Saturday, February 27, 2016

পুরোনো খাতার দীর্ঘশ্বাস

আমার প্রিয় জায়গা পড়ার টেবিলটা। শুনে মনে হতে পারে আমি খুব পড়ুয়া লোক, ভালো ছাত্র, জ্ঞানের সন্ধানে নিবেদিত প্রাণ। ঘটনা একদম বিপরীত। কিন্তু টেবিলটাতে বসতে আমার ভালো লাগে। পড়ন্ত দুপুরে টেবিলে বসলে পাশের জানালা দিয়ে সবুজ বাগান থেকে ভেসে আসে মাটির ঘ্রাণ, গাছের শাখাপ্রশাখার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশের টুকরো আলো, আর পুবালী বাতাস। এই টেবিলটা অনেক বড়। এক পাশে ক্যাসেট প্লেয়ার, তারপাশে ভাঁজ করা কিছু বইয়ের স্তুুপ, এলোমেলো খাতা, ডায়েরী, কলম, পেন্সিল। টেবিলের উপর বিছানো মসৃণ কাপড়ের কাভারটার উপর অসতর্ক কলমের আঁচড়। পেছনের বুকশেলফে থরে ধরে সাজানো বইগুলো হাতড়ে চোখ বন্ধ করে একটা প্রিয় বই নিয়ে বসি। দুই পাতা পড়ে জানালার বাইরে চোখ চলে যায়।

দুপুরবেলাটা পড়া হয় না আমার। ভাবতে ভাবতে কেটে যায় সময়। আবার লেখার খাতাটা খুলে, কলমের ঢাকনি তুলে যখন লিখতে শুরু করি তখন শব্দগুলো ফেরারী আসামীর মতো উধাও। "প্রত্যেক মানুষের...." শব্দ দুটো লেখার পর তিনদিন আর কোন শব্দ আসে নাই। কি লিখতে চেয়েছিলাম? ভুলে গেছি। এরকম হয় অনেক সময়। পুরোনো ডায়েরীতে এরকম অসমাপ্ত বাক্যের ছড়াছড়ি। দুটো ড্রয়ার আমার। একটা উন্মুক্ত, আরেকটা তালাবদ্ধ। উন্মুক্ত ড্রয়ারে থাকে কলম পেন্সিল রাবার নোটপ্যাড স্কেল আইডিকার্ড ইত্যাদি হাবিজাবি। আর তালাবদ্ধ ডায়েরীতে থাকে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু জিনিস। খুব মূল্যবান কিছু না। ব্যক্তিগত আলাপ লেখার ডায়েরীটা, পুরো কিছু দামী কয়েন, একটা খামে কিছু আপদকালীন সময়ের টাকা, যে ছবিগুলো হারাতে চাইনা সেই অ্যালবাম, আরো টুকিটাকি কিছু আপাত অপ্রয়োজনীয় বস্তু। তালাবদ্ধ ড্রয়ারের চাবিটা আবার জমা থাকে খোলা ড্রয়ারে। অর্থাৎ কেউ চাইলে তালাটা খুলে দেখতে পারে পাশের ড্রয়ার। কিন্তু আমি চাই না সরাসরি টেনে খুলে ফেলুক। এই হলো আমার প্রাইভেসী সংক্রান্ত সচেতন অবস্থা। আমার জীবনটাও তেমন। এখানে একটা অংশ প্রকাশ্য আরেকটা গোপন। কিন্তু কেউ চাইলে গোপন অংশটাও বের করে ফেলতে পারে, পাশের ড্রয়ার থেকে চাবিটা নিয়ে। তবু চাই, কিছু জিনিস জীবদ্দশায় না দেখুক। আমার টেবিলটা জুড়েই আমার পৃথিবী। এটা সৌরজগতের পৃথিবী না। এটা সেই পৃথিবী যা প্রত্যেক মানুষের বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে। আমার টেবিলটা সেই পৃথিবীর প্ল্যাটফর্ম। এখানে আমার প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে। এত সমৃদ্ধ পৃথিবী খুব কম মানুষেরই থাকে। তবু মাঝে মাঝে কেন শূন্যতার হাহাকার বাজে বুঝি না। আজ সকালেও হঠাৎ করে বেজে উঠলো একটা বিষন্নতার গান। কাল রাতে দেখা দুঃস্বপ্নের একটা বিপরীত অনুভুতি জেগে ওঠার পর যে আনন্দ দিয়েছিল, সেটা ভেজা বৃষ্টিতে মিইয়ে গিয়ে একটা অন্ধকার আশংকা আবারো কেমন একটা ঠেলে দেয়া কষ্টের মতো বাজলো। তারপর আমি চোখ মেলে সমৃদ্ধ টেবিলে সাজানো উপকরণের দিকে তাকালাম। সেখানে অন্য সবই আছে। আর কিছুই হারায়নি। মানুষ একটা অদ্ভুত প্রাণী। আমি ওই টেবিলে তাকিয়ে খুব সামান্য একটা জিনিসের অভাবকে বড় করে ভাবছিলাম, অথচ ওখানে থাকা জিনিসগুলো তার চেয়েও মূল্যবান। তার একটিও আমি হারাতে চাই না। তবু ছোট্ট একটা ভুলের কারণে ঘটনাটা ঘটলো।

রাতে কারেন্ট চলে যাবার পর অভ্যস্ত হাতে মোমবাতি আর লাইটার নিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম একটা ক্যাসেটের প্লাষ্টিক কাভারের উপর। উঠে খাবার ঘরে খেয়ে আসতে আসতে মোমটা জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে কখন যেন গোড়ার ক্যাসেটে আগুন দিল, প্লাস্টিক পোড়া গন্ধে ছুটে এসে দেখি টেবিলটা অল্পের জন্য রক্ষা, ক্যাসেটটি নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আগুন নিভলে কুড়িয়ে ভেতর থেকে ক্যাসেট বের করে দেখি একপাশের স্পুলের কিছু অংশ পুড়ে গেছে। ফিতাগুলো খুলে নিয়ে যে অংশটা বেঁচেছে সেটা আরেকটা ক্যাসেটের খোপে ঢুকিয়ে নবজন্ম দিলাম। এই ক্যাসেটটা আমার খুব প্রিয়, এখানে খুব প্রিয় একটা গান আছে, সেটাকে রক্ষা করতেই এত কায়দা। পরদিন নবজন্ম দেয়া ক্যাসেটটা নিয়ে বাজাতে গিয়ে দেখলাম, একদিকের প্রথম গান এবং অন্যপিঠের শেষ গানটা নেই, কাটা অংশে চলে গেছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। খারাপ ছিল বেশ কিছুদিন, কেননা ওই গানটি দোকানে খোঁজ করে পাই না আর। ক্যাসেটটি এসেছিল কোলকাতা থেকে, এখানে আর পাওয়া যাবে না। সেই তখন থেকে গানটার জন্য মন কেমন করতো।

অনেক বছর পর ইন্টারনেটের কল্যানে ভুলে যাওয়া গানটি আবারো পাওয়া গেল। এই গানটার জন্য কতোবার উদাস হয়েছি গানটা কি কখনো জানবে? গানটা নিজেও ভুলে গেছে একদিন সে বেজেছিল আমার কানের কাছে।

          সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে,   শোনো শোনো পিতা।
          কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে   মঙ্গলবারতা।।
          ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে,  সদাই ভাবনা।
          যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,   না মানে সান্ত্বনা।।
          সুখ-আশে দিশে দিশে  বেড়ায় কাতরে–
          মরীচিকা ধরিতে চায়   এ মরুপ্রান্তরে।।
          ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা,   সন্ধ্যা হয়ে আসে–
          কাঁদে তখন আকুল-মন,  কাঁপে তরাসে।।
          কী হবে গতি, বিশ্বপতি,   শান্তি কোথা আছে–
          তোমারে দাও, আশা পূরাও,   তুমি এসো কাছে।।

https://www.youtube.com/watch?v=LmCZk74wCco



Monday, February 22, 2016

নিঝুম দ্বীপঃ তিক্ত অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আরেকটা পাথর

 

নিঝুম দ্বীপ। নামটা শুনেই কেমন একটা রোমাঞ্চ বুকের ভেতর নির্জনতার ডাক দেয়। সঙ্গীহীন একাকী একটা দ্বীপ সমুদ্রের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বছর যাবত শুনছিলাম নামটা। যেখানে সমুদ্র সৈকত জুড়ে শুধুই সবুজ বনাঞ্চল আর সেই বনাঞ্চলে আছে অসংখ্য হরিনের পাল আর অজস্র পাখির মেলা। যাত্রাপথ মোটেও সুগম নয়, সেই কারণে যাচ্ছি যাবো করতে করতে, কাজ থেকে ছুটি নিচ্ছি নেবো করতে করতে যখন মনে হলো আর দেরী করা ঠিক হবে না, তখনই একদিন ছুটলাম জাহাজ চেপে। যাত্রার রুট জেনে নিলাম ইন্টারনেট ঘেঁটে। চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে হাতিয়া। হাতিয়া একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে নিঝুম দ্বীপ যাবার ঘাট, সেখান থেকে নৌকায় পার হলেই নিঝুম দ্বীপ।
জাহাজের টিকেট কেটে চারজনের জন্য একটা কেবিন বুকিং করা হলো। যথাসময়ে জাহাজে উঠে কেবিনের চেহারা দেখে চোখ ছানাবড়া। এই জাহাজের বয়স আমার বয়সের দ্বিগুন বই কম নয়। তবু তাতেই সই। এডভেঞ্চার করতে গেলে কিছুটা ছাড় দিতেই হয়। জাহাজ চলতে শুরু করলো। ছয় ঘন্টার যাত্রা। কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট জেটি থেকে জাহাজ ছেড়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পৌঁছাতেই ঘন্টা পার হয়ে গেল। শম্ভুকের চেয়ে অবশ্যই গতি বেশী, এমনকি কচ্ছপের চেয়ে। খরগোশের সাথে তুলনা করা ঠিক হবে না। কেবিনে চা দিয়ে গেল জাহাজের সেলুন থেকে। ফার্স্ট ক্লাসের সার্ভিস। দুপুরে খিচুড়ির অর্ডার নিয়ে গেল। ধুমিয়ে চা আর ধুম চলতে থাকলো জাহাজের সাথে সাথে। একসময় আবিষ্কার করলাম দিগন্ত মুছে গেছে, বহির্নোঙ্গরে ভিড় করে থাকা জাহাজের ছায়াও অদৃশ্য। এখন চারপাশে শুধুই আদিগন্ত সমুদ্র অগাধ জলরাশি। পান্নাসবুজ জলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
মুগ্ধতার রেশ নিয়ে দুপুরের ওজনদার ঝাল খিচুড়ি চালান করে দেয়া গেল। রেলিং এ ঝুঁকে সমুদ্রের জলের তরতর পিছিয়ে পড়া দেখছিলাম। তারপর বেলাটা পশ্চিমে হলে পড়ার কালে ডেক যাত্রীদের মধ্যে দূরদর্শী কেউ চিৎকার দিল, ওই তো হাতিয়ার চর দেখা যায়। আমি তাকিয়ে ঝাপসা দিগন্ত বাদে কিছুই দেখলাম না। তবু 'এসে গেছি', ভাবনাটাই আনন্দের। কিছুক্ষণ পর যখন আবারো রব উঠলো ঐ তো দেখা যায়। তখন আমি আবারো তাকিয়ে দেখলাম কিছু নেই। বিরক্ত হয়ে ভাবলাম এ কেমন বেকুবি রে বাপ! কিছুই দেখি না অথচ তারা বলছে, দেখা যায়! তখন একজন বললো- এদিকে না, ওই দিকে। তাকিয়ে দেখি, আরে তাই তো? মাত্র আধমাইল দূরেই তীর দেখা যায়।আমাদের কেবিনটা সমুদ্রের দিকে, তার উল্টা দিকে হলো তীর।
জাহাজ তীরের কাছে যাবে না। এখানে ভাঙনের খেলা চিরকাল। এখন যেখানে সমুদ্র, যেখানে আমাদের জাহাজ, তারো কয়েক মাইল গভীরে ছিল হাতিয়া জেলার বিস্তৃতি। ভাঙতে ভাঙতে চলে গেছে সব। জাহাজের কূলে ভেড়ার উপায় নেই। জাহাজ থামলো তীর থেকে কয়েকশো গজ দূরে। সেখানে যাত্রী নামাতে ছুটে আসছে কয়েকটা নৌকা ও ট্রলার। এরা ২০ টাকার বিনিময়ে যাত্রীদের তীরে তুলে দেবে। আমরা একটা নৌকায় উঠলাম। পাঁচ মিনিটেই তীরে পৌঁছে গেলাম। কাদামাটি এড়িয়ে তীরে উঠতে পেরে আনন্দিত। এই জায়গার নাম নলছিরি ঘাট।

তীরে নেমে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য 'ওসখালি বাজার'। হাতিয়ার প্রধান কেন্দ্র। আমাদের হোটেলও সেই বাজারের কাছেই। তীরে বেশ কিছু মোটর সাইকেল দাড়ানো। এই দ্বীপে মোটর সাইকেল হলো প্রাইভেট বাহন। কিছু তিন চাকা টেক্সি আছে। আর আছে লম্বা যাত্রীবাহী জীপ, যেটাকে চট্টগ্রামে আমরা বলি 'চাঁদের গাড়ি'। আমরা চারজন একটা ভটভট করা টেক্সি নিলাম আড়াইশো টাকা দিয়ে। আমাদের হোটেলের নাম রেড সী। জেনেছিলাম এটাই হাতিয়ার একমাত্র ভদ্র হোটেল। আরো কয়েকটা থাকলেও তেমন সুবিধার না। যেতে যেতে দেখলাম বাংলাদেশের আর দশটা মফস্বল এলাকার মতোই চেহারা। সাইনবোর্ড না থাকলে বলা মুশকিল এটা কোন অঞ্চল। সমগ্র বাংলাদেশেই দোকানপাঠ ঘরবাড়ি জমি, খালবিল, ধানক্ষেত, তরিতরকারীর চেহারা এক রকম। এমনকি আমি পশ্চিমবঙ্গে যখন যাই বেনাপোল থেকে কোলকাতা যাবার পথেও যেরকম দৃশ্য দেখেছি তাতে বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওটা আলাদা কোন দেশ। সেই একই মানুষ, একই দারিদ্রের ছাপ সবখানেই।
নলছিরি ঘাট থেকে ওসখালি বাজারের দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। কিন্তু যানজট না থাকাতে আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হোটেলে। এই দ্বীপের এটাই প্রধান সড়ক। দ্বীপের এই মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত চলে গেছে এক টানে।

নবনির্মিত হোটেলটা খুবই ছোট। মাত্র পাঁচখানা ঘর। সবগুলোই একতলায়। দোতলার কাজ চলছে দেখলাম। দুখানা ডাবল বেডের ঘর আমাদের দেয়া হলো। ঘরগুলো বেশ পছন্দ হলো। কোন ঘেরাও নেই হোটেলে। রাস্তার পাশে খোলামেলা জায়গায় তোলা। চারপাশে গ্রাম। এরকম জায়গায় এতটা ভালো ঘর আশা করিনি। ঘরের ফিটিংস বাথরুম এলসিডি সবই আন্তর্জাতিক মানের দাবী রাখে। আমরা ছাড়া তেমন কেউ নেই হোটেলে। ডেস্কের ছেলেটার সাথেই ফোনে বুকিং এর সময় কথা হয়েছিল। বেশ চটপটে স্মার্ট ছেলে। সে একাই পুরো হোটেলের কাজ চালাচ্ছে। এখানে খাবার ব্যবস্থা নেই। রাতে আমাদেরকে বাইরের একটা হোটেল থেকে এনে ঘরোয়া পরিবেশে খাওয়ালো। দেশী মুর্গী, ভর্তা, ডিম, ডাল, সালাদ দিয়ে আয়েশ করে খাওয়া গেল। আসার আগে শুনেছিলাম এখানকার খাওয়াদাওয়া খুবই বাজে। ভাগ্যক্রমে এই ছেলের বদৌলতে ভালো জায়গার খোঁজ পেলাম। পরদিন আমরা নিঝুম দ্বীপ রওনা দেবো। ভোরে আমাদের জন্য একটা তিন চাকার ভটভট টেক্সি ঠিক করা হলো। সে আমাদেরকে ঘাটে নামিয়ে অপেক্ষা করবে। আমরা ঘুরে ফিরে সন্ধ্যার সময় ওকে নিয়েই ফিরতে পারবো। বেশ ভালো ব্যবস্থা।
পরদিন সকালে যথাসময়ে টেক্সি এলে আমরা রওনা দিলাম। পথে একটা হোটেলে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম পরোটা মামলেট ডাল ভাজি চা ইত্যাদি দিয়ে। আটটা বেজে গেছে ততক্ষণে। আমাদের যেতে হবে মোক্তারিয়া ঘাট। দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। প্রথম ২৪ কিলোমিটারে জাহাজমারা নামক জায়গায় পৌঁছাবো মোটামুটি ভালো রাস্তা। তারপর বাকী ৮ কিলোমিটার রাস্তা ভাঙ্গা আছে। শেষ দুই কিলোমিটার একদম ইট বিছানো খরখরে রাস্তা। মেরুদণ্ডের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। তবু উপায় নেই। আমরা মোটামুটি দশটার দিকে পৌঁছে গেলাম ঘাটে। গিয়ে দেখি অনেক মানুষ অপেক্ষা করছে। নৌকা মাত্র একটা। সেখানে সবার জায়গা হবে না। একটা নৌকা যায়, আরেকটা আসে। এভাবেই চলে। ওঠানামার অবস্থাটা জঘন্য। সার্কাসের লোক না হলে এই যাত্রা কঠিন। পুরো এক্রোবেটিক কায়দা দিয়ে নৌকায় আরোহন করলাম আমরা। ঠাসাঠাসি গাদাগাদি অবস্থা। লোক তুলছে তো তুলছেই। শেষে ডুবে না যায় নৌকা মাঝ দরিয়ায়। ওই ওপারে দেখা যাচ্ছে আমাদের নিঝুম দ্বীপ। নদীটা প্রায় এক মাইল প্রস্থ। এটা সমুদ্রের একটা অংশ বলা যায়। বঙ্গোপসাগরের একটা চ্যানেল এফোড় ওফোড় করে বেরিয়ে গেছে। 

যাই হোক ইঞ্জিন নৌকা দশ মিনিটে পার হয়ে গেল ওই পারে। ওদিকেও নামার সময় এক্রোবেটিক কায়দা। ঘাট বলতে যা আছে সেটা কয়েকটা কাঠের তক্তা। ওটা পেরিয়ে তীরে উঠলাম আমরা। এই তো সেই কাংখিত নিঝুম দ্বীপ। এসে তো পড়লাম। এখন কী? কোনদিকে যাবো, কিছুই জানি না। আমাদের সাথে যারা এসেছে তাদের প্রায় সবাই পর্যটক বলা যায়, কিছু স্থানীয় লোক আছে।  এই জায়গাটা নির্জন। কোন স্থাপনা নেই। কিছু মোটর সাইকেল দাড়ানো। আমরা দুটো মোটর সাইকেল ভাড়া করলাম অন্যদের দেখাদেখি। ওরা বলছে নামার বাজার নামে একটা জায়গায় নিয়ে যাবে, সেখান থেকে পরবর্তী গন্তব্য। আসলে এটাই তো ছিল গন্তব্য। কিন্তু এখানে তো হরিন বা বন কোনটাই দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং আবারো পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কতদূর যেতে হবে আমরা জানি না। মোটরসাইকেল ড্রাইভার জানে। প্রায় আট নয় কিলোমিটার পেরিয়ে একটা বাজারমতো জায়গায় এসে আমাদের নামিয়ে দিল মোটরসাইকেল।
এবার? চারজন মুখ চাওয়াচাউয়ি করলাম। এটা তো দেখি একটা জলজ্যান্ত গ্রাম। এখানে বন কই, হরিন কই? কোথায় গেলে হরিনের ছোটছুটি দেখতে পাবো। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এখানে হরিন নেই, বনও নেই। এটা নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন। হরিন দেখতে হলে এখান থেকে নৌকা ভাড়া করে আরেকটা দ্বীপে যেতে হবে। খুঁজে এক মাঝির দেখা মিললো, সে বললো চৌধুরী খাল নামের একটা জায়গায় যাবার জন্য তাকে ২০০০ টাকা দিতে হবে। নৌকায় যেতে আধঘন্টাও লাগে না। মাইল দুয়েকের মতো রাস্তা। এত অল্প দূরত্বে এত টাকা! পরে দরাদরি করে সে এক হাজারে রাজী হলো, কিন্তু সে আমাদেরকে আরেকটা গ্রুপের সাথে যোগ করে নিয়ে যাবে। ওই গ্রুপটা এখন যাবে না। দুটোর পর যাবে। এখন বাজে বারোটা মাত্র। আরো দুঘন্টা বাকী।
দুপুরের খাবারের জন্য একটা হোটেলে ঢুকলাম। ঝুপড়ি কিছু রেস্টুরেন্ট আছে পাশাপাশি। সবগুলোতেই নানান পদের মাছ রান্না করে সাজানো আছে রেস্টুরেন্টের প্রবেশপথেই। আমরা পছন্দমতো মাছ নিয়ে কোনমতে খাওয়া সারলাম। রান্নাটা জঘন্য। তবু যেখানে যে ব্যবস্থা সেটা মেনে নেয়াই রীতি।
দুটোর পরপর আমরা ঘাটের দিকে হাঁটা দিলাম। কিছু পর একদল তরুণও আমাদের পেছন পেছন এলো। ওরা একটা নৌকায় উঠে বসছে। আমরা ওদের বললাম, এই নৌকাতে আমরাও যাবার কথা। শুনে তেড়িয়ে হয়ে উঠলো তাদের একজন। বললো কস্মিনকালেও না। আমরা বললাম, মাঝি তো তাই বললো। ওরা মাঝিকে ডেকে আচ্ছা করে ধমকালো। বললো ওই নৌকা ওরা একাই নেবে। আর কাউকে তুলবে না। ছেলেগুলো ঢাকা থেকে এসেছে। কয়েকটা ছেলে চরম বেয়াদব। বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলেপেলে মনে হলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত বড় নৌকা, আমরা সাথে গেলে সমস্যা কি। ওরা বললো, নৌকায় ওরা মাস্তি করবে, খারাপ কাজ করবে, আমরা থাকলে সেটা করতে পারবে না। মনে মনে শুয়োরের বাচ্চা গালিটা এলেও দমিয়ে রাখলাম। মাঝিকে বললাম, তুমি সমাধান করো, তোমার নৌকা। এখানে আর কোন নৌকাও নেই যে ঠিক করবো। আগে জানলে অন্য নৌকা ভাড়া করে নিতাম। 

তখন মাঝি একটা বিকল্প ব্যবস্থা করে দিল। ওর ছোট আরেকটা নৌকা আছে, সেটার ইঞ্জিন নেই। তাই এই নৌকার সাথে বেঁধে দেবে দড়ি দিয়ে। বড় নৌকার টানে এটাও চলবে। আমি প্রথমে রাজী ছিলাম না ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা হতে। কিন্তু হাতে সময় কম। এত দূর এসে হরিণের বন দেখে না গেলে কেমনে কী? বাকীরা বললো এই ব্যবস্থাতেও যেতে রাজী ওরা। কি আর করা। চললাম বড় নৌকার পেছনে দড়ি বাঁধা ভাসমান ছাগলের মতো। তবে নৌকাতে ইঞ্জিন না থাকাতে ভালোই লাগছে। বড় নৌকাতেই ভটভট। এটা নিঃশব্দে চলছে। কিছুদূর গিয়ে খাল পেরিয়ে বড় নদীতে পড়লো নৌকা। এবার আর শান্তি নাই। এখানে বড় ঢেউ। বড় নৌকার পেছনে খেলনার মতো লাফাচ্ছে আমাদের নৌকাটা। মোড় ঘুরতে গেলে উল্টে যাবার সম্ভাবনা। সামনে গিয়ে আরেকটা খাল আছে সেটাই চৌধুরীর খাল। আর পাঁচ মিনিটের পথ। তখনি বড় নৌকার এক তরুণ হুংকার দিল মাঝিকে- ঐ বেটা কই যাস? মাঝি বললো- চৌধুরী খাল। তরুণ বললো- আমরা যাবো কবিরাজের চর। নদীর ওই পারে। মাঝি বললো, আগে চৌধুরী খালে যাই। পেছনের নৌকার ওরা নামবে ওখানে। তারপর কবিরাজের চর যাবো। 

কিন্তু ওরা কিছুতে রাজী হলো না এখন চৌধুরী খালে ঢুকতে। ওরা আগে কবিরাজের চর ঘুরে আসবে, তারপর এখানে আসবে হরিন দেখতে। এদিকে আমাদের হাতে সময় কম। ফিরতে দেরী হলো হাতিয়া যাবার নৌকা পাবো না। এখনি সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। কবিরাজের চর গেলে আর ফেরা হবে না। নিঝুম দ্বীপে থাকার কোন জায়গা অবশিষ্ট নেই। এখানে মাত্র দুটো ছোট হোটেল আছে। আর কিছু আছে লোকের মেসবাড়ি। কোনটাই খালি নেই আজ। 

শেষমেষ বড় নৌকা থেকে আমাদের দড়ির বাঁধন খুলে নিয়ে এক মাঝি আমাদের নৌকাকে বৈঠা মেরে খালের মধ্যে নিয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে নেমে যেতে হলো আমাদের। ভাটার সময় আর ভেতরে যাওয়া যায় না। এবার তীরে উঠে বাকীটা পথ হেটেই যেতে হবে। তীরে উঠে দারুণ মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অতি চমৎকার একটা জায়গা। এটাকেই বলা যায় আসল নিঝুম দ্বীপ। এতক্ষণ যেসব এলাকা পেরিয়ে এলাম, তা ছিল নিতান্তই গ্রাম। ওদিকে দেখার কিছুই নাই। এই দুর্গম জায়গাটাই আসল দেখার জায়গা। এটা দেখার জন্যই এতদূরের যাত্রা। কিন্তু ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল যে এই সৌন্দর্য উপভোগের জন্য আমাদের হাতে মাত্র দেড় ঘন্টা আছে। এই দেড় ঘন্টার আনন্দের জন্য তিনটা দিন বরাদ্দ করতে হলো আমাদের!
ভেবে কাজ নেই। ক্যামেরায় ছোটখাট ক্লিক করতে করতে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। তীরে উঠে প্রথমে বিশাল একটা প্রান্তর। সবুজ ঘাসে ছাওয়া। এই ঘাস খেতেই সন্ধ্যার আগে আগে হরিন বেরিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। কিন্তু এখন হরিন দেখতে হলে জঙ্গলের গভীরে ঢুকতে হবে। মাঝি বললো সে আমাদের সাথে থাকবে। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা বললাম, খুব ভালো প্রস্তাব।
আমরা জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। রূপ দেখে তো পাগল হয়ে যাবার দশা। এরকম জনমানবহীন অরণ্য আগে কখনো দেখিনি। প্রথমে হালকা গাছপালা। তারপর যতই গভীরে যেতে থাকি গাছপালার ঘনত্ব বাড়তে থাকে। পায়ের নীচে মাথা উঁচু করে থাকা শ্বাসমূল। একটু পা ফসকালেই শ্বাসমূলের খোঁচায় আহত হবার সম্ভাবনা। সাবধানে পা চালাতে হচ্ছে। প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর যেখানে এসে পৌঁছালাম সেখান থেকে পেছনে তাকিয়ে কিছুই দেখা যায় না। চারপাশে একই রকমের গাছ, একই জঙ্গল। উত্তরদক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম কিছুই বোঝা যায় না। কোথাও কেউ নেই। কেমন একটা গা ছমছম  নির্জনতা। আমরা পাঁচজন ছাড়া যেন কেউ নেই এমন এক পৃথিবীতে এসে পৌঁছে গেছি। আরো কিছুদূর যাবার পর জঙ্গল এতই ঘন হয়ে গেছে যে হাঁটাই যাচ্ছে না গা বাঁচিয়ে।

জঙ্গল সরিয়ে সরিয়ে আমরা এগোচ্ছি। মাঝি লোকটা আগে আগে। সে বলছে আরো গভীরে গেলে একটা জলাশয় আছে সেখানে হরিনেরা জল খেতে আসে। তার আগে কিছুদূর যাবার পর আমরা হঠাৎ করে একটা পোড়ো ভিটায় এসে পড়লাম। এখানে বিশাল একটা গাছ শিকড় ছড়িয়ে হঠাৎ যেন মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেছে বিদঘুটে ভঙ্গীতে। দেখে শুনে জায়গাটাকে ডাকাতের আস্তানা বলে মনে হলো। কেমন অদ্ভুত একটা আলো এখানে। সূর্য নেমে যাচ্ছে দ্রুত। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে গেছে মনটা। কী জানি কোন ঝামেলা আছে কিনা। সবার চেহারায় খানিক অন্ধকার। এই জঙ্গল থেকে পথ খুঁজে বের হওয়া দুষ্কর। মাইলের পর মাইল জঙ্গল। এই দ্বীপের সাথে লোকালয়ের কোন সংযোগ নেই সমুদ্রপথ ছাড়া। সেই পথটা খুঁজে বের করা অসম্ভব গাইড ছাড়া। মাঝি লোকটার মতলব কিছু বুঝতেছি না।

আমাদের একজন ফিসফিস করে বললো, সে কোন ডাকাত দলের এজেন্ট না তো? আমাদের ভুলিয়ে গভীর জঙ্গলে কোন ডাকাতের আস্তানার কাছে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম অনেক রকম সন্দেহ দেখা দিল সঙ্গীদের মধ্যে। মাঝিকে  বললাম, 'আর দেখার কিছু নাই, চলো এবার ফিরে যাই', সে বললো- 'পেছন দিকে ফেরা যাবে না। সামনেই কোথাও পথ বের করতে হবে'। ওদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে বন। কোথাও হরিনের চিহ্নমাত্র নেই। হাঁটতে হাঁটতে গলা শুকিয়ে গেছে। পানির বোতল অনেক আগেই খালি। এই দ্বীপে কোন খাবার পানি নেই। দেড় ঘন্টা হেটে ফেলেছি ইতিমধ্যে। আর কতদূর। এখন যে জঙ্গলে এসে পৌছেছি সেটা আরো ভৌতিক। নীচে শ্বাসমূলগুলো আরো ঘন। পা ফেলতেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখানে কোন বিপদ ঘটলে ছুটে পালানো অসম্ভব। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে শ্বাসমূলে হৃদয় এফোড় ওফোড় হয়ে যাবে।

কেমন একটা অসহায়ত্ব এসে দাড়ালো। ছেলেটাকে বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। সে ছাড়া এই জঙ্গল থেকে বের হওয়া অসম্ভব। কিন্তু এরকম একজন অনিশ্চিত অপরিচিত লোকের পেছনে চলতে গিয়ে কেমন একটা গভীর অস্বস্তি খচখচ করছে। তবু যতটা দ্রুত পা চালাচ্ছি। প্রায় অন্ধকার একটা জঙ্গল ছেড়ে একটু আলোর সন্ধানে। কিন্তু আলো কই। যতই যাচ্ছি জঙ্গল আরো গভীর। মাঝি ছেলেটা বললো, পাঁচ মিনিট পর সামনে একটা খাল পড়বে, সেই খালের কিনার ধরে আমরা এগিয়ে গেলে একসময় বের হবার পথ পেয়ে যাবো। দ্রুত হাটছি। মাটি স্যাতস্যাতে এখানটায়। রোদ পড়ে না বলে এই অবস্থা। পা পিছলে যাচ্ছে বারবার। নীচের মাটিতে হরিনের অসংখ্য পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। বোঝা যায় এটা হরিনদের যাতায়াতের পথ। কিন্তু ওরা এখন আরো গভীরে।

আমরা কত মাইল হেঁটেছি জানি না। পায়ের ব্যথায় জানান দিচ্ছে পাঁচ কিলোমিটারের কম হবে না। খোলা জায়গায় এই পথ হাঁটা এতটা কষ্টের না। কিন্তু এখানে দুর্গম জঙ্গলে প্রতিটা পদক্ষেপেই অশান্তি। এতক্ষণের আনন্দ উবে গিয়ে আতংক ভর করতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। পা চলছে না। টেনে টেনে চলছে সবাই। কিন্তু সামনের লোকটা দিব্যি বিড়ি ধরিয়ে ফূর্তির সাথে হেঁটে যাচ্ছে। তার পাঁচ মিনিট পার হয়ে কবেই পনেরো হয়ে গেছে। সেই খাল আর আসে না। পথও ফুরায় না। আমি উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আর কিছুক্ষণ পর সূর্যটাও থাকবে না, তখন এই বনে সারারাত পচলেও বের হওয়া যাবে না। এখন জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে গাছের শীর্ষে পড়া সূর্যের আলোটা দেখে বোঝা যাচ্ছে ওটা কোন দিকে অস্ত যাবে। আমাদের গন্তব্য সেদিকেই হওয়া উচিত। অথচ সামনের লোকটা কোন মতলবে আমাদের বিপরীত দিকে হাঁটিয়ে মারছে।

আমি হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাকীদের পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম ওই লোকটার কাছাকাছি। ধমক দিয়ে বললাম, 'ঐ তুমি বাম দিকে ঘোরো, সোজা গেলে তো খালি গভীরেই যাবো, তোমারে বলছি এখান থেকে বের হবার পথে যাবো, তুমি উল্টা দিকে যাচ্ছো কেন? এখানে কোথাও তো রাস্তা নাই। তুমি বায়ে ঘুরে সোজা বের হবার পথের দিকে যাও, যেদিকে সূর্য ডুবছে, যেখানে আমাদের নৌকা আছে। সূর্য ডোবার আগেই বের হতে হবে এখান থেকে বুঝছো?'। সে আরো কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু আমি কড়া চোখে বললাম, 'যেদিকে বলছি বের হও সেদিকে'। এবার সে ঘুরলো বাঁয়ের দিকে।

আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঘন জঙ্গল ছেড়ে একটু পাতলা জঙ্গলের দিকে এলাম। এদিকে পথ অনেক সোজা। এবার জোরে পা চালাতে পারলাম আমরা। আর মিনিট পনেরো পরেই আমরা দূরে আলো দেখতে পেলাম সমুদ্রের দিকে। হ্যাঁ ওদিকেই আমাদের গন্তব্য। একদম শেষ বেলার দিকে আমরা পথ খুঁজে পেলাম। জঙ্গল থেকে বের হয়ে দেখি সূর্য ডুবতে আরো কিছুক্ষণ বাকী আছে। জঙ্গলে মনে হচ্ছিল সূর্য বুঝি ডুবেই গেছে। সামনে বিশাল খোলা প্রান্তর। আধমাইল প্রস্থ হবে ময়দানটা। সেটি পেরিয়ে আমরা নৌকার কাছাকাছি এসে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি আমাদের ফেলে যাওয়া সেই ঢাকাইয়া বদগুলা নৌকা থেকে নেমে আসছে। ওরা এখানে সন্ধ্যে কাটাবে হরিণের খোঁজে। ওরা জানতে চাইলো, হরিণ দেখেছি কিনা। বললাম, অনেক হরিণ জঙ্গলে খেলা করছে, যাও দেখে আসোগে। ওরা জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলো বীরদর্পে।

খালে যেখানে আমাদের নৌকা ছিল তার পাশেই বড় নৌকাটা। যেটায় আমাদের উঠতে দেয়া হয়নি। ফেরার সময় আমরা ঠিক করলাম বড় নৌকাটা দখলে নিতে হবে। মাঝিকে বললাম, ছোট নৌকায় ইঞ্জিন নেই। ওটা নিয়ে রওনা দিলে আমাদের আজকে আর হাতিয়া পৌছাতে হবে না। এখান থেকে নিঝুম দ্বীপের 'নামার বাজার' ঘাটে পৌছাতেই রাত হয়ে যাবে। সুতরাং যে করেই হোক বড় নৌকাটা দিয়ে আমাদের পৌঁছে দিতে হবে। সে প্রথমে রাজী হয় না। কিন্তু আমাদের চাপাচাপিতে সে বললো ঠিক আছে বড়টা নিয়ে নিঝুম দ্বীপের খাল অবধি যাবে আমাদের ছোট নৌকাটা নিয়ে। তারপর আমরা বৈঠা মেরে বাকী পথ চলে যাবো। অন্তত আধঘন্টা সময় বাঁচবে। বড় নৌকায় অন্য মাঝি ছিল। যেহেতু দুই নৌকার মালিক একই তাকে রাজী করিয়ে বড় নৌকাটা চালু করে আবারো আমাদের ফিরতি যাত্রা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সমুদ্রের অংশটা পাড়ি দিয়ে খালে ঢুকে পড়লাম। তারপর আমাদের ছেড়ে দিয়ে বড়টা ফিরে গেল। আমরা আমাদের মাঝিকে নিয়ে বৈঠা মেরে এগিয়ে চললাম। খুব ধীর গতি। সন্ধ্যের আধো অন্ধকারে জঙ্গলের মাথার উপর ভেসে থাকা দশমীর চাঁদটা অদ্ভুত রঙ ছড়াচ্ছিল। ইঞ্জিন নৌকার শব্দ যন্ত্রণা নেই। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

নির্জন একটা খাল বেয়ে আমরা ফিরতি গন্তব্যের দিকে যাবার সময় মাঝির সাথে গল্প শুরু করলাম। কিছুক্ষণ আগে এই মানুষটাকে জঙ্গলের মধ্যে মনে হচ্ছিল সাক্ষাত ডাকাত, এখন তাকে মনে হচ্ছে রূপ নারানের কূলে জেগে ওঠা এক দেবতা। সেই দেবতা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। সেই সাথে তার সাথে গল্প হচ্ছে জল জীবনের। গল্পের একটা অংশ আমাদের স্তব্ধ করে দিল। সেই অংশ বলতে গেলে ছোটখাট একটা রোমাঞ্চোপন্যাস হয়ে যাবে। সেটা অন্য সময় বলা যাবে। কিন্তু একই মানুষের উপর আমাদের বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের পার্থক্য দেখে বোঝা গেল দুঃসময়ে মানুষ কিভাবে চরম আস্থাহীনতায় ভুগতে পারে।

আর বেশীক্ষণ লাগলো না। কিছু পরেই আমরা নৌকা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাজারে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখান থেকে চা নাস্তা সেরে দুটো মোটর সাইকেলে চড়ে ফিরতি গন্তব্যে হাতিয়া ফেরার নৌকার ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নিঝুম দ্বীপের দুটো ঘাট দুই প্রান্তে। মোটর সাইকেলে আধঘন্টার মতো লাগলো খেয়াঘাটে পৌঁছাতে।

আসলে ঘাট বলতে কিছু নেই সেখানে। কাদাময় চর একটা। সেই ঘাটে গিয়ে দেখি অন্ধকারে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে যাত্রী উঠছে সরু তক্তার ব্রিজ দিয়ে। আমরা এগিয়ে উঠতে গেলাম, দেখলাম প্রবল ধাক্কাধাক্কি চলছে। কিছু লোক মোটর সাইকেল তুলছে। তারা হৈ হৈ করে বলছে এটা তাদের নৌকা আর কাউকে উঠতে দেবে না।

এদিকে আমাদের না উঠলে চলবে না। খানিক পর নৌকা থাকবে না এই ঘাটে। তখন থাকার কোন জায়গা নেই এই অচেনা জায়গায়। শেষমেষ আমাদের উঠতেই দিল না ওরা। রিজার্ভ নৌকা ওটা। বলা হলো আরেকটা নৌকা আসছে ওপার থেকে সেটা এলে আমরা উঠবো।

আবার ফিরে এসে তীরে অপেক্ষা। অন্ধকারের মধ্যে মাথার উপরে জ্বলছে রুপোলো চাঁদ। কিন্তু সেই চাঁদের সৌন্দর্য আর মৃদুমন্দ বাতাস আমাদের টানছে না। নদী পার হবার টেনশানে সবার মেজাজ খারাপ। এই নৌকা ছেড়ে যাবার পর আরেকটা নৌকা এলো। ওটাই শেষ নৌকা ওই পারে যাবার। 

ওটা ভিড়লে দেখা গেল ওটাতেও দখলবাজি, হৈ চৈ, বিশ্রী অবস্থা। কেউ কাকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয় এই অবস্থা। ওই দলটা আবারো মোটর সাইকেল তুলতে শুরু করেছে। অনেক লোক তাদের। তারা নাকি কোন রাজনৈতিক দলের পাণ্ডা। এদিকে আমাদের যেতেই হবে।

আমাদের সাথে আরো কিছু লোক আছে স্থানীয়। তারাও হৈ চৈ শুরু করলো। এই নৌকায় না গেলে কারোরই চলবে না। ক্যাডারদের হুমকির বিপরীতে্ আমাদের এদিকের একজন স্থানীয় এমপির হুমকি দিল। তাকে ফোন করে জানাবে এক্ষুনি। এই হুমকিতে বোধহয় কাজ হলো, উঠতে দিল আমাদের। উঠতে হল এক্রোবেটিক কায়দায়। স্যাণ্ডেল জুতো সব ভিজিয়ে পানি মাড়িয়ে ঝুলে উঠতে হলো নৌকায়।

উঠে দেখি ওখানে মোটরসাইকেল, ভেড়া, হাঁস, মানুষ সব ধাক্কাধাক্কি করছে। মানুষ আর মালের মধ্যে কোন তফাত নাই। তবু উঠতে পেরেছি এই ঢের। তারপর অন্ধকারের মধ্যে নৌকা তরতর এগিয়ে চললো। দশ মিনিটের পথ। ততক্ষণে রাত আটটা বেজে গেছে।

ওই পারে পৌঁছে আমাদের টেক্সি খুঁজে বের করলাম। সকাল থেকে রিজার্ভ করে এনেছিলাম বলে সে সারাদিন ঘাটে বসে ছিল আমাদের জন্য। যাক তাকে পেয়ে স্বস্তি। এবার আরো দুই ঘন্টার ফিরতি যাত্রা। বাকী আছে মাত্র ৩২ কিলোমিটার। রাত দশটার মধ্যে পৌঁছাতে পারলেই হয়। অবশেষে হোটেলে পৌঁছানো গেল রাত দশটার মধ্যেই।


[মন্তব্যঃ জায়গাটা সত্যিই অতীব সৌন্দর্যময়। ছবিতে অসুন্দর কিছু তুলতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু যাতায়াতের অব্যবস্থাপনা এবং বিশৃংখলাটাই চুড়ান্ত খারাপ।  সেই কারণেই এই তিক্ত অভিজ্ঞতা। যদি কোন কতৃপক্ষ যাতায়াত ব্যবস্থার দায়িত্বটা নিয়ে পর্যটন বান্ধব করে তাহলে নিঝুম দ্বীপকে নিয়ে এরকম অভিজ্ঞতা কারো হবে না]


Sunday, February 14, 2016

বসন্তদিনে শীত বন্দনা

বাঙালীরা বসন্ত এলে কেমন আপ্লুত হয়। ফাল্গুনের প্রথম দিন নিয়ে মাতামাতি করে। বাঙালীর হুজুগে আমিও পহেলা ফাল্গুনে ডিসি হিলে যাই কোন কোন বছর। কিন্তু বসন্ত আমার প্রিয় ঋতু না। ফাল্গুনের প্রথমাংশের প্রতি কিছু অনুরাগ থাকলেও মোটের উপর বসন্ত আমার ভালো লাগে না। বসন্তের শেষে কেমন একটা হাহাকারের সুর বাজে। বুকের ভেতর শিনশিন করে। হারিয়ে ফেলার সুর বাজে। সবসময় যে হারিয়েছি তা নয়, অনেক ভালো ভালো সময় কাটলেও পুরো ঋতুটাকে আমি ঠিক ভালোবেসে উঠতে পারি না। আমি বরং শীতের বন্দনা করি। বাংলাদেশের শীত আমার কাছে অনেক বেশী প্রিয়। প্রিয় ফুলগুলো শীতেই দেখা যায়।

বসন্ত এলে তাই এই কবিতাটি আমার সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে-

"হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?"
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
"দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?"

"এখনো দেখনি তুমি?" কহিলাম "কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?"
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
"অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনি সন্ধান।"

কহিলাম "ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।"
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে-
"নাই হ'ল, না হোক এবারে-
আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।"

কহিলাম "ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।"
কহিল সে পরম হেলায়-
"বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?"

"হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?"
কহিলাম "উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?"
কহিল সে কাছে সরি আসি-
"কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।"

['তাহারেই মনে পড়ে' - বেগম সুফিয়া কামাল]

তুমিও নিশ্চয়ই জানো তাহা!

Monday, February 8, 2016

মনুষ্যত্ব এবং অমনুষ্যত্ব

জীবিকার জন্য খুবই ক্ষুদ্রতম সময় ব্যয় করছি বেশ কিছুকাল যাবত। কয়েক বছর আগেও যা ছিল অকল্পনীয়। দিবসের এক পঞ্চমাংশ মাত্র ব্যয় করে যদি টিকে থাকা যায়, তাহলে বাকী সময়টা পছন্দের জগতে ব্যয় করা যেতে পারে। এক বছর আগেও ১২-১৪ ঘন্টার মতো ব্যয় করতে হতো জীবিকার জন্য। ওই পথে চলমান থাকলে আর্থিক উন্নতি হয়তো হতো, কিন্তু আত্মাটা শুকিয়ে মরতো। আমি যে জগত থেকে দুই দশক বঞ্চিত ছিলাম সেটা পুষিয়ে নেবার জন্য আর্থিক উন্নতির প্রয়োজনটাকে সংকুচিত করতে হয়েছে। মোটামুটি চলনসই জীবন হলেই চলে আমার। গাড়িবাড়ি দরকার নেই।

মানব জীবনের দুটো সত্ত্বা আছে। একটা হলো তার প্রাণী সত্ত্বা, অন্যটি হলে তার মনুষ্যত্ব। এই মনুষ্যত্বটাই অন্য প্রাণীদের চেয়ে আমাদের আলাদা করে পরিচয় করায়। সেই সত্ত্বাটির সন্ধান করার কথা আমরা প্রায়ই ভুলে থাকি। জীবিকাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ভেবে সারা জীবন কাটিয়ে দেই। যেদিন প্রথম মোতাহার হোসেন চৌধুরীর রচনাসমগ্র হাতে আসলো, সেদিন মনুষ্যত্ব পর্বটি পড়ে আমাকে নিজের ভাবনার সাথে মেলাতে হলো তাঁর দর্শনটিকে। তাঁর সাথে ভাবনার মিল পেয়ে ভীষণ ভালো লেগেছিল। গতানুগতিক জীবিকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে ওই ভাবনাটার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

তিনি বলেছেন এভাবে-
মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীবসত্তা সেই ঘরের নিচের তলা আর মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানবসত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য জীবসত্তার ঘরেও সে কাজ করে; ক্ষুৎপিপাসার ব্যাপারটি মানবিক করে কথায়, তার অন্যতম কাজ। কিন্তু তার আসল কাজ হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্বলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
এই অংশটি আমার খুবই পছন্দের।

তাঁর বইটি প্রায় পুরোটাই কোট করার মতো। তবু প্রিয় বাক্যগুলোই লিখবো শুধু। তিনি একজায়গায় লোভের বিষয়ে বলেছেন - লোভের ফলে যে মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে- অনুভুতির জগতে সে ফতুর হয়ে পড়ে.......ছোট জিনিসের মোহে বড় জিনিস হারাতে যে দুঃখবোধ করে না, সে আর যাই হোক, শিক্ষিত নয়।

আরেক জায়গায় তিনি বলেছেন - আত্মার জগতের সন্ধান পাওয়া যায় সাহিত্যে, শিল্পে। তাই শিল্প-সাহিত্যের সহায়তায়ই মানুষের মনের উন্নয়ন করা সম্ভব হয়

সুতরাং আত্মিক উন্নতির জন্য কিছুটা আর্থিক ছাড় দিতে আমার আর দ্বিধা রইলো না। মাত্র এক বছর কেটেছে নতুন জগতে। এর মধ্যে অবশ্য আত্মিক উন্নতি বিশেষ হয়নি কিছু বইপত্র পড়া ছাড়া। দীর্ঘকাল ধরে স্বার্থের জগতে বসবাস করে আত্মিক চেতনার উপর মরচে ধরে গিয়েছে। আরো কিছুকাল সময় লাগবে সেই মরচে সরিয়ে শুদ্ধ হয়ে উঠতে।

সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এসব নিয়ে গঠিত নাগরিক পরিমণ্ডলে আমার যাতায়াত নেই। যেখানে লোকের ভিড় আমি সেটা এড়িয়ে থাকি। আমি খুব আড্ডবাজ মানুষ। কিন্তু বইপত্রের দোকানে গিয়ে কারো সাথে দেখা হলে আমার সব ভেস্তে যায়। আড্ডাও হয় না, বইও কেনা যায় না। আমি বইয়ের দোকানে গেলে তাই সতর্কতার সাথে পরিচিত মুখ এড়িয়ে থাকি। সেই কারণে অতি সামাজিক মানুষদের সাথে আমার ঠিক বনিবনা হয় না। আমার আলাপ আড্ডা সবকিছু নিঃসঙ্গ মানুষদের সাথে। বিশেষত বইপত্র জগতে। অন্যদের মতো দশজনের সাথে জ্ঞানী আলাপ করার মতো সাহস হয় না আমার। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও একটা কারণ হয়তো। মানুষ সামাজিক প্রাণী হলেও আমি এক্ষেত্রে একটু অসামাজিক, হয়তো কিছুটা অমানুষও। সেই কারণে আমার আরো বেশী জ্ঞানের আলো দরকার। এখন আমি সেই আলোর সন্ধানে সকাল সন্ধ্যা ব্যয় করি।



Friday, February 5, 2016

দীঘির সাথে একটা দুপুর

আজ খুব চমৎকার একটা দিন গেল। ছুটির আমেজের সাথে একটা বাড়তি পাওনা ছিল অপ্রত্যাশিত। ফুরিয়ে আসা দিনের মধ্যে এরকম দিনগুলো অমূল্য হয়ে থাকে। বাতাসটা ছিল কিঞ্চিত শীতলতা মেশানো। রোদটা ছিল মোমের মতো নরোম। যে শব্দগুলো শোনা গেছে সেই শব্দে ছিল শতাব্দী প্রাচীন এক ভালোলাগার ইতিহাসের গান। আজ কোন কাজ ছিল না। দাওয়াত ছিল না। দূরে কোথাও যেতে হয়নি।

সেই সুযোগে দুপুরে একটা দীঘির কাছে গেলাম। কয়েকশো বছর প্রাচীন ঐতিহাসিক একটা দীঘি। দীঘির টলটলে স্বচ্ছ জলে পিছলে যায় দৃষ্টি। দীঘির দুইদিকে মুখোমুখি ছোট ছোট পাহাড়, মাঝখানে পথ চলে গেছে পূর্বদিকে, সেই পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে অনেকটা জঙ্গল ছিল কিছুদিন আগেও। জঙ্গল কেটে তৈরী হচ্ছে নতুন অট্টালিকা। তবু দীঘিটা এখনো টিকে আছে বলে সৌন্দর্য আড়াল হয়নি। সমস্ত দুপুরটা সেই দীঘির সাথে কেটেছে। দুই দফায় দীঘির কাছে ছিলাম কয়েক ঘন্টা। অনেক জমানো কথা বলা হলো দীঘিকে, দীঘিও বললো আমাকে। আমি বললাম, সাঁতার দেবো। দীঘি বললো, দাও। আমি বললাম, উড়নচন্ডি হবো, দীঘি বললো হও। আমি বললাম, আমি তোমার মাঝে ডুবে মরবো। দীঘি ঢেউ তুলে অনিচ্ছা প্রকাশ করলো।

একটা মাছরাঙ্গা তখন তাড়াহুড়ো দীঘিটা পাড়ি দিচ্ছিল জরুরী কোন প্রয়োজনে। বিকেল গড়িয়ে আসছিল আরো ঠাণ্ডা হাওয়া নিয়ে। অবনীশ যে পথ দিয়ে বাড়ি ফিরতো, আমি সেই পথ দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পথে গাড়ি নেই তেমন। রিকশা চলছে। অনেকদিন পর রিকশার ঘন্টি শুনলাম আজ। কেন জানি শহুরে রিকশাওয়ালা আজকাল ঘন্টা বাজায় না।

My house says to me, "Do not leave me, for here dwells your past."
And the road says to me, "Come and follow me, for I am your future."

And I say to both my house and the road, "I have no past, nor have I a future. If I stay here, there is a going in my staying; and if I go there is a staying in my going. Only love and death will change all things."

(Sand and Foam -Kahlil Gibran)

স্মৃতির বাগান

জ্ঞান এবং স্মৃতি ছাড়া মানুষের নিজস্ব সম্পদ বলতে কিছু নেই। আর যা কিছু আছে সবকিছুর 'আমারত্ব'ই আপেক্ষিক। আর কোন কিছুই স্থায়ী নয়। অথচ মানুষ মালিকানা দখল নিয়েই কত যুদ্ধ বিগ্রহ মামলা মোকদ্দমা হয়রানিতে জড়ায়। এমনকি দলিলপত্রে বৈধ আমিত্ব খুব জোরালোভাবে বজায় থাকলেও সম্পত্তি বেহাত হয়, বেদখল হয়।

কিন্তু সবকিছু হারিয়ে গেলেও হারায় না স্মৃতি, মানুষ বিশিষ্ট কিছু স্মৃতি দিয়েও জীবন পার করে দিতে পারে। স্মৃতিভ্রষ্টতা হয় কখনো কখনো, সেটা মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা কিংবা অন্য কোন সীমাবদ্ধতার জন্য। মানুষ যদি শুধু স্মৃতির মালিকানা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতো তাহলে পৃথিবীতে কোন সমস্যাই হতো না মানুষের মধ্যে।

আমাদের পুরোনো বাড়িটার জন্য মাঝে মাঝে মন কেমন করে, গোপন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। প্রথমে অনিচ্ছায়, পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে বাড়িটার মালিকানা ছেড়ে দিতে হয়। মালিকানা ছেড়ে দেয়াতে আমাদের কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি, বরং উপকারই হয়েছে বৃহত্তর অর্থে। তবু একসময় ছিল, এখন নেই - এই ভাবনাটা একটা কষ্টবোধ জাগিয়ে তোলে কখনো কখনো। বাড়িটা নেই, বাগানটাও নেই এখন। ছেড়ে আসার পর ওই পথে যেতে ইচ্ছে করতো না। কিন্তু যেতে হতো কোন এক অনিবার্য আকর্ষণে এবং চোখে পড়ে জীর্ণ বাড়িটা ভেঙ্গে, বাগানের ছায়াঘন গাছগুলো কেটে বিশাল ইমারত উঠে গেছে। সেই ইমারতে বাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন নতুন সুখী পরিবার। না, ইমারতের প্রতি আমার লোভ নেই, কিন্তু বাগানটার জন্য আমার লোভী স্মৃতিটার কান্না পায়।

ওই বাগানের আম কাঠাল নারিকেল সুপারী পেয়ারা বরই কামরাঙ্গা গাছগুলোর প্রতিটা নাড়ি নক্ষত্র আমার জানা। আমি জানতাম কোন গাছের ফল মিষ্টি, কোন গাছের ফল রসালো, কোন গাছের ছায়া দুপুরে শীতল মায়া যোগায়। শিউলী, কামিনী, রজনীগন্ধা, হাসনাহেনা ফুলের ঝাড়গুলো থেকে এখনো ভেসে আসে দূরবর্তী ঘ্রাণ। যন্ত্রপিষ্ট ইঠ পাথরের শহরের মাঝখানে এমন একটা দুর্লভ বাগানের অধিকার আমার ছিল, আজো ভাবতে ভালো লাগে।

সেই সময়ে ফিরে যাবার কোন উপায় নেই। ওরকম আরেকটি বাগান কখনো হবে না আমার। এই দীর্ঘশ্বাসের কোন মানে নেই। বরং এই ভেবে সন্তুষ্ট থাকি যে, আমার স্মৃতির মালিকানা বদল হয়নি, আমি এখনো স্মৃতির সুবাস মেখে চোখ বন্ধ করে সেই সময়ে পৌঁছে নিজের মতো করে ঘুরে বেড়াতে পারি আমার বাগানে। স্মৃতির বাগানের মতো নিরাপদ আর কী আছে। স্মৃতির বাগান কখনো নষ্ট হয় না, চুরি হয় না, মালিকানা বদল হয় না।


Monday, February 1, 2016

The Revenant : একটি বাঙাল দর্শক প্রতিক্রিয়া

অবশেষে The Revenant দেখে ফেললাম কাল রাতে। ডি'ক্যাপ্রিও আর টম হার্ডি দুজনই অসাধারণ করেছে। চিত্রায়নগুলো এত অসাধারণ হয়েছে যে কিছু কিছু ল্যাণ্ডস্কেপ বাঁধিয়ে রাখার মতো। এই কাহিনী নিয়ে আরেকটি ছবি হয়েছিল ১৯৭১ সালে Man in the Wilderness নামে। Hugh Glass এর সত্য  ঘটনার উপর ভিত্তি করে সিনেমাটি বানানো হয়েছে। আগাগোড়া থ্রিলিং সিনেমা! ছোট স্ক্রিনেই গায়ে কাঁটা দেয়, বড় পর্দায় নিশ্চয়ই আরো ভয়াবহ বাস্তবানুগ অনুভুতি হবে। ভালুকের আক্রমনে মারাত্মক আহত একজন মানুষ প্রায় পঙ্গু অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে ছয় সপ্তাহে ২০০ মাইল বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছে এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা। কিন্তু ঘটনাটি সত্যি ঘটেছিল ১৮২৩ সালে এবং Hugh Glass বেঁচেছিল ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত।

তবে সিনেমায় কিছু ফাঁক ছিল, হলিউডের সিনেমায় যা সচরাচর থাকে। যেমন-

১)  ২০০ মাইলের বিপদ সংকুল পথের প্রায় পুরোটাই বরফাচ্ছাদিত দেখানো হয়েছে। অন্যন্য প্রতিকূলতার সাথে প্রচণ্ড তুষারপাত, বরফগলা নদী, বরফজমা পর্বত ইত্যাদি পাড়ি দিতে হচ্ছে Glassকে। প্রায় সমস্ত যাত্রাই বরফের মধ্য দিয়ে। বাস্তবে এরকম হয়েছিল কিনা জানা সম্ভব না। কিন্তু এতটা বরফাচ্ছাদিত দেখানোর মানে Glass এর যাত্রাকে যতটা সম্ভব দুর্গম করে উপস্থাপন করা। যে অবস্থায় একজন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব বলা চলে। বেঁচে থাকার আরো অনেক প্রতিকূল সমস্যা আছে, শুধু বরফকেই বেছে নেয়া হয়েছে কেন, এই প্রশ্ন দর্শকের মনে জাগতেই পারে।

২) এরকম বরফাচ্ছাদিত এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে রাখা আরেকটি কঠিন কাজ। পাথর ঘষে আগুন জ্বালানো তো কঠিন বটেই। কিন্তু এখানে দেখা গেল সামান্য খড়কুটোর আগুনই সারারাত জ্বলছে। Glass ঘুমিয়ে উঠেছে, তারপরও আগুন অপরিবর্তিত। এরকম আগুন জ্বালানোর দৃশ্যগুলো অবাস্তব লেগেছে।

৩) ভালুকের আক্রমনের যে ধরণ দেখানো হয়েছে তাতে Glass এর সমস্ত শরীর চুরমার হয়ে গেছে। তার গায়ের উপর উঠে ভালুকটাকে কুন্দন করতে দেখা গেছে। তাতে মেরুদণ্ডের হাড় চুরচুর হয়ে যাবার কথা। কিন্তু দেখা গেছে সে বিনা চিকিৎসাতেই কয়েকদিন বাদে হামাগুড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। লাঠি দিয়ে হেটে পর্বত পাড়ি দিচ্ছে।

৪) Glass এর যাত্রাপথ নিশ্চয়ই খুব দুর্গম ছিল। কিন্তু সিনেমায় সেই দুর্গমতাকে এত বেশী কঠিন করে দেখানো হয় যেটা মানুষের পক্ষে অবিশ্বাস্য। যেমন হামাগুড়ি দিয়ে সে একটা পাহাড়ের খাড়া চুড়া থেকে দেখতে পায় অদূরে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে কলকল করে। পাহাড়টা একদম খাড়া। ওখান থেকে নামার কোন পথ দেখায়নি সিনেমাতে। কিন্তু পরের দৃশ্যে নায়ককে দেখা গেল নদীতে হামাগুড়ি দিয়ে জল পান করতে।

৫) হলিউডি থ্রিলার সিনেমার একটা সমস্যা হলো তারা খাড়া বিপদের উপর বিপদ হাজির করতে থাকে। একটা সামাল দিতে না দিতেই আরেকটা এসে হাজির। মাঝে কোন গ্যাপ থাকে না। এতটা ধারাবাহিক আক্রমন সামাল দেয়া শুধু সিনেমার নায়কদের পক্ষেই সম্ভব। আগাগোড়া টেনশানে রেখে সিনেমা শেষ করতে হবে। তবেই বক্স অফিস হিট করবে। সম্ভবত এই চিন্তা থেকেই সিনেমাগুলো এমন ধারায় তৈরী হয়।

ছবিটা অস্কার পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পেলে আশ্চর্য হবো না। কিন্তু আমার মতে এই ছবির অস্কার পাওয়া উচিত না। এই ছবি দেখতে গিয়ে মনে পড়লো Into the Wild ছবিটার কথা। সেই এক অসম্ভব মর্মান্তিক, অসাধারণ সুন্দর নির্মান। ওই ছবির তুলনায় এটি অনেক কম বিশ্বাসযোগ্য।
আমি Into the Wild কে ১০ এ ৮ দিলে  The Revenant কে দেবো ১০ এ ৬।