আমার প্রিয় কন্যা ও পুত্র(ওশিন ও শিহান)
শ এর প্রতি আমার দুর্বলতা বেশী নাকি ন এর প্রতি আমার দুর্বলতা আমি জানি না। কিন্তু সচেতনভাবে আমি তোমাদের নাম রাখতে গিয়ে এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছি। ওশিনের নাম রেখেছি আধঘন্টার এক সিদ্ধান্তে। যদিও নামের বই থেকে শত শত নাম দেখা হয়েছে। ইন্টারনেটেও খোঁজা হয়েছে অনেক। তবু শেষমেষ তারুণ্যের শুরুতে মুগ্ধ করা একটা জাপানী কাহিনীর চরিত্র ওশিনকে বেছে নিলাম তোমার জন্য। ওশিন আমার স্বপ্ন। যার জন্মের আগে থেকেই ভালোবেসেছিলাম প্রবলভাবে। তার একটা নাম রেখেছিলাম আয়নাপরী। আমি যেন জানতাম আমি একটা পরীর বাবা হতে যাচ্ছি। তোমার জন্মের সাথে সাথে আমাকে হাসপাতালের অপারেশান থিয়েটারে ডাকা হলো তোমাকে দেখার জন্য। আমি দেখলাম অবিশ্বাস্য সুন্দর একটা পরী দুই গালে টোল ফেলে হাসছে আমার দিকে চেয়ে। এইটুকুন বাচ্চার গালে টোল! আমার নিজেরই অবিশ্বাস লেগেছিল। তবে এই ফুটফুটে শিশুটি মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়েছে ইয়া মোটা একটা নাড়ী নিয়ে। ওটা অপারেশান ছাড়া নাভির ছিদ্র বন্ধ হবে না। কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার সমস্ত আনন্দ উবে গিয়ে বিষাদের কান্না ভর করলো। কি অপরাধে আমার এই শাস্তি? রাত দশটার মধ্যে অপারেশান সমাপ্ত হলেও তোমার জ্ঞান ফেরেনি বলে আমরা তোমাকে রুমে আনতে পারলাম না। অনেক রাতে তোমাকে রুমে দেয়া হলো। মাথায় ব্যন্ডেজ দিয়ে আটকানো স্যালাইন। তুমি কাঁদার শক্তিও হারালে। তারপর তোমার যখন জ্ঞান ফিরলো শুরু হলো ব্যাথার কান্না। সেই অবিরাম কান্না বহুরাত আমাদের নির্ঘুম রেখেছিল বাসায় ফেরার পরেও। তবু একদিন তুমি সেরে উঠলে। আমাদের মুক্ত করলে সকল দুশ্চিন্তা থেকে।
কান্নার ছবির একটা চিত্র ভিডিওতে তুলে রেখেছি ইন্টারনেটে।
ওশিনের একটা ওয়েবসাইটও তৈরী করা হলো জন্মের সাথে পরপর।
http://sites.google.com/site/oshinmahiyat/
আমরা তখন বেপারী পাড়ার বাসায়। একতলা টিনশেড বাড়ী। তোমার দাদার বানানো ঘর। আমাদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল ২২টি বছর। সেই ঘরটি তখন জরাজীর্ণ। বর্ষায় পানি পড়ে টিনের চাল দিয়ে। করিডোরে পানি জমে যায়। ইট দিয়ে পারাপার বাথরুমে। তবু নিরুপায় বসবাস। তুমি যে ঘরটিতে থাকতে সেটি অবশ্য ছাদের নিরাপদ আশ্রয় ছিল। পুরো বাড়ীতে এই একটি ঘর ছিল পাকা ছাদের। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের ঝড়ে পুরো চাল উড়ে যাবার পর পুননির্মান করতে গিয়ে এটাকে সবার ঘূর্নিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে বানানো। আমি সেই ঘরটিতে বসবাস করতে শুরু করি ৯১ থেকেই। তোমার জন্মের পর আমরা তিনজন ওই ঘরে ডাবল খাটে। মোটামুটি সুখী জীবন তোমাকে পেয়ে আরো সুখী। কিন্তু কিছু কিছু রাতের দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারি না। রাতে যখন বিদ্যুতের হাহাকার অন্ধকার গরমে আমি আর খুকী তখন দিশেহারা তোমাকে নিয়ে। তুমি একটুও গরম সহ্য করতে পারো না। হাতপাখার বাতাস দিয়ে নির্ঘুম রাত পার করেছি কখনো কখনো। তারপর একদিন খোঁজ পেয়ে চার্জ ফ্যান কিনে আনি মার্কেট থেকে। সেই চার্জ ফ্যান আসার পর অনেকটা শান্তি। যদিও দুঘন্টা পর চার্জ ফ্যানেও কাজ হতো না আর। সেই ছোট্ট ফ্যানের অল্প বাতাস তোমার ছোট্ট শরীর ছুয়ে আমাদেরও কিছু বাড়তি শীতল ছোঁয়া দিত। তুমি যখন বসতে শিখলে, খামচি দিতে শিখলে আমি তোমার খামচি খেয়ে অফিসে যেতাম, কেউ জিজ্ঞেস করলে গর্ব করে বলতাম, আমার কন্যার ভালোবাসার চিহ্ন।
তোমার প্রথম জন্মদিন ছিল অনাড়ম্বর যদিও তবু অনেক আনন্দ ছিল। কেক কেটে ছবি তুলে তুমুল আনন্দ করেছি আমরা।
কিন্তু জন্মদিনের আগেই একটা বন্যার ভয়াবহ আক্রমন আমাদের ভেঙে দেয় মানসিকভাবে। খুব বৃষ্টির এক সকালে (১১ই জুন ২০০৭ সম্ভবত) অফিসে গেলাম আধভেজা হয়ে। অফিসে পৌছানোর কিছুক্ষণ পর খুকী ফোন করলো উদ্বিগ্ন কন্ঠে। বারান্দায় পানি উঠে গেছে আমাদের। অবাক হলেও ভয় পাইনি। খানিক পরেই নেমে যাবে পানি। আমাদের কখনো বন্যা হয়নি। আশ্বাস দিয়ে ফোন কাটি। দশ মিনিট পরেই আবার ফোন। পানি বাড়ছে দ্রুত। বাসায় উঠে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। এখন কি হবে। এবার সত্যি চিন্তায় পড়লাম। বললাম, আসছি। অফিস থেকে দৌড়ে নেমে গাড়ী নিলাম। ড্রাইভারকে বললাম দ্রুত যেতে। কিন্তু বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি আমাদের সামনের এক্সেস রোড পানিতে থৈথৈ। কোমর পানি প্রায়। গাড়ীটা আটকে গেল। আমি নেমে গেলাম। পাগলের মতো দ্রুত পা চালালাম বাসার দিকে। এত এত পানি চারদিকে। জীবনেও দেখিনি। ১৯৯১ সালেও না। ভয়াবহ একটা দৃশ্য। আমি বাসায় ঢুকে দেখি বাসায় হাটু পানি। সোফাগুলো ডুবে গেছে। দ্রুত বাড়ছে পানি। তোমার নানা আর মামা এসেছে মোতাহারাকে নিয়ে তোমাদের নিয়ে যাবে। আমি রুমে ঢুকে দেখি তুমি প্রায় ডুবন্ত খাটে বসে আছো চুপ করে। আমি তোমাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মাথায় একটা প্লাস্টিক দিলাম তোমার। বৃষ্টি ঝরছে। কোমর পানিতে নেমে রিকশা খুঁজছি পালাবার জন্য। এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে এক্ষুনি। কিন্তু কোন রিকশা নিল না আমাদের। আমি ব্যর্থ হয়ে পূর্বদিকের আবদুল্লাহ স্টোরের ভেতর ঢুকে গেলাম। ওখানে এখনো পানি ওঠেনি। ওখানে ঢুকে পেছনের দরোজা দিয়ে চলে গেলাম দোতলার বাড়ীওয়ালার বাসায়। খোদেজা বেগমের বাড়ী ওটা। আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের কাছ থেকে জায়গা কিনে বাড়ী করেছিলেন। এই প্রথম আসা বিপদের দিনে ওনাদের বাসায়। তারপর একে একে সবাইকে নিয়ে আসি ওই বাসায়। দুদিন বাসায় যেতে পারিনি, ওখানেই ছিলাম। পানি নামতে দেরী করেছে। অপূর্ব আতিথেয়তা দিয়ে আমাদের রেখেছিলেন ওনারা। ওনাদের সম্পর্কে আমাদের সমস্ত পূর্ব ধারনা মুছে গেল। মহান মানুষ দেখলাম আরেকবার।
সেই বছর আরো দুবার বন্যায় ভুগলাম আমরা। তবে প্রস্তুতি থাকায় পরের দুটোতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। আমরা ভাবছিলাম এআর প্রোপার্টিজের ফ্ল্যাটে উঠে যাবো কদিন পরেই। কটা দিন কষ্ট করি আর। কিন্তু দিন কাটে না আর। কষ্ট বাড়তেই থাকে বসবাসের। হারুন সালাম মারা গেলেন। এআর প্রোপার্টিজের সাথে চুক্তি বাতিল হলো। ফেরদৌস ভাই বললেন ওখানে আর হবে না। আমরা নতুন উপায় খুজতে লাগলাম বাড়ীটা ছাড়ার। কিন্তু কোন উপায় হচ্ছিল না। একজনের সাথে কথা হয় হয় এমন সময় এলো আরেকটা ভয়ংকর দিন। সেইদিনটা না এলে আমাদের ওই বাড়ী হয়তো এখনো ছেড়ে আসা হতো না। একদিকে সেই ঘটনাকে আমি আশীর্বাদ মনে করি।
২৯শে জানুয়ারী ২০০৮ সকালে অচেনা একটা জায়গা থেকে টেলিফোন এলো। বিশাল অংকের টাকা পরিশোধ না করলে সপরিবারে হত্যার হুমকি এলো। আমি প্রথমেই তোমার কথা ভাবলাম। বাসায় তোমরা একটা। তুমি তোমার মা দাদী ফুপু। ওরা বললো বাসা ঘিরে রেখেছে। ভয়ে আমি আধমরা। আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে কোন উপায়ে আজকেই বাসাটা বদলাতে হবে। আত্মীয়বন্ধুদের সহায়তায় আমার চাচাদের বাসায় চলে গেলাম কসমোপলিটন আবাসিক এলাকায়। বাড়ীটা বুঝিয়ে দিলাম কোরাল রীফকে। ওরা বললো টাকা পরিশোধ করবে সময়মতো। সেই আশ্বাসে বিশ্বাস করে ভুল করলেও আমার উপায় ছিল না। আমি তোমাদের বাঁচাতেই বাকী সব হারানোর ঝুঁকি নিলাম। চাচার বাসায় থাকতেই ভাড়া নিলাম খুব চমৎকার একটা ফ্ল্যাট কাজীর দেউড়ীর এসএইচ টাওয়ারে। ওখানে গিয়েই যেন পেলাম আমি আমার কাংখিত জীবন। আস্বস্ত হলাম। অন্ততঃ কিছুদিন নিরুপদ্রপ থাকতে পারবো। এই বাসায় পানি বিদ্যুত সবকিছুর ব্যবস্থা চমৎকার। খরচটা যদিও বেশী তবু আমি এখানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম যতদিন সামর্থ্যে কুলোয়।
একদিন ওখানেই খবর এলো শিহান আসছে। প্রথমে দ্বিধা ছিল। কিন্তু সব কাটিয়ে আমরা আবারো আশীর্বাদ প্রাপ্ত হলাম সেই সৌভাগ্যের। সেই একই হাসপাতালে, প্রায় একই দিনে, সেই একই ভিআইপি রুমে শিহানের জন্ম হলো। এটা আমাকে অবাক করে। ২০০৬সালে যেই রুমটাতে ওশিনের জন্ম হয়েছিল। ঠিক সেই রুমটাই যেন আবার পেয়ে গেলাম শিহানের জন্য। জুলাই মাসের পনের তারিখ তুমি এলে। তোমাকে বাসায় ফিরিয়ে নেবার পর আমাকে গতবারের মতো টেনশান করতে হয়নি গরমে কষ্ট পাবে কিনা। আমি আর কিছু পারি বা না পারি একটা সুন্দর ফ্ল্যাটে আমার পুত্রকে নিয়ে আসতে পেরেছি। আমি সেই আনন্দে, তোমাদের নিরাপত্তার আনন্দে বাকী সব কষ্ট ভুলে গেলাম। আমরা এখনো আছি সেই বাসায়। ওশিন এখন চার বছর পেরিয়েছে। তুমি কদিন পরে দেড় বছরে পড়বে। তোমাদের নিয়ে আমি দারুন সুখী। কিন্তু এই সুখী বলতে আমি ভয় পাই। আমি চারপাশের অস্থিরতা অসুস্থতা দেখে দেখে আতংকিত হই। তোমাদেরকে সুস্থভাবে বড় করে তুলতে পারবো আমি? কিংবা আমি কি বেঁচে থাকতে পারবো তোমরা বড় হয়ে নিজের পায়ে দাড়াতে পারার আগ পর্যন্ত? মানুষের সব স্বপ্ন সফল হয় না। আমার এই স্বপ্নটাও হবে না। আমি তোমাদের বড় হওয়া পুরোপুরি দেখে যেতে পারবো না হয়তো। কোন একদিন আমিও ঢলে পড়বো নিঃশব্দে কিংবা পতন হবে ভিন্ন কোন দুর্যোগে। আমি ঠিক জানি না কি হবে। কেবল আস্বস্ত হতে ভয় পাই।
আমি তোমাদের ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই তাই। সবাই যখন তোমাদের ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে উত্তমরূপে মানুষ করার পরামর্শ দেয় আমি তখন বলি, আমি কেবল আমার সুস্থ দুই সন্তানের স্বাভাবিক বড় হওয়া দেখতে চাই। আমি খুব ভালো স্কুল চাই না, খুব ভালো রেজাল্ট চাই না। আমার সন্তানকে আমি কেবল সাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে দেখতে চাই। আজকের বিশাল ফ্ল্যাট ছেড়ে আমাকে যদি কেবল দুই ঘরের ঘুপচি বাসায় চলে যেতেও হয় তবু আমি খুশী আমার সন্তানদের সুস্থতা দেখে। তাদের সাথে কাটাবার জন্য যে দিন মাস বছরগুলো বাকী আছে আমি তাকে পরিপূর্ণ সুখে কাটাতে চাই। আমি এক নিখাদ ভালোবাসার কান্নায় ভাসতে চাই।
[আমি জানি না এই লেখাটা পড়ার মতো বয়স হতে হতে এই ওয়েবসাইট জীবিত থাকবে কিনা। কিংবা টেকনোলজি বদলে গিয়ে লেখাগুলো হারিয়ে যাবে কিনা। আমি এই সব কিছুই জানি না এই সময়ে। তবু লিখে রেখে যাচ্ছি আমার প্রবল ভালোবাসার সামান্য একটা চিহ্ন। যদি কখনো পড়ো বাবার লেখাটি]
শনিবার, ৪.০৯মি
৩০ অক্টোবর ২০১০
2 comments:
কী অসাধারণ আপনার লেখা। অপারেশান থিয়েটার দিয়ে সার্চ দিয়ে ছিলাম, ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছিলো। হঠাত আপনার লেখায় চোখ পড়লো। পুরো লেখাটা নিশ্বাস বন্ধ করে পড়লাম। জানেন আমি জন্মানোর পরে আমার বাবা এমনি একটা ডায়রী লিখেছিলেন। সেটা আমি যখন জানতে পারি তখন আমার বাবা আর আমাদের মধ্যে নেই। লিখতে থাকুন। শুভেচ্ছা রইলো। কল্লোল।
আপনার বাবার চিঠির কথা শুনে ভালো লাগলো, মন খারাপও। আপনাকে আমার ব্লগে দেখে খুব ভালো লাগছে। কেমন আছেন আপনি?
Post a Comment