Tuesday, January 31, 2017

ব্রাজিলের সিনেমা Latitudes: পথে হলো দেখা

একই দেশের দুজন মানুষ। রাশির ফেরে দেখা হয়ে গেল তৃতীয় কোন এক দেশে- পেশাগত ভ্রমণে। মেয়েটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের সম্পাদক, পুরুষটি পেশাদার ফটোগ্রাফার। নানান দেশে কাজ দুজনের। ছুটন্ত জীবন দুজনের। আকাশ থেকে আকাশ পথে। তার মাঝেই দেখা হয়ে যাচ্ছে কখনো কখনো। কখনো ব্রাজিল, কখনো আর্জেন্টিনা, কখনো ভেনিস, কখনো লণ্ডন, কখনো ইস্তাম্বুল। রাত ফুরোবার আগেই ভিন্ন গন্তব্যে ছুটতে হয় দুজনকে। দেখা হলেও নাম আর পেশা বাদে আর কোন পরিচয় জানা হয় না। যেটুকু ঘনিষ্টতা তাতে কোন মাত্রা নেই। বন্ধুতা বা সম্পর্ক নিয়ে কারো ভাবনা আসে না। দুজনের আছে আলাদা নিজস্ব জীবন, সে জীবনের কোন গল্প আসে না। কিন্তু কথায় কথায় জীবনের দর্শন আসে, আনমনা বোধ জাগে। উদাসী মন তখন কিছু বোঝে না, জীবনের সব হিসেব মেলে না। সমীকরণ বহির্ভুত দুজন বন্ধনহীন মানুষ পৃথিবীর সব জটিলতা বাদ দিয়ে শুধু নিজেদের মতো করে গল্প বলার অবসর খুঁজে নেয় এখানে।

ছবির গল্প মাত্র দুজন মানুষে সীমাবদ্ধ। ঠিক তুলনা করা যায় না, তবে দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাবে Before Sunset কিংবা Before Sunrise এর কথা। কেননা এটিও কোনরূপ সিনেমাটিক টেনশান ছাড়া আপনমনে উপভোগ করার মতো সিনেমা।

এক্সট্রা মিনিট!

স্বপ্নটা খুব মর্মান্তিক ছিল বলা যাবে না। যদিও ঘটনাটি আমার মৃত্যুর সাথে সংশ্লিষ্ট। এবং খুব স্পষ্ট একটা স্বপ্ন। কোন এক আধুনিক হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছি। বিছানার বাম পাশে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি টিভি মনিটর ইত্যাদিতে আমার জীবন রেখার  নীলাভ ওঠানামা বহমান। বিছানার ডানপাশে বসে আছে স্ত্রীপুত্র স্বজন। আমি কথা বলছি ওদের সাথে। শেষবারের মতো সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমি না থাকলে কী কী করা লাগবে, কোথায় কী রাখা আছে, আলমারীর কোন ড্রয়ারে কী রেখেছি সবকিছু নিয়ে আলোচনা চলছে।

ওরাও কথা বলছে তো বলছেই, কী বলছে মনে পড়ছে না সব। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আমি বাম পাশের মনিটরে তাকিয়ে দেখি ওখানে জীবনরেখার ঢেউটা বদলে গিয়ে সরলরেখায় পরিণত হয়ে গেছে। মানে আমার সময় শেষ। আমি পরিবারকে ডেকে মনিটরের দিকে ইঙ্গিত করে বললাম দ্রুত কথা শেষ করতে,  আর সময় নেই। আমি এবার আল বিদা।

ওরা এবার কথা থামিয়ে মনিটরের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করলো সবাই। কিন্তু আমি তখন একটু অবাক হয়ে ভাবছি- মনিটরের জীবন রেখাটা সোজা হয়ে গেলেও আমি এখনো সবকিছু দেখছি কী করে, শুনছি কী করে? মৃত্যুযন্ত্রণা এখনো শুরু হয়নি। সেই কঠিন যন্ত্রণা পেতে আমার কেমন লাগবে? নাকি মৃত্যুটা যন্ত্রণাবিহীন হবে শেষমেষ? মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে তো কেউ ফেরত আসেনি, তাহলে কে জানে আসলে ঘটনাটা কিভাবে ঘটবে?

এসব ভাবতে ভাবতে শোকাহত পরিবারের দিকে তাকিয়ে জীবনের শেষ রসিকতাটা করেই ফেললাম, আজরাইল সাহেব মনে হয় অন্য কোথাও কাজে আটকে গেছে, এদিকে আসতে দেরী হচ্ছে। সুতরাং আমরা আরো কয়েকটা এক্সট্রা মিনিট  কথা বলে নিতে পারি।

সেই এক্সট্রা মিনিট কথা চলতে চলতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং  জানালা দিয়ে পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়ে  বুঝলাম বেঁচে আছি! ভাগ্যিস এক্সট্রা মিনিট পেয়েছিলাম!!

Wednesday, January 25, 2017

গ্লানি : ১৯৭১

কয়েক জোড়া ছুটন্ত পায়ের ছবি। চেহারা দিলাম না, দিলেও কেউ চিনবেন না। তিনটি শিশু, একজন মা। মায়ের কোলে আরেকটি শিশু, অন্যহাতে টিনের একটি বাক্স। সেই বাক্সে সর্বস্ব বলতে যা বোঝায় তা আছে কিনা জানি না। তবে ছুটন্ত দৃশ্যেই নগ্নভাবে প্রকাশিত- ওরা ওই সর্বস্ব নিয়ে আগেও সর্বহারাই ছিল।

আমি সর্বহারা নই, ওরাও আমার দলের নয়। কিন্তু সেদিন ওরা আর আমরা এক পথে ছুটতে বাধ্য হয়েছিলাম, একই গতিতে, এমনকি ওদের চেয়ে বেশী গতিতেও। কেননা হাত ধরে থাকা ওই নগ্ন শিশুগুলোর মতো আমারও প্রাণ ছিল অন্যের বন্দুকের ট্রিগারে। আমাদের সবার একমাত্র সম্পদ হয়ে গিয়েছিল আমাদের পৈত্রিক প্রাণটা। আমিও তাই প্রাণপনে ছুটেছি ওদের সাথে পাল্লা দিয়ে।

নয় মাসে প্রায় এক কোটি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিল। ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণছাড়া হয়েছিল। আর কে কী হারিয়েছিল সে প্রশ্ন এখন থাক। কিন্তু সাড়ে চার দশক পরে এসে এই ছবিটা আমাকে খানিকটা থমকে দিল কেন? শরনার্থী জীবন থেকে ফিরে আমি একটি স্বাধীন দেশ-পতাকা-মানচিত্রের সাথে পেয়েছি আরো কিছু ঐশ্বর্য সম্পদ। অথচ ওরা ঘরে ফিরে এসেছিল কিনা জানি না। জানার উপায় ছিল না, উপায় থাকলেও জানতে চাইতাম না। ওই নগ্ন নির্জন কোমল শিশুর পায়ের পাতাগুলো রক্তাক্ত হতে হতে শেষমেষ বেঁচে ছিল কিনা, জুতো পরা মানুষগুলো তা কখনোই খোঁজ করেনা। 


[ছবিটি একাত্তরের অজানা এক চিত্র গ্রাহকের ভিডিও চিত্র থেকে নেয়া]

Monday, January 9, 2017

রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র এবং ছিন্নপত্রাবলী নিয়ে


বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের চিঠিপত্রগুলোই একেকটি শিল্পকর্ম। শুনেছি টলস্টয়ের চিঠির রেকর্ড কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। টলস্টয়ের চিঠি পড়া হয়নি জানি না সেই চিঠির রূপরস বৈচিত্র্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও কাহলিল জিবরানের চিঠি পড়ার সুযোগ হয়েছে। এই দুজনের চিঠির মধ্যে যে শৈল্পিক অবয়ব আছে তা যে কোন সংবেদনশীল পাঠককে মুগ্ধ করবে। এই দুজনের চিঠির মধ্যে এমন কিছু উপাদান আছে যা একাধারে শিল্প, দর্শন এবং মনোবিজ্ঞান। মানুষের মনের বিচিত্র অনুভুতি খুব যত্নের সাথে প্রকাশিত হয়েছে এইসব চিঠিপত্রে।

'ছিন্নপত্র' সেরকম একটি বই। রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত চিঠির অধিকাংশ ইন্দিরা দেবীকে লেখা। ছিন্নপত্রে প্রকাশিত ১৫৩টি চিঠির মধ্যে ৮টি বাদে বাকী সবগুলোই ইন্দিরার। ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোতে কিছু কাটছাট করা হয়েছে। আবার 'ছিন্নপত্রাবলী'তে সেই কাটছাটকৃত চিঠির সম্পূর্ন অংশ পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ রবীন্দ্রসমগ্র হাতে পাওয়ার আগে আমার ধারণা ছিল না 'ছিন্নপত্রাবলী' নামে আলাদা একটি গ্রন্থ আছে। রবীন্দ্রসমগ্রের ১১তম খণ্ডের ছিন্নপত্রাবলীতে মোট চিঠির সংখ্যা ২৫২টি। এখানে ইন্দিরা দেবী ছাড়াও অন্যন্যদের কাছে লেখা চিঠিপত্রও আছে।

'ছিন্নপত্র' এমন একটি বই যা বারবার পড়েও তৃপ্তি মেটে না। এবং বয়সভেদে নানান রকমের মানব দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়। এই বৈচিত্রের কারণেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে কখনো পুরোনো হয়ে যায় না। সব বয়সেই রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর জীবনে প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি হয়ে থাকেন। ছিন্নপত্রে ইন্দিরাকে লিখিত চিঠিগুলো সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ নিজে যা বলেছেন সেটি চিঠি সম্পর্কের ক্ষেত্রে সার্বজনীন একটি অনুভূতি। সেই অংশটি তাই বিশেষভাবে তুলে রাখার মতো।



Friday, January 6, 2017

Güneşi Gördüm (আমি সূর্য দেখেছিলাম) - একটি মর্মস্পর্শী বহুমাত্রিক তুর্কী সিনেমা

দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত একটি সিনেমা দেখার মধ্যে সময় অপচয়ের আশংকা থাকে যখন হাতে আরো অধিকতর চমৎকার সিনেমা জমা থাকে।

একদম অজানা এক পরিচালকের সিনেমা দেখা হয়ে গেল আজ।  Güneşi Gördüm তুরস্কের একটি চলচ্চিত্রের নাম যার অর্থ I saw the sun বা 'আমি সূর্য দেখেছিলাম'। পরিচালক Mahsun Kırmızıgül একজন কুর্দী গায়ক এবং অভিনেতা। ছবিটি কয়েকটি কারণে মুগ্ধ করেছে। প্রথম কারণ তুরস্কের কুর্দী সমস্যা নিয়ে পত্রিকার পাতায় কুর্দী সমস্যা নিয়ে খবরাখবর পাঠ করলেও তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে কিছুই জানা ছিল না। এই সিনেমাটি এক কুর্দী পরিবারের ঘটনার আবর্তন হলেও এতে বৈশ্বিক বাস্তবতার অনেক গুরুতর সমস্যাকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এই সিনেমাটির আরো একটি চমৎকার বিষয় হলো এর অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি। তুরস্কের প্রাকৃতিক এবং নাগরিক সৌন্দর্য এই ক্যামেরায় অতি চমকপ্রদভাবে ধরা পড়ছে। আবার তৃতীয় বিশ্বের রীতিতে স্কাইস্ক্র্যাপারের দিগন্ত পার হলেই নিদারুণ দারিদ্রের অপ্রিয় বাস্তবতার চিত্রও আছে। ছবিটি একটি পরিবারের গল্প শোনাবার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের জানায় এখনো পুত্র সন্তানের চাহিদা এগিয়ে থাকে, এখনো যুদ্ধ একটি পরিবারকে দুই মেরুতে ঠেলে দিতে পারে, এখনো অভিবাসন একটি জ্বলন্ত বৈশ্বিক সমস্যা।

ছবিটা দেখতে শুরু করে দুঘন্টা কখন কেটে যাবে টেরও পাওয়া যাবে না। শেষ হবার পর মুগ্ধতা ছাড়িয়ে বুকের কোথাও একটা ব্যথা জেগে থাকবে আরো কয়েক ঘন্টা।

Wednesday, January 4, 2017

নতুন বছরে ক্রমশঃ আমাদের পুরাতন হয়ে ওঠা

মানুষ যতই চেষ্টা করুক 'সবকিছু' কখনো 'ঠিকঠাক' হয়ে যাবে না। যা গেছে তা ফিরবে না, যা না আসার তা আসবে না। তাই যা আছে তাতেই মানিয়ে নিতে হবে, তাকেই মেনে নিতে হবে। কে কতটা সফল, কে কতটা অসফল তার পুরোটাই আপেক্ষিক। কে কতটা বেশী পেয়েও অসুখী তা যেমন জানি না, কে কতটা কম পেয়ে সুখী তাও আমরা জানি না। সমাজটা সবসময় একটা অসন্তুষ্টি নিয়ে কাটিয়েছে চিরকাল। এই সমাজ সংশোধন করতে গিয়ে অনেকের নিজেরই সংশোধন কেন্দ্রে কাটাবার অবস্থা হয়।

আসলে সবকিছু কোনদিন পুরোপুরি ঠিকঠাক হবে না কেননা সবকিছু কোনকালেই পুরো ঠিকঠাক ছিল না। শেরশাহ যখন ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেছিলেন, তখনো ছিল না, এই জুকারবার্গের আমলেও ঠিক নেই। এই বাস্তবতা মেনে নিলে 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম' - ভেবে আক্ষেপ হবে না। বর্তমান সময়টাকে যদি 'সেরা সময়' বলে ধরে নেয়া যায়, তাহলে হয়তো কিছুটা সেরা জীবন কাটানোর একটা সম্ভাবনা থাকে। সেই সম্ভাবনা নিয়ে ২০১৭ শুরু করতে চেয়েও কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের এই লেখাটি মনে করিয়ে দিল - পৃথিবীটা ভালো নেই! আমাদের আরো ভালো থাকার চেষ্টাটা অন্যায়ই হবে।


-----------------------------------------------------------------------------------------
ঝরে পড়ার বছর
শাহাদুজ্জামান


গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ছে—এ দৃশ্যের ভেতর কেমন একটা বেদনা মেশানো আছে। ঝরা পাতার মতো ঝরে গেল একটা বছর। শিশুর হাত থেকে ছুটে যাওয়া গ্যাস বেলুনের মতো আমাদের জীবন থেকে ফসকে গেল জীবনের এক টুকরো। নক্ষত্ররা যেমন আকাশ থেকে খসে পড়ে দ্রুত মিলিয়ে যায়, সেই রকম দ্রুততায় যেন চলে যায় আমাদের সময়? দ্রুত এবং জট পাকানো। খবরের কাগজ, টেলিভিশন, ফেসবুক—এসবের পথ ধরে আমাদের ব্যক্তিগত বছরের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে কত চেনা, অচেনা, কাছের, দূর–দূরান্তের মানুষের শঙ্কা, বেদনা, আনন্দ। টিভির পর্দায় দেখি আলেপ্পোর এক নারী তাঁর কোলের শিশুটিকে এক ত্রাণকর্মীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছেন, 'আমার এ বাচ্চাটাকে আমি এখানে বাঁচাতে পারব না, বোমার আঘাতে ও মরে যাবে যেকোনো দিন। তুমি ওকে নিয়ে যাও, যেখানে খুশি, তোমার কাছে রাখো কিংবা যে কাউকে দিয়ে দাও। ওকে নিয়ে যাও তুমি।' সেই নারীর কানে নীল পাথরের দুল ছিল। কথা বলার সময় সে দুলটা নড়ছিল ঘন ঘন। তারপর পুরো বছর থেকে থেকে আমার চোখে ভেসে উঠেছে সেই ঘন ঘন নড়তে থাকা নীল কানের দুল। এ বছর সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় পাঁচ লাখে।

মাকাটো ওকামুরার খুব প্রিয় একটা বিড়াল ছিল। বিড়ালটা এখন জাপানের একটা ফ্ল্যাটে একা একা এ ঘর থেকে ও ঘরে যায়, তার মনিবকে খোঁজে। তার মনিব মাকাটো আর ফিরবে না। এ বছর এক সন্ধ্যায় ফুরফুরে বাতাসে পাস্তা খেতে খেতে মারা গেছে সে, মেরে ফেলা হয়েছে তাকে, তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে তার অচেনা ঢাকা নামের এক শহরে, হলি আর্টিজান নামের এক রেস্তোরাঁয়। আরও অনেকের সঙ্গে তার মৃতদেহ রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে ছিল সারাটা রাত। মানিকগঞ্জের এক যুবকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইতালির ফ্লোরেন্সে। একটা পিৎজা রেস্টুরেন্টে কাজ করত সে। আমাকে জানাল, যেদিন গুলশানে নিহত নয়জন ইতালীয়র লাশ ঢাকা থেকে ইতালিতে পৌঁছাল, সেদিন তার রেস্তোরাঁর মালিক তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করেন। একটা ঘটনার অভিঘাত কোথায় কীভাবে গিয়ে যে পড়ে, তার হিসাব দুরূহ থেকে দুরূহতম এখন। এ বছর আমরা কি অনেক মূল্য দিয়ে আবিষ্কার করলাম দেশের মাটিতেই কারও কারও কল্পনার দেশ হয়ে গেছে অন্য রকম? তাদের কল্পনার সেই দেশে সব জাতি, ধর্ম, বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। সে দেশে থাকবে শুধু একটি ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে নিরীহ ব্যক্তিদের রক্তের বন্যা বইয়ে। তাদের এই বিশ্বাসেরই সহযোগীরা বার্লিনে ট্রাকের চাপায় পিষে মারে সেই নারীকে, যিনি মেলায় এসেছিলেন তাঁর মেয়ের জন্য একটা সান্তা ক্লজের পুতুল কিনতে।

আবার রুশ দেশের মাস্ত্রোয়েস্কা পুতুলের ওপরটা খুললে যেমন দেখা যায় ভেতরে আরেকটা পুতুল, সেটা খুললে দেখা যায় তারও ভেতর আরেকটা, তেমন একটা ঘটনার ভেতর তো ঢুকে আছে আরেক ঘটনা, একটা বছরের ভেতর ঢুকে আছে আরেকটা বছর। পৃথিবী এখন আইএস–আতঙ্কে কাবু। কিন্তু মাস্ত্রোয়েস্কা পুতুলের মতো আইএসের ঢাকনা খুললে দেখা যাবে আল-কায়েদা, আল-কায়েদার ঢাকনা খুললে দেখা যাবে তালেবান, তালেবানের ঢাকনা খুললে দেখা যাবে আমেরিকা। দোকান থেকে একটা কাচের ফুলদানি কিনে এনে ঘরে রাখি। ফুলদানিটা মোড়ানো ছিল যে সংবাদপত্রের কাগজে, সেটা মাটি থেকে তুলে দেখি, তাতে এ বছরের সেই সংবাদ—গণহত্যার অস্ত্র আছে ভেবে ইরাকে যে আক্রমণ চালিয়েছিল ব্রিটেন আর আমেরিকা, দীর্ঘ তদন্ত শেষে স্বতন্ত্র তদন্ত দল প্রমাণ করেছে যে এ অভিযোগ ছিল পুরোটাই ভুয়া। এ খবরে এখনো শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা সাপ নেমে যায়। বড় ক্ষমতাবান দেশগুলো মিলে বসে নিজেদের স্বার্থে কেমন ঠান্ডা মাথায় তছনছ করে দিতে পারে পৃথিবী। পৃথিবীর মানচিত্রকে লন্ডভন্ড করার অন্যতম কুশীলব ব্রিটেন এ বছর হাত গুটিয়ে নিয়ে বলছে, আমি আর খেলাতে নাই, আমি ব্রেক্সিট।

ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজ জিততে আর মাত্র ৩৩টা রান বাকি। পরদিন যখন ঢাকায় খেলা শুরু হবে, তখন ব্রিটেনে রাত তিনটা। ব্রিটেনে ৪০ বছর আছেন এক বাঙালি ডাক্তার, থাকেন উত্তর ইংল্যান্ডের এক গ্রামে। বলছিলেন বাংলাদেশ ওই ৩৩ রান করতে পারবে কি না—এই উদ্বেগে তিনি ঘুমাতে পারেননি সারা রাত। ইংল্যান্ডের হিম এক গ্রামে ফায়ার প্লেস জ্বালিয়ে রাত তিনটায় সেই বাংলাদেশি এসে বসেছেন টিভির সামনে। ক্রিকেট এ বছর দেশে-বিদেশে এমনি বহু বাংলাদেশিকে দিয়েছে রাত জাগার সুখ মেশানো উদ্বেগ।

এ বছরই কালভার্টের পাশে মেয়ের এক পাটি স্যান্ডেল পেয়েছেন তার বাবা। কিছুদূর গিয়ে পেলেন মেয়ের মৃতদেহ। এলাকাটি ছিল দেশের সংরক্ষিত এলাকাগুলোর একটি। সেই নিরাপদ স্থানে কে হত্যা করল তাঁর মায়াবী মেয়ে তনুকে? দিন গেল, সপ্তাহ গেল, বছর ঘুরে গেল—জানা গেল না সেই খবর। সেই এক পাটি স্যান্ডেল কি সংরক্ষণ করে রেখেছেন তার মা? একটা খুব চাপা ক্ষোভ তুষের আগুনের মতো জ্বলে রইল মানুষের মনে। মানুষের মনে এ বছর একটা খুব গভীর বেদনাও জেগে রইল অরণ্যের হরিণের জন্য। আমাদের ঘরে আলো প্রয়োজন; কিন্তু সারা বছর এত আবেদন, নিবেদন সত্ত্বেও সুন্দরবনের গা আরেকটু বাঁচিয়ে কেন বিদ্যুতের এই আয়োজন করা যাবে না, সেই যুক্তি বোধগম্য হলো না।

ময়মনসিংহের এক গ্রামে রাস্তার পাশে ছাগলের দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে এ বছরের সেই সময়, যখন জেল গেটে প্রস্তুত অ্যাম্বুলেন্স। তিনি বলছিলেন, 'ভাবি নাই কোনো দিন। বিশ্বাস হয় নাই হবে। কী ক্ষমতাবান মানুষ এরা। বাংলাদেশ চায় নাই এরা, তারপরও বাংলাদেশে কী ক্ষমতাবান ছিল এরা। ভাবি নাই কোনো দিন, এরা জেলে যাবে, এদের বিচার হবে, শাস্তি হবে। কী দাপট এদের। তারপরও তো শাস্তি হইল। দেখলাম তো।' এ বছর বাংলাদেশের মানুষের সেই আস্থা দৃঢ় হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা, ব্যাপারটা নিয়ে টালবাহানা করার দিন শেষ হয়েছে।

প্লেন দেরি হওয়াতে বসে ছিলাম হিথরো এয়ারপোর্টে। কথা হচ্ছিল রুশ দেশীয় এক প্রৌঢ়ার সঙ্গে। জানেন বাংলাদেশের ধানের কথা, যমুনা নদীর কথা। যাননি কখনো বাংলাদেশে। বললেন, মস্কোর কাছাকাছি একটা গ্রামের স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা ছিলেন, তাই পৃথিবীর অনেক খবরই জানেন। ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চাকরি চলে যায় তাঁর। দুর্বিষহ বেকারত্ব আর দারিদ্র্যে পড়েন। তারপর নানা ঘোরা পথে এখন ব্রিটেনের এক ক্যাসলের ৫০টি ঘরের মেঝে পরিষ্কার করেন। বলছিলেন, 'লাঠির আগায় লাগানো কাপড় ভিজিয়ে ভিজিয়ে এতগুলো ঘর মুছতে মুছতে এখন আমি শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকি, ওপরে তাকানো যেন ভুলে গেছি।' নাম জানতে চাইলে বলছিলেন, 'আমার নামটা সহজে বলি না, নাম আমার নাতাশা, রুশ দেশের খুব পরিচিত নাম; কিন্তু রাশিয়ার বাইরে এই নামের এখন অন্য রকম অর্থ দাঁড়িয়েছে। অনেক দেশে নাতাশা এখন গণিকার প্রতিশব্দ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দারিদ্র্য রুশ তরুণীদের নিয়ে গেছে পৃথিবীর নানা দেশে এবং যুক্ত করেছে সবচেয়ে সহজ এই পেশায়।'

বলি, 'একজন সাবেক কমিউনিস্টর পার্টির সদস্য হিসেবে অদ্ভুত লাগে না ব্যাপারটা, কষ্ট হয় না?' তিনি বলেন, 'সোভিয়েতের ভাঙা তো অনেক জটিল ব্যাপার, আছে ভেতরের কারণ, বাইরের কারণ। তবে জানেন কি, কমিউনিস্টরা একটু সরল টাইপের মানুষ। তারা আইডিয়ার ঘোরে পড়ে। মানুষ এবং বাস্তবতা ঠিক বুঝতে পারে না ভালো। বাস্তবতা তো ভীষণ ঘোড়েল ব্যাপার। কমিউনিস্টরা বুঝতে পারেনি, চায়নি। দেখুন, এ বছরের সবচেয়ে জাদুবাস্তব ঘটনা ট্রাম্পের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া। শ্রমজীবী মানুষই কিন্তু তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভোট দিয়েছে। কী মজার ব্যাপার দেখুন, রাশিয়ার পুতিন হতে চলেছেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। জানেন তো, কথিত কমিউনিস্ট দেশ চীন এখন আফ্রিকার হাজার হাজার একর জমি কিনে রীতিমতো উপনিবেশ গড়ে বসেছে। তারা কিন্তু সৌদি আরবেও অস্ত্র বিক্রি করে, যে অস্ত্র সৌদিরা ব্যবহার করে ইয়েমেনের মানুষ মারতে। বিশ্ববাস্তবতা এখন অনেক তালগোল পাকানো। সাম্রাজ্যবাদের কালো হাত চেনা এত সহজ নয়। পৃথিবী থেকে বৈষম্য দূর করার স্বপ্ন তো দেখতেই হবে আমাদের। কিন্তু সরল অঙ্কে হবে না। নতুন পথ খুঁজতে হবে।' ঘোষণা হয় প্লেনের বোর্ডিংয়ের সময় হয়ে গেছে। বিদায় জানাই প্রাসাদের মেঝে পরিষ্কারে নিপুণা সাম্যের স্বপ্ন দেখা নাতাশাকে।

আমার বাবার কবরের পাশে যাই এ বছর। এই তো সেদিনও বাবা গাইত 'হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর তারার মতো জ্বলে...'। এ বছর বাবা মাটির নিচে কতগুলো হাড় মাত্র। নিঃসঙ্গ মা অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটে, মোবাইলে বোতাম টিপে পৃথিবীর দূর প্রান্তে থাকা ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে। আমি সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলেকে শেখাই কী করে মুখে সাবান লাগিয়ে দাড়ি কামাতে হয়। স্ত্রীকে বলি, চলো, আগামী বছর আমরা আবার অচেনা হওয়ার ভান করি, খুঁজে ফিরি একে অপরকে চুরি করে দেখার সেই সব দিন। আমাদের বয়স বাড়ে, সবকিছু যেতে থাকে নশ্বরতার দিকে। ভাবি, 'এমন মানব জনম আর কী হবে, মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।'

মূল লেখার লিংক


Tuesday, January 3, 2017

আনন্দপাঠ বনাম সমালোচনাপাঠ

আনন্দপাঠ বনাম সমালোচনা পাঠ ৷ দ্বিতীয়টি কষ্টসাধ্য ৷ সুক্ষ্ণ কাজ ৷ অনায়াস লব্ধ নয় কিছুই৷ ইতিহাস বিষয়ে কাজটি আরো কঠিন ৷ লেজের পর লেজ বের হয় ৷ ছিদ্রের পর ছিদ্র বের করতে গিয়ে নিজেকে ছিদ্রান্মেষী হিসেবে আবিষ্কার করলে বিব্রতকর অবস্থাও তৈরী হতে পারে ৷ তাই হয়েছে ৷ পাঠের আনন্দ নির্বাসিত হয়ে মগজের ভেতর তিক্ততা কিলবিল করছে ৷ ফুল পাখি বিষয়ে এ বিড়ম্বনা নেই ৷ ইতিহাসের মিথ্যাচার প্রবঞ্চনা খুব পীড়াদায়ক বিষয় যদি তা নিজের দেশ বা জাতি বিষয়ক হয়৷ সাহিত্য বা চলচ্চিত্র বিষয়ে যা অনেকটা সহনীয়৷

ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভূ