নতুন শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে যারা মতামত দিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই এই বিষয়ে অনেকাংশে অজ্ঞ। অর্থাৎ পক্ষ বা বিপক্ষে যারা লিখছে তাদের কারোরই ব্যাপারটা নিয়ে পুরো ধারণা নেই। তাই ব্যাপারটা অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো হয়ে যাচ্ছে। এমনকি সরকারের মন্ত্রীদেরও বিষয়টা নিয়ে পুরো ধারণা নাই। থাকলে একপেশে কথাবার্তা বলতে পারতো না।
আমি বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় সেই কয়েকজন অভিভাবকদের একজন যারা গত বছর থেকে পাইলট প্রকল্প নিয়ে সরকারের এই নতুন শিক্ষাপদ্ধতির ভুক্তভোগী। আমার পুত্র গত বছর পাইলট প্রকল্পে গিনিপিগ ছিল।
তখন থেকে তার সমস্ত পড়াশোনা বদলে গেছে। সে এখন বই পড়ার সময় পায় না। অংক করার সময় পায় না। ইংরেজি শেখার সময় পায় না। তাকে সবগুলো বিষয় পড়তে হয় কাগজ কেটে কেটে। খাতা কলমের বদলে তাকে আমার কিনে দিতে হয় কাঁচি, আর্টপেপার, চার্টপেপার, গাম, রঙপেন্সিল ইত্যাদি। সে বীজগণিতের সূত্র লেখে কাগজ কেটে। তাকে কবিতার লাইন লিখতে হয় কাগজ কেটে বোর্ডে সাঁটিয়ে, তাকে বিজ্ঞান পড়তে হয় সেও কাগজ কেটে, গাম দিয়ে রঙিন বোর্ডে লাগিয়ে। এগুলো করতে যে পরিমান খরচ হয় সেটার কথা বাদই দিলাম, কিন্তু প্রতিদিন রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত সে ঘুমাতে যেতে পারে না এসব করতে গিয়ে। আমি অসহায় হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি সে গলদঘর্ম হয়ে এসব করছে। শুধু কী ছাত্র, ছাত্রের মা বাবা দাদা দাদী সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হয় এসব সামলাতে গিয়ে। আমি সেদিন দেখলাম সে কান্না করে দেবার অবস্থা হয়েছে। তাকে হোমওয়ার্ক দেয়া হয়েছে একটা ফসিল তৈরি করতে। তাকে নরম কাদা যোগাড় করতে হবে, গাছের পাতা এনে সেই কাদায় চুবিয়ে রাখতে হবে কয়েকদিন, তারপর সেটা শুকিয়ে ভেতরে যে ছাপ পড়বে, সেটা একটা ফসিলের চেহারা নেবে। তারপর কাদা সহ সেই ফসিল স্কুলে নিতে হবে। আমি ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। বাড়ির কাজ এমন হতে পারে। তখন সে বই খুলে দেখালো বাড়ির কাজ। এখন একটা ফসিল কিভাবে তৈরি হয় সেটা শেখানোর জন্য ঘরে ঘরে যদি কয়েক কোটি ফসিল তৈরির কারখানা করা হয় সেটা কী একটা সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা? এরকম অসংখ্য পাগলামি উদাহরণ আছে।
সে কারণে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি যার বাচ্চা এই শিক্ষাপদ্ধতির শিকার তারা কেউ এটার পক্ষে কথা বলবে না। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টা পুরোপুরি জানলে এটা এখনই বাতিল করবেন। বাংলাদেশে এত বড় পাগলামি শিক্ষা ব্যবস্থা আর কখনো আসেনি।
বলে রাখি, আমার পুত্র যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলটা একটা বিশেষায়িত স্কুল। সেখানে এসব নিয়ে শিক্ষা দেবার মতো যথেষ্ট অবকাঠামো আছে। তাদের বেশ কয়েকজন শিক্ষক গত বছর থেকে পাইলট প্রকল্পটির প্রশিক্ষক ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অবকাঠামো খুব কম স্কুলেই আছে। তাই এরকম পদ্ধতি অধিকাংশ স্কুলে জোড়াতালি দিয়ে চলবে। কিছুই দাড়াবে না শেষমেষ। আমার বাচ্চার স্কুলে অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও আমি এই পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী। শুরুতে আমিও বইগুলো দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলাম। এত সুন্দর বই আগে দেখিনি এদেশে। কিন্তু যখন তার প্রয়োগ শুরু হলো তখন আমার মাথায় বাজ পড়লো। আমি নিশ্চিত যে কোন অভিভাবকেরই এই অবস্থা হবে।
আসলে সময় তো এদেশে সস্তা। সে কারণেই এত নিরীক্ষা চলছে বছরের পর বছর। সারা পৃথিবীতে হাইস্কুল লেভেলে পড়াশোনার যে চাপ যেখানে গণিত বিজ্ঞানের মতো বিষয় শিখতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা হিমশিম খায়, সেখানে আমাদের দেশে এসব খেলো নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। এই ধরণের শিক্ষাগুলো কিণ্ডারগার্টেন লেভেলের বাচ্চাদের জন্য দেয়া হয় উন্নত বিশ্বে। আমাদের দেশে সেগুলো নিয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে হাইস্কুলে।
নতুন শিক্ষাপদ্ধতির আরেকটা উদাহরণ দেই। কাগজ কিভাবে আবিষ্কার হয়েছে সেটা বোঝাতে গিয়ে বাচ্চাদের বলা হয়েছে ঘরে বসে পুরোনো বইপত্র ছিড়ে সেই কাগজ ভিজিয়ে মণ্ড তৈরি করে কাগজ বানিয়ে নিয়ে যেতে। সেই কাগজে আবার গাছের বীজও বুনে দিতে বলা হয়েছে। যেন কাগজ নষ্ট হয়ে গেলে সেটা ফেলে দিলে সেখান থেকে গাছ ওঠে। পৃথিবীটা নাকি এভাবে সবুজ হয়ে যাবে, পরিবেশ রক্ষা পাবে। পরিবেশ বাঁচানোর সেই হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে আমার বাসায় তিনদিন ধরে কত কী কাণ্ড হয়েছে সেটা বলতেও ক্লান্ত বোধ করছি। এরকম একটা নতুন পদ্ধতির বাচ্চা যে বাসায় আছে সে বাসার অর্ধেক সদস্য পাগল হয়ে যাবে।