Saturday, December 20, 2008

ঢাকা নিয়ে কচকচানি

ঢাকার বাইরের লোক হয়েও ঢাকা আমার খুব প্রিয় শহর ছিল একসময়। আকাশ ছোঁয়া দালানের দিকে তাকিয়ে মতিঝিলের ফুটপাত ধরে হাটতে হাঁটতে নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ন কেউকেটা মনে হতো। সেই কৈশোরে আমার ধারনা ছিল ঢাকায় যাদের যেতে হয় তারা সাধারন কেউ না। ঢাকা যাওয়ার আগের আর পরের ক'টা দিন মুখিয়ে থাকতাম এরকম কয়েকটা রেডী উত্তর নিয়ে -"এই একটু ঢাকা যেতে হবে কাল", "আর বলিস না, ঢাকা যেতে হয়েছিল গত সপ্তাহে"। সবসময় কোন না কোন ছুতায় ঢাকা যাবার উপায় খুঁজতাম। কোন কাজ না থাকলেও শ্রেফ বইমেলায় যাবার অজুহাতে ঢাকা চলে যেতাম। বেমক্কা ঘুরতাম রাস্তায় রাস্তায়। মানুষ, গাড়ী, দালান সবকিছু কেমন স্বপ্নময় মনে হতো। যা দেখি তাই ভালো লাগে, যা খাই তাই তৃপ্তিময়। ঢাকার সবকিছুই সুন্দর মনে হতো। এমনকি সদরঘাট-রামপুরা রোডের লক্কর-ঝক্কর বাসগুলো পর্যন্ত। সদ্য কৈশোরোত্তীর্ন তরুনের রোমান্টিকতার জগতে ঢাকা শহরের ব্যাপক ভুমিকা ছিল।

বিশ-বাইশ বছর আগে ঢাকা শহর এত যানজটপূর্ন ছিল না। শহরের যে কোন জায়গায় স্বচ্ছন্দেই যাওয়া যেতো। মালিবাগে খালার বাসায় থাকা-খাওয়া চলতো, বাকী সময় ঘুরতাম ফিরতাম এদিক সেদিক। বাসে বা রিক্সায় করে যেখানে খুশী যাওয়া যায়। রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি এলাকায় বেহুদা ঘুরাঘুরির নেশা ছিল। পাবলিক লাইব্রেরী, আজিজ মার্কেটে বইয়ের দোকানেও গুজগুজ করতাম। নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে দাম দেখে অর্ধভোজনের অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে যেতাম গুলিস্তান, নয়াপল্টন, কাকরাইল কিংবা বায়তুল মোকাররমের সামনের ফুটপাতে পুরোনো বইয়ের টালে। হকারের সাথে খাপ-খুপ খাতির জমানোর চেষ্টা করতাম সস্তায় বই পত্তর মেলানোর আশায়। সুকান্ত, জীবননান্দ থেকে পিয়ার্স এনসাইক্লোপেডিয়া পর্যন্ত বিশ পঞ্চাশ টাকায় মিলে যেত কখনো কখনো। চাটগাঁ ফিরে যাবার গাড়ী ভাড়া বাদে সব টাকা ফুটপাতে বিলিয়ে ফিরে আসতাম মালিবাগের বাসায়।

যদিও ঢাকার নির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে কিছু চিনতাম না, তবু রাস্তায় হারিয়ে যাবার কোন ভয় ছিলনা। এমনকি মীরপুর পাইকপাড়ার ভেতর গলির খালাতো বোন জলি আপার বাসাটা খুঁজে বের করতেও মোটে বেগ পেতে হতো না। যদিও প্রতিবার রাস্তা হারিয়ে ফেলতাম নতুন নতুন দালানের ভীড়ে, তবু কোন অনিশ্চয়তায় ভুগতাম না।

সেই ঢাকা শহর আমার কাছে অচেনা লাগে। ভীষন অচেনা। যেন কখনো আসিনি এই শহরে। সবকিছুই নতুন লাগে। এত ভীড়, এত যানজট, কেবল রাস্তা হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করে। যে আমি একসময় যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর পর্যন্ত অবাধে ঘুরে বেড়াতাম, সেই আমি এখন আরামবাগ থেকে রাজারবাগ একা যেতে ভরসা পাইনা সন্ধ্যা সাতটায়। গুলশানে যেতে হলে অবশ্যই সাথে নিই ঢাকা অফিসের আলীকে। নাহলে কোথায় কোন বিপাকে পড়ি। এমনকি ব্যক্তিগত কাজে গেলেও ঢাকা পৌছার আগেই ফোন করি আলীকে, আলী ফোন পেলেই বোঝে কী করতে হবে, "কোথায় আসতে হবে স্যার, আরামবাগ না কলাবাগান?" হাসিখুশী লোকটা এসে আমাকে বনানীর রেষ্টহাউজে কিংবা হোটেলে নিয়ে যাবে। রেষ্টহাউজে সে একা থাকে। নিজেই রান্নাবান্না করে খায়। আমাকে পেলে বন্ধুর মতো গল্প করবে। হোটেলে বুকিং না থাকলে বলি, "আজ রাতে তোমার হাতের টেংরা মাছের ঝোল খাবো।"

আরেকবার বাস থেকে আরামবাগে নেমে ওর জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু সে গাড়ী নিয়ে মালিবাগ রেলগেটের জ্যামে আটকে আছে ঘন্টাখানেক। রাত নটা বাজে প্রায়, আমি যাবো রাজারবাগের হোটেল আশরাফীতে, ঢাকায় গেলে মাঝে মাঝে ওখানেই থাকি। কাছাকাছি জায়গা। কিন্তু গত কয় বছরে আমি এমনই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছি যে এই সামান্য পথটাও একা যেতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। এমকি রাস্তাটা কোথা দিয়ে রাজারবাগ পৌছেছে তাও মনে পড়ছিল না অন্ধকারে। তবু এদিক ওদিক তাকিয়ে নিরাপদ চেহারার একটা বুড়া রিকশাওয়ালা দেখে উঠে পড়লাম। দুরুদুরু বুকে কোন অঘটন ছাড়াই কিছুক্ষনের মধ্যেই হোটেলে পৌছালাম। এই যে 'দুরুদুরু বুকে' ঢাকা শহরে চলাচল, এটা আমার বয়সের পরিবর্তন নাকি ঢাকা শহরের পরিবর্তন, বুঝি না।

ঢাকা এখন আর ভালো লাগে না। একদমই না। যখনই ঢাকা যেতে হয় কখন কাজ শেষ করে পালিয়ে আসবো সে চিন্তায় থাকি। এত মানুষের ভীড়, এত গাড়ী, এত ধুলা, এত ধোঁয়া, দমবন্ধ হয়ে আসে। যে রাস্তা, যে ফুটপাত দিয়ে বিশ-বাইশ বছর আগে স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়িয়েছি সেখানে এখন পা রাখারও জো নেই। কোটি মানুষের শহর ঢাকা। ব্যস্ততম শহর ঢাকা। স্বার্থপর শহর ঢাকা। ঢাকার মানুষের স্বার্থপরতা নিয়ে খুব গল্প শুনতাম। আসলেই কী স্বার্থপরতা, নাকি নিরুপায়তা। জীবন যাপনের জন্য যখন এই স্বার্থপরতা অপরিহার্য, তখন তাকে আমি দোষ দেই না। আরেকটু কম স্বার্থপর হতে হলে যেটুকু সামর্থ্য থাকা দরকার সেটা সবার নেই, কিংবা বেশীরভাগের নেই। আমার বেশ কিছু কাছের বন্ধু ঢাকায় আস্তানা গেড়েছে অনেক বছর ধরে। এই স্বার্থপরতা কিংবা ব্যস্ততার পাতা জালে সবাই এমন আষ্টেপৃষ্টে আটকে গেছে কেউ কারো নিয়মিত খোজ খবর নেয়ার সুযোগ পায় না। অথচ একটা সময় ছিল দিনে অন্ততঃ একবার দুই বন্ধু মিলে ঘন্টাখানেক গেজাতো কোথাও বসে। ফকিরাপুলে রুপুদের বাসায় আমাদের সেই আড্ডাটার কথা মনে পড়লো। দিনরাত কেউ না কেউ আড্ডা দিচ্ছে ওখানে। পুরো ঘরে কার্পেট পাতা, বিরাট দুটো রুম। কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ সিগারেট টানছে, কেউ ডাইলের বোতল নিয়ে এসেছে সন্ধ্যা হতে না হতেই, কেউবা তাশ পেটাচ্ছে। বাজার রান্না সব করে দিচ্ছে অসাধারন রাধুনী রাশিদার মা। রাশিদার মা এখন কোথায় আছে কে জানে। এত ভালো বুয়া এমন ভালো রান্নার হাত আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। ঢাকার বন্ধুতো বটেই, চট্টগ্রাম থেকে আমরা সবকটা ওখানেই উঠতাম আড্ডার লোভে। প্রত্যেকেই এমন হুজুগে ছিল যে পরিকল্পনা ছাড়াই একবার সবাই মিলে হুট করে লালমনিরহাটের বাসে উঠে চলে গিয়েছিলাম বুড়িমারী সীমান্তে। থাকার জায়গা নাই বলে বাস কোম্পানীর এক স্টাফকে ধরে তার পেছনের একটা রুমে গাদাগাদি রাত্রিযাপন। কে একজন নিয়ে এল রূহ আফজা কালারের ভুটানী মদ। ভরপেট টাল মাতাল তরুনের দল পাশের ভারতীয় সীমানার কাছে গিয়ে পেশাব করে দিয়ে বিএসএফ এর হুংকারে হৈ হৈ ছুটে আসা। সেই জোৎস্না রাতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত রোডে নো ম্যানস ল্যান্ডের কাছে সেই মাতালীয় ছোটাছুটির স্মৃতি, আহ্ কী সুধাময়।

ঢাকার রাস্তার ব্যস্ততা সম্পর্কের মধ্যেও কেমন দুরত্ব সৃষ্টি করে একটা উদাহরন দেই। বছর তিনেক আগে আমি কারওয়ান বাজারের অ্যাংকর টাওয়ারে গেলাম একটা কাজে। ওই কাজ সেরে আগারগাঁও যেতে হবে, যাবার পথে জাহাঙ্গীর টাওয়ারে বন্ধু মামুনের সাথে দেখা করবো। অনেকদিন দেখা হয়না ওর সাথে। অ্যাংকর টাওয়ার থেকে বেরিয়েই জ্যামে পড়লাম। জাহাঙ্গীর টাওয়ার যেতে হলে গাড়ীকে বাঁয়ে অনেকদুর ঘুরে আসতে হবে বিপরীত রাস্তায়। সরাসরি যাবার উপায় নেই। কিন্তু মোড়ের কাছাকাছিই আটকে থাকলাম অনেকক্ষন। মামুন ফোন করছে বারবার। আমি তাকিয়ে দেখছি ওর অফিস বিল্ডিংটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমি ওখানে পৌছাতে পারছি না সহজে। অনেক সময় লাগবে ঘুরে আসতে। হেটে গেলে পাচ মিনিট লাগবে বড়জোর। কিন্তু গাড়ীকে জ্যামে রেখে কীভাবে হেটে যাবো। মুশকিলে পড়লাম। ওদিকে সময়ও কম। আগারগাঁওএর কাজ সেরে বাস ধরতে ছুটতে হবে আরামবাগে। হিসেব মেলাতে পারলাম না। অবশেষে এত টাইট শিডিউলের চাপে পড়ে মাত্র ২০০ গজ দুরে থাকা প্রিয় বন্ধুকে দেখার সাধ বিসর্জন দিতে হলো। ওকে ফোন দিয়ে বললাম, "দোস্ত মাফ করে দে, তোর অফিসের সামনেই আছি, কিন্তু উল্টাদিকে। রাস্তার যা অবস্থা তোর সাথে দশ মিনিট আড্ডা দেবার লোভ করতে গেলে আজকে যাওয়াটাই বাতিল করতে হবে, পরেরবার নিশ্চয়ই সময় করতে পারবো।"

তুই এখন কেমন আছিস জাহাঙ্গীর টাওয়ারের পাঁচতলায়? বন্ধু কী খবর বল, কতদিন দেখা হয় না!

No comments: