ওকে দেখে সব ক্লান্তি উধাও। ও তখন ক্লাস থ্রীতে পড়ে। আমি অফিস থেকে ফেরার পর গোসল খাওয়া সেরে ওকে অফিসের গল্প শোনাতে হতো। ও খুটিয়ে খুটিয়ে সব জেনে নিত, তারপর মাকে রিপোর্ট করতো।
একদিন বাসায় ফিরে দেখি, দিশা নেই। কোথায়? মামার বাসায় বেড়াতে গেছে। রাতে ফিরবে না। সমবয়সী মামাতো বোনের সাথে থাকবে। কাছেই মামার বাসাটা, এক কিলোমিটারের মধ্যে। রাত দশটা বাজে তখন। কথা শেখার পর থেকে ওর সাথে গল্প না করে, ওকে না দেখে ঘুমোইনি কোনদিন। সেদিন ও না থাকাটা কেমন লাগলো। আমি খেয়েই মামার বাসায় ছুটি। দুভাইবোন দশ মিনিট গল্প করে, ফিরে এলাম আমি। দিশার কল্যানে আশেপাশে যত পিচ্চিপাচ্চি ছিল সবগুলোর কমন ভাইয়া ছিলাম আমি। রাস্তায় বেরুলে ভাইয়া, ভাইয়া বলে চিৎকার করছে হরেক শিশু, এই দৃশ্যটা খুব স্বাভাবিক ছিল। শিশুদের ভালোবাসা আমি বরাবর পেয়ে আসছি।
এই ৪২ বছর বয়সেও সেই ভাগ্যটা ছাড়েনি আমাকে। কর্মক্ষেত্রে স্যার বলার নিয়ম থাকলেও সেটা স্বচ্ছন্দে লংঘন করে অনেকেই ভাই সম্বোধন করে। ব্লগেও আমাকে ভাইয়া হিসেবে নিয়েছে অনেকেই। পিচ্চি এক সহব্লগার সেটাকে রীতিমতো শিল্পের কাতারে নিয়ে গেছে। কেবল দোকানী ছোকরাগুলো ভাইয়া বদলে আংকেল ডাকা শুরু করেছে কিছুদিন আগে থেকে। নইলে দুনিয়াশুদ্ধ আমি ভাইয়া। এই ভাইয়া ডাকটাকে আমি সম্মান হিসেবে গ্রহন করি। মজা হয়েছিল একবার।
একবার সপরিবারে একটা ব্লগার আড্ডায় গেলাম। সেখানে নতুন পরিচয় হয়েছে এক ব্লগারের সাথে। সে বললো, আপনার লেখা পড়ে আপনাকে অনেক কম বয়সী ভেবেছিলাম। এখন দেখি আপনার বয়স অনেক। কানাকে কানা বললে যেমন লাগে, আমার তেমন লাগলেও করার কিছু নাই। তবু বললাম, কতো ভেবেছিলে আমাকে? সে বললো, ভেবেছিলাম বিশ বাইশ বছরের তরুন। ভয়ে ভয়ে জিগাই, এখন কতো লাগে? সে বললো, আপনি কমপক্ষে ত্রিশ বছর, দুবছর বেশীও হতে পারি অসম্ভব না। উপস্থিত পূর্বপরিচিত ব্লগারগন হেসে খুন হলো শুনে। আমার কলিজায় পানি আসলো, বললাম, আমার কাছ থেকে আপনার এক প্লেট বিরিয়ানী পাওনা হলো। আপনার মুখে ফুলচন্দন। বউকে ডেকে বললাম, আজম কি বলেছে শুনে নাও আবার।
সেদিন এক আত্মীয়বাড়ি গেছি দাওয়াতে। গিয়ে দেখি একপাল ছেলেপেলে। সব এই যুগের। আমি সাবধান হয়ে গেলাম। ব্যক্তিত্বের মুখোশে ঢুকে গেলাম। পিচ্চিপাচ্চিগুলো সব দুষ্টুমিতে ব্যস্ত। আমাকে তেমন গুনছে না দেখে স্বস্তি পেলাম। ভদ্র আছে বাচ্চাগুলো। হয়তো সম্পর্কে আমি ওদের আংকেল বলেই। ওদের বাবা মায়ের সাথেই আড্ডা হচ্ছে আমার। কিন্তু দাওয়াত শেষে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠছে ওরা, এমন সময় পিচ্চি গুলো সম্মিলিত ভাবে চিৎকার করে আমার নাম ধরে ছড়া কাটতে শুরু করলো,
আবুল হোসেন ভাইয়া!!
কেমন আছেন খাইয়া?
বাই বাই, খোদা হাফেজ,
এবার আমরা যাইগা!
No comments:
Post a Comment