ক.
অনেক কিছু মনে নেই। স্রেফ ভুলে গেছি অনেক গুরুত্বপূর্ন ঘটনা, দিন, কাল। অথচ একদম নগণ্য কিছু স্মৃতি মগজের নিউরনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে। পুরোপুরি ভুলে যাবার আগে স্মৃতির আদিকাল খুঁড়ে প্রথম পড়া কিংবা শোনা কবিতা/গান গুলোর একটা সন তালিকা করছিলাম এভাবে-
১. আমার সোনার বাংলা......১৯৭২
২. আমি হব সকাল বেলার পাখি.......১৯৭৪
৩. চল চল চল...........১৯৭৫
৪. ছিপখান তিনদাড়.....১৯৭৬
খ.
হঠাৎ ফ্লাশব্যাক হলো মাথায়। কি একটা ছবি, কোন একটা বই, বাংলা বই হবে সম্ভবতঃ। ক্লাস থ্রীর বাংলা বইয়ের একটা সাদাকালো ছবি। কার ছবি ছিল ওটা? সম্রাট আকবর না শাহজাহান? কী দারুণ রং দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল আপা। পুষ্প'পা, মনে আছে তুমি আমার ক্লাস থ্রীর বইয়ের একটা ছবি রং করে দিয়েছিলে? ছবিটা কোন একটা গল্পের সাথে দেয়া ছিল। গল্পটার নাম ভুলে গেছি। কিন্তু তোমার রং পেন্সিলে আঁকা সেই ছবিটা কেন যেন এই মুহূর্তে ভেসে উঠলো চোখে। কতোকাল আগের কথা? তোমার তো মনে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ওই ছবিটা আমার এত প্রিয় ছিল, বইটা ফেলতে পারিনি বহুদিন।
গ.
সবাই ছেলেবেলাটা খুব মিস করে। কিন্তু ছেলেবেলার প্রিয় স্মৃতিগুলো মুছে ফেলতে না চাইলেও একটা স্মৃতির পরতে আরেকটা স্মৃতি বসে যায় বলে অনেক ছবি হারিয়ে যায়। স্মৃতি কি? স্মৃতির সাথে কি মেমোরি কার্ডের তুলনা করা যায়? একটা মেমোরি ষ্টিকে শব্দ, গ্রাফিক্স, টেক্সট সবরকমের জিনিস থাকে। মগজের কোষেও সেরকম না? গানগুলো গানের ফরমেটে, কথাগুলো কথার ফরমেটে, দৃশ্যগুলো ভিডিও ফরমেটে। কিন্তু ছেলেবেলায় পড়া বইপত্রগুলো কি ফরমেটে থাকে সেটা এখনো বের করতে পারিনি। বহুকাল আগে পড়া একটা উপন্যাস যেটুকু মনে থাকে সেটা একটা দৃশ্যকল্প কিংবা কল্প দৃশ্যের ফরমেটে জেগে থাকে। বইয়ের টেক্সট ফরমেট মাথার ভেতর তেমন ঢোকে না। ঢুকলেও সেটা পিডিএফ কিংবা জেপিজি ফরমেটে ঢোকে মনে হয়।
ঘ.
তুমুল বৃষ্টির দিন। স্কুল থেকে দৌড়ে ফিরতে গিয়ে ভিজে একসা। ছাতা নেই। দাড়িয়েছি প্রতিবেশীর বারান্দায়। ঠিক বারান্দা নয়। দরোজার সামনে একটু ছায়ার মতো ছানশেড। মোটেও ঝড়ো বৃষ্টি থেকে রক্ষার উপযুক্ত নয়। ঠক ঠক ঠক করছি মনে মনে। দাঁতে দাঁতে ঠোক্কর খাচ্ছে শীতল বাতাসে। সেই শব্দ কানে বাজছে। ভীতু আমি দরোজায় কড়া নেড়ে বলতে পারছি না আমি ভিজে গেছি দরোজা খোলো আমাকে ঢোকাও, বইগুলো বাঁচাতে চাই। শার্টের ভেতর ঢুকিয়ে দুহাতে বুকে চেপে রেখেছি। তবু শেষ রক্ষা হলো না। ভিজেই গেল প্রায়। বাসা খুব দুরে নয়। এখানে না দাড়িয়ে ছুট দিলে বাসায় পৌছে যেতাম এতক্ষনে। কি বোকামি। কাউকে বলা যায়? যা ভেজার ভিজেই তো গেল। ছুটে গিয়ে বাসায় পৌছে গেলাম দুই মিনিটে। চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেলাম। কাউকে বললাম না বোকামির গল্পটা। ক্লাস নাইনে পড়ে এতটা হাঁদারাম কেউ হয় না।
ঙ.
প্রথম নৌকায় চড়া এবং নৌকাডুবি দেখা। ইসহাক চাচার বিয়ে হচ্ছিল। জীবনে প্রথম বিয়ের স্মৃতি। কতোসাল মনে নেই। আদিকালেরই কথা। ইশকুলে পড়ি না তখনো। গ্রামে থাকতাম। এটুকু মনে আছে। বাবা থাকতো কর্মস্থলে শহরে। সকাল বেলা চাচাদের হাত ধরে চলে গেলাম অনেক দূরের বিয়েবাড়ীতে। গিয়েছিলাম জীপে করে এটুকু মনে আছে। বিয়ে বাড়ীতে তেমন কিছু মনে নেই। কিন্তু ফিরে আসার পথে জীপের বদলে নৌকা নেয়া হলো কেন জানি। মাঝনদীতে এসে হঠাৎ নৌকায় পানি উঠতে শুরু করে। বরযাত্রীবাহী বিরাট নৌকা। শংখ নদী দিয়ে যাচ্ছিল। মাঝি চিৎকার দিয়ে বললো নৌকার তলা দিয়ে পানি ঢুকছে, বাচ্চা বাদে সবাই যে নেমে যায়। সবাই নৌকা থেকে লাফঝাপ দিয়ে নেমে সাঁতরে কূলে উঠলো। কনিষ্ঠতম বরযাত্রী আমি আর ফুপাতো বোন শাহীন। আমরা এক বুড়ো দাদুর সাথে গুটিশুটি নৌকার ছইয়ের নীচে পাটিতে বসে ভয়ে ফিঁ ফিঁ করে কাঁদছি।
অবশেষে মাঝি নিরাপদে আমাদের কুলে নামালো। বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। ওদিকে বাবা শহর থেকে বাড়ী ফিরে শুনলো আমি বিয়েবাড়িতে গেছি। আমাকে বিয়েবাড়িতে পাঠানোর অপরাধে মায়ের উপর একচোট নিয়ে জানলো আমাকে নিয়ে গেছে চাচাদের কেউ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমরা তখনো ফিরিনি। টেনশানে রাগে বাবা ফেরার পথে অপেক্ষায় থাকলো। আমাকে বরণ করে নেবার জন্য না, বরং আমাকে যে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে সেই চাচাকে ধোলাই করার জন্য। বাবা খুব বদরাগী ছিল। বরযাত্রীদল যখন অন্ধকার পথে হেঁটে আসছিল বাবার উপস্থিতি জানান দিল সামনের কোন একজন। শোনামাত্র পালে বাঘ পড়েছে যেন চাচাদের দলটা যে যেদিকে পারলো ছুট দিল অন্ধকারে। বাবা দোষী ব্যক্তিকে খুঁজতে গিয়ে একজনকে চাচা মনে করে ধরে বেদম চপোটাঘাত করে যাচ্ছিল, আর সেই পাড়াতো চাচা চিৎকার করছিল বদ্দা আঁই ন, বদ্দা আঁই ন। (বড়দা, আমি না, আমি না)। এত বছর পরেও আমি সেদিনের সেই শব্দগুলো ভুলতে পারি না। কিছু স্মৃতিতে একটুও মরিচা ধরে না।
জীবনের প্রথম ৫ বছর গ্রামে কাটিয়েছি, কিন্তু মনে হয়ে যেন আরো অনেক দীর্ঘসময়। স্মৃতির লেজগুলো কখনো কখনো বাস্তবের চেয়েও দীর্ঘতর।
No comments:
Post a Comment