* জীবনটা একটা খসড়া কাগজের মতো। বারবার লিখে ফাইনাল করতে চাই, কিন্তু ফাইনাল করার আগেই আমরা নাই।
* অসম্পূর্নতা কি একটা প্রাপ্তি হতে পারে? নাকি তৃপ্তি? অতৃপ্ত মানুষ সুখী হয় কি করে? কেউ কেউ অতৃপ্ত এবং সুখী দুটোই। কিরকম বৈপরীত্য না?
* মিথ্যেও কখনো কখনো সুখের কারন হতে পারে, সুখী করতে পারে তেমন মিথ্যাও কি বর্জনীয়?
* যার সব পাওয়া হয়ে যায়, সে তো কেবলই দেনাদার, তাই না?
* কাঠপেন্সিলে হাতের লেখা খুব ভালো হয়, কিন্তু কাঠপেন্সিল রেখে কলম দিয়েই লিখতে হয়, কারন পেন্সিলের লেখা সুন্দর হলেও ক্ষণস্থায়ী।
* চা এবং কফি দুটোর মধ্যে চা বেশী খাই, কফি কম। চায়ে চিনি না দিলেও অত তেতো লাগে না, কিন্তু চিনি ছাড়া কফি মুখে তুলতে পারি না।
* অন্ধকারে ভাবতে ভালোবাসি, কিন্তু ভাবনাটা লিখতে গেলে আলো জ্বালাতে হয়, আর আলো জ্বললেই ভাবনা হারিয়ে যায়।
* যে আমাকে চায় সে আমার পেছনে ছোটে, আমি তার দিকে ফিরেও তাকাই না। আমি যাকে চাই তার পেছনে ছুটি আমি,সে আমাকে ফিরেও চায় না।
* ভুল করার পর ভুলের যৌক্তিকতা খুঁজে বের করার প্রবণতা খুব ভয়ংকর।
* দুর্লভের প্রতি মানুষের লোভ,সেটা সস্তা হলেও।
* সুলভের প্রতি মানুষের অবহেলা, সেটা দামী হলেও
* সব পাওয়া হয়ে যাওয়ার মতো দুর্ভাগ্য আর কি আছে, সব কিছু নিয়ে হতাশাময় জীবন
* নারী অনেক বেশী প্রেম নিয়েই নির্বাক থাকে, পুরুষ অতি নগন্য প্রেমানুভুতি নিয়েও মহাকাব্য রচনা করে ফেলে।
* পুরুষ জন্মগতভাবেই বহুগামী। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত অজুহাত।
* ভালোবাসা আকাশমুখী, তাই মেঘ দেখলে বিরহ উথলে ওঠে।
Wednesday, May 18, 2011
Saturday, May 14, 2011
ক্ষ্যাপা খুঁজে মরে
চুম্বক বস্তুটা লোহার পাশাপাশি এক আদম সন্তানকেও আকর্ষণ করা শুরু করে তার শৈশবেই। আদম সন্তানটি যখন বালকাবস্থা অতিক্রম করছে, তখন তাদের বাসার চৌকির নীচে স্মতিময় রেডিওটা বিকল হয়ে পড়ে ছিল।
এই রেডিওটা তাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় একমাত্র সংবাদদাতা ছিল। গ্রামের মানুষ বাড়ীর পেছনে লুকিয়ে গোল হয়ে এই রেডিওকে ঘিরে বসে যুদ্ধের খবরাখবর শুনতো। বাড়ীতে বোমা পড়ার সম্ভাবনা দেখলে গৃহকর্তা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে পেছনের পুকুরে লুকিয়ে ডুব দিতে যাবার সময় রেডিওটাও নিয়ে যেতেন এবং পুকুরের কিনারের দিকে পাটিপাতার ঝোপের আড়ালে ভেসে থাকা দুটো গোলাকার মাথার পাশাপাশি যে একটা চারকোনা মাথা দেখা যেতো সেটা এই রেডিও।
স্বাধীনতার কয়েক বছর পর রেডিওটা যখন বিকল হলো ততদিনে ঘরে ঘরে রেডিও চলে এসেছে, আগের কদর আর নেই। এমনকি টেলিভিশনও শহরের আনাচে কানাচে দুয়েকটা চলে আসছিল। কলোনীর দেড় হাজার বাসিন্দার মধ্যে অন্ততঃ পনেরো বিশজনের বাসায় ন্যাশনাল বা ফিলিপস কিংবা জেভিসি টেলিভিশন চলে এসেছে। বালকের ঘরেও একখানা ১২ইঞ্চি টিভি আর একখানা টেপরেকর্ডার চলে এসেছে। টেপরেকর্ডারের মধ্যে আবার একটা রেডিও সেট করা আছে। ওটাকে 'টুইনওয়ান' বলা হতো। তাই সবুজ রেডিওটা নষ্ট হলেও মেরামতের দোকানে না গিয়ে খাটের নীচে আশ্রয় গ্রহন করে এবং কিছুকাল পর ওটার স্পীকারের খোলটা তেলাপোকার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
বালক একদিন খাটের নীচে খেলতে গিয়ে সেই রেডিওতে তেলাপোকার বেডরুম, বাথরুম সব আবিষ্কার করার পর বুঝতে পারে এই বস্তুর বেইল আর নাই। ইঞ্জিনিয়ার হবার বাসনায় যে কোন যন্ত্রপাতির প্রতি তার অমোঘ আকর্ষণ তখন। যে কোন খেলনা হাতে পেলে, খেলতে শুরু করার আগে ওটার কোন স্ক্রু দিয়ে কতটা অংশ খুলে আলগা ফেলা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, এবং খেলনার প্রাণবায়ু থাকা পর্যন্ত আবিষ্কার চলতেই থাকে। একসময় খেলনার লাশকে নিয়ে পোষ্টমর্টেমও করতে শুরু করে।
শতশত খেলনার পোষ্টমর্টেম করলেও সবুজ রেডিওটার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস হয়নি মারের ভয়ে। সেদিন রেডিওটার বেইল নাই বুঝতে পারার পরই শুরু হয় স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে অপারেশান রেডিও বাংলাদেশ। মনে আছে এটাতেই ভর দুপুরে বাজতো একসময়, বিজ্ঞাপন তরঙ্গ।
রেডিওটাকে যত টুকরায় খোলা যায় সব খোলার পর যে আবিষ্কারের নেশায় বালকের মাথা বুঁদ হয়ে আছে সেটা হলো শব্দ নির্গমন যন্ত্র। মানে স্পীকার। ওই দিক থেকে শব্দ বের হতে দেখেছে সে। কিভাবে শব্দ ওখান থেকে নির্গত হয় সেটা বিরাট কৌতুহলের ব্যাপার।
দেখা গেল স্পীকারটা গোলাকার কালো রঙের একটা ছোট কালো কড়াইর মতো বস্তু। কিন্তু কড়াইটা নরম জিনিস দিয়ে তৈরী। ঠিক কাপড়ও না, আবার কাগজও না। ওটার গায়ে তেলাপোকার ডিমগুলো সারিবদ্ধভাবে আশ্রয় নিয়েছে।
বালক খুটিয়ে খুটিয়ে সব তেলাপোকার ডিমগুলোকে উচ্ছেদ করে গোলাকার জিনিসটাকে রেডিও থেকে আলগা করে নেয়। ওটার মাঝখানটা বেশ ভারী। মাঝখানে গোলাকার লোহার তৈরী একটা বস্তু। পেছনে ইংরেজীতি হাবিজাবি লেখা। তারপর সে গোলাকার বস্তুটাকে এই নরম কড়াই থেকে আলাদা করার বাসনায় স্ক্রু ড্রাইভারটা কাছে নিতেই ঠকাশ করে লোহার সাথে আটকে গেল স্ক্রু ড্রাইভার। টেনে তুলতে গেলেও আবার ঠকাস। আরে, আজব জিনিস তো!
অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের আনন্দে বালক নিজেকে নিউটন ভাবতে শুরু করে। সে স্ক্রু ড্রাইভার আর গোলাকার বস্তুটা নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে সারা বিকেল। খেলতে খেলতে বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই জিনিসটা যথাস্থানে রেখে দেয়। পরদিন থেকে আবারো রহস্য নিয়ে খেলা। কিন্তু রহস্যটা কাউকে খুলে বলতে পারছে না বলে শান্তি পাচ্ছে না।
একদিন সাহস করে পাশের বাসার মারুফকে দেখালো। মারুফ এসব ব্যাপারে আইনস্টাইন কিংবা স্টিফেন হকিং। সে দেখা মাত্র জিনিসটা চিনলো। বললো, আরে এটা তো 'চম্বুক'। বালক অবাক হয়ে বলে, 'চম্বুক' কি। মারুফ তাকে ছোটখাট একটা বৈজ্ঞানিক লেকচার দিল এবং দুজনে সমবেতভাবে 'চম্বুক' গবেষণায় লেগে গেল।
'চম্বুক'এর প্রতি সেই যে আকর্ষণের যাত্রা, এটা অনেক বছর ছিল। তারপর দিন থেকে নতুন 'চম্বুক' খোজার পালা। মারুফ জানিয়েছে 'চম্বুক' যেমন আকর্ষণ করে, তেমন বিকর্ষণও করে। কারণ চম্বুকের মেরু আছে। সুতরাং ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য আরো একটা চম্বুক শীঘ্রি যোগাড় করা আবশ্যক। ঘরের বাইরে বের হলেই বালকের চোখ চম্বুক খোঁজে।
যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই.....এই কবিতা তখনো পড়া না হলেও যে কোন জায়গায় চকচকে কিছু দেখলেই ওটা ছুটে গিয়ে নিয়ে আসতো। রাতে ঘরের বাইরে গেলে, রাস্তার বাতির আলোয় চকচকে জিনিসের খোজ করতো অনবরত। বালির ভেতর যে কতো চকমকে জিনিস, কেউ জানেই না। তার ছোট চোখ দিয়ে সে বিরাট জগত আবিষ্কার করতো। কিন্তু চকচকে জিনিসগুলো কাছে গেলেই গায়েব। অথচ দূর থেকে অনেক বড় চকচকে বস্তু মনে হতো। বড় হয়ে জেনেছে। ওই সব জিনিস বালির খনিজ। কেবল আলোর প্রতিফলনেই দেখা যাবে, হাতে নেয়া যাবে না।
কিন্তু চম্বুক হাতে নেয়া সম্ভব। তাই মনিমুক্তা বাদ দিয়ে শুরু হলো চম্বুক খোজার পালা। একদিন বাবা জিজ্ঞেস করলো, কি এত খুঁজিস?
প্রথম বলতে চায় না সে। কিন্তু বাবা খুব জোরাজুরি করাতে বলতে বাধ্য হলো 'চম্বুক' খুঁজি। বাবা অবাক। 'চম্বুক' কি? সে বুঝিয়ে বলে আজব জিনিস চম্বুকের কথা। বাবা শুনে হো হো করে হাসতে থাকে। বলে, বোকা, ওটা তো 'চম্বুক' না, ওটাকে বলে 'চুম্বক'। সে বাবার কথা চুপচাপ মেনে নেয়। কিন্তু 'চুম্বক' বা 'চম্বুক' জিনিসটা যে সে কিভাবে আবিষ্কার করেছে সেটা বলার জন্য গলা পর্যন্ত কথা এসে আটকে গেল। রেডিওর এই দশা জানতে পারলে পিটিয়ে তার পেট থেকে নাড়িভুড়ি খুঁড়ে'চম্বুক' বের করে ফেলবে। চেপে যায় আবিষ্কারের কাহিনী।
চুম্বক খুঁজতে খুঁজতে আরো অনেক আবিষ্কার হয়ে গেলেও বালকের সেই কৌতুহল একেবারে চলে যায়নি।
বহুবছর পরেও বালক যখন তেত্রিশ বছরের পরিপূর্ণ মানুষ দেখা গেল এক দুপুরে কক্সবাজার সৈকতে একাকী হাঁটতে গিয়ে বালিতে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কলাতলী সৈকতের একপাশে কালো কালো বালির স্তুপ দেখে অবাক তাকিয়ে থাকে। তারপর দুই মুঠো কালো বালি পকেটে নিয়ে হোটেলে চলে আসে।
শহরে ফেরার পর বাসায় সেই বালি খবরের কাগজে ছড়িয়ে দিয়ে ছেলেবেলার সেই রেডিও চুম্বকটা বের করে। তারপর ওটাকে কালো বালির উপর ধরতোই কালো দানাগুলো সব খাড়া হয়ে গেল এক সারিতে, চুম্বকটা কাছে নিতেই সবগুলো এক লাফে সেই চুম্বকের বুকে উঠে এল। বালকের পুরোনো মুগ্ধতা ফিরে এলো ঝুপ করে।
যুবক তার বুয়েট বন্ধুর সাথে আলাপে জেনে যায় তার নতুন আবিষ্কৃত বস্তু বাংলাদেশের এক মহামূল্যবান খনিজ যাকে আদর করে ডাকা হয় ব্ল্যাক গোল্ড। অনাদরে অবহেলায় এই মূল্যবান খনিজ আহরিত হবার বদলে হোটেল মোটেলের নীচে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। নতুন এক সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবক ভাবলো, আবিষ্কারের সীমা নেই, শেষ নেই, বয়স নেই। তবু ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে।
এই রেডিওটা তাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় একমাত্র সংবাদদাতা ছিল। গ্রামের মানুষ বাড়ীর পেছনে লুকিয়ে গোল হয়ে এই রেডিওকে ঘিরে বসে যুদ্ধের খবরাখবর শুনতো। বাড়ীতে বোমা পড়ার সম্ভাবনা দেখলে গৃহকর্তা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে পেছনের পুকুরে লুকিয়ে ডুব দিতে যাবার সময় রেডিওটাও নিয়ে যেতেন এবং পুকুরের কিনারের দিকে পাটিপাতার ঝোপের আড়ালে ভেসে থাকা দুটো গোলাকার মাথার পাশাপাশি যে একটা চারকোনা মাথা দেখা যেতো সেটা এই রেডিও।
স্বাধীনতার কয়েক বছর পর রেডিওটা যখন বিকল হলো ততদিনে ঘরে ঘরে রেডিও চলে এসেছে, আগের কদর আর নেই। এমনকি টেলিভিশনও শহরের আনাচে কানাচে দুয়েকটা চলে আসছিল। কলোনীর দেড় হাজার বাসিন্দার মধ্যে অন্ততঃ পনেরো বিশজনের বাসায় ন্যাশনাল বা ফিলিপস কিংবা জেভিসি টেলিভিশন চলে এসেছে। বালকের ঘরেও একখানা ১২ইঞ্চি টিভি আর একখানা টেপরেকর্ডার চলে এসেছে। টেপরেকর্ডারের মধ্যে আবার একটা রেডিও সেট করা আছে। ওটাকে 'টুইনওয়ান' বলা হতো। তাই সবুজ রেডিওটা নষ্ট হলেও মেরামতের দোকানে না গিয়ে খাটের নীচে আশ্রয় গ্রহন করে এবং কিছুকাল পর ওটার স্পীকারের খোলটা তেলাপোকার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
বালক একদিন খাটের নীচে খেলতে গিয়ে সেই রেডিওতে তেলাপোকার বেডরুম, বাথরুম সব আবিষ্কার করার পর বুঝতে পারে এই বস্তুর বেইল আর নাই। ইঞ্জিনিয়ার হবার বাসনায় যে কোন যন্ত্রপাতির প্রতি তার অমোঘ আকর্ষণ তখন। যে কোন খেলনা হাতে পেলে, খেলতে শুরু করার আগে ওটার কোন স্ক্রু দিয়ে কতটা অংশ খুলে আলগা ফেলা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, এবং খেলনার প্রাণবায়ু থাকা পর্যন্ত আবিষ্কার চলতেই থাকে। একসময় খেলনার লাশকে নিয়ে পোষ্টমর্টেমও করতে শুরু করে।
শতশত খেলনার পোষ্টমর্টেম করলেও সবুজ রেডিওটার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস হয়নি মারের ভয়ে। সেদিন রেডিওটার বেইল নাই বুঝতে পারার পরই শুরু হয় স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে অপারেশান রেডিও বাংলাদেশ। মনে আছে এটাতেই ভর দুপুরে বাজতো একসময়, বিজ্ঞাপন তরঙ্গ।
রেডিওটাকে যত টুকরায় খোলা যায় সব খোলার পর যে আবিষ্কারের নেশায় বালকের মাথা বুঁদ হয়ে আছে সেটা হলো শব্দ নির্গমন যন্ত্র। মানে স্পীকার। ওই দিক থেকে শব্দ বের হতে দেখেছে সে। কিভাবে শব্দ ওখান থেকে নির্গত হয় সেটা বিরাট কৌতুহলের ব্যাপার।
দেখা গেল স্পীকারটা গোলাকার কালো রঙের একটা ছোট কালো কড়াইর মতো বস্তু। কিন্তু কড়াইটা নরম জিনিস দিয়ে তৈরী। ঠিক কাপড়ও না, আবার কাগজও না। ওটার গায়ে তেলাপোকার ডিমগুলো সারিবদ্ধভাবে আশ্রয় নিয়েছে।
বালক খুটিয়ে খুটিয়ে সব তেলাপোকার ডিমগুলোকে উচ্ছেদ করে গোলাকার জিনিসটাকে রেডিও থেকে আলগা করে নেয়। ওটার মাঝখানটা বেশ ভারী। মাঝখানে গোলাকার লোহার তৈরী একটা বস্তু। পেছনে ইংরেজীতি হাবিজাবি লেখা। তারপর সে গোলাকার বস্তুটাকে এই নরম কড়াই থেকে আলাদা করার বাসনায় স্ক্রু ড্রাইভারটা কাছে নিতেই ঠকাশ করে লোহার সাথে আটকে গেল স্ক্রু ড্রাইভার। টেনে তুলতে গেলেও আবার ঠকাস। আরে, আজব জিনিস তো!
অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের আনন্দে বালক নিজেকে নিউটন ভাবতে শুরু করে। সে স্ক্রু ড্রাইভার আর গোলাকার বস্তুটা নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে সারা বিকেল। খেলতে খেলতে বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই জিনিসটা যথাস্থানে রেখে দেয়। পরদিন থেকে আবারো রহস্য নিয়ে খেলা। কিন্তু রহস্যটা কাউকে খুলে বলতে পারছে না বলে শান্তি পাচ্ছে না।
একদিন সাহস করে পাশের বাসার মারুফকে দেখালো। মারুফ এসব ব্যাপারে আইনস্টাইন কিংবা স্টিফেন হকিং। সে দেখা মাত্র জিনিসটা চিনলো। বললো, আরে এটা তো 'চম্বুক'। বালক অবাক হয়ে বলে, 'চম্বুক' কি। মারুফ তাকে ছোটখাট একটা বৈজ্ঞানিক লেকচার দিল এবং দুজনে সমবেতভাবে 'চম্বুক' গবেষণায় লেগে গেল।
'চম্বুক'এর প্রতি সেই যে আকর্ষণের যাত্রা, এটা অনেক বছর ছিল। তারপর দিন থেকে নতুন 'চম্বুক' খোজার পালা। মারুফ জানিয়েছে 'চম্বুক' যেমন আকর্ষণ করে, তেমন বিকর্ষণও করে। কারণ চম্বুকের মেরু আছে। সুতরাং ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য আরো একটা চম্বুক শীঘ্রি যোগাড় করা আবশ্যক। ঘরের বাইরে বের হলেই বালকের চোখ চম্বুক খোঁজে।
যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই.....এই কবিতা তখনো পড়া না হলেও যে কোন জায়গায় চকচকে কিছু দেখলেই ওটা ছুটে গিয়ে নিয়ে আসতো। রাতে ঘরের বাইরে গেলে, রাস্তার বাতির আলোয় চকচকে জিনিসের খোজ করতো অনবরত। বালির ভেতর যে কতো চকমকে জিনিস, কেউ জানেই না। তার ছোট চোখ দিয়ে সে বিরাট জগত আবিষ্কার করতো। কিন্তু চকচকে জিনিসগুলো কাছে গেলেই গায়েব। অথচ দূর থেকে অনেক বড় চকচকে বস্তু মনে হতো। বড় হয়ে জেনেছে। ওই সব জিনিস বালির খনিজ। কেবল আলোর প্রতিফলনেই দেখা যাবে, হাতে নেয়া যাবে না।
কিন্তু চম্বুক হাতে নেয়া সম্ভব। তাই মনিমুক্তা বাদ দিয়ে শুরু হলো চম্বুক খোজার পালা। একদিন বাবা জিজ্ঞেস করলো, কি এত খুঁজিস?
প্রথম বলতে চায় না সে। কিন্তু বাবা খুব জোরাজুরি করাতে বলতে বাধ্য হলো 'চম্বুক' খুঁজি। বাবা অবাক। 'চম্বুক' কি? সে বুঝিয়ে বলে আজব জিনিস চম্বুকের কথা। বাবা শুনে হো হো করে হাসতে থাকে। বলে, বোকা, ওটা তো 'চম্বুক' না, ওটাকে বলে 'চুম্বক'। সে বাবার কথা চুপচাপ মেনে নেয়। কিন্তু 'চুম্বক' বা 'চম্বুক' জিনিসটা যে সে কিভাবে আবিষ্কার করেছে সেটা বলার জন্য গলা পর্যন্ত কথা এসে আটকে গেল। রেডিওর এই দশা জানতে পারলে পিটিয়ে তার পেট থেকে নাড়িভুড়ি খুঁড়ে'চম্বুক' বের করে ফেলবে। চেপে যায় আবিষ্কারের কাহিনী।
চুম্বক খুঁজতে খুঁজতে আরো অনেক আবিষ্কার হয়ে গেলেও বালকের সেই কৌতুহল একেবারে চলে যায়নি।
বহুবছর পরেও বালক যখন তেত্রিশ বছরের পরিপূর্ণ মানুষ দেখা গেল এক দুপুরে কক্সবাজার সৈকতে একাকী হাঁটতে গিয়ে বালিতে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কলাতলী সৈকতের একপাশে কালো কালো বালির স্তুপ দেখে অবাক তাকিয়ে থাকে। তারপর দুই মুঠো কালো বালি পকেটে নিয়ে হোটেলে চলে আসে।
শহরে ফেরার পর বাসায় সেই বালি খবরের কাগজে ছড়িয়ে দিয়ে ছেলেবেলার সেই রেডিও চুম্বকটা বের করে। তারপর ওটাকে কালো বালির উপর ধরতোই কালো দানাগুলো সব খাড়া হয়ে গেল এক সারিতে, চুম্বকটা কাছে নিতেই সবগুলো এক লাফে সেই চুম্বকের বুকে উঠে এল। বালকের পুরোনো মুগ্ধতা ফিরে এলো ঝুপ করে।
যুবক তার বুয়েট বন্ধুর সাথে আলাপে জেনে যায় তার নতুন আবিষ্কৃত বস্তু বাংলাদেশের এক মহামূল্যবান খনিজ যাকে আদর করে ডাকা হয় ব্ল্যাক গোল্ড। অনাদরে অবহেলায় এই মূল্যবান খনিজ আহরিত হবার বদলে হোটেল মোটেলের নীচে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। নতুন এক সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবক ভাবলো, আবিষ্কারের সীমা নেই, শেষ নেই, বয়স নেই। তবু ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে।
Wednesday, May 4, 2011
ব্যাড সেক্টরে আক্রান্ত মগজের মেমোরি কার্ড থেকে
ক.
অনেক কিছু মনে নেই। স্রেফ ভুলে গেছি অনেক গুরুত্বপূর্ন ঘটনা, দিন, কাল। অথচ একদম নগণ্য কিছু স্মৃতি মগজের নিউরনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে। পুরোপুরি ভুলে যাবার আগে স্মৃতির আদিকাল খুঁড়ে প্রথম পড়া কিংবা শোনা কবিতা/গান গুলোর একটা সন তালিকা করছিলাম এভাবে-
১. আমার সোনার বাংলা......১৯৭২
২. আমি হব সকাল বেলার পাখি.......১৯৭৪
৩. চল চল চল...........১৯৭৫
৪. ছিপখান তিনদাড়.....১৯৭৬
খ.
হঠাৎ ফ্লাশব্যাক হলো মাথায়। কি একটা ছবি, কোন একটা বই, বাংলা বই হবে সম্ভবতঃ। ক্লাস থ্রীর বাংলা বইয়ের একটা সাদাকালো ছবি। কার ছবি ছিল ওটা? সম্রাট আকবর না শাহজাহান? কী দারুণ রং দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল আপা। পুষ্প'পা, মনে আছে তুমি আমার ক্লাস থ্রীর বইয়ের একটা ছবি রং করে দিয়েছিলে? ছবিটা কোন একটা গল্পের সাথে দেয়া ছিল। গল্পটার নাম ভুলে গেছি। কিন্তু তোমার রং পেন্সিলে আঁকা সেই ছবিটা কেন যেন এই মুহূর্তে ভেসে উঠলো চোখে। কতোকাল আগের কথা? তোমার তো মনে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ওই ছবিটা আমার এত প্রিয় ছিল, বইটা ফেলতে পারিনি বহুদিন।
গ.
সবাই ছেলেবেলাটা খুব মিস করে। কিন্তু ছেলেবেলার প্রিয় স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে না চাইলেও একটা স্মৃতির পরতে আরেকটা স্মৃতি বসে যায় বলে অনেক ছবি হারিয়ে যায়। স্মৃতি কি? স্মৃতির সাথে কি মেমোরি কার্ডের তুলনা করা যায়? একটা মেমোরি ষ্টিকে শব্দ, গ্রাফিক্স, টেক্সট সবরকমের জিনিস থাকে। মগজের কোষেও সেরকম না? গানগুলো গানের ফরমেটে, কথাগুলো কথার ফরমেটে, দৃশ্যগুলো ভিডিও ফরমেটে। কিন্তু ছেলেবেলায় পড়া বইপত্রগুলো কি ফরমেটে থাকে সেটা এখনো বের করতে পারিনি। বহুকাল আগে পড়া একটা উপন্যাস যেটুকু মনে থাকে সেটা একটা দৃশ্যকল্প কিংবা কল্প দৃশ্যের ফরমেটে জেগে থাকে। বইয়ের টেক্সট ফরমেট মাথার ভেতর তেমন ঢোকে না। ঢুকলেও সেটা পিডিএফ কিংবা জেপিজি ফরমেটে ঢোকে মনে হয়।
ঘ.
তুমুল বৃষ্টির দিন। স্কুল থেকে দৌড়ে ফিরতে গিয়ে ভিজে একসা। ছাতা নেই। দাড়িয়েছি প্রতিবেশীর বারান্দায়। ঠিক বারান্দা নয়। দরোজার সামনে একটু ছায়ার মতো ছানশেড। মোটেও ঝড়ো বৃষ্টি থেকে রক্ষার উপযুক্ত নয়। ঠক ঠক ঠক করছি মনে মনে। দাঁতে দাঁতে ঠোক্কর খাচ্ছে শীতল বাতাসে। সেই শব্দ কানে বাজছে। ভীতু আমি দরোজায় কড়া নেড়ে বলতে পারছি না আমি ভিজে গেছি দরোজা খোলো আমাকে ঢোকাও, বইগুলো বাঁচাতে চাই। শার্টের ভেতর ঢুকিয়ে দুহাতে বুকে চেপে রেখেছি। তবু শেষ রক্ষা হলো না। ভিজেই গেল প্রায়। বাসা খুব দুরে নয়। এখানে না দাড়িয়ে ছুট দিলে বাসায় পৌছে যেতাম এতক্ষনে। কি বোকামি। কাউকে বলা যায়? যা ভেজার ভিজেই তো গেল। ছুটে গিয়ে বাসায় পৌছে গেলাম দুই মিনিটে। চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেলাম। কাউকে বললাম না বোকামির গল্পটা। ক্লাস নাইনে পড়ে এতটা হাঁদারাম কেউ হয় না।
ঙ.
প্রথম নৌকায় চড়া এবং নৌকাডুবি দেখা। ইসহাক চাচার বিয়ে হচ্ছিল। জীবনে প্রথম বিয়ের স্মৃতি। কতোসাল মনে নেই। আদিকালেরই কথা। ইশকুলে পড়ি না তখনো। গ্রামে থাকতাম। এটুকু মনে আছে। বাবা থাকতো কর্মস্থলে শহরে। সকাল বেলা চাচাদের হাত ধরে চলে গেলাম অনেক দূরের বিয়েবাড়ীতে। গিয়েছিলাম জীপে করে এটুকু মনে আছে। বিয়ে বাড়ীতে তেমন কিছু মনে নেই। কিন্তু ফিরে আসার পথে জীপের বদলে নৌকা নেয়া হলো কেন জানি। মাঝনদীতে এসে হঠাৎ নৌকায় পানি উঠতে শুরু করে। বরযাত্রীবাহী বিরাট নৌকা। শংখ নদী দিয়ে যাচ্ছিল। মাঝি চিৎকার দিয়ে বললো নৌকার তলা দিয়ে পানি ঢুকছে, বাচ্চা বাদে সবাই যে নেমে যায়। সবাই নৌকা থেকে লাফঝাপ দিয়ে নেমে সাঁতরে কূলে উঠলো। কনিষ্ঠতম বরযাত্রী আমি আর ফুপাতো বোন শাহীন। আমরা এক বুড়ো দাদুর সাথে গুটিশুটি নৌকার ছইয়ের নীচে পাটিতে বসে ভয়ে ফিঁ ফিঁ করে কাঁদছি।
অবশেষে মাঝি নিরাপদে আমাদের কুলে নামালো। বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। ওদিকে বাবা শহর থেকে বাড়ী ফিরে শুনলো আমি বিয়েবাড়িতে গেছি। আমাকে বিয়েবাড়িতে পাঠানোর অপরাধে মায়ের উপর একচোট নিয়ে জানলো আমাকে নিয়ে গেছে চাচাদের কেউ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমরা তখনো ফিরিনি। টেনশানে রাগে বাবা ফেরার পথে অপেক্ষায় থাকলো। আমাকে বরণ করে নেবার জন্য না, বরং আমাকে যে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে সেই চাচাকে ধোলাই করার জন্য। বাবা খুব বদরাগী ছিল। বরযাত্রীদল যখন অন্ধকার পথে হেঁটে আসছিল বাবার উপস্থিতি জানান দিল সামনের কোন একজন। শোনামাত্র পালে বাঘ পড়েছে যেন চাচাদের দলটা যে যেদিকে পারলো ছুট দিল অন্ধকারে। বাবা দোষী ব্যক্তিকে খুঁজতে গিয়ে একজনকে চাচা মনে করে ধরে বেদম চপোটাঘাত করে যাচ্ছিল, আর সেই পাড়াতো চাচা চিৎকার করছিল বদ্দা আঁই ন, বদ্দা আঁই ন। (বড়দা, আমি না, আমি না)। এত বছর পরেও আমি সেদিনের সেই শব্দগুলো ভুলতে পারি না। কিছু স্মৃতিতে একটুও মরিচা ধরে না।
জীবনের প্রথম ৫ বছর গ্রামে কাটিয়েছি, কিন্তু মনে হয়ে যেন আরো অনেক দীর্ঘসময়। স্মৃতির লেজগুলো কখনো কখনো বাস্তবের চেয়েও দীর্ঘতর।
অনেক কিছু মনে নেই। স্রেফ ভুলে গেছি অনেক গুরুত্বপূর্ন ঘটনা, দিন, কাল। অথচ একদম নগণ্য কিছু স্মৃতি মগজের নিউরনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে। পুরোপুরি ভুলে যাবার আগে স্মৃতির আদিকাল খুঁড়ে প্রথম পড়া কিংবা শোনা কবিতা/গান গুলোর একটা সন তালিকা করছিলাম এভাবে-
১. আমার সোনার বাংলা......১৯৭২
২. আমি হব সকাল বেলার পাখি.......১৯৭৪
৩. চল চল চল...........১৯৭৫
৪. ছিপখান তিনদাড়.....১৯৭৬
খ.
হঠাৎ ফ্লাশব্যাক হলো মাথায়। কি একটা ছবি, কোন একটা বই, বাংলা বই হবে সম্ভবতঃ। ক্লাস থ্রীর বাংলা বইয়ের একটা সাদাকালো ছবি। কার ছবি ছিল ওটা? সম্রাট আকবর না শাহজাহান? কী দারুণ রং দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল আপা। পুষ্প'পা, মনে আছে তুমি আমার ক্লাস থ্রীর বইয়ের একটা ছবি রং করে দিয়েছিলে? ছবিটা কোন একটা গল্পের সাথে দেয়া ছিল। গল্পটার নাম ভুলে গেছি। কিন্তু তোমার রং পেন্সিলে আঁকা সেই ছবিটা কেন যেন এই মুহূর্তে ভেসে উঠলো চোখে। কতোকাল আগের কথা? তোমার তো মনে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ওই ছবিটা আমার এত প্রিয় ছিল, বইটা ফেলতে পারিনি বহুদিন।
গ.
সবাই ছেলেবেলাটা খুব মিস করে। কিন্তু ছেলেবেলার প্রিয় স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে না চাইলেও একটা স্মৃতির পরতে আরেকটা স্মৃতি বসে যায় বলে অনেক ছবি হারিয়ে যায়। স্মৃতি কি? স্মৃতির সাথে কি মেমোরি কার্ডের তুলনা করা যায়? একটা মেমোরি ষ্টিকে শব্দ, গ্রাফিক্স, টেক্সট সবরকমের জিনিস থাকে। মগজের কোষেও সেরকম না? গানগুলো গানের ফরমেটে, কথাগুলো কথার ফরমেটে, দৃশ্যগুলো ভিডিও ফরমেটে। কিন্তু ছেলেবেলায় পড়া বইপত্রগুলো কি ফরমেটে থাকে সেটা এখনো বের করতে পারিনি। বহুকাল আগে পড়া একটা উপন্যাস যেটুকু মনে থাকে সেটা একটা দৃশ্যকল্প কিংবা কল্প দৃশ্যের ফরমেটে জেগে থাকে। বইয়ের টেক্সট ফরমেট মাথার ভেতর তেমন ঢোকে না। ঢুকলেও সেটা পিডিএফ কিংবা জেপিজি ফরমেটে ঢোকে মনে হয়।
ঘ.
তুমুল বৃষ্টির দিন। স্কুল থেকে দৌড়ে ফিরতে গিয়ে ভিজে একসা। ছাতা নেই। দাড়িয়েছি প্রতিবেশীর বারান্দায়। ঠিক বারান্দা নয়। দরোজার সামনে একটু ছায়ার মতো ছানশেড। মোটেও ঝড়ো বৃষ্টি থেকে রক্ষার উপযুক্ত নয়। ঠক ঠক ঠক করছি মনে মনে। দাঁতে দাঁতে ঠোক্কর খাচ্ছে শীতল বাতাসে। সেই শব্দ কানে বাজছে। ভীতু আমি দরোজায় কড়া নেড়ে বলতে পারছি না আমি ভিজে গেছি দরোজা খোলো আমাকে ঢোকাও, বইগুলো বাঁচাতে চাই। শার্টের ভেতর ঢুকিয়ে দুহাতে বুকে চেপে রেখেছি। তবু শেষ রক্ষা হলো না। ভিজেই গেল প্রায়। বাসা খুব দুরে নয়। এখানে না দাড়িয়ে ছুট দিলে বাসায় পৌছে যেতাম এতক্ষনে। কি বোকামি। কাউকে বলা যায়? যা ভেজার ভিজেই তো গেল। ছুটে গিয়ে বাসায় পৌছে গেলাম দুই মিনিটে। চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেলাম। কাউকে বললাম না বোকামির গল্পটা। ক্লাস নাইনে পড়ে এতটা হাঁদারাম কেউ হয় না।
ঙ.
প্রথম নৌকায় চড়া এবং নৌকাডুবি দেখা। ইসহাক চাচার বিয়ে হচ্ছিল। জীবনে প্রথম বিয়ের স্মৃতি। কতোসাল মনে নেই। আদিকালেরই কথা। ইশকুলে পড়ি না তখনো। গ্রামে থাকতাম। এটুকু মনে আছে। বাবা থাকতো কর্মস্থলে শহরে। সকাল বেলা চাচাদের হাত ধরে চলে গেলাম অনেক দূরের বিয়েবাড়ীতে। গিয়েছিলাম জীপে করে এটুকু মনে আছে। বিয়ে বাড়ীতে তেমন কিছু মনে নেই। কিন্তু ফিরে আসার পথে জীপের বদলে নৌকা নেয়া হলো কেন জানি। মাঝনদীতে এসে হঠাৎ নৌকায় পানি উঠতে শুরু করে। বরযাত্রীবাহী বিরাট নৌকা। শংখ নদী দিয়ে যাচ্ছিল। মাঝি চিৎকার দিয়ে বললো নৌকার তলা দিয়ে পানি ঢুকছে, বাচ্চা বাদে সবাই যে নেমে যায়। সবাই নৌকা থেকে লাফঝাপ দিয়ে নেমে সাঁতরে কূলে উঠলো। কনিষ্ঠতম বরযাত্রী আমি আর ফুপাতো বোন শাহীন। আমরা এক বুড়ো দাদুর সাথে গুটিশুটি নৌকার ছইয়ের নীচে পাটিতে বসে ভয়ে ফিঁ ফিঁ করে কাঁদছি।
অবশেষে মাঝি নিরাপদে আমাদের কুলে নামালো। বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। ওদিকে বাবা শহর থেকে বাড়ী ফিরে শুনলো আমি বিয়েবাড়িতে গেছি। আমাকে বিয়েবাড়িতে পাঠানোর অপরাধে মায়ের উপর একচোট নিয়ে জানলো আমাকে নিয়ে গেছে চাচাদের কেউ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমরা তখনো ফিরিনি। টেনশানে রাগে বাবা ফেরার পথে অপেক্ষায় থাকলো। আমাকে বরণ করে নেবার জন্য না, বরং আমাকে যে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে সেই চাচাকে ধোলাই করার জন্য। বাবা খুব বদরাগী ছিল। বরযাত্রীদল যখন অন্ধকার পথে হেঁটে আসছিল বাবার উপস্থিতি জানান দিল সামনের কোন একজন। শোনামাত্র পালে বাঘ পড়েছে যেন চাচাদের দলটা যে যেদিকে পারলো ছুট দিল অন্ধকারে। বাবা দোষী ব্যক্তিকে খুঁজতে গিয়ে একজনকে চাচা মনে করে ধরে বেদম চপোটাঘাত করে যাচ্ছিল, আর সেই পাড়াতো চাচা চিৎকার করছিল বদ্দা আঁই ন, বদ্দা আঁই ন। (বড়দা, আমি না, আমি না)। এত বছর পরেও আমি সেদিনের সেই শব্দগুলো ভুলতে পারি না। কিছু স্মৃতিতে একটুও মরিচা ধরে না।
জীবনের প্রথম ৫ বছর গ্রামে কাটিয়েছি, কিন্তু মনে হয়ে যেন আরো অনেক দীর্ঘসময়। স্মৃতির লেজগুলো কখনো কখনো বাস্তবের চেয়েও দীর্ঘতর।
পাহারা
রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নীরবতার আগ্রাসন। বাড়াবাড়ি শীত আজ। ভাঁজ করা হাঁটু দুটো কাঁপছে লুঙ্গির আচ্ছাদনে। শীত-ভয়ের বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বগলের নীচটা ঘামছে। কোথাও একটা কুকুর কেঁদে উঠলো। রাত বারোটার ঘন্টা শোনা গেছে অনেকক্ষণ হলো। এদিকে এখন কেউ আসবে না। গলা থেকে নীল মাফলারটা খুলে কোমরে বেঁধে নিল।
ডিসেম্বরের কয় তারিখ আজ? পৌষমাস এসে গেছে প্রায়। শীতটা তাই গত কদিনের তুলনায় বিশ্রী।
বাড়ীটাতে বাতি জ্বলছে এখনো। কি করে ব্যাটা? এত রাতেও ঘুমায় না কেন? কোন খবর পেয়েছে? জানালা দিয়ে দুবার উঁকি দিল বাইরে। কিছু সন্দেহ করেছে? এটা জানার তো কথা নয়। গুটি কয়েক শীর্ষপদ বাদে খোদ করাচীর সবাই এই পরিকল্পনা কথা জানে না।
এই কাজের কোন জোরালো প্রতিক্রিয়া আসবে না। না ভারতের, না রাশিয়ার, না আমেরিকার না চীনের। নিরাপদ একটা মিশন।
ডানহাতে ঠাশ করে একটা চড় দিল পায়ে। একসাথে তিনটা মশার কামড়। শব্দটা বহুদূর গেল।
ঝিমানি আসছে। লেবু তেজপাতা দিয়ে এক কাপ চা পেলে মন্দ হতো না। কাল থেকে নাকি ডিউটি নাই। আজ রাতেই শেষ। ভারতের সাথে আপোষ হয়ে গেছে। এটাই শেষ পূণ্য কাজ।
এই লোকটা শিক্ষক। ছাত্র চড়ায় ঢাকা ভার্সিটিতে। কিন্তু গাদ্দার। সব বেঈমানের তালিকা করা হয়েছে। আজ রাতে পাহারা দিচ্ছে যাতে একটাও পালাতে না পারে। পালাতে গেলে গুল্লি। আর না পালালে তো কালকে ট্রাকে চড়ে রায়ের বাজারে বেড়াতে যাবে। টাইম নাই। স্টেনগানটা ডান কাঁধে ঝুলিয়ে হাত দুটো ফ্রী করলো সে। প্রজাপতি ম্যাচটা বের করে ফস করে একটা বগা সিগারেট ধরালো।
সিগারেটে কয়েকটা সুখটান দেবার পর দেখলো দোতলা জানালার বাতিটা নিভে গেছে। ঘুমাতে গেছে পাখি। এখন আর উড়াল দেবে না।
নিশ্চিন্তে সিঁড়িটার উপর মাথা রেখে চোখ বুজলো আলবদর।
ডিসেম্বরের কয় তারিখ আজ? পৌষমাস এসে গেছে প্রায়। শীতটা তাই গত কদিনের তুলনায় বিশ্রী।
বাড়ীটাতে বাতি জ্বলছে এখনো। কি করে ব্যাটা? এত রাতেও ঘুমায় না কেন? কোন খবর পেয়েছে? জানালা দিয়ে দুবার উঁকি দিল বাইরে। কিছু সন্দেহ করেছে? এটা জানার তো কথা নয়। গুটি কয়েক শীর্ষপদ বাদে খোদ করাচীর সবাই এই পরিকল্পনা কথা জানে না।
এই কাজের কোন জোরালো প্রতিক্রিয়া আসবে না। না ভারতের, না রাশিয়ার, না আমেরিকার না চীনের। নিরাপদ একটা মিশন।
ডানহাতে ঠাশ করে একটা চড় দিল পায়ে। একসাথে তিনটা মশার কামড়। শব্দটা বহুদূর গেল।
ঝিমানি আসছে। লেবু তেজপাতা দিয়ে এক কাপ চা পেলে মন্দ হতো না। কাল থেকে নাকি ডিউটি নাই। আজ রাতেই শেষ। ভারতের সাথে আপোষ হয়ে গেছে। এটাই শেষ পূণ্য কাজ।
এই লোকটা শিক্ষক। ছাত্র চড়ায় ঢাকা ভার্সিটিতে। কিন্তু গাদ্দার। সব বেঈমানের তালিকা করা হয়েছে। আজ রাতে পাহারা দিচ্ছে যাতে একটাও পালাতে না পারে। পালাতে গেলে গুল্লি। আর না পালালে তো কালকে ট্রাকে চড়ে রায়ের বাজারে বেড়াতে যাবে। টাইম নাই। স্টেনগানটা ডান কাঁধে ঝুলিয়ে হাত দুটো ফ্রী করলো সে। প্রজাপতি ম্যাচটা বের করে ফস করে একটা বগা সিগারেট ধরালো।
সিগারেটে কয়েকটা সুখটান দেবার পর দেখলো দোতলা জানালার বাতিটা নিভে গেছে। ঘুমাতে গেছে পাখি। এখন আর উড়াল দেবে না।
নিশ্চিন্তে সিঁড়িটার উপর মাথা রেখে চোখ বুজলো আলবদর।
যাত্রা ফেরত
যমদুতের সাথে সুসম্পর্কের কারণে শেষ মুহুর্তে বেঁচে গেল গোরখোদক ঠান্ডু মিয়া। বজ্রপাতটা ঠিক কান ঘেঁষে মাটিতে নেমে যাবার সময় কয়হাত দুরের বিশাল ইউক্যালিপটাস গাছটাকে দো-ফালা করে গেলেও টিকে গেছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাড় জিরজিরে বুড়োটা।
নগরীর সবগুলো গোরস্তানে ঠান্ডু মিয়ার বিচরণ। ঝড়বৃষ্টি বাদলা যে কোন সময় মাটি খুঁড়ে লাশের জন্য ঘর তৈরী করা তার জন্য নস্যি। জীবনে যতবার কবরে নেমেছে অতবেলা ভাতও খায়নি পেট ভরে। যমদুতের সাথে পরিচয়ের সুবাদে দেশের এত দুর্যোগ, মহামারী, ভয়াবহ দুর্ঘটনা কোন কিছুই তার সাতাশি বছর বয়সী শরীরকে কাবু করতে পারেনি। কোন মুর্দার কিরকম বিছানা দরকার হয়, কোন আবহাওয়ায় কিরকম বাঁশ বিছাতে হয়, সবকিছু নখদর্পনে তার।
ঠান্ডু মিয়ার যাত্রা শুরু চৈতন্যগলির টিলাময় বাইশমহল্লার কবরস্থান থেকে। কৈশোরের মাঝামাঝি সময়। বাবা মারা গিয়েছিল জন্মের পরপর। মায়ের কাছে বড় হচ্ছিল। একদিন মাও তাকে রেখে চলে গেলে লোকমুখে প্রথম শুনে আজরাইল বা যমদুতের নাম। খুব রাগ হয়েছিল যমদুতের উপর। এতটা নির্দয় কেউ হয়? দুনিয়াতে দেখার কেউ নেই এরকম একজনকে পিতামাতাহীন করা। রাগ করে সে গোরস্থানে চলে আসে। যমদুতের দেখা পেলে কথা বলবে। যেখানে মাকে মাটিচাপা দিয়েছিল বস্তির দয়ালু লোকেরা। তাকে ভাতও খাইয়েছিল দুদিন। মা না থাকার যন্ত্রনা সে কদিন বাদেই ভুলে যায় ভাতের খিদায়।
কিন্তু কদিন খাওয়াবে বাইরের লোক? যে পাড়াতো খালা মা মরার পর "আয় কান্দিস না, আইজ থেকে তুই আমার পেটের ছাওয়াল, আমার কাছেই খাইবি" বলে বুকে টেনে নিয়েছিল কদিন যাবার পর দেখা গেল দুপুর হলেই সেই খালার দরোজা বন্ধ। "ভাইফুত ন কান্দিস, আঁরা থাইকতে তোর খন অসুবিধা নইবো", বলে যে পাড়াতো চাচা তাকে ঘরে নিয়ে মুরগীর ঝোল দিয়ে নানরুটি খাইয়েছিল সেদিন, সেই চাচা তাকে দেখে চিনতে পারে না কদিন বাদে। আস্তে আস্তে পাড়ার সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলে খিদের সময় কবরস্থানে গিয়ে বসে থাকে। মায়ের কাছে ভাত খোঁজে।
মায়ের কাছে চাইলে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়। মা তাকে একেকদিন ব্যবস্থা করে দেয় একেকভাবে। প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ মরে। লোকজন দল বেধে খাটিয়া নিয়ে আসে গোরস্থানে। লাশ কবরে নামিয়ে চলে যাবার সময় তাদের পিছুপিছু মৃত বাড়ী গিয়ে দরজার বাইরে মলিন মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে ঠান্ডু। এরকম বাড়ির বাসিন্দাদের কলিজা নরোম থাকে কদিন। মলিন চেহারার দরিদ্র লোকদের খুব কদর থাকে তখন। খাওয়া জুটে যায় তার। এভাবে একেকদিন একেক বাড়ীতে ভোজন করে, রাতে স্টেশানের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ঘুমোয়। যদি কোন দিন কেউ মারা না যায়, সে একটু বিপাকে পড়ে।
একবার পরপর তিনদিন কোন লাশ এলো না। সে কি কষ্ট তার। ভিক্ষা করার অভ্যেস না থাকলেও মাজারের পাশে বসে গিয়েছিল। বহু কষ্টে তিনটা দিন পার করার পর চতুর্থ দিনে যখন খাটিয়া মাথায় টুপিওয়ালা লোকজন দেখা দিল, তখন ঈদের আনন্দে সে দৌড়ে কবরস্থানে পৌঁছে যায়। কিন্তু দ্রুত ছুটতে গিয়ে পা হড়কে ঢুকে যায় পাশের পুরোনো একটা কবরে। মাটি নরম হয়ে ছিল বৃষ্টিতে, কোমর পর্যন্ত দেবে যায় তার। লাশ দাফন করতে আসা লোকজন হায় হায় করে তাকে উদ্ধার করে।
কে একজন বললো, কবরে টানছে তাকে। মানে মউত। ভয় পেয়ে গেল সে। পাশেই মার কবর। মা কি তাকে ডাকছে কবরে?
আরেকজন জিজ্ঞেস করলো, 'কী করিস তুই এখানে?' সে কেন যেন মুখ ফসকে বলে ফেলে, 'কবরের কাজ করি।' দাফন করতে আসা লোকজন জনবল সংকটে ছিল বোধহয়। তাকে কবরের কাজে লাগিয়ে দিল অন্যদের সাথে। সেদিন আর পরবর্তী তিনদিন তাকে খাওয়া নিয়ে ভাবতে হলো না। ওই বাড়িতেই খেল। আর কিছু টাকা বকশিশও জুটে গেল শেষদিন।
সেদিন থেকে নতুন জীবন তার। মুর্দার আগেই কবরে নেমে কবর ঠিক করা, মাটির অবস্থা বুঝে ফিনিশিং লাইন টানা, মুর্দার গায়ে যেন মাটি না পড়ে সে ব্যবস্থা করা, কবরের উপর লাগানো ফুলের চারায় পানি দেয়া ইত্যাদি কাজ করে সে মোটামুটি ভালো আয় করতে থাকে। কিন্তু পরবর্তী পঁচাত্তর বছর যে তার কবরের সাথে কাটবে সেটা কল্পনাও করেনি তখন।
ফুলমতীর সাথে সংসারের ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও দুজন একা রয়ে গেছে। কোন সন্তান হয়নি তাদের। বংশরক্ষার কেউ নেই। ঠান্ডু মিয়া ছাড়া ফুলমতিকে দেখাশোনা করার কেউ নেই। এই বয়সেও দুজন দুজনকে আগলে রাখে একরকম। ফুলমতীর মুখের কথাও ফুলের মতো নরম। কখনো খোঁচা বা কাঁটার ছোঁয়া থাকে না কথার মধ্যে।
কিন্তু আজ সকালে কি মতিভ্রম হলো তার? ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে যাবার সময় ঠান্ডু মিয়ার পায়ে লেগে ফুলমতীর অনেক শখের যোগাড় কাঁচের গেলাসটা ঠক্কাস করে মেঝেতে পড়ে গুঁড়ো হয়ে গেলো। অমনি ফুলমতীর মুখে একটা বিস্ফোরন ঘটলো, "মিনসের মিনসে মরণও হয় না তোর, চোখের মাথা খাইছস? আমার এত সাধের গেলাসটা ভাইঙ্গা দিলি? দুর হ আমার সামনে থেইক্যা........ইত্যাদি আরো অনেক অকথ্য গালিগালাজ।
তব্দা খেয়ে যায় ঠান্ডু মিয়া। ফুলমতীর মুখ দিয়ে এরকম বেশুমার বেমানান শব্দ কখনোই আশা করেনি সে। রাগে অপমানে এক কাপড়েই ঘর থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় চলে গেলো। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছিল চতুর্দিক। শহর এলাকার একটা বাস আসতেই কিছু না ভেবে উঠে গেল বাসে। যাত্রীর ভিড় নেই। পেছনের দিকের আধভেজা একটা সীটে হেলান দিয়ে বসে রইলো। কোথায় যাবে জানে না। কিন্তু এই জায়গা ছেড়ে, এই দুনিয়া ছেড়ে, এই জগত ছেড়ে তার নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। বাসটা তাকে যেখানে খুশী নিয়ে যাক।
বাসের শেষ গন্তব্য যেখানে তার কিছুদূর পরেই কর্নফূলীর মোহনা। অদূরে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখা যাচ্ছে। বাস থেকে নেমে সোজা সমুদ্রের দিকে হাঁটতে শুরু করে নেভী রোড ধরে। বামপাশে নদী। নদীর ওপারে ছোট ছোট টিলা। বৃষ্টিতে সব নৌ চলাচল বন্ধ। জেদের তেজে এত জোরে হাঁটছিল যেন কোন জরুরী কাজে যাচ্ছে। লুঙ্গি শার্ট ভিজে সপসপ করছে হাঁটার তালে তালে। বাতাসের ঠান্ডা তীর বুড়ো হাড়ে কনকন করে বিধছে। বৃষ্টি ছাঁটে চোখে ঝাপসা দেখছে। কিন্তু অপমানের জ্বালা তার চেয়েও বেশী বলে কোন দুর্যোগ তার চামড়ায় আঘাত হেনে সুবিধা করতে পারলো না।
কিন্তু সে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে কেন? মরতে হলে রেল লাইন সবচেয়ে সোজা। এদিকে রেল লাইন নেই। কাছাকাছি জায়গার মধ্যে স্টীলমিল বাজার পর্যন্ত রেল লাইন আছে, কিন্তু ওই পথে রেল চলেনি বহুবছর। ভুল রাস্তায় চলে এসেছে। কদমতলী রেলক্রসিংএর দিকে যাওয়া দরকার ছিল। এখন ফিরে যাবার ভাড়াও পকেটে নেই। দশটাকা খরচ হয়ে গেছে আসার পথেই। মরতে গেলে তাকে আরো পনেরো টাকা যোগাড় করে মরতে হবে। কে দেবে টাকা? ভিক্ষা করার উপায় নেই এই নির্জন জায়গায়।
ধুশশশ.....খিদেও পেয়ে গেছে এসময়ে আবার। সকালের খাওয়াটা হয়নি এই ক্যাচালে। খিদে পেটে মরতেও কেমন লাগছে। টাকার যোগাড় কেমনে হবে? পাশের একটা মসজিদের দানবাক্স দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সে। মসজিদের টাকার উপর পরকালের হক আছে। সে তো পরকালেই চলে যাচ্ছে খানিক বাদে। যাবার আগে পরকালের তহবিল থেকে খানিক আগাম নেয়া যায় না? খিদের সময় নীতিকথা কাজ করে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দানবাক্সের তালায় একটা মোচড় দিতেই তালাটা ঠুস করে খুলে গেল।
কতটাকা আছে গোনার সময় নাই। খুব বেশী না, দু'পাঁচ টাকার নোটের সাথে কিছু চকচকে কয়েন। সবগুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে লুঙ্গির গিটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর জোর কদমে হাঁটা শুরু করলো বাস স্টেশানের দিকে। আঠারো নম্বর পৌছলে দোকানপাট মিলবে। তেলে ভাজা পরোটার ঘ্রান আর গরম চায়ের সুগন্ধী ধোঁয়ার চিত্রটা ভেসে উঠতেই খিদেটা আবারো বজ্জাতি শুরু করলো পেটের ভেতর।
প্রথমেই যে ঝুপড়ি দোকানটা পড়লো তাতে ঢুকে পেটপুরে চা-পরোটা-ভাজি খেয়ে নিল।
খিদেটা মরার পর রাগটা চাঙা হলো আবার। আজকে মরতেই হবে। কাছে ধারে মরার জায়গা খুঁজতে খুজতে ভাবতে থাকলো সে মরার পর ফুলমতী কি করবে? তার খবর পেয়ে সে কিরকম ভেউ ভেউ করে কাঁদবে, সকালের গালাগালির জন্য কিরকম অনুতপ্ত হয়ে মাথা কুটবে মেঝেতে এই দৃশ্যগুলো তাকে বিপুল আনন্দিত করলো। মরতেও সুখ সুখ লাগছে তার। ভাবতে ভাবতে বৃষ্টির ছাট উপেক্ষা করে হাঁটতে থাকলো ঠান্ডু। এখানে ব্যবস্থা না হলে স্টেশান রোডেই চলে যেতে হবে।
ঠিক তখনই পাশের বিরাট উচু ইউক্যালিপটাস গাছটার উপর একটা আঁকাবাঁকা অতি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা নাজিল হলে মুহূর্তে গাছটা ফড়ফড় করে দুভাগ হয়ে পড়তে দেখে অবাক হবার আগেই আকাশ ভেঙ্গে একটা গর্জন নেমে আসলো এবং সে বুঝতে পারলো বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে সে।
দুপুরের পর জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালের মেঝেতে। মরেনি সে। কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারলো কাজটা কতো লজ্জাজনক হয়েছে। সে পরিষ্কার দেখেছে বজ্রপাতে গাছটা দুই ফাঁক হয়ে গেছে। গাছটার এত কাছে থেকেও সে বেঁচে থাকলো কিভাবে। নিশ্চয়ই যমদুত আবারো তাকে খাতির করেছে।
ওপাশে একটা নার্স দেখে সে ডাক দিতে চাইলো। কিন্তু একি? নিজের কন্ঠ তার নিজের কানেই গেল না। সমস্যাটা বুঝতে পারলো না সে। নার্স মুখ নাড়ছে, কিন্তু সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। পুরা কবরের নিস্তব্ধতা।
অনেকক্ষণ পর ডাক্তার এসে দেখার পর জানলো যমদুত তার প্রাণ নেয়নি, কিন্তু কানটা নিয়ে গেছে। এখন থেকে ফুলমতীর কোন বাক্য তার কানে পৌঁছাবে না কোনদিন। ফুলমতীর জন্য এটাও কম শাস্তি না। বাড়ি ফিরে যাবার একটা যুতসই অজুহাত খুঁজে পেল সে।
মেঝেতে উঠে বসে কোমরের কাছে হাত দিয়ে লুঙ্গির গিটের ভেতর টাকার অস্তিত্বটা ছুঁয়ে ভাবতে লাগলো, পরকালের হিসেব থেকে আগাম কেটে নেয়া এই ক্ষুদ্রঋনের কি ব্যবস্থা হবে?
নগরীর সবগুলো গোরস্তানে ঠান্ডু মিয়ার বিচরণ। ঝড়বৃষ্টি বাদলা যে কোন সময় মাটি খুঁড়ে লাশের জন্য ঘর তৈরী করা তার জন্য নস্যি। জীবনে যতবার কবরে নেমেছে অতবেলা ভাতও খায়নি পেট ভরে। যমদুতের সাথে পরিচয়ের সুবাদে দেশের এত দুর্যোগ, মহামারী, ভয়াবহ দুর্ঘটনা কোন কিছুই তার সাতাশি বছর বয়সী শরীরকে কাবু করতে পারেনি। কোন মুর্দার কিরকম বিছানা দরকার হয়, কোন আবহাওয়ায় কিরকম বাঁশ বিছাতে হয়, সবকিছু নখদর্পনে তার।
ঠান্ডু মিয়ার যাত্রা শুরু চৈতন্যগলির টিলাময় বাইশমহল্লার কবরস্থান থেকে। কৈশোরের মাঝামাঝি সময়। বাবা মারা গিয়েছিল জন্মের পরপর। মায়ের কাছে বড় হচ্ছিল। একদিন মাও তাকে রেখে চলে গেলে লোকমুখে প্রথম শুনে আজরাইল বা যমদুতের নাম। খুব রাগ হয়েছিল যমদুতের উপর। এতটা নির্দয় কেউ হয়? দুনিয়াতে দেখার কেউ নেই এরকম একজনকে পিতামাতাহীন করা। রাগ করে সে গোরস্থানে চলে আসে। যমদুতের দেখা পেলে কথা বলবে। যেখানে মাকে মাটিচাপা দিয়েছিল বস্তির দয়ালু লোকেরা। তাকে ভাতও খাইয়েছিল দুদিন। মা না থাকার যন্ত্রনা সে কদিন বাদেই ভুলে যায় ভাতের খিদায়।
কিন্তু কদিন খাওয়াবে বাইরের লোক? যে পাড়াতো খালা মা মরার পর "আয় কান্দিস না, আইজ থেকে তুই আমার পেটের ছাওয়াল, আমার কাছেই খাইবি" বলে বুকে টেনে নিয়েছিল কদিন যাবার পর দেখা গেল দুপুর হলেই সেই খালার দরোজা বন্ধ। "ভাইফুত ন কান্দিস, আঁরা থাইকতে তোর খন অসুবিধা নইবো", বলে যে পাড়াতো চাচা তাকে ঘরে নিয়ে মুরগীর ঝোল দিয়ে নানরুটি খাইয়েছিল সেদিন, সেই চাচা তাকে দেখে চিনতে পারে না কদিন বাদে। আস্তে আস্তে পাড়ার সব দরজা বন্ধ হয়ে গেলে খিদের সময় কবরস্থানে গিয়ে বসে থাকে। মায়ের কাছে ভাত খোঁজে।
মায়ের কাছে চাইলে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়। মা তাকে একেকদিন ব্যবস্থা করে দেয় একেকভাবে। প্রায় প্রতিদিন কেউ না কেউ মরে। লোকজন দল বেধে খাটিয়া নিয়ে আসে গোরস্থানে। লাশ কবরে নামিয়ে চলে যাবার সময় তাদের পিছুপিছু মৃত বাড়ী গিয়ে দরজার বাইরে মলিন মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে ঠান্ডু। এরকম বাড়ির বাসিন্দাদের কলিজা নরোম থাকে কদিন। মলিন চেহারার দরিদ্র লোকদের খুব কদর থাকে তখন। খাওয়া জুটে যায় তার। এভাবে একেকদিন একেক বাড়ীতে ভোজন করে, রাতে স্টেশানের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ঘুমোয়। যদি কোন দিন কেউ মারা না যায়, সে একটু বিপাকে পড়ে।
একবার পরপর তিনদিন কোন লাশ এলো না। সে কি কষ্ট তার। ভিক্ষা করার অভ্যেস না থাকলেও মাজারের পাশে বসে গিয়েছিল। বহু কষ্টে তিনটা দিন পার করার পর চতুর্থ দিনে যখন খাটিয়া মাথায় টুপিওয়ালা লোকজন দেখা দিল, তখন ঈদের আনন্দে সে দৌড়ে কবরস্থানে পৌঁছে যায়। কিন্তু দ্রুত ছুটতে গিয়ে পা হড়কে ঢুকে যায় পাশের পুরোনো একটা কবরে। মাটি নরম হয়ে ছিল বৃষ্টিতে, কোমর পর্যন্ত দেবে যায় তার। লাশ দাফন করতে আসা লোকজন হায় হায় করে তাকে উদ্ধার করে।
কে একজন বললো, কবরে টানছে তাকে। মানে মউত। ভয় পেয়ে গেল সে। পাশেই মার কবর। মা কি তাকে ডাকছে কবরে?
আরেকজন জিজ্ঞেস করলো, 'কী করিস তুই এখানে?' সে কেন যেন মুখ ফসকে বলে ফেলে, 'কবরের কাজ করি।' দাফন করতে আসা লোকজন জনবল সংকটে ছিল বোধহয়। তাকে কবরের কাজে লাগিয়ে দিল অন্যদের সাথে। সেদিন আর পরবর্তী তিনদিন তাকে খাওয়া নিয়ে ভাবতে হলো না। ওই বাড়িতেই খেল। আর কিছু টাকা বকশিশও জুটে গেল শেষদিন।
সেদিন থেকে নতুন জীবন তার। মুর্দার আগেই কবরে নেমে কবর ঠিক করা, মাটির অবস্থা বুঝে ফিনিশিং লাইন টানা, মুর্দার গায়ে যেন মাটি না পড়ে সে ব্যবস্থা করা, কবরের উপর লাগানো ফুলের চারায় পানি দেয়া ইত্যাদি কাজ করে সে মোটামুটি ভালো আয় করতে থাকে। কিন্তু পরবর্তী পঁচাত্তর বছর যে তার কবরের সাথে কাটবে সেটা কল্পনাও করেনি তখন।
ফুলমতীর সাথে সংসারের ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও দুজন একা রয়ে গেছে। কোন সন্তান হয়নি তাদের। বংশরক্ষার কেউ নেই। ঠান্ডু মিয়া ছাড়া ফুলমতিকে দেখাশোনা করার কেউ নেই। এই বয়সেও দুজন দুজনকে আগলে রাখে একরকম। ফুলমতীর মুখের কথাও ফুলের মতো নরম। কখনো খোঁচা বা কাঁটার ছোঁয়া থাকে না কথার মধ্যে।
কিন্তু আজ সকালে কি মতিভ্রম হলো তার? ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে যাবার সময় ঠান্ডু মিয়ার পায়ে লেগে ফুলমতীর অনেক শখের যোগাড় কাঁচের গেলাসটা ঠক্কাস করে মেঝেতে পড়ে গুঁড়ো হয়ে গেলো। অমনি ফুলমতীর মুখে একটা বিস্ফোরন ঘটলো, "মিনসের মিনসে মরণও হয় না তোর, চোখের মাথা খাইছস? আমার এত সাধের গেলাসটা ভাইঙ্গা দিলি? দুর হ আমার সামনে থেইক্যা........ইত্যাদি আরো অনেক অকথ্য গালিগালাজ।
তব্দা খেয়ে যায় ঠান্ডু মিয়া। ফুলমতীর মুখ দিয়ে এরকম বেশুমার বেমানান শব্দ কখনোই আশা করেনি সে। রাগে অপমানে এক কাপড়েই ঘর থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় চলে গেলো। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছিল চতুর্দিক। শহর এলাকার একটা বাস আসতেই কিছু না ভেবে উঠে গেল বাসে। যাত্রীর ভিড় নেই। পেছনের দিকের আধভেজা একটা সীটে হেলান দিয়ে বসে রইলো। কোথায় যাবে জানে না। কিন্তু এই জায়গা ছেড়ে, এই দুনিয়া ছেড়ে, এই জগত ছেড়ে তার নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। বাসটা তাকে যেখানে খুশী নিয়ে যাক।
বাসের শেষ গন্তব্য যেখানে তার কিছুদূর পরেই কর্নফূলীর মোহনা। অদূরে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখা যাচ্ছে। বাস থেকে নেমে সোজা সমুদ্রের দিকে হাঁটতে শুরু করে নেভী রোড ধরে। বামপাশে নদী। নদীর ওপারে ছোট ছোট টিলা। বৃষ্টিতে সব নৌ চলাচল বন্ধ। জেদের তেজে এত জোরে হাঁটছিল যেন কোন জরুরী কাজে যাচ্ছে। লুঙ্গি শার্ট ভিজে সপসপ করছে হাঁটার তালে তালে। বাতাসের ঠান্ডা তীর বুড়ো হাড়ে কনকন করে বিধছে। বৃষ্টি ছাঁটে চোখে ঝাপসা দেখছে। কিন্তু অপমানের জ্বালা তার চেয়েও বেশী বলে কোন দুর্যোগ তার চামড়ায় আঘাত হেনে সুবিধা করতে পারলো না।
কিন্তু সে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে কেন? মরতে হলে রেল লাইন সবচেয়ে সোজা। এদিকে রেল লাইন নেই। কাছাকাছি জায়গার মধ্যে স্টীলমিল বাজার পর্যন্ত রেল লাইন আছে, কিন্তু ওই পথে রেল চলেনি বহুবছর। ভুল রাস্তায় চলে এসেছে। কদমতলী রেলক্রসিংএর দিকে যাওয়া দরকার ছিল। এখন ফিরে যাবার ভাড়াও পকেটে নেই। দশটাকা খরচ হয়ে গেছে আসার পথেই। মরতে গেলে তাকে আরো পনেরো টাকা যোগাড় করে মরতে হবে। কে দেবে টাকা? ভিক্ষা করার উপায় নেই এই নির্জন জায়গায়।
ধুশশশ.....খিদেও পেয়ে গেছে এসময়ে আবার। সকালের খাওয়াটা হয়নি এই ক্যাচালে। খিদে পেটে মরতেও কেমন লাগছে। টাকার যোগাড় কেমনে হবে? পাশের একটা মসজিদের দানবাক্স দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সে। মসজিদের টাকার উপর পরকালের হক আছে। সে তো পরকালেই চলে যাচ্ছে খানিক বাদে। যাবার আগে পরকালের তহবিল থেকে খানিক আগাম নেয়া যায় না? খিদের সময় নীতিকথা কাজ করে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দানবাক্সের তালায় একটা মোচড় দিতেই তালাটা ঠুস করে খুলে গেল।
কতটাকা আছে গোনার সময় নাই। খুব বেশী না, দু'পাঁচ টাকার নোটের সাথে কিছু চকচকে কয়েন। সবগুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে লুঙ্গির গিটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর জোর কদমে হাঁটা শুরু করলো বাস স্টেশানের দিকে। আঠারো নম্বর পৌছলে দোকানপাট মিলবে। তেলে ভাজা পরোটার ঘ্রান আর গরম চায়ের সুগন্ধী ধোঁয়ার চিত্রটা ভেসে উঠতেই খিদেটা আবারো বজ্জাতি শুরু করলো পেটের ভেতর।
প্রথমেই যে ঝুপড়ি দোকানটা পড়লো তাতে ঢুকে পেটপুরে চা-পরোটা-ভাজি খেয়ে নিল।
খিদেটা মরার পর রাগটা চাঙা হলো আবার। আজকে মরতেই হবে। কাছে ধারে মরার জায়গা খুঁজতে খুজতে ভাবতে থাকলো সে মরার পর ফুলমতী কি করবে? তার খবর পেয়ে সে কিরকম ভেউ ভেউ করে কাঁদবে, সকালের গালাগালির জন্য কিরকম অনুতপ্ত হয়ে মাথা কুটবে মেঝেতে এই দৃশ্যগুলো তাকে বিপুল আনন্দিত করলো। মরতেও সুখ সুখ লাগছে তার। ভাবতে ভাবতে বৃষ্টির ছাট উপেক্ষা করে হাঁটতে থাকলো ঠান্ডু। এখানে ব্যবস্থা না হলে স্টেশান রোডেই চলে যেতে হবে।
ঠিক তখনই পাশের বিরাট উচু ইউক্যালিপটাস গাছটার উপর একটা আঁকাবাঁকা অতি উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা নাজিল হলে মুহূর্তে গাছটা ফড়ফড় করে দুভাগ হয়ে পড়তে দেখে অবাক হবার আগেই আকাশ ভেঙ্গে একটা গর্জন নেমে আসলো এবং সে বুঝতে পারলো বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে সে।
দুপুরের পর জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালের মেঝেতে। মরেনি সে। কয়েক সেকেন্ড পর বুঝতে পারলো কাজটা কতো লজ্জাজনক হয়েছে। সে পরিষ্কার দেখেছে বজ্রপাতে গাছটা দুই ফাঁক হয়ে গেছে। গাছটার এত কাছে থেকেও সে বেঁচে থাকলো কিভাবে। নিশ্চয়ই যমদুত আবারো তাকে খাতির করেছে।
ওপাশে একটা নার্স দেখে সে ডাক দিতে চাইলো। কিন্তু একি? নিজের কন্ঠ তার নিজের কানেই গেল না। সমস্যাটা বুঝতে পারলো না সে। নার্স মুখ নাড়ছে, কিন্তু সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। পুরা কবরের নিস্তব্ধতা।
অনেকক্ষণ পর ডাক্তার এসে দেখার পর জানলো যমদুত তার প্রাণ নেয়নি, কিন্তু কানটা নিয়ে গেছে। এখন থেকে ফুলমতীর কোন বাক্য তার কানে পৌঁছাবে না কোনদিন। ফুলমতীর জন্য এটাও কম শাস্তি না। বাড়ি ফিরে যাবার একটা যুতসই অজুহাত খুঁজে পেল সে।
মেঝেতে উঠে বসে কোমরের কাছে হাত দিয়ে লুঙ্গির গিটের ভেতর টাকার অস্তিত্বটা ছুঁয়ে ভাবতে লাগলো, পরকালের হিসেব থেকে আগাম কেটে নেয়া এই ক্ষুদ্রঋনের কি ব্যবস্থা হবে?
আনন্দ-বিস্ময়-প্রেম সম্পর্কিত কয়েক টুকরো তোবড়ানো দর্শন
১.
হাইস্কুল জীবনটা ছিল মোটামুটি জঘন্য রকমের। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর ভুগোল, ইতিহাস, ধর্ম, বাংলা ব্যাকরন, ইংরেজী গ্রামার,পাটীগনিত, জ্যামিতি ইত্যাদির অত্যাচারে দম বন্ধ হয়ে আসতো সময় সময়। সিক্স থেকে এইট এই তিন বছরের যেসব স্মৃতি আছে সব জ্যৈষ্ঠের খরতপ্ত দুপুরের মতো ঝলসানো। বেত নামক লিকলিকে ভয়ংকর বস্তুটার সাথে প্রতিদিন দেখা সাক্ষাত হলে, আর বাড়ির কাজ যথাসময়ে শেষ না করলে যা হবার কথা আর কি।
তুলনামূলকভাবে আমার প্রাইমারী সময়ের(১৯৭৪-১৯৭৮) স্কুলের জীবনটা আনন্দের ছিল। বইপত্রগুলো সহজ নামমাত্র। জ্ঞানের বাড়াবাড়ি দেখা যেতো না স্কুলের প্রথম পাঁচ বছরে। আজকাল তো জ্ঞানবাহনের ষ্টিয়ারিংটা জন্মমাত্রেই শিশুদের ঘাড়ে বেঁধে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। শৈশবের আনন্দ জিনিসটা যাত্রা শুরুর আগেই মরে যায়।
আমার সেই জঘন্য হাইস্কুল জীবনটাই মধুরতম হয়ে উঠেছিল যখন স্কুলের শেষ বছরে আসি। টেষ্ট পরীক্ষার পর ফেয়ারওয়েলের দিন আমরা অঝোরে কেঁদেছিলাম স্কুল জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। কারণ ঐ বছর আমরা এমন একজন শিক্ষকের দেখা পেয়েছিলাম যিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন কি করে পড়াশোনা থেকেও আনন্দ আবিষ্কার করতে হয়। খুব দেরীতে দেখা পেয়েছিলাম তাঁর।
২.
আনন্দের সাথে বড় হওয়ার একটা নেতিবাচক সম্পর্ক আছে।
মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে আনন্দের পরিমাণ কমতে থাকে। একটা ৩ বছরের শিশু যেমন অকারণে হাসতে পারে ১৫ বছরের কিশোর তা পারে না। ২০ বছরের তরুণ তো রীতিমতো গম্ভীর। আজকাল অকালেই পেকে যাচ্ছে শিশুকিশোরের দল, অনেক কম বয়সেই জেনে যাচ্ছে জীবনের অনেক গভীর বিষয় যা তার জানার কথা নয়। তাদের মুখে অনেক শব্দ অবলীলায় উচ্চারিত হতে শুনি যা ত্রিশোর্ধ মানুষও উচ্চারণ করতে দ্বিধা করে। টেলিভিশনের ভুমিকাটা এক্ষেত্রে মারাত্মক। আমাদের শিশুদের শৈশব নষ্ট করে দিচ্ছে টেলিভিশন। গাম্ভীর্যের বয়স আসার আগেই তাদের গম্ভীর করে ফেলছে। দোষটা টেলিভিশনের দেয়া হলেও দায়টা পিতামাতা অভিভাবকের। তারাই শিশুদের টেলিভিশন মুখী করেন নানান উসিলায়।
আনন্দের সাথে বিস্ময়ের সম্পর্ক আরো গভীর। যে যত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বিস্মিত হতে পারবে, সে তত সুখী মানুষ। যার সব জানা হয়ে গেছে, তার মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই। একটা নতুন বই পড়ার আগে যেরকম বিস্ময় জাগায়, পড়া শেষ করে ওই দিকে তেমন তাকাতে ইচ্ছে করে না। একটা ভ্রমণে যাত্রা করার সময় যেরকম আড্ডা হয়, ফিরতি যাত্রায় তার বিপরীত। ইন্টারনেটে কেউ সামান্য একটা ছবি আপলোড করতে পেরেও অনেক আনন্দিত হয়, আবার কেউ আস্ত গুগল আর্থের স্ট্রীট ভিউ দেখেও বিস্মিত হয় না।
তার মানে যার যত জ্ঞান সে তত কম বিস্মিত, তত বেশী গম্ভীর। গম্ভীর মানুষেরা কি সুখী নয়? জানি না। এখানে আবার সমীকরণ মেলে না।
৩.
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি গম্ভীর হতে চেষ্টা করেও উত্তরোত্তর ব্যর্থ হয়েছি। বাধ্য হয়ে হালকা চালে আনন্দিত থাকি, তুচ্ছ জিনিসে ডুবে থাকি। ইংরেজী বোতাম টিপে বাংলা লেখা স্ক্রীনে ভেসে উঠতে দেখে নিজেকে যাদুকর মনে করি। কাগুর কাছ থেকে বাংলাকে মুক্ত করার অভ্রের সংগ্রাম দেখে আলোড়িত, আনন্দিত হই। আমি বাংলায় লিখি, অভ্রের কল্যানে। আমার বাংলা শেখাটাও একটা বিরাট বিস্ময়। এই বিস্ময়ও আছে আনন্দের উৎসে।
৪.
একতরফা প্রেম সুখের হয় না। প্রায়ই হতাশা এসে ভর করে। একটা মেয়েকে একতরফা ভালোবাসতাম। কিন্তু সে বাসতো অন্য আরেকজনকে। আমার দিকে তাকাবার ফুরসত তার নেই। তবু আমি তার সৌন্দর্যে মাধুর্যে বিস্মিত হয়ে একরকম প্রেমেই পড়ে যাই। জেনেশুনে আত্মহত্যার মতো। ওই ভালোবাসার মূল উৎস ছিল বিস্ময়। বিস্ময় থেকে হয়েছিল আনন্দের সুত্রপাত। আর সেই আনন্দের ফলশ্রুতি গভীর প্রেমে পতন। চুড়ান্ত ফলাফল পূর্বনির্ধারিতই ছিল।
চুড়ান্ত ঝামা ঘষে দেবার পর আনন্দ-বিস্ময়-প্রেম-ছ্যাকার চতুর্ভূজ সমীকরণে দুই সংলাপের একটা পদ্যই লিখে বসেছিলাম:
-হে আমার আনন্দিত বিস্মিত প্রেম, তুমি আমারে করিয়াছ অপমান।
-হে নাদান তরুণ, ভালোবাসিয়া যুগে যুগে কে কবে পাইয়াছে পরিত্রাণ।
হাইস্কুল জীবনটা ছিল মোটামুটি জঘন্য রকমের। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর ভুগোল, ইতিহাস, ধর্ম, বাংলা ব্যাকরন, ইংরেজী গ্রামার,পাটীগনিত, জ্যামিতি ইত্যাদির অত্যাচারে দম বন্ধ হয়ে আসতো সময় সময়। সিক্স থেকে এইট এই তিন বছরের যেসব স্মৃতি আছে সব জ্যৈষ্ঠের খরতপ্ত দুপুরের মতো ঝলসানো। বেত নামক লিকলিকে ভয়ংকর বস্তুটার সাথে প্রতিদিন দেখা সাক্ষাত হলে, আর বাড়ির কাজ যথাসময়ে শেষ না করলে যা হবার কথা আর কি।
তুলনামূলকভাবে আমার প্রাইমারী সময়ের(১৯৭৪-১৯৭৮) স্কুলের জীবনটা আনন্দের ছিল। বইপত্রগুলো সহজ নামমাত্র। জ্ঞানের বাড়াবাড়ি দেখা যেতো না স্কুলের প্রথম পাঁচ বছরে। আজকাল তো জ্ঞানবাহনের ষ্টিয়ারিংটা জন্মমাত্রেই শিশুদের ঘাড়ে বেঁধে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। শৈশবের আনন্দ জিনিসটা যাত্রা শুরুর আগেই মরে যায়।
আমার সেই জঘন্য হাইস্কুল জীবনটাই মধুরতম হয়ে উঠেছিল যখন স্কুলের শেষ বছরে আসি। টেষ্ট পরীক্ষার পর ফেয়ারওয়েলের দিন আমরা অঝোরে কেঁদেছিলাম স্কুল জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। কারণ ঐ বছর আমরা এমন একজন শিক্ষকের দেখা পেয়েছিলাম যিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন কি করে পড়াশোনা থেকেও আনন্দ আবিষ্কার করতে হয়। খুব দেরীতে দেখা পেয়েছিলাম তাঁর।
২.
আনন্দের সাথে বড় হওয়ার একটা নেতিবাচক সম্পর্ক আছে।
মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে আনন্দের পরিমাণ কমতে থাকে। একটা ৩ বছরের শিশু যেমন অকারণে হাসতে পারে ১৫ বছরের কিশোর তা পারে না। ২০ বছরের তরুণ তো রীতিমতো গম্ভীর। আজকাল অকালেই পেকে যাচ্ছে শিশুকিশোরের দল, অনেক কম বয়সেই জেনে যাচ্ছে জীবনের অনেক গভীর বিষয় যা তার জানার কথা নয়। তাদের মুখে অনেক শব্দ অবলীলায় উচ্চারিত হতে শুনি যা ত্রিশোর্ধ মানুষও উচ্চারণ করতে দ্বিধা করে। টেলিভিশনের ভুমিকাটা এক্ষেত্রে মারাত্মক। আমাদের শিশুদের শৈশব নষ্ট করে দিচ্ছে টেলিভিশন। গাম্ভীর্যের বয়স আসার আগেই তাদের গম্ভীর করে ফেলছে। দোষটা টেলিভিশনের দেয়া হলেও দায়টা পিতামাতা অভিভাবকের। তারাই শিশুদের টেলিভিশন মুখী করেন নানান উসিলায়।
আনন্দের সাথে বিস্ময়ের সম্পর্ক আরো গভীর। যে যত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বিস্মিত হতে পারবে, সে তত সুখী মানুষ। যার সব জানা হয়ে গেছে, তার মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই। একটা নতুন বই পড়ার আগে যেরকম বিস্ময় জাগায়, পড়া শেষ করে ওই দিকে তেমন তাকাতে ইচ্ছে করে না। একটা ভ্রমণে যাত্রা করার সময় যেরকম আড্ডা হয়, ফিরতি যাত্রায় তার বিপরীত। ইন্টারনেটে কেউ সামান্য একটা ছবি আপলোড করতে পেরেও অনেক আনন্দিত হয়, আবার কেউ আস্ত গুগল আর্থের স্ট্রীট ভিউ দেখেও বিস্মিত হয় না।
তার মানে যার যত জ্ঞান সে তত কম বিস্মিত, তত বেশী গম্ভীর। গম্ভীর মানুষেরা কি সুখী নয়? জানি না। এখানে আবার সমীকরণ মেলে না।
৩.
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি গম্ভীর হতে চেষ্টা করেও উত্তরোত্তর ব্যর্থ হয়েছি। বাধ্য হয়ে হালকা চালে আনন্দিত থাকি, তুচ্ছ জিনিসে ডুবে থাকি। ইংরেজী বোতাম টিপে বাংলা লেখা স্ক্রীনে ভেসে উঠতে দেখে নিজেকে যাদুকর মনে করি। কাগুর কাছ থেকে বাংলাকে মুক্ত করার অভ্রের সংগ্রাম দেখে আলোড়িত, আনন্দিত হই। আমি বাংলায় লিখি, অভ্রের কল্যানে। আমার বাংলা শেখাটাও একটা বিরাট বিস্ময়। এই বিস্ময়ও আছে আনন্দের উৎসে।
৪.
একতরফা প্রেম সুখের হয় না। প্রায়ই হতাশা এসে ভর করে। একটা মেয়েকে একতরফা ভালোবাসতাম। কিন্তু সে বাসতো অন্য আরেকজনকে। আমার দিকে তাকাবার ফুরসত তার নেই। তবু আমি তার সৌন্দর্যে মাধুর্যে বিস্মিত হয়ে একরকম প্রেমেই পড়ে যাই। জেনেশুনে আত্মহত্যার মতো। ওই ভালোবাসার মূল উৎস ছিল বিস্ময়। বিস্ময় থেকে হয়েছিল আনন্দের সুত্রপাত। আর সেই আনন্দের ফলশ্রুতি গভীর প্রেমে পতন। চুড়ান্ত ফলাফল পূর্বনির্ধারিতই ছিল।
চুড়ান্ত ঝামা ঘষে দেবার পর আনন্দ-বিস্ময়-প্রেম-ছ্যাকার চতুর্ভূজ সমীকরণে দুই সংলাপের একটা পদ্যই লিখে বসেছিলাম:
-হে আমার আনন্দিত বিস্মিত প্রেম, তুমি আমারে করিয়াছ অপমান।
-হে নাদান তরুণ, ভালোবাসিয়া যুগে যুগে কে কবে পাইয়াছে পরিত্রাণ।
একজন রাজনীতিবিদের জন্মবৃত্তান্ত
নেয়ামত যখন মেট্রিক পাশ করে গ্রাম থেকে শহরে আসে তখন সে পাজামা-পাঞ্জাবীর সাথে কেডস পরে এসেছিল বলে কলোনিতে একটা হাসাহাসি হয়েছিল। নেয়ামত যে গ্রাম থেকে উঠে এসেছে সেখানে কেডসের সাথে জিন্স কিংবা পাজামার সাথে স্যান্ডেল পরতে হবে সেরকম কোন নিয়মকানুনের বালাই ছিল না।
সবকিছুর সাথে সবকিছু পরা চলে যেখানে, সেখান থেকে বাপ তাকে ঠেলে শহরে পাঠালে দূর সম্পর্কের কাকার বাসায় থেকে কলেজে পড়ার উসিলায় শহরময় চক্কর দিতে পারবে, এর চেয়ে বড় কোন উচ্চাকাংখাও তার ছিল না।
কলোনীর পরিবেশটা প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায় তার। যে দালানে তার কাকার বাসা, তার একটা ব্লক পরেই বিরাট একটা সবুজ মাঠ। মাঠের ঘাসগুলো গ্রামের ঘাসের চেয়ে ভিন্ন। কেমন ছোট ছোট করে ছাঁটা। এত বড় মাঠ, কিন্তু এক কণা ধান-গম-সবজির চাষ নাই কোনখানে। পুরো মাঠ জুড়ে হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে একদল কিশোর তরুণ। কেউ ফুটবলে লাথি মারছে, কেউ ব্যাডমিন্টন খেলছে(এই খেলা আগে দেখেনি সে), কেউ বেহুদা লাফাচ্ছে, কেউ বাঁশের ধনুক নিয়ে কায়দা করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে পেরেক গাঁথা তীর। মাঠের চারপাশে বাদাম বুট চানাচুরের ফেরীওয়ালা সারিবদ্ধভাবে বসে গেছে।
তাকে নিয়ে যারা হাসাহাসি করেছিল প্রথম দেখায়, তাদেরই একজনের সাথে পরিচয় ঘটে গেল বাদাম কিনতে গিয়ে। নাম তারেক। মাঠের পূর্বদিকে একটা মেটারনিটি ক্লিনিক। তার পেছনে আরেকটা মাঠ তারপর মসজিদ। তারেক নেয়ামতকে নিয়ে গেল হাসপাতালের পেছনের মাঠে। এই মাঠটা অনেক নীরব। এখানে গোল হয়ে বসে কি যেন করছে সবাই। সেই আসরে নিয়ে নেয়ামতকে পরিচয় করাতেই সবাই তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আরেক চোট হেসে নিল। নেয়ামত বোকাবোকা হাসি দিয়ে শহরের এই নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলো।
তারেকদের দলের নেতা রবি। পেছনের মাঠে তার রাজত্ব। রাজনীতি ব্যাপারটা নেয়ামত আগে ভাসা ভাসা শুনলেও এই প্রথম দেখলো একজন রাজনৈতিক নেতা রবিকে। কলেজের ছাত্র নেতা বলে তাকে সবাই সমীহ করে। কেন যেন প্রথমদিন রবিকে দেখেই নেয়ামতের শখ লাগলো নেতা হবার জন্য। কিন্তু মন খুলে কাউকে বলতে পারে না লজ্জায়।
কয়েক মাসের মধ্যেই নেয়ামত শহুরে কায়দা মোটামুটি রপ্ত করে ফেললো। এখন সে প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করতে শিখেছে এবং শিখেছে মাথাটা তেল ছাড়া উসকো খুশকো রাখতে। আগে নিয়ম করে দুবেলা নারিকেল তেল দিত মাথায় আর প্যান্টের পেছনের পকেটে একটা চিরুণী থাকতো।
একদিন সন্ধ্যায় তারেককে পকেট থেকে একটা চিরুনী বের করতে দেখে তার মাথা আচড়ানোর কথা মনে পড়লে সে চিরুণীটা ধার চাইল। তারেক তার হাতে চিরুনী সাইজের যে জিনিস ধরিয়ে দিলে সেটা আসলে একটা ভাঁজকরা ক্ষুর। নেয়ামতের গা বেয়ে শিরশির অনুভুতি বয়ে গেল। ক্ষুর কেন জানতে চাইলে তারেক জানালো, ক্ষুর হলো প্রাথমিক অস্ত্র। রবির কাছে আরো ভয়ংকর জিনিস আছে। মাছ মার্কা ছুরি। রাজনীতি করতে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এসব রাখতে হয়।
নেয়ামত ধরতে পারছে না ওদের আসল উদ্দেশ্যটা কি। এরকম ধারালো অস্ত্র পকেটে থাকলে কোন সময় কি বিপদ হয়। সে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু বুঝতে পারে এইসব অস্ত্রের কারনে কলোনীতে তাদের দলকে সবাই সমীহ করে।
সমীহ জিনিসটার প্রতি তারও গোপন লোভ আছে। এই জিনিস তার দখলে ছিল না কখনো। চিরকাল অবজ্ঞাই পেয়ে এসেছে। এখানে আসার পর তো অবস্থা দুর্বিসহ। এমনকি মোড়ের পানের দোকানদারও তাকে দেখলে হাসে। আড়ালে 'পাঞ্জাবী কেডস' ডাকে। যদিও সে রবি দলের পাকাপাকি সদস্য হবার পথে, তবু তার দুর্নাম ঘুচে না।
একদিন মসজিদ মার্কেটে ডিম কিনতে গেলে ডিমঅলা তাকে দেখে বলে, ভাইজানের কেডস কই আইজ? ইঙ্গিতটা বুঝলো সে। তবু চুপ করে রইলো। দেখলো পাশের তরকারীওয়ালাও খিক খিক করে হাসছে। সে জবাব না দিয়ে বিকালে তারেকের কাছে ব্যাপারটা জানালো। তারেক ঘটনাটা রবিকে বলতেই রবি হো হো করে হেসে উঠলো প্রথমে। তারপর সুক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে নেয়ামতকে মিনিটখানেক দেখে তারেকের কানে কানে কি যেন বললো। নেয়ামত তখন মরমে মরে যাচ্ছিল। কেন বলতে গেল? এখন তো আরো অপমান।
কিন্তু রবি তাকে ডাক দিয়ে বললো, আয় চল্ যাই।
সে অবাক, কোথায় যাবো?
রবি বলে, আমরা দেখে আসি তোকে কে কি বলছে। আয় সবাই।
দলবল নিয়ে মসজিদ মার্কেটের ডিমের দোকানে গেল ওরা। পাশেই তরকারীর দোকান। রবি হাঁসের ডিমের খাঁচাটা খুলে নিয়ে নেয়ামতের হাতে দিয়ে বললো, এটা কতদূরে ছুঁড়ে মারতে পারিস দেখাতো!
নেয়ামতের গায়ে তখনো অপমানের আগুন। ডিমের খাঁচাটা এমন জোরে ছুঁড়ে মারলো, ওটা মার্কেটের ওপাশের বেকারীর সামনে থপ করে আছাড় খেয়ে পড়লো এবং সবগুলো ডিম ভেঙে জায়গাটা হলদেটে থকথক করে দিল। ডিমঅলার মুখে রা নেই। পুরো বাজারের সবাই চুপ। মুখ খুলতে গেলে আরো বিপদ ওরা জানে।
রবি এবার ওকে নিয়ে তরকারীঅলার দিকে নিয়ে ফিরতেই তরকারীঅলা এসে রবির পায়ে পড়ে অবস্থা। "ভাইজান ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না। এবারের মতো মাফ করে দেন।" কেস খতম।
পরদিন থেকে নেয়ামতকে দেখলে বাজারের দোকানীরা সালাম দেয়া শুরু করে। একমাস পর নেয়ামতকে রবির মোটর সাইকেলের পেছনে ঘুরতে দেখা গেল। মাথায় উল্টো করে ক্যাপ পরা, চোখে কালো চশমা। আর দলের সবাই জানে ওর পেছনের পকেটে একটা ক্ষুরও যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি। নেয়ামত এখন ছাত্র নেতা। কলেজের সংসদ নির্বাচনে নেয়ামতকে ক্রীড়া সম্পাদকের পদ দেয়া হলো, যদিও হাডুডু বাদে জীবনে অন্য কোন খেলা সে কখনো খেলেনি।
সেই ছোট্ট চারাগাছটি একদিন মহীরূহ হলো। জন্ম হয়ে গেল একজন মহান রাজনীতিবিদের।
উনিশ বছর পর হাজী নেয়ামত আলী পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে এমপি নির্বাচনের নমিনেশান কিনবেন, দশ কোটি টাকা ব্যয় করে নির্বাচন করবেন আর পাঁচ বছর ধরে সেই পনেরো কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ আদায় করবেন দেড়শো কোটি টাকায়। গনতন্ত্রের এই মহান নেতা সব পেয়েছেন জীবনে, কেবল মন্ত্রী হওয়াটাই বাকী। মন্ত্রী হতে গেলে কতো টাকা লাগে তিনি তা জানেন না, তবে মন্ত্রীত্ব অর্জনের আগে তিনি যা অর্জন করতে চান তা নাহিয়ানের মা সেদিন মুখ ফসকে বলে দেয়াতে সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হলো না আর।
তার প্রথম ঘরের স্ত্রী সেদিন কথায় কথায় বলছিল, "ডক্টরেট ডিগ্রীটা এবার নিয়াই ফালান নাহিয়ানের বাপ! হাজীসাব শুনতে আর ভাল্লাগে না।"
সবকিছুর সাথে সবকিছু পরা চলে যেখানে, সেখান থেকে বাপ তাকে ঠেলে শহরে পাঠালে দূর সম্পর্কের কাকার বাসায় থেকে কলেজে পড়ার উসিলায় শহরময় চক্কর দিতে পারবে, এর চেয়ে বড় কোন উচ্চাকাংখাও তার ছিল না।
কলোনীর পরিবেশটা প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায় তার। যে দালানে তার কাকার বাসা, তার একটা ব্লক পরেই বিরাট একটা সবুজ মাঠ। মাঠের ঘাসগুলো গ্রামের ঘাসের চেয়ে ভিন্ন। কেমন ছোট ছোট করে ছাঁটা। এত বড় মাঠ, কিন্তু এক কণা ধান-গম-সবজির চাষ নাই কোনখানে। পুরো মাঠ জুড়ে হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে একদল কিশোর তরুণ। কেউ ফুটবলে লাথি মারছে, কেউ ব্যাডমিন্টন খেলছে(এই খেলা আগে দেখেনি সে), কেউ বেহুদা লাফাচ্ছে, কেউ বাঁশের ধনুক নিয়ে কায়দা করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে পেরেক গাঁথা তীর। মাঠের চারপাশে বাদাম বুট চানাচুরের ফেরীওয়ালা সারিবদ্ধভাবে বসে গেছে।
তাকে নিয়ে যারা হাসাহাসি করেছিল প্রথম দেখায়, তাদেরই একজনের সাথে পরিচয় ঘটে গেল বাদাম কিনতে গিয়ে। নাম তারেক। মাঠের পূর্বদিকে একটা মেটারনিটি ক্লিনিক। তার পেছনে আরেকটা মাঠ তারপর মসজিদ। তারেক নেয়ামতকে নিয়ে গেল হাসপাতালের পেছনের মাঠে। এই মাঠটা অনেক নীরব। এখানে গোল হয়ে বসে কি যেন করছে সবাই। সেই আসরে নিয়ে নেয়ামতকে পরিচয় করাতেই সবাই তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আরেক চোট হেসে নিল। নেয়ামত বোকাবোকা হাসি দিয়ে শহরের এই নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলো।
তারেকদের দলের নেতা রবি। পেছনের মাঠে তার রাজত্ব। রাজনীতি ব্যাপারটা নেয়ামত আগে ভাসা ভাসা শুনলেও এই প্রথম দেখলো একজন রাজনৈতিক নেতা রবিকে। কলেজের ছাত্র নেতা বলে তাকে সবাই সমীহ করে। কেন যেন প্রথমদিন রবিকে দেখেই নেয়ামতের শখ লাগলো নেতা হবার জন্য। কিন্তু মন খুলে কাউকে বলতে পারে না লজ্জায়।
কয়েক মাসের মধ্যেই নেয়ামত শহুরে কায়দা মোটামুটি রপ্ত করে ফেললো। এখন সে প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করতে শিখেছে এবং শিখেছে মাথাটা তেল ছাড়া উসকো খুশকো রাখতে। আগে নিয়ম করে দুবেলা নারিকেল তেল দিত মাথায় আর প্যান্টের পেছনের পকেটে একটা চিরুণী থাকতো।
একদিন সন্ধ্যায় তারেককে পকেট থেকে একটা চিরুনী বের করতে দেখে তার মাথা আচড়ানোর কথা মনে পড়লে সে চিরুণীটা ধার চাইল। তারেক তার হাতে চিরুনী সাইজের যে জিনিস ধরিয়ে দিলে সেটা আসলে একটা ভাঁজকরা ক্ষুর। নেয়ামতের গা বেয়ে শিরশির অনুভুতি বয়ে গেল। ক্ষুর কেন জানতে চাইলে তারেক জানালো, ক্ষুর হলো প্রাথমিক অস্ত্র। রবির কাছে আরো ভয়ংকর জিনিস আছে। মাছ মার্কা ছুরি। রাজনীতি করতে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এসব রাখতে হয়।
নেয়ামত ধরতে পারছে না ওদের আসল উদ্দেশ্যটা কি। এরকম ধারালো অস্ত্র পকেটে থাকলে কোন সময় কি বিপদ হয়। সে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু বুঝতে পারে এইসব অস্ত্রের কারনে কলোনীতে তাদের দলকে সবাই সমীহ করে।
সমীহ জিনিসটার প্রতি তারও গোপন লোভ আছে। এই জিনিস তার দখলে ছিল না কখনো। চিরকাল অবজ্ঞাই পেয়ে এসেছে। এখানে আসার পর তো অবস্থা দুর্বিসহ। এমনকি মোড়ের পানের দোকানদারও তাকে দেখলে হাসে। আড়ালে 'পাঞ্জাবী কেডস' ডাকে। যদিও সে রবি দলের পাকাপাকি সদস্য হবার পথে, তবু তার দুর্নাম ঘুচে না।
একদিন মসজিদ মার্কেটে ডিম কিনতে গেলে ডিমঅলা তাকে দেখে বলে, ভাইজানের কেডস কই আইজ? ইঙ্গিতটা বুঝলো সে। তবু চুপ করে রইলো। দেখলো পাশের তরকারীওয়ালাও খিক খিক করে হাসছে। সে জবাব না দিয়ে বিকালে তারেকের কাছে ব্যাপারটা জানালো। তারেক ঘটনাটা রবিকে বলতেই রবি হো হো করে হেসে উঠলো প্রথমে। তারপর সুক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে নেয়ামতকে মিনিটখানেক দেখে তারেকের কানে কানে কি যেন বললো। নেয়ামত তখন মরমে মরে যাচ্ছিল। কেন বলতে গেল? এখন তো আরো অপমান।
কিন্তু রবি তাকে ডাক দিয়ে বললো, আয় চল্ যাই।
সে অবাক, কোথায় যাবো?
রবি বলে, আমরা দেখে আসি তোকে কে কি বলছে। আয় সবাই।
দলবল নিয়ে মসজিদ মার্কেটের ডিমের দোকানে গেল ওরা। পাশেই তরকারীর দোকান। রবি হাঁসের ডিমের খাঁচাটা খুলে নিয়ে নেয়ামতের হাতে দিয়ে বললো, এটা কতদূরে ছুঁড়ে মারতে পারিস দেখাতো!
নেয়ামতের গায়ে তখনো অপমানের আগুন। ডিমের খাঁচাটা এমন জোরে ছুঁড়ে মারলো, ওটা মার্কেটের ওপাশের বেকারীর সামনে থপ করে আছাড় খেয়ে পড়লো এবং সবগুলো ডিম ভেঙে জায়গাটা হলদেটে থকথক করে দিল। ডিমঅলার মুখে রা নেই। পুরো বাজারের সবাই চুপ। মুখ খুলতে গেলে আরো বিপদ ওরা জানে।
রবি এবার ওকে নিয়ে তরকারীঅলার দিকে নিয়ে ফিরতেই তরকারীঅলা এসে রবির পায়ে পড়ে অবস্থা। "ভাইজান ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না। এবারের মতো মাফ করে দেন।" কেস খতম।
পরদিন থেকে নেয়ামতকে দেখলে বাজারের দোকানীরা সালাম দেয়া শুরু করে। একমাস পর নেয়ামতকে রবির মোটর সাইকেলের পেছনে ঘুরতে দেখা গেল। মাথায় উল্টো করে ক্যাপ পরা, চোখে কালো চশমা। আর দলের সবাই জানে ওর পেছনের পকেটে একটা ক্ষুরও যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি। নেয়ামত এখন ছাত্র নেতা। কলেজের সংসদ নির্বাচনে নেয়ামতকে ক্রীড়া সম্পাদকের পদ দেয়া হলো, যদিও হাডুডু বাদে জীবনে অন্য কোন খেলা সে কখনো খেলেনি।
সেই ছোট্ট চারাগাছটি একদিন মহীরূহ হলো। জন্ম হয়ে গেল একজন মহান রাজনীতিবিদের।
উনিশ বছর পর হাজী নেয়ামত আলী পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে এমপি নির্বাচনের নমিনেশান কিনবেন, দশ কোটি টাকা ব্যয় করে নির্বাচন করবেন আর পাঁচ বছর ধরে সেই পনেরো কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ আদায় করবেন দেড়শো কোটি টাকায়। গনতন্ত্রের এই মহান নেতা সব পেয়েছেন জীবনে, কেবল মন্ত্রী হওয়াটাই বাকী। মন্ত্রী হতে গেলে কতো টাকা লাগে তিনি তা জানেন না, তবে মন্ত্রীত্ব অর্জনের আগে তিনি যা অর্জন করতে চান তা নাহিয়ানের মা সেদিন মুখ ফসকে বলে দেয়াতে সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হলো না আর।
তার প্রথম ঘরের স্ত্রী সেদিন কথায় কথায় বলছিল, "ডক্টরেট ডিগ্রীটা এবার নিয়াই ফালান নাহিয়ানের বাপ! হাজীসাব শুনতে আর ভাল্লাগে না।"
“ব্লগ লিখে ব্লগারই হয়, ব্লগ লিখে সাহিত্যিক নয়”
[ব্লগ নিয়ে কোন একটা উন্নত নাসিকার মঞ্চ থেকে শিরোনামের তীরটা নিক্ষিপ্ত হতে দেখেই এই আপাতঃ জ্ঞানী লেখাটির সূত্রপাত।]
লেখক দুই ধরনের। একদল লেখেন নিজের জন্য। আরেকদল লেখেন পাঠকের জন্য। আরো শুদ্ধ করে বলতে গেলে, যখন নিজের জন্য লেখেন তখন লেখকের উন্মেষকাল। এই সময়ের লেখাগুলি একজন লেখকের শ্রেষ্ঠ লেখা। এই সময়ে লেখকের ভেতর পাঠকের চিন্তা থাকে না, বাজারের চাহিদা থাকে না, কাটতির টেনশান থাকে না, প্রকাশকের চাপ থাকে না। লেখালেখি থাকে উন্মুক্ত। ভেতর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস কিংবা উচ্ছ্বাসগুলোকে শব্দের গাঁথুনিতে প্রকাশ করার চমৎকার একটা প্রয়াস থাকে এই সময়টাতে। যখন অন্যের জন্য, বাজারের জন্য, পাঠকের জন্য, পত্রিকার জন্য লেখেন, তখন লেখকের পরিণতকাল হলেও তাঁর আদি আন্তরিকতা আর বোধের প্রকাশ প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে।
তাই যে কোন লেখকের পরিণত বয়সের লেখার চেয়ে কাঁচা বয়সের লেখার মধ্যে রসের যোগান বেশী। কাঁচা হাতের লেখাও পাঠসুন্দর থাকে। হুমায়ুন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ কিংবা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ একটা উদাহরণ হতে পারে।
আজকাল অনেকেই লেখে। প্রযুক্তির সুলভতার কারণে লেখালেখির পরিমাণ অনেক বেশী যার মধ্যে ব্লগ অন্যতম একটি মাধ্যম।
ব্লগ লেখে কারা? বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে ব্লগ জিনিসটাই অপরিচিত। কেবল ইন্টারনেট ও পত্রিকার সাথে যুক্ত মানুষেরর একাংশই ব্লগ সম্পর্কে জ্ঞাত। যাদের প্রায় সবাই অতি তরুণ। গত দুবছরে অন্ততঃ ২০টা নতুন কমিউনিটি ব্লগ এসেছে। মতাদর্শের ভিত্তিতে ব্লগগুলি একেকটা পাড়ায় বিভক্ত। আবার প্রত্যেক ব্লগেরই কিছু না কিছু আবাসিক লেখক থাকেন যাঁরা ওই ব্লগেই লেখেন। এটা একটা নেশাও বটে। লেখালেখি ছাড়াও আড্ডা দেবার জনপ্রিয় একটা আয়না একেকটি ব্লগ কমিউনিটি। বাংলা ব্লগের বয়স তিন বছরের সামান্য উপরে।
প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কাছে ব্লগ এখনো তেমন গুরত্ব না পেলেও এই ব্লগ থেকেই এমন কিছু লেখক উঠে এসেছেন যাঁদের রচনাশৈলী রীতিমত ঈর্ষণীয়। নাম বলে বিব্রত করবো না, কিন্তু কয়েকটা প্রধান ব্লগ মিলে অন্ততঃ বিশজন ব্লগারের লেখার মানকে আমি জীবিত যে কোন প্রতিষ্ঠিত লেখকের সাথে তুল্য বলে মনে করি। কিন্তু বয়সে তরুণ বলেই এখনো তাঁদের কাজের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। তাঁদের অনেকের কোন বইই বের হয়নি। তাঁদের প্রত্যেকের লেখার তাড়না স্বতঃপ্রণোদিত। এই তারুণ্যটাই তাঁদের মূল শক্তি। তাঁদের হাতে আলোর মশাল তুলে দিয়েছে বলে কমিউনিটি ব্লগগুলোর কাছে জাতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ এই ব্লগগুলির বেশীরভাগেরই পরিচালন ব্যয় তুলতে হয় চাঁদা দিয়ে। অথচ তাঁদের কাজগুলো অমূল্য সম্পদ।
কী নেই ব্লগে? গবেষণা আছে, তথ্য আছে, গল্প আছে, উপন্যাস আছে, সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে সামাজিক আন্দোলনের ডাক আছে, প্রতিবাদ আছে। পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশী দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় এই কমিউনিটির কাছ থেকে।
এই লেখকেরা আজ লিখছেন মনের তাগিদে। লেখক হবার উন্মেষকাল পেরুচ্ছে তাঁদের। একজন লেখক লেখালেখির প্রাথমিক শিহরন পেরিয়ে যখন জনপ্রিয়তার পাঠকপ্রিয়তার নির্দিষ্ট ধাপ পেরিয়ে যায়, তখন বাজারে মুদ্রিত বই আসতে শুরু করে। মুদ্রিত বইয়ের সাফল্য যাদের লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, তারাই ভবিষ্যতে টিকে থাকে।
তবে লেখক যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন কি শিল্পের শরীর অক্ষত থাকে? জনপ্রিয়তার কাঁটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করলে লেখকের ব্যস্ততা বাড়ে, লেখালেখির আত্মিক তাগিদের চেয়ে বাহ্যিক চাহিদার প্রতি মনোযোগ বাড়ে। আবার এই বাড়ন্ত চাহিদার প্রতিক্রিয়ায় লেখার মানও নিম্নগামী হতে থাকে। একসময় লেখক পরিণত হয় চার হাত পায়ে যা-তা লেখা জনপ্রিয় সেলেব্রিটিতে। এই সময়কে যদিও বাহ্যিকভাবে দেখা হয় লেখকের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে, কিন্তু আমার চোখে এই সময়টা আসলে লেখকের মৃত্যুকাল যখন বইয়ের গুণ নয়, লেখকের নাম দেখেই বই কিনতে শুরু করে পাঠক।
সাইনবোর্ডের আকার যখন বেড়ে যায়, তখন লেখকের নিজের তাগিদ বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। অন্যের তাগিদেই, বাজারের চাহিদা মেটাতেই লেখক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ততক্ষণে আদি আসল লেখকটার মৃত্যু ঘটে গেছে।
সুতরাং নিন্দুকেরা কিংবা ঈর্ষাবায়ুগ্রস্তরা যাই বলুক, এই তরুণ ব্লগারদের কেউ কেউ একদিন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হবেন। প্রকাশকেরা তখন আগাম পয়সা দিয়ে তাঁদের বুকিং দিয়ে রাখবেন, পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকেরা ঈদসংখ্যার পৃষ্ঠা পূরণ করতে এঁদের শরণাপন্ন হবেন। কিন্তু তখন তাঁর প্রতিষ্ঠার কাল, উপার্জনের কাল, খ্যাতির কাল। উন্মেষের কাল তিনি পেরিয়ে এসেছেন ব্লগেই। জীবনের সেরা লেখাগুলোও রেখে এসেছেন ব্লগে। সবচেয়ে ভালো লেখাগুলো লেখার সময় তিনি সাহিত্যিক স্বীকৃত নন, প্রকাশকের আবদারে গার্বেজ লেখার সময়েই তিনি সাহিত্যিক।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি কি ব্লগ লিখতেন নাকি ব্লগারদের নিয়ে নাক সিঁটকাতেন? জানার উপায় নেই।
তবু একটা উপসংহারে আসা যায়, সকল ব্লগারই লেখক হন কিন্তু সকল লেখক ব্লগার নন।
লেখক দুই ধরনের। একদল লেখেন নিজের জন্য। আরেকদল লেখেন পাঠকের জন্য। আরো শুদ্ধ করে বলতে গেলে, যখন নিজের জন্য লেখেন তখন লেখকের উন্মেষকাল। এই সময়ের লেখাগুলি একজন লেখকের শ্রেষ্ঠ লেখা। এই সময়ে লেখকের ভেতর পাঠকের চিন্তা থাকে না, বাজারের চাহিদা থাকে না, কাটতির টেনশান থাকে না, প্রকাশকের চাপ থাকে না। লেখালেখি থাকে উন্মুক্ত। ভেতর থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস কিংবা উচ্ছ্বাসগুলোকে শব্দের গাঁথুনিতে প্রকাশ করার চমৎকার একটা প্রয়াস থাকে এই সময়টাতে। যখন অন্যের জন্য, বাজারের জন্য, পাঠকের জন্য, পত্রিকার জন্য লেখেন, তখন লেখকের পরিণতকাল হলেও তাঁর আদি আন্তরিকতা আর বোধের প্রকাশ প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে।
তাই যে কোন লেখকের পরিণত বয়সের লেখার চেয়ে কাঁচা বয়সের লেখার মধ্যে রসের যোগান বেশী। কাঁচা হাতের লেখাও পাঠসুন্দর থাকে। হুমায়ুন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ কিংবা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ একটা উদাহরণ হতে পারে।
আজকাল অনেকেই লেখে। প্রযুক্তির সুলভতার কারণে লেখালেখির পরিমাণ অনেক বেশী যার মধ্যে ব্লগ অন্যতম একটি মাধ্যম।
ব্লগ লেখে কারা? বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে ব্লগ জিনিসটাই অপরিচিত। কেবল ইন্টারনেট ও পত্রিকার সাথে যুক্ত মানুষেরর একাংশই ব্লগ সম্পর্কে জ্ঞাত। যাদের প্রায় সবাই অতি তরুণ। গত দুবছরে অন্ততঃ ২০টা নতুন কমিউনিটি ব্লগ এসেছে। মতাদর্শের ভিত্তিতে ব্লগগুলি একেকটা পাড়ায় বিভক্ত। আবার প্রত্যেক ব্লগেরই কিছু না কিছু আবাসিক লেখক থাকেন যাঁরা ওই ব্লগেই লেখেন। এটা একটা নেশাও বটে। লেখালেখি ছাড়াও আড্ডা দেবার জনপ্রিয় একটা আয়না একেকটি ব্লগ কমিউনিটি। বাংলা ব্লগের বয়স তিন বছরের সামান্য উপরে।
প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কাছে ব্লগ এখনো তেমন গুরত্ব না পেলেও এই ব্লগ থেকেই এমন কিছু লেখক উঠে এসেছেন যাঁদের রচনাশৈলী রীতিমত ঈর্ষণীয়। নাম বলে বিব্রত করবো না, কিন্তু কয়েকটা প্রধান ব্লগ মিলে অন্ততঃ বিশজন ব্লগারের লেখার মানকে আমি জীবিত যে কোন প্রতিষ্ঠিত লেখকের সাথে তুল্য বলে মনে করি। কিন্তু বয়সে তরুণ বলেই এখনো তাঁদের কাজের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। তাঁদের অনেকের কোন বইই বের হয়নি। তাঁদের প্রত্যেকের লেখার তাড়না স্বতঃপ্রণোদিত। এই তারুণ্যটাই তাঁদের মূল শক্তি। তাঁদের হাতে আলোর মশাল তুলে দিয়েছে বলে কমিউনিটি ব্লগগুলোর কাছে জাতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ এই ব্লগগুলির বেশীরভাগেরই পরিচালন ব্যয় তুলতে হয় চাঁদা দিয়ে। অথচ তাঁদের কাজগুলো অমূল্য সম্পদ।
কী নেই ব্লগে? গবেষণা আছে, তথ্য আছে, গল্প আছে, উপন্যাস আছে, সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে সামাজিক আন্দোলনের ডাক আছে, প্রতিবাদ আছে। পত্রিকার চেয়ে অনেক বেশী দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় এই কমিউনিটির কাছ থেকে।
এই লেখকেরা আজ লিখছেন মনের তাগিদে। লেখক হবার উন্মেষকাল পেরুচ্ছে তাঁদের। একজন লেখক লেখালেখির প্রাথমিক শিহরন পেরিয়ে যখন জনপ্রিয়তার পাঠকপ্রিয়তার নির্দিষ্ট ধাপ পেরিয়ে যায়, তখন বাজারে মুদ্রিত বই আসতে শুরু করে। মুদ্রিত বইয়ের সাফল্য যাদের লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, তারাই ভবিষ্যতে টিকে থাকে।
তবে লেখক যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন কি শিল্পের শরীর অক্ষত থাকে? জনপ্রিয়তার কাঁটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করলে লেখকের ব্যস্ততা বাড়ে, লেখালেখির আত্মিক তাগিদের চেয়ে বাহ্যিক চাহিদার প্রতি মনোযোগ বাড়ে। আবার এই বাড়ন্ত চাহিদার প্রতিক্রিয়ায় লেখার মানও নিম্নগামী হতে থাকে। একসময় লেখক পরিণত হয় চার হাত পায়ে যা-তা লেখা জনপ্রিয় সেলেব্রিটিতে। এই সময়কে যদিও বাহ্যিকভাবে দেখা হয় লেখকের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে, কিন্তু আমার চোখে এই সময়টা আসলে লেখকের মৃত্যুকাল যখন বইয়ের গুণ নয়, লেখকের নাম দেখেই বই কিনতে শুরু করে পাঠক।
সাইনবোর্ডের আকার যখন বেড়ে যায়, তখন লেখকের নিজের তাগিদ বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। অন্যের তাগিদেই, বাজারের চাহিদা মেটাতেই লেখক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ততক্ষণে আদি আসল লেখকটার মৃত্যু ঘটে গেছে।
সুতরাং নিন্দুকেরা কিংবা ঈর্ষাবায়ুগ্রস্তরা যাই বলুক, এই তরুণ ব্লগারদের কেউ কেউ একদিন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হবেন। প্রকাশকেরা তখন আগাম পয়সা দিয়ে তাঁদের বুকিং দিয়ে রাখবেন, পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকেরা ঈদসংখ্যার পৃষ্ঠা পূরণ করতে এঁদের শরণাপন্ন হবেন। কিন্তু তখন তাঁর প্রতিষ্ঠার কাল, উপার্জনের কাল, খ্যাতির কাল। উন্মেষের কাল তিনি পেরিয়ে এসেছেন ব্লগেই। জীবনের সেরা লেখাগুলোও রেখে এসেছেন ব্লগে। সবচেয়ে ভালো লেখাগুলো লেখার সময় তিনি সাহিত্যিক স্বীকৃত নন, প্রকাশকের আবদারে গার্বেজ লেখার সময়েই তিনি সাহিত্যিক।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি কি ব্লগ লিখতেন নাকি ব্লগারদের নিয়ে নাক সিঁটকাতেন? জানার উপায় নেই।
তবু একটা উপসংহারে আসা যায়, সকল ব্লগারই লেখক হন কিন্তু সকল লেখক ব্লগার নন।
Subscribe to:
Posts (Atom)