১.
আকাশটা ঘোলা দেখাচ্ছে সকাল থেকে। মেঘ নয়, নীল নয়, ধোঁয়াশা। কঠিন উত্তাপ রাস্তার পিচ থেকে। আজ জব্বর আলী রাস্তায় নামতে ভরসা পাচ্ছে না। বিয়ারিং গাড়ীতে এই গরমে চলা অসম্ভব। দিনের সূচনাতেই ভ্রু কুঁচকালো। চম্পারানী ছাড়া সে অচল। কিন্তু চম্পার নষ্টামি ইদানীং তার চোখে অসহ্য লাগছে। চোখটা বন্ধ করেও শান্তি নেই। খিলখিল হাসিতে মাথায় ঝিম ধরিয়ে দেয়। কারণ সে হাসে অন্য কোন গন্তব্যে।
কালকের ঘটনাটা এখনো পোড়াচ্ছে। তুচ্ছ ব্যাপার। কিন্তু কঠিন।
জব্বর আলী দুপুরে ভাতঘুমে ফুটপাতের পাশে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছিল। কাল ভিক্ষারও বরকত হয়েছিল দিনভর। মনের সাথে পেটও ভরে ছিল। কিন্তু আধবোজা চোখ দিয়ে আড়চোখে দেখলো সেই ছোকরা পাশ দিয়ে যেতে যেতে চম্পারানীর দিকে তাকিয়ে আছে, যেন জীবনে মেয়েমানুষ দেখেনাই। ওই দৃষ্টি জব্বরালী চেনে। তাতেও কিছু এসে যেতো না। কিন্তু জব্বরালী চম্পার দিকে তাকিয়ে দেখলো সেও পরম মুগ্ধতা নিয়ে ছোকরার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। জীবনে য্যান পুরুষ মানুষ দেখে নাই।
চম্পার চোখে যে আলো, গন্ডে যে লালিমা, সেই লালিমায় জব্বরআলীর বুকের ভেতর আগুন ধরিয়ে দিল তৎক্ষনাৎ! আগুন!!! দাউ দাউ জ্বলে উঠলো। অক্ষম ক্রোধ। আগের সেই সুদিন থাকলে দায়ের এক কোপে কল্লা নামিয়ে দিত সে।
চিৎকার দিয়ে বলে, “ওই মাগী!!!!!!!!!!!!”
চম্পা ছ্যাঁত করে ফিরে জব্বারালীর দিকে। “কী হইছে, চিল্লাও ক্যান?”
“ভাত দে হারামজাদী” জব্বরালীর ভলিউম আরো বাড়তে থাকে।
“একটু আগে না ভাত খাইলা পোয়া মাছের ঝোল দিয়া? হোটেল থেকে আনলাম। এখন আবার ভাত পামু কই?”
জব্বর আলীর খিদা মোটেও নাই। তবু অসম্ভব কিছু একটা চেয়ে তার জিদকে জানান দেয়া। যাতে ব্যর্থ হলে চম্পারানীকে গালি দেয়ার অজুহাত বের করা যায়।
“যেখান থেকে পারস সেখান থেকে আনবি, আমার ভাত চাই, মুরগীর সালুন চাই”
'মুরগীর সালুন' কথাটা এইমাত্র মাথায় এলো। ভাত পেলেও এই বেলায় মুরগীর সালুন পাবে না। দিলাম আটকায়া। যাবি কই? জব্বারালী সন্তুষ্ট চিত্তে তাকায় চম্পারানীর দিকে।
ছোকরাটা ততক্ষণে ভেগেছে। আজই প্রথম নয়। গত কয়েকদিন ধরে খেয়াল করছে। জব্বর আলীর থালায় একটা টাকা দিয়ে চম্পার দিকে আদুরে দৃষ্টিতে তাকায়। ভিক্ষা দেয়া অজুহাত মাত্র, খেয়াল তার অন্য।
“আইচ্ছা, আনতেছি, বহো তুমি। মুরগার সালুন যোগাড় করি গিয়ে” চম্পারানী শীতল গলায় বলে।
এই কথাটা জব্বারালীর প্ল্যানটাকে দুরমুছ করে দিল। চম্পারানী এত চট করে রাজী হবে ভাবেনি সে। ফলে জিদটাকে আরো একধাপ বাড়িয়ে বললো, “এক বোতল কুকও আনবি ভাতের সাথে।”
রহস্যময় হাসি দিয়ে চম্পারানী বলে, “আইচ্ছা, আনতেছি”
......................................................................................
২.
চম্পারানী মুরগীর সালুনের ভাত আনতে গেলে জব্বরালী চোখ বুজে স্মৃতি চর্বন করতে থাকে।
দুধ্বর্ষ ডাকাত ছিল জব্বরালী। শান শওকত বাহিনী সব কিছু ছিল তার। বিয়ে থা করেনি। দরকারও হয়নি। নারীসঙ্গের প্রয়োজন মেটানো কোন ব্যাপার ছিল না। প্রচুর আকাম করছে ডাকাতি করতে গিয়ে। উত্তরবঙ্গে তার নামে পুলিশের লোম খাড়া হয়ে যেত। তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না হিংস্রতায়।
কিন্তু সবকিছুর শেষ আছে। একদিন ট্রেন ডাকাতি করে নেমে যাবার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে ট্রেনের চাকায় দুই পা হারালো। বিশ্বস্ত সহযোগীরা তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। বেঁচে থাকে কোন মতে। ডাকাতির পেশায় যবনিকাপাত তখনি। পরিচয় লুকিয়ে চলে আসে চট্টগ্রাম। স্টেশানে পঙ্গু ভিক্ষুকের সিন্ডিকেটে ঢুকে যায়। আসলে সিন্ডিকেটে ঢুকিয়ে দেয় তার এক সাগরেদ। সেখানেই চম্পারানীকে পায়। জানাশোনা হয়। জব্বারালী আসল পরিচয় গোপন করে বলে সে রাজমিস্ত্রী ছিল, ছাদ থেকে পড়ে পা হারিয়েছে।
সহানুভুতি আদায় করে চম্পার কাছ থেকে। চম্পা এলাকার নিশিকন্যা । কিন্তু পেশাটা তার অপছন্দ হলেও ছাড়তে পারছে না নির্ভর করার মতো একজন পুরুষ নেই বলে। দুনিয়ার পুরুষ মানুষের প্রতি চরম অভক্তি তার, কাকে বিশ্বাস করবে?
জব্বরকে দেখে তার বাপের বয়সী মনে হয়। আসলে জব্বরের বয়স আরো কম। দাড়িতে বয়স একটু বেশী লাগে পুরুষের। পরিচয়ের প্রথমদিকে চাচা বলে ডাকলে জব্বর রাগ করে। রাগের কারণ অনুমান করে চম্পা মনে মনে খুশীই হয়। পুরুষ মানুষের চোখ দেখে তার জানা হয় অনেক কিছু। তাই চাচা না ডেকে চুপ থাকে, কিছুই ডাকে না।
জব্বর তবুও খুশী। শ্রদ্ধাবোধের কারণে কিংবা ভিন্ন কোন কারনে চম্পারানী জব্বর আসার পর খদ্দেরের কাছে যাওয়া কমিয়ে দেয়। কিন্তু বাঁচতে হলে উপায় নেই। তবু কাজ সেরে যত রাতই হোক ফিরে আসে জব্বারলীর কাছে। পঙ্গু মানুষটার পাশে রাতের বেলা থাকাটা দায়িত্বের মতো হয়ে যায়। ভালোও লাগে।
কেউ একজন তার জন্য পথ চেয়ে আছে, অপেক্ষায় থাকে, এটা ভাবতেই চম্পারানীর সুখ। সে যা পারে এনে রান্না করে খাওয়ায়।
জব্বারলীর ভিক্ষার অংকও নেহায়েত কম নয়। যদিও সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতে হয় মোটা অংকের। তবে তার পুর্বের কিছু টাকা এখনো রয়ে গেছে জমা। গোপন একটা ঝোলাতে আছে সব টাকা। চম্পারানীর সাথে সম্পর্কটা অনিশ্চিত হলেও সে সাহস করে একদিন সে প্রস্তাব করে বসে, ‘চল চম্পা আমরা বিয়া করি।’
এই কথা শুনে চম্পা রাগ করে না বরং হেসে কুটি কুটি হয়ে পড়ে। “বুইড়া ব্যাটার বিয়ার শখ কত। ওই বুড়া, বিয়া করলে খামু কিতা। তোমার ভিক্ষার টাকায় আমার পেট তো চলবো না।”
“বিয়া করলে উপাস থাকবি কেন? তোর টাকায় তুই খাবি, আমার টাকায় আমি।”
“আমার টাকা? আমি টাকা পামু কই?”
“ক্যান, এহন যেরুম পাস সেরুম পাবি? তোর কাম ছাড়তে হইবো না। আমি তোরে মাসে মাসে টাকা দিমু। তুই হবি আমার চুক্তি বউ। যেদিন ভাল্লাগবো না চইলা যাবি।”
দপ করে চম্পারানীর আলো নিভে যায় যেন। এতদিন যে একটু আশা জেগেছিল জব্বারালীর কথায় তা কোথায় উবে যায়। জব্বারালী তাকে বিয়ে করবে কিন্তু তাকে শুতে হবে অন্যপুরুষের সঙ্গে? এ কেমন বিয়া? কেমন পুরুষ জব্বারালী? তাইলে বিয়ার কাম কি। জব্বার তার শইল চাইলেই তো পায়। পয়সা ছাড়াই পেতে পারে। সেকি জানে না? কেমন মরদ। ভীষন রাগ হয় চম্পার।
এরপর কয়দিন প্রসঙ্গটা উহ্য থাকে। চম্পারানী গম্ভীর। চুপচাপ কাজে যায়। ফিরে আসে মাঝরাতের পরপর। খাবার তৈরী করে জব্বারালীকে খাওয়ায়। জব্বারালীও কিছু বলে না আর। চম্পাকে ঘাটায় না আর।
সেদিন কাজ থেকে ফিরে চম্পা কেন যেন জব্বারালীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। যতই জিজ্ঞেস করা হোক কিছু বলে না সে। একসময় কান্না থামলে বলে, আমি তোমার বিয়াতে রাজী।
.............................................................................
৩.
পিঠের উপর খামচিসহকারে থেকে একটা জোরালো ধাক্কায় জব্বারালীর দিবাস্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। খনখনে একটা গলা শোনা যায়। কাধের উপর অচেনা হাতের স্পর্শ পেয়ে মাথা উচু করে তাকিয়ে দেখে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কোতোয়ালী মোড়ের ঘসেটি বেগম!! দস্যিরানী, ডাকাতনী। ফুটপাতের পুরা সাম্রাজ্য তার কব্জায়। সে কেন এখানে। তার কাছে? কি চায়? চম্পা কই? এতক্ষন আহেনা ক্যান। সে হুংকার দেয় প্রচন্ড জোরে,
“ওই চম্পা!!!!!! কই গেলি রে মাগী!! এতক্ষন লাগে ভাত আনতে?”
খনখনে গলাটা বলে ওঠে, “চম্পারানী আইবো না আর। তোর পাখি উড়াল দিছে, যাওনের সুময় আমার কাছে তোরে বেইচা দিছে? তুই এখন আমার! যা ইনকাম করবি, অর্ধেক আমারে দিবি। ফাঁকি মারবি তো চোখ কানা কইরা দিমু। আমার চ্যালা সবখানে আছে। নে এলা চল !”
জব্বারালীর মাথার উপর থেকে আকাশের ছাউনিটা যেন সরে যায়। চার চাকার বিয়ারিংএর গাড়ীতে ঢলে পড়তে গিয়ে সামলে নেয়। আগামী দুর্বিষহ দিনগুলির অনিশ্চিত ভাবনায় চম্পারানীর স্মৃতি পালিয়ে বাঁচে। এখন নিজের প্রাণটা বাঁচাতে তৎপর হয় সে। ঘসেটি বেগমের কাছ থেকে কেউ নিস্তার পায় না। পঙ্গু ভিখারিদের সাক্ষাত যম। পাপের প্রায়শ্চিত্ত বোধহয় শুরু হলো তার।
Thursday, May 20, 2010
পাখি বাসন
হঠাৎ একটা পাখির কথা মনে পড়ছে আজ। নিঃসঙ্গ পাখিটা সবুজ বাঁশের জঙ্গলে নির্জন দুপুরে লাল ঠোঁট নিয়ে চুপ করে বসে থাকতো। দিনরাত একই জায়গায় বসে থাকতো সে। পাখিটা আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে স্পষ্ট স্মৃতি। একদিন সেই পাখিটার জন্য মাকেও ত্যাগ করেছিলাম। সেই গল্পটাই বলি আজ মা দিবসে।
চাটগাঁর ভাষায় ভাতের প্লেটকে বলে 'বাসন'। যে পাখিটার কথা বললাম সেই পাখিটা দাদা বাড়ির একটা বাসনের উপর আঁকা ছিল। সাদা টিনের প্লেটের উপর সবুজ বাঁশবনে লাল ঠোঁট নিয়ে বসে থাকা নীলচে শালিকটা আমাদের এত প্রিয় ছিল যে ওই বাসনে ভাত খেতে পারার বিনিময়ে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারতাম।
আমার তখন ৩/৪বছর বয়স। সেবার মার সাথে নানা বাড়ীতে গেছি বেড়াতে। বেশ কিছুদিন পর একদিন ছোট চাচা গেল আমাদের দেখতে। চাচা গল্পগুজব করে খেয়েদেয়ে ফিরে আসার সময় আমাকে বললো, "দাদাবাড়ি যাবি? পাখি বাসনে ভাত খেতে পারবি।"
আমি মাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাইনি। একা থাকিনি একদিনও। কিন্তু সেদিন পাখি বাসনের কথা শুনে আমার চিত্তটা রোমাঞ্চে এতই উত্তেজিত হলো যে আমি মার কথা দিব্যি ভুলে গিয়ে বললাম, "যাবো!!"
চাচার সাথে দাদা বাড়ী চলে গেলাম। রাতে ঘুমোলাম দাদার সাথে গল্প করে। পরদিন সকাল থেকে দাদার সাথে হাটে মাঠে ঘুরে বেড়াই। ক্ষেতে গিয়ে শাক সবজী দেখি। পুকুরে গিয়ে ইচ্ছে মতো পানি ঝাপটা ঝাপটি করি। স্বাধীনতার আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করি। দুপুরে গোসল সেরে ভাত খেতে বসলাম পাটি বিছিয়ে। পাখি বাসন দেয়া হলো। ভাত দেয়া হলো। মাছ দেয়া হলো, শাক দেয়া হলো। আমার প্রিয় সকল উপাদান উপস্থিত। কিন্তু পাখি বাসনে অনেকক্ষণ হাত নেড়ে চেড়েও মুখে ভাত উঠছে না। দাদা আদর করে বললো, "মজা করে খা। আজকে পাখি বাসনে তুই একাই খাবি। কেউ বিরক্ত করবে না। আমি খাইয়ে দেই?"
আমি পাখি বাসনটা নিয়ে বসেই থাকি। এত প্রিয় বাসন, এত প্রিয় খাবার। সব আছে কিন্তু আমার চোখটা কেমন জ্বলছে। কাউকে কিছু বলছি না। কেন জ্বলছে তাও বুঝতে পারছি না। কিন্তু পাখি বাসনে ভাত খাবার আগের আনন্দটা যেন পাচ্ছি না। ঠিক জুত হচ্ছে না। দাদার হাতে দু চার গ্রাস খেয়ে উঠে পড়লাম। ওরা ভাবলো আমি খালে বিলে দৌড়ঝাঁপ করে আর হাবিজাবি খেয়ে রুচি নষ্ট করে ফেলেছি।
বিকেলে চাচার হাত ধরে মরিচ ক্ষেতে গেলাম। লাল লাল মরিচ ধরে আছে সেখানে। অন্যপাশে পাকা টমেটোর ক্ষেত। এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। এখানে এসে ইচ্ছে মতো ধুলো ময়লা ঘাঁটা যায়। আজকে ধুলো ময়লা ঘেঁটেও ঠিক আনন্দ পাচ্ছি না।
ক্ষেতের বেড়ায় হাত দিয়ে কাচা রাস্তাটা যেখানে বড় রাস্তার সাথে মিশেছে সেদিকে তাকিয়ে আছি। ওদিক থেকে কেউ আসার কথা না আজ। তবু তাকিয়ে আছি। অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা বোরকার পরা মানুষের অবয়ব চোখে পড়লো। কে সে। এক সেকেন্ড ভালো করে দেখলাম। চিনতে আমার মুহূর্তও ভুল হলো না।
"মা!!!" বলে চিৎকার করে ছুটতে শুরু করলাম!!! দিগন্ত ছাড়িয়ে ছুটে যাবো যেন। কাছে গিয়ে এক লাফে মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করলাম, "আমার পাখি বাসন চাই না আর, আমি তোমাকে চাই মা, আমার তোমাকে চাই!!"
মা বাপের বাড়ির সফর সংক্ষিপ্ত করে চলে এসেছিল আমার জন্য।
মাকে দেখার আগে বুঝতেই পারিনি সেই প্রিয় 'পাখি বাসন'টি এত সাধারন হয়ে গিয়েছিল কেন?
চাটগাঁর ভাষায় ভাতের প্লেটকে বলে 'বাসন'। যে পাখিটার কথা বললাম সেই পাখিটা দাদা বাড়ির একটা বাসনের উপর আঁকা ছিল। সাদা টিনের প্লেটের উপর সবুজ বাঁশবনে লাল ঠোঁট নিয়ে বসে থাকা নীলচে শালিকটা আমাদের এত প্রিয় ছিল যে ওই বাসনে ভাত খেতে পারার বিনিময়ে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারতাম।
আমার তখন ৩/৪বছর বয়স। সেবার মার সাথে নানা বাড়ীতে গেছি বেড়াতে। বেশ কিছুদিন পর একদিন ছোট চাচা গেল আমাদের দেখতে। চাচা গল্পগুজব করে খেয়েদেয়ে ফিরে আসার সময় আমাকে বললো, "দাদাবাড়ি যাবি? পাখি বাসনে ভাত খেতে পারবি।"
আমি মাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাইনি। একা থাকিনি একদিনও। কিন্তু সেদিন পাখি বাসনের কথা শুনে আমার চিত্তটা রোমাঞ্চে এতই উত্তেজিত হলো যে আমি মার কথা দিব্যি ভুলে গিয়ে বললাম, "যাবো!!"
চাচার সাথে দাদা বাড়ী চলে গেলাম। রাতে ঘুমোলাম দাদার সাথে গল্প করে। পরদিন সকাল থেকে দাদার সাথে হাটে মাঠে ঘুরে বেড়াই। ক্ষেতে গিয়ে শাক সবজী দেখি। পুকুরে গিয়ে ইচ্ছে মতো পানি ঝাপটা ঝাপটি করি। স্বাধীনতার আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করি। দুপুরে গোসল সেরে ভাত খেতে বসলাম পাটি বিছিয়ে। পাখি বাসন দেয়া হলো। ভাত দেয়া হলো। মাছ দেয়া হলো, শাক দেয়া হলো। আমার প্রিয় সকল উপাদান উপস্থিত। কিন্তু পাখি বাসনে অনেকক্ষণ হাত নেড়ে চেড়েও মুখে ভাত উঠছে না। দাদা আদর করে বললো, "মজা করে খা। আজকে পাখি বাসনে তুই একাই খাবি। কেউ বিরক্ত করবে না। আমি খাইয়ে দেই?"
আমি পাখি বাসনটা নিয়ে বসেই থাকি। এত প্রিয় বাসন, এত প্রিয় খাবার। সব আছে কিন্তু আমার চোখটা কেমন জ্বলছে। কাউকে কিছু বলছি না। কেন জ্বলছে তাও বুঝতে পারছি না। কিন্তু পাখি বাসনে ভাত খাবার আগের আনন্দটা যেন পাচ্ছি না। ঠিক জুত হচ্ছে না। দাদার হাতে দু চার গ্রাস খেয়ে উঠে পড়লাম। ওরা ভাবলো আমি খালে বিলে দৌড়ঝাঁপ করে আর হাবিজাবি খেয়ে রুচি নষ্ট করে ফেলেছি।
বিকেলে চাচার হাত ধরে মরিচ ক্ষেতে গেলাম। লাল লাল মরিচ ধরে আছে সেখানে। অন্যপাশে পাকা টমেটোর ক্ষেত। এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। এখানে এসে ইচ্ছে মতো ধুলো ময়লা ঘাঁটা যায়। আজকে ধুলো ময়লা ঘেঁটেও ঠিক আনন্দ পাচ্ছি না।
ক্ষেতের বেড়ায় হাত দিয়ে কাচা রাস্তাটা যেখানে বড় রাস্তার সাথে মিশেছে সেদিকে তাকিয়ে আছি। ওদিক থেকে কেউ আসার কথা না আজ। তবু তাকিয়ে আছি। অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা বোরকার পরা মানুষের অবয়ব চোখে পড়লো। কে সে। এক সেকেন্ড ভালো করে দেখলাম। চিনতে আমার মুহূর্তও ভুল হলো না।
"মা!!!" বলে চিৎকার করে ছুটতে শুরু করলাম!!! দিগন্ত ছাড়িয়ে ছুটে যাবো যেন। কাছে গিয়ে এক লাফে মাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করলাম, "আমার পাখি বাসন চাই না আর, আমি তোমাকে চাই মা, আমার তোমাকে চাই!!"
মা বাপের বাড়ির সফর সংক্ষিপ্ত করে চলে এসেছিল আমার জন্য।
মাকে দেখার আগে বুঝতেই পারিনি সেই প্রিয় 'পাখি বাসন'টি এত সাধারন হয়ে গিয়েছিল কেন?
কক্সবাজার সৈকতের উৎপাতঃ আমি রক্ষা পেয়েছি, আপনি নাও পেতে পারেন
হতে পারতো জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর স্মৃতিলেখা এটি। আজ হয়নি, আমার হয়নি। কিন্তু আগামীকাল আরেকজনের জীবনের ভয়ংকর ঘটনা হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। প্রথমে ভ্রমনের গল্পটি বলি।
সেদিন হুট করে কক্সবাজার চলে গেলাম দুদিনের জন্য। বৈশাখের গরমে সমুদ্র মন্থন করবো বলে নয়। সবচেয়ে বড় কারণ আমার সাড়ে তিন বছরের শিশুকন্যাটির সমুদ্র দেখার সাধ পুরণ। সুযোগ পাচ্ছিলাম না অনেকদিন। সেদিন সুযোগ এলো তাই দুটো দিন নিরিবিলি কাটাবো বলে সপরিবারে চলে গেলাম। কিন্তু ভবিতব্য বড় অনিশ্চিত, বড্ড বেরসিক।
কক্সবাজার গিয়ে পৌঁছুলাম দুপুরে। হোটেলে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের হালকা রোদে সমুদ্রের দিকে রওনা দিলাম হেঁটে হেঁটে। শুরু হলো আনন্দ ভ্রমণ।
১. জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখতে এসেছে ওশিন। নিরাপদ সৈকতের অপূর্ব শোভা দেখতে দেখতে হাঁটছে।
২. ঢেউয়ের সাথে সাথে সৈকতে ছুটোছুটি করছে উচ্ছ্বসিত ওশিন
৩. বাবার হাত শক্ত করে ধরে আছে যদি ঢেউ এসে টেনে নিয়ে যায়
৪. কেবল মানুষ নয় শহুরে কাকও সমুদ্র দর্শনে বিমুগ্ধ
৫. গরমে ঝিম ধরে থাকা ঘোড়াটি যেন সমুদ্র স্নানে প্রস্তুত
৬. সৈকতে নাই কী? ফেরীওয়ালা, বাদামঅলা, ডাবঅলা, চা-কফিঅলার পাশাপাশি হীনস্বাস্থ্য ঘোড়াও। সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন উৎপাত দ্রুত ধাবমান সৈকত শকট।
৭.ধাবমান সৈকত শকটগুলো কখনো কখনো জলের কাছাকাছি বসা প্রেমিক জুটির ঘাড়ের উপর এসেও হাজির হয় ভটভট করে।
৮. সূর্যাস্ত সমাগত। মুগ্ধ চোখে ওশিন তাকিয়ে দিগন্তের পানে। তখনো সে জানে না পাঁচ মিনিট পরেই তার এই আনন্দের সমাপ্তি ঘটবে।
খানিক পরেই সূর্যটা পাটে বসবে। কী অপরূপ দৃশ্য হবে তখন প্রকৃতিতে!! আজকের আকাশটাও অদ্ভুত মায়াবী সুন্দর। এমন দৃশ্য ওশিন কখনো দেখেনি আগে। সমুদ্রের সাথে রাঙ্গানো আকাশের মিতালী।
কন্যার এই বিরল আনন্দকে স্মৃতির ছবিতে ধারন করতে ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত তার বাবাও। গলায় ঝোলানো ক্যামেরার ব্যাগটা ওদিকে রেখে আসার জন্য কন্যাকে দাঁড় করিয়ে সামনে দুপা বাড়ায় বাবা। কিন্তু পেছন ফিরতে না ফিরতেই পেছন থেকে ওশিনের প্রাণ উপড়ে নেয়া তীক্ষ্ণ চীৎকার, "বাবাআআআআআ!!!"
মুহুর্তে ঘুরে তাকিয়ে দেখে সৈকতের ওই দ্রতগামী শকটের একটি এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার প্রিয়তম শিশুকন্যার ফর্সা নরম শরীরের উপর। মাথাটা ঘুরে উঠলো বাবার। চীৎকার করে ছুটে গেল কন্যার দিকে। এ কী হয়ে গেল? এটা কী ঘটলো? কি করে ঘটলো? বালিতে শরীর গেঁথে পড়ে কাতরাচ্ছে মাত্র এক মিনিট আগেও হাসিখুশি উচ্ছল শিশুটি। কোথা দিয়ে রক্ত পড়ছে তাকিয়ে দেখারও সাহস পেল না বাবা। আনন্দ ভ্রমনে নিমেষে নেমে এলো ঘোর অমাবস্যা।
স্রেফ কপাল জোরে আমার কন্যা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল সেদিন। কোথায় সমুদ্র, কোথায় সূর্যাস্ত সব চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেছিল সেদিন। কক্সবাজার ভ্রমণের পুরো আনন্দকে বিষাদে পরিণত করলো মাত্র এক সেকেন্ডের একটা ধাক্কা।
ঘটনা ওখানেই শেষ নয়। পরদিন সকালে আমার কলিগের একই বয়সী কন্যার উপর দিয়ে আরেকটা গাড়ী চড়ে বসলো আরো ভয়ংকর ভাবে। সেই মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। এখনো মেয়েটা কথা বলতে পারছে না স্বাভাবিকভাবে, ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে খানিক পরপর।
নিজের ঘাড়ে আসা দুটো ঘটনা। নিশ্চয়ই এরকম আরো অদেখা অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিদিন।
আমার প্রশ্ন সমুদ্র সৈকতের মতো নিরাপদ জায়গায় গাড়ী চালাবার অনুমতি দেয়া হয় কেন?
নাকি অনুমতি ছাড়াই চলে গাড়ীগুলো। মানুষের ভীড়ের আশপাশ দিয়ে ভয়ংকর দ্রুতগতিতে ছুটে যায় গাড়ীগুলো। নিয়ন্ত্রণের কোন কতৃপক্ষ আছে কি? আমার মেয়ের কিছু হলে আমি কি করতাম? আরো কতজন এরকম দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে কে জানে।
আজ আমি ভাগ্যক্রমে কন্যাকে জীবিত পেয়েছি। আরেকজন নাও পেতে পারে। পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। এদেশে অনুমতি ছাড়া অনেক কিছু করা হয়। পর্যটন কতৃপক্ষ বলে যারা আছে তাদের কি এসবে কোন ভূমিকা আছে?
আমরা এই অনিরাপদ সৈকতকে বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের তালিকায় রাখার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম?
সেদিন হুট করে কক্সবাজার চলে গেলাম দুদিনের জন্য। বৈশাখের গরমে সমুদ্র মন্থন করবো বলে নয়। সবচেয়ে বড় কারণ আমার সাড়ে তিন বছরের শিশুকন্যাটির সমুদ্র দেখার সাধ পুরণ। সুযোগ পাচ্ছিলাম না অনেকদিন। সেদিন সুযোগ এলো তাই দুটো দিন নিরিবিলি কাটাবো বলে সপরিবারে চলে গেলাম। কিন্তু ভবিতব্য বড় অনিশ্চিত, বড্ড বেরসিক।
কক্সবাজার গিয়ে পৌঁছুলাম দুপুরে। হোটেলে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের হালকা রোদে সমুদ্রের দিকে রওনা দিলাম হেঁটে হেঁটে। শুরু হলো আনন্দ ভ্রমণ।
১. জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখতে এসেছে ওশিন। নিরাপদ সৈকতের অপূর্ব শোভা দেখতে দেখতে হাঁটছে।
২. ঢেউয়ের সাথে সাথে সৈকতে ছুটোছুটি করছে উচ্ছ্বসিত ওশিন
৩. বাবার হাত শক্ত করে ধরে আছে যদি ঢেউ এসে টেনে নিয়ে যায়
৪. কেবল মানুষ নয় শহুরে কাকও সমুদ্র দর্শনে বিমুগ্ধ
৫. গরমে ঝিম ধরে থাকা ঘোড়াটি যেন সমুদ্র স্নানে প্রস্তুত
৬. সৈকতে নাই কী? ফেরীওয়ালা, বাদামঅলা, ডাবঅলা, চা-কফিঅলার পাশাপাশি হীনস্বাস্থ্য ঘোড়াও। সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন উৎপাত দ্রুত ধাবমান সৈকত শকট।
৭.ধাবমান সৈকত শকটগুলো কখনো কখনো জলের কাছাকাছি বসা প্রেমিক জুটির ঘাড়ের উপর এসেও হাজির হয় ভটভট করে।
৮. সূর্যাস্ত সমাগত। মুগ্ধ চোখে ওশিন তাকিয়ে দিগন্তের পানে। তখনো সে জানে না পাঁচ মিনিট পরেই তার এই আনন্দের সমাপ্তি ঘটবে।
খানিক পরেই সূর্যটা পাটে বসবে। কী অপরূপ দৃশ্য হবে তখন প্রকৃতিতে!! আজকের আকাশটাও অদ্ভুত মায়াবী সুন্দর। এমন দৃশ্য ওশিন কখনো দেখেনি আগে। সমুদ্রের সাথে রাঙ্গানো আকাশের মিতালী।
কন্যার এই বিরল আনন্দকে স্মৃতির ছবিতে ধারন করতে ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত তার বাবাও। গলায় ঝোলানো ক্যামেরার ব্যাগটা ওদিকে রেখে আসার জন্য কন্যাকে দাঁড় করিয়ে সামনে দুপা বাড়ায় বাবা। কিন্তু পেছন ফিরতে না ফিরতেই পেছন থেকে ওশিনের প্রাণ উপড়ে নেয়া তীক্ষ্ণ চীৎকার, "বাবাআআআআআ!!!"
মুহুর্তে ঘুরে তাকিয়ে দেখে সৈকতের ওই দ্রতগামী শকটের একটি এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার প্রিয়তম শিশুকন্যার ফর্সা নরম শরীরের উপর। মাথাটা ঘুরে উঠলো বাবার। চীৎকার করে ছুটে গেল কন্যার দিকে। এ কী হয়ে গেল? এটা কী ঘটলো? কি করে ঘটলো? বালিতে শরীর গেঁথে পড়ে কাতরাচ্ছে মাত্র এক মিনিট আগেও হাসিখুশি উচ্ছল শিশুটি। কোথা দিয়ে রক্ত পড়ছে তাকিয়ে দেখারও সাহস পেল না বাবা। আনন্দ ভ্রমনে নিমেষে নেমে এলো ঘোর অমাবস্যা।
স্রেফ কপাল জোরে আমার কন্যা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল সেদিন। কোথায় সমুদ্র, কোথায় সূর্যাস্ত সব চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেছিল সেদিন। কক্সবাজার ভ্রমণের পুরো আনন্দকে বিষাদে পরিণত করলো মাত্র এক সেকেন্ডের একটা ধাক্কা।
ঘটনা ওখানেই শেষ নয়। পরদিন সকালে আমার কলিগের একই বয়সী কন্যার উপর দিয়ে আরেকটা গাড়ী চড়ে বসলো আরো ভয়ংকর ভাবে। সেই মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। এখনো মেয়েটা কথা বলতে পারছে না স্বাভাবিকভাবে, ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে খানিক পরপর।
নিজের ঘাড়ে আসা দুটো ঘটনা। নিশ্চয়ই এরকম আরো অদেখা অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিদিন।
আমার প্রশ্ন সমুদ্র সৈকতের মতো নিরাপদ জায়গায় গাড়ী চালাবার অনুমতি দেয়া হয় কেন?
নাকি অনুমতি ছাড়াই চলে গাড়ীগুলো। মানুষের ভীড়ের আশপাশ দিয়ে ভয়ংকর দ্রুতগতিতে ছুটে যায় গাড়ীগুলো। নিয়ন্ত্রণের কোন কতৃপক্ষ আছে কি? আমার মেয়ের কিছু হলে আমি কি করতাম? আরো কতজন এরকম দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে কে জানে।
আজ আমি ভাগ্যক্রমে কন্যাকে জীবিত পেয়েছি। আরেকজন নাও পেতে পারে। পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। এদেশে অনুমতি ছাড়া অনেক কিছু করা হয়। পর্যটন কতৃপক্ষ বলে যারা আছে তাদের কি এসবে কোন ভূমিকা আছে?
আমরা এই অনিরাপদ সৈকতকে বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের তালিকায় রাখার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম?
দ্বিতীয় দেখা লেটেষ্ট কম্পিউটার
চল চল চল/ ওরে তরুন দল/ তোদেরকে বোকা বানিয়ে/ যত্তসব আইবুড়োদের দল
ভয়ের কারন নাই। কবিতা লেখার অপচেষ্টা হচ্ছে না। আরেকটা টেকি গল্প। কম্পিউটারের ভুত স্মৃতি নিয়ে।
চাকরীতে ঢোকার সময় প্রথম মিথ্যাটা বলেছিলাম কম্পিউটার নিয়ে। অফিসে একখানা লেটেষ্ট কম্পিউটার কেনা হয়েছিল। ব্রান্ড Acer মডেল 486 সাথে আরো নানা ধরনের আপডেট জিনিস। নতুন ফিচার উইনডোজ ৩.১ এবং সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা এটি সম্পূর্ণ রঙ্গিন। এত চোখা জিনিস দেখে আমার ২৮৬ পিসিতে করা ৭ দিনের কোর্সের জ্ঞান ভিরমি খেল।
ফলে অফিসে জয়েন করার পর বড় সাহেব যখন জিজ্ঞেস করলো কে কে কম্পিউটার জানে, আমি 'জীবনেও কম্পিউটার দেখি নাই' বলে সবার পেছনে লুকিয়ে থাকলাম। যে কয়েকজন কম্পিউটার জানে বলে হাত তুললো তাদেরকে লম্বা দিস্তা কাগজের শিট ধরিয়ে দেয়া হলো কাজ করার জন্য। আমি মনে মনে বললাম, “মরগে তোরা, আমি বাঁচলাম”।
কম্পুজ্ঞানী কলিগরা ভেবেছিল ‘কম্পু পারি’ বললে বস খাতির করবে, বেতন ভাতা বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু লম্বা কাগজের দিস্তা দেখে ‘জেনারেল’ এসির বাতাসেও ঘামতে থাকলো এবং রাত বারোটায়ও কাজ অসম্পূর্ণ রেখে বাড়ী ফিরতে লাগলো। আমি কম্পুজ্ঞান লুকিয়ে রাখছিলাম ঠিকই কিন্তু মাঝে মধ্যে উকি দিয়ে দেখি কিভাবে কি করে। খেয়াল করে দেখলাম ওই কম্পুজ্ঞানীরা টাইপ কাজে আমার চেয়ে পিছিয়ে এবং লোটাস জ্ঞান খুবই দুর্বল। দুর্বলকে সাহায্য করার নৈতিক মানসে একদিন দুপুরবেলা বললাম আমি একটু ‘ট্রাই করি’।
দেখা গেল আমার ‘ট্রাই’ ওদের চেয়ে দ্রুত হচ্ছে। বসের অগোচরে ওদের কাজে সাহায্য করার অনুরোধ পেলাম। কিন্তু একদিন কাজ শেষে পেছনে ফিরে দেখলাম বস খাড়া আমার পেছনে। ভয়ে আমার শিরদারা টনটন করতে লাগলো। কারণ বসের পরবর্তী সংলাপগুলো হুমকিমূলক।
-কি করো তুমি এখানে, কম্পিউটার জানো না, কিন্তু অন্যের কাজে বিঘ্ন ঘটাও কেন? গেম খেলতে বসেছো নাকি?
-গেম? তাওবা। কাজের জায়গায় গেম খেলবো কেন? কিসের গেম?
-ন্যাকামি করো? ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানো না?
-সত্যি জানি না স্যার
-শাট আপ
-সরি স্যার
-তুমি ভালো করেই জানো লেটেষ্ট কম্পিউটারে সব ধরনের গেম লোড করা থাকে। কিন্তু খবরদার ভুলেও ওসব কখনো খেলবে না। এটা কাজের জায়গা। খেলাধুলার মাঠ নয়।
-কিন্তু কোথায় সেগুলা? আমি নিজেও খেলাধুলা পছন্দ করিনা কাজের সময়। খালি একবার দেখিয়ে দেন। জীবনেও যাবো না ওদিকে।
-আচ্ছা দেখাচ্ছি। বাট বি কেয়ারফুল। ডোন্ট এভার ওপেন দোজ গেমস!
তারপর বস একটা কমান্ড দিলে উইন্ডোজ ৩.১ খুললো। তারপর আরেকটা ক্লিক করলো। তারপর আরেকটা মেনু এলো। তারপর দেখা গেল নানা রকম তাস খেলা, মাইন সুইপার, আরো কি কি। সবাই মনযোগ দিয়ে দেখলাম। নোট করে নিলাম।
বস বললো, মনে থাকবে তো?
আমরা বললাম, ইয়েস স্যার। আলবত থাকবে।
আসলেই মনে থেকেছিল কিভাবে গেম সেকশান খুলতে হয়। সেদিন সন্ধ্যা থেকে নিয়ম করে দুই ঘন্টা কম্পিউটারে পালাক্রমে তাস খেলা চলতে লাগলো। অফিসে এতদিন পর একটা আনন্দের জায়গা পাওয়া গেল। ভার্সিটি ছাড়ার পর তাস খেলার সুযোগ হয় নাই আর।
পাগল তুই সাঁকো নাড়িস না রে।
ভয়ের কারন নাই। কবিতা লেখার অপচেষ্টা হচ্ছে না। আরেকটা টেকি গল্প। কম্পিউটারের ভুত স্মৃতি নিয়ে।
চাকরীতে ঢোকার সময় প্রথম মিথ্যাটা বলেছিলাম কম্পিউটার নিয়ে। অফিসে একখানা লেটেষ্ট কম্পিউটার কেনা হয়েছিল। ব্রান্ড Acer মডেল 486 সাথে আরো নানা ধরনের আপডেট জিনিস। নতুন ফিচার উইনডোজ ৩.১ এবং সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা এটি সম্পূর্ণ রঙ্গিন। এত চোখা জিনিস দেখে আমার ২৮৬ পিসিতে করা ৭ দিনের কোর্সের জ্ঞান ভিরমি খেল।
ফলে অফিসে জয়েন করার পর বড় সাহেব যখন জিজ্ঞেস করলো কে কে কম্পিউটার জানে, আমি 'জীবনেও কম্পিউটার দেখি নাই' বলে সবার পেছনে লুকিয়ে থাকলাম। যে কয়েকজন কম্পিউটার জানে বলে হাত তুললো তাদেরকে লম্বা দিস্তা কাগজের শিট ধরিয়ে দেয়া হলো কাজ করার জন্য। আমি মনে মনে বললাম, “মরগে তোরা, আমি বাঁচলাম”।
কম্পুজ্ঞানী কলিগরা ভেবেছিল ‘কম্পু পারি’ বললে বস খাতির করবে, বেতন ভাতা বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু লম্বা কাগজের দিস্তা দেখে ‘জেনারেল’ এসির বাতাসেও ঘামতে থাকলো এবং রাত বারোটায়ও কাজ অসম্পূর্ণ রেখে বাড়ী ফিরতে লাগলো। আমি কম্পুজ্ঞান লুকিয়ে রাখছিলাম ঠিকই কিন্তু মাঝে মধ্যে উকি দিয়ে দেখি কিভাবে কি করে। খেয়াল করে দেখলাম ওই কম্পুজ্ঞানীরা টাইপ কাজে আমার চেয়ে পিছিয়ে এবং লোটাস জ্ঞান খুবই দুর্বল। দুর্বলকে সাহায্য করার নৈতিক মানসে একদিন দুপুরবেলা বললাম আমি একটু ‘ট্রাই করি’।
দেখা গেল আমার ‘ট্রাই’ ওদের চেয়ে দ্রুত হচ্ছে। বসের অগোচরে ওদের কাজে সাহায্য করার অনুরোধ পেলাম। কিন্তু একদিন কাজ শেষে পেছনে ফিরে দেখলাম বস খাড়া আমার পেছনে। ভয়ে আমার শিরদারা টনটন করতে লাগলো। কারণ বসের পরবর্তী সংলাপগুলো হুমকিমূলক।
-কি করো তুমি এখানে, কম্পিউটার জানো না, কিন্তু অন্যের কাজে বিঘ্ন ঘটাও কেন? গেম খেলতে বসেছো নাকি?
-গেম? তাওবা। কাজের জায়গায় গেম খেলবো কেন? কিসের গেম?
-ন্যাকামি করো? ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানো না?
-সত্যি জানি না স্যার
-শাট আপ
-সরি স্যার
-তুমি ভালো করেই জানো লেটেষ্ট কম্পিউটারে সব ধরনের গেম লোড করা থাকে। কিন্তু খবরদার ভুলেও ওসব কখনো খেলবে না। এটা কাজের জায়গা। খেলাধুলার মাঠ নয়।
-কিন্তু কোথায় সেগুলা? আমি নিজেও খেলাধুলা পছন্দ করিনা কাজের সময়। খালি একবার দেখিয়ে দেন। জীবনেও যাবো না ওদিকে।
-আচ্ছা দেখাচ্ছি। বাট বি কেয়ারফুল। ডোন্ট এভার ওপেন দোজ গেমস!
তারপর বস একটা কমান্ড দিলে উইন্ডোজ ৩.১ খুললো। তারপর আরেকটা ক্লিক করলো। তারপর আরেকটা মেনু এলো। তারপর দেখা গেল নানা রকম তাস খেলা, মাইন সুইপার, আরো কি কি। সবাই মনযোগ দিয়ে দেখলাম। নোট করে নিলাম।
বস বললো, মনে থাকবে তো?
আমরা বললাম, ইয়েস স্যার। আলবত থাকবে।
আসলেই মনে থেকেছিল কিভাবে গেম সেকশান খুলতে হয়। সেদিন সন্ধ্যা থেকে নিয়ম করে দুই ঘন্টা কম্পিউটারে পালাক্রমে তাস খেলা চলতে লাগলো। অফিসে এতদিন পর একটা আনন্দের জায়গা পাওয়া গেল। ভার্সিটি ছাড়ার পর তাস খেলার সুযোগ হয় নাই আর।
পাগল তুই সাঁকো নাড়িস না রে।
প্রথম দেখা লেটেষ্ট কম্পিউটার
আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথমবারের মতো শুনতে পাই কম্পিউটার নামক আজব বস্তুটার কথা। এই যাদুকরী বাক্সটিতে নাকি হেন কিছু নাই পাওয়া যায় না। তখনো সচক্ষে কোন কম্পিউটার দেখিনি। কেবল শুনে শুনেই গপ্পো করি। টিভিতে তখন নাইট রাইডার সিরিজ চলছিল। গাড়ীর সাথে কথা বলে নাইট রাইডারের নায়ক মাইক। সকল প্রশ্নের উত্তর দেবার এবং তার সকল ক্ষমতার উৎস এই গাড়ীটা। আমার ধারনা হয় মাইক তার গাড়ীকে যেভাবে হুকুম দিয়ে চালায়, কম্পিউটার জিনিসটা নিশ্চয়ই সেরকম কোন বস্তু হবে। হুকুম দেবার সাথে সাথে পেট চিরে সকল তথ্য বেরিয়ে আসবে।
চট্টগ্রামে তখন কম্পিউটার মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শেখায়। জব্বার কাগুর আনন্দ কম্পিউটার আর সালমান কাগুর বেক্সিমকো। ভার্সিটির দুই বন্ধু এই দুই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহন করছে। দেখা হলেই বলে, 'দোস্ত পিছায়া পড়তেছ। এইটা এমন এক জিনিস, যা শিখতে একদিন দেরী করা মানে এক বছর পিছায়া যাওয়া।' আমাকে হিংসা লাগানোর জন্য বলতো না তবু আমার হিংসা হতো।
কিন্তু আমি নিরুপায়। বাপের হোটেলে খেয়ে পড়াশোনা চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। কম্পিউটারের কথা বললে বাপ চটকানা দেবে। প্রায় সব বন্ধু টিউশানি করে কিছু না কিছু আয় করে। একমাত্র আমিই ছিলাম ভাদাইম্যা। তাই কম্পিউটার থেকে জোর করে মনটারে সরিয়ে রাখি। আর রাতে ঘুমানোর আগে হিসেব করি, একটা দিন যায় এক বছর পিছাই...........একদিন সমান এক বছর....... পিছাতে পিছাতে পিথাগোরাসের রাজ্যে পৌঁছে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
আরো বেশ কবছর পর। ১৯৯২/৩ সাল বোধহয়। এক বন্ধু খবর আনে এলাকার এক বাসায় মুনীর নামের এক জুনিয়র ছেলে কম্পিউটার কিনেছে বাসায়। বড়লোকের পোলা শখ করলেই দুই লাখ টাকার কম্পিউটার পায়। সেই ছেলে নাকি একটা দুর্লভ সুযোগ দিয়েছে সস্তায় কম্পিউটার শেখার। শিখবা নাকি দুস্ত? আমি রাজী হবো কি হবো না বুঝতে পারছিলাম। রিস্ক নিলাম।
পড়াশোনা তখন অনার্স শেষের দিকে। এবার সাহস করে বাবাকে বললাম। বাবা হয়তো কম্পিউটারে ভবিষ্যত উজ্জ্বল দেখলো, রাজী হলো বিনা আপত্তিতে। মুনীরের বাসায় গিয়ে দেখি তিনতলা একটা বস্তু। ওই তিনে মিলে কম্পিউটার। বললো, এটি এখনকার সবচে লেটেষ্ট জিনিস। IBM 286 কম্পিউটার। আমেরিকায় এর পরের মডেলও চলে এসেছে। তবে এটির কনফিগারেশান খুব ভালো এখনো Processor: 4.77 MHz, Memory 256KB ফ্লপি ড্রাইভ ছিল কিনা মনে নাই।
কিন্তু এত লেটেস্ট জিনিসটা দেখে প্রণাম করার জন্য শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। হুকুম দিলেই কথা বলে এই জিনিস? আমার চোখে 'নাইট রাইডার' ভর করে।
আমাদের কোর্স হলো দুই বিষয়ে। এক হলো 'ওয়ার্ড পারফেক্ট', যেটা শিখলে দুনিয়ার তাবৎ কমিউনিকেশান করা যাবে। আরেকটা হলো লোটাস১২৩, এটা জানলে দুনিয়ার সকল হিসেব লিখে ফেলা যাবে। আমি নাইট রাইডার হবার স্বপ্নে বিভোর। বিশেষ কোন প্রশ্ন না করে বসে যাই শিখতে। দেড় হাজার টাকার কোর্স। পনেরো দিন। আমি বললাম, টাইম কম। সাত দিনে শিখায়া দিতে হবে।
বললো, 'অসুবিধা নাই। দিনে দুই পাতা করে গিলবেন।'
আমরা রাজী। তিনদিন ওয়ার্ড পারফেক্ট। তিনদিন লোটাস। শেষদিন ফিনিশিং টাচ।
সাত দিনে কোর্স করে চলে আসি দেড় হাজার টাকা দিয়ে। ফিরে আসার সময় একটা আলগা শক্তি এনে দেয় সাথের এক শিক্ষার্থী ছেলের সমাপনী বক্তব্য।
সেই ছেলেটি একটা বড় কোম্পানীর কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে চাকরী করতো। তার চাকরী চলে গেছে কদিন আগে কি যেন কারনে। সে নাকি আসার সময় রাগ করে সেই কম্পিউটারে এমন কিছু দিয়ে এসেছে যার বিষক্রিয়ায় সেই কোম্পানী দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। সে ছাড়া কেউ ওটাকে সারাতে পারবে না।
ওটা শুনে আমাদের নিজেকে তখন ইনক্রেডিবল হাল্ক মনে হয়। একসময় কারাতে শিখতাম আর কল্পনা করতাম ব্রুসলী হয়ে যাচ্ছি ছমাস বাদেই, কাল্পনিক শত্রুকে খতম করার সাথে বলতাম, 'আর জীবনে গায়ে হাত তুলবি তুই? এখন বুঝলি আমি কি জিনিস? সাবধান, পরের বার মাফ নাই।'
কম্পিউটারের সাত দিনের কোর্স করেও সেই রকম অনুভূতি হলো। আমার সঙ্গে তেড়ি বেড়ি করলে কম্পিউটারে এমন জিনিস ঢুকিয়ে দেবো তোমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। মনে মনে অনাগত চাকুরীদাতা বড় কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর সমীহ করা দৃষ্টিকে কল্পনা করলাম। অনার্স পাশ দিলেই চাকরী বসে থাকবে আমার জন্য। আমি আর পিছিয়ে পড়া মানুষ নই। কম্পিউটার পাশ দিছি। সেই বন্ধুর সাথে দেখা করার জরুরী তৃষ্ণা হলো। 'দোস্তওওওওওওওও, আমিও তোদের সাথে এগিয়ে যাচ্ছি। দিনে এক বছর করে আর পিছাবো না।'
[বাণীঃ কম্পিউটারের চেয়ে দ্রুততম বিবর্তন আর কোন প্রযুক্তিতে ঘটে নাই। আজিকে যা অত্যাধূনিক আগামী কল্য তাহা প্রাগৈতিহাসিক হইয়া যাইবে]
চট্টগ্রামে তখন কম্পিউটার মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শেখায়। জব্বার কাগুর আনন্দ কম্পিউটার আর সালমান কাগুর বেক্সিমকো। ভার্সিটির দুই বন্ধু এই দুই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহন করছে। দেখা হলেই বলে, 'দোস্ত পিছায়া পড়তেছ। এইটা এমন এক জিনিস, যা শিখতে একদিন দেরী করা মানে এক বছর পিছায়া যাওয়া।' আমাকে হিংসা লাগানোর জন্য বলতো না তবু আমার হিংসা হতো।
কিন্তু আমি নিরুপায়। বাপের হোটেলে খেয়ে পড়াশোনা চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। কম্পিউটারের কথা বললে বাপ চটকানা দেবে। প্রায় সব বন্ধু টিউশানি করে কিছু না কিছু আয় করে। একমাত্র আমিই ছিলাম ভাদাইম্যা। তাই কম্পিউটার থেকে জোর করে মনটারে সরিয়ে রাখি। আর রাতে ঘুমানোর আগে হিসেব করি, একটা দিন যায় এক বছর পিছাই...........একদিন সমান এক বছর....... পিছাতে পিছাতে পিথাগোরাসের রাজ্যে পৌঁছে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
আরো বেশ কবছর পর। ১৯৯২/৩ সাল বোধহয়। এক বন্ধু খবর আনে এলাকার এক বাসায় মুনীর নামের এক জুনিয়র ছেলে কম্পিউটার কিনেছে বাসায়। বড়লোকের পোলা শখ করলেই দুই লাখ টাকার কম্পিউটার পায়। সেই ছেলে নাকি একটা দুর্লভ সুযোগ দিয়েছে সস্তায় কম্পিউটার শেখার। শিখবা নাকি দুস্ত? আমি রাজী হবো কি হবো না বুঝতে পারছিলাম। রিস্ক নিলাম।
পড়াশোনা তখন অনার্স শেষের দিকে। এবার সাহস করে বাবাকে বললাম। বাবা হয়তো কম্পিউটারে ভবিষ্যত উজ্জ্বল দেখলো, রাজী হলো বিনা আপত্তিতে। মুনীরের বাসায় গিয়ে দেখি তিনতলা একটা বস্তু। ওই তিনে মিলে কম্পিউটার। বললো, এটি এখনকার সবচে লেটেষ্ট জিনিস। IBM 286 কম্পিউটার। আমেরিকায় এর পরের মডেলও চলে এসেছে। তবে এটির কনফিগারেশান খুব ভালো এখনো Processor: 4.77 MHz, Memory 256KB ফ্লপি ড্রাইভ ছিল কিনা মনে নাই।
কিন্তু এত লেটেস্ট জিনিসটা দেখে প্রণাম করার জন্য শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। হুকুম দিলেই কথা বলে এই জিনিস? আমার চোখে 'নাইট রাইডার' ভর করে।
আমাদের কোর্স হলো দুই বিষয়ে। এক হলো 'ওয়ার্ড পারফেক্ট', যেটা শিখলে দুনিয়ার তাবৎ কমিউনিকেশান করা যাবে। আরেকটা হলো লোটাস১২৩, এটা জানলে দুনিয়ার সকল হিসেব লিখে ফেলা যাবে। আমি নাইট রাইডার হবার স্বপ্নে বিভোর। বিশেষ কোন প্রশ্ন না করে বসে যাই শিখতে। দেড় হাজার টাকার কোর্স। পনেরো দিন। আমি বললাম, টাইম কম। সাত দিনে শিখায়া দিতে হবে।
বললো, 'অসুবিধা নাই। দিনে দুই পাতা করে গিলবেন।'
আমরা রাজী। তিনদিন ওয়ার্ড পারফেক্ট। তিনদিন লোটাস। শেষদিন ফিনিশিং টাচ।
সাত দিনে কোর্স করে চলে আসি দেড় হাজার টাকা দিয়ে। ফিরে আসার সময় একটা আলগা শক্তি এনে দেয় সাথের এক শিক্ষার্থী ছেলের সমাপনী বক্তব্য।
সেই ছেলেটি একটা বড় কোম্পানীর কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে চাকরী করতো। তার চাকরী চলে গেছে কদিন আগে কি যেন কারনে। সে নাকি আসার সময় রাগ করে সেই কম্পিউটারে এমন কিছু দিয়ে এসেছে যার বিষক্রিয়ায় সেই কোম্পানী দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। সে ছাড়া কেউ ওটাকে সারাতে পারবে না।
ওটা শুনে আমাদের নিজেকে তখন ইনক্রেডিবল হাল্ক মনে হয়। একসময় কারাতে শিখতাম আর কল্পনা করতাম ব্রুসলী হয়ে যাচ্ছি ছমাস বাদেই, কাল্পনিক শত্রুকে খতম করার সাথে বলতাম, 'আর জীবনে গায়ে হাত তুলবি তুই? এখন বুঝলি আমি কি জিনিস? সাবধান, পরের বার মাফ নাই।'
কম্পিউটারের সাত দিনের কোর্স করেও সেই রকম অনুভূতি হলো। আমার সঙ্গে তেড়ি বেড়ি করলে কম্পিউটারে এমন জিনিস ঢুকিয়ে দেবো তোমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। মনে মনে অনাগত চাকুরীদাতা বড় কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর সমীহ করা দৃষ্টিকে কল্পনা করলাম। অনার্স পাশ দিলেই চাকরী বসে থাকবে আমার জন্য। আমি আর পিছিয়ে পড়া মানুষ নই। কম্পিউটার পাশ দিছি। সেই বন্ধুর সাথে দেখা করার জরুরী তৃষ্ণা হলো। 'দোস্তওওওওওওওও, আমিও তোদের সাথে এগিয়ে যাচ্ছি। দিনে এক বছর করে আর পিছাবো না।'
[বাণীঃ কম্পিউটারের চেয়ে দ্রুততম বিবর্তন আর কোন প্রযুক্তিতে ঘটে নাই। আজিকে যা অত্যাধূনিক আগামী কল্য তাহা প্রাগৈতিহাসিক হইয়া যাইবে]
সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না
যুদ্ধ শেষ। দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। স্কুলে যাবার বয়স হয়নি আমার তখনো। পটিয়ায় দাদার বাড়ীতে গ্রামে থাকতাম। স্কুলে ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর সেই গ্রামটিতে শৈশবের চমৎকার ৪ বছর কেটেছে।
বলে রাখি, তখনকার দিনে প্রধান বিনোদন ছিল মাইক। আজকাল বিয়ে বাড়ীতে যেমন ব্যান্ডপার্টির আনাগোনা, তখনকার দিনে ছিল মাইক। সেই মাইকে এইচএমভি লেখা লং প্লে ডিস্কের গান বাজানো হতো। চালানো হতো হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দম দিয়ে। গ্রামের মাঠে মাঠে এলোপাতাড়ি ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই অনেক গানের ভিড়ে দুটো গানকে বারবার বাজতে শুনতাম কোন দুর গ্রামের মাইকে।
১) সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না, এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাবো...।
২) আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
'আমার সোনার বাংলা' যে জাতীয় সঙ্গীত, শ্রদ্ধার গান সেটা তখনই শিখেছিলাম বড়দের কাছ থেকে। কিন্তু অন্য গানটা কিসের গান সেটা কেউ বলে দিত না। ফলে আমিও ধরে নিয়েছিলাম ওটাও শ্রদ্ধাশীল দেশাত্ববোধক গান। দুটো গানই মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং কেউ আমাকে গান গাইতে বললে, আমি পরপর দুটোই শুনিয়ে দিতাম। মুশকিল হলো আমার সোনার বাংলা শুনে হাততালি দিলেও, পরের গানটা শুনে কেন যেন সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তো।
বড় হবার পর ভুলে গেলাম গান দুটোর কথা। সেদিন টিভিতে পুরোনো দিনের গান দেখাচ্ছিল, সেখানে প্রথমবারের মতো দেখলাম 'সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না' গানটা। বউকে খুলে বললাম ছেলেবেলার ঘটনাটা। দেখি সেও গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে।
মনে মনে বললাম, যাশশালা! সবকিছু বদলাইছে, এই গানের মাজেজা দেখি বদলায় না!
বলে রাখি, তখনকার দিনে প্রধান বিনোদন ছিল মাইক। আজকাল বিয়ে বাড়ীতে যেমন ব্যান্ডপার্টির আনাগোনা, তখনকার দিনে ছিল মাইক। সেই মাইকে এইচএমভি লেখা লং প্লে ডিস্কের গান বাজানো হতো। চালানো হতো হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দম দিয়ে। গ্রামের মাঠে মাঠে এলোপাতাড়ি ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই অনেক গানের ভিড়ে দুটো গানকে বারবার বাজতে শুনতাম কোন দুর গ্রামের মাইকে।
১) সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না, এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাবো...।
২) আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
'আমার সোনার বাংলা' যে জাতীয় সঙ্গীত, শ্রদ্ধার গান সেটা তখনই শিখেছিলাম বড়দের কাছ থেকে। কিন্তু অন্য গানটা কিসের গান সেটা কেউ বলে দিত না। ফলে আমিও ধরে নিয়েছিলাম ওটাও শ্রদ্ধাশীল দেশাত্ববোধক গান। দুটো গানই মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং কেউ আমাকে গান গাইতে বললে, আমি পরপর দুটোই শুনিয়ে দিতাম। মুশকিল হলো আমার সোনার বাংলা শুনে হাততালি দিলেও, পরের গানটা শুনে কেন যেন সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তো।
বড় হবার পর ভুলে গেলাম গান দুটোর কথা। সেদিন টিভিতে পুরোনো দিনের গান দেখাচ্ছিল, সেখানে প্রথমবারের মতো দেখলাম 'সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না' গানটা। বউকে খুলে বললাম ছেলেবেলার ঘটনাটা। দেখি সেও গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে।
মনে মনে বললাম, যাশশালা! সবকিছু বদলাইছে, এই গানের মাজেজা দেখি বদলায় না!
দাড়িওয়ালা খেয়ে ধায়, গোঁফওয়ালা লটকে যায়
যে বয়সে ছেলেরা বালিকাদের কাছ থেকে একটু মনোযোগের আশায় জিন্সের তালি দেয়া প্যান্টের সাথে উল্টা সেলাই করা টিশার্ট পরে থুতনির গোড়ায় এক চিমটে দাড়ি নিয়ে রাস্তার মোড়ে কিংবা বালিকা স্কুলের গেটের অদূরে অপেক্ষমান থাকে, সেই বয়সে আমার এক বন্ধু রীতিমত কামেলত্ব অর্জন করেছিল বালিকা বান্ধবী সংগ্রহে। তার নেটওয়ার্ক ছিল সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টনের মতো।
বালিকাদের কাছে সে নিজস্ব নাম রনকে পরিচিত থাকলেও তার আসল নাম কুতুবুদ্দিন। সমগ্র বাংলাদেশে তার ঘোষিত বান্ধবীর সংখ্যা ছিল ডজন খানেক। আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধের কথা। আমরা তখন কলেজের করিডোর পেরিয়ে ভার্সিটির বারান্দায় হাঁটতে শিখছি মাত্র। আর কুতুব পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে ভিডিও দোকান নিয়ে বসে গেছে পিতৃপুরুষের কল্যাণে। ফ্রিতে ভিডিও ক্যাসেট পাবার লোভে মৌ-লোভী বন্ধুরা মৌমাছির মতো ঘিরে রাখতো তাকে। দেখতে খাটো হলেও চলনবলন বেশ স্মার্ট। তার একটা সমস্যা ছিল তোতলানো। কথা বলতে গেলে মুখে থুথু ছিটাতো। একদিন তার দেশব্যাপী বান্ধবী নেটওয়ার্কের কথা শুনেও প্রথমে আমরা হেসেই উড়িয়ে দিলাম।
কিন্তু না। ঘটনা সত্যি। একদিন গিয়ে চেপে ধরতেই কুতুব স্বীকার করলো। তবে সবগুলো বালিকা নাকি তার অদেখা। ফোনে ফোনেই প্রেম। আমরা তো আরো টাসকি খেয়ে গেলাম। ফোনে ফোনে প্রেম মানে? তখনো মোবাইল যুগ আসতে অনেক দেরী। লং ডিসটেন্স কলের মতো লং ডিসট্যান্স প্রেমও চালু হয়নি।
বন্ধুরা শুনে বললো- কস্কি মমিন! এই ব্যাটা আমাদের সাথে কথা বলতেই তোতলায়, মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে ওর আছাড় খেয়ে পড়ার কথা। তাছাড়া ওর মধ্যে মেয়ে পটানোর মতো রসদ কি আছে আমরা ভেবে পাই না। জীবনে একটা কবিতা পড়েনি, একটা ভালো গান শোনেনি, দেখার মধ্যে খালি সিনেমা দেখেছে তাও এক্সের প্রাধান্য। কেম্নে কী ভেবে পাই না।
প্রমান দেবার জন্য একদিন আমাদের সামনেই ফোন করলো বান্ধবীদের একজনকে। যেই মাত্র ওই প্রান্তের ফোনটা উঠলো তার প্রচলিত কথার সুর-লয়-তাল সব বদলে গিয়ে সাক্ষাত সুধীন দত্ত নেমে এলো শান্তিনিকেতনের আঙিনায়। কী ভাষা, কী কথা, মোহনীয় হাসি!! এইটা কি কুতুব্যা রে??? বিশ্বাস করা কঠিন!
তবে তার প্রেমের নেটওয়ার্ক ছিল এনডব্লিউডি। মানে চাটগাঁর বাইরে। লোকালে বিশ্বাসী না কুতুব। লোকাল কোন ফোন নাম্বার নেই তার। কিন্তু কোন ফাঁকে একবার চট্টগ্রামের একটা মেয়ে ঢুকে পড়ে তার নেটওয়ার্কে। সেই মেয়েই একদিন বিপত্তি ডেকে আনলো। ধরা যাক মেয়েটার নাম নীলা।
নীলা একদিন আবদার করে সে রনককে দেখবে। রনক অনেক গাঁইগুই করেও এড়াতে পারে না। নীলা আঠার মতো লেগে থাকে। দেখা করতেই হবে। কুতুব এড়াতে পারে না তবে নিজের বাসায় ধরা খাওয়ার ভয়ে ঠিকানা দিল আরেক বন্ধু নয়নের বাসার। নয়নকে আগেভাগে বলে রাজী করালো। বললো এক ঘন্টার ব্যাপার, আসবে গল্প করবে, তারপর চলে যাবে। তোর বাসা তো সারাদিন খালি থাকে।
পরদিন ঠিক সময়ে নয়নের বাসার সামনে এসে থামলো একটা রিকশা। দুটি বালিকা রিকশা থেকে নামলো। বালিকা বলা হলেও অবয়বে দুজনকেই ভদ্রমহিলাই বলা যায়। একজন শাড়ীতে আরেকজন সালোয়ার কামিজে। শাড়ী মহিলা ভাড়া মেটাচ্ছে বাকীজন বাড়ীর গেটের নাম্বার মেলাচ্ছে। যিনি নাম্বার মেলাচ্ছিলেন তাঁর পরনে পূর্বঘোষিত রঙের পোষাক। রনক বুঝলো এই সেই নীলা! দুর থেকে স্ক্যান চালিয়ে দৈর্ঘ্য প্রস্থ পরিমাপ করে আন্দাজ করলো কিছু একটা। তারপর জানালা থেকে সরে এসে ভেতরে গেল।
নয়ন ভেতরের ঘরে গান শুনছিল, বিষয়ের কিচ্ছু জানে না সে। রনক বললো, "দোস্ত মজা করবি একটু?"
নয়ন বলে, "কি মজা?"
রনক বলে, "তোর তো কেউ নাই, আজকে তুই আমার নামে প্রক্সি দে। তোর কপালে একটা কিছু আসুক।"
নয়ন লাজুক হাসে। বলে, "ধুরো, আমার ওসব নাই। তোর মজা তুই কর।"
রনক বলে, "আজকে তুইও মজা কর। জীবনে আছে কী ব্যাটা?"
দোনোমোনো করে নয়ন রাজী। কয়, কি করতে হবে।
রনক বলে, "ওরা আসলে তুই বলবি তুই রনক, আমি নয়ন। ঠিকাছে?"
নয়ন বলে, "আচ্ছা বললাম। তারপর?"
রনক বলে, "তারপর আর কি? কিছুক্ষণ ফান করে তারপর আসল কথা বলবি, খুব মজা হবে।"
নয়ন সহজ সরল ছেলে। আশু মজার ঘটনা কল্পনা করে সে নিদারুন পুলকিত। হাসিমুখেই রাজী হলো।
কলিং বেল বাজতেই রনক দরোজা খুলে ভিড়মি খেল। হাসিমুখে যিনি দাড়িয়ে আছেন তিনি কেবল প্রস্থ নয় দৈর্ঘেও রনকের চেয়ে বেশ এগিয়ে। উপর থেকে এতটা বোঝা যায়নি। ওদের কাষ্ঠহাসি দিয়ে স্বাগতঃ জানালো।
বললো, "আমি নয়ন, রনক ভেতরে আছে, আপনারা বসুন। আমি ডেকে দিচ্ছি"
ভেতরে গিয়ে নয়নকে খবর দিল, বললো কথাবার্তা এগিয়ে নিতে। সে একটু পরে চা নিয়ে আসছে। নয়ন ড্রইংরুমে গিয়ে অতিথির সম্মুখে গুটিসুটি মেরে বসলো। কথাবার্তা শুরু হলো। কুশলাদি বিনিময় শুরু হলো।
কলকল শব্দে আড্ডা চলতে চলতে রনক আস্তে করে ওদের পেছনের দরোজা খুললো। পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে সোজা নীচে নেমে গেছে। পালাচ্ছে বীরপুঙ্গব প্রেমিক পুরুষ। দ্রুত পায়ে মোড়ের দিকে এগিয়ে একটা রিকশা ডেকে সোজা চম্পট দিল।
আর নয়ন? কিছুক্ষন পর তার কি দশা হলো সেটা বিস্তারিত নাই বলি এখানে। তবে দুজন লোকাল চাটগাইয়া নারীর হাতে মার খাওয়াটাই বাকী ছিল তার কেবল। গালিগালাজ বকাবকি। চিটিং বাটপারীর দায়ে আহাজারি। আরো কতো কি। ভাগ্যিস বাসায় কেউ ছিল না। কিন্তু প্রেমের নামে প্রতারণার দায়ে পরের মাসেই বাসা বদলে পালাতে হয়েছিল তাকে।
এইজন্যই জ্ঞানীরা বলেছেন- দাড়িওয়ালা খেয়ে যায়, গোঁফঅলা লটকে যায়।
বালিকাদের কাছে সে নিজস্ব নাম রনকে পরিচিত থাকলেও তার আসল নাম কুতুবুদ্দিন। সমগ্র বাংলাদেশে তার ঘোষিত বান্ধবীর সংখ্যা ছিল ডজন খানেক। আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধের কথা। আমরা তখন কলেজের করিডোর পেরিয়ে ভার্সিটির বারান্দায় হাঁটতে শিখছি মাত্র। আর কুতুব পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে ভিডিও দোকান নিয়ে বসে গেছে পিতৃপুরুষের কল্যাণে। ফ্রিতে ভিডিও ক্যাসেট পাবার লোভে মৌ-লোভী বন্ধুরা মৌমাছির মতো ঘিরে রাখতো তাকে। দেখতে খাটো হলেও চলনবলন বেশ স্মার্ট। তার একটা সমস্যা ছিল তোতলানো। কথা বলতে গেলে মুখে থুথু ছিটাতো। একদিন তার দেশব্যাপী বান্ধবী নেটওয়ার্কের কথা শুনেও প্রথমে আমরা হেসেই উড়িয়ে দিলাম।
কিন্তু না। ঘটনা সত্যি। একদিন গিয়ে চেপে ধরতেই কুতুব স্বীকার করলো। তবে সবগুলো বালিকা নাকি তার অদেখা। ফোনে ফোনেই প্রেম। আমরা তো আরো টাসকি খেয়ে গেলাম। ফোনে ফোনে প্রেম মানে? তখনো মোবাইল যুগ আসতে অনেক দেরী। লং ডিসটেন্স কলের মতো লং ডিসট্যান্স প্রেমও চালু হয়নি।
বন্ধুরা শুনে বললো- কস্কি মমিন! এই ব্যাটা আমাদের সাথে কথা বলতেই তোতলায়, মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে ওর আছাড় খেয়ে পড়ার কথা। তাছাড়া ওর মধ্যে মেয়ে পটানোর মতো রসদ কি আছে আমরা ভেবে পাই না। জীবনে একটা কবিতা পড়েনি, একটা ভালো গান শোনেনি, দেখার মধ্যে খালি সিনেমা দেখেছে তাও এক্সের প্রাধান্য। কেম্নে কী ভেবে পাই না।
প্রমান দেবার জন্য একদিন আমাদের সামনেই ফোন করলো বান্ধবীদের একজনকে। যেই মাত্র ওই প্রান্তের ফোনটা উঠলো তার প্রচলিত কথার সুর-লয়-তাল সব বদলে গিয়ে সাক্ষাত সুধীন দত্ত নেমে এলো শান্তিনিকেতনের আঙিনায়। কী ভাষা, কী কথা, মোহনীয় হাসি!! এইটা কি কুতুব্যা রে??? বিশ্বাস করা কঠিন!
তবে তার প্রেমের নেটওয়ার্ক ছিল এনডব্লিউডি। মানে চাটগাঁর বাইরে। লোকালে বিশ্বাসী না কুতুব। লোকাল কোন ফোন নাম্বার নেই তার। কিন্তু কোন ফাঁকে একবার চট্টগ্রামের একটা মেয়ে ঢুকে পড়ে তার নেটওয়ার্কে। সেই মেয়েই একদিন বিপত্তি ডেকে আনলো। ধরা যাক মেয়েটার নাম নীলা।
নীলা একদিন আবদার করে সে রনককে দেখবে। রনক অনেক গাঁইগুই করেও এড়াতে পারে না। নীলা আঠার মতো লেগে থাকে। দেখা করতেই হবে। কুতুব এড়াতে পারে না তবে নিজের বাসায় ধরা খাওয়ার ভয়ে ঠিকানা দিল আরেক বন্ধু নয়নের বাসার। নয়নকে আগেভাগে বলে রাজী করালো। বললো এক ঘন্টার ব্যাপার, আসবে গল্প করবে, তারপর চলে যাবে। তোর বাসা তো সারাদিন খালি থাকে।
পরদিন ঠিক সময়ে নয়নের বাসার সামনে এসে থামলো একটা রিকশা। দুটি বালিকা রিকশা থেকে নামলো। বালিকা বলা হলেও অবয়বে দুজনকেই ভদ্রমহিলাই বলা যায়। একজন শাড়ীতে আরেকজন সালোয়ার কামিজে। শাড়ী মহিলা ভাড়া মেটাচ্ছে বাকীজন বাড়ীর গেটের নাম্বার মেলাচ্ছে। যিনি নাম্বার মেলাচ্ছিলেন তাঁর পরনে পূর্বঘোষিত রঙের পোষাক। রনক বুঝলো এই সেই নীলা! দুর থেকে স্ক্যান চালিয়ে দৈর্ঘ্য প্রস্থ পরিমাপ করে আন্দাজ করলো কিছু একটা। তারপর জানালা থেকে সরে এসে ভেতরে গেল।
নয়ন ভেতরের ঘরে গান শুনছিল, বিষয়ের কিচ্ছু জানে না সে। রনক বললো, "দোস্ত মজা করবি একটু?"
নয়ন বলে, "কি মজা?"
রনক বলে, "তোর তো কেউ নাই, আজকে তুই আমার নামে প্রক্সি দে। তোর কপালে একটা কিছু আসুক।"
নয়ন লাজুক হাসে। বলে, "ধুরো, আমার ওসব নাই। তোর মজা তুই কর।"
রনক বলে, "আজকে তুইও মজা কর। জীবনে আছে কী ব্যাটা?"
দোনোমোনো করে নয়ন রাজী। কয়, কি করতে হবে।
রনক বলে, "ওরা আসলে তুই বলবি তুই রনক, আমি নয়ন। ঠিকাছে?"
নয়ন বলে, "আচ্ছা বললাম। তারপর?"
রনক বলে, "তারপর আর কি? কিছুক্ষণ ফান করে তারপর আসল কথা বলবি, খুব মজা হবে।"
নয়ন সহজ সরল ছেলে। আশু মজার ঘটনা কল্পনা করে সে নিদারুন পুলকিত। হাসিমুখেই রাজী হলো।
কলিং বেল বাজতেই রনক দরোজা খুলে ভিড়মি খেল। হাসিমুখে যিনি দাড়িয়ে আছেন তিনি কেবল প্রস্থ নয় দৈর্ঘেও রনকের চেয়ে বেশ এগিয়ে। উপর থেকে এতটা বোঝা যায়নি। ওদের কাষ্ঠহাসি দিয়ে স্বাগতঃ জানালো।
বললো, "আমি নয়ন, রনক ভেতরে আছে, আপনারা বসুন। আমি ডেকে দিচ্ছি"
ভেতরে গিয়ে নয়নকে খবর দিল, বললো কথাবার্তা এগিয়ে নিতে। সে একটু পরে চা নিয়ে আসছে। নয়ন ড্রইংরুমে গিয়ে অতিথির সম্মুখে গুটিসুটি মেরে বসলো। কথাবার্তা শুরু হলো। কুশলাদি বিনিময় শুরু হলো।
কলকল শব্দে আড্ডা চলতে চলতে রনক আস্তে করে ওদের পেছনের দরোজা খুললো। পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে সোজা নীচে নেমে গেছে। পালাচ্ছে বীরপুঙ্গব প্রেমিক পুরুষ। দ্রুত পায়ে মোড়ের দিকে এগিয়ে একটা রিকশা ডেকে সোজা চম্পট দিল।
আর নয়ন? কিছুক্ষন পর তার কি দশা হলো সেটা বিস্তারিত নাই বলি এখানে। তবে দুজন লোকাল চাটগাইয়া নারীর হাতে মার খাওয়াটাই বাকী ছিল তার কেবল। গালিগালাজ বকাবকি। চিটিং বাটপারীর দায়ে আহাজারি। আরো কতো কি। ভাগ্যিস বাসায় কেউ ছিল না। কিন্তু প্রেমের নামে প্রতারণার দায়ে পরের মাসেই বাসা বদলে পালাতে হয়েছিল তাকে।
এইজন্যই জ্ঞানীরা বলেছেন- দাড়িওয়ালা খেয়ে যায়, গোঁফঅলা লটকে যায়।
Subscribe to:
Posts (Atom)