সাধ সাধ্যের বর্ডার লাইনে যাদের বসবাস তাদের জন্য কোন শখই সহজপাচ্য থাকে না। বইকেনা ব্যাপারটাও আমার জন্য সহজ ছিল না। সাধারণত কলেজ পড়ুয়া বয়স থেকে বইপত্রের রোমাঞ্চকর জগত ব্যাকুল হয়ে ডাকতে থাকে স্থায়ী আসন গাড়ার জন্য। স্থায়ী আসন মানে বই কিনে একের পর এক ভাঁজ করে বুক শেলফে সাজিয়ে রাখা। সেই শখটা আমাকে ডাক দিতে শুরু করেছিল কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটির শুরুতেই যখন পরিবারের সাধসাধ্যের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধটা সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। ফলে বাবা-মার হোটেলে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা সহ সব মৌলিক অধিকারের বন্দোবস্ত থাকলেও 'আউট বই' কেনার কোন বাজেট ছিল না। বই কেনার জন্য বিকল্প ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হতো। যেভাবে দিন মজুরেরা এক দিনের আয় দিয়ে আজকের খাবারটুকু ম্যানেজ করে সেভাবে বই কেনার ব্যবস্থা হতো কয়েকদিনের রিকশা ভাড়া কিংবা বাজার খরচ থেকে বাঁচিয়ে।
একটু পেছনে যাই।
আগ্রাবাদ কলোনী স্কুলের দক্ষিণ কোনার ছোট্ট লাইব্রেরী ঘরটা যেদিন ছাত্রদের জন্য খুলে দেয়া হলো সেদিন আমার জগতে নতুন একটা পৃথিবী যুক্ত হলো। তখন আমি ক্লাস সেভেনে। লাইব্রেরী কার্ডে প্রথম যে বইটির নাম উঠলো, সেটি ছিল 'থ্রি মাস্কেটিয়ার্স'। কার্ডে নাম লিখে যত্নের সাথে বইটা যখন হাতে নেই, সেই অনুভুতির রোমাঞ্চ এখনো স্পষ্ট আমার কাছে। তালাবদ্ধ আলমীরা থেকে একটা বই আমার হাতে লোভনীয় একটা কেকের মতো লাগছিল। একেকটা বই হলো একেকটা এডভেঞ্চার। যে কোন স্কুলে 'আউট বই'য়ের এর একটা লাইব্রেরী অতি অপরিহার্য অঙ্গ। নিজের হাতে বই যোগাড় ওটাই প্রথম হলেও বাবার হাত দিয়ে বই কেনা শুরু হয়েছিল আরো দুই ক্লাস আগে। সময়কে দুবছর পিছিয়ে নেই।
ক্লাস ফাইভে কি সিক্সে বাবা আমাকে বইয়ের দোকান চিনিয়েছিল প্রথম। চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের দোতলায় সিঁড়ির পাশেই এল শেপের বড়সড় একটা দোকান ছিল। সেই দোকানে কয়েকটা অনুজ্জ্বল টিউবলাইটের আলোয় কিছু বই কেমন একটা ঝিমধরা ঘ্রান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো কাঠের তাকগুলোতে। ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত সেই তাকগুলোর মাত্র তিন চার তাক আমার নাগালে। তার মধ্যেই আমার এডভেঞ্চারের রাজ্য। ওই দোকানটি আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। যদি আমাকে নস্টালজিক স্মৃতির কোন প্রতিযোগিতা করতে বলা হয়, তাহলে আমি সেই দোকানটির কথাই বলবো সবার আগে। যার নাম ছিল, বইঘর। আমার সর্বকালের সেরা বইয়ের দোকান। ছেলেবেলার প্রিয় জিনিসগুলো কেন যেন কখনোই হারে না।
সেই দোকানটিতে অদ্ভুত একটা নীরবতা কাজ করতো। যেরকম নীরবতা থাকে প্রাচীন উপাসনালায়গুলোতে, ঠিক সেরকম নীরব প্রাচীনগন্ধী এক নীরবতার আশ্রয় ছিল বইঘরে। আমি সেই নীরবতাকে ভালোবাসতাম। কৈশোরে বা তারুণ্যের সূচনায় যতবার নিউমার্কেটে গিয়েছি অবশ্যই বইঘরে একবার পা দিয়েছি। বই না কিনলেও বইয়ের ঘ্রান নিয়ে ফিরে এসেছি। বইঘর থেকে কেনা প্রথম দুটো বই, আমার স্কুলের এক সহপাঠি পড়তে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। আমার সেই প্রথম কোন বই হারানো। বন্ধুটি বই ফেরত দিচ্ছে দেবে করতে করতে একসময় স্কুলই ছেড়ে চলে যায়। আমি শোকটা ভুলতে পারিনি বহুকাল। তারো প্রায় দুই যুগ পর একদিন সেই বন্ধুটির সাথে রাস্তায় দেখা। দুজনে হাত মিলিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতে করতে আমার মনে পড়ে গেল সেই বই দুটোর কথা। ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করি, বইদুটো এখনো আছে কিনা। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হলো না। এখন আমার হাজার বইয়ের মেলা, তবু শৈশবের সেই বই দুটোর শোক ভুলতে পারি না।
বই কেনা আমার জন্য কেন সহজ ছিল না সেটা বলছি। যখন সত্যিকার অর্থে বই কেনার নেশায় পেয়ে বসেছে তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু, সেই সাথে অভাবের দিনেরও। সামর্থ্য ছিল না নতুন বই কেনার। বই কেনা প্রায় বিলাসিতা তখন। তাই খুঁজে খুঁজে পুরোনো এডিশানের বই কিনতাম সস্তায়। বইয়ের এই ব্যাপারটা খুব ভালো লাগতো। বর্তমানমূল্য বলে কিছু ছিল না। যে দামে প্রকাশিত, সেই দামেই বইটা কেনা যেতো। মনে আছে ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ৫ টাকা দামের বই একই দামে কিনেছিলাম কারেণ্ট বুক সেন্টার থেকে ১৯৮৮ সালে। 'বইঘর' ছাড়াও তখন যাওয়া শুরু করেছি নিউমার্কেটের/আশেপাশের আরো কয়েকটা দোকানে। কারেণ্ট বুক সেন্টার তাদের অন্যতম। 'লাইসিয়াম' নামের একটা দোকান ছিল একতলায়। বিজ্ঞানের বইসহ বিদেশ থেকে প্রকাশিত বইপত্র পত্রিকা পাওয়া যেত। রিডার্স ডাইজেস্টের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম কিন্তু উচ্চমূল্যের জন্য কিনতে পারতাম না। ভাবতাম যদি কোনদিন বড়লোক হই তবে অবশ্যই রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকাটির প্রত্যেকটা সংখ্যা কিনে ফেলবো। 'লাইসিয়াম' বাদে আরো দুটি দোকান 'মনীষা', আর 'উজালা'য় মাঝে মধ্যে উঁকি দিতাম। 'কারেন্ট বুক সেন্টার' ছিল নিউমার্কেটের রাস্তার উল্টোদিকে জলসা সিনেমার নীচে । সবচেয়ে বেশী বই কালেকশান ওই দোকানেই। মননশীল বই পছন্দে নিউমার্কেট এলাকার পরে আন্দরকিল্লা। যদিও আন্দরকিল্লা মূলত পাঠ্যবইয়ের আড়ত, তবু ওখানেও কয়েকটা ভালো দোকান খুঁজে পেয়েছিলাম। 'কথাকলি' ছিল অন্যতম। ছোট্ট দোকানটিতে মজার সব বই। কালজয়ী উপন্যাস থেকে গুরুগম্ভীর তত্ত্বের বই সবকিছু ছিল। তারপর খোঁজ পাই 'বুক সিন্ডিকেট' নামে প্রাচীন একটা দোকান। জামে মসজিদের উল্টোদিকে দোতলায়। সেখানেও বিরল কিছু বই পাওয়া যায়। জামে মসজিদ মার্কেটে 'সুপ্রীম' নামের একটা দোকানেও ভালো কালেকশান ছিল। বই কেনার চেয়ে বইয়ের ঘ্রান নিতেই যেন দোকানগুলোতে ঢুঁ মারা হতো বেশী।
ভার্সিটিতে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ছিলাম বোধহয়। সেবার হাত একদম খালি। বই কেনা দূরে থাক, বইয়ের দোকানে যাবার বাসভাড়াও নেই। আমার বাসা আগ্রাবাদে। বইয়ের দোকানগুলো নিউমার্কেট আর আন্দরকিল্লায়। বাবার কাছে হাত পাতার মতো অবস্থা নেই। দুপুরে খাবার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কি করা যায়। তাকের ওপর সাজিয়ে রাখা ইন্টারের পরিত্যক্ত বইগুলোর দিকে চোখ গেল। ফিজিক্সের একটা বই আ্ছে প্রায় নতুন। হোয়াইট প্রিন্টের বইটা বেশ ভারী। দেড়শো টাকায় কেনা। একাডেমিক বইপত্রের প্রতি আমার আজন্ম বিরাগ। পরীক্ষা শেষ হবার পরপরই কটকটিওয়ালার ঝুড়িতে যায়। এটা যায়নি চেহারা সুন্দর বলে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেললো মাথায়। বইটা নামিয়ে একটা পলিথিনে ভরে চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সোজা আন্দরকিল্লা। জামে মসজিদের উল্টোদিকের ফুটপাতে পুরোনো বইয়ের দোকান। সেখানে গিয়ে দরদাম করে দেড়শো টাকার ফিজিক্স বইটা বিশ টাকায় গছিয়ে দিলাম। কী আনন্দ, বিশ টাকার মূল্য অনেক তখন। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেট এসেছি। উজালা বইঘরে ঢুকে খুজতে খুজতে হঠাৎ একটা বইয়ের দিকে চোখ গেল। বাংলাদেশের ছোটগল্প। গত একশো বছরের কালেকশান। এমন লোভ লাগলো এখুনি কিনে ফেলতে চাই। কিন্তু দাম দেখে থমকে গেলাম। চল্লিশ টাকা। নিরাশ হয়ে বইটি রেখে দোকানের বাইরে চলে আসি। কিন্তু জায়গাটা ছেড়ে নড়তে পারছি না। যদি কেউ এসে বইটা নিয়ে যায়। অনেকদিন আগের পুরোনো সংস্করন, বাজারে পাওয়া যাবে না এখন। ছোট্ট একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল। নিউমার্কেটে শাড়ির দোকানে চাকরী করে এক আত্মীয়। তার কাছে যাওয়া যায়? এক দোকান কর্মচারীর পকেটে নগদ বিশ টাকা কি থাকবে? অবাক হবার কিছু নেই। আশির দশকের সেই সময়ে পকেটে পাঁচ টাকা থাকলেও নিজেকে স্বচ্ছল মনে হতো। সাহস করে তার কাছে গিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম সমস্যার কথা। সেই মহানুভব আত্মীয় কোত্থেকে যেন ২০ টাকার বন্দোবস্ত করে দিল এবং আমি বইটা কিনে বাসায় ফিরতে পারলাম। কী যে অসাধারণ সেই অনুভূতি!
আরো কিছুদিন পর আবিষ্কার করলাম একটা পুরোনো বইয়ের দোকান। অমর বই ঘর। নূপুর সিনেমার পাশেই দোতলায় ঘুপচিঘরের মধ্যে দোকানটা। আহ তখন সেই দোকানে ঢুকলে মনে হতো আমি উনিশ শতকের কোন পুরোনো নগরীতে চলে গেছি। যে নগরীতে আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত বইতে ছাওয়া। একবার ঢুকলে দু ঘন্টার কমে বেরুতে পারতাম না। কঠিন এক নেশা। লোভ হতো রিডার্স ডাইজেস্টের প্রতি। এমনকি পুরোনো সংখ্যা হলেও। এই পত্রিকাটির পুরোনো সংখ্যাগুলোও একেকটা ক্লাসিক। অমর বইঘরে পুরোনোগুলো বিক্রি করতো অর্ধেক দামে। তাও সামর্থ্যে কুলোতো না আমার। তারপর আরো কবছর পর পেয়ে যাই আরেকটা খনি। নূপুর সিনেমার অন্যপাশে একটা মিষ্টির দোকান ছিল, সেই দোকানটার আড়ালে দেখি একটা বইয়ের দোকান হা করে বসে আছে, লোকজন কেউ নেই। আমি দোকানটায় ঢুকে রীতিমত হতভম্ব। দোকানটি খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বই বিক্রি করে। কিন্তু হতভম্ব হয়েছি বিরল সব ইংরেজী বই থরে থরে সাজানো দেখে। সাথে আছে রিডার্স ডাইজেস্টের পুরোনো বেশ কিছু কপি। ইংরেজী বইয়ের অনেক দাম বলে কখনো কেনার সাহস করিনি। কেবল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরীতে গিয়েই পড়তাম। দোকানী কাছে এসে অভয় দিয়ে বললো, এই বইগুলো বিশেষ মূল্যে বিক্রি করছেন। ইংরেজী বই আর ম্যাগাজিনগুলো এক মিশনারীর কাছ থেকে সংগৃহিত, যিনি দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম বাস করছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যার বিশেষ ভূমিকা ছিল। পাকিস্তানী সেনাদের হুমকির মুখেও বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি তিনি। তাঁর নিজের লেখা বইও আছে এ ব্যাপারে। ঘরে স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে সম্ভবত কিছু বই বিক্রি করে দিয়েছেন। ঠিক কারণটা মনে নেই। রিডার্স ডাইজেস্টগুলো পাঁচ টাকা মূল্যে বিক্রি করবেন বললেন। আমি সেদিনের মতো চলে এলাম। পরে টাকা যোগাড় করে বিরাট সংখ্যক ইংরেজী বই কিনে ফেলেছিলাম। কথা ছিল বইয়ের মালিকের সাথে একদিন দেখা করবো। একজন বিদেশী নাগরিক হিসেবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলবো। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না। একদিন দোকানটা বন্ধ হয়ে গেল। দোকানীর কাছেই ওই ভদ্রলোকের যোগাযোগের সুত্রটা ছিল। দোকান বন্ধ হবার সাথে সেই সুত্রটাও হারিয়ে গেল। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো তাঁর নামটাও ভুলে গিয়েছি।
শহরের পরিধি বেড়েছে গত দুই দশকে। সেই হিসেবে বইয়ের দোকান তেমন বাড়েনি চট্টগ্রামে। গত ক'বছরে মাত্র কয়েকটা নতুন দোকান যুক্ত হয়েছে। বিশদ বাঙলা, বাতিঘর, নন্দন সবচেয়ে জনপ্রিয়। কারেন্ট বুক সেন্টারে যাওয়া কমে গেছে অনেক। নিউমার্কেট এলাকার ঘিঞ্জি আর যানজট পেরিয়ে ওখানে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু কারেণ্ট বুক সেন্টার আমার বই সংগ্রহের অন্যতম প্রিয় জায়গা হয়ে থাকবে সবসময়। কারেন্ট বুক সেন্টারের শাহীন ভাইয়ের আন্তরিকতার কথাও ভোলার মতো নয়। বই নিয়ে এরকম সুরসিক আড্ডাবাজ মানুষ পাওয়া ভার। বাবার তৈরী করা এই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরে রেখেছেন এখনো।
একটা সময় গেছে যখন বই কিনে গোগ্রাসে গেলার অনেকদিন পর আরেকটা বই কিনতে পারতাম। এখন বই কেনা হয় অনেক, কিন্তু পড়ে শেষ করা যায় না। বেড়ে যাচ্ছে আধপড়া বইয়ের সংখ্যা। আজকাল সবচেয়ে বেশী অভাববোধ করি সময়ের। শেষবেলায় অনেকগুলো না পড়া বই রেখে যেতে হবে হয়তো।
No comments:
Post a Comment