Monday, September 30, 2024

লেভান্টের দানব

ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে যেখানে তুরস্ক, লেবানন, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, প্যালেস্টাইনের অবস্থান, সেই এলাকাকে সম্মিলিতভাবে লেভান্ট অঞ্চল বলা হতো। সেটা ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মানব সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। মানবজাতির প্রধান খাদ্যশস্যের প্রাচীন উৎসভূমিও ছিল ওই অঞ্চল। কয়েকশো বছর আগে সেই এলাকা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা সেই অঞ্চল দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে সুবিধা করতে না পেরেই কলম্বাস, ভাস্কো দা গামাকে পুরো দুনিয়া চষে বিকল্প রাস্তা বের করতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই সুখী সমৃদ্ধ অঞ্চলে ইসরায়েল নামের একটা বিষফোঁড়া বপন করলো ইউরোপ-আমেরিকার সম্মিলিত শক্তি। চারপাশের আরব দেশের মাঝখানে একটা হাইব্রীড রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র পুরো লেভান্ট এবং আরব অঞ্চলকে অশান্ত করে রেখেছে গত ৫০ বছর ধরে। এই বিষফোঁড়া যদি পৃথিবী ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া দানবীয় তাণ্ডব গাজা ছাড়িয়ে লেবানন ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এটা ইরান তুরস্কসহ আরো অনেক দেশকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেললে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর মানবজাতির হাতে যে পরিমাণ বিধ্বংসী অস্ত্র আছে তাতে এই গ্রহের কোনো অংশ রক্ষা পাবে বলে মনে হয় না। যেখানে সরাসরি যুদ্ধ হবে না, সেখানেও মানুষ কাতারে কাতারে মরতে থাকবে দুর্ভিক্ষ আর মহামারীতে। বিষাক্ত বায়ুতে পৃথিবীর প্রাণ প্রকৃতিও অবশিষ্ট থাকবে না। বৃটেন-আমেরিকার পোষ্য এই দানব দুদিন আগে লেবানন আক্রমণ করে ধ্বংসের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করেছে। নেতানিয়াহু নামের এই দানবকে থামাতে না পারলে ইউরোপ আমেরিকার শান্তিপূর্ণ জীবনও অক্ষত থাকবে না। দেরি হয়ে যাবার আগে তাকে কেউ থামাবে?

Wednesday, September 25, 2024

পাহাড় বিক্রির বিজ্ঞাপন

 পাহাড় বিক্রির বিজ্ঞাপন: চিঙ ওয়েঙ

যারা পাহাড়ে জমি কিনতে চান আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। একটা পাহাড় কিনে দিব। তবে বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি বানিয়ে থাকতে হবে। আপনার বউ সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে পাহাড়ের নিচে ছড়া তে পানি আনতে যাবে।  সেই পানি মাথায় করে বাড়িতে নিয়ে আসবে আপনার বউ। আর হে, শীতকালে কিন্তু ছড়ার পানি শুকিয়ে যাবে!আপনি জুম চাষ করবেন পাহাড়ে।( তবে এই জুম চাষ শুধুমাত্র বর্ষাকালে করা যাবে। বাকি মাস ৪০০ টাকার মজুরি তে জংগলে কাজ করতে হবে)।  দূপুর বেলা আপনার বউ  তেল ছাড়া খাবার নিয়ে আসবে জুম ঘরে! নতুবা জুমের সবজি, ছড়ার কাঁকড়া ধরে বাঁশের চুঙ্গাই ভরে রান্না করে খাবেন তেল আর মসলা ছাড়া। মাঝে মাঝে আমরাও গেলাম আপনার অতিথি হতে। এক দুই দিন আপনার পাহাড়ের ভিলাতে থেকে আসলাম। আর হে আপনার বাচ্চাদের কিন্তু ইস্কুলে পাঠাতে হবে। ইস্কুলে যেতে দুই তিন কিলো হাটা লাগবে কিন্তু!!! 

কেউ চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন। দেখলাম আমার পরিচিত অনেকেই পাহাড় কিনতে চাচ্ছেন । 

জমির দাম একরে ১০ হাজার টাকা মাত্র!!!

----------------------------------


বন্ধুতালিকার একজনের শেয়ার করা বিজ্ঞাপন পোস্টটি পড়ে আমার কয়েক বছর আগের সাজেকের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল। সাজেকের প্রাইমারী স্কুলটার পেছনদিকে একটা রাস্তা নেমে গেছে খাড়া নীচের দিকে। মনে হলো সেদিকে একটা পাড়া  আছে। একদিন ভোরবেলা নাস্তা করার আগে হোটেল থেকে বেরিয়ে আমি কৌতূহলী হয়ে সেই পথ দিয়ে পাহাড়ের নীচের দিকে নেমে গেলাম। অনেকটা পথ নামার পর দেখলাম মাথায় দুটো কলসী(একটার ওপর আরেকটা) বসিয়ে একটা বাচ্চা ছেলে উঠে আসছে। ওকে একটু থামিয়ে আলাপ করলাম। জানতে চাইলাম কোথা থেকে পানি আনছে। সে জানালো নীচের দিকে একটা ঝরনা আছে সেখান থেকে ঘরের জন্য পানি আনছে। সেই ঝরনার খোঁজে আরো নীচে নেমে যেখানে গেলাম, সেখান থেকে  উঠে আসতে খালি হাতেই আমার দম বেরিয়ে যাবার দশা। আমি তখন ভাবছিলাম ওই ৯/১০ বছরের বাচ্চাটার মাথায় রাখা কলসীগুলোর কথা। 

Sunday, September 22, 2024

আদিবাসী বনাম অভিবাসী

কয়েকদিন ধরে পিটার বেলউডের First Farmers পড়ছিলাম। বইটা মোটামুটি দশাসই হলেও তথ্য উপাত্তে বেশ উপভোগ্য। পড়তে গিয়ে মানবজাতির গত বিশ হাজার বছরের অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটা সারাংশও পড়া হয়ে গেল।  পড়ার সময় পৃথিবীর নানান অঞ্চলের আদিবাসী বনাম অভিবাসী ইস্যুতে সমসাময়িক কিছু আলোচিত বিষয় মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। বুক রিভিউ নয়, আদি মানবের বসতি পরিবর্তন, অভিবাসন বিষয়ক কিছু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ।

বসতির নিরিখে পৃথিবীর মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। আদিবাসী এবং অভিবাসী। যারা যুগ যুগ ধরে নিজেদের আদি বাসভূমে নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করে তারা আদিবাসী। আবার যারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে বসতি গড়ে এবং নিজেদের সংস্কৃতি সভ্যতাকে ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ওপর চাপিয়ে দেয় তারা হলো অভিবাসী। হাজার বছর আগে আদিবাসীরা ছিল শক্তিশালী। কিন্তু সময়ের সাথে আধুনিক প্রযুক্তি আয়ত্ব করার কারণে অভিবাসীরা আদিবাসীদের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গত পাঁচশো বছর ধরে পৃথিবীটা অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় যায় পুরোপুরি। আধুনিক মানচিত্রে গত পাঁচশো বছরে যেসব অঞ্চল ‘আবিষ্কার’ করা হয়েছে তার সবটুকু অভিবাসীদের দখলে। তিন মহাদেশ এবং তিন মহাসমুদ্রে অভিবাসীদের হাতে কয়েক কোটি মানুষ নিহত হবার পর আদিবাসীরা নিজেদের বাসভূমি হারানোর বিষয়টা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। পৃথিবীটা অভিবাসীদের রাজত্বে চলে গেছে পুরোপুরি।

আদিবাসীর সংজ্ঞা কী আসলে? এটা কি ভূমির অধিকার বিষয়ক ব্যাপার নাকি জাতি ও সংস্কৃতির ব্যাপার? খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে আদিবাসী হলো তারা যারা এখনো নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠির আদিম সংস্কৃতিগুলো ধারণ করেছে। যাদের জীবনযাত্রার মধ্যে ইউরোপের সংজ্ঞায় নির্মিত সভ্যতা প্রবেশ করেনি অথবা প্রবেশ করলেও সেটা সীমিত আকারে আছে। কিন্তু আদিবাসীর সংজ্ঞা নিয়ে প্রায়ই যে বিতর্কটা ওঠে সেটা হলো ভূমির অধিকার বিষয়ক। এই ভূমিতে কে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল। কারা আগে এসেছিল। কাদের প্রভাব বেশি ছিল ইত্যাদি। কিন্তু আদিম জনগোষ্ঠী মূলত যাযাবর ছিল যাদের নির্দিষ্ট এলাকায় বেশিদিন বসবাস করতো না। নানান কারণে বাসস্থান স্থানান্তর হতো। পৃথিবীর অধিকাংশ আদিবাসী পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে। এটার মূল কারণ সমভূমির দখল নিয়েছে ভদ্রলোকের সভ্যতা। যারা প্রযুক্তির শক্তি নিয়ে পৃথিবী দখল করেছে। 

আধুনিক সভ্যতার রাষ্ট্রকাঠামোতে পৃথিবীকে ভাগ করে নিয়েছে মানচিত্র নামের এক সীমান্ত রাজনীতি দিয়ে। আদিবাসীরা মানচিত্র বহির্ভূত জনগোষ্ঠী। তাদের কাছে যখন যে গ্রামে বাস করে সেটাই সীমান্ত। আদিবাসীদের কোনো স্থায়ী স্থাপনা নেই পৃথিবীর কোথাও। তারা অস্থায়ী নিবাসেই বিশ্বাসী। গত পাঁচশো বছরে পৃথিবীতে যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে তার পর থেকেই আদিবাসীরা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তাদেরকে কোনো না কোনো একটা রাষ্ট্রের খোপে ঢুকতে হয়েছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। গত পাঁচশো বছরের হিসেব বাদ দিলে আগের দশ হাজার বছরের কখনো এই মানচিত্র খাঁচা তাদের ভূমিকে বেদখল করেনি। আদিবাসীদের সংজ্ঞা নিরূপন করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই ভুল করি সভ্যতার চশমা পরে। পশ্চিমা সভ্যতা এই চশমা আমাদের চোখে এমনভাবে সেঁটে দিয়েছে যে আমরা তার বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে পারি না।

এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন আদিবাসীদের বসতি ছিল তাইওয়ানে। গত দশ হাজার বছর ধরে তাইওয়ান থেকেই ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া সহ পুরো প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে আদিবাসীরা ছড়িয়ে পড়েছে। তাইওয়ানে সেই আদিবাসীরা এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। জনসংখ্যার মাত্র ২% আদিবাসী। বাকী সবাই অভিবাসী। অভিবাসীদের ৯২ ভাগ হলো চীনের হান জনগোষ্ঠী। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নৃতাত্তিক জাতি গোষ্ঠী হলো চীনের হান জনগোষ্ঠী। এরাই চীনের ৯৫ ভাগ জনসংখ্যা। একই কথা প্রযোজ্য দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরো জাতির ক্ষেত্রে। পুরো উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিম জাতিগোষ্ঠিগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আন্দেজ পর্বতমালার পাদদেশে যেসব জাতিগোষ্ঠি বসবাস করছে, একসময় এদের পূর্বপুরুষ পুরো দক্ষিণ আমেরিকা দাপিয়ে বেড়াতো। 

আমি পৃথিবীর আদিবাসী জনগোষ্ঠিগুলোকে একেকটা সম্পদ মনে করি, কারণ এদের জীবনধারন, আচার-সংস্কৃতি সবকিছু প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসকে ধারণ করেছে। সভ্য জাতির হাতে নষ্ট হবার পর যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা এদের হাতেই নিরাপদ। সভ্যতার শক্তি দেখিয়ে এদের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা পৃথিবীর ইতিহাসেরই ক্ষতি। উন্নয়নের খপ্পরে পড়ে নগরায়ন এবং শিল্পোন্নয়নের নামে প্রায় পুরো পৃথিবী গ্রাস করে ফেলেছে সভ্যজগতের মানুষেরা। 

বাংলাদেশে যেসব পার্বত্য জাতিগোষ্ঠি আছে তারা এদেশের আদিবাসী কিনা এটা নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হয়। তারা কত বছর ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করছে, তাদের আগেও এখানে আদিম জনগোষ্ঠী ছিল কিনা ইত্যাদি নিয়ে। এই কথাগুলো বলা হয় শুধু ভূমির অধিকার নিয়ে। একটু বৃহত্তর পরিসরে ভাবলে দেখা যাবে ভূমিটা এখানে মূখ্য বিষয় নয়। ভারতের মিজোরাম, বার্মার চিন, কিংবা পূর্বাঞ্চলে কুকি বা লুসাই নামে সাধারণভাবে পরিচিত যে জনগোষ্ঠি, তাদের মধ্যে শত শত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি রয়েছে। বিবর্তিত বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে তেমন জাতিগোষ্ঠিও কম নয়। তারা সবাই দেড় থেকে দুহাজার বছর আগে চীনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এই অঞ্চলে এসেছিল। তারও আগে এখানে যেসব জনগোষ্ঠি ছিল, তাদের কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। যেমন আমাদের দেশে পার্বত্য জাতিগোষ্ঠির মধ্যে চাকমারা সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ, আবার বম জনগোষ্ঠি  সংখ্যায় অনেক কম। কিন্তু এই অঞ্চলে বমদের বসতি চাকমাদের চেয়ে অনেক প্রাচীন। সুতরাং কাকে আপনি এখানকার আদিবাসী বলবেন? সবক্ষেত্রেই দেখা যাবে আগে কোনো না কোনো জাতিগোষ্ঠীর বসতি ছিল ওই এলাকায়। একহাজার, দুহাজার, তিন হাজার, দশ হাজার? তাদের কোনো ইতিহাস কিংবা চিহ্ন নেই কোথাও। 

অতএব সেই জাতিগোষ্ঠিগুলো কোন এলাকায় কতদিন ধরে বসবাস করছে সেটা দিয়ে তাদের বিচার করা যাবে না। আদিকাল থেকে ভূমির অধিকার বলে কোনো বস্তু ছিল না। সবাই ছিল যাযাবর। একশো বছর পরপর বাসস্থান বদল করেছে তেমন উদাহরণও প্রচুর। এমনকি বাঙালিদের মধ্যেও পাকাপাকিভাবে ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকে। 
আদিবাসী শব্দটা দেশে দেশে সবসময় রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত। যে যার সুবিধামত, রাজনৈতিক ভৌগলিক প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে শব্দটাকে ব্যবহার করে। আমার ব্যক্তিগত মত হলো কোন দেশে কারা আদিবাসী সেটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন জাতি তাদের আদিম সংস্কৃতি কতখানি ধরে রেখেছে। যে জাতি সেটা ধরে রেখেছে সে জাতি নিজস্ব সংস্কৃতির আদিবাসী হিসেবে পরিচিত হতে পারে। তাদের আবাসস্থল কিংবা ভৌগলিক অবস্থান বদলাতে পারে, কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় এখনো ধরে রেখেছে কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সেই হিসেবে পার্বত্য জাতিগোষ্ঠিগুলো তাদের সংস্কৃতি লালন করার ব্যাপারে সমভূমির জাতিগোষ্ঠিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি যত্নবান।  

আমাদের সমভূমির বাঙালিদেরও নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। কিন্তু সেটার সাথে পার্বত্যবাসীদের তুলনা করা উচিত হবে না। আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যের পরিচয় কিছুটা তুলনা করা যাবে আমেরিকানদের সাথে। ইউরোপ থেকে দলে দলে নানা জাতিগোষ্ঠি আমেরিকা গিয়ে যে একটা নতুন জনগোষ্ঠি এবং সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে তারাই আমেরিকান। বাঙালিরা আমেরিকানদের চেয়ে হাজার বছর পুরোনো জাতি, কিন্তু এখানেও দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে আসা নানান জাতিগোষ্ঠির মিশ্রিত একটা জাতির জন্ম হয়েছে। এখানে আমাদের বিশুদ্ধ আদিম সংস্কৃতি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। এই বিশুদ্ধতার অভাবেই সমভূমির জাতিগুলোর মধ্যে সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সবকিছুতে অস্থিরতা, বিশৃংখলা, নৈরাজ্য বেশি। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এখানে প্রবল। কারণ ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠি থেকে আসা লোকেরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চায় নানা ভাবে। কেউ বংশগৌরবে, কেউ অর্থ সম্পদে। কেউবা স্রেফ হাস্যকর ইগোর জোরে। 

এক কথায় আমি যেটা বলতে চাই তা হলো- আসলে মানবজাতির সবচেয়ে বড় অংশটাই হলো অভিবাসী। এটা মেনে নিয়ে আমেরিকার মতো এত বড় রাষ্ট্র সদর্পে পৃথিবী রাজত্ব করছে, আমাদের সমস্যা কেন?

Friday, September 20, 2024

Waiting books


Maybe you will not finish reading all these books. But they are waiting for you for months. Your waiting list is getting bigger, but your time is getting shorter. Make your time for waiting books.

Friday, September 13, 2024

নীরবতাপর্ব....ক্রমশ...

১.
দেশের এই বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটার পর থেকে একটা বিষয় চোখে পড়েছে। অসংখ্য মানুষ বলছে আগের সরকারের আমলে বাক স্বাধীনতা ছিল না, কেউ ভয়ে কথা বলতো না, এখন সবার বাক স্বাধীনতা হয়েছে, ব্যাকস্পেস চাপতে হচ্ছে না ইত্যাদি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি সেটা হলো একটা বিশাল নীরবতা। আমার বন্ধুতালিকার ৯০ ভাগের বেশি মানুষ অরাজনৈতিক শ্রেণীর। কোনো বিশেষ দলের পক্ষপাতিত্ব নেই। সবাই লেখালেখি জগতের মানুষ। ইতিহাস ঐতিহ্য এবং শিল্প সাহিত্যজগত নিয়ে কাজকারবার। বলা চলে দেশের প্রধান সারির মননশীল জগতের মানুষ। আমি প্রায়ই দেখতাম এরা সবাই আওয়ামী লীগের আমলে যতটুকু সম্ভব সরকারের নানা অনিয়মের সমালোচনা করেছে, সুপরামর্শ দিয়েছে। এসব করতে গিয়ে কেউ কেউ হুমকি ধামকিও খেয়েছে সরকার সমর্থকদের কাছ থেকে। মামলার হুমকিও দিয়েছে কখনো। সেইসব ধমকের ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে খুব সাবধানে শব্দচয়ন করে লিখেছে। কিন্তু লেখা থামায়নি কখনো। এখন আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি একটা বিশাল নীরবতা। সবাই একদম চুপ হয়ে গেছে। কেউ কেউ ফেসবুক অফ করে দিয়েছে। যারা আছে তারা একটা মন্তব্যও করে না। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? আমরা আরো ভয়ের রাজত্বে চলে এলাম? এমন তো হবার কথা ছিল না। ইউনুস সরকারের প্যানেল দেখে আমি আশাবাদী হই। কিন্তু এত মানুষের নীরবতায় আমি আশঙ্কায় ভুগি। বন্ধুতালিকার সবাইকে আমি আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু তাদের লেখালেখির ওপর আমার আস্থা আছে। সে কারণে মনে হচ্ছে কোথাও কিছু গোলমাল আছে। এমন কিছু যা আমরা হয়তো জানি না। এই নীরবতাপর্ব কাটার পরেই বোঝা যাবে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। তার আগে নয়। [১৩.৯.২০২৪]

২.
সামাজিক মাধ্যমে তেমন সক্রিয় না থেকেও দর্শক হিসেবে প্রতিনিয়ত যা দেখতে হয়, সেটা মোটেও সুখকর নয়। এখন যারা পথে পথে অনাচার অজাচার করছে, সেই কাঠমোল্লারা কেউ আন্দোলনের প্রথম দ্বিতীয় কোনো সারিতে ছিল না। এরা ঘাপটি মেরে ছিল অন্ধকারে। ৫ আগষ্টের পর এরা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে এখানে সেখানে তাণ্ডব চালাচ্ছে নানান খেয়াল খুশীর ইস্যুতে। এটাকে মবের মুল্লুক বলা হচ্ছে। এরা যেন প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে আগের যুগই ভালো ছিল। যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এরা কথা বলছে তার কয়েকগুন বেশি ফ্যাসিবাদী মানসিকতা নিয়ে দেশকে কোন অন্ধকারে ঠেলে দেয় সেটা দুশ্চিন্তার বিষয়। এই শক্তি যদি বাংলাদেশে  কখনো ক্ষমতায় বসে, দেশকে নির্ঘাত আফগানিস্তান বানিয়ে ছাড়বে।

৩.
ভয়েস অব আমেরিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনুস বলেছেন এই অভ্যুত্থান দেশকে রিসেট বাটন পুশ করে নতুন যুগে নিয়ে এসেছে। এতে তিনি নিজেও বাতিল হয়ে পড়বেন বিষয়টা বুঝতে পারছেন না। তার ওপর যেটুকু ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল ওই সাক্ষাতকারের অংশ পড়ে সব উবে গেল। এটা কী বয়সকালীন মতিভ্রম নাকি নিয়োগকর্তাদের খুশী করার চেষ্টা বোঝা যাচ্ছে না। ক্ষমতার চশমা দিয়ে দেশের আসল চেহারা দেখা যায় না মনে হয়।[২.১০.২০২৪]

Wednesday, September 11, 2024

'অসভ্য' দেশের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক

‘বাংলা’ নামের ছোট্ট একটা গ্রাম ছিল মনিপুর রাজ্যে। মনিপুরী মেইতেই জনগোষ্ঠির বসবাস ছিল সেখানে। গত বছরের দাঙ্গার সময় গ্রামটা পুড়িয়ে দিয়েছিল কুকি বিদ্রোহীরা। মারা গিয়েছিল অনেকে। বাকীরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল অন্য এলাকায়। গত কয়েকদিন ধরে মনিপুর আবারো সহিংসতার সংবাদ শিরোনাম হবার কারণে মনে পড়লো ঘটনাটা। মনিপুরের এই দাঙ্গার সূত্র ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া উপহার। ভারত সেটার উত্তরাধিকার বহন করে যাচ্ছে।


এই জাতিগত দাঙ্গাগুলো আধুনিক সভ্যতার দান। বিষয়টা অনেক দীর্ঘ বিস্তারিত আলাপের বিষয়। সংক্ষেপে বলতে গেলেও ধৈর্যে কুলাবে না অনেকের। তবু যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বলছি।


পৃথিবীতে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলোর মানচিত্র সৃষ্টির অনেক গল্প আছে। একেকটি মানচিত্র কিভাবে তৈরি হয়েছে সেই গল্পগুলোর বড় অংশ জুড়ে আছে মর্মান্তিক সব উপাখ্যান। অধিকাংশ সীমান্ত বিভাজন ভয়ানক যুদ্ধের পরিণতি। মানুষ যতই নিজেকে সুসভ্য বলে ঘোষণা করুক, সীমান্তের এই গল্পগুলোর মধ্যে মানবজাতির সবচেয়ে বড় অসভ্যতাগুলো লুকিয়ে আছে। অস্ত্রশক্তি আর রাজনৈতিক কুটকৌশলের খেলার মাধ্যমে জন্ম হওয়া স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর ভেতরেও অনেক অমানবিক ব্যাপার রয়ে গেছে। পৃথিবীর অল্প কিছু রাষ্ট্র বাদে বৃহৎ সব রাষ্ট্রের মানচিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নানা ধরণের অসভ্যতার ইতিবৃত্ত। এসব অসভ্য মানচিত্র ছিঁড়ে কিছু দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও এখনো অসংখ্য পরাধীন জাতি এসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে পিষ্ট হচ্ছে সভ্যতার ছাদের নীচে। একেকটা দেশে একেক রকমের বঞ্চনার গল্প।


কাছের দেশ হিসেবে সবার আগে ভারতের উদাহরণ দেই। পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে অনেকগুলো জাতির বসবাস। তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। সরলভাবে চিন্তা করলে ভারতের ভেতরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারতো সেরকম রাজ্যের সংখ্যা কয়টি? মোটা দাগে বলতে গেলেও সংখ্যাটা দশের বেশি হবে। অনেক জায়গাতেই ভারতের মূলধারার সংস্কৃতি ধারণ করে না তেমন কিছু জাতিকেও জোর করে ভারতের ভেতরে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেঁধে রাখা হয়েছে বলতে হচ্ছে কারণ সে রাজ্যগুলো নিজ থেকে ভারতের সাথে যুক্ত হয়নি। বৃটিশ শাসনের সময় থেকে তাদের জোর করে ভারতভুক্তি করা হয়েছে। যেমনভাবে সোভিয়েত আমলে মধ্য এশিয়ার অনেক রাজ্যকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল।


পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে এই কথা আরো বেশি সত্য। এই ২০২৪ সালে মনিপুরে যে আগুন চলছে, বার্মায় আরাকান রাজ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইছে অথবা কুকিচিনের প্রধান ঘাঁটি চিনল্যান্ড যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সবগুলো ওই একই কারণে। গত দেড়শো দুশো বছর ধরে ওইসব অঞ্চল যারা শাসন করছে তারা সবাই বহিরাগত। জোর করে ওইসব রাজ্য দখল না করলে সেগুলো হয়তো এখন স্বাধীন রাজ্য হিসেবেই থাকতো। অস্বীকার করা যাবে না কোনো কোনো এলাকায় বাংলাদেশও তাদের ছোট ভাই। একই কথা প্রযোজ্য হিমালয় অঞ্চলের রাজ্য গুলোর ক্ষেত্রেও।


হিমালয় অধ্যুষিত এলাকার একটা জাতিও ভারতীয় নয়। বৃটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে মালিকানা না পেলে সেই রাজ্যগুলো কখনোই ভারতের অংশ হতো না। নেপাল ভূটান যে কারণে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, একই কারণে ভারতের ভেতরের সেই রাজ্যগুলোর অধিকার ছিল স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু অসভ্য রাজনীতির কুটনৈতিক চালের কারণে তা হয়নি। এই অঞ্চলের সবগুলো সরকার পৈত্রিক উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া সম্পদের মতো আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যগুলোকে ভোগ দখল করছে। রাজ্যগুলোকে যদি জনমত যাচাই করা হয় তবে নিশ্চয়ই তারা স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকতে চাইবে। অরুনাচল থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সমগ্র উত্তরাঞ্চলে একই চিত্র। পূর্ব দিকে মনিপুর মেগালয় মিজোরাম নাগাল্যাণ্ডের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের সঙ্গে এই রাজ্যগুলো নিতান্ত বাধ্য হয়ে যুক্ত আছে।


আগামী একশো বছরের মধ্যে হয়তো এখানে অনেকগুলো আলাদা রাষ্ট্র গঠিত হবে। দুশো বছর আগে পৃথিবীর যেসব জাতি পরাধীন ছিল, তাদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য ছিল। একইভাবে তিব্বত কিছুতেই চীনের অংশ হতে পারে না। পারে না জিনজিয়াং নামের উইঘুরদের দেশটাও। চীনের ভেতরে লুকিয়ে আছে এরকম অন্ততঃ আরো ডজনখানেক আলাদা জাতি। সোভিয়েত রাশিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া রাষ্ট্রগুলো আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। আরো অনেক পরাধীন জাতি আছে তার ভেতরেই। সারা পৃথিবীতে স্বাধীন রাষ্ট্র হবার যোগ্যতা সম্পন্ন জাতির সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেশে দেশে তাদের অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে। সবগুলো জাতি যদি যদি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতো পৃথিবীতে স্বাধীন দেশের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতো।


ষোড়শ শতকের আবিষ্কারের যুগ থেকে শুরু করে জগতের শক্তিমানেরা পৃথিবীর একশোভাগ ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে। এক ইঞ্চি মুক্ত জায়গা নেই কোথাও। আপনি শুনে অবাক হতে পারেন ভারত মহাসাগরে কয়েকশো ফুট প্রস্থের এমন কিছু ক্ষুদে দ্বীপ আছে যেগুলো এখনো ইউরোপীয়ানদের দখলে।


মোদ্দাকথা পৃথিবীর সব মানুষকে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনস্থ করা হয়েছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। পৃথিবীতে এমন অনেক আদিবাসী আছে তারা জানেও না কে তাদেরকে শাসন করছে। হয়তো শাসন করছে এমন কেউ যাদের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। হয়তো সেই জাতি উপজাতিগুলোর রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, পতাকা, মানচিত্র এসবের কোন প্রয়োজন নেই। তবু সভ্যতার দোহাই দিয়ে তাদেরকে কোন না কোন রাষ্ট্র খোপে প্রবেশ করানো হয়েছে। মানুষ আধুনিক বলে বিবেচিত হবার পর থেকে এসব রাষ্ট্র সীমানার জন্ম। অথচ এসব সীমানার প্রশ্ন যখন ছিল না তখনও তাদের অস্তিত্ব ছিল। সীমান্ত থাকা না থাকায় তাদের কিছু এসে যায় না। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সীমান্ত নেই। আদিযুগে হাজার হাজার বছর ধরে মানবজাতি এসব ছাড়াই পৃথিবীতে বেঁচে ছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। কিন্তু এখন ইচ্ছে থাকলেও কোনও জাতি রাষ্ট্রবিহীন থাকতে পারবে না। তাদেরকে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকতেই হবে। কেউ না কেউ তাকে দখল করে নেবেই। এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের দূর দূরান্তের হাজার হাজার ক্ষুদে ক্ষুদে দ্বীপের জাতিগোষ্ঠীগুলোও রক্ষা পায়নি এই সভ্যতার থাবা থেকে।


কিন্তু সব মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে হবে কেন? এই যে আধুনিক সভ্য রাষ্ট্রের যে ফরমূলা, পতাকা মানচিত্র জাতীয়সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয় পৃথিবীর আদিম জনগোষ্ঠিদের মধ্যে ছিল না, এখনো নেই। আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই প্রশ্নটা সাধারণভাবে আমাদের মানে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষদের মনে জাগে না। আমরা মেনেই নিয়েছি মানুষের জীবনে এমন হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী এই আইনের আওতায় নেই। একটা পিঁপড়া কিংবা কাক কিংবা কুকুর বেড়ালকে নাগরিকত্ব নিয়ে কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। অথচ মানুষকে নিরন্তর এই যন্ত্রনা পোহাতে হয়।


হঠাৎ করে কেন এই প্রশ্ন তুললাম? আমার মনে হয়েছে মানুষের জন্য পৃথিবীতে কিছু মুক্ত দেশ মুক্ত অঞ্চল থাকা দরকার। যেখানে আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো থাকবে না, রাজনীতি থাকবে না, পাসপোর্ট থাকবে না, মানচিত্র থাকবে না, পতাকা থাকবে না। শুধু মানুষ থাকবে। আদিম স্বাধীন মানুষ। যে মানুষেরা স্বাধীনভাবে তাদের আদিম জীবনযাত্রা বজায় রাখতে পারবে। যে মানুষকে জোর করে আধুনিক সভ্যতার দীক্ষা গ্রহন করতে হবে না। যে মানুষকে অন্যের বানানো স্বর্গে সুখী হবার ভাণ করতে হবে না। যে মানুষ নিজস্ব আলয়ে একটি স্বাধীন বন্য প্রাণীর জীবন যাপন করবে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন দেশ কোথাও নেই। পৃথিবীতে আর কোন জঙ্গল, পর্বতমালা কিংবা দ্বীপ নেই যেখানে সভ্যতার কদর্য পদক্ষেপ পড়েনি।


আধুনিক মানুষের বানানো সভ্যতার সংজ্ঞায় মানুষদের জন্য প্রকৃতির দেয়া স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করার স্বাধীন কোন অঞ্চল নেই। এই না থাকাটা একটা বড় রকমের মানবাধিকার লংঘন। এই মানবাধিকার লংঘনের কথা কেউ বলে না। অথচ প্রকৃত স্বাধীনতা হলো প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকার। পৃথিবীতে অন্য প্রাণীদের জন্য ছোটখাট অভয়ারণ্য থাকলেও মানুষের জন্য কোনও অভয়ারণ্য নেই।


আধুনিক মানুষের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এই সভ্যতার যাত্রা শুরু মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে। ইউরোপীয়ান ফরমূলার রাষ্ট্রকাঠামোর বয়স মাত্র কয়েকশো বছর। মহাকালের তুলনায় এটা কিছুই না। এটা হয়তো আর এক হাজার বছরও টিকবে না। টিকলে কী হবে কল্পনায় আসে না। তিনশো বছর আগে মানুষ প্রযুক্তির যে পর্যায়ে ছিল তাতে করে মানবজাতি আরো দশ হাজার বছর টিকতে পারতো। কিন্তু গত একশো বছরে মানুষ যেসব প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে তাতে স্বজাতিকে ধ্বংস করার মতো যথেষ্ট অস্ত্র মজুদ হয়ে গেছে, স্বজাতিকে চরম ঘেন্না করার নানান বিভক্তিও তৈরী হয়ে গেছে। এই মানসিকতার বহুধাবিভক্ত মানব জাতি আর এক হাজার বছর দূরে থাক দুশো বছর টিকবে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।


মাঝে মাঝে তাই মানুষের জন্য একটা অভয়ারণ্যের খুব প্রয়োজন অনুভব করি। পৃথিবীতে কিছু আদিম অসভ্য জাতিগোষ্ঠির জন্য এমন কিছু ভূখণ্ড থাকা দরকার ছিল যেখানে ওরা নিজেদের মতো জীবন কাটাবে। আদিম স্বাধীন মানুষেরাই পৃথিবীর প্রকৃত নাগরিক। পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য রাখার জন্য এমন কিছু এলাকা থাকা উচিত।


কেন উচিত সে বিষয়ে একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি। অনেকে থাংলিয়ানা বইতে পড়েছেন ঘটনাটা। উনিশ শতকে লুসাই যুদ্ধের পর একদল পার্বত্য আদিবাসীকে আধুনিক উন্নত সভ্যতা দেখিয়ে মুগ্ধ করার জন্য জাহাজে করে কলকাতা শহরে নেয়া হলো। কিন্তু দেখা গেল মুগ্ধ হওয়া দূরে থাক, দুদিন বাদেই ওরা কলকাতার ওপর মহা বিরক্ত হয়ে বলছে, তোমাদের এই সভ্যতা আমাদের দরকার নাই। আমাদের সেই পাহাড়ের চুড়ায় রেখে আসো যেখান থেকে নিয়ে এসেছো। ওখানেই আমাদের শান্তি। ওটাই আমাদের দুনিয়া।

সুতরাং পৃথিবীর কিছু অঞ্চলকে 'অসভ্য' থাকার সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। তাহলে এসব আঞ্চলিক হানাহানি কিছুটা হলেও কমতো।

Saturday, September 7, 2024

ফ্যাসিবাদী শব্দপ্রয়োগ সংক্রান্ত

ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর থেকে একটা শব্দ খুব বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ। গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী দুঃশাসনকে বোঝাতে এই শব্দটা ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু সপ্তাহখানেক বা তার বেশিসময় ধরে খেয়াল করছি শব্দটা অপব্যবহার শুরু হয়েছে। যারা শব্দটার অর্থ বোঝে না, প্রয়োগ বোঝে না তারাও মুখস্থ শব্দটা ব্যবহার করছে। নিজের মতামতের বাইরে কিছু পেলেই তাকেই ফ্যাসিবাদ বলা হচ্ছে। যার ফলে এই শব্দটার আসল অর্থটা হারিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের আমলে যেভাবে রাজাকার শব্দটা যত্রতত্র ব্যবহার করা হতো এখন ফ্যাসিবাদ শব্দটিও সেই পথে যাত্রা শুরু করেছে। 

আন্দোলনের সময় বলা হয়েছিল এই বিপ্লবের স্বপ্ন ছিল নতুন কিছু উপহার দেবে। পুরোনো ভুল পন্থাগুলো ঝেড়ে ফেলে নতুন ভাষায় কথা বলবে, নতুন প্রজন্ম বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে, সেজন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও সরকারের শীর্ষপদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ছাত্র প্রতিনিধিদের। তারা কোনো রাজনৈতিক পথ ও মতের অনুসারী হবার কথা নয়। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। 

যা ঘটছে তাতে মনে হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রতারণার ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে এখানে। এই নাটকের মঞ্চ হিসেবে বাংলাদেশের এই রেকর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারবে মনে হয় না। দুই মাস আগে কেউ কল্পনাও করেনি মুক্তিযুদ্ধ শব্দটাকে ফ্যাসিবাদ শব্দার্থে রূপান্তরিত করার দুঃসাহস কেউ দেখাতে পারবে। এখন সেটাই দেখা যাচ্ছে চারদিকে। সাধারণ মানুষকে এত বোকা মনে করা ঠিক না।


ত্রিদেশীয় সীমান্তের রহস্য: চিনল্যান্ড

অধ্যয়ন-১

বাংলাদেশ-বার্মা-ভারত সীমান্তের দূর্গ অরণ্যের জাতিগোষ্ঠি সম্পর্কিত অনুসন্ধান। ১৮৮২ সালে ক্যাপ্টেন লুইনের লেখা ফ্লাই অন দ্য হুইলের হারিয়ে যাওয়া জাতিগোষ্ঠির খোঁজ করার চেষ্টার প্রথম পর্ব। লুসাই বলে কথিত তিনটি  গোত্রের মধ্যে ছিল হাওলং, সাইলু এবং শেন্দু। এদের মধ্যে মাত্র একটির সন্ধান মিলেছে বলে মনে হয়। বার্মার চিন প্রদেশ যাদের নিয়ন্ত্রণে সম্ভবত তারাই হাওলং। সাইলু এবং শেন্দুজদের বিষয়ে আরো খোঁজ করতে হবে। বিশেষ করে শেন্দুজ গোত্রকে কখনোই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। 

সাম্প্রতিক সময়ের একটি ঘটনা। যেটা পৃথিবীর প্রধান পত্রপত্রিকায় তেমন ঠাঁই করতে পারেনি। ফলে আমাদের অগোচরেই থেকে গেছে ঘটনাটা। অন্তত বাংলাদেশের মানুষের জন্য খবরটা গুরুত্বপূর্ণ।

বার্মার চিন প্রদেশ চিনল্যান্ড নামে একটা দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, এই স্বাধীনতা অবশ্য কোনো দেশ থেকে স্বীকৃতি পায়নি। তাদের ভাষায় চিনল্যান্ড এর আক্ষরিক অর্থ হলো 'আমারদেশ'।  মূলত চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামের বিদ্রোহী গ্রুপ এই স্বাধীন দেশের মালিকানা দাবী করেছে। তাদের নিজস্ব সরকার কাঠামো প্রকাশ করেছে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পু পা থাং। নতুন দেশের জনসংখ্যা পনের লাখের মতো। তাদের সরকারী ভাষা বার্মিজ, কুকিচিন,ইংরেজির পাশাপাশি মিজো ভাষাও ব্যাপক প্রচলিত। জাতীয় প্রতাকায় লাল সাদা নীলের মধ্যে দুটো ধনেশ পাখি। চিনল্যান্ডকে লুসাই ভাষায় চিনরামও বলা হয়। মূলত প্রাচীন লুসাই জাতির একাংশ দিয়েই এই রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছে। এই সরকার গঠনের পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্রোহী গ্রুপ CNF, এই দলের প্রতিষ্ঠা ছিলেন পু তিয়াল খাল এবং পু লিয়ান নো থাং। তারা ভারতে এই দলটি গঠন করেছিলেন। ওই দলের সামরিক শাখার নাম CNA বা চিন ন্যাশনাল আর্মি।

এদের মূল গোত্রটি হলো উনিশ শতকে হাওলং নামে যে গোত্রটা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেছিল সেই গোত্র। হারবার্ট লুইন তাদেরকে হাওলং বলে অভিহিত করেছিলেন তার বইতে। তবে তাদের আসল নামটা সম্ভবত Khlong  বা Khlaung, যেটার অর্থ মানুষ। বার্মিজরা তাদেরকে আশো চিন বা আশো খালং নামে ডাকে। বর্তমানে বার্মিজ সরকারের প্রবল নিপীড়নের মধ্যে আছে ওই জাতিগোষ্ঠি। পালিয়ে গেছে অনেকে ভারতের মিজোরামে। হয়তো বাংলাদেশেও কিছু আশ্রয় নিয়েছে গোপনে।

এদের উপভাষাগুলোর মধ্যে আছে:

Zomi Tedim Chin with an estimated 344,000 speakers

Thadou Kuki Chin estimated 300,000

Asho Chin 200,000-300,000

Falam Chin with an estimated 50,300 speakers

Haka Chin (Hakha) with an estimated 125,000 speakers

Matu Chin 25,000 speakers

Khumi Chin 90,000

Mara Chin with an estimated 50,000 speakers

Cho Chin 60,000

Zotung Chin 35,000

এদেরই একটা অংশ বান্দরবানে বাংলাদেশের সীমানায় বসবাস করছে যারা কুকি চিন নামে পরিচিত। এরা বাংলাদেশেও বিদ্রোহের চেষ্টা করে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এদের অধিকাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। কিছুদিন ধরে একটা মতবাদ চালু হয়েছে এরা বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের একাংশ নিয়ে একটা খ্রিস্টান দেশ গড়তে চায়। সে কারণেই কুকি চিন বিদ্রোহীরা বাংলাদেশ সীমান্তে অস্থিরতা চালাচ্ছে। 

প্রাচীন লুসাই জাতির একাংশ নিয়ে গঠিত এই দেশ বা প্রদেশটা এখনো আরাকান আর্মির মতো তেমন শক্তিশালী নয়। কিন্তু ভবিষ্যতে বাইরের শক্তির প্রশ্রয় পেলে এরা আঞ্চলিক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এদিকে।




অধ্যয়ন-২

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ভারতের দুটি রাজ্য ত্রিপুরা এবং মিজোরাম। বার্মার দুটি রাজ্য চিন ও আরাকান। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বদিকে মনিপুর। বর্তমান মানচিত্রে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনস্থ হলেও এই রাজ্যগুলোর মধ্যে একটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐক্য আছে। সেই ঐক্য হাজার বছর প্রাচীন। ঐক্যের সূত্র বুঝতে হলে রাজ্যগুলোর ইতিহাস জানতে হবে। রাজ্যগুলোতে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠিগুলোকে বুঝতে হবে। পত্রিকার পাতায় মনিপুর প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। মনিপুরের যে সমস্যা সেটা ভাল করে বুঝতে হলে মনিপুর মিজোরাম এবং চিন এই তিনটা রাজ্যের ইতিহাস একসাথে পড়তে হবে। কারণ গত একশো বছরে রাজনৈতিক সীমান্ত বদলে গেলেও এই রাজ্যে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠিগুলোর সাংস্কৃতিক ঐক্য বদলায়নি। এরা একদিকের ধাওয়া খেয়ে আরেক রাজ্যে বসতি গড়েছে ঠিক, কিন্তু এদের মধ্যে প্রাচীন জাতীয়তাবোধ ভালোভাবেই অক্ষুন্ন আছে। ভারত কিংবা বার্মার আগ্রাসন এদেরকে যে গত অর্ধশতাব্দী সময় দরে দমন করতে পারেনি সেটা এখন ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। 

বার্মায় চিন রাজ্যের অভিযানে অংশ নেয়া ব্রিটিশ কর্মকর্তা Lt. Betram ১৮৮৮ থেকে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে The Chin Hills লিখেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর অস্থিরতার আদ্যপান্ত বোঝার জন্য এই গ্রন্থটি জরুরী। কারণ সীমান্তের ধোঁয়া এই পারেও কিছু কিছু উড়ে আসতে শুরু করেছে। মনিপুরে যাদের সাথে যুদ্ধ চলছে, তাদেরই অন্য অংশ বার্মার চিন প্রদেশ স্বাধীন করতে চাইছে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের কুকি-চিন বিদ্রোহী গোষ্ঠিও বান্দরবানে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যদিও সংখ্যায় তেমন বেশি নয়। চিন, মিজোরাম, মনিপুরে সব মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশি জাতিগোষ্ঠি আছে যাদের অধিকাংশ বাস্তবতা মেনে যে যার দেশের সরকারের সাথে আপোষ করে নিয়েছে। কিন্তু অল্প কয়েকটা গ্রুপ এখনো বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে পূর্ব পুরুষদের মতো। বলাবাহুল্য এই বিদ্রোহগুলোর পেছনে ন্যায্য কারণও আছে। প্রতিটা দেশে সরকারী শক্তি কোনো না কোনো ভাবে তাদের ওপর অবিচার চালিয়েছে। দেশভেদে সেই অবিচারের কারণগুলো আলাদা। কিন্তু অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তাদের রক্তের ভেতরে লুকিয়ে আছে। যেটা শত শত বছর পরও লুপ্ত হয়নি।

আ ফ্লাই অন দ্য হুইল গ্রন্থে তার কিছু অংশ পড়েছিলাম। এখন পড়ছি দ্য চিন হিলসের বিবরণ। দুটো গ্রন্থই সমসাময়িক। পার্বত্য অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার কারণের পাশাপাশি সেই জাতিগুলোকে চিনতে সাহায্য করে। বলাবাহুল্য, এসব বই শাসকদের দিক থেকে যে বাস্তবতার চিত্র দেখায় আমরা সেটাই দেখতে পাই। পার্বত্যজাতিগোষ্ঠির দিক থেকে সেটা এক নাও হতে পারে। তাদের কারো লেখা বই পড়ার আগ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে না। জো কিংবা চিন গোষ্ঠির কেউ কি তাদের ইতিহাস লিখেছেন?

## নোট :  হারবার্ট লুইন ১৮৭১ সালে তিনটা জাতিগোষ্ঠির কথা লিখেছিলেন। সাইলু, হাওলং, সেন্দুজ। এর মধ্যে সাইলু এবং হাওলংদের সাথে যুদ্ধের পর তিনি আপোষ মীমাংসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু সেন্দুজদের সাথে কোনো সমঝোতা হয়নি। কালাদান নদী ধরে তিনি সেন্দুজ এলাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। পরবর্তী জরিপের মানচিত্রে সাইলু এবং হাওলং এলাকাগুলো ব্রিটিশ অধীনস্থ হয়। সেন্দুজ তখনো বাইরে ছিল। ১৮৯০ সালে আবারো কুকি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। সাধারণ পরিভাষায় কুকি বিদ্রোহ হলেও সেগুলো আদতে সেন্দুজ এবং অন্যান্য পার্বত্য জাতিগোষ্ঠির সাথে যুদ্ধ ছিল। লুইন যাদেরকে সেন্দুজ জাতি হিসেবে লিখেছিলেন লে. বেট্রাম তাদের Klangklang নামে চিহ্নিত করেছেন। তাদের সাথে ছিল Siying, Soktes সহ আরো কিছু শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠি।  ১৮৯০ পরবর্তী যুদ্ধগুলোতে তারাবো ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। মিজোরামের মতো চিন হিলও ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে আসে।


১৮৯০ সালের হিসেবে চিন হিলের সেই জনগোষ্ঠিগুলোর আনুমানিক জনসংখ্যা( প্রতি ঘরে পাঁচজন সদস্য হিসেব করা হয়েছে)


চট্টগ্রাম-বার্মা সীমান্তের পাহাড়ে যেসব গাছপালা জন্মায় সে সম্পর্কিত বিবরণ:



ফুল-ফল ইত্যাদির গাছ:
[সূত্র: দ্য চিন হিলস: বেট্রাম-টাক]


কুকি-চিন ভাষাভাষীদের মধ্যে তিনটি জাতি বাংলাদেশে আছে। বম,খিয়ং এবং খুমি। এর মধ্যে খিয়ং জাতিকে হিও(Hyow) নামেও ডাকা হয়। বার্মায় যেটা চিন, বাংলাদেশে সেটাই খিয়াং বা হিও। লুইন বর্নিত হাওলং এদের দলভুক্ত হতে পারে। আবার এরাই জো বলে পরিচিত মনিপুর-মিজোরাম থেকে আরাকান পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলে। বাংলাদেশের বাইরে বার্মার চিন প্রদেশে এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় পনের লাখ। মনিপুর এবং আসামে আছে আরো কয়েক লাখ। মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশ এই তিন দেশে বিদ্রোহী গ্রুপের অস্তিত্ব আছে। কুকিচিনের সবচেয়ে দুর্বল অংশটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাঝে মাঝে তৎপরতা চালাচ্ছে বান্দরবান এলাকায়। এই অঞ্চলের সীমানায় মিয়ানমারের চিনল্যান্ড। সে কারণেই বাংলাদেশে আক্রমণ চালাবার সাহস পাচ্ছে এই দলটা।





Tuesday, September 3, 2024

ভুল স্বপ্নের বিপ্লব

১.

গত কয়েকদিনের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের ঘটনা প্রবাহের জের থেকে কিছু ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ। 

যদিও সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু কাঠামো আগের মতোই রয়ে গেছে। পুরোনো ফর্মেই নতুন সরকার কাজ করছে। ছাত্রদের ক্ষমতাসীন পক্ষ চাইছে নতুন কিছু করতে। এমন কিছু যা আগে ছিল না। বিপ্লবের পুরোপুরি বাস্তবায়ন। সেই বিপ্লবের এজেণ্ডা আবার সাধারণ মানুষ জানে না। এখানেই একটু গোলমাল। মানুষ কোনো বিপ্লবের এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করতে মাঠে নামেনি জুলাই মাসে। কোনো রাজনৈতিক পক্ষের আহবানও ছিল না সেখানে। মানুষ নেমেছিল হত্যাকারীর বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়াতে। তাদের সন্তানেরা গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছিল। শত শত নিরীহ ছাত্রের মৃত্যুর জন্যই মানুষের মাঝে এত ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ক্ষোভের আগুনে পুড়ে গিয়েছিল সরকারের সকল শক্তি সামর্থ্য। মৃত্যুই ছিল ঐক্যের মন্ত্র, বিপ্লবের শক্তি, গণঅভ্যুত্থানের জন্মদাতা। অন্য কোনো শক্তি নয়, সরকার নিজেই নিজের পতন ডেকে এনেছিল। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শেখ হাসিনাই মানুষের বিরুদ্ধ শক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছিল গোয়ার্তুমি দিয়ে।

এখন সেই বিজয়ের সাফল্য নিয়ে যারা কৃতিত্ব দাবী করছে তাদের একাংশ দেশকে নিয়ে এমন একটা স্বপ্ন দেখছে যেটা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। কিছু কিছু বক্তব্য ইতোমধ্যে তার প্রমাণও দিয়েছে। এটা আরেকটা ভুলের জন্ম দেবে। বিপ্লবীদের কেউ কেউ আরেকটা পূর্নাঙ্গ বিপ্লবের কথাও বলছে। সেই বিপ্লবটা হবে পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক। যেটুকু বাকী আছে সেটুকুও শেষ করে ফেলা। ওই বিপ্লবে মানুষ সাড়া দেবে মনে হয় না। মানুষকে চাইলেই পথে নামানো যায় না। চরম অবস্থা ছাড়া মানুষ যে রাস্তায় নামে না সেটা গত ১৫ বছরেই প্রমাণিত। এখন কার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে মানুষ? এখন যেটা হতে পারে সেটা ক্ষমতার কাঠামোর ভেতরে অন্তর্বিপ্লব। শক্তিকেন্দ্রের ভেতরেই ঘটতে পারে। ১৯৭৫ এর নভেম্বরে যার উদাহরণ আছে। ভালো উদাহরণ নয়। দেশ হিসেবে পাকিস্তানে রূপান্তরিত হবার চেষ্টা।

ইউনুস সরকারে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী লোকদের প্রাধান্য। প্রগতিশীল লোকদের সংখ্যাই বেশি। এটাও এদের একটা মাথাব্যথা। এই সরকারকে নিজেদের পক্ষে টানতে হলে প্রগতিশীল লোকদের সরিয়ে দিতে হবে। প্রগতিশীল শক্তি মানেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি। ২০২৪ বিপ্লবের নেতারা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে প্রতিপক্ষ মনে করে। এই ছেলেদের কেউ কেউ খুব স্মার্ট। বেশ পড়াশোনাও আছে। কিন্তু বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শীতার অভাব রয়েছে। অথবা কেউ এদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। যারা করছে তাদের প্রকাশ্য জনসমর্থনের অভাব আছে, তাই এদের বিপ্লবী ইমেজকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা সফল হবে না। তাহলে মানুষকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলা হবে। ১ আগষ্ট যে মানুষগুলো শহীদ মিনারে জড়ো হয়েছিল, সে মানুষগুলোই বাংলাদেশের প্রতিনিধি। তারা কোনো অন্ধকার শক্তির প্রতিনিধিত্ব করবে না। মেনে নেবে না। তখন যে বক্তব্য শুনে তারা রাস্তায় নেমেছিল, এখন তার বিপরীত চেতনার কথা শোনা যাচ্ছে। এই বৈপরীত্যের কারণে বিপ্লবী ছেলেগুলো জনসমর্থন হারাতে পারে। দেশ পুরোনো সিস্টেমেই ফিরে যেতে পারে। এই দেশের মানুষ খুব পশ্চাদপদ। 'আগেই ভালো ছিলাম' বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাবে ছেলেদের এই ভুল পন্থার কারণে। ভুল স্বপ্ন দেখার ফলে দেশে দেশে অনেক বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে গেছে অতীতে।

২.

পরিবর্তন সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে মানুষের আগ্রহ আছে সত্যি। কিন্তু যে কোনো কিছুর একটা সীমা আছে। সীমা ছাড়িয়ে গেলে সেটাকে বাড়াবাড়ি বলে, বাড়াবাড়ির ফল করার কখনো ভালো হয় না। দেশের মূল সমস্যা অর্থনীতি, দুর্নীতি, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি। এখন কিছু অতি উৎসাহী এগুলোর চেয়ে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এসব পরিবর্তন করার মতো বিপ্লবী কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। মানে বাংলাদেশকে একটা হাস্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। 

দেশের সরকার পরিবর্তন হলে যদি জাতীয় সঙ্গীত আর পতাকা বদলাতে হয়, তাহলে দলের মার্কার মতো প্রতিটা রাজনৈতিক শক্তির একটা করে পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করে নেয়া উচিত। যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে তারা সেই পতাকা উড়াবে। সেই জাতীয় সঙ্গীত বাজাবে। সেই ইতিহাস পড়বে। ইতিহাসের বইপত্র সবগুলোর কয়েকটা সংস্করণ তৈরি করা উচিত। এমনকি দেশের নামও কয়েকটা রাখার প্রস্তাব করা যায়। প্রতিটা দলের পছন্দমতো একটা করে নাম থাকবে। দেশের নাম  দেখে মানুষ বুঝতে পারবে ওই দেশে কোন সরকার ক্ষমতায় আছে। বিদেশীরা এদেশে আসার আগে ভেবে চিন্তে আসবে কোন সরকারের দেশে যাচ্ছে। সেরকম পোশাক প্রস্তুতি নিয়ে আসবে। ব্যাপারটা ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছে। 

৩.

ডোবার মাছ দীঘিতে পড়লে তাও মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সমুদ্রে পড়ে গেলে বিপত্তি ঘটে। এখন তোমাদের অবস্থা সমুদ্রে পতিত হওয়া ডোবার মাছের মতো। কোনদিকে সাঁতার দিতে হবে সেটা বুঝতে পারছো না। কদিন ধরে দেখতে পাচ্ছি আবোল তাবোল বকছো। দিশাহীন বঙ্গদেশে গন্তব্য হাতড়ে মরছো খামাকা। পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছো। শেষমেষ কোথাও পৌঁছাতে পারবে না।