Sunday, July 17, 2011

গাচ্ছাতা

বাস থেকে নেমে পূব দিকে যে পাকা রাস্তাটা চলে গেছে, সেদিকে মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে মাইল দুয়েক গেলেই বন্য হাতির এলাকা। কয়েকশো বর্গমাইল জুড়ে আদিম অরণ্য, বন্যপ্রানীদের স্বাধীন বিচরণ। পাহাড় থেকে এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে স্বচ্ছ জলের ঝরনা। একদা হরিণের পদচারণা ছিল ঝরনার কিনারে। এখন তারা আরো গহীনে হারিয়ে গেছে। তার বদলে কেবল ক্ষুধার্ত হাতির দলই নেমে আসে মাঝে মাঝে। এই পথটা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষদের। আমি নিরাপদ অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় লোক হলেও এই বরষায় ওদিকটায় যেতে ভরসা পাচ্ছি না। আজ বরং উল্টোদিকে যাই, যেদিকে দুপেয়ে সভ্য মানুষের বসতি।

প্রধান সড়কে খরনা রাস্তার মাথায় নেমে পশ্চিমদিকে যে ইট বিছানো পথটা গেছে সেদিকে হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে তিনশো গজের মতো গেলেই লোকালয়, মানুষের কাঁচাপাকা ঘরবসতি, নিকোনো উঠোন, খড়ের গাদা, ধানের গোলা, টলমলে জলের পদ্মপুকুর, পুকুর থেকে মাঝে মাঝে লাফ দিচ্ছে রুই কাতলা মৃগেলের বাচ্চাগুলো।

এই পাড়ায় আমাদের পূর্বপুরুষের বাস ছিল, এখনো বাস করে অনেক ঘর উত্তরপুরুষ আত্মীয়। আমরা গ্রামে ঢুকবো না এই অসময়ে, দুপুরের ভাতঘুমে নিথর পাড়াগাঁ লোক। আমরা বরং পা টিপে টিপে পাড়াকে বাঁয়ে রেখে খরনা খালের ধার নিয়ে হেঁটে পাড়ার পেছন দিকটায় চলে যাই।

মানুষের ঘরবাড়ী থেকে একটু তফাত জায়গার এখানে সবুজ ঘন একটা বাঁশবন, তার মাঝ দিয়ে বালির পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পাহাড়ী ছড়া, পুবদিকের অরণ্যঘেরা যে পাহাড় থেকে এই জলধারা নেমে আসছে সেই অপরূপ সবুজ পাহাড়গুলো দেখা যাবে বাঁশবনের ফাকে একটু উঁকি দিলেই। বাঁশবনের সেই ফিসফিস নির্জনতার মাঝে মাঝে মাঝেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশছোঁয়া শিরীষ গাছ, আম, জাম, গাব, তুলা সহ আরো নানান জাতের চেনা অচেনা প্রাচীন বৃক্ষ। নির্জন দুপুরে মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে বউ কথা কও কিংবা বিষন্ন কোন ঘুঘু। বিশাল সেই ছায়ার রাজ্যে গা এলিয়ে বসলেই আবেশে চোখদুটো মুদে আসবে পরম সুখে।

বেলা দুপুর। আকাশে মেঘের ছাতা। বাতাসে গতরাতের বৃষ্টির সোঁদা মিষ্টি গন্ধে তখনো ম ম চারপাশ। পুরো বাঁশবন জুড়ে বালিয়াড়ি। সাদা ঝুরঝুরে বালিতে পায়ের তালু ডুবে যাবে। দুপায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে শুকনো বালি। হাঁটতে হাঁটতে বনের শেষ প্রান্তে এসে থমকে দাঁড়াবো আমরা। আরো সামনে যেতে হলে হাটু জলের ছড়াটা পার হতে হবে। স্বচ্ছ জলধারায় ভালো করে খেয়াল করলে দেখবে অসংখ্য মলা পুটি চিংড়ির পোনা খেলতে খেলতে চলে যাচ্ছে ভাটির দিকে। পানি আরেকটু বাড়লে বিশাল বড় বোয়াল মাছও দেখা যাবে। বর্ষাজুড়ে মাছ ধরার উৎসব চলে এই খালের ধারে। এখান থেকে সোজা পশ্চিমে তাকালে একটা দীঘির নির্জন পাড়। দীঘির পাড়ে সারি সারি প্রাচীন বৃক্ষ সটান দাঁড়িয়ে।

ওই পাড়ে যাবো না আমরা। কারণ হঠাৎ করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। মাথার উপর বড় বড় গাছ, তাই টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঝুমঝুমিয়ে কুকুর-বিড়াল নামতে শুরু করবে, তখন আশ্রয়ের খোঁজ করতে হবে। এরকম নির্জন বনে আশ্রয় কই? ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরতে হবে ভেবে মনটা দমে যাচ্ছে?

না! মোটেও হতাশ হবে না। আরেকটু এগিয়ে হাতের ডানে তাকালেই চোখে পড়বে সেই গাছটি। বিশাল একটা তুলাগাছ। অদ্ভুত চেহারার কান্ডটা। গোড়ার দিকে দুটো দেয়ালের মতো চ্যাপটা দেয়াল বেড়িয়ে একটা গুহার সৃষ্টি করেছে। ওখানে অনায়াসেই বড়সড় একজন মানুষ হারিয়ে যেতে পারে। পাতলা শরীরের দুজনও হারাতে পারবে। যতই বৃষ্টি হোক, ওখানে কেউ ভিজবে না। এক ছুটে নিরাপদ ওই আশ্রয়ে গিয়ে দাঁড়াবো আমরা। এখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখার সুখ অতুলনীয়। যত বৃষ্টিই হোক সরাসরি জল ঝরবে না মাথার উপর। শীতল বাতাসের ঝাপটায় গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাবে। আনন্দ শিহরন। চকচকে পাতার উপর টুপটুপ করে ঝরতে থাকা দুপুরিয়া বৃষ্টিটা দেখতে থাকো। বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে ওদিকে দেখা যাবে কল কল করে বয়ে চলা ঝরনার জলও।

একটু পরেই বৃষ্টি থেমে যাবে। বৃষ্টি থামলেও বেরুতে ইচ্ছে করবে না সেই আশ্রয় ছেড়ে। বেরিও না। দাঁড়িয়ে থাকো। আর একেকটা দমে বুক ভরে নাও বিশুদ্ধ বাতাস, প্রতিটা নিঃশ্বাসে তুমি হয়ে যাবে আপাদমস্তক শুদ্ধ মানুষ। বিশ্বাস করো এখানে দাঁড়িয়ে তুমি অতীতের সকল গ্লানি দুঃসময়কে ক্ষমা করে দেবে অবলীলায়।

ছেলেবেলায় আমার অনেক নিটোল দুপুর কেটেছে এই গাছের আশ্রয়ে! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর গাছটির কাছে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কারণ তুমি এই গ্রামটিকে খুব ভালোবাসো। সেই গাছটার নীচে তোমাকে একটিবার দাঁড় করিয়ে বৃষ্টির ঘ্রান নেবার সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম।

আরেকটা অপূর্ণ স্বপ্ন। তোমাকে ওই স্বপ্নময় ভ্রমণের লোভ দেখানোর জন্য আমি খুবই দুঃখিত, ব্যথিত। মাত্র কদিন আগে গ্রামে গিয়ে দেখে এসেছি সেই গাছটির জায়গায় আকাশটা বড় রকমের উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এত মানুষকে এত বছর আশ্রয় দিয়েও গাছটির জীবন হেরে গেছে জ্বালানী কিংবা আসবাবের দৈনন্দিন প্রয়োজনের কাছে।

আমার ছেলেবেলার গাচ্ছাতাটি আমি আর কখনোই ফিরে পাবো না।

No comments: