১.
হাইস্কুল জীবনটা ছিল মোটামুটি জঘন্য রকমের। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর ভুগোল, ইতিহাস, ধর্ম, বাংলা ব্যাকরন, ইংরেজী গ্রামার,পাটীগনিত, জ্যামিতি ইত্যাদির অত্যাচারে দম বন্ধ হয়ে আসতো সময় সময়। সিক্স থেকে এইট এই তিন বছরের যেসব স্মৃতি আছে সব জ্যৈষ্ঠের খরতপ্ত দুপুরের মতো ঝলসানো। বেত নামক লিকলিকে ভয়ংকর বস্তুটার সাথে প্রতিদিন দেখা সাক্ষাত হলে, আর বাড়ির কাজ যথাসময়ে শেষ না করলে যা হবার কথা আর কি।
তুলনামূলকভাবে আমার প্রাইমারী সময়ের(১৯৭৪-১৯৭৮) স্কুলের জীবনটা আনন্দের ছিল। বইপত্রগুলো সহজ নামমাত্র। জ্ঞানের বাড়াবাড়ি দেখা যেতো না স্কুলের প্রথম পাঁচ বছরে। আজকাল তো জ্ঞানবাহনের ষ্টিয়ারিংটা জন্মমাত্রেই শিশুদের ঘাড়ে বেঁধে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। শৈশবের আনন্দ জিনিসটা যাত্রা শুরুর আগেই মরে যায়।
আমার সেই জঘন্য হাইস্কুল জীবনটাই মধুরতম হয়ে উঠেছিল যখন স্কুলের শেষ বছরে আসি। টেষ্ট পরীক্ষার পর ফেয়ারওয়েলের দিন আমরা অঝোরে কেঁদেছিলাম স্কুল জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। কারণ ঐ বছর আমরা এমন একজন শিক্ষকের দেখা পেয়েছিলাম যিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন কি করে পড়াশোনা থেকেও আনন্দ আবিষ্কার করতে হয়। খুব দেরীতে দেখা পেয়েছিলাম তাঁর।
২.
আনন্দের সাথে বড় হওয়ার একটা নেতিবাচক সম্পর্ক আছে।
মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে আনন্দের পরিমাণ কমতে থাকে। একটা ৩ বছরের শিশু যেমন অকারণে হাসতে পারে ১৫ বছরের কিশোর তা পারে না। ২০ বছরের তরুণ তো রীতিমতো গম্ভীর। আজকাল অকালেই পেকে যাচ্ছে শিশুকিশোরের দল, অনেক কম বয়সেই জেনে যাচ্ছে জীবনের অনেক গভীর বিষয় যা তার জানার কথা নয়। তাদের মুখে অনেক শব্দ অবলীলায় উচ্চারিত হতে শুনি যা ত্রিশোর্ধ মানুষও উচ্চারণ করতে দ্বিধা করে। টেলিভিশনের ভুমিকাটা এক্ষেত্রে মারাত্মক। আমাদের শিশুদের শৈশব নষ্ট করে দিচ্ছে টেলিভিশন। গাম্ভীর্যের বয়স আসার আগেই তাদের গম্ভীর করে ফেলছে। দোষটা টেলিভিশনের দেয়া হলেও দায়টা পিতামাতা অভিভাবকের। তারাই শিশুদের টেলিভিশন মুখী করেন নানান উসিলায়।
আনন্দের সাথে বিস্ময়ের সম্পর্ক আরো গভীর। যে যত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বিস্মিত হতে পারবে, সে তত সুখী মানুষ। যার সব জানা হয়ে গেছে, তার মতো দুর্ভাগা আর কেউ নেই। একটা নতুন বই পড়ার আগে যেরকম বিস্ময় জাগায়, পড়া শেষ করে ওই দিকে তেমন তাকাতে ইচ্ছে করে না। একটা ভ্রমণে যাত্রা করার সময় যেরকম আড্ডা হয়, ফিরতি যাত্রায় তার বিপরীত। ইন্টারনেটে কেউ সামান্য একটা ছবি আপলোড করতে পেরেও অনেক আনন্দিত হয়, আবার কেউ আস্ত গুগল আর্থের স্ট্রীট ভিউ দেখেও বিস্মিত হয় না।
তার মানে যার যত জ্ঞান সে তত কম বিস্মিত, তত বেশী গম্ভীর। গম্ভীর মানুষেরা কি সুখী নয়? জানি না। এখানে আবার সমীকরণ মেলে না।
৩.
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমি গম্ভীর হতে চেষ্টা করেও উত্তরোত্তর ব্যর্থ হয়েছি। বাধ্য হয়ে হালকা চালে আনন্দিত থাকি, তুচ্ছ জিনিসে ডুবে থাকি। ইংরেজী বোতাম টিপে বাংলা লেখা স্ক্রীনে ভেসে উঠতে দেখে নিজেকে যাদুকর মনে করি। কাগুর কাছ থেকে বাংলাকে মুক্ত করার অভ্রের সংগ্রাম দেখে আলোড়িত, আনন্দিত হই। আমি বাংলায় লিখি, অভ্রের কল্যানে। আমার বাংলা শেখাটাও একটা বিরাট বিস্ময়। এই বিস্ময়ও আছে আনন্দের উৎসে।
৪.
একতরফা প্রেম সুখের হয় না। প্রায়ই হতাশা এসে ভর করে। একটা মেয়েকে একতরফা ভালোবাসতাম। কিন্তু সে বাসতো অন্য আরেকজনকে। আমার দিকে তাকাবার ফুরসত তার নেই। তবু আমি তার সৌন্দর্যে মাধুর্যে বিস্মিত হয়ে একরকম প্রেমেই পড়ে যাই। জেনেশুনে আত্মহত্যার মতো। ওই ভালোবাসার মূল উৎস ছিল বিস্ময়। বিস্ময় থেকে হয়েছিল আনন্দের সুত্রপাত। আর সেই আনন্দের ফলশ্রুতি গভীর প্রেমে পতন। চুড়ান্ত ফলাফল পূর্বনির্ধারিতই ছিল।
চুড়ান্ত ঝামা ঘষে দেবার পর আনন্দ-বিস্ময়-প্রেম-ছ্যাকার চতুর্ভূজ সমীকরণে দুই সংলাপের একটা পদ্যই লিখে বসেছিলাম:
-হে আমার আনন্দিত বিস্মিত প্রেম, তুমি আমারে করিয়াছ অপমান।
-হে নাদান তরুণ, ভালোবাসিয়া যুগে যুগে কে কবে পাইয়াছে পরিত্রাণ।
No comments:
Post a Comment