সারাদিন ধকল গেছে। শিকার ধরতে বেগ পেতে হয়েছে অনেক। একটা গণ্ডারের তাড়া খেয়ে গাছে উঠে বেঁচেছে। শেষে বনের এক পাশে গাছতলায় পড়ে থাকা হাবিজাবি ফলমুল খেয়ে পেট ভর্তি করে আসার পথে একটা খরগোশের বাচ্চা চোখে পড়লো। দেখামাত্র দেরী না করে নিখুঁতভাবে পাথর নিক্ষেপ করলো হাদিম। অব্যর্থ লক্ষ্য। চামড়া ছিলে এতটুকুন মাংস মিললো। কিন্তু এটুকুনে কি পেট ভরে? তবু পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর ঝক্কি ঝামেলায় না গিয়ে কাঁচাকাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেললো নাড়িভুড়ি সহ।
সেই থেকে অশান্তির শুরু। পেটটা ঢোল হয়ে আছে। কতক্ষণ গড়াগড়ি খেল সে মাটিতে। তবু ঢোলটা কমে না। কী মুশকিল। দুহাতে পেট চাপড়ালো, খামচি দিল বড় বড় নখে। কোথাও ফুটা করে দিতে পারতো যদি। পায়খানার বেগও আসছে না যে কিছু জায়গা খালি করবে।
হাদিমের মনে হচ্ছে খরগোশটা জীবিত হয়ে পেটের মধ্যে ঢুশ মারছে। হারামজাদা! এত ছোট্ট জিনিসের এত শক্তি কেমনে হয়? অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে হাদিম ভাবতে থাকে কি করলে ঘুম আসবে। হাই উঠছে কিন্তু ঘুম আসে না। চোখ বুজতেই পেটে ঢুশঢাশ শুরু হয়। ভুটভাট শব্দটা মাঝে মাঝে এত জোরে হয় যে কানে এসেও বাজে।
শুয়ে বসে কিছুতে শান্তি নেই। মাঝরাতে সে উঠে বাইরে যায়। কাজটা সারতে পারলে আরাম হতো। একটু দূরে গর্তের পাশে বসে যায় আবার। কিন্তু অনেক কোৎকাত করেও কাজ সারা যায় না। অসমাপ্ত রেখে উঠে পড়ে।
শুনতে পায় দূরে গর্জন করছে হিংস্র প্রাণী। কিন্তু ভয় লাগছে না আজ, পেটের অশান্তিতে ভয়ডর চলে গেছে। আবার গুহায়ও ফিরতে ইচ্ছে করছে না এই অশান্তি নিয়ে। শরীরে কেমন আলস্য ধরে গেছে। হাদিম শুয়ে পড়ে একটা জঙ্গলের পাশে। কিন্তু মাথাটায় যেন আরাম লাগছে না। ব্যথা ব্যথা অনুভব। হাদিম কিছু ঘাস পাতা জড়ো করে মাথায় দিল। তাও হয় না। আরো কিছু লতাপাতা দিয়ে এক মাথা উচু করে মাথা রাখলো। এখন বেশ আরাম লাগছে। ঘুম চলে আসছে তার। পেটের ভুটভাটগুলো গলার ঢেকুর হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। টেরই পেল না কখনো ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ঘুম ভাঙলো একদম সূর্য ওঠার পর। আজ প্রথম গুহার বাইরে রাত কাটালো। বিপদ হতে পারতো। দলের সবাই তিরস্কার করলো হাদিমকে।
কিন্তু হাদিমের শরীর একদম ঝরঝরে হয়ে গেছে। সে ভাবলো রাতে ঘুমোবার সময় মাথার নীচে দেয়া ঘাস লতাপাতার বোঝাটাই পেটের ভুটভাট দূর করে শান্তির ঘুম এনে দিয়েছে। তখন থেকে সে প্রায়ই ঘুমোবার আগে জঙ্গল থেকে ঘাসলতাপাতা ছিড়ে এনে মাথার নীচে দেয়। বাকীরা দেখে দেখে হাসে। ব্যাটা পাগল নাকি। কিন্তু হাদিম পাত্তা দেয় না ওসব।
কিছুদিন পর গুহার আরো একজনের সেরকম ভুটভাট সমস্যা হলো। হাদিম তাকেও ঘুমাবার সময় ঘাসপাতা দিয়ে শুতে বললো। প্রথমে সে অবিশ্বাস করলেও যখন সে ঘাসপাতা দিয়ে শুলো, তার ঘুম এসে গেল। ভুটভাট কমে গেল। তখন বুঝলো জিনিসটা কামেল আছে। তারপর থেকে আস্তে আস্তে পদ্ধতিটা জনপ্রিয় হতে থাকে।
যখন পাড়ার সর্দারের কাছে ঘাসপাতা মাথায় দিয়ে ঘুমানোর উপকারীতার কথাটা পাড়লো একজন, তখন সর্দার একটু ভেবে হুকুম দিল ঘাস পাতা নয়, তার জন্য ভেড়ার চামড়া আর লোম দিয়ে অমন একটা বোঁচকা তৈরী করে দিতে। ওটা মাথায় দিয়ে সর্দার ঘুমাতে শুরু করলো প্রতিদিন।
সর্দারকে ভেড়ার চামড়া ব্যবহার করতে দেখে কিছুদিন পর বাকীরাও ঘাসপাতা বাদ দিয়ে চামড়া ব্যবহার শুরু করলো এই কাজে। এদ্দিন ধরে কোমরে আর মাথায় এক টুকরো চামড়া পরা হতো বিশেষ উৎসবের দিনে নাচানাচি করার জন্য। এখন চামড়ার চাহিদা অনেক বেড়ে গেল বোঁচকা বানাবার কাজে।
ভুটভাট সমস্যা প্রায় সবারই থাকে। কিন্তু সেই সমস্যার চেয়েও বোঁচকার প্রয়োজনটা বাড়লো ঘুমের আরামের জন্য। মাথার নীচে একটা বোঁচকা দিলে ঘুমটা কেমন স্বর্গীয় আনন্দের ব্যাপার হয়ে যায়। এই জিনিসটা আস্তে আস্তে মানুষের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠতে লাগলো এবং একসময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেল।
নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কাহিনীটা কি? হ্যাঁ, সেটাই। সেই থেকে চালু হওয়া বোঁচকটা কয়েক হাজার বছর পর বালিশ নামে পরিচিত হলো। আজ বালিশের নাম সবাই জানে কিন্তু হাদিমের নামটা বেমালুম ভুলে গেছে মানুষ।
[পাদটীকাঃ আদিম মানুষদের কোন নাম ছিল না। তবু আধুনিক যুগের এক মানুষের কাছে 'হাদিম' নামে একজন ধরা দিল কল্পজালে। হাদিমের যুগ দশ হাজার বছরেরও পুরোনো। আধুনিক মানুষের মতে খ্রিষ্ট্রপূর্ব ৭০০০ সালের দিকে মেসোপটমিয়ার মানুষ প্রথম বালিশ ব্যবহার করে। কিন্তু তারো কয়েক হাজার বছর আগেই কোন এক গুহাবাসী হাদিম বালিশের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে সেটা কোন রেকর্ডে নেই। তাই আজ হাদিমকে চেনে না কেউ। হাদিম আজ কল্পলোকের বাসিন্দা হলেও মাঝে মাঝে সে আপনাদের সামনে আসবে তার আদিম আবিষ্কারের আরো বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে। ]