Thursday, December 4, 2008

সাতকানিয়ায় এক স্বাধীনতা দিবসে

সময়টা ২০০২ সাল। জোট সরকার সদ্য ক্ষমতায় আসীন। সাতকানিয়া উপজেলার ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের সরকারী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলাম। পরিবারের একজন সদস্য উপজেলার সরকারী কর্মকর্তা হবার সুবাদে এই দাওয়াত। উপজেলার একটা স্কুল মিলনায়তনে বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। একে একে অতিথিবৃন্দ আসছেন। আমাকে দর্শকদের প্রথম সারিতে নিয়ে বসানো হলো। এই প্রথম মফস্বলের এধরনের একটা অনুষ্ঠানে এসেছি। এই এলাকাটা জামাতের শক্ত ঘাটি, সেকারনে আমার আগ্রহটা একটু বেশী। অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষন এলাকার সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহনে আলোচনা সভা এবং আমন্ত্রিত সব মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সনদ ও পুরস্কার বিতরন।

অনুষ্ঠান শুরু হলো। অতিথিদের নাম ঘোষিত হচ্ছে। সভাপতি স্বয়ং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তাছাড়া অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে গন্যমান্য ব্যক্তিদের নাম ঘোষনা হচ্ছে। সবশেষে ঘোষিত হলো প্রধান অতিথির নাম। প্রধান অতিথি হিসেবে যার নাম ঘোষিত হলো, তিনি সাতকানিয়ার জামায়াতে ইসলামীর আমীর। প্রধান অতিথির নামটা শুনে আমি একটু চমকে গেলাম। এই লোক একাত্তরের চিহ্নিত রাজাকার এবং পাকিস্তানীদের প্রিয় দোসরদের একজন। এই রাজাকার আজ স্বাধীন দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য সনদ ও পুরস্কার দেবেন!! হায় স্বাধীনতা, হায় বাংলাদেশ, হায় লক্ষ শহীদের আত্মা!!! পরে জেনেছি ওটা ছিল জোট সরকারের অবিস্মরনীয় বিজয়ের ফসল। এলাকায় আর কারো প্রধান অতিথি হবার জো নেই। ওই আমীরের আঙ্গুলি হেলন ছাড়া কারো সাধ্য নেই এখানে কিছু করার। আমার তক্ষুনি ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল অনুষ্ঠান থেকে। তবু থাকলাম কৌতুহলবশতঃ।

রাজাকার বেষ্টিত অনুষ্ঠানে স্বাভাবিকভাবেই একাত্তর নিয়ে স্মৃতিচারনে রাজাকারদের ভুমিকা নিয়ে কেউ কোন কথা বললো না। প্রধান অতিথি জামাত আমীর তার ভাষনে বললেন, "একাত্তরের যুদ্ধ খুব দুঃখজনক ঘটনা। আমরা যুদ্ধের সময় একেকজন একেকভাবে দেশের জন্য কাজ করেছি। প্রত্যেকের অবদান স্মরনীয়। আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে যুদ্ধের শুরুতে আমরা কীভাবে পাকিস্তানী হামলা থেকে আমাদের এলাকাকে রক্ষা করেছি, শান্তি কমিটি করেছি, বাহিনী করেছি। পাকিস্তানীদেরকে দেখাতে হয়েছে এলাকায় কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই। এখানে সবাই পাকিস্তানের সমর্থক। ওদের সাথে হাত মিলিয়ে এলাকার জনগনের জানমাল রক্ষা করেছি। ব্যাপক ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছি সাতকানিয়াকে। আমি জানি কিছু মানুষ আমাদের ভুমিকা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে, আমাদর কার্যক্রমকে ভুলভাবে নিয়েছে। কিন্তু আসলে তো আমরা দেশের স্বাধীনতার জন্যই কাজ করেছিলাম। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজকে তাই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করবো তাদের আত্মত্যাগের জন্য।" ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ধরে ধরে মঞ্চে ডাকা হলো পুরস্কার ও সনদের জন্য। খুব কষ্ট হলো হতভাগ্য মুক্তিযোদ্ধাদের করুন অসহায় নির্বাক চেহারা দেখে। যে দেশের জন্য এরা নিজের জীবনটাকে আজরাইলের হাতে তুলে দিয়েছিল বিনা দ্বিধায়, সেই দেশ কী দিয়েছে এদের? স্বাধীন দেশের ফসল খাচ্ছে আজ পাকিস্তানী দালালেরা। মুক্তিযোদ্ধাদের একজনকেও দেখলাম না সোজা হয়ে দাড়ানোর শক্তি আছে, এত অভাবী মানুষ এরা। প্রত্যেককে শাড়ি লুঙ্গি আর ভাতের থালা প্রদান করা হলো। একজন করুন স্বরে আবেদন করলেন লুঙ্গির বদলে একটা শাড়ী দিতে, কারন নিজের লুঙ্গির চেয়ে বউয়ের শাড়ীটা বেশী দরকার। আয়োজকদের কটুদৃষ্টির সম্মুখীন হয়েও অধিকার আদায়ে নাছোড়বান্দা তিনি। পরে প্রধান অতিথি রাজাকারের বদান্যতায় লুঙ্গির বদলে শাড়ী পেলেন তিনি!

পুরস্কার প্রদান পর্ব শেষ হলে প্রধান অতিথি মঞ্চ থেকে নেমে আসলেন। বসলেন আমার পাশে। বসে জামাতী কায়দায় হাত মেলালেন। আমার শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো। ভাবলাম, এই হাতে কত মানুষ প্রান হারিয়েছে, কত মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু হয়েছে। হয়তো তাদের স্বজনেরা এই হলরূমেই আছে। আমি যেন একটা সিনেমা দেখছিলাম। এসব দৃশ্য আগে সিনেমার পর্দায়ই দেখতাম কেবল। আমার সাথে খুচরা আলাপ জমানোর চেষ্টা করলেন জামাত আমীর, বললেন আমাকে বোধহয় তিনি চেনেন, কোথাও দেখেছে ইত্যাদি। আমি তেমন জবাব দিলাম না। পাত্তা দিচ্ছি না বুঝতে পেরে তফাত রইলেন।

অনুষ্ঠানের শেষদিকে একজন হাড় জিরজিরে মুক্তিযোদ্ধা দর্শক গ্যালারী থেকে উঠে দাঁড়ালেন। চরম দারিদ্র আর বয়সের ভারে ন্যুজ, কিন্তু চোখটা এখনো ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ। দেখে বোঝা যায় এ বান্দা মাথা নোয়াবার নয়। জানালেন মঞ্চে গিয়ে কিছু বলতে চান। সভাপতি অনুমতি দিলেন।

মঞ্চে উঠে জ্বালাময়ী কন্ঠ গমগম করে উঠলো হলরুমে, "আমাদের কী সৌভাগ্য!! আপনারা লুঙ্গি-থালা-বাসন দিয়ে আমাদের পুরস্কৃত করলেন। প্রতি বছরই করেন। কিন্তু আমরা কী বছরে একবার শাড়ি-লুঙ্গি-বাসন-কোসন পাবার জন্য যুদ্ধ করেছি, এইদেশ স্বাধীন করেছি? আমাদের জীবনটা কী এতই তুচ্ছ? কারা এদেশকে স্বাধীন করেছিল, আর কারা স্বাধীনতা চায় নি, আমরা কী তাদের চিনি না? যারা এদেশের স্বাধীনতা চায়নি তাদের কাছ থেকে পুরস্কার নিয়ে আমরা কী আজ লক্ষ শহীদকে সম্মান দিলাম? এটা সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন। আমাদের আর কত অপমান করবেন এভাবে? চাইনা আপনাদের লুঙ্গি শাড়ী, চাইনা আপনাদের সার্টিফিকেট। আমরা শুধু মিনতি করছি, জীবনের তো বেশী বাকী নেই আমাদের, যেটুকু আছে তা অন্ততঃ আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে দিন।" চোখে পানি নিয়ে বক্তৃতা শেষ করলেন প্রৌড় মুক্তিযোদ্ধা।

পুরো হলরুমে পিনপতন নিস্তব্ধতা। রাজাকার এলাকায় এতটা সাহস কেউ আশা করেনি। শরীরে রোগা হলেও চেতনায় উজ্জীবিত এই মুক্তিযোদ্ধা। এই চেতনাই তো আমাদের শক্তি। এই শক্তির জোরেই আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম একাত্তরে। সবাই উঠে দাড়িয়ে সম্মান জানালাম সেই সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আঁধার নেমেছে তখন সাতকানিয়ায়। আমি অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করলাম অন্যরকম এক আবিষ্ট মন নিয়ে। আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি এখনো। এই চেতনা মরতে পারে না

No comments: