Saturday, August 31, 2024

আগষ্ট ২০২৪: বিবেচনা

বাংলাদেশের ইতিহাস আরেকটা অন্ধকার আগষ্ট মাস অতিক্রম করলো। ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে ২০২৪ সালের আগষ্ট। ১৫ বছরের ক্ষমতার তাজমহল ভেঙ্গে পড়েছে। এমন একটা পতন অনিবার্য ছিল। অনেকেই অপেক্ষা করছিলেন এই পতনের জন্য। কিন্তু এক মাস আগেও কেউ জানতো না এমন কিছু ঘটবে। যারা ঘটিয়েছে তারাও জানতো না, যাদের পতন ঘটেছে তাদের দূরবর্তী কল্পনাতেও ছিল না। ক্ষমতা মানুষকে এমনই নির্বোধ, এমনই অন্ধ করে ফেলে।

এই পরিবর্তনে বাংলাদেশ কেমন সুফল পাবে সেটা আমরা এখনো জানি না। এদেশের মানুষেরা নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য অনেকটা দায়ী। তাদের মধ্যে বিশ্বাসের বড় ধরণের ঘাটতি আছে। প্রচুর স্ববিরোধীতা, অসংলগ্নতা। রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশই মতলবাজ। সবার ভেতরেই বাস করছে কোনো না কোনো একটা শকুন। বড় বড় দুর্নীতিবাজ যেমন আছে, তেমনি ছোট ছোট দুর্নীতিবাজেরও কমতি নেই। যে চুনোপুটিটা বড় দুর্নীতিবাজকে গালি দিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছে, দেখা যায় সেও ব্যক্তিগত পরিসরে কোনো না কোনো দূর্নীতির কাজে যুক্ত। আমি চারপাশের পরিচিত মানুষদের মধ্যেই দেখতে পাই তাদের।

তাই এই বিপ্লবে দেশটা আমূল পাল্টে যাবে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

এই ছাত্রদের আমি বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম শুরু থেকেই। তারা হয়তো নতুন কিছু করবে। হয়তো তারা কোনো রাজনৈতিক মতলবপুষ্ট নয়।  

কিন্তু আজকে সমন্বয়কের গুরুর একটা বক্তব্যে খটকা লাগলো। ছেলেটা আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বলে পরিচিত। তার বুদ্ধির কাছে হেরে গেছে এত শক্তিশালী সরকার, ভাবতে অবাক লাগে। 

কিন্তু সে আজ বিশেষ একটা সভার মধ্যে তার বক্তব্যে একটা শব্দবন্ধ কয়েকবার উচ্চারণ করেছে। ভুলে করেছে নাকি সচেতনভাবে করেছে জানি না। কয়েকবার বলেছে এই শব্দবন্ধটা। '১৯৭১ সালের ঘটনাটা'। কী ঘটনা? ১৯৭১ সালে কী ঘটেছিল? মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ? নাকি ছোট একটা দুর্ঘটনা? 

কথা হচ্ছিল নতুন পরিস্থিতিতে সংবিধান বদলাবে ২০২৪ সালের প্রেক্ষাপটে। জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সেখানে দয়া করে  '১৯৭১ সালের ঘটনাটা' জায়গা পেতে পারে। বক্তব্যে এটুকু বুঝলাম। 

মুশকিল হলো যদি মুক্তিযুদ্ধ শব্দটা উচ্চারণ করতে এতটা সংকোচ হয় তাহলে বুঝতে হবে তাদের এজেণ্ডা সাধারণ মানুষের চাহিদার সাথে মিলছে না। মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের সম্পত্তি নয়, যদিও তারা সবসময় এটা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছে সবসময়। জোর করে ১৫ বছরে গেলানোর চেষ্টা করে হিতে বিপরীত হয়েছে। যেসব লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে একাত্তরে তাদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। ৭ কোটি মানুষই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ছিল। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের অপকর্মের কারণে তাদের বিরোধীতা করতে গিয়ে একাত্তরের লাখ লাখ শহীদকে ছোট করে দেখার প্রবণতা যদি দেখা দেয় তাহলে নতুন বিপ্লবীরা সাধারণ মানুষের সমর্থন হারাবে নিশ্চিতভাবেই। কারণ বিএনপি-জামাত যদি সরকার পরিবর্তন আন্দোলনের ডাক দিতো তাহলে এত মানুষ নামতো না। কখনো নামেনি। সে কারণে নির্দলীয়ভাবে আন্দোলনটা চালানোর কৌশল করা হয়েছিল। যাতে মানুষ একাত্মতা বোধ করে। মানুষ আওয়ামী লীগ যেমন বিশ্বাস করে না, তেমনি বিএনপি-জামাতকেও করে না। মানুষ নতুন কিছু চায়। ছাত্ররা সেরকম কিছুর আশ্বাস দিয়েছিল বলেই সবাই একযোগে নেমেছিল। 

এখন যদি তার বিপরীত কিছু করা হয় তাহলে মানুষ সেটা মেনে নেবে না। নতুন বিপ্লবী সরকার এমন ভুল করবে কিনা সেটা দেখার অপেক্ষা।

এই বিপ্লবের অনেক ভালো দিকের সাথে কিছু কলঙ্কিত অধ্যায়ও যুক্ত হয়ে গেছে অতি উৎসাহী কিছু ছাত্রছাত্রীর কারণে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন কুৎসিত ব্যাপার ঘটেছে যে মনে হতে পারে এটা একটা বেয়াদবী বিপ্লব ছিল। সারা দেশে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানো তার মধ্যে একটা। মজার ব্যাপার হলো সেই গণবেয়াদবীর ঘটনাগুলো ভিডিও করে প্রচারও করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। 

Tuesday, August 27, 2024

সময়রেখা : জুলাই-আগষ্ট ২০২৪

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে বেশ কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। সরকার বদল ঘটেছে বহুবার। কিন্তু ২০২৪ সাল বাকীগুলোর চেয়ে অনেকটা আলাদা। এত সহিংসতা, এত ধ্বংসযজ্ঞ, এত হত্যাকাণ্ড, এত নৈরাজ্য, এত অন্যায়, এত অপকর্ম, এত অঘটন, এত অনৈতিকতা, এত নৃশংসতা বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনোই ঘটেনি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাস থেকে একটা নতুন বাংলাদেশ যাত্রা করেছে। এক পক্ষ এই যাত্রাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছে, আরেকদল মানুষ এটাকে নৈরাজ্যে পথে নতুন যাত্রা বলছে। সময়ই বলবে আসলে কোন পথে যেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। ভালোমন্দ বিচার করার সময় এখনো আসেনি। আরো ছমাস পর কিংবা বছর কেটে যাবার পর আমরা আরেকটু পরিষ্কার হবো। তবে ইতিহাসের এই মাইলফলকটা ঘটনাবহুল কয়েকটা দিনের পত্রিকার পাতা দিয়ে রেকর্ড করা থাকলো। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ মাঝে মাঝে এই তারিখগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেও পারে।

১৫ জুলাই ২০২৫: সূত্রপাত

১৬ জুলাই ২০২৪: অপরিণামদর্শী ভুলের যাত্রা

২০ জুলাই ২০২৪: সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষ

২০ জুলাই ২০২৪:  মৃত্যু আর ধ্বংসের নগরী



৪ আগষ্ট ২০২৪: ধ্বংসের শেষ প্রান্তে 

৫ আগষ্ট ২০২৪: অনিবার্য পরিণতি






 

Tuesday, August 20, 2024

চোরকাঁটা

একেকটা সরকারের পতন ঘটলে দেখা যায়, 

এতদিন ধরে নীতিবাক্যের রেকর্ড বাজানো লোকগুলো একেকজন কত বড় বড় চোর! 

পুরো দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই লোকগুলো চোরকাঁটার মতো বিঁধে ছিল।

গত চল্লিশ বছর ধরে দেখে যাচ্ছি এক ব্যাচ চোর যায়, আরেক ব্যাচ চোর আসে। মহারাজ চোর, মহারানী চোর, আগা চোর, বাঘা চোর, পুটি চোর, বোয়াল চোর, পুকুর চোর, সমুদ্র চোর, আদিগন্ত চোরে চোরাকার!

চোরকাঁটার আয়ু অফুরান!


Monday, August 19, 2024

৯ নম্বর মাঠ

 


সত্তর দশকের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর ৯ নম্বর মাঠ। এই মাঠকে ঘিরে আমার শৈশব কৈশোর তারুণ্যের একাংশ কেটেছে। এখন আর এই নামে কোনো মাঠ নেই। এই দালানগুলো নেই। এখানে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে আর ছবিতে এই মাঠ আমৃত্যু থেকে যাবে। এই মাঠের ওই দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আমাদের কত হাজারো আড্ডা হয়েছে। এই মাঠের পাশেই আমাদের একতলা বাসাটার একাংশ দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যমান দালানগুলোর মধ্যে কোন ফ্ল্যাটে কার বাসা এখনো আমার মুখস্থ আছে প্রায়। ওরা এখন কে কোথায়? আজহার সাহেবের এফ ৯/৭ বাসাটা দেখা যাচ্ছে। আমরা যে বাসায় ছিলাম তার পাশের বাসা। ১৯৮২ সালে সে বাসার অর্ধেক সদস্য মারা গিয়েছিল এক রাতের দুর্ঘটনায়, পরদিন ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম হয়েছিল, তারিখটা কী ১০ নভেম্বর? আমার কেন মনে আছে? ওই পরিবারের সাথে আমাদের একটা বিশেষ ঘনিষ্টতা ছিল। পারিবারিক, একান্ত ব্যক্তিগত।

নয় নম্বর মাঠে আমাদের যেসব বন্ধুদের সাথে দীর্ঘ সময় কেটেছে, শৈশব থেকে তার যাত্রা শুরু। যেটুকু মনে আছে সেখান থেকে নোট করে রাখা যায়।

আমার জন্ম এই কলোনীতে। তবু নানা কারণে জীবনের প্রথম পাঁচ বছর গ্রামেই কেটেছে। কখনো দাদাবাড়ি, কখনো নানাবাড়ি। পটিয়া এবং বোয়ালখালীতে। তখনো আমার বন্ধুবান্ধবের জগত সৃষ্টি হয়নি। শহরে এসে স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে প্রথম বন্ধুতার যাত্রা শুরু হয় মিলনকে দিয়ে। অবশ্য বাদলকে প্রথম বন্ধু বলা উচিত হলেও বলছি না, কারণ বাদলের ভূমিকা ছিল প্রধানত ভাই। মামাতো ভাই হিসেবে সে আমার প্রথম শহরগুরু। আমি গ্রাম থেকে আসা বালক, আমাকে শহরের নানা বিষয়ে প্রথম জ্ঞানদান শুরু করেছিল। শহরের নানান বিস্ময়কর ব্যাপারের সাথে আমার পরিচয় ঘটাতে শুরু করে। তাকে আমি বিশিষ্ট জ্ঞানী বলে জানতাম কারণ সে ইতোমধ্যে ক্লাস টুতে উঠে গেছে। আমি মাত্র ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছি। কথা ছিল আমরা দুজন একই ক্লাসে ভর্তি হবো। ঘরে বসে আমার ক্লাস টু পর্যন্ত পড়া শেষ। কিন্তু ভর্তি হবার সময় স্কুলে গিয়ে পাঠশালা বানান করতে না পারার অপরাধে আমাকে নীচের ক্লাসে ভর্তি হতে হয়েছিল। কিন্তু আমি কিছুতে ক্লাস ওয়ানে বসবো না। আমি খুব ভীতু ছিলাম। স্কুলে মানুষখেকো ধরণের কিছু আছে, তাদের কবল থেকে বাঁচতে হলে বাদলের সাথেই বসতে হবে। সে এখানকার পথঘাট সব জানে। নিরুপায় হয়ে সহৃদয় শিক্ষকেরা তা মেনে নিয়েছিলেন। অবিশ্বাস্য হলেও আমি প্রথম দুবছর ক্লাস করেছি উপরের ক্লাসে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে নিজের ক্লাসে বসার সাহস অর্জন করেছিলাম। আমার নিজস্ব বন্ধুবান্ধবের জগত শুরু হয় তখন থেকেই। তবে বাদলের সঙ্গপ্রিয়তা থেকে আমি যে আরো অনেক কিছু অর্জন করেছিলাম, সে কথা আরেক পর্বে বলা হবে। বাদল যে অনেক বড় কিছু হবে আমি যেন শৈশব থেকেই জানতাম। আজকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বাদল সৈয়দের দিকে তাকিয়ে সেটার প্রমাণ পাই।

শৈশবের সেই প্রথম পর্বে আমার নিজস্ব বন্ধু জগতের সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা বেশিদিন টেকেনি। ভাগ্যিস টেকেনি, নইলে আজকে আমি অন্য জগতের বাসিন্দা হতাম। তবে সেটা খুব বৈচিত্র্যময় একটা অভিজ্ঞতা ছিল। আমাদের বাসা কলোনীর যে অঞ্চলে ছিল সেখানে সব দুরন্ত ছেলেপেলের বসবাস। আমাদের খেলাধুলার জগত ছিল মার্বেল, ডাংগুলি, লাঠিম, সাতচাড়া, বোম্বেটে, দাঁড়িয়াবান্দা, হাডুডু, ঘুড়ি উড়ানো এবং আরো কত হাবিজাবি সব মনে নেই। মাঝে মাঝে ফুটবল ক্রিকেটও খেলেছি, কিন্তু উপকরণের অভাবে সেগুলো তেমন জমেনি। আমার প্রথম বন্ধু মিলন অতি ভদ্র ছেলে ছিল, ওর সাথে আমার পোষায় না। আমার আগ্রহ বখাটে বেয়াড়া ধরণের ছেলেপেলের দিকে। তুহীনের সাথেও তখন বন্ধুতা হয়, টুটুল, পুটুল, মামুন, সাইদ, মারুফ, এরা সবাই স্কুলের বন্ধু, কিন্তু স্কুলের বাইরে খেলাধুলার সম্পর্ক তাদের সাথে ছিল না। আমার খেলার বন্ধুগুলো ছিল আলাদা।

আমার শৈশবের এই বন্ধুগুলোর বৈশিষ্ট্য ছিল বাকী জীবনের বন্ধুদের চেয়ে আলাদা। এরা প্রত্যেকে নিজস্ব ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী। এদের ভেতরে ওই বয়সে যে পরিমাণ অকালপক্কতা ছিল সেটা ভেবে বুড়ো বয়সেও আমি রীতিমত বিস্মিত। আমাকে বিশেষজ্ঞানে বিশেষায়িত করার ব্যাপারে ওই বন্ধুগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। পৃথিবীর অনেক অজানা রহস্য তাদের মাধ্যমে উদঘাটিত হয়েছিল। তাদের কেউ কেউ স্কুলে পড়তো, কেউ কেউ স্কুলের ছায়াও মাড়ায়নি। তবে কে কোন স্কুলে পড়তো সেটা আমি জানতাম না। স্কুল বা পড়াশোনা বিষয়ে তাদের সাথে কোনদিন কথা হতো না। তাদের সাথে আমার বন্ধুতার ভিত্তি হলো ডাংগুলি, লাঠিম, মার্বেল, ঘুড়ি ওড়ানো, বাজি ফোটানো, তিল্ল এসপ্রেস( এই নামের রহস্য আমি জানি না তবে এটা এক জাতের লুকোচুরি), সহ নানান বখাটেপনা। এসব করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই ধাওয়া খেতাম নানান গুরুজনের কাছ থেকে। ধাওয়া খেয়ে খিকখিক করে হেসে গড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক দৃশ্য। কেউ বেদম পিটুনি খাচ্ছে সেটাও ছিল আমাদের বিনোদনের অংশ। স্কুল থেকে আসার পর ওরাই ছিল আমার খেলার সঙ্গী। বার্ষিক পরীক্ষার পর দীর্ঘ ছুটিতে গ্রামে যেতাম, তখন মনটা হু হু করতো ওদের সাথে খেলাধুলার জন্য। ওদের মধ্যে কেউ ছিল লাঠিম এক্সপার্ট, কেউ মার্বেল এক্সপার্ট, কেউ তাস খেলার ডাগ্গি ছোড়ার এক্সপার্ট, কেউ ঘুড়িতে মাঞ্জা দেবার এক্সপার্ট। লাঠিমে এক্সপার্ট যারা তারা লাঠিম খেলার পারদর্শীতার পাশাপাশি আরেকটা বিষয়েও পারঙ্গম ছিল। লাঠিম খেলায় জিতলে হেরে যাওয়া লাঠিমটা তাকে দিয়ে দিতে হতো। সে বাজির শর্তানুসারে তার লাঠিম দিয়ে ওটাকে গেজ মারবে। এই গেজ মারার বিষয়টা ছিল অদ্ভুত নৃশংস। লাঠিমের যে পেরেকটা আছে সেটা দিয়ে অন্য লাঠিমে আঘাত করা। যারা এক্সপার্ট ছিল তারা গেজ মেরে অন্য লাঠিমকে ফাটিয়ে দুভাগ করে দিতে পারতো। সে কারণে বাজিতে রাখার জন্য আমরা একটু সস্তা লাঠিম ব্যবহার করতাম। চকচকে রঙিন লাঠিম বাজিতে রাখা হতো না সাধারণত। নতুন পাংখি ধরণের লাঠিমকে গেজ থেকে বাঁচানোর জন্য একটা কায়দা করা হতো। লাঠিমের মধ্যখানে একটা বুটপিন ঢুকিয়ে দেয়া হতো। তাহলে ওই গেজের আঘাতে লাঠিম ফাটতো না সহজে। ওই বুটপিন সংগ্রহ করার কায়দাটাও বিচিত্র ছিল। দোকানে ওই জিনিস বিক্রি হতো না। ওটা চুরি করতে হতো রিকশা বা টেক্সির সিট থেকে। নতুন চকচকে রিকশা বা টেক্সির সিটগুলো বুটপিন দিয়ে সাজানো থাকতো। যখন বাবা মার সাথে কোথাও বেড়াতে যেতাম, তখন খেয়াল করতাম রিকশা বা টেক্সিটা বুটপিনঅলা কিনা। বুটপিনওয়ালা রিক্সা টেক্সিতে উঠতে পারা একটা ভাগ্যের ব্যাপার মনে করতাম। সিটে বসেই বড়দের অলক্ষ্যে হাতের নখ দিয়ে আস্তে আস্তে একটু বুটপিন খুলে নিতে হবে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে। দীর্ঘ গন্তব্য হলে দুটো বুটপিন তোলার সুযোগ হতো। একটা বুটপিন খুলে পকেটে নিতে পারলেও মনে হতো একটা বড় কাজ সেরেছি। যেসব টেক্সিতে বুটপিন নেই, সেগুলোতে আমি উঠতে চাইতাম না। রিকশা টেক্সি থেকে বুটপিন খুলে লাঠিমের মাথায় বসানোর এই কায়দাটা শৈশবের ওই বেয়াড়া বন্ধুদের কাছ থেকেই শেখা।

শৈশবের বেয়াড়া বন্ধুদের ওই পর্বে আরো অনেক কিছু শেখা হতো এবং আমার জীবন অন্য দিকে প্রবাহিত হয়ে যেতো। কিন্তু সেটা হয়নি বাসা বদল হয়ে নতুন বন্ধুদের সাথে জুটে যাবার কারণে। আমার শৈশবের সেই বন্ধুগুলোর কেউ কেউ পরবর্তী জীবনে নামকরা চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছিল। কেউ কেউ একাধিক খুনের মামলার আসামী হয়ে জেল খেটেছে, কেউবা ফেরারি হয়েছে। তাদের নাম উচ্চারণ করতেও ভয় পেতো এলাকার লোক। হাই স্কুলে ওঠার পর ওদের সাথে আমার আর খেলাধুলা কিংবা কথাবার্তাও হয়নি তেমন। আমি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতাম। কখনো কখনো পথে দেখা সাক্ষাত হলে আমি আশঙ্কায় থাকতাম, তাদের সাথে যোগ দিতে বলে কিনা। কিন্তু না, সেরকম কিছু হয়নি। তাদের সঙ্গ ছেড়েছি বলে তারা আমাকে বিরূপ চোখে দেখেছে বলেও মনে হয়নি। দুয়েকবার পথে দেখা হয়েছে, আমি চোখ সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেছি। একবার একজন আমাকে পেয়ে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরেছে। তখন আমি রীতিমত ভদ্রলোক হয়ে উঠেছি। অস্বস্তির সাথে আশপাশে তাকাচ্ছি কেউ দেখছে কিনা এক দাগী সন্ত্রাসী আমাকে জড়িয়ে ধরেছে এভাবে। 

হাইস্কুলে ওঠার পর আমাদের বাসা বদল হয়। একই কলোনীতে আরেকটু বড় বাসা। নতুন সজ্জন প্রতিবেশি। পুরোনো ডাংগুলি দোস্তদের বাদ দিয়ে আরেকটু উজ্জ্বল বন্ধুর সাথে যুক্ত হতে শুরু করি। ডাংগুলি, সাতচাড়া খেলা বাদ দিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু হয়। এই পর্ব থেকে আমার বইপড়া যাত্রা হয় বন্ধু মিজানের হাত ধরে। এই পর্বে মিজানের সাথে আমার ঘনিষ্টতা হয় বেশি। পরে তার সাথে যুক্ত হয় মামুন, বেনু, কবির, টুটুল, পুটুল, সাইদ, বাবুলসহ আরো অনেকে। আমরা দস্যু বনহুর থেকে শুরু করে, কুয়াশা পেরিয়ে মাসুদরানার দিকে হাত বাড়াই সন্তর্পনে। স্কুল লাইব্রেরি থেকে কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স ইত্যাদি। সিজিএস কলোনীর মসজিদ মার্কেটে মহিউদ্দিন স্যারের একটা বইয়ের দোকান ছিল। সেখানে নতুন বই আসলে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতাম। সেবা প্রকাশনীর সাথে পরিচয় হয় এই পর্বে। মিজানদের চারতলায় হামিদ নামের এক বন্ধু ছিল আমার। ওর এক ভাই ছিল আজাদ নামে। শুনেছিলাম ওরা চাঁদ সুরুজ একটা সিনেমায় অভিনয় করেছিল। আমাদের কাছে ওদের পরিবারটা একটা বিশেষ বিস্ময় ছিল। ওদের বাসায় টিভি ছিল। আমরা মাঝে মাঝে টিভি দেখার নিমন্ত্রণ পেতাম। তখন যাদের বাসায় টিভি থাকতো তাদের বাসায় কলোনীর যে কেউ গিয়ে টিভি দেখার সুযোগ পেতো। সেটা চেনা বা অচেনা যাই হোক। ওটা ছিল সাধারণ একটা মানবাধিকার। আজকে এই চিত্র কল্পনাও করা যায় না।

সিজিএস কলোনী হলো আমার গ্রামের মতো। আমার সবচেয়ে বেশি বন্ধু এই কলোনীতে। পুরো স্কুল এবং কলেজ জীবন কেটেছে ওই কলোনীতে। আমার পুরো জীবনের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল ওখানেই। তাই বাকী জীবনে ঘুরে ফিরে বছরে অন্তত দুয়েকবার ওই কলোনীতে গিয়ে ঘুরে আসি। এখন ওখানে তেমন বন্ধু নাই। অল্প কয়েকজন সরকারী চাকরিসূত্রে বাসা পেয়েছে শুধু তারাই আছে। তাদের সান্নিধ্য পেয়ে আমার মনে হয় আমি পুরোনো জীবনে ফিরে গেছি। কলোনির নয় নম্বর মাঠ ছিল আমাদের বন্ধুদের আড্ডার প্রধান জায়গা। হাসপাতালের সিড়ি, পাওয়ার হাউসের বারান্দা এই দুটো জায়গাও ছিল আমাদের স্থায়ী আড্ডাখানা। বেনু, মামুন, মিজান, জয়নাল, মোমিন, জাহেদ, জিয়া, টুটুল, পুটুল, বাবুল, সাইদ, ফন্টু, মোশারফ, রিপন, মিরাজ, আরো অনেকে।

৯ নম্বর মাঠের আড্ডা ছাড়াও আমাদের আরেকটি জায়গা ছিল তার পাশেই। ওটার নাম পাওয়ার হাউস। আমাদের সেই পাওয়ার হাউসের আড্ডাটা কফি হাউসের আড্ডার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। এখন সবকিছু গল্প হয়ে গেছে।



(আগ্রাবাদের বর্তমান মানচিত্রে ৯ নম্বর মাঠ)



Saturday, August 17, 2024

তুলনার অপপ্রয়োগ

তুলনা জিনিসটার অপপ্রয়োগ পৃথিবীতে অনেক অনাচারের জন্ম দেয়। এখন কেউ কেউ ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনা করছে। এটাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতাও বলছে কেউ কেউ। সাময়িক আবেগে ভেসে গিয়ে এই ধরণের অবান্তর তুলনা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার সামিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য প্রতিহিংসায় তাড়িত হয়ে এ ধরণের উচ্চারণ বাংলাদেশকে অপমান করে। আমাদের লক্ষ লক্ষ পূর্বপুরুষ নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে এই দেশটাকে স্বাধীন করেছিল। নয় মাস ধরে যে ভয়ানক হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল সেটার নজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া আর কোথাও নেই। সুতরাং এই ধরণের অবান্তর তুলনা সেই সব লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রতি অপমান। ১৯৭১ সালকে অপমান করা নিজের জন্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো ব্যাপার। আমার বিশ্বাস এই প্রজন্মের কোনো শিক্ষিত তরুণ এমন তুলনা করে না। যেসব অর্বাচীন এমন অসঙ্গত তুলনা করে তাদের সংখ্যা বেশি নয়।

যেন ভুলে না যাই, এই ছাত্র আন্দোলন সফল হয়েছিল প্রাজ্ঞ শিক্ষিত প্রগতিশীল মননশীল মানুষেরা সমর্থন দিয়েছিল বলে। যেসব ছাত্র শ্লোগান দিয়ে মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছিল তারা কেউ এই অবান্তর তুলনাকারী নির্বোধ জনগোষ্ঠির অংশ নয়। এই ছাত্রগুলো ৫২, ৬৯, ৭১ সালের ইতিহাসের পথ ধরে তাদের আন্দোলনকে সফল করেছিল। আন্দোলনের সফলতার পর হঠাৎ করে রাজপথ দখল করে যেসব নির্বোধ এমন অবান্তর তুলনা করতে শুরু করেছে, তাদের মতো কেউ আন্দোলনের ডাক দিলে সাধারণ মানুষ নামতো না। এই বাস্তবতাও যেন ভুলে না যাই।

Friday, August 16, 2024

সামান্য ক্ষতি! - ২০২৪ সংস্করণ

[পুরোনো লেখার পুনর্মুদ্রণ। প্রায় এক যুগ আগে ২০১৩ সামান্য ক্ষতি নিয়ে লিখেছিলাম। ২০২৪ সালেও যে সেটা প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে কে জানতো। কোনো পরিবর্তন ছাড়াই সামান্য ক্ষতির বিবরণ পরিবেশিত হলো]

সামান্য ক্ষতি-২০১৩!

ভয়ানক দুঃসময় অতিক্রম করছে অনেক মানুষ। অনেক না কিছু মানুষ? বেশীরভাগ মানুষ কি ভালো আছে? আমি কি ভালো আছি? আমি ভালো থাকলেই 'কিছু' মানুষের দুঃখ গায়ে কাঁটা দেয় না? এখন কিসের দুঃসময়? কতটা দুঃসময়? এক বন্ধু বললো এখনো তেমন দুঃসময় ঠিকভাবে এসে উপস্থিত হয়নি। এখনো দেখার অনেক বাকী। অনেক অন্ধকার এখনো বিষদাঁত লুকিয়ে আড়ালে অপেক্ষা করছে। সেই দাঁতাল অন্ধকার এসে উপস্থিত হলে এই যে লেখাটা টাইপ করছি, সেটাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এই যে প্রাত্যাহিক ইন্টারনেট বিচরণ সেখানেও পড়বে করাল থাবা। তখন কেবল অন্ধকারেরই প্রবল রাজত্ব থাকবে।

তবু............এটা............বিচ্ছিন্ন............ একটা..........লেখা। এটার সাথে বাস্তবের কোন সম্পর্ক না থাকলেই ভালো হতো।

(... ... ... . .... .... .... ... ... ...)

______শূন্যতা_____


এটা কি?

এটা একটা দায়সারা শূন্যতা। এই যে বন্ধনীর ভেতর দেড় ইঞ্চির শূন্যস্থান - সেখানে আসলে কয়েক হাজার বা লক্ষ পৃষ্ঠা। একেকটা মানুষের সর্বনাশের ইতিহাস, সর্বনাশের বেদনার কথা কয়েক হাজার পৃষ্টা হবে যা লেখার সাধ্য আমার নেই। আমি প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুলে সংবাদ পাঠ করতে সাহস পাই না। শুধু হেডলাইন আর থেতলানো ঝলসানো শরীরগুলোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবার পর আমার বুকের ভেতরে ক্রোধ আর বেদনা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন আমার ইচ্ছে করে একটা নিউট্রন প্রোটন বা হাইড্রোজেন বোমায় পৃথিবীটা ধ্বংস করে দেই। কিন্তু কিছু করা হয় না। অতঃপর অক্ষমতার আগ্রাসনে এক টুকরো শূন্যস্থানে আমি লুকিয়ে থাকি। এ আমার দায়সারা শূন্যতা।

আমার কি দায়? সে তুমি বুঝবে না। কারণ তোমার প্রিয়তম সন্তান এখনো পোড়েনি। তোমার বটবৃক্ষ বাবা এখনো বোমার আঘাতে থেতলে যায়নি। তোমার আদরের ভাই/বোনটা এখনো নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসছে, এমনকি তোমার প্রিয় বন্ধুটি বলতে পারছে, চল আজ 'রোদেলা বিকেলে' বসে একটা আড্ডা দেই। তোমার কাছে এই সর্বনাশগুলো তৃতীয় কোন পক্ষের ঘটনা, কেবলই একটা খবরের হেডলাইন কিংবা নেহায়েত ২০ ফন্টের একটা ব্লগ টাইটেল।

অথচ কি জানো, কুড়িয়ে পাওয়া ককটেল বিস্ফোরিত হয়ে হাতের পাঁচটি আঙুল হারালো যে সাড়ে তিন বছরের শিশু লিমা -তার জন্য, তার অসহায় বাবা মায়ের জন্যও লেখা যাবে কয়েকশো পৃষ্ঠা। আর গত এক মাসে দেশের সর্বনাশ হওয়া মানুষের কথার যোগফল লেখার মতো কাগজ সমগ্র বাংলাদেশেই নেই।

তাদের সবার জন্য ওই শূন্যস্থানটি। ওই শূন্যস্থানেই আমার শোকগাঁথা। বাংলাদেশে মানুষের জীবন এখন ঢাকা শহরের সীসা মিশ্রিত দুষিত বাতাসের চেয়েও সস্তা হয়ে গেছে। দাঁতাল শুয়োরের (শমসেরের) বাচ্চারা তবু বলছে এরকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক। এই দেশ আফগানিস্তান হয়ে গেছে? ইরাক হয়ে গেছে? পাকিস্তান হয়ে গেছে? এই মৃত্যু, এই জীবন্ত দাহ্য শরীরগুলো সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে শমসেরের বাচ্চাদের কাছে। তাদের চোখে স্বপ্নের সর্বনাশ গদিয়ান হয়ে মসনদী জয়গান গাইছে। তবু ওই বানচোত হয়তো একদিন গোলাপী ওড়নায় চড়ে দেশ বিদেশে বাংলার পতাকা নিয়ে দেশবিদেশে পররাষ্ট্র সেবা করবে। গ্রেনেড বোমা গুলি পেট্রোল বারুদের গন্ধ এড়িয়ে বেঁচে থাকলে আমার দুর্ভাগা চোখও কি তা দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে নেবে?

এখানে যাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের আর উপায় নেই। যাদের হয়নি তারা যে কোন সময় আশংকার করছে সর্বনাশের। যারা কোন রাজনীতি করে না, যাদের সাথে রাজনীতির কোন প্রেম বিদ্বেষের সম্পর্ক নেই, যারা কেবল নিজের কাজ করে, কাজ সেরে বাজারে যায়, শাক ডাল সবজি কিনে বাড়ি ফিরে, রান্না করে গরম তুলতুলে ভাত খায়, খাওয়া শেষে শক্ত বিছানায় তৈলাক্ত বালিশে মাথা রেখে ঘুমায়, জগতের আর কোন ত্রিবিধ ব্যাপারে যারা কখনো মাথা ঘামায় না, রাজনীতির দুষ্টচক্র তাদেরকেও রেহাই দিচ্ছে না। কামড়ে ধরছে তাদের ঘাড়, কাঁধ, নাক মুখ চোখ। যে নির্বিবাদী মানুষটা কাজ করে বাড়ি ফিরছে তার সর্বনাশ করছে রাজনীতি, যে কর্মক্লান্ত মানুষ বাজারে গিয়ে পরিবারের জন্য পঞ্চাশ টাকার আলু ডাল কিনে আনছে তাদেরও সর্বনাশ করছে রাজনীতি, যারা কোথাও কোন পক্ষ নয়, কারো বাদ বিবাদ যোগ বিয়োগে নেই, রাজনীতি তাদেরকেও সুস্থ জীবন ধারণে বাধা দিচ্ছে। গুলি বোমা বারুদের ভাষায় ডেকে ডেকে বলছে, এই দেখ আমরা শুয়োরের বাচ্চারা এই দেশে আছি, এই দেশে বাস করেও এই দেশ জ্বালিয়ে দিচ্ছি। আমাদের লোহার নল দিয়ে গুলি ফুটাই, তোর বুক পেট মুণ্ডু ফুটা করি, কি করতে পারিস তুই?

এই ভূখণ্ডে বসবাস করাটাই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে।

কেউ কেউ বলছে, এখানে আর থাকা যাবে না, এদেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এখান থেকে পালিয়ে যাও। কিন্তু নিজের দেশ ছেড়ে, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে, নিজের আত্মীয় পরিজন ছেড়ে কোথায় পালাবে মানুষ? সবার পালিয়ে যাবার সামর্থ্য নেই। অনেকের সামর্থ্য থাকলেও পালাবে না। পালাতে পারবে না। পালিয়ে কোন সমাধান হবার নয়।

তাহলে কি মরে যাওয়াই সমাধান? এখনো যথেষ্ট মরেনি মানুষ? এখনো লাশের টার্গেট পুরণ হয়নি? এখনো কবরে জায়গা খালি রয়ে গেছে? নিঃশেষে প্রাণ এখনো করিতে পারো দান?

হায় রবীন্দ্রনাথ, তুমি শত বছর আগেই বুঝেছিলে অপরিণামদর্শী বাঙালীর মন। শতবর্ষ পেরিয়েও তাই তোমার কবিতা প্রাসঙ্গিক থেকে যায়-

বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস,
          স্বচ্ছসলিলা বরুণা।
পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে
শিলাময় ঘাট চম্পকবনে,
স্নানে চলেছেন শতসখীসনে
          কাশীর মহিষী করুণা।

সে পথ সে ঘাট আজি এ প্রভাতে
          জনহীন রাজশাসনে।
নিকটে যে ক'টি আছিল কুটির
ছেড়ে গেছে লোক, তাই নদীতীর
স্তব্ধ গভীর, কেবল পাখির
          কূজন উঠিছে কাননে।

আজি উতরোল উত্তর বায়ে
          উতলা হয়েছে তটিনী।
সোনার আলোক পড়িয়াছে জলে,
পুলকে উছলি ঢেউ ছলছলে--
লক্ষ মানিক ঝলকি আঁচলে
          নেচে চলে যেন নটিনী।

কলকল্লোলে লাজ দিল আজ
          নারী কণ্ঠের কাকলি।
মৃণালভুজের ললিত বিলাসে
চঞ্চলা নদী মাতে উল্লাসে,
আলাপে প্রলাপে হাসি-উচ্ছ্বাসে
          আকাশ উঠিল আকুলি।

স্নান সমাপন করিয়া যখন
          কূলে উঠে নারী সকলে
মহিষী কহিলা, "উহু! শীতে মরি,
সকল শরীর উঠিছে শিহরি,
জ্বেলে দে আগুন ওলো সহচরী--
          শীত নিবারিব অনলে।'

সখীগণ সবে কুড়াইতে কুটা
চলিল কুসুমকাননে।
কৌতুকরসে পাগলপরানী
শাখা ধরি সবে করে টানাটানি,
সহসা সবারে ডাক দিয়া রানী
          কহে সহাস্য আননে--

"ওলো তোরা আয়! ওই দেখা যায়
          কুটির কাহার অদূরে,
ওই ঘরে তোরা লাগাবি অনল,
তপ্ত করিব করপদতল'--
এত বলি রানী রঙ্গে বিভল
          হাসিয়া উঠিল মধুরে।

কহিল মালতী সকরুণ অতি,
          "একি পরিহাস রানীমা!
আগুন জ্বালায়ে কেন দিবে নাশি?
এ কুটির কোন্‌ সাধু সন্ন্যাসী
কোন্‌ দীনজন কোন্‌ পরবাসী
          বাঁধিয়াছে নাহি জানি মা!'

রানী কহে রোষে, "দূর করি দাও
          এই দীনদয়াময়ীরে।'
অতি দুর্দাম কৌতুকরত
যৌবনমদে নিষ্ঠুর যত
যুবতীরা মিলি পাগলের মতো
          আগুন লাগালো কুটিরে।

ঘন ঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া
          ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল।
দেখিতে দেখিতে হুহু হুংকারি
ঝলকে ঝলকে উল্কা উগারি
শত শত লোল জিহ্বা প্রসারি
          বহ্নি আকাশ জুড়িল।

পাতাল ফুঁড়িয়া উঠিল যেন রে
          জ্বালাময়ী যত নাগিনী।
ফণা নাচাইয়া অম্বরপানে
মাতিয়া উঠিল গর্জনগানে,
প্রলয়মত্ত রমণীর কানে
          বাজিল দীপক রাগিণী।

প্রভাতপাখির আনন্দ গান
          ভয়ের বিলাপে টুটিল--
দলে দলে কাক করে কোলাহল,
উত্তরবায়ু হইল প্রবল,
কুটির হইতে কুটিরে অনল
          উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল।

ছোটো গ্রামখানি লেহিয়া লইল
          প্রলয়লোলুপ রসনা।
জনহীন পথে মাঘের প্রভাতে
প্রমোদক্লান্ত শত সখী-সাথে
ফিরে গেল রানী কুবলয় হাতে
          দীপ্ত-অরুণ-বসনা।


[সামান্য ক্ষতি -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]


২০২৪ সালের রানীমাতার কাছেও কী শুরুতে এটা সামান্য ঘটনা মনে হয়েছিল? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে খুব বেশি সময় লাগে না এই বঙ্গদেশে!

Wednesday, August 14, 2024

দুঃখ এবং শোক



শেখ হাসিনার খোলা চিঠি পড়লাম। অশ্রু ভারাক্রান্ত চিঠি। যথেষ্ট করুণ ভাষায় লেখা হয়েছে চিঠি। আমার মন খারাপ হয়েছে চিঠিটা পড়ে। তবু চিঠির শুরুতে যে সত্যগুলো গোপন করেছে, সেগুলোর জবাব না লিখে পারছি না। কোটা আন্দোলন কেন শুরু হয়েছিল, সেটা যদি আপনি বা আপনার গোয়েন্দা সংস্থা না বোঝেন তাহলে আপনাদের দেশ শাসন করাই উচিত হয়নি ১৫ বছর ধরে। একটা শিশুও জানে কোটা আন্দোলন ছিল একটা টোপ, আপনি সে টোপ গিলবেন কিনা সেটা আন্দোলনকারীরাও নিশ্চিত ছিল না। আমরা জানতাম আপনি যথেষ্ট চালাক। নইলে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতা আকড়ে থাকতে পারতেন না। এত কিছু করতে পারলেন, এত কায়দা কৌশল জানেন তবু টোপটা গিললেন। কয়েকটা তরুণ বুদ্ধিমান ছেলের কাছে পরাস্ত হলেন। এই পরাজয়টা অনিবার্য ছিল বোধকরি।
আপনি লিখেছেন- "সেই অপরাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভনিতা করে গেছে। সে কারনেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সকল দাবী পূরণের পরেও তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে, একদিকে নয় দফা দাবী মেনে নেয়ার জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছে কিন্তু দাবী পূরণের জন্য আলোচনা করতে চাইলে সে আহবান প্রত্যাখান করেছে"


ভণিতা তো করবেই। কিন্তু বিষয়টা কী এতই সরল ছিল? আপনি ১৪ তারিখ কী বলেছেন? ১৫-১৬ তারিখ কী করেছে আপনার ছাত্রলীগ আর পুলিশ? কেন ৯ দফা দাবীর প্রশ্ন উঠলো? ৯ দফায় কী আপনার পদত্যাগ ছিল? ছিল না। আপনি সহজেই ৯ দফা মেনে নিতে পারতেন ক্ষমা চেয়ে। মন্ত্রীগুলোকে বরখাস্ত করে। ডিবি হারুনকে শায়েস্তা করে। কিন্তু আপনি করেন নাই।আপনার অহংকার, নির্বুদ্ধিতা, মানুষের শক্তিকে খাটো করে দেখেছিলেন, আপনি মানুষের চেয়ে বাহিনীগুলোকে শক্তিশালী ভেবেছিলেন। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আপনাকে অন্ধ করে রেখেছিল।


ছাত্ররা চাইলেই এত মানুষকে রাস্তায় নামাতে পারতো? আপনারা ছাত্রলীগ দিয়ে ছাত্র দমন করতে গিয়ে নিরীহ ছেলেপেলের মাথা ফাটিয়ে দিলেন, পুলিশ গুলি চালালো নিরীহ ছাত্রদের ওপর। তবু আপনি ক্ষমা চাইলেন না, দুঃখপ্রকাশ করলেন না। বরং ১৭ তারিখের বক্তৃতায় ক্ষমা চাওয়ার বদলে নিজের স্বজন হারানোর লক্ষবার পুনারবৃত্ত করা গীতটা গাইলেন। তারপরেই তো মানুষ ক্ষেপে গিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হলো। ১৮ তারিখ থেকে যে ঘটনা শুরু হলো, সেটা আপনার বোঝা উচিত ছিল ১৭ তারিখেই। আপনি তখনই একটা আপোষ করে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তা না করে ছেলেগুলোকে ধরে আটকে রেখে মেরে কেটে আন্দোলন দমাতে গেলেন। তখনই তো কেঁচে গেছে সব। সারাদেশ ক্ষেপে গেছে এক যোগে। আপনি এসব দেখেননি, আপনার গোয়েন্দারা এসব বলেনি আপনাকে? আপনি কতগুলো মানুষকে খুন করার পর আপোষে রাজী হলেন। মনে আছে?


ওই ছাত্রদের পেছনে জামাত-শিবির আছে বুঝলাম। আপনিও তা জানতেন। তবু আপনি তাদের খেলো ভাবলেন। আপনি ভাবলেন আপনার বাহিনী আপনাকে রক্ষা করবে। কিন্তু সাধারণ জনগণ যখন পথে নামে তখন কোনো বাহিনী তাকে থামাতে পারে না। আপনার সেটা বোঝা উচিত ছিল। ইতিহাস থেকে আপনি কিছুই শেখেননি। আপনার ঔদ্ধত্য আপনার ধ্বংস ডেকে এনেছিল। আপনি নিজেও ধ্বংস হলেন, আপনার দলকেও ধ্বংস করলেন।


খোলা চিঠিতে নিজের ভুলের কথাটা একবারও লিখলেন না দেখে আমি দুঃখিত হলাম। আপনি কোনো শিক্ষাই নিলেন না এই ভয়ংকর ঘটনা থেকে।

Tuesday, August 13, 2024

মুখ ও মুখোশ

 অতীতের ছাত্র আন্দোলনের সাথে ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের একটা মৌলিক পার্থক্য হলো, খোলস। এই আন্দোলনটা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে হয়নি। কিন্তু পেছনে একটা সক্রিয় শক্তি ছিল, সেটা কে আমরা এখনো জানি না। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হবার পর কিছু কিছু তৎপরতা দেখে স্পষ্ট হচ্ছে চিত্রটা। খোলসটা ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছে। সরকারে ১৬ জন উপদেষ্টা। আন্দোলনকারীদের দেওয়া তালিকা থেকেই তাদের নির্বাচিত করা হয়েছে। তালিকাটা নিয়ে প্রথম দুদিন কারো আপত্তি শোনা যায়নি। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে মৃদুস্বরে আপত্তি শোনা যাচ্ছে কারো কারো ব্যাপারে। অচিরেই আপত্তিটা জোরদার হবে। এখান থেকে কাউকে কাউকে বাদ দেবার জন্য দাবী জানানো হবে। ঘেরাও হবে নানান দফতর। তখন মুখোশটা আরেকটু উন্মোচিত হবে। 

বাংলাদেশ আরো কিছুদিন এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো একটা পক্ষ পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহন করছে না ততক্ষণ এই অস্থিরতা থাকবে। এই আন্দোলন আওয়ামী বিরোধী শক্তির হাত ধরে হয়েছে, আগামীতে তাদের হাতেই ক্ষমতা থাকবে। ২০০৭ এর পরিবর্তন আওয়ামী লীগের অনুকূলে হয়েছিল, তারাই বেনেফিশিয়ারী হয়েছিল। এদেশে নিরপেক্ষতা বলে কোনো জিনিস নাই রাজনীতি কিংবা রাষ্ট্রপরিচালনায়। এই সত্যটা স্বীকার করতেই হবে। 

এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও সুবিবেচক নিরপেক্ষ লোকের সংখ্যা খুব কম। অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোনোভাবে দলকানা, মতলবাজ, সুবিধাবাদী। একটু চোখ খুলে তাকালে আপনি আপনার নিজের পরিবারের মধ্যেই দেখতে পাবেন তাদের।


Monday, August 12, 2024

নতুন অধ্যায়ে বাংলাদেশ

এই অঞ্চলের মানুষ তিনটা গণ অভ্যুত্থানের সাক্ষী হলো ৫৬ বছরে। ১৯৬৯, ১৯৯০, ২০২৪। তিনটা আন্দোলনেরই নেতৃত্বে ছিল ছাত্রসমাজ। প্রথমটা হয়েছিল আমার বাবাদের যৌবনে, দ্বিতীয়টা আমার যৌবনে, তৃতীয়টি হলো আমার পুত্রকন্যাদের ছাত্রজীবনে। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সাথে বাকী দুটোর তুলনা চলে না। কারণ ওই অভ্যুত্থান ছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। পরের দুটো হলো সরকার পতন আন্দোলন।
১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের আন্দোলনে একটা বড় মিল আছে। ১৯৯০ সালের আন্দোলনটি হয়েছিল ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ নামের একটা প্ল্যাটফর্মে। সেই দলটির কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি। কারণ ঐক্যটি বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল কয়েক বছরের মধ্যেই। ২০২৪ সালের আন্দোলন হয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজে'র প্ল্যাটফর্মে’। এদের ঐক্য কতদিন থাকবে আমি জানি না। ঘরপোড়া গরু আমরা।
১৯৯০ সালের আন্দোলনটি পরিচালিত হয়েছিল সরাসরি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে। কিন্তু ২০২৪ সালের আন্দোলনে প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক দল যুক্ত ছিল না। তবে দুটো আন্দোলনই ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল। দলমতধর্মবর্ণ নির্বিশেষে পথে নেমেছিল মানুষ। সাধারণ মানুষকে পথে নামানোর মতো যোগ্যতা বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেই, গত ১৫ বছরে সেটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৯০ সালের সরকার পতনে এত লোকক্ষয় হয়নি, এত ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটেনি, এতটা নৃশংসতা দেখেনি মানুষ। নিষ্ঠুরতার দিক থেকে ২০২৪ সালের ঘটনা শতবর্ষের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকবে। সমস্ত আইন শৃংখলার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে এই আন্দোলনে। গৃহযুদ্ধ বাদে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনার দ্বিতীয় নজির আছে কিনা সন্দেহ।
এবারের সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম হলো নতুন সরকারে আন্দোলনকারী ছাত্রদের অংশগ্রহন। এমন কিছু এক সপ্তাহ আগেও কেউ কল্পনা করেনি। আমার মনে হয় যারা এখন সরকারে যুক্ত হয়েছে তারাও করেনি। এত কমবয়সী দুই তরুণ দুটো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েছে, বাঘা বাঘা বয়স্ক অফিসারগণ তাদের স্যার স্যার করছে, এটা কোনো সিনেমার দৃশ্যেও দেখেনি বোধহয় কেউ। কিন্তু আমরা জানি, ট্রুথ ইজ স্ট্রেনজার দ্যান ফিকশন।
বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের একাংশ ড. ইউনুসকে পছন্দ করে না। পছন্দ না করার যেসব কারণ বলা হয় তার সবগুলাই হাস্যকর। অন্যতম একটি অভিযোগ হলো কর ফাঁকি। যারা এসব অভিযোগ করে তাদের প্রত্যেকের ট্যাক্স ফাইল খুলে যদি প্রমাণ করতে পারে তারা শতভাগ সত্য ঘোষণা দিয়েছে, তাহলে তাদের অভিযোগ মেনে নেবো। আমি ২০০৯ সালের নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের শতাধিক শীর্ষ নেতার ট্যাক্স ফাইল দেখেছিলাম অনলাইনে। আপলোড করা হয়েছিল নির্বাচন কমিশন থেকে। তখন দেখেছি একেকটা সাধু নেতা কত বড় বড় মিথ্যুক আর বাটপার। আমার পরিচিত হাজার কোটি টাকার মালিক প্রধান রাজনৈতিক দলের এক শীর্ষ নেতা তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন দেড় লাখ টাকা। তাই তিনি সেবছর কর মওকুফ পেয়েছিলেন। মনে হয়েছিল তিনি দুস্থ ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত।

এই সরকার নিয়ে ড. ইউনুস কতদূর যায় আমি দেখতে আগ্রহী। তাঁর বিরুদ্ধে সবসময় ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ করা হয়, তিনি আমেরিকার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন, তিনি বিশ্ব মোড়লদের দালালী করছেন, ইত্যাদি। কিন্তু কথা হলো বাংলাদেশের ৫৩ বছরে সবগুলো সরকারের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ ছিল। সবাই কারো না কারো দালাল হিসেবে অভিযুক্ত। কেউ ভারত, কেউ পাকিস্তান, কেউ সৌদিআরব, কেউ আমেরিকা, রাশিয়া, চীন। যুগ যুগ ধরে এসব অভিযোগ আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শুনতে শুনতে রাখাল বালকের গল্পটাই শুধু মনে পড়ে। আমার ভয় হয়, সত্যিকারের বিপদের সতর্কতা হলেও মানুষ আর বিশ্বাস করবে না।
নতুন সরকারের কাছে আপাতত আমরা শুধু দুটো জিনিস চাই। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব মানুষের নিরাপত্তা এবং সহনীয় দ্রব্যমূল্য। বাকীগুলোর দায়িত্ব মানুষ নিজেরাই নেবে।

পুনশ্চ:
এখনো তিনদিন গড়ায়নি নতুন সরকারের। তবু একটা সম্ভাবনার কথা বলা যাক। এই অভ্যুত্থানের পেছনে যে শক্তি ছিল তাদের সাথে ড. ইউনুসের গোপন যোগসাজসের অভিযোগ করা হয় আওয়ামী পক্ষ থেকে। আমার কাছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বরং আমার ধারণা ড. ইউনুসের সাথে তাদের বিরোধ শুরু হবে অচিরেই। কারণ তাদের সব এজেন্ডা বাস্তবায়নে রাজী হবেন না তিনি। আওয়ামীরা যতই অভিযোগ করুক, তিনি ওই দলের লোক নন এটা পরিষ্কার। কারণ উপদেষ্টা পরিষদে যাদের নেওয়া হয়েছে সেখানে তাদের পছন্দের লোক বেশি নেই। অতএব বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে এই পরিষদে পরিবর্তন আনার দাবী শুরু হয়ে যাবে অচিরেই। সেখানে কট্টরপন্থী লোকদের ঢোকানোর চেষ্টা চলবে। সেটা নিয়ে বিরোধ নিয়ে আরেকটা অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তখন ইউনুস সাহেব হাল ছেড়ে পদত্যাগও করতে পারেন। নতুন আরেকটা সরকার গঠিত হতে পারে সেনা সমর্থনে। সেটাই হবে বাংলাদেশের আসল নতুন যুগ। সেই নতুন যুগটা না আসলেই আমি খুশী হবো।

Saturday, August 10, 2024

বিভক্তির আশঙ্কা

অল্প সময়ের মধ্যে একটা ব্যাপার ঘটবে আন্দোলনকারী ছাত্রদের মধ্যে। বিভাজন। সরকার পতনের এই যে আনন্দ করছে ওরা তাদের মধ্যে দুই শ্রেণী আছে। একটা ভাগ কট্টরপন্থী, আরেকটা ভাগ প্রগতিশীল। এদের মধ্যে বিরোধ শুরু হবে এবং প্রগতিশীল অংশ অচিরেই বাতিলের দলে পড়ে যাবে। ডানপন্থী কট্টর গ্রুপ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেবে সবকিছু। এই আন্দোলনে যে সাধারণ মানুষ যুক্ত ছিল, প্রগতিশীল শ্রেণীর সক্রিয় সমর্থন ছিল, সেটা পুরোপুরি মুছে যাবে। সেখান থেকেই নতুন অন্ধকার ধারা শুরু।

Wednesday, August 7, 2024

বেহাত বিপ্লবের সমীকরণ

১.
আওয়ামী লীগের এবং শেখ হাসিনার ভুলের মাশুল দিচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশ। যে চোরগুলোর কারণে দেশের এই পরিণতি তাদের কিছু হয়নি, তারা পালিয়ে গেছে কিন্তু অপমানিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং নিরীহ মানুষ।

১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ ইতিহাসের সবচেয়ে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ১৫ জুলাই যে আশঙ্কাটা ব্যক্ত করেছিলাম, ৫ আগষ্ট তার ফলাফল দেখা গেল। ১৫ বছর প্রবল প্রতাপের সাথে দেশ শাসন করে লজ্জাজনকভাবে পালিয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনাগুলোর জন্ম দিয়েছেন তিনি। যাবার আগে ও পরে যেসব মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার সবকিছুর জন্য দায়ী থাকবেন তিনি। বাংলাদেশকে একটা অন্ধকার নৈরাজ্যকর অবস্থায় ফেলে তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছেন। হাজার হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে প্রতিশোধের অংশ হিসেবে। পুরো পুলিশ বাহিনীটা ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশে কোনো কার্যকর আইন শৃংখলা বাহিনী নেই। পুরো দেশটাই একটা অরাজক অনিরাপদ রাজ্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অন্ধকার আগে কখনো আসেনি।

যে ছাত্ররা এই বিপ্লব ডেকে এনেছিল, তাদের ঘাড়ে চেপে একটা অশুভ শক্তি সারা দেশে অরাজকতা চালাচ্ছে। বিপ্লব বেহাত হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই অরাজকতা হিংস্রতা চায়নি। সারা দেশে একদল দানবের আবির্ভাব হয়েছে। যেন এক দানবের প্রস্থান হলো, অমনি আরেক দানব উপস্থিত হলো।

৫ আগষ্ট যারা আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল, তাদের অনেকেও আক্রান্ত হয়েছে এই দানবের হাতে। বাংলাদেশে সকল দানবের রাজত্বের অবসান ঘটুক।

২.

আমাদের যৌবনে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ পতন হলো। তারপর ধারাবাহিকভাবে তিনটা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের একই ফ্যাসিবাদী আচার আচরণ দেখার পর চিরতরে ভোটবর্জন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। পাঁচ বছরে একবার ভোট দিয়ে সারা বছর হাহুতাশ করার কোনো মানে হয় না। যে সিস্টেমটা বারবার ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নামে লুটপাটের মেয়াদপূর্তি করে, সে সিস্টেমে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ভোট না দিলেও কিছু এসে যায় না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের শুধু কোনোমতে টিকে থাকার মতো একটা জীবিকার দরকার। সেটার জন্যই শ্রম ও সময় বিনিয়োগ করবো। গত বিশ বছর তাই করে এসেছি। এবার তাই ছাত্ররা যখন বললো, পুরোনো সিস্টেম ভেঙ্গে নতুন কিছু করবো, আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। এদের কথাবার্তা বিপ্লবের গন্ধ আছে। নতুন কিছু করার জন্য বিপ্লবের কোনো বিকল্প নেই। অথর্ব রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে নবীনদের কাছেই দেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যাক। কিন্তু বিপ্লব সফল হতে না হতেই যা দেখতে শুরু করলাম, সেটা আর বললাম না। অনেকে বলছে এগুলো নাকি বিপ্লবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। একটু সময় দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দিলাম সময়। আরো কয়েক হাজার ধ্বংস হোক, আরো কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হোক। কিন্তু তারপর? 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। মেয়াদ তিন মাস। তাদের কাজ কী? একটা নির্বাচন করা। নির্বাচন করে কী হবে? সেই পুরোনো দলগুলোর একটা আবার ক্ষমতায় আসবে। তাহলে বিপ্লবের কী হবে? নতুন বোতলে পুরোনো মদ ঢেলেই বিপ্লবের দায়িত্ব শেষ? 

পুরোনো সিস্টেম বদলে নতুন কিছু গড়তে না পারলে তাহলে এত প্রাণের অপচয় কেন? পুরোনো দানবের নব উত্থানের জন্য এই বিপুল প্রাণক্ষয়? শুধুই ক্ষমতার পালাবদল? 

যে তরুনরা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিল, তাদের অপ্রাসঙ্গিক অপাংক্তেয় হয়ে যেতে কতদিন সময় লাগবে?