Saturday, December 20, 2008

একজন 'বাঘা মমিন'

পকেটে ঘাটতি বাজেটের মানিব্যাগ নিয়ে কোরবানীর গরু কেনার জন্য সাগরিকার রোডের সিডিএ মার্কেটের কাছাকাছি যেতেই একটা হৈ চৈ কানে এলো বাজারের গেটের দিক থেকে। লোকজন দিশেহারা হয়ে কিছু একটা থেকে বাঁচার জন্য বাজারের ভেতর থেকে পরি কি মরি করে ছুটে বেরিয়ে এসে রাস্তার চলন্ত-থামন্ত বাস-ট্রাকের সামনে গিয়ে পড়ছে। আরেকটু পেছনে চোখ পড়তেই যা দেখলাম তাতে আমিও তিন লাফে চলে গেলাম পাশ্ববর্তী দোকানের পেছনে। কারন ধাবমান জনতার পিছু পিছু ছুটে আসছে দড়ি ছেঁড়া কালো রঙের বিশাল এক পাগলা ষাঁড়। পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে এলেও বাজারে ঢুকতে ভরসা পেলাম না। এমনিতে কোরবানীর হাটে যাওয়া আমার পছন্দ না, কুরবানি করতে গিয়ে খামাকা পাগলা গরুর হাতে শহীদ হওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার। তবু পরিবারের একমাত্র পুরুষ হওয়াতে নিতান্ত বাধ্য হয়েই যেতে হয়। যাই ঠিকই কিন্তু বাজারে ঢুকিনা। এবারও যথারীতি সাথে আসা গরু ধরতে অতি উৎসাহী কাজের ছেলেটাকে বলি, যা ভেতর থেকে তোর পছন্দমতো কোন একটা গরু নিয়ে আয়, কিন্তু ত্রিশ হাজারের বেশী যাবি না।

আমি বাজারের বাইরে একটা বন্ধ দোকানের সামনের ভাঙ্গা দেয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরালাম। রাস্তায় গাড়ী-মানুষের হাড্ডাহাড্ডি ভীড়, গ্রামমুখী মানুষের অসহনীয় দুর্ভোগ দেখতে দেখতে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো গ্রামে যেতে হয়নি বলে। পাশে একটা গরু পেটানো বেত হাতে চুপচাপ বসে থাকা দীন-হীন মলিন পোষাকের বুড়ো লোকটাকে দেখে কথা বলতে ইচ্ছে হলো। মানুষকে জানা আমার একটা শখ। প্রথম পর্বের কথোপকথন এরকম।

-আপনার গরু আছে?
-না
-ওহ্........গরু ছিল?
-ছিল
-এখন নাই?
-নাই
-সব শেষ?
-শেষ

কথা জমলো না। নিরাসক্ত বুড়ো মুখ ফিরিয়ে রাস্তার মানুষ গননায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একটু পরে ফস করে বিড়ি ধরালো একটা। খেয়াল করলাম তার দুপায়ের মাঝখানে একটা মশার কয়েল জ্বলছে। আবার চেষ্টা করলাম।
-খুব মশা, তাই না?
-খুব
-গরু কোথা থেকে আনছেন?
-দুর থেইকা
-কোন দুর
-ফরিদপুর
-অনেকদুর...কয়টা আনছেন?
-৩০/৩২টা
-লাভ কেমুন?
-হইছে...
-কয়দিন আগে আসছেন
-৭দিন
-কখন শেষ হইছে?
-আইজ
-এখানে আছিলেন কই?
-বোডিং-এ
আবার চুপ। আমার ছেলেটাও গরু নিয়ে ফিরছে না। কতক্ষন আর বসে থাকা যায়। আবার খাজুরে আলাপ জুড়াবার চেষ্টা। বুড়া আমাকে ছিনতাইকারী ভাবছে কিনা কে জানে। ফুসলিয়ে গরু বিক্রির টাকাগুলো হাতিয়ে নেবো ভাবছে হয়তো। তাই সাবধানে কথা বলছে। কিছুক্ষন নীরবতার পর বুড়ো আপনমনে কথা বলে উঠলো-
-আমার শেষ গরু দুইটা পাশের এক বেপারী কিনে নিছে। কদিনে খাতির হয়ে গেছিল তার সাথে। সকালে সে এসে বললোঃ
=কাহা, আমি এই গরু দুইটা নিবাম
=নেও, অসুবিধা কি
=দাম চাইবার পারবেন না কিন্তুক
=আইচ্ছা
=আমি যা দিমু নিতে হইবো
=ঠিক আছে নিমু
=কোন দরাদরি করতে পারবেন না
=কইলামতো, তুমি যা খুশী দাও
=এই লন, গুনতে পারবেন না।
=আইচ্ছা
-টাকার বান্ডিল পকেটে দিয়া চলে গেল। গুনে দেখি সত্তর হাজার আছে। অথচ আমি ভাবছিলাম পঞ্চাশ হবে। তারে আবার ডাক দিলাম।
=ওই মিয়া শোনো
=কাহা, আমি কিন্তুক আগেই কইছি আপনি কিছু কইবার পারবেন না। লেনদেন কিন্তুক শেষ।
=ঠিকাছে, কিন্তু গরুতো নিলা। কত বেচবা? মানে কত লাভ করবা এই দুইটা বেইচ্যা?
=দশ-পনের হাজার তো করবোই
=একটাতে না দুইটা মিল্লা?
=দুইটা মিল্লা
=তারপর কী করবা?
=বৌ-পোলাপান নিয়া মৌজে ঈদ করবাম।
=তুমি এই পাঁচ হাজার রাখো, আমারে বেশী লাভ দিছিলা। আমার লাভের কিছু অংশ তোমারে দিলাম।
=কী বলেন কাহা, আপনি আজব মানুষ!!
-তারপর সে খুশী হয়ে চলে গেল। আমার খুব ভালো লাগলো দেখে।
-আপনি তো মহান মানুষ চাচা
-আমি সামান্য মানুষ বাবা। একসময় ছোট চাকরী করতাম। রিটায়ার করার পর থেইক্যা গত ১৮ বছর গরুর কারবার করি। এইখান থেকে গিয়ে দশ বারোদিন আরাম করবো। তারপর গরুর হাটে গিয়ে ৪০টার মতো গরুবাছুর কিন্যা খামারে ঢুকায়া দিব। আগামী কোরবান পর্যন্ত ওগুলা বাইরে আসবে না। খইল-ভুষি আর যত রকম ভালো খাবার আছে সব খাওয়ামু। তারপর কোরবানীর একসপ্তাহ আগে বাইর কইরা সোজা হাটে। আমি কোন গরু ৫ হাজার টাকার উপরে কিনি না। ২ থেকে ৫ হাজারের মধ্যে সবগুলা।
-আপনি তো অনেক বড়লোক চাচা।
-নারে বাবা, ৬৫টাকা বেতনে সার্ভিসে যোগ দিছিলাম ৫০০০ টাকায় রিটায়ার করছি। রিটায়ার করার সময় ৬ লাখ টাকা নগদে পাইছি। সেই টাকায় এই গরুর কারবার করতাছি।
-কোন সার্ভিসে আছিলেন?
-এই আছিলাম ছোটখাট একটাতে। এহন কইতে চাইনা।
-গরু ব্যবসায় আপনার তো অনেক লাভ তাইলে?
-লাভ আছে, হিসাব করি না, সংসার ভালোই চলে আল্লার রহমতে
-ছেলে মেয়ে আছে?
-আছে
-কয়জন
-১১জন, ৭ ছেলে ৩ মেয়ে
-খাওয়ার লোক তো অনেক।
-তা আছে। নাতিপুতি মিলে ৫৪ জন
-বলেন কি? এতো বিরাট মিছিল।
-তা ঠিক, প্রতিদিন আমার ঘরে চাল লাগে ২৫-৩০ কেজি, তার উপর মেহমানতো আছেই।
-দিনে ২৫-৩০ কেজি? (আমি ভিড়মি খাই মনে মনে, আমার সারা মাসের বাজেট)
-অবাক হইলেন? আমার একার কত চাল লাগে আন্দাজ করেন তো?
-পারলাম না
-আমি দেড় কেজি চালের ভাত খাই এক বেলায়, রাতের বেলা রুটি খাই এক কেজি আটার
-বলেন কী? (আমি মনে মনে হিসেব করতে গিয়ে হোচট খাই)
-আমরা যা খাইছি আজকালকার পোলাপানরে তার কিছুই তো দিতে পারি না। সবকিছুতে ভেজাল।
-আপনার ছেলেমেয়েরা কী করে
-কেউ বিদেশে থাকে, কেউ দেশে কাজ কারবার করে
-গরুর কারবার আপনি একা করেন?
-একাই করি, আমার বাড়ীর সাথেই গরুর ঘর। দেড় বিঘার উপর বাড়ীটা।
-বিরাট ব্যাপার, দুধের গরু নাই?
-আছে দুইটা, বিশ কেজির মতো দুধ পাই, ঘরের খাওয়া চলে, আর একটা রামছাগল আছে, শখের পালা। ওইটাও দেড় কেজি দুধ দেয়। তবে রামছাগলের খরচ অনেক তিনবেলাই ভাত খায়, ছাগলের পিছনে ডেইলী খরচ লাগে ১০০ টাকার মতো। তবু শখের কারবার।
-আপনার শখ দেখে আমার লোভ লাগতেছে, আমিও আপনার সাথে গরুর কারবার করবো
-হে হে হে
-আপনার নাম কী? আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো
-আমার নাম আবদুল মমিন খান, তবে বাঘা মমিন বললে লোকে চিনে বেশী, ফরিদপুর সদরে বাস।
-বাঘা মমিন মানে?
-আমার দাদায় আমারে আদর কইরা ডাকতো, আমার নাকি সাহস বেশী
-৭১ সালে আপনি কোথায় ছিলেন? যুদ্ধ করছেন?
-যুদ্ধের সময় জান বাচায়া লুকায় আছিলাম
-পুলিশের অনেকে তো যুদ্ধ করেছে। আপনি পুলিশে ছিলেন, তাই না?
-জী। কিন্তু যুদ্ধের ঝামেলায় না গিয়ে পরিবারকে রক্ষা করছি
-আপনারে কোথায় পাবো ফরিদপুরে
-ফরিদপুর সদরে বাঘা মমিন বললে লোকে দেখিয়ে দেবে
-আপনি তো বিখ্যাত লোক
-আমার একটা কুকুর আছে, নাম ভুলু, সে আমার চেয়ে বিখ্যাত
-বলেন কী?
-ভুলু আমার সব কাজ করে দেয়, এমনকি বাজারটা পর্যন্ত।
-আরে, মজার ব্যাপার তো?
- আমি যদি ভুলুকে বলি, ভুলু যা বাজারটা নিয়ে আয়। ভুলু ঘেউ ঘেউ করে ছুট লাগাবে বাজারের নির্দিষ্ট দোকানে। ভুলুর গলার বেল্টে ছোট একটা ব্যাগে কাগজের স্লিপে বাজারের লিষ্টি দেয়া থাকে। ভুলু দোকানের সামনে গিয়ে দাড়ালে চেনা দোকানদার ভুলুর গলার ব্যাগ থেকে কাগজটা নিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে ভুলুর গলায় ঝুলিয়ে দেবে। কিন্তু ভুলু নড়বে না। দুবার ঘেউ ঘেউ করবে। তখন দোকানদার ছোট একটা আধপাউন্ডের পাউরুটি সামনে দিলে ভুলু গপগপ করে খেয়ে দুবার ঘেউ ঘেউ করে ধন্যবাদ দেবে। তারপর বাজারের থলেটা কামড়ে ধরে ছুট লাগাবে। রাত দশটার সময় বাড়ীর চারপাশে ছেড়ে দেই ওকে। সারারাত পাহারা দেয়।
-বাহ, আপনার কুকুরতো বড় আশ্চর্য? সরাইলের নাকি?
-জী, সরাইল থেকে আনছি

এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো আমার, গরু কেনার সংবাদ এলো। আমি বিদায় নিলাম বাঘা মমিনের কাছ থেকে। মানুষের জীবনের বিচিত্র কাহিনীর কথা ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম বাজারের ভিড় থেকে।

No comments: