বাংলাদেশের গত আট মাসের বিদঘুটে রাজনৈতিক বিবর্তন নিয়ে এত চমৎকার বিশ্লেষণ আর একটিও পড়িনি। আখতারুজ্জামান আজাদের লেখাটা সংরক্ষিত থাকুক।
আখতারুজ্জামান আজাদ
৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশকে কেউ-কেউ বলছে ‘বাংলাদেশ ২.০’। ঐ একই ‘কেউ-কেউ’ জুলাই আন্দোলনকে প্রচার করছে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে এবং স্বৈরাচারপতনকে অভিহিত করছে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিশেবে। বিশেষত ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্ব দুটো প্রচারিত হচ্ছে অত্যন্ত জোরেশোরে। এই তত্ত্বদ্বয়ের সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতারা এর প্রচারে মত্ত তো বটেই, মত্ত তাদের নিযুক্ত বেশুমার বুদ্ধিজীবীও। এই প্রচারে তারা অক্লান্ত, অবিরাম, অবিশ্রান্ত। একই গোষ্ঠীটি ৫ আগস্টকে কখনও-কখনও ‘বিজয়দিবস’ হিশেবেও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল, চেষ্টা করেছিল ‘স্বাধীনতাদিবস’ হিশেবেও প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু এই চেষ্টা হালে পানি পায়নি। গণঅভ্যুত্থান এই ভূখণ্ডে অতীতেও সংঘটিত হয়েছে— ১৯৬৯ সালে, আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে। সেই অভ্যুত্থানের বিজয়কে কেউ ‘প্রথম স্বাধীনতা’ বলে আখ্যা দেয়নি; দিলে আর একাত্তর সংঘটিত হতো না, আইয়ুবের পতনকেই ‘স্বাধীনতা’ ভেবে এখন পর্যন্ত সুখ অনুভব করতে হতো। গণঅভ্যুত্থান স্বাধীন বাংলাদেশেও হয়েছে। সেই অভ্যুত্থানে, সর্বজনস্বীকৃত স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনও হয়েছে। কিন্তু এরশাদের পতনের দিনটিকে কেউ ‘বিজয়দিবস’ বা ‘স্বাধীনতাদিবস’ হিশেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেনি, এরশাদপতনের ঘটনাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেও প্রচার করেনি, এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনকে কেউ অভিহিত করার ধৃষ্টতা দেখায়নি ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলেও। এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিলেন নয় বছর, শেখ হাসিনা নৈশ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ছিলেন শেষ দশ বছর। দুজনই স্বৈরশাসক। দুজনের পতনই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয়েছে। কিন্তু একজনের পতন ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ আর অন্যজনের পতন ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ না। কেন না— এর পেছনে পুরোনো সমীকরণ ও অঙ্ক আছে। এই অঙ্ক মোটেই জটিল না, বরং ভীষণ রকমের সহজ-সরল।
তিনটি নিরবচ্ছিন্ন নৈশ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০২৪-এর নির্বাচনের পর দেশের অধিকাংশ বোদ্ধারই স্বাভাবিক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল হাসিনার এই সরকারটি টিকবে না এবং বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। জুলাই আন্দোলনে হাসিনার বিদায় না-হলে বিদায়টি অন্য কোনোভাবে অন্য কোনো আন্দোলনে হতো। হতোই, এর কোনো বিকল্প ছিল না। কেননা, স্বাভাবিক প্রস্থানের কোনো পথ একনায়ক হাসিনা খোলা রাখেননি। আমৃত্যু সরকারপ্রধান থাকতে চেয়েছিলেন তিনি; তার মৃত্যুর পর দেশের বা তার দলের কী হবে, এ-সংক্রান্ত বিন্দুমাত্র ভাবলেশ তার ছিল না। ফলে, জুলাই মাসে তার বিদায়-আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। এই বিদায় একজন স্বৈরশাসকের বিদায়, একটা ডামি সরকারের বিদায়। বাংলাদেশে স্বৈরশাসকের বিদায়ও আগে এক বা একাধিকবার ঘটেছে, অস্বাভাবিক সরকারপরিবর্তনও ঘটেছে। এখানে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, মাত্র একবার বাদে বাংলাদেশে কখনোই কোনো সরকারের স্বাভাবিক বিদায় হয়নি। যে-একবার ক্ষমতার স্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটেছিল, সেটি ঘটিয়েছিলেন শেখ হাসিনাই— ২০০১ সালে। যা হোক, ২০২৪-এর ৫ আগস্ট একজন স্বৈরশাসকের এবং জনগণের ম্যান্ডেট না-থাকা একটি সরকারের পতন ঘটেছে, আরকিছুর পতন ঘটেনি। ঐদিন দেশ ‘স্বাধীন’ হয়ে যায়নি। দেশ আগে থেকেই স্বাধীন— সেই ১৯৭১ সাল থেকে; তা-ও আবার ১৬ ডিসেম্বর থেকে না, একদম ২৬ মার্চ থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ২৬ মার্চ, শত্রুমুক্ত হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর।
নতুন বিজয়দিবস, নতুন স্বাধীনতাদিবস কিংবা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ প্রয়োজন হচ্ছে কাদের? উত্তর যারপরনাই সহজ— ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যাদের কাছে অধীনতাদিবস, ১৬ ডিসেম্বর যাদের কাছে পরাজয়দিবস এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যাদের কাছে পরাধীনতা। একাত্তরের গণহত্যায় যে-জামায়াতে ইসলামি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সশস্ত্র সহযোগিতা করেছিল, নিজেরাও সাংগঠনিকভাবে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল, নিজেদের উদ্যোগে যারা গঠন করেছিল আল-বদর ও রাজাকারবাহিনী; ২০০১ থেকে ২০০৬— স্বাধীন বাংলাদেশে এই পাঁচ বছর বাদে অবশিষ্ট আটচল্লিশ বছর সেই জামায়াতে ইসলামি পরাধীনই ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে তারা নিজেদেরকে ‘স্বাধীন’ অনুভব করছে। আহমদ ছফার যে-উক্তিটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে উদ্ধৃত হয়, সেটি হলো— আওয়ামি লিগ যখন জেতে, একা জেতে; আওয়ামি লিগ যখন হারে, গোটা দেশসহ হারে। ২০২৪-এর আগস্টে আওয়ামি লিগ হেরেছে, হেরে স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়ে দলকে না-জানিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়েছেন কেবল নিজের বোনকে নিয়ে আর আওয়ামি লিগ ঝাড়ে-বংশে প্রভুরাষ্ট্রে পালিয়েছে গোটা দেশকে অরক্ষিত রেখে। পালানোর আগে হাসিনা ভাবার প্রয়োজন বোধ করেননি দলের কী হবে, দল ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি দেশের কী হবে। অরক্ষিত বাংলাদেশের প্রথম প্রহরেই একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী অংশটি সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে ভূগর্ভস্থ ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত যাবতীয় স্থাপনা ও ভাস্কর্য যথাসম্ভব বিনষ্ট করেছে, পরবর্তী সাত-আট মাসে দেশ থেকে মুছে দিয়েছে বা মুছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নাম-নিশানা। জামায়াতের কাছে এটিই বিজয়, এটিই স্বাধীনতা। ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র প্রয়োজন পড়েছে জামায়াতের; কারণ, প্রথম স্বাধীনতা, অর্থাৎ একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা, এদের কাছে পরাধীনতা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শুরুর দিকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্বটি বিএনপি বেশ উপভোগই করছিল। কিন্তু বিএনপির এই উপভোগপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় মূলত দুটো অঙ্কের মারপ্যাঁচে। জুলাই-আগস্টে জামায়াত-শিবিরের চেয়ে বিএনপির নেতাকর্মী অপেক্ষাকৃত বেশিসংখ্যক নিহত হলেও আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে নেয় জামায়াত এবং মুহাম্মদ ইউনুসকে ঢাল হিশেবে ব্যবহার করে দেশ চালাচ্ছে এই মুহূর্তে মূলত জামায়াতই। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে জামায়াত এত ক্ষমতা কখনোই ভোগ করেনি; যতটা ক্ষমতা ভোগ করছে ৬ আগস্ট থেকে। ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতিতে জামায়াত সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও জামায়াত অপ্রাসঙ্গিকই ছিল। নতুন করে প্রাসঙ্গিক ও ক্ষমতাধর হয়ে, অন্তর্বর্তী সরকারে প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে, জামায়াত বিএনপিকে সেরেফ বিয়োগ করে ভাঁড় বানিয়ে বসিয়ে রেখেছে। বিএনপির এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নির্বাচন, আর জামায়াতের প্রয়োজন নির্বাচন ঠেকানো। কারণ, নির্বাচন হলেই জামায়াতের বর্তমান ক্ষমতা আর থাকবে না, বিএনপি হয়ে যাবে ক্ষমতাসীন দল। এ-পর্যায়ে বিএনপির প্রয়োজন যেকোনোভাবে জামায়াতকে ঠেকানো এবং জামায়াতকে ঠেকাতে বিএনপির হাতে কোনো অজুহাতই নেই। দল দুটো দীর্ঘদিন একযোগে নির্বাচন করেছে, ফলে এরা মূলত পরস্পরের পরিপূরকই। সমীকরণ যখন এই, তখন জামায়াতকে মোকাবেলা করতে বিএনপি এখন মুক্তিযুদ্ধের অভিভাবক হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিএনপির রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে মূলত ‘একটি’ পুঁজির ওপর; সেটি হলো— দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষক’। একাত্তরের স্বাধীনতার বিপরীতে আরেকটি স্বাধীনতা, অর্থাৎ দ্বিতীয় স্বাধীনতা, যদি দাঁড়িয়েই যায়; তা হলে জিয়াউর রহমানের গুরুত্ব কমে যায় এবং বিএনপির রাজনীতি মার খেয়ে যায়। এসব সমীকরণ না-থাকলে বিএনপিও জামায়াতের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্বের সাথে ধেইধেই করে তাল মেলাত।
জুলাই আন্দোলন ছিল দৃশ্যত কোটা-আন্দোলন; তা-ও আবার কোটা-বাতিল আন্দোলন না, কোটা-সংস্কার আন্দোলন। ১৬ জুলাই যদি পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত না-হতো, তা হলে ঐ আন্দোলন দেড়-দুই দিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে যেত। ঐ ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন ছিল ছাত্র। পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষই শান্তিকালীন অবস্থায় পাঁচজন ছাত্রের হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না, বিবেকের তাড়নায় পথে নেমে আসে, বিচার চায়। জুলাই মাসেও তা-ই হয়েছিল। একের পর এক হত্যাকাণ্ড দেখে সেরেফ বিবেকের তাড়নায়ই সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছিল— বিচারের দাবিতে। কোনো ঘোষক, সংগঠক বা সমন্বয়কের আহ্বানে মানুষ রাস্তায় নামেনি; নেমেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ‘সমন্বয়ক’ নামধারী যারা ছিল; দেশজুড়ে কেউই তাদেরকে চিনত না, আলাদা কোনো কারিশমা তাদের ছিল না, তারা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল না— এমনকি পার্শ্বচরিত্রও না। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল সেরেফ রক্ত দেখে, কোনো সমন্বয়কের চেহারা দেখে নয়। তখন কেউই জানত না সরকারপতন হবে। ফলে, জুলাইয়ের আন্দোলন আদতে সরকারপতন-আন্দোলনও ছিল না। জুলাইয়ে কোনো সমন্বয়ক বলতে পারেনি যে, সে সরকারের বিদায় চায়; তারা বরং এই মর্মে অভিনয় করে গেছে যে, তারা সাধারণ ছাত্রদের অধিকার চায়। যারা সরকারপতনের দাবিও তোলেনি বা তুলতে পারেনি, সেই আন্দোলনকে তারা অভিহিত করছে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ হিশেবে— হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি এমন প্রতারণা বা প্রগলভতা দেখেছে কি না, সন্দেহ আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন কোনো গোপন আন্দোলন ছিল না। একাত্তরেরও বহু আগে থেকে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক লোকজন প্রকাশ্যেই স্বাধীনতার দাবি করে এসেছিলেন। যুদ্ধ শুরুর বহু আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ দেওয়া হয়েছিল, আলাদা জাতীয় পতাকা তৈরি করা হয়েছিল, সেই পতাকা ওড়ানো হয়েছিল, নতুন দেশের জাতীয় সংগীত কী হবে তা-ও ঘোষণা করা হয়েছিল। ঘোষণাগুলো করেছিলেন প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য নেতাকর্মীরা— প্রকাশ্যে। স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওতে দেওয়া হয়েছিল— প্রকাশ্যে। যুদ্ধ শুরুর পর প্রকাশ্যে গঠন করা হয়েছিল অস্থায়ী সরকার, অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছিল— প্রকাশ্যেই। অস্থায়ী সরকারের ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ ছিল প্রকাশ্যঘোষিত রাজনৈতিক এজেন্ডা। অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পঁচিশে মার্চের গণহত্যার রাতেও নিজ বাড়িতে প্রকাশ্যেই ছিলেন, কোথাও পালিয়ে যাননি। মুক্ত দেশে তার প্রত্যাবর্তনও ছিল প্রকাশ্য। মুজিব কখনও গোপন রাজনীতি করেননি; গোপনে দেশ ছাড়েননি, গোপনে দেশে ফেরেননি। কোনো মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় লুকিয়ে পাকিস্তান পিপল্স পার্টিতে ঢুকে ঘাপটি মেরে থাকেননি (যেভাবে ছাত্রশিবির লুকিয়ে ছিল ছাত্রলিগে)। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা রাজনীতি করেছেন, প্রকাশ্যেই করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু প্রকাশ্য ছিল বিধায় সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়নি— মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করা উচিত হবে কি হবে না। যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার করা হবে, তা-ও ২০০৮-এ আওয়ামি লিগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যেই উল্লিখিত ছিল। এই বিচার হুট করেও হয়নি, গোপনেও হয়নি। একই কথা বলা যায় নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বেলায়ও। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের দাবিটা তখন প্রকাশ্য ছিল। তৎকালীন প্রায় রাজনৈতিক দলই এরশাদের পতনের ব্যাপারে একমত ছিল এবং এই দাবিতে লাগাতার আন্দোলনও করে গেছে। এই আন্দোলনেও কোনো গোপনীয়তা বা ছদ্মবেশ ছিল না। জনসাধারণ জানত আন্দোলনটি এরশাদপতনের আন্দোলন এবং কী কী ঘটবে আন্দোলন সফল বা ব্যর্থ হলে।
২০২৪-এর জুলাইয়ের আন্দোলন— চক্ষুলজ্জার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে জামায়াতে ইসলামি এবং তাদের বি-টিম ও সি-টিম যেটিকে এখন ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে বেড়াচ্ছে— সমন্বয়কদের মাধ্যমে সেটিকে তারা প্রথমে প্রচার করিয়েছিল ‘কোটা-সংস্কার আন্দোলন’ বলে। শুরুতে তারা কোনোভাবেই প্রচার করেনি যে, তাদের উদ্দেশ্য আসলে সরকারপতন, তাদের লড়াইটা আসলে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’, লড়াইয়ে জয়ী হলে তারা কী কী করবে। সমন্বয়করা প্রথমে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় কোনোভাবেই দেয়নি, পরিচয় দিয়েছে ‘সাধারণ ছাত্র’ হিশেবে। জুলাই আন্দোলনে ব্যর্থ হলে সমন্বয়করা গ্রেপ্তার হতো ঠিকই; আবার জনমতের চাপে সরকার তাদেরকে ‘সাধারণ ছাত্র’ হিশেবেই মুক্তি দিতে বাধ্য হতো, বাকি জীবনটা তারা ‘সাধারণ ছাত্র’ হিশেবেই কাটিয়ে দিত। কিন্তু যখনই সরকারপতন নিশ্চিত হয়েছে, তখনই সমন্বয়করা ক্রমশ শিবিরনেতা হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যে-সমন্বয়করা এককালে ছাত্রলিগে পদধারী ছিল; শেখ হাসিনার পলায়নের পর তারাই পরিচয় দেওয়া শুরু করল যে, তাদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক, কেউ সভাপতি। যে-আবু সাঈদের মরদেহের ওপর ভিত্তি করে পুরো জুলাই আন্দোলনটা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিল, সরকারপতনের আগ পর্যন্ত শিবির সেই আবু সাঈদকেও শিবিরকর্মী বলে স্বীকার করেনি। শিবির সাঈদকে ‘সাথী’ বলে প্রচার করেছে সরকারপতন নিশ্চিত হওয়ার পরে। জামায়াত-শিবির কখনোই স্বনামে রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেনি; সেজন্যই তারা অপেক্ষা করে দেশে কখন সামরিক শাসন আসবে, সেজন্যই জামায়াত বলে বেড়ায়— দেশে দেশপ্রেমিক সংগঠন কেবল দুটো— জামায়াত আর সেনাবাহিনী।
সমন্বয়কদের একটা বড় অংশ ছিল গোপনে ছাত্রশিবিরের পদধারী, প্রকাশ্যে ছাত্রলিগকর্মী। যে-সমন্বয়করা প্রকাশ্যে বা গোপনে শিবিরের পদধারী ছিল না, তারাও শিবিরেরই উপজাত। শিবির তাদেরকে তৈরি করে রেখেছিল সরকারপতন-আন্দোলনে ব্যবহার করার জন্য। সরকারপতন-আন্দোলন অন্যায় কিছু না। যেকোনো ব্যক্তি বা সংগঠন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ঘোষণা দিয়ে সরকারের পতন চাইতে পারে, চাইতে পারে বিএনপি বা জামায়াতও। কিন্তু একটা সর্বজনীন কোটা-আন্দোলনে পড়ে-যাওয়া লাশকে পুঁজি করে দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টি করে সরকারপতন ঘটিয়ে, পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের নামনিশানা মুছে দেওয়ার পাঁয়তারা করে আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে প্রচারের কোনো অধিকার কারো নেই। জুলাই আন্দোলনে শুধু জামায়াত-শিবির বা বিএনপি-ছাত্রদল অংশগ্রহণ করেনি। নির্দিষ্ট কোনো দলের তাঁবেদারি না-করা— মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী— প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীও জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। নিজ-নিজ শিল্পমাধ্যম ব্যবহার করে এই গোষ্ঠীটি জুলাই আন্দোলনে অংশ না-নিলে বা নৈতিক সমর্থন না-দিলে আগস্টে কোনোভাবেই সরকারপতন হতো না। প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকরা আওয়ামি জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে জুলাইয়ে কলাম-কবিতা না-লিখলে, কার্টুন ও গ্রাফিতি না-আঁকলে, প্রতিবাদী গান না-গাইলে আওয়ামি লিগ সরকার সে-যাত্রায় টিকে যেত। প্রগতিশীলরা কবিতা লিখে, কার্টুন এঁকে, গান গেয়ে নিজ-নিজ জায়গায় ফিরে গেছেন; ক্ষমতার জন্য দেনদরবার করেননি। কিন্তু সমন্বয়কচক্র এবং জামায়াতে ইসলামি রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে এবং ঐ প্রগতিশীলদের অনেকেরই রুটিরুজির পথ বন্ধ হয়ে গেছে আগস্টপরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থানের কারণে। মুহাম্মদ ইউনুসকে সামনে রেখে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জামায়াতে ইসলামি— বাংলাদেশের বুক থেকে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ কায়েম করার জন্য যা যা করা সম্ভব— সবকিছুই করে চলছে। কিন্তু জামায়াতকে বা ইউনুস সরকারকে এসব করার ম্যান্ডেট জনগণ দেয়নি। প্রগতিশীল লোকজন বা রাজনীতি-না-বোঝা জনসাধারণ জুলাইয়ে আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছিল ছাত্রজনতার রক্ত সহ্য করতে না-পেরে সেরেফ বিবেকের তাড়নায়; দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বিদায় করে দিতে নয়, জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করাতেও নয়, সরকারপতনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিশেবে সাব্যস্ত করতেও নয়। জামায়াত জুলাই আন্দোলন ছিনতাই করেছে।
যদি জামায়াতে ইসলামি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী জুলাইয়ে ঘোষণা করত— চলমান আন্দোলনটা মুক্তিযুদ্ধকে হটিয়ে পূর্ব পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলন, আন্দোলনে জয়ী হলে আন্দোলনকে তারা মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করাবে, সরকারপতনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে গেজেট প্রকাশ করবে; তা হলে জামায়াতের বা ঐ রাজনৈতিক গোষ্ঠীটির বর্তমান কর্মকাণ্ড মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সাধারণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে জামায়াত জুলাইয়ের সমস্ত কৃতিত্ব লুটপাট করে নিয়েছে, দেশের সর্বক্ষেত্রে নিজেদের লোক বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেশকে অঘোষিত পূর্ব পাকিস্তান বানিয়েছে, জাতির সাথে পুনর্বার প্রতারণা করেছে। জামায়াত-শিবির ভালো করেই জানে— কোটা-আন্দোলন দূরে থাক, নিজেদের পরিচয়ে কোনো আন্দোলনেই ডাকলে সাধারণ মানুষ বা ছাত্রসমাজ তাতে সাড়া দেবে না। তাই, জুলাইয়ে তারা এমন দেড়শো সমন্বয়ককে মাঠে নামিয়েছিল— যাদের কেউ বাইরে শিবির বলে পরিচিত না, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে প্রত্যেকে শিবির অথবা শিবির-ভাবাপন্ন। আন্দোলনের সময়ে সমন্বয়করা শতভাগ ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রেখেছে। কারণ, জামায়াত এও জানে— কোনো ধর্মীয় সংগঠনের, বিশেষত জামায়াতের, আহ্বানে কোনো ইশুতেই মানুষ রাজপথে নামবে না। আন্দোলনে জামায়াত-শিবির নিজেদের পরিচয় রেখেছে লুক্কায়িত, উদ্দেশ্যও রেখেছে লুক্কায়িত। ছদ্মবেশে ছাত্রলিগেরও একটা বড় অংশ দখল করে রেখেছিল শিবির। অতীতে-ছাত্রলিগ-করা সমন্বয়করা এখন নিজেদের শিবিরপরিচয় তুলে ধরে দাবি করছে— আওয়ামি লিগের আমলে তারা বাধ্য হয়ে ছাত্রলিগ করেছে। অথচ আওয়ামি লিগের আমলে শুধু শিবিরই নিপীড়িত ছিল না, নিপীড়িত ছিল ছাত্রদলও। ছাত্রদলের কেউ অদ্যাবধি দাবি করেনি যে, সে বাধ্য হয়ে ছাত্রলিগ করেছিল। জুলাইয়ের আদ্যোপান্তজুড়ে যে-জামায়াত আশ্রয় নিয়েছে পৌনঃপুনিক প্রতারণার, সেই জামায়াতই এখন দাবি করে বসছে— জুলাই হলো ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’। সাধারণ শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে যে-শিবিরকর্মীরা জুলাইয়ে সমন্বয়ক সেজেছিল, অর্থাৎ যে-সমন্বয়করা জুলাইয়ে ন্যূনতম আত্মপরিচয়টুকু প্রকাশের সৎ সাহস দেখাতে পারেনি; তারাই এখন বীরদর্পে আবদার করছে ৫ আগস্ট ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতাদিবস’। স্বনামে আন্দোলন করার মুরোদ যাদের নেই, যারা জিতে গেলে ‘শিবির’ আর হেরে গেলে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’; তারা এসেছে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্ব নিয়ে। প্রতারণার মাধ্যমে যাদের উত্থান, তাদের মুখে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটাই প্রহসন। প্রতারণা ক্ষমতা এনে দিতে পারে, স্বাধীনতা না।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ, ক্ষয়-ক্ষতি, দায়-দায়িত্ব— সবকিছুই মীমাংসিত। কিন্তু ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলন এখনও মীমাংসিত না, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অমীমাংসিত। জুলাই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা ও আওয়ামি লিগের দায় সর্বজনস্বীকৃত। জুলাইয়ের ঘটনায় হুকুমের আসামি হিশেবে শেখ হাসিনার বিচার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, জুলাই বাবদ দল হিশেবে আওয়ামি লিগেরও বিচার হওয়ার অবকাশ আছে। কিন্তু জুলাইয়ে যতজন নিহত-আহত হয়েছে; এর সবাই পুলিশ বা আওয়ামি লিগের নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত-আহত হয়েছে কি না, তৃতীয় কোনো শক্তি লাশের সংখ্যা বাড়িয়ে সরকারপতন ত্বরান্বিত করেছিল কি না— এই প্রশ্নের উত্তর এখনও কেউ দিতে পারেনি। এ নিয়ে প্রশ্ন করায় দপ্তর পালটে দিয়ে সরকারে উলটো অপ্রাসঙ্গিক ও অপাঙ্ক্তেয় করে রাখা হয়েছে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনকে। জুলাই-আগস্টে মোট কতজন পুলিশসদস্য হতাহত হয়েছেন এবং তাদেরকে কারা হত্যা করেছে, কারা পুলিশ মেরে ওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রেখেছে, মরদেহ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে— মেলেনি এর জবাবও। কারা মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছিল, কারা থানা আক্রমণ করে পুলিশের অস্ত্র লুটপাট করেছিল, কারা কারাগারে আক্রমণ করে নিজেদের দলের আসামিদেরকে ছিনিয়ে নিয়েছিল— এর ব্যাখ্যা জামায়াত দেয়নি, সমন্বয়করা দেয়নি, দেয়নি সরকারও। কোনো জবাব না-দিয়ে সরকার উলটো জারি করেছে এমন দায়মুক্তি আইন; উল্লিখিত অপরাধীদেরকে যে-আইন সুরক্ষা দিয়েছে, যে-আইনের কারণে এই অপরাধীদের বিচার হবে না। এতকিছু অমীমাংসিত রেখে একটা আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা বীভৎস বাতুলতা বৈ কিছুই নয়। যে-কোটার বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলন দেশে এমন প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল; ইতিহাসে সোনার হরফে বাঁধিয়ে রাখার মতো মোনাফেকি হলো— জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্যবর্গ ও আহতদের জন্য সরকারি চাকরিতে সেই ‘কোটা’-ই রেখেছে অন্তর্বর্তীকালীন সমন্বয়ক সরকার। সমন্বয়কদের আনীত ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র নমুনা হলো এই। সমন্বয়কদের মুখে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিই অসহনীয়— হোক তা ‘প্রথম স্বাধীনতা’, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বা ‘তৃতীয় স্বাধীনতা’।
এই লেখায় ইতোমধ্যেই একবার উল্লেখ করেছি মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের একটা প্রোক্লেমেশন ছিল— ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’। জুলাই আন্দোলনের কথিত সমন্বয়করা এর দেখাদেখি ২০২৪-এর ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে ‘প্রোক্লেমেশন অব রিভোলিউশন’ হাজির করতে চেয়েছিল এবং আত্মবিশ্বাসে টগবগ করতে-করতে বলেছিল ‘নাউ অর নেভার’। প্রোক্লেমেশন হাজির করতে হয় ঘটনা ঘটানোর পরে না, আগে। সমন্বয়করা আন্দোলন চলাকালে কিছুই হাজির করতে পারেনি, হাজির করতে চেয়েছে পাঁচ মাস পরে। তা-ও পারেনি, শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যে-আন্দোলনের পরতে-পরতে প্রতারণা, সে আন্দোলন কোনো-না-কোনো পর্যায়ে ব্যর্থ হবেই। সমন্বয়করা আবদার করেছিল সংবিধান বাতিল করতে। সে-যাত্রায়ও তারা ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধান বাতিল করতে চাওয়ার নেপথ্য কারণ— এই সংবিধানের মূল ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধ। এই সংবিধানের শুরুতেই স্বীকার করা হয়েছে— ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি’। জামায়াত বা সমন্বয়করা যদি এই সংবিধান বাতিল করাতে পারত, তা হলে সংবিধান থেকে ১৯৭১ এবং ২৬ মার্চকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সেখানে যথাক্রমে ২০২৪ ও ৫ আগস্ট প্রতিস্থাপন করত। ১৯৭১, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামি এবং তাদের বি-টিম ও সি-টিমের জন্য পরাজয়। এই সাল ও তারিখগুলোকে, তাই, তারা যেকোনোভাবে নিশ্চিহ্ন করতে চায়; নিদেনপক্ষে অগুরুত্বপূর্ণ করে দিতে চায়।
জুলাই আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলার ধারা জামায়াতে ইসলামিরও আগে শুরু হয়েছিল আরেকটি জায়গা থেকে। ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে পালিত হয়েছে পাকিস্তানরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলি জিন্নাহ্র মৃত্যুবার্ষিকী। আয়োজন করেছিল একাত্তরে বাংলাদেশে-আটকে-পড়া বিহারিরা। পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনারের উপস্থিতিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সেই অনুষ্ঠানে বিহারি নাগরিক মো. শামসুদ্দিন বলেছিলেন— ‘১৯৭১ সালে ভারত যুদ্ধ করে আমাদের এ-দেশকে দুই ভাগ করে দিয়েছে। পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন বছর ধরে আমাদের বাপ-দাদারা এই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখে গেছেন। এজন্য আজ আমাদের এখানে পাকিস্তানের সবাইকে দেখে আর এ-অনুষ্ঠানে এসে খুব খুশি লাগছে।’ শামসুদ্দিন আরো বলেছিলেন— ‘৫ আগস্ট আমাদের বিজয়দিবস, এটিই আমাদের স্বাধীনতাদিবস।’ এই বিহারি ভুল কিছু বলেননি। বিহারিদের জন্য ৫ আগস্ট বিজয়দিবস এবং স্বাধীনতাদিবসই। যেহেতু ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর তাদের পরাধীনতাদিবস ও পরাজয়দিবস এবং যেহেতু ৫ আগস্টের আগে তারা বাংলাদেশে কখনও প্রকাশ্যে জিন্নাহ্র জন্মদিন পালন করার কথা কল্পনাও করেনি বা পাকিস্তানের হাই কমিশনারকে অতিথি করে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেনি— এমনকি খন্দকার মোশতাক আহমেদ বা জিয়াউর রহমানের আমলেও না; সেহেতু ৫ আগস্টই তাদের বিজয়দিবস ও স্বাধীনতাদিবস। জামায়াতে ইসলামি এবং তাদের বি-টিম ও সি-টিমের জন্যও ৫ আগস্ট বিজয়দিবস ও স্বাধীনতাদিবস। জামায়াতকে এই ঔদ্ধত্যপ্রদর্শনের সুযোগ দিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। হাসিনাই এই ভূখণ্ডের একমাত্র বেসামরিক শাসক, যার পতন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয়েছে। টানা তিনটি ভুয়া নির্বাচনের ফলে তাকে এবং তার দলকে ঝাড়ে-বংশে পালাতে হয়েছে এবং এই পলায়নসৃষ্ট খালি-মাঠে জামায়াত এখন একাই গোল দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ও এসেছিল আওয়ামি লিগের রাজনৈতিক নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ও রচিত হলো আওয়ামি লিগেরই হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের যতটা ক্ষতি আওয়ামি লিগ করে গিয়েছে, অতটা ক্ষতি জামায়াতও করতে পারেনি।
এখানে জামায়াতের বি-টিম বলতে বোঝাচ্ছি ‘এবি পার্টি’কে। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার পর জামায়াত যখন নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছিল; তখন তারা নিজেদেরই কিছু নেতাকর্মীকে দিয়ে বিকল্প হিশেবে ‘এবি পার্টি’ বানিয়ে রেখেছিল, যাতে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ামাত্র জামায়াতের নেতাকর্মীরা সদলবল এবি পার্টিতে সেঁধিয়ে পড়তে পারেন। জামায়াতের সি-টিম হলো নবগঠিত ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’। ছাত্রশিবিরের যে ভূগর্ভস্থ কর্মীরা কখনও প্রকাশ্যে শিবির করেনি, জামায়াত তাদেরকে দিয়ে এই ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ তৈরি করেছে। এই দলটি করে জামায়াত লাভবান হচ্ছে দুইভাবে— প্রথমত, নাগরিক পার্টির গায়ে প্রত্যক্ষ জামায়াত-ট্যাগ নেই; ফলে, জামায়াত যা-যা বলতে পারে না বা বললেও তরুণসমাজ গায়ে মাখে না; জামায়াত সেসব কথাবার্তা নাগরিক পার্টিকে দিয়ে অনায়াসে বলাতে পারছে; দ্বিতীয়ত, নাগরিক পার্টির সব নেতা যেহেতু বয়সে তরুণ এবং যেহেতু তাদের পক্ষে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ সংঘটন অসম্ভব, সেহেতু নাগরিক পার্টি সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধাপরাধের কলঙ্কমুক্ত। একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত যেহেতু কখনোই ক্ষমা না-চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এজন্য তরুণসমাজের কাছে জামায়াতের যেহেতু গ্রহণযোগ্যতা নেই, সেহেতু যুদ্ধাপরাধের কলঙ্কমুক্ত একটা কুমারী রাজনৈতিক দল জামায়াতের প্রয়োজন ছিল; জামায়াতের প্রয়োজনীয় সেই তারুণ্যনির্ভর কুমারী দলটিই হলো নাগরিক পার্টি। নাগরিক পার্টি এখন কুসুম-কুসুম ভঙ্গিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকবে, আধো-আধো অসাম্প্রদায়িক চেতনাও দেখাবে, ইদে-চান্দে প্রগতিশীল ভাবমূর্তিও ধরে রাখবে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধপ্রশ্নে বাস্তবায়ন করবে জামায়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। নির্বাচনে যতগুলো আসন নাগরিক পার্টি পাবে, পরবর্তীকালে সব আসন নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে গড়বে রাজনৈতিক জোট।
মনে রাখতে হবে— জামায়াতের ছাত্রসংগঠনের নাম অতীতে ছিল পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসংঘের ভূমিকা এত নৃশংস ছিল যে, ছাত্রসংঘ স্বনামে আর রাজনীতি করতে পারেনি। ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীদেরকে নিয়েই ১৯৭৭ সালে গঠন করা হয় ছাত্রশিবির। আরো মনে রাখতে হবে— শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল, ফলে ধর্মীয় সংগঠন হিশেবে জামায়াতে ইসলামিও শেখ মুজিবের আমলে নিষিদ্ধ ছিল এবং জামায়াত-নেতারা ছিলেন পাকিস্তানে পলাতক অথবা আত্মগোপনে ছিলেন দেশের ভেতরেই। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জামায়াতে ইসলামি আর বসে থাকেনি, রাজনীতি করেছে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ’ নামে। জামায়াত-নেতারা ১৯৭৬ সালে সমমনা অন্য স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে নিয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ গঠন করেছিলেন, দলটি ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে এই নামে অংশগ্রহণ করে কিছু আসনও পেয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, অর্থাৎ বিপদ কেটে যাওয়ার পর, জামায়াতে ইসলামি আবার জামায়াতে ইসলামি রূপে ফিরে আসে। অর্থাৎ অস্তিত্বরক্ষার খাতিরে সাময়িকভাবে আরেক দল গঠনের ইতিহাস এবং প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর নতুন দল বিলুপ্ত করে পুরোনো দলে ফিরে যাওয়ার নজির জামায়াতের আগে থেকেই আছে। উল্লেখ্য— এই মুহূর্তে যেকোনো ইশুতে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান এবং এবি পার্টি ও নাগরিক পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান হুবহু এক, তারা কখনোই আলাদা সুরে কথা বলছে না। তাদের গানের সুরও এক, বাণীও এক; কেবল গায়ক আলাদা, মঞ্চ আলাদা; গ্রিনরুম অভিন্ন। নাগরিক পার্টির নেতারা সাধারণ কথাও বলে চিৎকার করে। কারণ, তাদের বক্তব্যগুলো আরোপিত। আরোপিত কথা চিৎকার করেই বলতে হয়, স্বাভাবিকভাবে বলা যায় না। আওয়ামি লিগ-বিএনপি নিজেদের সমস্ত শক্তি একই জায়গায় খরচ করে এবং যখন পালানোর প্রয়োজন পড়ে, সদলবল পালায়। কিন্তু জামায়াত সব শক্তি এক জায়গায় খরচ করে না, শাখা রাখে; যেন পালাতে হলে সদলবল পালাতে না-হয়। জামায়াতে ইসলামি ‘মাদার অর্গানাইজেশন’, এবি পার্টি এবং নাগরিক পার্টি জামায়াতের ‘সিস্টার কনসার্ন’। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর জামায়াত এবি পার্টিকেও বিলুপ্ত করে দেবে, বিলুপ্ত করে দেবে নাগরিক পার্টিকেও। আরো উল্লেখ্য— জামায়াতে ইসলামি, এবি পার্টি, নাগরিক পার্টি এবং বিহারি জনগোষ্ঠী ছাড়া আর কেউই ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্ব প্রচার করছে না। তিপ্পান্ন বছর ধরে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি যাদের জন্য ছিল পরাজয়ের শামিল, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তাদেরই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। জামায়াত জানে বিহারিদের কোন-কোন জায়গায় ব্যথা। বিহারিরাও জানে জামায়াতের ব্যথা কোন-কোন জায়গায়।
পুনশ্চ—
নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা— এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার কিছু পঙ্ক্তি এ-রকম— ‘এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে-ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না। তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি? তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কে বেঞ্চে-বৃক্ষে ফুলের বাগানে ঢেকে দেওয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি? জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালো হাত। তাই দেখি— কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ (রচনাকাল ১৯৮০)। নির্মলেন্দু গুণের সাথে কথা বলে জেনেছি— ‘উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান’ বলতে তিনি সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানের (রেসকোর্স ময়দান) বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমানের আমলে দাঁড় করানো শিশুপার্ককে বুঝিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে— সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব খর্ব করার জন্যই উদ্যানের ভেতর শিশুপার্ক বানানো হয়েছিল। শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় রাজনৈতিক সমাবেশগুলো রেসকোর্স ময়দানেই হতো। তার মৃত্যুর পর ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ চালু হলেও সামরিক শাসন জারি থাকার কারণে রাজনৈতিক সমাবেশের অনুমতি ছিল না। পরবর্তীকালে জিয়া ‘ঘরোয়া রাজনীতি’র অনুমতি দেন এবং গুলিস্তানে জিপিওর পার্শ্ববর্তী খালি জায়গায় (মুক্তাঙ্গন) ক্ষুদ্রপরিসরে সভা করার সুযোগ দেন। এই প্রক্রিয়াকেই গুণ ‘মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ’ বলেছেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর শাসকগোষ্ঠীকে তোয়াজ করার জন্য অখ্যাত অনেক কবি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছিলেন এবং প্রগতিশীল কিছু কবি নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। ‘কবির বিরুদ্ধে কবি’— এখানে প্রথমোক্ত ‘কবি’ স্বয়ং মুজিব আর দ্বিতীয়োক্ত ‘কবি’ হলেন ঐ দুই শ্রেণির কবিসম্প্রদায়।
১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে তৎকালীন বিমানবাহিনীপ্রধান গোলাম তাওয়াব তিনদিনব্যাপী একটি ‘সিরাত মাহফিল’ আয়োজন করেছিলেন। তারিখ হিশেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ৭ মার্চকেই, কারণ পাঁচ বছর আগের এই দিনে শেখ মুজিবুর রহমান একই মাঠে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সিরাত মাহফিলে বক্তব্য রাখেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, যাদের অধিকাংশই বাহাত্তরের দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত। মাহফিলে বক্তব্য রাখেন তরুণ মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও, পাঠ করে শোনানো হয় গোলাম আজমের লিখিত বক্তব্যও। স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে একযোগে মাঠে নামালে মুক্তিযোদ্ধারা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান, তা পরখ করে দেখাই ছিল ঐ মাহফিল আয়োজনের উদ্দেশ্য। ৭ মার্চের ভাষণের বিপরীতে ৭ মার্চের সিরাত মাহফিলকেই নির্মলেন্দু গুণ অভিহিত করেছেন ‘মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ বলে।
কবিতাটি ১৯৮০ সালে না-লিখে এখন লিখলে নির্মলেন্দু গুণ নিশ্চয়ই ‘কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ লিখেই থামতেন না; যুক্ত করতেন আরো তিনটি শব্দ— স্বাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা।
================================
To the young politician:
Tricks with the people never win in the long run. When you manipulate the trust of the citizens of Bangladesh with deceitful tactics, you not only betray their faith but also pave your own downfall. Real power lies in wisdom, integrity, and the genuine commitment to serve the nation. In the end, those who choose trickery are marked as the ultimate losers.
তিনটি নিরবচ্ছিন্ন নৈশ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০২৪-এর নির্বাচনের পর দেশের অধিকাংশ বোদ্ধারই স্বাভাবিক ভবিষ্যদ্বাণী ছিল হাসিনার এই সরকারটি টিকবে না এবং বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। জুলাই আন্দোলনে হাসিনার বিদায় না-হলে বিদায়টি অন্য কোনোভাবে অন্য কোনো আন্দোলনে হতো। হতোই, এর কোনো বিকল্প ছিল না। কেননা, স্বাভাবিক প্রস্থানের কোনো পথ একনায়ক হাসিনা খোলা রাখেননি। আমৃত্যু সরকারপ্রধান থাকতে চেয়েছিলেন তিনি; তার মৃত্যুর পর দেশের বা তার দলের কী হবে, এ-সংক্রান্ত বিন্দুমাত্র ভাবলেশ তার ছিল না। ফলে, জুলাই মাসে তার বিদায়-আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। এই বিদায় একজন স্বৈরশাসকের বিদায়, একটা ডামি সরকারের বিদায়। বাংলাদেশে স্বৈরশাসকের বিদায়ও আগে এক বা একাধিকবার ঘটেছে, অস্বাভাবিক সরকারপরিবর্তনও ঘটেছে। এখানে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, মাত্র একবার বাদে বাংলাদেশে কখনোই কোনো সরকারের স্বাভাবিক বিদায় হয়নি। যে-একবার ক্ষমতার স্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটেছিল, সেটি ঘটিয়েছিলেন শেখ হাসিনাই— ২০০১ সালে। যা হোক, ২০২৪-এর ৫ আগস্ট একজন স্বৈরশাসকের এবং জনগণের ম্যান্ডেট না-থাকা একটি সরকারের পতন ঘটেছে, আরকিছুর পতন ঘটেনি। ঐদিন দেশ ‘স্বাধীন’ হয়ে যায়নি। দেশ আগে থেকেই স্বাধীন— সেই ১৯৭১ সাল থেকে; তা-ও আবার ১৬ ডিসেম্বর থেকে না, একদম ২৬ মার্চ থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ২৬ মার্চ, শত্রুমুক্ত হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর।
নতুন বিজয়দিবস, নতুন স্বাধীনতাদিবস কিংবা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ প্রয়োজন হচ্ছে কাদের? উত্তর যারপরনাই সহজ— ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যাদের কাছে অধীনতাদিবস, ১৬ ডিসেম্বর যাদের কাছে পরাজয়দিবস এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যাদের কাছে পরাধীনতা। একাত্তরের গণহত্যায় যে-জামায়াতে ইসলামি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সশস্ত্র সহযোগিতা করেছিল, নিজেরাও সাংগঠনিকভাবে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল, নিজেদের উদ্যোগে যারা গঠন করেছিল আল-বদর ও রাজাকারবাহিনী; ২০০১ থেকে ২০০৬— স্বাধীন বাংলাদেশে এই পাঁচ বছর বাদে অবশিষ্ট আটচল্লিশ বছর সেই জামায়াতে ইসলামি পরাধীনই ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে তারা নিজেদেরকে ‘স্বাধীন’ অনুভব করছে। আহমদ ছফার যে-উক্তিটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে উদ্ধৃত হয়, সেটি হলো— আওয়ামি লিগ যখন জেতে, একা জেতে; আওয়ামি লিগ যখন হারে, গোটা দেশসহ হারে। ২০২৪-এর আগস্টে আওয়ামি লিগ হেরেছে, হেরে স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়ে দলকে না-জানিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়েছেন কেবল নিজের বোনকে নিয়ে আর আওয়ামি লিগ ঝাড়ে-বংশে প্রভুরাষ্ট্রে পালিয়েছে গোটা দেশকে অরক্ষিত রেখে। পালানোর আগে হাসিনা ভাবার প্রয়োজন বোধ করেননি দলের কী হবে, দল ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি দেশের কী হবে। অরক্ষিত বাংলাদেশের প্রথম প্রহরেই একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী অংশটি সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে ভূগর্ভস্থ ‘স্বাধীনতা জাদুঘর’ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত যাবতীয় স্থাপনা ও ভাস্কর্য যথাসম্ভব বিনষ্ট করেছে, পরবর্তী সাত-আট মাসে দেশ থেকে মুছে দিয়েছে বা মুছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নাম-নিশানা। জামায়াতের কাছে এটিই বিজয়, এটিই স্বাধীনতা। ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র প্রয়োজন পড়েছে জামায়াতের; কারণ, প্রথম স্বাধীনতা, অর্থাৎ একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা, এদের কাছে পরাধীনতা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শুরুর দিকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্বটি বিএনপি বেশ উপভোগই করছিল। কিন্তু বিএনপির এই উপভোগপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় মূলত দুটো অঙ্কের মারপ্যাঁচে। জুলাই-আগস্টে জামায়াত-শিবিরের চেয়ে বিএনপির নেতাকর্মী অপেক্ষাকৃত বেশিসংখ্যক নিহত হলেও আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে নেয় জামায়াত এবং মুহাম্মদ ইউনুসকে ঢাল হিশেবে ব্যবহার করে দেশ চালাচ্ছে এই মুহূর্তে মূলত জামায়াতই। ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে জামায়াত এত ক্ষমতা কখনোই ভোগ করেনি; যতটা ক্ষমতা ভোগ করছে ৬ আগস্ট থেকে। ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতিতে জামায়াত সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও জামায়াত অপ্রাসঙ্গিকই ছিল। নতুন করে প্রাসঙ্গিক ও ক্ষমতাধর হয়ে, অন্তর্বর্তী সরকারে প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে, জামায়াত বিএনপিকে সেরেফ বিয়োগ করে ভাঁড় বানিয়ে বসিয়ে রেখেছে। বিএনপির এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নির্বাচন, আর জামায়াতের প্রয়োজন নির্বাচন ঠেকানো। কারণ, নির্বাচন হলেই জামায়াতের বর্তমান ক্ষমতা আর থাকবে না, বিএনপি হয়ে যাবে ক্ষমতাসীন দল। এ-পর্যায়ে বিএনপির প্রয়োজন যেকোনোভাবে জামায়াতকে ঠেকানো এবং জামায়াতকে ঠেকাতে বিএনপির হাতে কোনো অজুহাতই নেই। দল দুটো দীর্ঘদিন একযোগে নির্বাচন করেছে, ফলে এরা মূলত পরস্পরের পরিপূরকই। সমীকরণ যখন এই, তখন জামায়াতকে মোকাবেলা করতে বিএনপি এখন মুক্তিযুদ্ধের অভিভাবক হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিএনপির রাজনীতি দাঁড়িয়ে আছে মূলত ‘একটি’ পুঁজির ওপর; সেটি হলো— দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষক’। একাত্তরের স্বাধীনতার বিপরীতে আরেকটি স্বাধীনতা, অর্থাৎ দ্বিতীয় স্বাধীনতা, যদি দাঁড়িয়েই যায়; তা হলে জিয়াউর রহমানের গুরুত্ব কমে যায় এবং বিএনপির রাজনীতি মার খেয়ে যায়। এসব সমীকরণ না-থাকলে বিএনপিও জামায়াতের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্বের সাথে ধেইধেই করে তাল মেলাত।
জুলাই আন্দোলন ছিল দৃশ্যত কোটা-আন্দোলন; তা-ও আবার কোটা-বাতিল আন্দোলন না, কোটা-সংস্কার আন্দোলন। ১৬ জুলাই যদি পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত না-হতো, তা হলে ঐ আন্দোলন দেড়-দুই দিনের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে যেত। ঐ ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন ছিল ছাত্র। পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষই শান্তিকালীন অবস্থায় পাঁচজন ছাত্রের হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না, বিবেকের তাড়নায় পথে নেমে আসে, বিচার চায়। জুলাই মাসেও তা-ই হয়েছিল। একের পর এক হত্যাকাণ্ড দেখে সেরেফ বিবেকের তাড়নায়ই সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছিল— বিচারের দাবিতে। কোনো ঘোষক, সংগঠক বা সমন্বয়কের আহ্বানে মানুষ রাস্তায় নামেনি; নেমেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ‘সমন্বয়ক’ নামধারী যারা ছিল; দেশজুড়ে কেউই তাদেরকে চিনত না, আলাদা কোনো কারিশমা তাদের ছিল না, তারা নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল না— এমনকি পার্শ্বচরিত্রও না। মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল সেরেফ রক্ত দেখে, কোনো সমন্বয়কের চেহারা দেখে নয়। তখন কেউই জানত না সরকারপতন হবে। ফলে, জুলাইয়ের আন্দোলন আদতে সরকারপতন-আন্দোলনও ছিল না। জুলাইয়ে কোনো সমন্বয়ক বলতে পারেনি যে, সে সরকারের বিদায় চায়; তারা বরং এই মর্মে অভিনয় করে গেছে যে, তারা সাধারণ ছাত্রদের অধিকার চায়। যারা সরকারপতনের দাবিও তোলেনি বা তুলতে পারেনি, সেই আন্দোলনকে তারা অভিহিত করছে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ হিশেবে— হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি এমন প্রতারণা বা প্রগলভতা দেখেছে কি না, সন্দেহ আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন কোনো গোপন আন্দোলন ছিল না। একাত্তরেরও বহু আগে থেকে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক লোকজন প্রকাশ্যেই স্বাধীনতার দাবি করে এসেছিলেন। যুদ্ধ শুরুর বহু আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ দেওয়া হয়েছিল, আলাদা জাতীয় পতাকা তৈরি করা হয়েছিল, সেই পতাকা ওড়ানো হয়েছিল, নতুন দেশের জাতীয় সংগীত কী হবে তা-ও ঘোষণা করা হয়েছিল। ঘোষণাগুলো করেছিলেন প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য নেতাকর্মীরা— প্রকাশ্যে। স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওতে দেওয়া হয়েছিল— প্রকাশ্যে। যুদ্ধ শুরুর পর প্রকাশ্যে গঠন করা হয়েছিল অস্থায়ী সরকার, অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছিল— প্রকাশ্যেই। অস্থায়ী সরকারের ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ ছিল প্রকাশ্যঘোষিত রাজনৈতিক এজেন্ডা। অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পঁচিশে মার্চের গণহত্যার রাতেও নিজ বাড়িতে প্রকাশ্যেই ছিলেন, কোথাও পালিয়ে যাননি। মুক্ত দেশে তার প্রত্যাবর্তনও ছিল প্রকাশ্য। মুজিব কখনও গোপন রাজনীতি করেননি; গোপনে দেশ ছাড়েননি, গোপনে দেশে ফেরেননি। কোনো মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় লুকিয়ে পাকিস্তান পিপল্স পার্টিতে ঢুকে ঘাপটি মেরে থাকেননি (যেভাবে ছাত্রশিবির লুকিয়ে ছিল ছাত্রলিগে)। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা রাজনীতি করেছেন, প্রকাশ্যেই করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু প্রকাশ্য ছিল বিধায় সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়নি— মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করা উচিত হবে কি হবে না। যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার করা হবে, তা-ও ২০০৮-এ আওয়ামি লিগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যেই উল্লিখিত ছিল। এই বিচার হুট করেও হয়নি, গোপনেও হয়নি। একই কথা বলা যায় নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের বেলায়ও। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের দাবিটা তখন প্রকাশ্য ছিল। তৎকালীন প্রায় রাজনৈতিক দলই এরশাদের পতনের ব্যাপারে একমত ছিল এবং এই দাবিতে লাগাতার আন্দোলনও করে গেছে। এই আন্দোলনেও কোনো গোপনীয়তা বা ছদ্মবেশ ছিল না। জনসাধারণ জানত আন্দোলনটি এরশাদপতনের আন্দোলন এবং কী কী ঘটবে আন্দোলন সফল বা ব্যর্থ হলে।
২০২৪-এর জুলাইয়ের আন্দোলন— চক্ষুলজ্জার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে জামায়াতে ইসলামি এবং তাদের বি-টিম ও সি-টিম যেটিকে এখন ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে বেড়াচ্ছে— সমন্বয়কদের মাধ্যমে সেটিকে তারা প্রথমে প্রচার করিয়েছিল ‘কোটা-সংস্কার আন্দোলন’ বলে। শুরুতে তারা কোনোভাবেই প্রচার করেনি যে, তাদের উদ্দেশ্য আসলে সরকারপতন, তাদের লড়াইটা আসলে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’, লড়াইয়ে জয়ী হলে তারা কী কী করবে। সমন্বয়করা প্রথমে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় কোনোভাবেই দেয়নি, পরিচয় দিয়েছে ‘সাধারণ ছাত্র’ হিশেবে। জুলাই আন্দোলনে ব্যর্থ হলে সমন্বয়করা গ্রেপ্তার হতো ঠিকই; আবার জনমতের চাপে সরকার তাদেরকে ‘সাধারণ ছাত্র’ হিশেবেই মুক্তি দিতে বাধ্য হতো, বাকি জীবনটা তারা ‘সাধারণ ছাত্র’ হিশেবেই কাটিয়ে দিত। কিন্তু যখনই সরকারপতন নিশ্চিত হয়েছে, তখনই সমন্বয়করা ক্রমশ শিবিরনেতা হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যে-সমন্বয়করা এককালে ছাত্রলিগে পদধারী ছিল; শেখ হাসিনার পলায়নের পর তারাই পরিচয় দেওয়া শুরু করল যে, তাদের কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক, কেউ সভাপতি। যে-আবু সাঈদের মরদেহের ওপর ভিত্তি করে পুরো জুলাই আন্দোলনটা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিল, সরকারপতনের আগ পর্যন্ত শিবির সেই আবু সাঈদকেও শিবিরকর্মী বলে স্বীকার করেনি। শিবির সাঈদকে ‘সাথী’ বলে প্রচার করেছে সরকারপতন নিশ্চিত হওয়ার পরে। জামায়াত-শিবির কখনোই স্বনামে রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেনি; সেজন্যই তারা অপেক্ষা করে দেশে কখন সামরিক শাসন আসবে, সেজন্যই জামায়াত বলে বেড়ায়— দেশে দেশপ্রেমিক সংগঠন কেবল দুটো— জামায়াত আর সেনাবাহিনী।
সমন্বয়কদের একটা বড় অংশ ছিল গোপনে ছাত্রশিবিরের পদধারী, প্রকাশ্যে ছাত্রলিগকর্মী। যে-সমন্বয়করা প্রকাশ্যে বা গোপনে শিবিরের পদধারী ছিল না, তারাও শিবিরেরই উপজাত। শিবির তাদেরকে তৈরি করে রেখেছিল সরকারপতন-আন্দোলনে ব্যবহার করার জন্য। সরকারপতন-আন্দোলন অন্যায় কিছু না। যেকোনো ব্যক্তি বা সংগঠন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ঘোষণা দিয়ে সরকারের পতন চাইতে পারে, চাইতে পারে বিএনপি বা জামায়াতও। কিন্তু একটা সর্বজনীন কোটা-আন্দোলনে পড়ে-যাওয়া লাশকে পুঁজি করে দেশব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টি করে সরকারপতন ঘটিয়ে, পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের নামনিশানা মুছে দেওয়ার পাঁয়তারা করে আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে প্রচারের কোনো অধিকার কারো নেই। জুলাই আন্দোলনে শুধু জামায়াত-শিবির বা বিএনপি-ছাত্রদল অংশগ্রহণ করেনি। নির্দিষ্ট কোনো দলের তাঁবেদারি না-করা— মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী— প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীও জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। নিজ-নিজ শিল্পমাধ্যম ব্যবহার করে এই গোষ্ঠীটি জুলাই আন্দোলনে অংশ না-নিলে বা নৈতিক সমর্থন না-দিলে আগস্টে কোনোভাবেই সরকারপতন হতো না। প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকরা আওয়ামি জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে জুলাইয়ে কলাম-কবিতা না-লিখলে, কার্টুন ও গ্রাফিতি না-আঁকলে, প্রতিবাদী গান না-গাইলে আওয়ামি লিগ সরকার সে-যাত্রায় টিকে যেত। প্রগতিশীলরা কবিতা লিখে, কার্টুন এঁকে, গান গেয়ে নিজ-নিজ জায়গায় ফিরে গেছেন; ক্ষমতার জন্য দেনদরবার করেননি। কিন্তু সমন্বয়কচক্র এবং জামায়াতে ইসলামি রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে এবং ঐ প্রগতিশীলদের অনেকেরই রুটিরুজির পথ বন্ধ হয়ে গেছে আগস্টপরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থানের কারণে। মুহাম্মদ ইউনুসকে সামনে রেখে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জামায়াতে ইসলামি— বাংলাদেশের বুক থেকে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ কায়েম করার জন্য যা যা করা সম্ভব— সবকিছুই করে চলছে। কিন্তু জামায়াতকে বা ইউনুস সরকারকে এসব করার ম্যান্ডেট জনগণ দেয়নি। প্রগতিশীল লোকজন বা রাজনীতি-না-বোঝা জনসাধারণ জুলাইয়ে আওয়ামি লিগের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে এসেছিল ছাত্রজনতার রক্ত সহ্য করতে না-পেরে সেরেফ বিবেকের তাড়নায়; দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে বিদায় করে দিতে নয়, জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করাতেও নয়, সরকারপতনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিশেবে সাব্যস্ত করতেও নয়। জামায়াত জুলাই আন্দোলন ছিনতাই করেছে।
যদি জামায়াতে ইসলামি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী জুলাইয়ে ঘোষণা করত— চলমান আন্দোলনটা মুক্তিযুদ্ধকে হটিয়ে পূর্ব পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলন, আন্দোলনে জয়ী হলে আন্দোলনকে তারা মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করাবে, সরকারপতনকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে গেজেট প্রকাশ করবে; তা হলে জামায়াতের বা ঐ রাজনৈতিক গোষ্ঠীটির বর্তমান কর্মকাণ্ড মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সাধারণ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে জামায়াত জুলাইয়ের সমস্ত কৃতিত্ব লুটপাট করে নিয়েছে, দেশের সর্বক্ষেত্রে নিজেদের লোক বসিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেশকে অঘোষিত পূর্ব পাকিস্তান বানিয়েছে, জাতির সাথে পুনর্বার প্রতারণা করেছে। জামায়াত-শিবির ভালো করেই জানে— কোটা-আন্দোলন দূরে থাক, নিজেদের পরিচয়ে কোনো আন্দোলনেই ডাকলে সাধারণ মানুষ বা ছাত্রসমাজ তাতে সাড়া দেবে না। তাই, জুলাইয়ে তারা এমন দেড়শো সমন্বয়ককে মাঠে নামিয়েছিল— যাদের কেউ বাইরে শিবির বলে পরিচিত না, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে প্রত্যেকে শিবির অথবা শিবির-ভাবাপন্ন। আন্দোলনের সময়ে সমন্বয়করা শতভাগ ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রেখেছে। কারণ, জামায়াত এও জানে— কোনো ধর্মীয় সংগঠনের, বিশেষত জামায়াতের, আহ্বানে কোনো ইশুতেই মানুষ রাজপথে নামবে না। আন্দোলনে জামায়াত-শিবির নিজেদের পরিচয় রেখেছে লুক্কায়িত, উদ্দেশ্যও রেখেছে লুক্কায়িত। ছদ্মবেশে ছাত্রলিগেরও একটা বড় অংশ দখল করে রেখেছিল শিবির। অতীতে-ছাত্রলিগ-করা সমন্বয়করা এখন নিজেদের শিবিরপরিচয় তুলে ধরে দাবি করছে— আওয়ামি লিগের আমলে তারা বাধ্য হয়ে ছাত্রলিগ করেছে। অথচ আওয়ামি লিগের আমলে শুধু শিবিরই নিপীড়িত ছিল না, নিপীড়িত ছিল ছাত্রদলও। ছাত্রদলের কেউ অদ্যাবধি দাবি করেনি যে, সে বাধ্য হয়ে ছাত্রলিগ করেছিল। জুলাইয়ের আদ্যোপান্তজুড়ে যে-জামায়াত আশ্রয় নিয়েছে পৌনঃপুনিক প্রতারণার, সেই জামায়াতই এখন দাবি করে বসছে— জুলাই হলো ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’। সাধারণ শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশে যে-শিবিরকর্মীরা জুলাইয়ে সমন্বয়ক সেজেছিল, অর্থাৎ যে-সমন্বয়করা জুলাইয়ে ন্যূনতম আত্মপরিচয়টুকু প্রকাশের সৎ সাহস দেখাতে পারেনি; তারাই এখন বীরদর্পে আবদার করছে ৫ আগস্ট ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতাদিবস’। স্বনামে আন্দোলন করার মুরোদ যাদের নেই, যারা জিতে গেলে ‘শিবির’ আর হেরে গেলে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’; তারা এসেছে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্ব নিয়ে। প্রতারণার মাধ্যমে যাদের উত্থান, তাদের মুখে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটাই প্রহসন। প্রতারণা ক্ষমতা এনে দিতে পারে, স্বাধীনতা না।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ, ক্ষয়-ক্ষতি, দায়-দায়িত্ব— সবকিছুই মীমাংসিত। কিন্তু ২০২৪-এর জুলাই আন্দোলন এখনও মীমাংসিত না, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অমীমাংসিত। জুলাই হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা ও আওয়ামি লিগের দায় সর্বজনস্বীকৃত। জুলাইয়ের ঘটনায় হুকুমের আসামি হিশেবে শেখ হাসিনার বিচার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, জুলাই বাবদ দল হিশেবে আওয়ামি লিগেরও বিচার হওয়ার অবকাশ আছে। কিন্তু জুলাইয়ে যতজন নিহত-আহত হয়েছে; এর সবাই পুলিশ বা আওয়ামি লিগের নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত-আহত হয়েছে কি না, তৃতীয় কোনো শক্তি লাশের সংখ্যা বাড়িয়ে সরকারপতন ত্বরান্বিত করেছিল কি না— এই প্রশ্নের উত্তর এখনও কেউ দিতে পারেনি। এ নিয়ে প্রশ্ন করায় দপ্তর পালটে দিয়ে সরকারে উলটো অপ্রাসঙ্গিক ও অপাঙ্ক্তেয় করে রাখা হয়েছে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনকে। জুলাই-আগস্টে মোট কতজন পুলিশসদস্য হতাহত হয়েছেন এবং তাদেরকে কারা হত্যা করেছে, কারা পুলিশ মেরে ওভারব্রিজে ঝুলিয়ে রেখেছে, মরদেহ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে— মেলেনি এর জবাবও। কারা মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছিল, কারা থানা আক্রমণ করে পুলিশের অস্ত্র লুটপাট করেছিল, কারা কারাগারে আক্রমণ করে নিজেদের দলের আসামিদেরকে ছিনিয়ে নিয়েছিল— এর ব্যাখ্যা জামায়াত দেয়নি, সমন্বয়করা দেয়নি, দেয়নি সরকারও। কোনো জবাব না-দিয়ে সরকার উলটো জারি করেছে এমন দায়মুক্তি আইন; উল্লিখিত অপরাধীদেরকে যে-আইন সুরক্ষা দিয়েছে, যে-আইনের কারণে এই অপরাধীদের বিচার হবে না। এতকিছু অমীমাংসিত রেখে একটা আন্দোলনকে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা বীভৎস বাতুলতা বৈ কিছুই নয়। যে-কোটার বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলন দেশে এমন প্রলয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল; ইতিহাসে সোনার হরফে বাঁধিয়ে রাখার মতো মোনাফেকি হলো— জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্যবর্গ ও আহতদের জন্য সরকারি চাকরিতে সেই ‘কোটা’-ই রেখেছে অন্তর্বর্তীকালীন সমন্বয়ক সরকার। সমন্বয়কদের আনীত ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র নমুনা হলো এই। সমন্বয়কদের মুখে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিই অসহনীয়— হোক তা ‘প্রথম স্বাধীনতা’, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বা ‘তৃতীয় স্বাধীনতা’।
এই লেখায় ইতোমধ্যেই একবার উল্লেখ করেছি মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের একটা প্রোক্লেমেশন ছিল— ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’। জুলাই আন্দোলনের কথিত সমন্বয়করা এর দেখাদেখি ২০২৪-এর ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে ‘প্রোক্লেমেশন অব রিভোলিউশন’ হাজির করতে চেয়েছিল এবং আত্মবিশ্বাসে টগবগ করতে-করতে বলেছিল ‘নাউ অর নেভার’। প্রোক্লেমেশন হাজির করতে হয় ঘটনা ঘটানোর পরে না, আগে। সমন্বয়করা আন্দোলন চলাকালে কিছুই হাজির করতে পারেনি, হাজির করতে চেয়েছে পাঁচ মাস পরে। তা-ও পারেনি, শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যে-আন্দোলনের পরতে-পরতে প্রতারণা, সে আন্দোলন কোনো-না-কোনো পর্যায়ে ব্যর্থ হবেই। সমন্বয়করা আবদার করেছিল সংবিধান বাতিল করতে। সে-যাত্রায়ও তারা ব্যর্থ হয়েছে। সংবিধান বাতিল করতে চাওয়ার নেপথ্য কারণ— এই সংবিধানের মূল ভিত্তি মুক্তিযুদ্ধ। এই সংবিধানের শুরুতেই স্বীকার করা হয়েছে— ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি’। জামায়াত বা সমন্বয়করা যদি এই সংবিধান বাতিল করাতে পারত, তা হলে সংবিধান থেকে ১৯৭১ এবং ২৬ মার্চকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সেখানে যথাক্রমে ২০২৪ ও ৫ আগস্ট প্রতিস্থাপন করত। ১৯৭১, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামি এবং তাদের বি-টিম ও সি-টিমের জন্য পরাজয়। এই সাল ও তারিখগুলোকে, তাই, তারা যেকোনোভাবে নিশ্চিহ্ন করতে চায়; নিদেনপক্ষে অগুরুত্বপূর্ণ করে দিতে চায়।
জুলাই আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলার ধারা জামায়াতে ইসলামিরও আগে শুরু হয়েছিল আরেকটি জায়গা থেকে। ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে পালিত হয়েছে পাকিস্তানরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলি জিন্নাহ্র মৃত্যুবার্ষিকী। আয়োজন করেছিল একাত্তরে বাংলাদেশে-আটকে-পড়া বিহারিরা। পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনারের উপস্থিতিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সেই অনুষ্ঠানে বিহারি নাগরিক মো. শামসুদ্দিন বলেছিলেন— ‘১৯৭১ সালে ভারত যুদ্ধ করে আমাদের এ-দেশকে দুই ভাগ করে দিয়েছে। পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন বছর ধরে আমাদের বাপ-দাদারা এই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখে গেছেন। এজন্য আজ আমাদের এখানে পাকিস্তানের সবাইকে দেখে আর এ-অনুষ্ঠানে এসে খুব খুশি লাগছে।’ শামসুদ্দিন আরো বলেছিলেন— ‘৫ আগস্ট আমাদের বিজয়দিবস, এটিই আমাদের স্বাধীনতাদিবস।’ এই বিহারি ভুল কিছু বলেননি। বিহারিদের জন্য ৫ আগস্ট বিজয়দিবস এবং স্বাধীনতাদিবসই। যেহেতু ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর তাদের পরাধীনতাদিবস ও পরাজয়দিবস এবং যেহেতু ৫ আগস্টের আগে তারা বাংলাদেশে কখনও প্রকাশ্যে জিন্নাহ্র জন্মদিন পালন করার কথা কল্পনাও করেনি বা পাকিস্তানের হাই কমিশনারকে অতিথি করে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেনি— এমনকি খন্দকার মোশতাক আহমেদ বা জিয়াউর রহমানের আমলেও না; সেহেতু ৫ আগস্টই তাদের বিজয়দিবস ও স্বাধীনতাদিবস। জামায়াতে ইসলামি এবং তাদের বি-টিম ও সি-টিমের জন্যও ৫ আগস্ট বিজয়দিবস ও স্বাধীনতাদিবস। জামায়াতকে এই ঔদ্ধত্যপ্রদর্শনের সুযোগ দিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। হাসিনাই এই ভূখণ্ডের একমাত্র বেসামরিক শাসক, যার পতন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয়েছে। টানা তিনটি ভুয়া নির্বাচনের ফলে তাকে এবং তার দলকে ঝাড়ে-বংশে পালাতে হয়েছে এবং এই পলায়নসৃষ্ট খালি-মাঠে জামায়াত এখন একাই গোল দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ও এসেছিল আওয়ামি লিগের রাজনৈতিক নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ও রচিত হলো আওয়ামি লিগেরই হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের যতটা ক্ষতি আওয়ামি লিগ করে গিয়েছে, অতটা ক্ষতি জামায়াতও করতে পারেনি।
এখানে জামায়াতের বি-টিম বলতে বোঝাচ্ছি ‘এবি পার্টি’কে। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার পর জামায়াত যখন নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছিল; তখন তারা নিজেদেরই কিছু নেতাকর্মীকে দিয়ে বিকল্প হিশেবে ‘এবি পার্টি’ বানিয়ে রেখেছিল, যাতে জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ামাত্র জামায়াতের নেতাকর্মীরা সদলবল এবি পার্টিতে সেঁধিয়ে পড়তে পারেন। জামায়াতের সি-টিম হলো নবগঠিত ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’। ছাত্রশিবিরের যে ভূগর্ভস্থ কর্মীরা কখনও প্রকাশ্যে শিবির করেনি, জামায়াত তাদেরকে দিয়ে এই ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ তৈরি করেছে। এই দলটি করে জামায়াত লাভবান হচ্ছে দুইভাবে— প্রথমত, নাগরিক পার্টির গায়ে প্রত্যক্ষ জামায়াত-ট্যাগ নেই; ফলে, জামায়াত যা-যা বলতে পারে না বা বললেও তরুণসমাজ গায়ে মাখে না; জামায়াত সেসব কথাবার্তা নাগরিক পার্টিকে দিয়ে অনায়াসে বলাতে পারছে; দ্বিতীয়ত, নাগরিক পার্টির সব নেতা যেহেতু বয়সে তরুণ এবং যেহেতু তাদের পক্ষে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ সংঘটন অসম্ভব, সেহেতু নাগরিক পার্টি সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধাপরাধের কলঙ্কমুক্ত। একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াত যেহেতু কখনোই ক্ষমা না-চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এজন্য তরুণসমাজের কাছে জামায়াতের যেহেতু গ্রহণযোগ্যতা নেই, সেহেতু যুদ্ধাপরাধের কলঙ্কমুক্ত একটা কুমারী রাজনৈতিক দল জামায়াতের প্রয়োজন ছিল; জামায়াতের প্রয়োজনীয় সেই তারুণ্যনির্ভর কুমারী দলটিই হলো নাগরিক পার্টি। নাগরিক পার্টি এখন কুসুম-কুসুম ভঙ্গিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকবে, আধো-আধো অসাম্প্রদায়িক চেতনাও দেখাবে, ইদে-চান্দে প্রগতিশীল ভাবমূর্তিও ধরে রাখবে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধপ্রশ্নে বাস্তবায়ন করবে জামায়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। নির্বাচনে যতগুলো আসন নাগরিক পার্টি পাবে, পরবর্তীকালে সব আসন নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে গড়বে রাজনৈতিক জোট।
মনে রাখতে হবে— জামায়াতের ছাত্রসংগঠনের নাম অতীতে ছিল পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসংঘের ভূমিকা এত নৃশংস ছিল যে, ছাত্রসংঘ স্বনামে আর রাজনীতি করতে পারেনি। ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীদেরকে নিয়েই ১৯৭৭ সালে গঠন করা হয় ছাত্রশিবির। আরো মনে রাখতে হবে— শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল, ফলে ধর্মীয় সংগঠন হিশেবে জামায়াতে ইসলামিও শেখ মুজিবের আমলে নিষিদ্ধ ছিল এবং জামায়াত-নেতারা ছিলেন পাকিস্তানে পলাতক অথবা আত্মগোপনে ছিলেন দেশের ভেতরেই। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জামায়াতে ইসলামি আর বসে থাকেনি, রাজনীতি করেছে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ’ নামে। জামায়াত-নেতারা ১৯৭৬ সালে সমমনা অন্য স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে নিয়ে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লিগ গঠন করেছিলেন, দলটি ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে এই নামে অংশগ্রহণ করে কিছু আসনও পেয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, অর্থাৎ বিপদ কেটে যাওয়ার পর, জামায়াতে ইসলামি আবার জামায়াতে ইসলামি রূপে ফিরে আসে। অর্থাৎ অস্তিত্বরক্ষার খাতিরে সাময়িকভাবে আরেক দল গঠনের ইতিহাস এবং প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর নতুন দল বিলুপ্ত করে পুরোনো দলে ফিরে যাওয়ার নজির জামায়াতের আগে থেকেই আছে। উল্লেখ্য— এই মুহূর্তে যেকোনো ইশুতে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান এবং এবি পার্টি ও নাগরিক পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান হুবহু এক, তারা কখনোই আলাদা সুরে কথা বলছে না। তাদের গানের সুরও এক, বাণীও এক; কেবল গায়ক আলাদা, মঞ্চ আলাদা; গ্রিনরুম অভিন্ন। নাগরিক পার্টির নেতারা সাধারণ কথাও বলে চিৎকার করে। কারণ, তাদের বক্তব্যগুলো আরোপিত। আরোপিত কথা চিৎকার করেই বলতে হয়, স্বাভাবিকভাবে বলা যায় না। আওয়ামি লিগ-বিএনপি নিজেদের সমস্ত শক্তি একই জায়গায় খরচ করে এবং যখন পালানোর প্রয়োজন পড়ে, সদলবল পালায়। কিন্তু জামায়াত সব শক্তি এক জায়গায় খরচ করে না, শাখা রাখে; যেন পালাতে হলে সদলবল পালাতে না-হয়। জামায়াতে ইসলামি ‘মাদার অর্গানাইজেশন’, এবি পার্টি এবং নাগরিক পার্টি জামায়াতের ‘সিস্টার কনসার্ন’। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর জামায়াত এবি পার্টিকেও বিলুপ্ত করে দেবে, বিলুপ্ত করে দেবে নাগরিক পার্টিকেও। আরো উল্লেখ্য— জামায়াতে ইসলামি, এবি পার্টি, নাগরিক পার্টি এবং বিহারি জনগোষ্ঠী ছাড়া আর কেউই ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তত্ত্ব প্রচার করছে না। তিপ্পান্ন বছর ধরে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি যাদের জন্য ছিল পরাজয়ের শামিল, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ তাদেরই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। জামায়াত জানে বিহারিদের কোন-কোন জায়গায় ব্যথা। বিহারিরাও জানে জামায়াতের ব্যথা কোন-কোন জায়গায়।
পুনশ্চ—
নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা— এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতার কিছু পঙ্ক্তি এ-রকম— ‘এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না, এই বৃক্ষে-ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না, এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না। তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি? তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কে বেঞ্চে-বৃক্ষে ফুলের বাগানে ঢেকে দেওয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি? জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত কালো হাত। তাই দেখি— কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ (রচনাকাল ১৯৮০)। নির্মলেন্দু গুণের সাথে কথা বলে জেনেছি— ‘উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান’ বলতে তিনি সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানের (রেসকোর্স ময়দান) বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমানের আমলে দাঁড় করানো শিশুপার্ককে বুঝিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে— সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব খর্ব করার জন্যই উদ্যানের ভেতর শিশুপার্ক বানানো হয়েছিল। শেখ মুজিবের জীবদ্দশায় রাজনৈতিক সমাবেশগুলো রেসকোর্স ময়দানেই হতো। তার মৃত্যুর পর ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ চালু হলেও সামরিক শাসন জারি থাকার কারণে রাজনৈতিক সমাবেশের অনুমতি ছিল না। পরবর্তীকালে জিয়া ‘ঘরোয়া রাজনীতি’র অনুমতি দেন এবং গুলিস্তানে জিপিওর পার্শ্ববর্তী খালি জায়গায় (মুক্তাঙ্গন) ক্ষুদ্রপরিসরে সভা করার সুযোগ দেন। এই প্রক্রিয়াকেই গুণ ‘মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ’ বলেছেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর শাসকগোষ্ঠীকে তোয়াজ করার জন্য অখ্যাত অনেক কবি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছিলেন এবং প্রগতিশীল কিছু কবি নিপীড়িত হওয়ার ভয়ে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। ‘কবির বিরুদ্ধে কবি’— এখানে প্রথমোক্ত ‘কবি’ স্বয়ং মুজিব আর দ্বিতীয়োক্ত ‘কবি’ হলেন ঐ দুই শ্রেণির কবিসম্প্রদায়।
১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে তৎকালীন বিমানবাহিনীপ্রধান গোলাম তাওয়াব তিনদিনব্যাপী একটি ‘সিরাত মাহফিল’ আয়োজন করেছিলেন। তারিখ হিশেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ৭ মার্চকেই, কারণ পাঁচ বছর আগের এই দিনে শেখ মুজিবুর রহমান একই মাঠে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সিরাত মাহফিলে বক্তব্য রাখেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা, যাদের অধিকাংশই বাহাত্তরের দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত। মাহফিলে বক্তব্য রাখেন তরুণ মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও, পাঠ করে শোনানো হয় গোলাম আজমের লিখিত বক্তব্যও। স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে একযোগে মাঠে নামালে মুক্তিযোদ্ধারা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান, তা পরখ করে দেখাই ছিল ঐ মাহফিল আয়োজনের উদ্দেশ্য। ৭ মার্চের ভাষণের বিপরীতে ৭ মার্চের সিরাত মাহফিলকেই নির্মলেন্দু গুণ অভিহিত করেছেন ‘মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ বলে।
কবিতাটি ১৯৮০ সালে না-লিখে এখন লিখলে নির্মলেন্দু গুণ নিশ্চয়ই ‘কবির বিরুদ্ধে কবি, মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল, উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান, মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ লিখেই থামতেন না; যুক্ত করতেন আরো তিনটি শব্দ— স্বাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা।
================================
To the young politician:
Tricks with the people never win in the long run. When you manipulate the trust of the citizens of Bangladesh with deceitful tactics, you not only betray their faith but also pave your own downfall. Real power lies in wisdom, integrity, and the genuine commitment to serve the nation. In the end, those who choose trickery are marked as the ultimate losers.
No comments:
Post a Comment