ওশিনের স্কুল নিয়ে বিরাট টেনশান ওর মায়ের। মেয়ে স্কুলে ভর্তি হবে সেজন্য মায়েরা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো প্রস্তুতি নেয়। খুকীর টেনশান দেখে আমি মুখটিপে হেসেছি। মেট্রিক পরীক্ষা দেবার সময় না জানি কিরকম করবে। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল বাংলা স্কুলে পড়াবো। আমি যেরকম স্কুলে পড়ে এসেছি সেরকম স্কুল। আমি আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর সরকারী প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৭৪ সালে। সাদামাটা স্কুল। যেটাকে ব্যঙ্গ করে কাউয়া স্কুল বলা হতো। সব ভাইবোন সেই স্কুলেই পড়েছি। কিন্তু এখানে ওরকম স্কুল কোথায় পাই। এখন আমরা কাজীর দেউড়ীতে। গলির ভেতর একটা স্কুল আছে অবশ্য। সরকারী প্রাইমারী। কিন্তু ওখানে দরিদ্র ছেলেমেয়েরা পড়ে, তাই ওখানে আমাদের সন্তানদের যেতে দেয়া হবে না। ওখানে কেবল টিকা দেবার জন্যই যাওয়া হয়।
কাছে পিঠে সিজিএস আর সেন্টমেরিস স্কুল আছে। সিজিএস ইংরেজী স্কুল, আর সেন্ট মেরিস যুদ্ধক্ষেত্র। আমি রাজী হলাম না। আমি প্রতিযোগিতার মারামারিতে নেই। সহজ একটা বাংলা স্কুল দরকার। যেখানে বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য বইয়ের বস্তা দেয়া হয় না। আনন্দের সাথে পড়াশোনা করানো হয়। ইংরেজী বাদে সেরকম স্কুল নাকি আর নাই। আমার কঠিন ইচ্ছে ইংরেজী স্কুলে পড়াবো না। কেন ইংরেজী স্কুলের বিপক্ষে সে ব্যাপারে ব্লগে প্রচুর লেখালেখি করেছি। এখানে লিখলাম না আর।
খুঁজতে গিয়ে কাছাকাছিই আরেকটা স্কুলের সন্ধান পেলাম। ফুলকি। এই স্কুলের নাম শুনেছিলাম। কিন্তু কোথায় কিভাবে পড়ায় জানতাম না। খবর নিয়ে জানলাম আমি যেরকম স্কুল চাই এটি সেরকম একটি স্কুল। কেবল খেলার মাঠ নেই। স্কুলের অবস্থানটাও চমৎকার জায়গায়। নন্দনকাননে, ডিসি হিলের উল্টোদিকে।
View Larger Map
খেলার মাঠ নেই এটাকে মেনে নিয়ে তাই ফুলকি থেকেই ভর্তি ফরম নিলাম।
ভর্তি পরীক্ষার দিন ছিল কঠিন একটা দিন। সে কিছুতেই পরীক্ষা দিতে একা ঢুকবে না। বাবা মা সহ ঢুকতে হবে। দুটোর সময় ওর পরীক্ষার শিডিউল ছিল। শেষে ছটার সময় সবার শেষে বাবা-মা সহ ওশিন মাহিয়াত ইতিহাস সৃষ্টি করে ইন্টারভিউ দিতে ঢুকলো। ইন্টারভিউ ভালো দিল। রেজাল্ট বের হলে দেখি, পাশ করেছে। দেরী না করে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে ফেললাম।
স্কুল পেলাম। পরীক্ষা দিল। পাশ করলো। ভর্তি হলো। ভাবলাম টেনশান গেল। কিন্তু না। এবার নতুন টেনশান। যে মেয়ে পরীক্ষা দিতে ঢোকেনি পাচ মিনিটের জন্য, সে কি করে স্কুলে ক্লাস করবে।
১০ জানুয়ারী থেকে স্কুলে ক্লাস শুরু। ওর মা ওর ফুপু দুজনে মিলে নিয়ে গেল। নাহ। কিছুতেই ক্লাসে ঢুকলো না। কান্নাকাটি করে গেটের বাইরে চলে এল। প্রথমদিন পুরো ব্যর্থ।
স্কুলের প্রথম দিন। বিশেষ একটা দিন। মহাসমারোহে ওশিন বিদায় নিচ্ছে দাদুর কাছ থেকে।
...........................
ফুপুর সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে
......................
ওশিনদের স্কুলের গলি। গলিমুখ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ডিসি হিল পার্কের আভাস। স্কুলটা ডিসি হিলের উল্টোদিকের ঢালে অবস্থিত।
............................
স্কুলের প্রথমদিন। স্কুলের সিড়িঘরে বসা মা মেয়ে দুজন। ওর মা ওশিনকে বুঝিয়ে ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ওশিনের চেপে রাখা ঠোটদুটো বলে দিচ্ছে। 'কিচ্ছুতেই যাব্বো নাহ'!!!
দ্বিতীয় দিন আবারো চেষ্টা করা হলো। এবার বারান্দা পর্যন্ত গিয়েই ফিরে এল। খুকী হতাশ। আমি আশাবাদী। ৩য় দিন ক্লাসে ঢুকলো অবশেষে। খুশী মনে ফিরে এল। বললো, স্কুলটা খুব ভালো, টিচার খুব আদর করেছে, খেলাধুলা বাদে কোন পড়ালেখা নেই। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কিন্তু ৪র্থ দিন আবারো বিগড়ালো। ফিরে চলে এল কান্নাকাটি করে। অনেক বুঝিয়ে ৫ম দিনে মোটামুটি রাজী করানো হলো। হলো ঢুকতে। ষষ্ঠ দিনেও গেল। ওর মার মুখে একটু হাসি ফুটেছে। কিন্তু আগামীদিন এখনো অনিশ্চিত। কিছুদিন এই টেনশান থাকবে। আগামী দিন ওশিন স্কুলে যাবে তো?
1 comment:
হ্যাঁ, প্রথমে যে মেয়ে স্কুলে ঢুকতেই চাইতো না, সেই মেয়ে এখন স্কুলের প্রেমে পড়ে গেছে। গতবছর ওশিন ফুলকি থেকে পিএসসি পাশ দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতেও পড়ছে। এই স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও পড়তে রাজী নয় সে। এটা নিয়ে আমরা একটু চিন্তিত বটে। ফুলকির হাইস্কুল এখনো শৈশব পেরোচ্ছে ওশিনদের মতো অল্প কয়েকজনকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত এখানে কী এসএসসি চালু হবে?
Post a Comment