Wednesday, April 29, 2020

মানুষের অভয়ারণ্য নেই

পৃথিবীতে বিদ্যমান রাজ্য সীমান্তগুলো অদ্ভুত। অস্ত্রশক্তি আর রাজনৈতিক কুটকৌশলের খেলার মাধ্যমে জন্ম হওয়া রাষ্ট্রগুলো বর্তমান সময়ে সভ্য বলে স্বীকৃত হলেও জাতিসত্ত্বাসমূহের বিবেচনায় চরম অবিবেচক একটা সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর অল্প কিছু রাষ্ট্র বাদে বৃহৎ সব শক্তির মানচিত্রই অসভ্য। অসভ্য মানচিত্র ছিঁড়ে কিছু দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও এখনো অসংখ্য পরাধীন জাতি এসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে পিষ্ট হচ্ছে সভ্যতার ছাদের নীচে।

কাছের দেশ হিসেবে সবার আগে ভারতের উদাহরণ দেই। ভারতের ভেতরে স্বাধীনতা পাওয়া যোগ্য রাজ্যের সংখ্যা কয়টি? মোটা দাগে বলতে গেলে ভারতের ভেতরে কমপক্ষে দশটি ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র উপযোগী রাজ্য আছে। ভারতের সংস্কৃতি ধারণ করে না তেমন জাতিগুলোকে জোর করে ভারতের ভেতরে বেঁধে রাখা হয়েছে। হিমালয় অধ্যুষিত এলাকার একটা জাতিও ভারতীয় নয়। বৃটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে মালিকানা না পেলে সেই রাজ্যগুলো কখনোই ভারতের অংশ হতো না। নেপাল ভূটান যে কারণে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, একই কারণে ভারতের ভেতরের সেই রাজ্যগুলোর অধিকার ছিল স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকা। কিন্তু অসভ্য রাজনীতির কুটনৈতিক চালের কারণে তা হয়নি। অসভ্য রাজনীতি পৈত্রিক উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া সম্পদের মতো রাজ্যগুলোকে ভোগ দখল করছে। রাজ্যগুলোকে যদি জনমত যাচাই করা হয় তবে নিশ্চয়ই তারা স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকতে চাইবে। কোন কোন রাজ্যে এসব নিয়ে অস্থিরতাও আছে। অরুনাচল থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত সমগ্র উত্তরাঞ্চলে একই চিত্রে। পূর্ব দিকে মনিপুর মেগালয় মিজোরাম নাগাল্যাণ্ডের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতের সঙ্গে এই রাজ্যগুলো নিতান্ত বাধ্য হয়ে যুক্ত আছে। দুশো বছর পর হয়তো এরা আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হবে। দুশো বছর আগে পৃথিবীর যেসব জাতি পরাধীন ছিল, তাদের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। একইভাবে তিব্বত চীনের অংশ হতে পারে না। পারে না জিনজিয়াং নামের উইঘুরদের দেশটাও। চীনের ভেতরে লুকিয়ে আছে এরকম অন্ততঃ আরো ডজনখানেক আলাদা জাতি। সোভিয়েত রাশিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া রাষ্ট্রগুলো আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। স্বাধীন রাষ্ট্র হবার যোগ্যতা সম্পন্ন জাতির সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেশে দেশে তাদের অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে। সবগুলো জাতি যদি যদি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতো পৃথিবীতে স্বাধীন দেশের সংখ্যা পাঁচশো ছাড়িয়ে যেতো।

জগতের শক্তিমানেরা পৃথিবীর একশোভাগ ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে। এক ইঞ্চি মুক্ত জায়গা নেই কোথাও। সব মানুষকে কোন না কোন রাষ্ট্রে অধীনস্থ করা হয়েছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। পৃথিবীতে এমন অনেক আদিবাসী আছে তারা জানেও না কে তাদেরকে শাসন করছে। হয়তো শাসন করছে এমন কেউ যাদের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। হয়তো সেই জাতি উপজাতিগুলোর রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, পতাকা, মানচিত্র এসবের কোন প্রয়োজন নেই। তবু সভ্যতার দোহাই দিয়ে তাদেরকে কোন না কোন রাষ্ট্র খোপে প্রবেশ করানো হয়েছে। মানুষ আধুনিক বলে বিবেচিত হবার পর থেকে এসব রাষ্ট্র সীমানার জন্ম। অথচ এসব সীমানার প্রশ্ন যখন ছিল না তখনও তাদের অস্তিত্ব ছিল। সীমান্ত থাকা না থাকায় তাদের কিছু এসে যায় না। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সীমান্ত নেই। আদিযুগে হাজার হাজার বছর ধরে মানবজাতি এসব ছাড়াই পৃথিবীতে বেঁচে ছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এখন চাইলেই রাষ্ট্রবিহীন থাকতে পারবে না কোন জাতি। তাদেরকে কোন না কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকতেই হবে।

কিন্তু সব মানুষকে কেন বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রের অধীনে থাকতে হবে? মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী এই আইনের আওতায় নেই। একটা পিঁপড়া কিংবা কাক কিংবা কুকুর বেড়ালকে নাগরিকত্ব নিয়ে কোন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। অথচ মানুষকে নিরন্তর এই যন্ত্রনা পোহাতে হয়।

পৃথিবীতে কিছু মুক্ত দেশ থাকা দরকার ছিল। যেখানে কোন রাজা থাকবে না, রাজনীতি থাকবে না, পাসপোর্ট থাকবে না, মানচিত্র থাকবে না, পতাকা থাকবে না। শুধু মানুষ থাকবে। স্বাধীন মানুষ। যে মানুষেরা স্বাধীনভাবে তাদের আদিম জীবনযাত্রা বজায় রাখতে পারবে। যে মানুষকে জোর করে আধুনিক সভ্যতার দীক্ষা গ্রহন করতে হবে না। যে মানুষকে অন্যের বানানো স্বর্গে সুখী হবার ভাণ করতে হবে না। যে মানুষ নিজস্ব আলয়ে একটি স্বাধীন বন্য প্রাণীর জীবন যাপন করবে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোন দেশ কোথাও নেই। পৃথিবীতে আর কোন জঙ্গল, পর্বতমালা কিংবা দ্বীপ নেই যেখানে সভ্যতার কদর্য পদক্ষেপ পড়েনি।

আধুনিক মানুষের বানানো সভ্যতার সংজ্ঞায় মানুষদের জন্য প্রকৃতির দেয়া স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করার স্বাধীন কোন অঞ্চল না থাকা বড় রকমের মানবাধিকার লংঘন। এই মানবাধিকার লংঘনের কথা কেউ বলে না। অথচ প্রকৃত স্বাধীনতা হলো প্রকৃতির সন্তান হিসেবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকার। পৃথিবীতে অন্য প্রাণীদের জন্য ছোটখাট অভয়ারণ্য থাকলেও মানুষের জন্য কোন অভয়ারণ্য নেই। মানুষ সারা পৃথিবীতেই সীমান্ত  রাজনীতির শিকার।


আধুনিক মানুষের রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এই সভ্যতার যাত্রা শুরু মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে। এটা হয়তো আর এক হাজার বছরও টিকবে না। টিকলে কী হবে কল্পনায় আসে না। তিনশো বছর আগে মানুষ প্রযুক্তির যে পর্যায়ে ছিল তাতে করে মানবজাতি আরো দশ হাজার বছর টিকতে পারতো। কিন্তু গত একশো বছরে মানুষ যেসব প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে তাতে স্বজাতিকে ধ্বংস করার মতো যথেষ্ট অস্ত্র মজুদ হয়ে গেছে, স্বজাতিকে চরম ঘেন্না করার নানান বিভক্তিও তৈরী হয়ে গেছে। এই মানসিকতার বহুধাবিভক্ত মানব জাতি আর এক হাজার বছর দূরে থাক দুশো বছর টিকবে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।

মৌলিক চাহিদা এবং মানুষ

প্রত্যেকটা মানুষের কয়েকটা মৌলিক অবস্থান/চাহিদা আছে
শারিরীক (সুস্থতার) অবস্থান/শারিরীক চাহিদা=২৫
মানসিক (সুস্থতার) অবস্থান/মানসিক চাহিদা=২৫
আর্থিক (স্বচ্ছলতার) অবস্থান/চাহিদা=২৫
সামাজিক অবস্থান/চাহিদা=২৫
মোট নাম্বার=১০০
ক=৮০+ (-ক মাইনাস যদি ১টি  বিষয়ে ফেল থাকে)
খ=৬০+  (-খ মাইনাস যদি ২টি  বিষয়ে ফেল থাকে)
গ=৪০+  (-গ মাইনাস যদি ৩টি  বিষয়ে ফেল থাকে)

অন্য যে কোন প্রাণীর চেয়ে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা ভিন্নতা দিয়েছে এই কয়েকটি বিষয়ের যোগফল। যদি মোট মানকে ১০০ ধরা হয় তাহলে এই প্রতিটি উপদানের মান ২৫। কোন মানুষই ১০০/১০০ পায় না। কোথাও না কোথাও তার ঘাটতি থাকেই। এখন যদি পাশ মার্ক ৪০ ধরি তাহলে প্রতিটি বিষয়ে তাকে ১০ করে পেতে হবে। ১০ এর কম পেলে সে ওই বিষয়ে ফেল। আবার অন্য বিষয়ে বেশী পেয়ে মোট ফলাফল ৪০ হতে পারে। সেক্ষেত্রে সে পাশ করলেও তাকে সুখী বলা যাবে না। মানুষের জীবনটা এরকম গড়পড়তা নাম্বার দিয়ে বিচার করা যায়।

আমাদের চারপাশের মানুষদের বিচার করলে দেখা যায় কেউ ক পেয়েও সুখী না, আবার কেউ গ পেয়েও সুখী। যারা মাইনাস তারা মোটের উপর অসুখী। কারো টাকা আছে সুস্থতা নেই, সুস্থতা আছে টাকা নেই। টাকা সুস্থতা আছে মানসিক শান্তিতে নেই। এরকম নানান ঘাটতিময় জীবন আমাদের।

আপনি নিজের ফলাফল নিজেই নির্ণয় করে দেখতে পারেন। আমি নিজেকে খ লেভেলে দেখতে পাই।

১৫ মার্চ ২০২০ 

অন্য প্রাণীর মানুষ ভাবনা

১.
বিশ্বজুড়ে মানবজাতি কান্নাকাটি করছে। তাদের বিরাট সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। সর্বশক্তিমানের কাছে করুণাভিক্ষা করছে। খুব স্বাভাবিক। সবাই নিজ নিজ প্রাণ রক্ষায় নিশ্চয়ই আকুল হবে। কিন্তু মানবজাতির এই দুর্দশায় অন্য প্রাণীগুলো কী ভাবছে? তারা কী বুঝতে পারছে মানুষ প্রাণীটা হঠাৎ করে অন্যরকম আচরণ করছে কেন? এটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে মানুষের গতিবিধি নড়াচড়ার ধরণ বদলে গেছে মাসখানেক ধরে। গতিবিধির পরিবর্তন ছাড়া অন্য প্রাণীরা মানবজাতির এই দুর্দশা সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারছে না। মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী তো লিখতে পড়তে শেখেনি। বনের পশুপাখিরা যদি পড়াশোনা জানতো আমেরিকা হয়তো এই সংকট উত্তরণের ভ্যাকসিনের জন্য চীনের দিকে তাকিয়ে না থেকে আফ্রিকার জঙ্গলে বিজ্ঞানীদের মিশন পাঠাতো। 

২.
মানুষ জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে দাবী করে। কিন্তু সেই জগতের আকার কতখানি মানুষ সেটাও জানে না। অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও জানে না আমাদের গ্যালাক্সিতে পৃথিবীটা করোনা ভাইরাসের চেয়েও ক্ষুদ্র। তবু যুগে যুগে চেঙ্গিজ, হালাকু, হিটলার, ট্রাম্পের মতো হাজারো নির্বোধ শক্তিমানেরা ইতিহাসের ক্ষুদ্র অংশ দুষিত করে যায় শ্রেষ্ঠত্বের নামে।

৩.
জীবনের উদ্দেশ্য কী? আমরা কেবল ভাববো অন্য প্রাণীরা জন্মেছে মানুষের সেবার জন্য আর মানুষ জন্মেছে তাদের খতম করার জন্য। অন্য প্রাণীদের উপর খবরদারী শেষে নিজেদের মধ্যে বিভেদের বেড়াজাল তৈরী করে পৃথিবীর সুস্থ বায়ুকে অসুস্থ করে তুলবো।

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে অন্য সকল প্রাণীর প্রবৃত্তির শিক্ষায় জানে, পৃথিবীতে দুপেয়ে একটা প্রাণী আছে। তাদের হাতে থাকে বাড়তি অস্ত্র। তারা যখন তখন কারণ অকারণে আক্রমণ করতে পারে। তাদের দেখামাত্র পালাবার নির্দেশ আছে প্রবৃত্তির কাছ থেকে। মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী নিজের দাঁত নখের বাইরে কোন অস্ত্র ব্যবহার শেখেনি এখনো। তাই মানুষের কাছ থেকে সাবধানে থাকে সব প্রাণী। শক্তি সুযোগ থাকলেও পরিকল্পিতভাবে মানব সমাজের উপর আক্রমণ করে না কখনোই। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া মানুষের কেশও স্পর্শ করে না কোন প্রাণী। কিন্তু অতি ক্ষুদে জীবানুরা মানুষকে নিয়ে কোন ভাবনা চিন্তা করে না। মানুষ যে এমন শ্রেষ্ঠ একটা জীব সেটাও তারা জানে না এবং তারা মানুষের বড় অস্ত্রের আঘাতে মরে না।  তাই সুযোগ পেলে তারা মানুষের শরীরকে নিজেদের কলোনী বানিয়ে বংশবিস্তার করার চেষ্টা করে। 

এপ্রিল ১৯, ২০২০

বোধ

এই গ্রহের মানবজাতির সব সদস্য দুই লাখ বছর আগের এক আফ্রিকান আদি মাতার সন্তান।  মাইটোকণ্ড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গবেষকদের এই তথ্যটি বেশ পুরোনো হলেও আমি জেনেছি মাত্র পরশুদিন। জানার পর থেকেই ভাবছি এই পৃথিবীর ভুগোল খামচে রক্তাক্ত করা রাজনীতিবিদরা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, সাদা, কালো, লাল, হলুদ, গেরুয়া, দাড়িয়াল, ছাগিয়াল কত রকমের বিশ্ব তৈরী করে মানবজাতিকে বিভক্ত করে যাচ্ছে শত শত বছর ধরে। করোনা ভাইরাস কী তাদের কান বরাবর চপোটাঘাত করে মনে করিয়ে দিল তোরা সব এক নগণ্য হোমো স্যাপিয়েন্সের বংশধর?


করোনা

না, এখনো নাকি মূলপর্ব শুরুই করোনি?

কত চাও?

আক্রান্ত ১০ কোটি, মৃত্যু ৫০ লাখ, সন্তুষ্ট তুমি? 
নাকি আক্রান্ত ১০০ কোটি, মৃত্যু ৫কোটি? 

কোনটা চাও? 

তৃতীয় বিশ্বের উষ্ণমণ্ডলে এসো তাহলে। 
পরিসংখ্যানের বাইরে প্রস্তুত হচ্ছে নীরব ঘাতক
ঘন্টা বাজিয়ে সস্তার লাশ নিয়ে যাও পৃথিবীর গহ্বরে।

প্রথম বিশ্বে লাখো মৃত্যুর হাহাকার বেজে যাচ্ছে।
কত মরবে তৃতীয় বিশ্বে এখনো কেউ জানে না। 

যারা বেঁচে থাকবে, তারা মরবে অনাহারে দুর্ভিক্ষে। 
২০২২ সাল দেখার জন্য অনেকে বেঁচে থাকবে না।