নেয়ামত যখন মেট্রিক পাশ করে গ্রাম থেকে শহরে আসে তখন সে পাজামা-পাঞ্জাবীর সাথে কেডস পরে এসেছিল বলে কলোনিতে একটা হাসাহাসি হয়েছিল। নেয়ামত যে গ্রাম থেকে উঠে এসেছে সেখানে কেডসের সাথে জিন্স কিংবা পাজামার সাথে স্যান্ডেল পরতে হবে সেরকম কোন নিয়মকানুনের বালাই ছিল না।
সবকিছুর সাথে সবকিছু পরা চলে যেখানে, সেখান থেকে বাপ তাকে ঠেলে শহরে পাঠালে দূর সম্পর্কের কাকার বাসায় থেকে কলেজে পড়ার উসিলায় শহরময় চক্কর দিতে পারবে, এর চেয়ে বড় কোন উচ্চাকাংখাও তার ছিল না।
কলোনীর পরিবেশটা প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায় তার। যে দালানে তার কাকার বাসা, তার একটা ব্লক পরেই বিরাট একটা সবুজ মাঠ। মাঠের ঘাসগুলো গ্রামের ঘাসের চেয়ে ভিন্ন। কেমন ছোট ছোট করে ছাঁটা। এত বড় মাঠ, কিন্তু এক কণা ধান-গম-সবজির চাষ নাই কোনখানে। পুরো মাঠ জুড়ে হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে একদল কিশোর তরুণ। কেউ ফুটবলে লাথি মারছে, কেউ ব্যাডমিন্টন খেলছে(এই খেলা আগে দেখেনি সে), কেউ বেহুদা লাফাচ্ছে, কেউ বাঁশের ধনুক নিয়ে কায়দা করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে পেরেক গাঁথা তীর। মাঠের চারপাশে বাদাম বুট চানাচুরের ফেরীওয়ালা সারিবদ্ধভাবে বসে গেছে।
তাকে নিয়ে যারা হাসাহাসি করেছিল প্রথম দেখায়, তাদেরই একজনের সাথে পরিচয় ঘটে গেল বাদাম কিনতে গিয়ে। নাম তারেক। মাঠের পূর্বদিকে একটা মেটারনিটি ক্লিনিক। তার পেছনে আরেকটা মাঠ তারপর মসজিদ। তারেক নেয়ামতকে নিয়ে গেল হাসপাতালের পেছনের মাঠে। এই মাঠটা অনেক নীরব। এখানে গোল হয়ে বসে কি যেন করছে সবাই। সেই আসরে নিয়ে নেয়ামতকে পরিচয় করাতেই সবাই তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আরেক চোট হেসে নিল। নেয়ামত বোকাবোকা হাসি দিয়ে শহরের এই নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করলো।
তারেকদের দলের নেতা রবি। পেছনের মাঠে তার রাজত্ব। রাজনীতি ব্যাপারটা নেয়ামত আগে ভাসা ভাসা শুনলেও এই প্রথম দেখলো একজন রাজনৈতিক নেতা রবিকে। কলেজের ছাত্র নেতা বলে তাকে সবাই সমীহ করে। কেন যেন প্রথমদিন রবিকে দেখেই নেয়ামতের শখ লাগলো নেতা হবার জন্য। কিন্তু মন খুলে কাউকে বলতে পারে না লজ্জায়।
কয়েক মাসের মধ্যেই নেয়ামত শহুরে কায়দা মোটামুটি রপ্ত করে ফেললো। এখন সে প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করতে শিখেছে এবং শিখেছে মাথাটা তেল ছাড়া উসকো খুশকো রাখতে। আগে নিয়ম করে দুবেলা নারিকেল তেল দিত মাথায় আর প্যান্টের পেছনের পকেটে একটা চিরুণী থাকতো।
একদিন সন্ধ্যায় তারেককে পকেট থেকে একটা চিরুনী বের করতে দেখে তার মাথা আচড়ানোর কথা মনে পড়লে সে চিরুণীটা ধার চাইল। তারেক তার হাতে চিরুনী সাইজের যে জিনিস ধরিয়ে দিলে সেটা আসলে একটা ভাঁজকরা ক্ষুর। নেয়ামতের গা বেয়ে শিরশির অনুভুতি বয়ে গেল। ক্ষুর কেন জানতে চাইলে তারেক জানালো, ক্ষুর হলো প্রাথমিক অস্ত্র। রবির কাছে আরো ভয়ংকর জিনিস আছে। মাছ মার্কা ছুরি। রাজনীতি করতে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এসব রাখতে হয়।
নেয়ামত ধরতে পারছে না ওদের আসল উদ্দেশ্যটা কি। এরকম ধারালো অস্ত্র পকেটে থাকলে কোন সময় কি বিপদ হয়। সে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু বুঝতে পারে এইসব অস্ত্রের কারনে কলোনীতে তাদের দলকে সবাই সমীহ করে।
সমীহ জিনিসটার প্রতি তারও গোপন লোভ আছে। এই জিনিস তার দখলে ছিল না কখনো। চিরকাল অবজ্ঞাই পেয়ে এসেছে। এখানে আসার পর তো অবস্থা দুর্বিসহ। এমনকি মোড়ের পানের দোকানদারও তাকে দেখলে হাসে। আড়ালে 'পাঞ্জাবী কেডস' ডাকে। যদিও সে রবি দলের পাকাপাকি সদস্য হবার পথে, তবু তার দুর্নাম ঘুচে না।
একদিন মসজিদ মার্কেটে ডিম কিনতে গেলে ডিমঅলা তাকে দেখে বলে, ভাইজানের কেডস কই আইজ? ইঙ্গিতটা বুঝলো সে। তবু চুপ করে রইলো। দেখলো পাশের তরকারীওয়ালাও খিক খিক করে হাসছে। সে জবাব না দিয়ে বিকালে তারেকের কাছে ব্যাপারটা জানালো। তারেক ঘটনাটা রবিকে বলতেই রবি হো হো করে হেসে উঠলো প্রথমে। তারপর সুক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে নেয়ামতকে মিনিটখানেক দেখে তারেকের কানে কানে কি যেন বললো। নেয়ামত তখন মরমে মরে যাচ্ছিল। কেন বলতে গেল? এখন তো আরো অপমান।
কিন্তু রবি তাকে ডাক দিয়ে বললো, আয় চল্ যাই।
সে অবাক, কোথায় যাবো?
রবি বলে, আমরা দেখে আসি তোকে কে কি বলছে। আয় সবাই।
দলবল নিয়ে মসজিদ মার্কেটের ডিমের দোকানে গেল ওরা। পাশেই তরকারীর দোকান। রবি হাঁসের ডিমের খাঁচাটা খুলে নিয়ে নেয়ামতের হাতে দিয়ে বললো, এটা কতদূরে ছুঁড়ে মারতে পারিস দেখাতো!
নেয়ামতের গায়ে তখনো অপমানের আগুন। ডিমের খাঁচাটা এমন জোরে ছুঁড়ে মারলো, ওটা মার্কেটের ওপাশের বেকারীর সামনে থপ করে আছাড় খেয়ে পড়লো এবং সবগুলো ডিম ভেঙে জায়গাটা হলদেটে থকথক করে দিল। ডিমঅলার মুখে রা নেই। পুরো বাজারের সবাই চুপ। মুখ খুলতে গেলে আরো বিপদ ওরা জানে।
রবি এবার ওকে নিয়ে তরকারীঅলার দিকে নিয়ে ফিরতেই তরকারীঅলা এসে রবির পায়ে পড়ে অবস্থা। "ভাইজান ভুল হয়ে গেছে, আর হবে না। এবারের মতো মাফ করে দেন।" কেস খতম।
পরদিন থেকে নেয়ামতকে দেখলে বাজারের দোকানীরা সালাম দেয়া শুরু করে। একমাস পর নেয়ামতকে রবির মোটর সাইকেলের পেছনে ঘুরতে দেখা গেল। মাথায় উল্টো করে ক্যাপ পরা, চোখে কালো চশমা। আর দলের সবাই জানে ওর পেছনের পকেটে একটা ক্ষুরও যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি। নেয়ামত এখন ছাত্র নেতা। কলেজের সংসদ নির্বাচনে নেয়ামতকে ক্রীড়া সম্পাদকের পদ দেয়া হলো, যদিও হাডুডু বাদে জীবনে অন্য কোন খেলা সে কখনো খেলেনি।
সেই ছোট্ট চারাগাছটি একদিন মহীরূহ হলো। জন্ম হয়ে গেল একজন মহান রাজনীতিবিদের।
উনিশ বছর পর হাজী নেয়ামত আলী পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে এমপি নির্বাচনের নমিনেশান কিনবেন, দশ কোটি টাকা ব্যয় করে নির্বাচন করবেন আর পাঁচ বছর ধরে সেই পনেরো কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ আদায় করবেন দেড়শো কোটি টাকায়। গনতন্ত্রের এই মহান নেতা সব পেয়েছেন জীবনে, কেবল মন্ত্রী হওয়াটাই বাকী। মন্ত্রী হতে গেলে কতো টাকা লাগে তিনি তা জানেন না, তবে মন্ত্রীত্ব অর্জনের আগে তিনি যা অর্জন করতে চান তা নাহিয়ানের মা সেদিন মুখ ফসকে বলে দেয়াতে সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হলো না আর।
তার প্রথম ঘরের স্ত্রী সেদিন কথায় কথায় বলছিল, "ডক্টরেট ডিগ্রীটা এবার নিয়াই ফালান নাহিয়ানের বাপ! হাজীসাব শুনতে আর ভাল্লাগে না।"
No comments:
Post a Comment