কোন দেয়ালেই ছবিটা মানাচ্ছিল না। যেখানেই ঝুলাই মনে হয় ছবিটা টেরা চোখে তাকিয়ে আছে। ঘরের চারটা দেয়ালের একটাতেও ফিট করা গেল না। ছবিটাতে সবুজ ত্বকের একটা বাচ্চা ছেলে কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগে না। অথচ যখন আর্ট গ্যালারীতে অনেক ছবির ভিড়ে সাজানো ছিল বোঝা যায়নি। এই একলা ঘরে ছবিটা সামনে রেখে বসতে কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে।
আমি তিনতলা একটা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকি। বিয়ে থা করিনি বলে স্বাধীন জীবনযাপন। বাড়িওয়ালা লোকটা ভালোই ছিল কিন্তু তার স্ত্রী দজ্জালের দজ্জাল। লোকমুখে শোনা যায় গত বছর বাড়িওয়ালা যখন হঠাৎ এক ভোরে মারা গেল, তখন তার লাশটাও ঠিকমতো কেউ দেখতে পারেনি বাড়িওয়ালীর শীতল চাউনির কারণে। নিন্দুকেরা বলে লোকটাকে বাড়িওয়ালী গলা টিপে হত্যা করেছে। সেই ঘটনার পর থেকে আমি বাড়িওয়ালীকে এড়িয়ে চলি। বাসাটা ছেড়ে দেবো ভেবেছিলাম অনেকবার। কিন্তু এত সস্তায় এরকম নিরিবিলি একটা ঘর কোথাও পাবো না। আমি অবশ্য সারাদিনই বাইরে থাকি, বাড়িওয়ালীর মুখোমুখি হই মাসে একবার ভাড়া দেবার সময়। সেই সাক্ষাতেও চেষ্টা করি কোন কথা না বলে থাকতে। কিন্তু বাড়িওয়ালী খনখনে গলায় তার চিরায়ত উপদেশ বিতরণ করতে ছাড়ে না। উপদেশ দেবার সময় বাড়িওয়ালীর চোখে কোন কোমলতা থাকে না। কেমন একটা রাগী কমলা দ্যুতি চোখ থেকে ঠিকরায়। গা টা শিউরে ওঠে আমার।
এই বাড়িওয়ালীই গতমাসে ভাড়া নেবার সময় আমার ঘরে উঁকি দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিল, 'এ কেমন ঘর একটা পেইন্টিংও নেই। শুনেছি কবি-সাহিত্যিকগন রুচিবান হয়। আপনার দেখি রুচির র-ও নেই'। আমি পেইন্টিং এর উচ্চমূল্যের কথা বলাতে ঝামটা মেরে বলে উঠে বলেছিল জীবনে কোনদিন আর্ট গ্যালারীতে গিয়েছি কিনা। তারপর আমাকে একটা আর্ট গ্যালারীর নাম দিয়ে বলে ওখানে একটা ছবি আছে যেটা সর্বোচ্চ ডিসকাউন্টে কেনা যাবে। রুচি বদলানোর চ্যালেঞ্জ নিতেই ছবিটা কিনতে হলো।
কিন্তু একটা কৌতুহল বাকী থেকে গেল। ছবিটার শিল্পী কে ছিল অনেক চেষ্টা করেও বের করতে পারিনি। ছবিটা যেখান থেকে কেনা হয়েছে সেটা শহরের সবচেয়ে প্রাচীন আর্ট গ্যালারী। আটত্রিশ বছর এই শহরে বাস করলেও সেই আর্ট গ্যালারির খবর পেয়েছি মাত্র দুদিন আগে। এই গ্যালারির আদি ব্রিটিশ মালিক মরে ভুত হয়ে গেছে চল্লিশের দশকেই। তারপর পাকিস্তান আমল ঘুরে বাংলাদেশ আমল হয়ে কমপক্ষে পাঁচবার হাত বদল হয়ে বর্তমান মালিকের কাছে এসেছে। তাই এই ছবির ইতিহাস সম্পর্কে বর্তমান মালিকের কাছ থেকেও কিছুই জানা গেল না। জানার মধ্যে এটুকুই জানা গেছে আর্ট গ্যালারীর সবচেয়ে পুরোনো ছবি হলেও এই ছবিটা আগে কেউ কিনতে আকর্ষণ বোধ করেনি। উপযুক্ত ক্রেতার অভাবে ছবিটা এত বছর অবিক্রিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
শতবর্ষ প্রাচীন পেইন্টিং হলেও এর উপর বয়সের কোন ছাপ পড়েনি। ফ্রেমগুলো পুরোনো হয়ে রং চটে একাকার হয়ে গেলেও মূল ছবিটাতে কোন ছাপ নেই। ওটা থেকে এমন একটা রং বিচ্ছুরিত হচ্ছে যা দেখে মনে হয় মাত্র গতকাল আঁকা। ছবির ফ্রেমটা ছিল মোটা কাঠের। পোকায় খেয়ে ঝুরঝুর করে ফেলেছিল বলে বাড়িতে আনার পর সেটা থেকে কাঠগুলো খসিয়ে ছবিটাকে আলাদা বের করে নিয়েছি। আপাততঃ স্কচটেপ দিয়ে আলমারির পাল্লার সাথে সেঁটে রেখেছি। ছবিটা আসলে এমন এক রকমের কাগজের উপর আঁকা যা প্রাথমিক স্পর্শে কাপড়ের মতো মনে হয়। সেই জন্যই হয়তো সস্তা মিলেছে। কিন্তু কাগজে আঁকা ছবি এতকাল টেকার কথা না। তাহলে? কেউ একজন মিথ্যে বলছে আমাকে। বাড়িওয়ালী নাকি দোকানী? কিছু একটা গোলমাল আছে ছবিটাতে। ছবিটা এত পুরোনো হতেই পারে না। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম। এতকাল পড়া রহস্যগল্পগুলোর সুত্র ধরে শার্লক হোমস হবার চেষ্টা করছিলাম।
কারেন্ট চলে গেল হঠাৎ। হাতের কাছে মোমটোম নেই। দোকানে যেতে হবে। বিছানা থেকে উঠতে যেতেই ছবিটার দিকে চোখ গেল। এই অন্ধকারেও হাসছে সবুজ বালকটা। কেমন কুৎসিত হাসি। দাঁতগুলো বেরিয়ে গেছে। সবুজ মুখের লাল ঠোটে কালতে তরমুজের বিচির মতো দাঁত। ড্রাকুলার চেয়েও ভয়ংকর লাগছে। পান খেয়েছে নাকি রক্ত? কোথাও এক ফোঁটা আলো নেই, তবু অন্ধকারে ছবিটা দেখা যাচ্ছে কি করে?
আরো আশ্চর্য, আমি দোকানে যাবো ঠিক করেছি, কিন্তু ছবির বালকটা ইশারা করে বলছে কোন দরকার নেই!! নীচে নামতে গেলে নাকি বিপদ। বাড়িওয়ালী দোতলার অন্ধকার সিড়িতে বটি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। টুকরো টুকরো করে কেটে রক্ত খাবে। এই ছবি কথা বলে!!! কথাটা শোনামাত্র আমার রক্তে ভয়ের বান ডাকলো। সারা শরীরে কে যেন সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে রক্ত বের করে নিচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এমন সময় দমাদম শব্দ হলো দরোজায়। কেউ যেন দা দিয়ে কোপাচ্ছে দরজার উপর। দরোজাটা এমনিতে নড়বড়ে। সেই সাথে বাড়িওয়ালির ত্রাহি চীৎকার 'আগুন আগুন'। কোথায় আগুন? নিশ্চয়ই এটা কোন প্রতারনা অথবা আমাকে ঘর থেকে বের করার ফন্দী। দরোজার দমাদম আওয়াজ থামছেই না।
চোখ খুলে গেল আমার। দেখলাম জানালা দিয়ে কমলা রঙের আলো আসছে। আর আগুনের হলকা। সত্যি সত্যি আগুন লেগেছে সামনের বস্তিতে। বাড়িওয়ালীর চিৎকার আর দরজায় আঘাত তখনো চলছে। আমি শিরশির অনুভুতি নিয়ে দরোজা খুলতেই আমাকে এক হেঁচকায় টেনে বাইরে নিয়ে গেল বাড়িওয়ালী। আমার গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না, বাধাও দিতে পারছি না। সিড়ি দিয়ে একরকম টেনে হিঁচড়ে আমাকে গেটের বাইরে নিয়ে এল সে। যে কোন সময় আগুন বস্তি ছাড়িয়ে এ বাড়িতেও ধরে যাবে। প্রচণ্ড গরমে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ওই গরমেও শীতের কাঁপুনি দিল গায়ে যখন বাড়িওয়ালী আমার একদম কাছ ঘেষে কেমন ফিসফিস করে বললো, "আশ্চর্য মানুষ!! এমন মরন ঘুম মানুষের হয় নাকি? আরেকটু হলেই তো ঝলসে যেতেন। আপনাকে যে আমার খুব দরকার!" কথাগুলো বলার সময় খেয়াল করলাম তার চোখ দুটো দিয়ে কমলা রং ঠিকরে বেরুচ্ছে। আসলে প্রজ্জ্বলিত আগুনের শিখা ওটা। তার ডানহাতটা আমার বামহাতের কবজি প্রায় মুচড়ে চ্যাপটা করে দিচ্ছে। আমি হাত ছাড়াতে চাইলে সেই চোখ দুটো এমন কামনার চোখে তাকালো আমি অনড় হয়ে গেলাম।
আগুন নিবে গেলে ঘরে ফিরে এলাম। আগুন লাগার পর কারেন্ট চলে গিয়েছিল, এখনো আসেনি। যতদূর দেখা যায় আমাদের বাড়িটার তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু টেবিলের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম, ছবিটা নেই! অন্ধকারে হাতড়ে টেবিলের আশেপাশে কোথাও ছবিটা পেলাম না। সকালে উঠে আবারো খুজলাম। নেই ছবিটা কোথাও। আশ্চর্য! রীতিমত হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? এই আগুনের মধ্যে চোর আসার কথা না। চোর এসে শুধু ছবিটা নিয়ে গেল? ঘড়িটা পর্যন্ত টেবিলে রয়ে গেছে।
পরদিন রাতে গরম লাগছিল বলে ছাদের দিকে দরোজাটা খোলা রেখে শুয়ে পড়লাম। গরমকালে কারেন্ট চলে গেলে প্রায়ই এরকম করি। কারেন্ট গেছে সেই দশটায় এখনো আসেনি। ঘুম আসছে না, তবু অন্ধকারে শুয়ে আছি। হঠাৎ ছাদের ওপাশে একটা মূর্তি দেখে তড়াক করে উঠে বসলাম। চোর? আবার এসেছে? ছবিটার কথা মনে হতে হিংস্র হয়ে উঠলাম। ড্রয়ার থেকে ছুরি বের করে বেরুলাম আস্তে। মূর্তিটা তখনো ঠায় দাড়িয়ে। আমি পেছন থেকে খেয়াল করলাম লুঙ্গি পরা খালি গা একটা ছেলে। কৈশোর পেরিয়েছে কি পেরোয়নি তেমন। 'চোর' বলে ঝাপটে ধরে যাবো তখুনি আমার হাত থেকে ছুড়িটা কেড়ে নিল কেউ। তাকিয়ে দেখি বাড়িওয়ালী। রাত পোষাক পরে ছাদে চলে এসেছে। এই পোষাকে কেউ বাইরে আসে না। আবছা আলোয় যা দেখা যাচ্ছে তাতে আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ভয় বা শিহরণ কোনটা হচ্ছে বুঝলাম না। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জড়িয়ে ধরলো প্রবল কামনার চোখে। দুই হাতে আমাকে পেচিয়ে শূন্যে তুলে ফেললো প্রায়। দুহাতের সাঁড়াশি চাপ থেকে মুক্তি পেতে হাঁসফাঁস করছি। ছাদের কোনে তাকালাম ছেলেটা পেছন ফিরে দাড়িয়ে আছে নির্বিকার। এদিকে কি হচ্ছে তার ধারণা নেই। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। এরকম কঠিন বাঁধনে আর কোন নারী আমাকে জড়ায়নি। আমার পেছনে ছাদের কোমর সমান দেয়ালটা। প্রেমের ঠেলায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এবার বাড়িওয়ালীর মুখটা ঠোটমুখ ছাড়িয়ে গলায় এসে ঠেকলো, কিন্তু গলায় চুমুর বদলে বিশাল একটা কামড়!! এটাকে মরণ কামড় বলে বুঝতে দেরী হলো না। এই পিশাচনীর উদ্দেশ্য বুঝে আমি চীৎকার করে জোরে একটা ঝটকা দিয়ে আত্মরক্ষা করার শেষ চেষ্টা হিসেবে অনেক বছর আগে শেখা একটা জুডোর কায়দা প্রয়োগ করলাম। সেই কায়দায় আমার মাথার উপর দিয়ে বাড়িওয়ালী উড়ে গিয়ে সামনের রাস্তায় পড়লো দপ করে।
ছাদের অপর কোনায় দাঁড়ানো ছেলেটা দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি তখনো এত হতবাক যে নড়াচড়া করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। কাঁধের ক্ষত থেকে রক্ত বেরুচ্ছে তখনো। দেরী করা ঠিক হবে না। পুলিশী ঝামেলা হতে পারে। জিনিসপত্র গুছিয়ে সেই রাতেই পালালাম বাড়িটা ছেড়ে। পেছনে রয়ে গেল এক অমীমাংসিত রহস্য।
No comments:
Post a Comment