Monday, April 22, 2024

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বিচিত্র আলোকমালা: বায়োলুমিনিসেন্স




আমি জানি না সেন্টমার্টিন দ্বীপে রাতের বেলা এই দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আর কারো হয়েছে কিনা। সেটা জানার জন্য ত্রিশ বছর আগের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।

১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা ছয় তরুণের একটা দল গল্প করতে করতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পূর্ব দিকের সৈকত ধরে হাঁটছিল। এডভেঞ্চারপ্রিয় দলটা সেদিন দুপুরে এসেছে একটা জেলে নৌকায় চড়ে। উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে নৌকাটা যখন খাবি খেতে খেতে সৈকতে এসে পৌঁছালো তখন চরের মধ্যে ঘুরতে থাকা দু চারজন বাদে আর কেউ ছিল না। ওই দ্বীপে তখন কোন ঘাট ছিল না। নৌকা সরাসরি এসে সৈকতে লাগতো। সৈকতে সারি সারি জেলে নৌকা বাদে আর কিছু নেই। ধূ ধূ বালিয়াড়ি, নারিকেল গাছ আর কেয়া ঝাড় শুধু। সাগর গরম থাকায় সেদিন সেন্টমার্টিনের কোন জেলে নৌকা সমুদ্রে নামেনি। টেকনাফ থেকেও এই একটি নৌকা বাদে কোনও নৌকা আসেনি। সেন্টমার্টনে তখনো পর্যটন ব্যাপারটা চালু হয়নি। মাঝে মাঝে দলছুট দুয়েকজন বাদে সেই দ্বীপে কেউ যেতো না। হুমায়ূন আহমদের সমুদ্র বিলাস তখনো তৈরি হয়নি।
ছয়জনের দলটি যখন আগের রাতে টেকনাফে ঘুরে ঘুরে সেন্টমার্টিনে যাবার উপায় খুঁজছিল তখন বাজারের লোকজন তাদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছিল। দুয়েকজন তো এমন ভয় দেখালো ওই দ্বীপে গেলে জলদস্যুদের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু সেসব ভয়কে জয় করে দলটা যে কোন উপায়ে যেতে মরিয়া ছিল। তাদের কারো বাসায় জানে না এই অভিযানের কথা। সবাই বলে এসেছে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি চারদিনের জন্য।
দিকনির্দেশনাহীন সেই ভ্রমণে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেগুলো অন্য সময়ে বলা যাবে। আপাতত সেই রাতের ঘটনাটা বলা যাক।
একটা ঝুপড়ি দোকানে রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুটঘুটে অন্ধকার দ্বীপে গ্রাম্য পথ ধরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাত দশটার পর ঘুমানোর জন্য নির্ধারিত আস্তানায় রওনা হলো দলটা। আস্তানাটা হলো পূর্বদিকের সৈকতের ওপর দাঁড়ানো গণস্বাস্থ্যের রেস্টহাউস। ভাগ্যক্রমে নৌকায় আসার পথে ওই রেস্টহাউসের কেয়ারটেকারের সাথে পরিচয় হয়েছিল দলের একজনের সাথে। তাঁর সাথে রফা করে ১০০ টাকার বিনিময়ে একটা রুমে ছজনের থাকার বন্দোবস্ত। সৈকতের বালিতে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া দলটার জন্য একটা ডাবল খাট সমৃদ্ধ এক রুমের এই আস্তানা পাঁচ তারকা হোটেলের চেয়ে বেশি ছিল।
নিঝুম সৈকতে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো দলটা। বাম দিকে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র থেকে নীল রঙের ঢেউ এসে লুটিয়ে পড়ছে দূরের সৈকতে। প্রথম দেখায় সবাই ভাবলো কোথাও থেকে আলো এসে পড়েছে বলে ঢেউয়ের নীলাভ ফেনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুতবিহীন দ্বীপে আলো আসবে কোথা থেকে? হারিকেন আর কুপিবাতি ছাড়া ওই গ্রামে আর কোন আলোর উৎস নেই।
দলের মধ্যে সেন্টমার্টিন নিয়ে খানিক পড়াশোনা করা একমাত্র সদস্য আমি। তাই সবাই আমার দিকে তাকালো কোন উত্তর আছে কিনা। কিন্তু আমার পড়াশোনা সেন্টমার্টিনের সমুদ্রের তলদেশে প্রবালের রঙিন বাগান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। সেটাও পশ্চিম সৈকতে। পূর্বদিকে এই ঘটনা ভারী অদ্ভুত।
রহস্যময় আলোর ছটা দেখে কৌতূহলী হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম যেখানে ঢেউগুলো সৈকতে আছড়ে পড়ছে সেই জায়গাতে। কাছে যাবার পর আমাদের মাথা ঘুরে যাবার দশা। ঢেউগুলো যখন সৈকতে ভেঙ্গে পড়ছে তখন লক্ষ কোটি তারকা যেন ছড়িয়ে পড়ছে বালির ওপর। দূর থেকে ঢেউটা দেখতে নীল মনে হচ্ছিল। কিন্তু ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার পর দেখলাম লাল নীল সবুজ হলুদ কমলা নানান রঙের তারকা সৈকতে ছড়ানো। আকাশে তাকিয়ে যত তারা দেখছি নীচের সৈকতেও তার চেয়ে কম নয়। ভয় আর আনন্দের যুগপৎ শিহরণে আমরা নেচে উঠলাম সবাই।
কাছে গিয়ে ভেজা বালিতে হাত দিয়ে জিনিসটা তুলে নিলাম। হাতে নেবার পর হাতও নীলাভ রঙে আলোকিত হয়ে গেছে। ওই আলোতে ঘড়ির সময় দেখেছিলাম মনে আছে। কিন্তু জিনিসটা কী বুঝতে পারছিলাম না। টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম স্বচ্ছ দানাদার কোন পদার্থ মনে হলো। চিনির দানা যতটুকু, ততটুকু আকার। হাতে নিলে একটু উষ্ণবোধ হয়। আমাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে আশ্চর্য একটা দৃশ্য।
তখন ভেবেছিলাম এই দৃশ্য সেন্টমার্টিনে সবসময় দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী ত্রিশ বছরে আরো কয়েকবার সেন্টমার্টিন গেছি, ওই দৃশ্যের দেখা আর কখনো পাইনি। সেই অপরূপ দৃশ্যের ছবি তোলার সুযোগ হয়নি। আমাদের কাছে যে সাধারণ ক্যামেরা ছিল তাতে ওই দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব ছিল না। এতদিন পর মনে হচ্ছে সেই দৃশ্যের উৎস ছিল ‘বায়োলুমিনিসেন্স’ জাতীয় কিছু। যেটা প্লাঙ্কটন বা কোন ধরণের সামুদ্রিক অনুজীব থেকে ছড়ায়। বিশেষ কোন দিনে কিংবা বিশেষ কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে সেগুলো আবির্ভূত হয়।
এখন কত হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সেন্টমার্টিন যায়। কিন্তু কারো কাছ থেকে ওরকম অপরূপ দৃশ্যের কোন অভিজ্ঞতার সন্ধান পাইনি। কয়েকদিন আগে সেন্টমার্টিনের এক বাসিন্দা ওই দৃশ্যের একটা ছবি পোস্ট করলেন ফেসবুকে। ছবিটা দেখে আমি চমকে গেলাম। এই তো সেই ঢেউ ৩০ বছর আগে যেটা আমরা দেখেছিলাম সৈকতে দাঁড়িয়ে। তাঁর কাছ থেকে ছবিটা ধার নিলাম এই লেখার জন্য। কিন্তু সৈকতে ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার পর যে লক্ষ কোটি তারার মেলা বসে সে দৃশ্যের ছবি নেই।
আমি জানি না আমার বন্ধু তালিকায় সেই দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আছে তেমন কেউ আছে কিনা। যদি কেউ থাকেন, তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন। সম্ভব হলে ছবিও।
পৃথিবীর খুব বেশি জায়গায় এরকম দৃশ্য নেই। গুগল করে অল্প যে কয়টি ছবি দেখলাম সবগুলোতেই নীল রঙ। ৩০ বছর আগে আমরা যে বহু রঙের তারার মেলা দেখেছিলাম কোথাও সেই দৃশ্য নেই। কেন নেই? তার মানে যে জীবগুলো ওই রঙের সৃষ্টি করতো সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে পরিবেশ দুষণের কারণে? আমি জানি না।
আজ নাকি Earth Day, এই দিবসটা পৃথিবীর জন্য মন খারাপ করে দেয়। আমরা প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন এই গ্রহটাকে একটু একটু করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।
......................................................
[** পোস্টে ব্যবহৃত তিনটি ছবির দুটি নিয়েছি সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ ভাইয়ের কাছ থেকে। আরেকটি ছবি নেয়া হয়েছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপের একটা সাইট থেকে ]

Friday, April 19, 2024

চোখের আলোয় দেখেছিলাম

লেখালেখির কাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চোখ। দিনের অর্ধেকের বেশি সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে হয়। চশমার পাওয়ার বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বী। কিছুদিন পর স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। এত কিছু পড়তে হয়, সবকিছুতে চোখের ব্যবহার। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অথচ রাতের বেলা দুই চোখে ঘুম থাকে না। দিনের অভ্যেসে জেগে থাকে কোন কাজ না থাকলেও। মাথার ওপর ছাদ না থাকলে আকাশের তারা গুনতাম। আমি যে বাসায় থাকি তার ওপরে আরো পাঁচটা বাসা আছে। তার ওপর ছাদ। সেই ছাদে কখনো শোবার সুযোগ পাইনি। ছাদে শুয়ে ঘুমোতে কেমন লাগে একবার দেখতে হবে। বারো তলার ছাদের ওপর মাদুর পেতে বালিশ নিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। নক্ষত্রের কাছ থেকে আলো ধার নিয়ে আরো কিছুদিন পৃথিবীর রূপরস উপভোগ করতে চাই। জ্ঞানচর্চার জন্য দৃষ্টি শক্তিকে বিসর্জন দেয়ার উপযোগিতা কতখানি? এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। মাঝে মাঝে ভাবা উচিত।

বাবার নোটবুক ১৯৫৫

 






হঠাৎ করে আমার বাবার পুরোনো একটা পকেট ডায়েরি আবিষ্কার করলো আমার পুত্র। যে জিনিস আমি নিজেও কোনদিন দেখার সুযোগ পাইনি। দাদীর সাথে খাতির করে তাঁর পুরোনো রত্নভাণ্ডার থেকে এটা উদ্ধার করেছে সে। ব্যক্তিগত জিনিস হলেও শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না কারণ সেখানে বাবার তারুণ্যের দুটো কাব্য প্রতিভার নিদর্শন রয়েছে। যার একটা বাংলা আরেকটা ইংরেজি। যদিও নিশ্চিত নই এগুলো মৌলিক কবিতা নাকি অন্য কারো বই থেকে টুকে নেয়া। কিন্তু বিষয়টা চমকপ্রদ এবং ১৯৫৫ সালের এত চমৎকার একটা ডায়েরি খুঁজে পাওয়াটাই আমার জন্য দারুণ ব্যাপার। ২৭ বছর আগে প্রয়াত বাবার এই স্মৃতিটা এখন আমার কাছে অমূল্য সম্পদ।

লেখা ও শেখা: ক্রমশ...

:: উপলব্ধি-১::

শেখার কোনও বয়স নেই, শেখার কোনও শেষ নেই, শিখতে কোনও লজ্জা নেই। আমি সব জেনে বসে আছি এই ধারণা যার ভেতরে ঢুকবে তার শেখার সম্ভাবনা শেষ। আমার প্রতিদিনই নতুন কিছু শেখার আগ্রহ জাগে। অনেক ক্ষেত্রে আমি শেখার সূত্র পাই তরুণদের কাছ থেকে। আমার বন্ধুতালিকায় যত পড়ুয়া আছে, তাদের অধিকাংশই আমার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ, কিন্তু জ্ঞানে আমার চেয়ে অনেক ভারী। আমি প্রতিনিয়ত তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার সুযোগ পাই। নাম বলছি না, কিন্তু এখানে এমন কয়েকজন আছে তারা জীবনে যত বই পড়েছে, আমি তত বই চোখেও দেখিনি।
 
মাঝে মাঝে দেখি প্রবীন লেখকদের কেউ কেউ বলেন আজকালকার তরুণরা যা লিখছে তা কিছুই হচ্ছে না,তাদের দেবার কিছুই নেই। দুর্ভাগ্য তাঁদের তাঁরা নিশ্চয়ই শুধু খারাপ লেখকদেরই দেখেছেন। আমার সৌভাগ্য আমার চোখে পড়া অধিকাংশ তরুণ দারুণ প্রতিভাবান। আমার বন্ধু তালিকায়ও এমন কয়েকজন আছেন তারা দেশের যে কোন প্রতিষ্ঠিত লেখকের চেয়ে অনেক ভালো লেখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকাংশই প্রচারের আলোয় থাকে না। অন্তত মূলধারার সাহিত্য বলে যেটা আছে সেখানে তাদের লেখাপত্রের প্রচার দেখি না।

এটা গেল সাহিত্যের কথা। এবার ইতিহাসের কথা বলি। যেহেতু ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করি, আমার ধারণা ছিল আমি পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি অনেকদূর জেনে গেছি। সেদিন এক কিশোরকে দেখে আমার সেই ধারণা বড় ধরণের ধাক্কা খেলো। মাত্র আধঘন্টার আলাপে সে আমাকে পৃথিবীর ইতিহাসের এমন গুরুতর কিছু তথ্য শেখালো, যেগুলো আমার জানা ছিল না। যেটা শিখতে গেলে আমার দশটা ভলিউম উল্টাতে হতো। যে যুগে তরুণরা বই পড়ে না বলে দুর্নাম আছে সে যুগে এই তরুণেরা আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা হতে পারে।
 
অতএব, এই আকালের দিনে বাংলা সাহিত্যে যেসব তরুণ ভালো কাজ করছে তাদের উৎসাহ দেয়া উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক এখন আর ভালো লিখছেন না, শুধু নাম হয়েছে বলে মূলধারার সাহিত্যের আসরগুলো দখল করে আছেন, তাদের উচিত অবসরে যাওয়া। তাঁদের কারণে অনেক প্রতিভাবান তরুণ পত্রিকার পাতায় জায়গা পাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চমৎকার একটা সরস লেখা লিখেছিলেন। লেখাটি আমার বিশেষ প্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক বলে এখানে যুক্ত করলাম। শ্যামল যদিও পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতায় লিখেছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতাও একই বলা চলে।

++বৃক্ষ যদি বৃদ্ধ হয়++

“পাহাড়ের ক্ষয় আছে। নদী একদিন শীর্ণ হয়ে আসে। বৃক্ষ বৃদ্ধ হয়। এই অবস্থায় লেখক কত দিন লেখক থাকতে পারেন? তাঁরও তো ক্ষয় আছে। শারীরিক ক্ষয়ের প্রশ্ন তো আছেই। লেখক সত্তারও তো ক্ষয় আছে।

সে কথা কতটা মনে থাকে। লিখে লিখে পাঠক তৈরি হয়ে গেলে লেখক লেখক হয়ে যান। তার পর তৈরি পাঠককে লেখক লেখা দিতে থাকেন। একটা সময় আসে— যখন দেখা যায়— পাঠক আর সে লেখা চাইছেন না। পাঠক আর আগের মতো স্বাদ পাচ্ছেন না। উপরন্তু নতুন নতুন পাঠক এসে গেছেন। তাঁরা নতুন খাবার চান। এই পালটে যাওয়া অবস্থা অনেক লেখক মেনে নিতে পারেন না। কিম্বা নিজেও নিজেকে বদলাতে পারেন না। ভাবেন— পাঠক যেমন নিচ্ছিলেন—তেমনই নিতে থাকবেন। এই দুঃখজনক অবস্থা সৃষ্টি হয় প্রধানত লেখকের জন্যে। আর সৃষ্টি হয় সম্পাদকের কল্যাণে। কোনও এক সময় লেখকের লেখা ছেপে সম্পাদক সাড়া পেয়েছিলেন। কয়েক বার সাড়া পেয়ে মনে হয় নিরন্তর সাড়া পেয়ে যাব।

পত্রিকার রথ নিজের গতিতে সর্বদাই কিছুটা গড়গড় করে গড়ায়। সেই গড়গড়ানো লেখকের লেখার সাড়া ভ্রমে সম্পাদক নিরন্তর যদি পাঠকের ওপর লেখককে চাপিয়ে দেন—তখনই দুঃখের ঘটনা ঘটে।

পাহাড়, নদী, গাছের কর্মকাণ্ড বা ক্ষয় হঠাৎ বোঝা যায় না। এদের জয় বা ক্ষয়- দুটোই খুব বড়। কিন্তু ধীরে ধীরে। তাই দেখা যায় না। সে তুলনায় লেখক একজন মানুষ মাত্র। জেমা, অভিমান, অহম্ ইত্যাদির পুঁটুলি এই লোকটির ক্ষয় ও জয় বেশ চোখে পড়ার। তাই বোধ হয় তাঁর অবসর নেওয়ারও একটা সময় আছে।
কিন্তু ঘটনা দেখা যায় অন্য রকম।

আমরা লেখক। অন্য গ্রহ থেকে এসে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছি। নিত্য প্রসবিনী। নিত্য প্রকাশমান। অশক্ত না হওয়া অবধি লিখে যাব।

নিষ্ঠুর সময় বালির ঝাপটায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস চাপা দিয়ে ঢেকে ফেলছে। পাহাড়ের গা বর্ষার জলে ক্ষয় হয়ে ধসে পড়ছে। মোহনা থেকে পালটা ধাক্কায় পলি ফিরে এসে নদীর বুকে চর তুলে দিচ্ছে। চার হাজার বছরের প্রাচীন রেড উড গাছ সভ্যতার পর সভ্যতার জন্ম ও মৃত্যুর ফেনা গায়ে মেখে নিয়ে নিজের উচ্ছেদের দিনটি শুনতে থাকে। আর একজন লেখক — সামান্য মানুষ— তিনি কী করে প্রকৃতির নিয়ম অতিক্রম করবেন?

বাবুর প্রথম গল্প ১৯৪৬ সনে সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৫৬ সনে তিনি যুগের প্রথম মশালচি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকেই তিনি একটি নাম। এবং এই নাম হবার পর থেকেই তিনি অহম্, যা-লিখি-তাই-ই-লেখার মনোভাবে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে যান। তখন আর তিনি শিল্প নন। তিনি পত্রিকার অলংকার।

সংঘর্ষ, আবিষ্কার, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ব্যাপারটা লেখকের ভেতর থেকে যেদিন উবে যায়— প্রাকৃতিক কারণেই উবে যেতে বাধ্য— তখন লেখককে প্রধানত মাথার ভেতরে বীজ বুনতে হয় গল্পের। লিখতে লিখতে সেই গল্পগাছের বৃত্তে ফুল আসে। তা দেখতে হয়তো ভালো। কিন্তু তা ফুল নয়।

বিষ্ণুপুর থেকে বাঁকুড়া যাবার পথে জ’পুরের জঙ্গলে দেখেছি— পুরনো গাছের জায়গায় তরুণ শাল চারা বসানো হচ্ছে।
লামডিং থেকে বিশ মাইলের ভেতর চা বাগানে দেখেছি ৬০ বছর বয়সের চায়ের ঝাড়কে লোহার চেনে বেঁধে ট্রাক্টর শেকড়-শুদ্ধ টেনে তুলছে। জানলাম, চায়ের ঝাড়ের আয়ু মানুষের মতোই। পীচে বালক, বিশে জওয়ান, চল্লিশে প্রবীণ, ষাটে বিদায়ী।
তাই— ভাবছিলাম, বৃক্ষ যদি বৃদ্ধ হয়— তাহলে....”


::উপলব্ধি-২::

লেখালেখি একটা নেশা। কিছু কিছু লেখকের এমন নেশা  লিখতে না পারলে অনেকের ভাত হজম হয় না, রাতে ঘুম হয় না, শরীর জুড়ে অতৃপ্তি। সেই অতৃপ্তি কাটানোর জন্য লেখককে কলম হাতে নিয়ে বসতেই হয়। মার্কেজ সেরকম কিছু লেখকের উদাহরণ দিয়েছিলেন তাঁর 'কেন লিখি' শিরোনামের একটা প্রবন্ধে।

বই প্রকাশ অন্য ব্যাপার। সেখানে অর্থের যোগাযোগ থাকলেও ভাগ্যের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। এদেশে অধিকাংশ লেখক নিজের খরচে বই প্রকাশ করেন। এমনকি জনপ্রিয় বিখ্যাত লেখকদের অনেকেই প্রথম বইটা নিজের খরচে প্রকাশ করেছিলেন। তবু কী এক দুঃসাহসে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আগ্রহী প্রকাশক না পেলে নিজের খরচে কোনো বই প্রকাশ করবো না। ২০১৭ সালে উপনিবেশ চট্টগ্রামের পাণ্ডুলিপি যখন মাঝামাঝি তখন থেকেই সিদ্ধান্তটা পাকা ছিল।  আমার মতো অচেনা লেখকের বই কে প্রকাশ করবে নিজের গরজে এবং নিজের খরচে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনো। বই লিখে আয় করা তো সুদূর স্বপ্ন। ২০২০ সালের শেষদিকে বই প্রকাশ চুড়ান্ত হবার প্রাক্কালেও আমি পূর্বস্বরের মইনুল ভাইকে বলছিলাম, আপনি খামাকা এতগুলো টাকা বিনিয়োগ করছেন। দশটা বইও বিক্রি হবে না। তিনি আত্মবিশ্বাস নিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন, এই বইটা বিক্রি হতে দশ বছর লেগে গেলে আমার ক্ষতি নেই। আমি একটা ভালো কাজ করতে চাই। সেই বই ২০২১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে প্রকাশ হবার চার মাসের মধ্যে যখন প্রথম সংস্করণ শেষের দিকে শুনলাম, তখন সত্যি বিস্মিত হবার পালা। তখন করোনার সময়, বইয়ের দোকান সব বন্ধ। অনলাইনেই কেনাবেচা। প্রচ্ছদ দেখেই এত বই কিনলো? লেখক হিসেবে আমার নামটা তো পরিচিত নয়। এটাকে ভাগ্য বলছি আমি। মাঝে দুবছর কোনো বই প্রকাশ হয়নি। কিন্তু বেশ কয়েকজন নামকরা প্রকাশক যোগাযোগ করে পাণ্ডুলিপি চাইতে শুরু করেছেন। অগ্রিম রয়েলটিও অফার করছেন। এগুলো সত্যি অভাবিত।  ২০২৪ সালে বাতিঘর ও কথাপ্রকাশ থেকে আরো দুটো বই প্রকাশ হলো। ভেবেছিলাম এগুলো তেমন বাজার পাবে না। প্রথমটা কোনো কারণে প্রচ্ছদ দেখে কিনে ফেলেছে। কিন্তু বইমেলার শেষ সপ্তাহে প্রকাশ হবার পর দুই প্রকাশনীতেই দুটো বই বেস্টসেলার তালিকায় উঠে গেল। যার মধ্যে কথাপ্রকাশের বইটা এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় মুদ্রন আনতে হলো। বাতিঘরের বইটা মুদ্রনের অর্ধেক শেষ একসপ্তাহেই। অচেনা অজানা পাঠকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা এবং রিভিউর কথা বলতেও সংকোচ হয়। পাঠকের বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গবেষক এমনকি ভিসিও আছেন। বই প্রকাশের এমন অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে সুখকর।

এই তিনটা বইয়ের মাধ্যমে পাঠকের যে ভালোবাসা পেয়েছি তা এক জীবনের জন্য যথেষ্ট। জীবনে আর লেখালেখি না করলেও কোনো অতৃপ্তি থাকবে না। তবু এখনো লিখছি। কারণ লেখালেখি একটা নেশা। লিখলেও সবটুকু প্রকাশযোগ্য মনে করি না। আমি গত দশ বছরে যে পরিমাণ লিখেছি তার ১০ভাগও প্রকাশ করিনি। অধিকাংশ লেখাই অপ্রকাশিত থেকে যাবে। আমি নিজের আনন্দের জন্য যা লিখেছি তার সবটা পাঠকের ঘাড়ে চাপানোর কোনো মানে হয় না। আমার হাতে অন্তত ৬জন আগ্রহী প্রকাশক আছে, যার মধ্যে চারজনই দেশের শীর্ষ প্রকাশক। এখন  চাইলে আমি যে কোনো পাণ্ডুলিপি তাদের দিতে পারি। কিন্তু সেটা করছি না। দুটোর বেশি পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করতে চাই না। ২০২৫ সালের বইমেলার জন্য দুই প্রকাশক ইতোমধ্যে পাণ্ডুলিপি নিয়েছে। সেই বইগুলো পাঠক কিভাবে নেবে জানি না। যদি পাঠক বিমুখ হয়, প্রকাশকের মুখও বেজার থাকবে। তখন লেখককে ভাবতে হবে, পরের পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করবে কিনা। অর্ধসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিগুলো শেষ করবে কিনা। বুঝতে হবে লেখকের অবসর নেবার সময় হয়ে গেছে।  প্রকাশনা জগত থেকে সরে গিয়ে শুধু নিজের জন্য লেখালেখি করতে পারেন। বড়জোর ইবুক প্রকাশ করে বিনামূল্যে বিতরণ করতে পারেন। লেখকের অবসর বিষয়ে একটা দরকারী কথা। লেখকের অবসর দুরকম। একটা হলো পাঠকের কাছ থেকে অবসর নেয়া, আরেকটা হলো নিজের কাছ থেকে অবসর নেয়া। বই প্রকাশ না করলে পাঠকের কাছ থেকে অবসর নেয়া হয়ে গেল। কিন্তু নিজের আনন্দের জন্য যতদিন লিখতে ইচ্ছা করে ততদিন লিখতে পারেন। সেগুলো প্রকাশ না করলে এমন কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। আমার নিজের কাছে যখন মনে হবে আমি পাঠকের জন্য নতুন কিছু দিতে পারছি না, তখনই থামিয়ে দেবো লেখা।



Wednesday, April 10, 2024

ঈদসংখ্যার পাঠক প্রতিক্রিয়া

গত পাঁচ বছর ধরে শুধু সিল্করুটের সংখ্যায় লিখতাম। এই প্রথম একাধিক ঈদ সংখ্যায় লিখেছি। চারটি ঈদ সংখ্যায় লেখা একটু বাড়াবাড়ি। কিন্তু সম্ভব হয়েছে আগে থেকেই তৈরি লেখা ছিল বলে। সম্পাদকগণ অনুরোধ করেছে বলে নয়। ঈদ সংখ্যায় আমি কখনো ফরমায়েশি লেখা লিখিনি। চারটির মধ্যে তিনটি লেখাই অপ্রত্যাশিত পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তার মধ্যে দুটো এখানে তুলে রাখলাম।


১.

প্রথম আলো : ''রাজকীয় জলদস্যুর দল : সম্রাট আকবর, রানী এলিজাবেথ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম''

এবারের ঈদসংখ্যাগুলোর লেখার মধ্যে সর্বশেষ পড়লাম 'দৈনিক প্রথম আলো'য় প্রকাশিত হারুন রশীদের ''রাজকীয় জলদস্যুর দল : সম্রাট আকবর, রানী এলিজাবেথ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম'' লেখাটি। এক কথায় প্রতিক্রিয়া হলো - লেখাটি অসাধারণ। বিষয় নির্বাচন, তথ্যসন্নিবেশ, বিশ্লেষণ আর শাণিত গদ্যে উপস্থাপন - সবমিলিয়ে অনন্য এ লেখাটি পড়ে আমি মুগ্ধ। কীভাবে রানী এলিজাবেথের উত্থান হলো, তাঁর শৈশব-কৈশোর জীবনের ট্র্যাজেডি, দুঃখ-কষ্ট, সিংহাসনে আরোহণ, সাম্রাজ্যবিস্তার পরিকল্পনা,দস্যুতা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন, সম্রাট আকবরের কাছে পত্রপ্রেরণ ও ভারতসহ দুনিয়ার নানাস্থানে ব্রিটিশদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ; এসবের এমন চমকপূর্ণ ও তথ্যনিষ্ঠ বয়ান এর আগে কোথাও পড়িনি। লেখা পড়ে মুগ্ধতার বার্তা জানান দিতে রাতেই লেখকের সন্ধান করে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম।

ড. এম.আবদুল আলীম
ইতিহাসবিদ, গবেষক
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা।

২.
সিল্করুট ঈদসংখ্যা: আমার 'শেখ দীন মোহামেদ' আবিষ্কার

ইতিহাসে আমার আগ্রহ সমকালীন সময়ে যারা উস্কে দিয়েছেন তাদের মধ্যে Haroon Rashid ভাইয়ের নাম অগ্রগণ্য। প্রতি ইদে নানান ইদসংখ্যা কেনা হয় --- সিল্করুট গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত কিনি। এবারে সিল্করুটের বাড়তি আকর্ষণ হারুন ভাই আর Shuhan Rizwan এর লেখা।
আজ পড়লাম হারুন ভাইয়ের ' আমার 'শেখ দীন মোহামেদ' আবিষ্কার' প্রবন্ধটি। প্রায় আড়াইশ বছর আগের কাহিনি। পলাশীর যুদ্ধের দুই বছর পরে জন্ম নেওয়া এক বাঙালি কিভাবে তার উচ্চাকাঙ্খা আর দুরন্ত সাহসে ভর করে এক সাহেবের সঙ্গে করে বিলেতে পাড়ি জমায়, সেখানে সংসার পাতে, ব্যবসায় উন্নতি করে --- সর্বোপরি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংরেজিতে তার আত্মকাহিনী প্রকাশ করে তার রোমাঞ্চকর বর্ণনা আছে এই লেখাতে। পাটনা থেকে আয়ারল্যান্ড, তারপর সেখান থেকে ব্রাইটন --- পৃথিবীর এ প্রান্তে জন্ম নিয়ে অন্য প্রান্তে যখন এই বাঙালি তার জীবনের অধ্যায় সমাপ্ত করেছেন ততদিনে তিনি হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টা এবং সঙ্গত কারণেই, বিখ্যাত জন।
হারুন ভাইয়ের লেখা নির্মেদ, নির্ভার। তার লেখায় ইতিহাস স্পর্শ করে সাহিত্যের মর্যাদা।
তার আরও অনেক লেখা পড়ার আশায় রইলাম।
আনন্দম!

ড. তারেক আজিজ 
বিজ্ঞানী ও গবেষক

Wednesday, April 3, 2024

বই প্রকাশনার বাস্তবতা: এক প্রকাশকের অভিজ্ঞতা

 সুমেরু মুখোপাধ্যায়:

বছর কুড়ি হল বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ই একটি পত্রিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হই, পরের বছরই সমস্ত দায়িত্ব হুড়মুড় করে ঘাড়ের উপর এসে পড়ে। সেসব ধরলে আরও পাঁচ বছর। ট্রেডল প্রেসে ছাপা হত, গালি প্রুফ ছিঁড়ে পাতা ডামি বানানো শেখাতেন কলেজস্কোরারের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় শ্রীকৃষ্ণগোপাল মল্লিক। প্রতিষ্ঠানিক ক্লাসে সেসব শিখিনি। তিনশো কপি ছাপা হত সে পত্রিকা যার বেশির ভাগ কপি পাঠাতে হত বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। পাতিরাম, শিয়ালদা, সুবর্ণরেখা শান্তিনিকেতনে কিছু কপি রাখা থাকত, যার টাকা কখনই পেতাম না আর। কপি যেত অধিকাংশই সৌজন্য হিসাবে, বিক্রি করে টাকা ঘরে আসত না। হিসাবপত্তর সেভাবে করাও হয়নি, সেসব মিশে যেত নানা হইচইতে। তবে বান্ডিল বান্ডিল পত্রিকার কপি পড়ে থাকত পত্রিকা অফিসের বাংকারে। সে বাংকারে হাত পড়ত পরবর্তী সংখ্যার প্রস্তূতিতে। ২০০৯-১০ আমার ঢাকা প্রবাসে বাংলাদেশের প্রকাশনার সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়ি, তার আগে এসে গেছে গুচ। লেখার থেকে নাচানাচি কাঁপাকাপি বেশি হচ্ছে। কাজ ভাগাভাগি, দেশে বিদেশে মেল চেনে ঝগড়াঝাঁটি আহ্লাদ, সবই এখন কম্পিউটারে। প্রথম থেকেই ঠিক ছিল দাম রাখা হবে তুমুল সিজিনের বাঁধাপকপির থেকেও কম। সবাই ঘরে ঘরে পড়বে আর ডাকবে, হাম্বা-হাম্বা বলে। তখনও দিদির হরেকরকম্বার আবিষ্কার হয়নি। প্রথম চারটি চটি ছাপা হল ৫০০ কপি করে।
৯ঋকাল বুকস করতে এসে জানতাম তিনশো কপি তো বেচে দিতে পারব। প্রিন্ট অর্ডার ৫৫০ দেখে প্রেসের শান্তনুবাবু কিন্তু কিন্তু করলেন অনেকবার, সরাসরি কিছু বললেন না ছাপলেন একটু কমিয়ে ৩৫০ করে। প্রথম দুটি বই ৫৫০ করেই ছাপা হয়ে গিয়েছিল। যার একটি বই আজও শেষ হয়নি আট বছরে। আরও বলা ভাল তার অর্ধেক শেষ হয়েছে সবে। ঠেকে শিখি। সিটিপিতে ছাপা, কাগজের দাম, কাপড় দিয়ে বোর্ড বাঁধাই সবই বেড়েছে কয়েক বছরে। এসেছে ডিজিটাল বলে এক মারণ রোগ। যাতে ১০/২০ কপিও ছেপে ফেলে হাত ঝেড়ে ফেলা যায়। আমাদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৪০ ছুঁইছুঁই। আপ্রাণ চেষ্টা করছি বইয়ের সংখ্যা কমানোর। অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয় বই বলে মনে হলে এগোই না আর। নতুনদের বই করার জন্য অনেক প্রকাশনা এসেছেন। তাঁরা অনেক শর্টকার্ট জানেন। অধিকাংশ স্বপ্ন দেখেন বয়ই বেচে বড় হবেন, বদলে দেবেন সব। দুরন্ত পি আর। রেগুলার ফিডে থাকার মতো মমতাশংকর বা প্রামাণিক চাই। আসলে টোপ চাই, শাঁসালো লেখক চাই কারণ একমাত্র তেলেই মাছ ভাজা যায়। তার পরে বায়নাক্কা কম থাকে। কেউ কেউ সোসাল মিডিয়ায় খুব পপুলার। পোস্ট দেওয়ার আগেই ভক্তেরা লাইক, লাভ দেওয়ার স্যাডো প্রাকটিশ করেন। বই বার হলে একশো কপি ফুস করে ( হ্যাঁ দুই তিন দিনে) বিক্রিও হয়ে যায়, পরের একশো কপি যদিও পরবর্তী দুই তিন বছরেও বিক্রি হয় না। একশো কপি কী অনেক বেশি? এঁদের বই তখন অনেক প্রকাশকই করতে চান নিজের খরচায়। পরের বই ৮০% ক্ষেত্রে ৫০ কপিও বিক্রি হয় না। এঁদের বেশিরভাগ ওয়ান টাইম ওয়ান্ডার হিসাবে থেকে যাচ্ছেন বাংলা প্রকাশনায়।
প্রচুর ত্যানা পেঁচিয়েছি। আমি কলকাতার সহযোগী প্রকাশক / লেখক বন্ধুদের থেকে জানতে চাই, এখন খুব বেশি বিক্রি বলতে কত বোঝেন? সংস্করণ বলে এখন কিছু বেঁচে নেই। সবাই তুমুল সংস্কার করে ফেলেছি সব। তন্ত্র, মন্ত্র, ভুত, গোয়েন্দা, এগুলি নাকি ভাল বিকোয়। সেসব নিয়ে আমি জানি না, আলোচনায় আনবেন না। কলেজস্ট্রিটে আর একটা শব্দ খুব কার্যকরী 'মরা লেখক'। আমি ব্যাখ্যা করলাম না। বাংলাদেশের রয়্যালটির চেকের ছবি অনেকের মনোবিকারের কারণ হতে পারে, কিন্তু বাস্তব তো কঠিন। নিজেকে আনিসুল হক, নজিম উদ্দিন, সুমন্ত আসলাম ভাববেন না। আপনার বই আপনি নিজে বিপণন না করলে (না কিনে নিলে) সারা বছরে ৫০ কপিও বিক্রি করা শক্ত। তাকে মেনে নিতে হবে।

[সূত্র: লেখকের ফেসবুক পোস্ট, ৩ এপ্রিল ২০২৪]