চুম্বক বস্তুটা লোহার পাশাপাশি এক আদম সন্তানকেও আকর্ষণ করা শুরু করে তার শৈশবেই। আদম সন্তানটি যখন বালকাবস্থা অতিক্রম করছে, তখন তাদের বাসার চৌকির নীচে স্মতিময় রেডিওটা বিকল হয়ে পড়ে ছিল।
এই রেডিওটা তাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় একমাত্র সংবাদদাতা ছিল। গ্রামের মানুষ বাড়ীর পেছনে লুকিয়ে গোল হয়ে এই রেডিওকে ঘিরে বসে যুদ্ধের খবরাখবর শুনতো। বাড়ীতে বোমা পড়ার সম্ভাবনা দেখলে গৃহকর্তা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে পেছনের পুকুরে লুকিয়ে ডুব দিতে যাবার সময় রেডিওটাও নিয়ে যেতেন এবং পুকুরের কিনারের দিকে পাটিপাতার ঝোপের আড়ালে ভেসে থাকা দুটো গোলাকার মাথার পাশাপাশি যে একটা চারকোনা মাথা দেখা যেতো সেটা এই রেডিও।
স্বাধীনতার কয়েক বছর পর রেডিওটা যখন বিকল হলো ততদিনে ঘরে ঘরে রেডিও চলে এসেছে, আগের কদর আর নেই। এমনকি টেলিভিশনও শহরের আনাচে কানাচে দুয়েকটা চলে আসছিল। কলোনীর দেড় হাজার বাসিন্দার মধ্যে অন্ততঃ পনেরো বিশজনের বাসায় ন্যাশনাল বা ফিলিপস কিংবা জেভিসি টেলিভিশন চলে এসেছে। বালকের ঘরেও একখানা ১২ইঞ্চি টিভি আর একখানা টেপরেকর্ডার চলে এসেছে। টেপরেকর্ডারের মধ্যে আবার একটা রেডিও সেট করা আছে। ওটাকে 'টুইনওয়ান' বলা হতো। তাই সবুজ রেডিওটা নষ্ট হলেও মেরামতের দোকানে না গিয়ে খাটের নীচে আশ্রয় গ্রহন করে এবং কিছুকাল পর ওটার স্পীকারের খোলটা তেলাপোকার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়।
বালক একদিন খাটের নীচে খেলতে গিয়ে সেই রেডিওতে তেলাপোকার বেডরুম, বাথরুম সব আবিষ্কার করার পর বুঝতে পারে এই বস্তুর বেইল আর নাই। ইঞ্জিনিয়ার হবার বাসনায় যে কোন যন্ত্রপাতির প্রতি তার অমোঘ আকর্ষণ তখন। যে কোন খেলনা হাতে পেলে, খেলতে শুরু করার আগে ওটার কোন স্ক্রু দিয়ে কতটা অংশ খুলে আলগা ফেলা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, এবং খেলনার প্রাণবায়ু থাকা পর্যন্ত আবিষ্কার চলতেই থাকে। একসময় খেলনার লাশকে নিয়ে পোষ্টমর্টেমও করতে শুরু করে।
শতশত খেলনার পোষ্টমর্টেম করলেও সবুজ রেডিওটার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস হয়নি মারের ভয়ে। সেদিন রেডিওটার বেইল নাই বুঝতে পারার পরই শুরু হয় স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে অপারেশান রেডিও বাংলাদেশ। মনে আছে এটাতেই ভর দুপুরে বাজতো একসময়, বিজ্ঞাপন তরঙ্গ।
রেডিওটাকে যত টুকরায় খোলা যায় সব খোলার পর যে আবিষ্কারের নেশায় বালকের মাথা বুঁদ হয়ে আছে সেটা হলো শব্দ নির্গমন যন্ত্র। মানে স্পীকার। ওই দিক থেকে শব্দ বের হতে দেখেছে সে। কিভাবে শব্দ ওখান থেকে নির্গত হয় সেটা বিরাট কৌতুহলের ব্যাপার।
দেখা গেল স্পীকারটা গোলাকার কালো রঙের একটা ছোট কালো কড়াইর মতো বস্তু। কিন্তু কড়াইটা নরম জিনিস দিয়ে তৈরী। ঠিক কাপড়ও না, আবার কাগজও না। ওটার গায়ে তেলাপোকার ডিমগুলো সারিবদ্ধভাবে আশ্রয় নিয়েছে।
বালক খুটিয়ে খুটিয়ে সব তেলাপোকার ডিমগুলোকে উচ্ছেদ করে গোলাকার জিনিসটাকে রেডিও থেকে আলগা করে নেয়। ওটার মাঝখানটা বেশ ভারী। মাঝখানে গোলাকার লোহার তৈরী একটা বস্তু। পেছনে ইংরেজীতি হাবিজাবি লেখা। তারপর সে গোলাকার বস্তুটাকে এই নরম কড়াই থেকে আলাদা করার বাসনায় স্ক্রু ড্রাইভারটা কাছে নিতেই ঠকাশ করে লোহার সাথে আটকে গেল স্ক্রু ড্রাইভার। টেনে তুলতে গেলেও আবার ঠকাস। আরে, আজব জিনিস তো!
অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের আনন্দে বালক নিজেকে নিউটন ভাবতে শুরু করে। সে স্ক্রু ড্রাইভার আর গোলাকার বস্তুটা নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে সারা বিকেল। খেলতে খেলতে বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই জিনিসটা যথাস্থানে রেখে দেয়। পরদিন থেকে আবারো রহস্য নিয়ে খেলা। কিন্তু রহস্যটা কাউকে খুলে বলতে পারছে না বলে শান্তি পাচ্ছে না।
একদিন সাহস করে পাশের বাসার মারুফকে দেখালো। মারুফ এসব ব্যাপারে আইনস্টাইন কিংবা স্টিফেন হকিং। সে দেখা মাত্র জিনিসটা চিনলো। বললো, আরে এটা তো 'চম্বুক'। বালক অবাক হয়ে বলে, 'চম্বুক' কি। মারুফ তাকে ছোটখাট একটা বৈজ্ঞানিক লেকচার দিল এবং দুজনে সমবেতভাবে 'চম্বুক' গবেষণায় লেগে গেল।
'চম্বুক'এর প্রতি সেই যে আকর্ষণের যাত্রা, এটা অনেক বছর ছিল। তারপর দিন থেকে নতুন 'চম্বুক' খোজার পালা। মারুফ জানিয়েছে 'চম্বুক' যেমন আকর্ষণ করে, তেমন বিকর্ষণও করে। কারণ চম্বুকের মেরু আছে। সুতরাং ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য আরো একটা চম্বুক শীঘ্রি যোগাড় করা আবশ্যক। ঘরের বাইরে বের হলেই বালকের চোখ চম্বুক খোঁজে।
যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই.....এই কবিতা তখনো পড়া না হলেও যে কোন জায়গায় চকচকে কিছু দেখলেই ওটা ছুটে গিয়ে নিয়ে আসতো। রাতে ঘরের বাইরে গেলে, রাস্তার বাতির আলোয় চকচকে জিনিসের খোজ করতো অনবরত। বালির ভেতর যে কতো চকমকে জিনিস, কেউ জানেই না। তার ছোট চোখ দিয়ে সে বিরাট জগত আবিষ্কার করতো। কিন্তু চকচকে জিনিসগুলো কাছে গেলেই গায়েব। অথচ দূর থেকে অনেক বড় চকচকে বস্তু মনে হতো। বড় হয়ে জেনেছে। ওই সব জিনিস বালির খনিজ। কেবল আলোর প্রতিফলনেই দেখা যাবে, হাতে নেয়া যাবে না।
কিন্তু চম্বুক হাতে নেয়া সম্ভব। তাই মনিমুক্তা বাদ দিয়ে শুরু হলো চম্বুক খোজার পালা। একদিন বাবা জিজ্ঞেস করলো, কি এত খুঁজিস?
প্রথম বলতে চায় না সে। কিন্তু বাবা খুব জোরাজুরি করাতে বলতে বাধ্য হলো 'চম্বুক' খুঁজি। বাবা অবাক। 'চম্বুক' কি? সে বুঝিয়ে বলে আজব জিনিস চম্বুকের কথা। বাবা শুনে হো হো করে হাসতে থাকে। বলে, বোকা, ওটা তো 'চম্বুক' না, ওটাকে বলে 'চুম্বক'। সে বাবার কথা চুপচাপ মেনে নেয়। কিন্তু 'চুম্বক' বা 'চম্বুক' জিনিসটা যে সে কিভাবে আবিষ্কার করেছে সেটা বলার জন্য গলা পর্যন্ত কথা এসে আটকে গেল। রেডিওর এই দশা জানতে পারলে পিটিয়ে তার পেট থেকে নাড়িভুড়ি খুঁড়ে'চম্বুক' বের করে ফেলবে। চেপে যায় আবিষ্কারের কাহিনী।
চুম্বক খুঁজতে খুঁজতে আরো অনেক আবিষ্কার হয়ে গেলেও বালকের সেই কৌতুহল একেবারে চলে যায়নি।
বহুবছর পরেও বালক যখন তেত্রিশ বছরের পরিপূর্ণ মানুষ দেখা গেল এক দুপুরে কক্সবাজার সৈকতে একাকী হাঁটতে গিয়ে বালিতে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। কলাতলী সৈকতের একপাশে কালো কালো বালির স্তুপ দেখে অবাক তাকিয়ে থাকে। তারপর দুই মুঠো কালো বালি পকেটে নিয়ে হোটেলে চলে আসে।
শহরে ফেরার পর বাসায় সেই বালি খবরের কাগজে ছড়িয়ে দিয়ে ছেলেবেলার সেই রেডিও চুম্বকটা বের করে। তারপর ওটাকে কালো বালির উপর ধরতোই কালো দানাগুলো সব খাড়া হয়ে গেল এক সারিতে, চুম্বকটা কাছে নিতেই সবগুলো এক লাফে সেই চুম্বকের বুকে উঠে এল। বালকের পুরোনো মুগ্ধতা ফিরে এলো ঝুপ করে।
যুবক তার বুয়েট বন্ধুর সাথে আলাপে জেনে যায় তার নতুন আবিষ্কৃত বস্তু বাংলাদেশের এক মহামূল্যবান খনিজ যাকে আদর করে ডাকা হয় ব্ল্যাক গোল্ড। অনাদরে অবহেলায় এই মূল্যবান খনিজ আহরিত হবার বদলে হোটেল মোটেলের নীচে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে। নতুন এক সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবক ভাবলো, আবিষ্কারের সীমা নেই, শেষ নেই, বয়স নেই। তবু ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে।
No comments:
Post a Comment