Thursday, December 28, 2023
ডেটলাইন : ১৯১৬ আমেরিকা :: আততায়ীদের টার্গেট রবীন্দ্রনাথ
অক্টোবর, ১৯১৬। তিন মাসের দীর্ঘ যুক্তরাষ্ট্র সফরের অংশ হিসেবে স্যান ফ্রান্সিসকো পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেশটিতে এটি তার দ্বিতীয় সফর।
রবীন্দ্রনাথ যখন ইউরোপে সফর করেন, তখন সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগুন জ্বলছে। যুক্তরাষ্ট্রে মহাযুদ্ধের ছোঁয়া লাগে ১৯১৭ সালের এপ্রিলে। ওই সময় আটলান্টিক রুট বন্ধ ছিল। তাই রবীন্দ্রনাথকে জাপান থেকে যাত্রা করে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ১৯১৬ সালের ৪ অক্টোবর অরিগনের পোর্টল্যান্ডে পৌঁছতে হয়। ৪ অক্টোবর তিনি স্যান ফ্রান্সিসকোর মাটিতে পা রাখেন। এর কয়েকদিন পরই সেখানে রবীন্দ্রনাথকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষুদ্র দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়গুলো রবীন্দ্রনাথকে কোন দৃষ্টিতে দেখত, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এ ঘটনা থেকে। ঘটনাটির সঙ্গে যুক্ত ছিল দুটি সংগঠন—স্টকটনের খালসা দিওয়ান সোসাইটি ও হিন্দুস্তান গদর পার্টি। দ্বিতীয়টির সদর দপ্তর স্যান ফ্রান্সিসকোতে। সংগঠন দুটির জন্ম কয়েক মাসের ব্যবধানে।
খালসা দিওয়ান সোসাইটি ছিল মূলত ধর্মীয় ও সমাজ-সংস্কারমূলক সংগঠন। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১২ সালে। এই সংগঠন ১৯১৫ সালে স্টকটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম স্থায়ী গুরুদুয়ারা প্রতিষ্ঠা করে। আর গদর—উর্দুতে যার অর্থ 'বিপ্লব'—প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৩ সালে। সংগঠনটির রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। গদর পার্টির লক্ষ্য ছিল মূলত পাঞ্জাবি অভিবাসীদের মধ্য থেকে অর্থ ও স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উসকে দেওয়া। ১৯১৫ সালে—রবীন্দ্রনাথের সফরের এক বছর আগে—জার্মান এজেন্টদের সহায়তায় সক্রিয়ভাবে ভারতে বন্দুক পাঠানোর চেষ্টাও করেছিল গদর। যদিও সেই প্রচেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়।
গদর পার্টি ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমেরিকা সফর রাজনৈতিক ছিল না। এ কারণেই গদর পার্টি তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তৎকালীন গদর নেতা রামচন্দ্র ভরদ্বাজের সম্পাদনায় হিন্দুস্তান গদর প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটি পাঞ্জাবি ও উর্দু—মাঝে মাঝে ইংরেজিতেও প্রকাশিত হতো। রামচন্দ্র ছিলেন ব্রিটিশ নীতির কট্টর সমালোচক। তাছাড়া ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধেরও পক্ষপাতী ছিলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রথম সম্পাদকীয়তে, অক্টোবরের শুরুতে, রামচন্দ্র ব্রিটিশদের রীতিমতো সমালোচনার বাণে জর্জরিত করেন। এছাড়া তিনি জগদীশ চন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথসহ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের ওপর সেন্সরিং ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অক্টোবরের শুরুর দিকে সবকিছু বদলে যায়। ওই সময় রবীন্দ্রনাথ স্যান ফ্রান্সিসকোতে ছিলেন, ওখানে উঠেছিলেন প্যালেস হোটেলে।
১৯১৬ সালের ৫ অক্টোবর স্যান ফ্রান্সিসকো এক্সামিনার-এ রামচন্দ্রের একটি একটি দীর্ঘ চিঠি ছাপা হয়। সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের তীব্র সমালোচনা করেন। ব্রিটিশদের কাছ থেকে নাইট উপাধি গ্রহণ করার জন্য রামচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করেন। এছাড়া ব্রিটিশ শাসনকে মোগল শাসনের মতো 'সদাশয়' মনে করার জন্যও তিনি রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনার বাণে জর্জরিত করেন। রামচন্দ্র বলেন, মোগলদের দরবারে হিন্দুদের উচ্চ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ সরকারে (স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়) ব্রিটিশদের তুলনায় হিন্দুর সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। তিনি লেখেন, ব্রিটেনের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সম্পদ চলে গেছে।
স্যান ফ্রান্সিসকোতে গোলমাল
এদিকে স্যান ফ্রান্সিসকোর গোয়েন্দা উইলিয়াম মান্ডেল আগেই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ব্রিটিশ গোয়েন্দা এজেন্টদের ভারতীয় বিদ্রোহী কার্যকলাপের ব্যাপারে জানিয়েছিলেন। মান্ডেল আসলে ছিলেন একরকমের ডাবল এজেন্ট। কেননা রামচন্দ্র ও তার সহযোগীদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য গদরদের একটি গ্রুপ তাকে নিযুক্ত করে। গদরদের ওই গ্রুপের বিশ্বাস ছিল, রামচন্দ্র নিজে রিয়েল এস্টেট কেনার জন্য জার্মানদের কাছ থেকে আসা অর্থ সরাচ্ছেন। তাদের এ সন্দেহের পেছনে যুক্তিসংগত কারণও ছিল। যাহোক, রবীন্দ্রনাথের ওপর সম্ভাব্য হামলার তথ্য মান্ডেল পুলিশকে জানিয়েছিলেন।
৫ অক্টোবর প্যালেস হোটেলের ঠিক বাইরে—রবীন্দ্রনাথ যেখানে থাকতেন—খালসা দিওয়ানের দুই সদস্য, বিষেন সিং মাট্টু ও উমরাও সিংয়ের ওপর হাতেশি সিং ও জীবন সিং নামে দুজন ব্যক্তি হামলা করেন। পড়ে জানা যায়, হাতেশি ও জীবন ছিলেন গদর পার্টির সদস্য। তার মাথার পাগড়ি ছিঁড়ে ফেলেন দুই আক্রমণকারী। পুলিশ আসার আগেই দুপক্ষে বেধে যায় মারামারি। মারামারির জেরে গদর সদস্যদের জেলে ঢোকানো হয়।
মাট্টু পরে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তারা ফ্রেসনো থেকে স্টকটনে যাচ্ছিলেন ট্রেনে চেপে। ট্রেনেই তারা আলাপের একপর্যায়ে এক 'হিন্দু' সহযাত্রীকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলে ফেলেন। আলামিডা টার্মিনালে ওই সহযাত্রী বিদায় নেন। মাট্টুর বিশ্বাস ছিল, ওই 'ইনফরমার'ই রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানানোর তথ্য গদরের কাছে পৌঁছে দেয়।
পরে গোয়েন্দারা জানান, গদরকর্মীদের আক্রমণের আসল লক্ষ্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি অবশ্য অক্ষতই ছিলেন। দুজন অতি-উৎসাহী গোয়েন্দাকে বহাল করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিয়েছিলেন কলম্বিয়া থিয়েটারে। সেখানে ওই দুই গোয়েন্দা কোনো 'হিন্দু'কে (ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে সমস্ত দক্ষিণ এশীয়কেই হিন্দু বলে ডাকা হতো) প্রবেশ করতে দেননি। প্যালেস হোটেলেও রবীন্দ্রনাথের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বলছে, রবীন্দ্রনাথকে মঞ্চের দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর গোপনে হোটেলের পেছনের প্রবেশপথ দিয়ে তাকে হোটেলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথকে সমস্ত এনগেজমেন্ট বাতিল করে তৎক্ষণাৎ স্যান ফ্রান্সিসকো ছাড়তে বলা হয়েছিল। সেজন্য ফের তাকে একই কৌশলে হোটেল থেকে বের করে গোপনে ঘণ্টাখানেক দূরত্বের সান্তা বারবারায় নিয়ে যাওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে বিষেন সিং মাট্টুর উপর হামলা হওয়ার বিষয়ে কিছু জানার কথা অস্বীকার করেছিলেন। তিনি শুধু বলেছিলেন যে, এটি তার কাছে স্রেফ 'রাজনৈতিক মতপার্থক্য' নিয়ে গোলমাল মনে হয়েছিল, যে ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই।
'দ্য কাল্ট অভ টেগোর'
এক্সামিনার লিখেছে, এই আতঙ্ক সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ স্যান ফ্রান্সিসকোতেই সবচেয়ে বড় সাফল্য পান। পত্রিকাটির খবরের শিরোনাম ছিল, 'দ্য কাল্ট অভ টেগোর হ্যাজ টেকেন দ্য ওয়ার্ল্ড বাই স্টর্ম'। ১৯৬২ সালে আমেরিকান কোয়ার্টারলি-তে বিশিষ্ট পণ্ডিত স্টিফেন হে লেখেন, লস অ্যাঞ্জেলেসে রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি বক্তৃতায় প্রচুর লোকসমাগম হতো।
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস লিখেছে, ৫৫ বছর বয়সি রবীন্দ্রনাথকে দেখে মনে হয় যেন যিশু খ্রিষ্টের মানবরূপ। তাকে ভারতের নতুন জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণা ও আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ওই লেখায়।
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস আরও লেখা, 'দেশের অন্য যেকোনো শহরের তুলনায় এ শহরে তার বই বেশি বিক্রি হয়।'
ক্যালিফোর্নিয়ার সংবাদপত্র হ্যানফোর্ড কিংস কাউন্টি সেন্টিনেল-এ 'হোয়াই দ্য ওয়ার্ল্ড লাভস তেগোর' নামে একটি লেখা ছাপা হয়। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস অক্টোবরের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের সফর ও তার বইগুলোর ওপর একটি বিস্তারির লেখা ছাপে। ওই বছরের পুরো নভেম্বর নিউইয়র্কে কাটান রবীন্দ্রনাথ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের লেখায় তাকে 'লম্বা, সুন্দর মানুষ' হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ওই লেখায় আরও বলা হয়, ওয়াল্ট হুইটম্যানের সঙ্গে তার চেহারার কিছুটা মিল আছে।
১৯৬২ সালে আমেরিকান কোয়ার্টারলিতে প্রকাশিত 'টেগোর ইন আমেরিকা' নিবন্ধে স্টিফেন বলেন, রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার মূল বিষয় ছিল 'জাতীয়তাবাদের কাল্ট'। রবীন্দ্রনাথ ওসব বক্তৃতায় আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের অনিয়ন্ত্রিত লোভের সমালোচনা করেন।
আমেরিকান শ্রোতাদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী সন্দেহ, লোভ ও আতঙ্কের বিষাক্ত পরিবেশে বসবাসকারী মানুষ জাতীয়তাবাদের উন্মাদনার কাছে নিজ স্বাধীনতা ও মানবতাকে বলি দিচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ বোস্টন সফর সংক্ষিপ্ত করে ফেলেন। ততদিনে সফর করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ১৯১৭ সালে 'ন্যাশনালিজম' বইটি লেখা শেষ করার পর তিনি এটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯১৭-১৮ সালে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের বিচারকাজের সময় রবীন্দ্রনাথের নাম চলে আসায় তার এ উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়।
'হিন্দু-জার্মান' ষড়যন্ত্র
হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের ফলে জার্মানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে বেশ কয়েকজন গদর সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমেরিকার নিরপেক্ষতা আইন অনুসারে এ ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল বেআইনি। স্যান ফ্রান্সিসকোতে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে এ ষড়যন্ত্রের বিচারকার্য শুরু হয়। বিচারের সময় দুবার রবীন্দ্রনাথের নাম আসে।
শিকাগোতে গ্রেপ্তার হওয়া গদরকর্মী হেড়ম্ব লাল গুপ্ত, রাম চন্দ্রকে টেলিগ্রাম করে জাতীয় বিষয়ের ওপর রবীন্দ্রনাথের আইডিয়াগুলোর অনুলিপি পাঠাতে বলেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, কবির এসব আইডিয়াকে 'প্রোপাগান্ডা' হিসেবে ব্যবহার করা।
আমস্টারডামে এক জার্মান এজেন্টের কাছে ওয়াশিংটন ডিসির একজন ভারতীয় এজেন্টের পাঠানো চিঠিতে দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হয় যে রবীন্দ্রনাথ 'আমাদের পরামর্শে'ই যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। ওই চিঠিতে আরও বলা হয় যে, জাপান সফরে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের পক্ষে কাউন্ট ওকুমা ও অন্যদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। বিচার চলাকালে প্রসিকিউটিং আইনজীবী জন প্রেস্টনকে ডিফেন্স অ্যাটর্নি জিজ্ঞেস করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথকে কেন বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না। এর জবাবে অপরজন বলেন, 'তিনি তাড়াহুড়ায় ছাড়া পেয়ে গেছেন।'
এই খবর রবীন্দ্রনাথের কানে পৌঁছায় ১৯১৮ সালের এপ্রিলে, বিচারের শেষ দিকে। ওই বছরের ২৩ এপ্রিল আদালতকক্ষে প্রতিপক্ষ এক গদর সদস্যের গুলিতে মারা যান রাম চন্দ্র।
ষড়যন্ত্র মামলায় নিজের নাম টেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ১৯১৮ সালের ১২ মে একটি টেলিগ্রাম ও ৩১ জুলাই একটি চিঠি পাঠান রবীন্দ্রনাথ। তার বিরুদ্ধে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার মিথ্যা অপবাদ ও কষ্টকল্পিত প্রমাণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান বিশ্বকবি।
টেলিগ্রামটি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এর কিছুদিন পরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের জন্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। এর ফলে আমলাতান্ত্রিক আদান-প্রদানের ভিড়ে রবীন্দ্রনাথের ওই তারবার্তা হারিয়ে যায়। এর জেরে ১৯১৭ সালে উৎসর্গ ছাড়াই প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম। তার এই বইটি বহুল পঠিত এবং প্রায়ই নানা উপলক্ষে উদ্ধৃত হয়। ১৯১৯ সালে ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরপরই রবীন্দ্রনাথ তার নাইটহুড ত্যাগ করেন। এরপর তিনি আরও তিনবার—১৯২০-২১, ১৯২৮ ও ১৯৩০ সালে—যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান।
...................................................................................
লিখেছেন: অনু কুমার ( Anu Kumar), Apr 04, 2020
লিংক: https://scroll.in/article/958079/on-his-second-visit-to-the-usa-in-1916-rabindranath-tagore-was-an-assassination-target
বাংলা রূপান্তর: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ডেস্ক(২০২২)
রবীন্দ্রনাথের আকাশ বাহনের অভিজ্ঞতা এবং অন্যন্য
কলকাতা থেকে পারস্য
[রবীন্দ্র রচনাবলীর 'পারস্যে' ভ্রমণ কাহিনী থেকে সংকলিত]১১ এপ্রেল, ১৯৩২। দেশ থেকে বেরবার বয়স গেছে এইটেই স্থির করে বসেছিলুম। এমন সময় পারস্যরাজের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ এল। মনে হল এ নিমন্ত্রণ অস্বীকার করা অকর্তব্য হবে। তবু সত্তর বছরের ক্লান্ত শরীরের পক্ষ থেকে দ্বিধা ঘোচেনি। বোম্বাই থেকে আমার পারসী বন্ধু দিনশা ইরানী ভরসা দিয়ে লিখে পাঠালেন যে, পারস্যের বুশেয়ার বন্দর থেকে তিনিও হবেন আমার সঙ্গী। তা ছাড়া খবর দিলেন যে, বোম্বাইয়ের পারসিক কনসাল কেহান সাহেব পারসিক সরকারের পক্ষ থেকে আমার যাত্রার সাহচর্য ও ব্যবস্থার ভার পেয়েছেন।
এর পরে ভীরুতা করতে লজ্জা বোধ হল। রেলের পথ এবং পারস্য উপসাগর সেই গরমের সময় আমার উপযোগী হবে না বলে ওলন্দাজদের বায়ুপথের ডাকযোগে যাওয়াই স্থির হল। কথা রইল আমার শুশ্রূষার জন্যে বউমা যাবেন সঙ্গে, আর যাবেন কর্মসহায়রূপে কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ও অমিয় চক্রবর্তী। এক বায়ুযানে চারজনের জায়গা হবে না বলে কেদারনাথ এক সপ্তাহ আগেই শূন্যপথে রওনা হয়ে গেলেন।
পূর্বে আর-একবার এই পথের পরিচয় পেয়েছিলুম লণ্ডন থেকে প্যারিসে। কিন্তু সেখানে যে ধরাতল ছেড়ে উর্ধ্বে উঠেছিলুম তার সঙ্গে আমার বন্ধন ছিল আলগা। তার জল-স্থল আমাকে পিছুডাক দেয় না, তাই নোঙর তুলতে টানাটানি করতে হয় নি। এবারে বাংলাদেশের মাটির টান কাটিয়ে নিজেকে শূন্যে ভাসান দিলুম, হৃদয় সেটা অনুভব করলে।
কলকাতার বাহিরের পল্লীগ্রাম থেকে যখন বেরলুম তখন ভোরবেলা। তারাখচিত নিস্তব্ধ অন্ধকারের নীচে দিয়ে গঙ্গার স্রোত ছলছল করছে। বাগানের প্রাচীরের গায়ে সুপুরিগাছের ডাল দুলছে বাতাসে, লতাপাতা-ঝোপঝাপের বিমিশ্র নিশ্বাসে একটা শ্যামলতার গন্ধ আকাশে ঘনীভূত। নিদ্রিত গ্রামের আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ গলির মধ্য দিয়ে মোটর চলল। কোথাও-বা দাগ-ধরা পুরোনো পাকা দালান, তার খানিকটা বাসযোগ্য, খানিকটা ভেঙে-পড়া; আধা-শহুরে দোকানে দ্বার বন্ধ; শিবমন্দির জনশূন্য; এবড়ো-খেবড়ো পোড়ো জমি; পানাপুকুর; ঝোপঝাড়। পাখিদের বাসায় তখনো সাড়া পড়েনি, জোয়ার-ভাঁটার সন্ধিকালীন গঙ্গার মতো পল্লীর জীবনযাত্রা ভোরবেলাকার শেষ ঘুমের মধ্যে থমকে আছে।
গলির মোড়ে নিষুপ্ত বারান্দায় খাটিয়া-পাতা পুলিস-থানার পাশ দিয়ে মোটর পৌঁছল বড়ো রাস্তায়। অমনি নতুন কালের কড়া গন্ধ মেলে ধুলো জেগে উঠল, গাড়ির পেট্রোল-বাষ্পের সঙ্গে তার সগোত্র আত্মীয়তা। কেবল অন্ধকারের মধ্যে দুই সারি বনস্পতি পুঞ্জিত পল্লবস্তবকে প্রাচীনকালের নীরব সাক্ষ্য নিয়ে স্তম্ভিত; সেই যে কালে শতাব্দীপর্যায়ের মধ্যে দিয়ে বাংলার ছায়াস্নিগ্ধ অঙ্গনপার্শ্বে অতীত যুগের ইতিহাসধারা কখনো মন্দগম্ভীর গতিতে কখনো ঘূর্ণাবর্তসংকুল ফেনায়িত বেগে বয়ে চলেছিল। রাজপরম্পরার পদচিহ্নিত এই পথে কখনো পাঠান, কখনো মোগল, কখনো ভীষণ বর্গী, কখনো কোম্পানির সেপাই ধুলোর ভাষায় রাষ্ট্রপরিবর্তনের বার্তা ঘোষণা করে যাত্রা করেছে। তখন ছিল হাতি উট তাঞ্জাম ঘোড়সওয়ারদের অলংকৃত ঘোড়া; রাজপ্রতাপের সেই-সব বিচিত্র বাহন ধুলোর ধূসর অন্তরালে মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেছে। একমাত্র বাকি আছে সর্বজনের ভারবাহিনী করুণমন্থর গোরুর গাড়ি।
দমদমে উড়ো জাহাজের আড্ডা ঐ দেখা যায়। প্রকাণ্ড তার কোটর থেকে বিজলি বাতির আলো বিচ্ছুরিত। তখনো রয়েছে বৃহৎ মাঠজোড়া অন্ধকার। সেই প্রদোষের অষ্পষ্টতায় ছায়াশরীরীর মতো বন্ধুবান্ধব ও সংবাদপত্রের দূত জমে উঠতে লাগল। সময় হয়ে এল। ডানা ঘুরিয়ে, ধুলো উড়িয়ে, হাওয়া আলোড়িত করে ঘর্ঘর গর্জনে যন্ত্রপক্ষীরাজ তার গহ্বর থেকে বেরিয়ে পড়ল খোলা মাঠে। আমি, বউমা, অমিয় উপরে চড়ে বসলুম। ঢাকা রথ, দুই সারে তিনটে করে চামড়ার দোলা-ওয়ালা ছয়টি প্রশস্ত কেদারা, আর পায়ের কাছে আমাদের পথে-ব্যবহার্য সামগ্রীর হালকা বাক্স। পাশে কাঁচের জানলা।
ব্যোমতরী বাংলাদেশের উপর দিয়ে যতক্ষণ চলল ততক্ষণ ছিল মাটির কতকটা কাছাকাছি। পানাপুকুরের চারি ধারে সংসক্ত গ্রামগুলি ধূসর বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো দ্বীপের মতো খণ্ড খণ্ড চোখে পড়ে। উপর থেকে তাদের ছায়াঘনিষ্ঠ শ্যামল মূর্তি দেখা যায় ছাড়া-ছাড়া, কিন্তু বেশ বুঝতে পারি আসন্ন গ্রীষ্মে সমস্ত তৃষাসন্তপ্ত দেশের রসনা আজ শুষ্ক। নির্মল নিরাময় জলগণ্ডুষের জন্য ইন্দ্রদেবের খেয়ালের উপর ছাড়া আর-কারো 'পরে এই বহু কোটি লোকের যথোচিত ভরসা নেই।
মানুষ পশু পাখি কিছু যে পৃথিবীতে আছে সে আর লক্ষ্য হয় না। শব্দ নেই, গতি নেই, প্রাণ নেই; যেন জীববিধাতার পরিত্যক্ত পৃথিবী তালি-দেওয়া চাদরে ঢাকা। যত উপরে উঠছে ততই পৃথিবীর রূপবৈচিত্র্য কতকগুলি আঁচড়ে এসে ঠেকল। বিস্মৃতনামা প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিলিপি যেন অজ্ঞাত অক্ষরে কোনো মৃতদেশের প্রান্তর জুড়ে খোদিত হয়ে পড়ে আছে; তার রেখা দেখা যায়, অর্থ বোঝা যায় না।
প্রায় দশটা। এলাহাবাদের কাছাকাছি এসে বায়ুযান নামবার মুখে ঝুঁকল। ডাইনের জানলা দিয়ে দেখি নীচে কিছুই নেই, শুধু অতল নীলিমা, বাঁ দিকে আড় হয়ে উপরে উঠে আসছে ভূমিতলটা। খেচর-রথ মাটিতে ঠেকল এসে; এখানে সে চলে লাফাতে লাফাতে, ধাক্কা খেতে খেতে; অপ্রসন্ন পৃথিবীর সম্মতি সে পায় না যেন।
শহর থেকে জায়গাটা দূরে। চার দিকে ধূ ধূ করছে। রৌদ্রতপ্ত বিরস পৃথিবী। নামবার ইচ্ছা হল না। কোম্পানির একজন ভারতীয় ও একজন ইংরেজ কর্মচারী আমার ফোটো তুলে নিলে। তার পরে খাতায় দু-চার লাইন স্বাক্ষরের দাবি করল যখন, আমার হাসি পেল। আমার মনের মধ্যে তখন শঙ্করাচার্যের মোহমুদ্গরের শ্লোক গুঞ্জরিত। ঊর্ধ্ব থেকে এই কিছু আগেই চোখে পড়েছে নির্জীব ধুলিপটের উপর অদৃশ্য জীবলোকের গোটাকতক স্বাক্ষরের আঁচড়। যেন ভাবী যুগাবসানের প্রতিবিম্ব পিছন ফিরে বর্তমানের উপর এসে পড়েছে। যে ছবিটা দেখলেম সে একটা বিপুল রিক্ততা; কালের সমস্ত দলিল অবলুপ্ত; স্বয়ং ইতিবৃত্তবিৎ চিরকালের ছুটিতে অনুপস্থিত; রিসার্চ্-বিভাগের ভিতটা-সুদ্ধ তলিয়ে গেছে মাটির নীচে।
এইখানে যন্ত্রটা পেট ভরে তৈল পান করে নিলে। আধঘন্টা থেমে আবার আকাশযাত্রা শুরু। এতক্ষণ পর্যন্ত রথের নাড়া তেমন অনুভব করি নি, ছিল কেবল তার পাখার দুঃসহ গর্জন। দুই কানে তুলো লাগিয়ে জানলা দিয়ে চেয়ে দেখছিলুম। সামনের কেদারায় ছিলেন একজন দিনেমার, ইনি ম্যানিলা দ্বীপে আখের খেতের তদারক করেন, এখন চলেছেন স্বদেশে। গুটানো ম্যাপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যাত্রাপথের পরিচয় নিচ্ছেন; ক্ষণে ক্ষণে চলছে চীজ রুটি, চকোলেটের মিষ্টান্ন, খনিজাত পানীয় জল। কলকাতা থেকে বহুবিধ খবরের কাগজ সংগ্রহ করে এনেছেন, আগাগোড়া তাই তন্ন তন্ন করে পড়ছেন একটার পর একটা। যাত্রীদের মধ্যে আলাপের সম্বন্ধ রইল না। যন্ত্রহুংকারের তুফানে কথাবার্তা যায় তলিয়ে। এক কোণে বেতারবার্তিক কানে ঠুলি লাগিয়ে কখনো কাজে কখনো ঘুমে কখনো পাঠে মগ্ন। বাকি তিনজন পালাক্রমে তরী-চালনায় নিযুক্ত, মাঝে মাঝে যাত্রার দফ্তর লেখা, কিছু-বা আহার, কিছু-বা তন্দ্রা। ক্ষুদ্র এক টুকরো সজনতা নীচের পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ে উড়ে চলেছে অসীম জনশূন্যতায়।
জাহাজ ক্রমে উর্ধ্বতর আকাশে চড়ছে, হাওয়া চঞ্চল, তরী টলোমলো। ক্রমে বেশ একটু শীত করে এল। নীচে পাথুরে পৃথিবী, রাজপুতানার কঠিন বন্ধুরতা শুষ্ক স্রোতঃপথের শীর্ণ রেখাজালে অঙ্কিত, যেন গেরুয়া-পরা বিধবাভূমির নির্জলা একাদশীর চেহারা।
অবশেষে অপরাহ্নে দূর থেকে দেখা গেল রুক্ষ মরুভূমির পাংশুল বক্ষে যোধপুর শহর। আর তারই প্রান্তরে যন্ত্রপাখির হাঁ-করা প্রকাণ্ড নীড়। নেমে দেখি এখানকার সচিব কুন্বার মহারাজ সিং সস্ত্রীক আমাদের অভ্যর্থনার জন্য উপস্থিত, তখনই নিয়ে যাবেন তাঁদের ওখানে চা-জলযোগের আমন্ত্রণে। শরীরের তখন প্রাণধারণের উপযুক্ত শক্তি কিছু ছিল, কিন্তু সামাজিকতার উপযোগী উদ্বৃত্ত ছিল না বললেই হয়। কষ্টে কর্তব্য সেরে হোটেলে এলুম।
হোটেলটি বায়ুতরীযাত্রীর জন্যে মহারাজের প্রতিষ্ঠিত। সন্ধ্যাবেলায় তিনি দেখা করতে এলেন। তাঁর সহজ সৌজন্য রাজোচিত। মহারাজ স্বয়ং উড়োজাহাজ-চালনায় সুদক্ষ। তার যতরকম দুঃসাহসী কৌশল আছে প্রায় সমস্তই তাঁর অভ্যস্ত!
পরের দিন ১২ই এপ্রেল ভোর রাত্রে জাহাজে উঠতে হল। হাওয়ার গতিক পূর্বদিনের চেয়ে ভালোই। অপেক্ষাকৃত সুস্থ শরীরে মধ্যাহ্নে করাচিতে পুরবাসীদের আদর-অভ্যর্থনার মধ্যে গিয়ে পৌঁছনো গেল। সেখানে বাঙালি গৃহলক্ষ্মীর সযত্নপক্ক অন্ন ভোগ করে আধ ঘন্টার মধ্যে জাহাজে উঠে পড়লুম।
সমুদ্রের ধার দিয়ে উড়ছে জাহাজ। বাঁ দিকে নীল জল, দক্ষিণে পাহাড়ে মরুভূমি। যাত্রার শেষ অংশে বাতাস মেতে উঠল। ডাঙায় বাতাসের চাঞ্চল্য নানা পদার্থের উপর আপন পরিচয় দেয়। এখানে তার একমাত্র প্রমাণ জাহাজটার ধড়্ফড়ানি। বহুদূর নীচে সমুদ্রে ফেনার সাদা রেখায় একটু একটু তুলির পোঁচ দিচ্ছে। তার না শুনি গর্জন, না দেখি তরঙ্গের উত্তালতা। এইবার মরুদ্বার দিয়ে পারস্যে প্রবেশ। বুশেয়ার থেকে সেখানকার গবর্নর বেতারে দূরলিপিযোগে অভ্যর্থনা পাঠিয়েছেন। করাচি থেকে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যোমতরী জাস্কে পৌঁছল। সমুদ্রতীরে মরুভূমিতে এই সামান্য গ্রামটি। কাদায় তৈরি গোটাকতক চৌকো চ্যাপটা-ছাদের ছোটো ছোটো বাড়ি ইতস্ততবিক্ষিপ্ত, যেন মাটির সিন্দুক।
আকাশযাত্রীদের পান্থশালায় আশ্রয় নিলুম। রিক্ত এই ভূখণ্ডে নীলাম্বুচুম্বিত বালুরাশির মধ্যে বৈচিত্র্যসম্পদ কিছুই নেই। সেইজন্যেই বুঝি গোধূলিবেলায় দিগঙ্গনার স্নেহ দেখলুম এই গরিব মাটির 'পরে। কী সুগম্ভীর সূর্যাস্ত কী তার দীপ্যমান শান্তি, পরিব্যাপ্ত মহিমা। স্নান করে এসে বারান্দায় বসলুম, স্নিগ্ধ বসন্তের হাওয়া ক্লান্ত শরীরকে নিবিড় আরামে বেষ্টন করে ধরলে।
এখানকার রাজকর্মচারীর দল সম্মানসম্ভাষণের জন্যে এলেন। বাইরে বালুতটে আমাদের চৌকি পড়েছে। যে দুই-একজন ইংরেজি জানেন তাঁদের সঙ্গে কথা হল। বোঝা গেল পুরাতনের খোলস বিদীর্ণ করে পারস্য আজ নূতন প্রাণের পালা আরম্ভ করতে প্রস্তুত। প্রাচ্য জাতির মধ্যে যেখানে জাগরণের চাঞ্চল্য সেখানে এই একই ভাব। অতীতের আবর্জনামুক্ত সমাজ, সংস্কারমুক্ত চিত্ত, বাধামুক্ত মানবসম্বন্ধের ব্যাপ্তি, বাস্তব জগতের প্রতি মোহমুক্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি, এই তাদের সাধনার প্রধান লক্ষ্য। তারা জানে, হয় বর্তমান কালের শিক্ষা নয় তার সাংঘাতিক আঘাত আমাদের গ্রহণ করতে হবে। অতীত কালের সঙ্গে যাদের দুশ্ছেদ্য গ্রন্থিবন্ধনের জটিলতা, মৃত যুগের সঙ্গে আজ তাদের সহমরণের আয়োজন।
এখানে পরধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি কিরকম ব্যবহার, এই প্রশ্নের উত্তরে শুনলুম, পূর্বকালে জরথুস্ত্রীয় ও বাহাইদের প্রতি অত্যাচার ও অবমাননা ছিল। বর্তমান রাজার শাসনে পরধর্মমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দূর হয়ে গেছে; সকলেই ভোগ করছে সমান অধিকার, ধর্মহিংস্রতার নররক্তপঙ্কিল বিভীষিকা কোথাও নেই। ডাক্তার মহম্মদ ইসা খাঁ সাদিকের রচিত আধুনিক পারস্যের শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধীয় গ্রন্থে লিখিত আছে--অনতিকাল পূর্বে ধর্মযাজকমণ্ডলীর প্রভাব পারস্যকে অভিভূত করে রেখেছিল। আধুনিক বিদ্যাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রভাবের প্রবলতা কমে এল। এর পূর্বে নানা শ্রেণীর অসংখ্য লোক, কেউ-বা ধর্মবিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউ-বা ধর্মপ্রচারক, কোরানপাঠক, সৈয়দ--এরা সকলেই মোল্লাদের মতো পাগড়ি ও সাজসজ্জা ধারণ করত। যখন দেশের প্রধানবর্গের অধিকাংশ লোক আধুনিক প্রণালীতে শিক্ষিত হলেন তখন থেকে বিষয়বুদ্ধিপ্রবীণ পুরোহিতদের ব্যবসায় সংকুচিত হয়ে এল। এখন যে খুশি মোল্লার বেশ ধরতে পারে না। বিশেষ পরীক্ষা পাস করে অথবা প্রকৃত ধার্মিক ও ধর্মশাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতের সম্মতি-অনুসারে তবেই এই সাজ-ধারণের অধিকার পাওয়া যায়। এই আইনের তাড়নায় শতকরা নব্বই সংখ্যক মানুষের মোল্লার বেশ ঘুচে গেছে। লেখক বলেন :
Such were the results of the contact of Persia with the Western world. They could not have been attained without the leadership of Reza Shah Pehlevi, the greatest man that Persia has produced for many centuries.
অন্তত একবার কল্পনা করে দেখতে দোষ নেই যে, হিন্দুভারতে যত অসংখ্য পাণ্ডা পুরোহিত ও সন্ন্যাসী আছে কোনো নূতন আইনে তাদের উপাধি-পরীক্ষা পাস আবশ্যিক বলে গণ্য হয়েছে। কে যথার্থ সাধু বা সন্ন্যাসী কোনো পরীক্ষার দ্বারা তার প্রমাণ হয় না স্বীকার করি। কিন্তু স্বেচ্ছাগৃহীত উপাধি ও বাহ্য বেশের দ্বারা তার প্রমাণ আরো অসম্ভব। অথচ সেই নিরর্থক প্রমাণ দেশ স্বীকার করে নিয়েছে। কেবলমাত্র অপরীক্ষিত সাজের ও অনায়াসলব্ধ নামের প্রভাবে ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ লোকের মাথা নত হচ্ছে বিনা বিচারে এবং উপবাসপীড়িত দেশের অন্নমুষ্টি অনায়াসে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, যার পরিবর্তে অধিকাংশ স্থলে আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কোনো প্রতিদান নেই। সাধুতা ও সন্ন্যাস যদি নিজের আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য হয় তা হলে সাজ পরবার বা নাম নেবার দরকার নেই, এমন-কি, নিলে ক্ষতির কারণ আছে; যদি অন্যের জন্য হয় তা হলে যথোচিত পরীক্ষা দেওয়া উচিত। ধর্মকে যদি জীবিকা, এমন-কি লোকমান্যতার বিষয় করা যায়, যদি বিশেষ বেশ বা বিশেষ ব্যবহারের দ্বারা ধার্মিকতার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তবে সেই বিজ্ঞাপনের সত্যতা বিচার করবার অধিকার আত্মসম্মানের জন্য সমাজের গ্রহণ করা কর্তব্য এ কথা মানতেই হবে।
পরদিন তিনটে-রাত্রে উঠতে হল, চারটের সময় যাত্রা। ১৩ই এপ্রেল তারিখে সকাল সাড়ে-আটটার সময় বুশেয়ারে পৌঁছনো গেল।
বুশেয়ারের গবর্নর আমাদের আতিথ্যভার নিয়েছেন। যত্নের সীমা নেই। মাটির মানুষের সঙ্গে আকাশের অন্তরঙ্গ পরিচয় হল, মনটা কী বললে এই অবকাশে লিখে রাখি।
ছেলেবেলা থেকে আকাশে যে-সব জীবকে দেখেছি তার প্রধান লক্ষণ গতির অবলীলতা। তাদের ডানার সঙ্গে বাতাসের মৈত্রীর মাধুর্য। মনে পড়ে ছাদের ঘর থেকে দুপুর-রৌদ্রে চিলের ওড়া চেয়ে চেয়ে দেখতেম; মনে হত দরকার আছে বলে উড়ছে না, বাতাসে যেন তার অবাধ গতির অধিকার আনন্দবিস্তার করে চলেছে। সেই আনন্দের প্রকাশ কেবল যে পাখার গতিসৌন্দর্যে তা নয়, তার রূপসৌন্দর্যে। নৌকোর পালটাকে বাতাসের মেজাজের সঙ্গে মানান রেখে চলতে হয়, সেই ছন্দ রাখবার খাতিরে পাল দেখতে হয়েছে সুন্দর। পাখির পাখাও বাতাসের সঙ্গে মিল করে চলে, তাই এমন তার সুষমা। আবার সেই পাখায় রঙের সামঞ্জস্যও কত। এই তো হল প্রাণীর কথা, তার পরে মেঘের লীলা-- সূর্যের আলো থেকে কত রকম রঙ ছেঁকে নিয়ে আকাশে বানায় খেয়ালের খেলাঘর! মাটির পৃথিবীতে চলায় ফেরায় দ্বন্দ্বের চেহারা, সেখানে ভারের রাজত্ব, সকল কাজেই বোঝা ঠেলতে হয়। বায়ুলোকে এতকাল যা আমাদের মন ভুলিয়েছে সে হচ্ছে ভারের অভাব, সুন্দরের সহজ সঞ্চরণ।
এতদিন পরে মানুষ পৃথিবী থেকে ভারটাকে নিয়ে গেল আকাশে। তাই তার ওড়ার যে চেহারা বেরল সে জোরের চেহারা। তার চলা বাতাসের সঙ্গে মিল করে নয়, বাতাসকে পীড়িত করে; এই পীড়া ভূলোক থেকে আজ গেল দ্যুলোকে। এই পীড়ায় পাখির গান নেই, জন্তুর গর্জন আছে। ভূমিতল আকাশকে জয় করে আজ চিৎকার করছে।
সূর্য উঠল দিগন্তরেখার উপরে। উদ্ধত যন্ত্রটা অরুণরাগের সঙ্গে আপন মিল করবার চেষ্টামাত্র করে নি। আকাশনীলিমার সঙ্গে ওর অসবর্ণতা বেসুরো, অন্তরীক্ষের রঙমহলে মেঘের সঙ্গে ওর অমানান রয়ে গেল। আধুনিক যুগের দূত, ওর সেণ্টিমেণ্টের বালাই নেই; শোভাকে ও অবজ্ঞা করে; অনাবশ্যককে কনুইয়ের ধাক্কা মেরে চলে যায়। যখন পূর্বদিগন্ত রাঙা হয়ে উঠল, পশ্চিমদিগন্তে যখন কোমল নীলের উপর শুক্তিশুভ্র আলো, তখন তার মধ্য দিয়ে ঐ যন্ত্রটা প্রকাণ্ড একটা কালো তেলাপোকার মতো ভন্ ভন্ করে উড়ে চলল।
বায়ুতরী যতই উপরে উঠল ততই ধরণীর সঙ্গে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যোগ সংকীর্ণ হয়ে একটা মাত্র ইন্দ্রিয়ে এসে ঠেকল, দর্শন-ইন্দ্রিয়ে, তাও ঘনিষ্ঠভাবে নয়। নানা সাক্ষ্য মিলিয়ে যে পৃথিবীকে বিচিত্র ও নিশ্চিত করে জেনেছিলুম সে ক্রমে এল ক্ষীণ হয়ে, যা ছিল তিন আয়তনের বাস্তব তা হয়ে এল দুই আয়তনের ছবি। সংহত দেশকালের বিশেষ বিশেষ কাঠামোর মধ্যেই সৃষ্টির বিশেষ বিশেষ রূপ। তার সীমানা যতই অনির্দিষ্ট হতে থাকে, সৃষ্টি ততই চলে বিলীনতার দিকে। সেই বিলয়ের ভূমিকার মধ্যে দেখা গেল পৃথিবীকে, তার সত্তা হল অস্পষ্ট, মনের উপর তার অস্তিত্বের দাবি এল কমে। মনে হল, এমন অবস্থায় আকাশযানের থেকে মানুষ যখন শতঘ্নী বর্ষণ করতে বেরয় তখন সে নির্মমভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে; যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না, কেননা, হিসাবের অঙ্কটা অদৃশ্য হয়ে যায়। যে বাস্তবের 'পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে। গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়ো জাহাজ--অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর। বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক তত্ত্বনির্মিত উড়ো জাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে। সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্ত্বনাবাক্য এই যে, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।
বোগদাদে ব্রিটিশদের আকাশফৌজ আছে। সেই ফৌজের খ্রীস্টান ধর্মযাজক আমাকে খবর দিলেন, এখানকার কোন্ শেখদের গ্রামে তাঁরা প্রতিদিন বোমা বর্ষণ করছেন। সেখানে আবালবৃদ্ধবনিতা যারা মরছে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঊর্ধ্বলোক থেকে মার খাচ্ছে; এই সাম্রাজ্যনীতি ব্যক্তিবিশেষের সত্তাকে অস্পষ্ট করে দেয় বলেই তাদের মারা এত সহজ। খ্রীস্ট এই-সব মানুষকেও পিতার সন্তান বলে স্বীকার করেছেন, কিন্তু খ্রীস্টান ধর্মযাজকের কাছে সেই পিতা এবং তাঁর সন্তান হয়েছে অবাস্তব, তাঁদের সাম্রাজ্যতত্ত্বের উড়ো জাহাজ থেকে চেনা গেল না তাদের, সেইজন্যে সাম্রাজ্য জুড়ে আজ মার পড়ছে সেই খ্রীস্টেরই বুকে। তা ছাড়া উড়ো জাহাজ থেকে এই-সব মরুচারীদের মারা যায় এত অত্যন্ত সহজে, ফিরে মার খাওয়ার আশঙ্কা এতই কম, মারের বাস্তবতা তাতেও ক্ষীণ হয়ে আসে। যাদের অতি নিরাপদে মারা সম্ভব মারওয়ালাদের কাছে তারা যথেষ্ট প্রতীয়মান নয়। এই কারণে, পাশ্চাত্য হননবিদ্যা যারা জানে না তাদের মানবসত্তা আজ পশ্চিমের অস্ত্রীদের কাছে ক্রমশই অত্যন্ত ঝাপসা হয়ে আসছে।
ইরাক বায়ুফৌজের ধর্মযাজক তাঁদের বায়ু-অভিযানের তরফ থেকে আমার কাছে বাণী চাইলেন, আমি যে বাণী পাঠালুম সেইটে এইখানে প্রকাশ করা যাক।
From the beginning of our days man has imagined the seat of divinity in the upper air from which comes light and blows the breath of life for all creatures on this earth. The peace of its dawn, the splendour of its sunset, the voice of eternity in its starry silence have inspired countless generations of men with an ineffable presence of the infinite urging their minds away from the sordid interests of daily life. Man has accepted this dust-laden earth for his dwelling place, for the enacting of the drama of his tangled life ever waiting for a call of perfection from the boundless depth of purity surrounding him in a translucent atmosphere. If in an evil moment man's cruel history should spread its black wings to invade that realm of divine dreams with its cannibalistic greed and fratricidal ferocity then God's curse will certainly descend upon us for that hideous desecration and the last curtain will be rung down upon the world of Man for whom God feels ashamed.
নিকটের থেকে আমাদের চোখ যতটা দূরকে একদৃষ্টিতে দেখতে পায়, উপরের থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক দেশকে দেখে। এইজন্যে বায়ুতরী যখন মিনিটে প্রায় এক ক্রোশ বেগে ছুটছে তখন নীচের দিকে তাকিয়ে মনে হয় না তার চলন এত দ্রুত। বহু দূরত্ব আমাদের চোখে সংহত হয়ে ছোটো হয়ে গেছে বলেই সময়পরিমাণও আমাদের মনে ঠিক থাকল না। দুইয়ে মিলে আমাদের কাছে বাস্তবের যে প্রতীতি জন্মাচ্ছে সেটা আমাদের সহজ বোধের থেকে অনেক তফাত। জগতের এই যন্ত্র পরিমাপ যদি আমাদের জীবনের সহজ পরিমাপ হত তা হলে আমরা একটা ভিন্ন জগতে বাস করতুম। তাই ভাবছিলুম সৃষ্টিটা ছন্দের লীলা। যে তালের লয়ে আমরা এই জগৎকে অনুভব করি সেই লয়টাকে দুনের দিকে বিলম্বিতের দিকে বদলে দিলেই সেটা আর-এক সৃষ্টি হবে। অসংখ্য অদৃশ্য রশ্মিতে আমরা বেষ্টিত। আমাদের স্নায়ুস্পন্দনের ছন্দ তাদের স্পন্দনের ছন্দের সঙ্গে তাল রাখতে পারে না বলে তারা আমাদের অগোচর। কী করে বলব এই মুহূর্তেই আমাদের চার দিকে ভিন্ন লয়ের এমন অসংখ্য জগৎ নেই যারা পরস্পরের অপ্রত্যক্ষ। সেখানকার মন আপন বোধের ছন্দ অনুসারে যা দেখে যা জানে যা পায় সে আমাদের পক্ষে সম্পূর্ণ অগম্য, বিভিন্ন মনের যন্ত্রে বিভিন্ন বিশ্বের বাণী একসঙ্গে উদ্ভূত হচ্ছে সীমাহীন অজানার অভিমুখে।
এই ব্যোমবাহনে চড়ে মনের মধ্যে একটা সংকোচ বোধ না করে থাকতে পারি নে। অতি আশ্চর্য এ যন্ত্র, এর সঙ্গে আমার ভোগের যোগ আছে, কিন্তু শক্তির যোগ নেই। বিমানের কথা শাস্ত্রে লেখে-- সে ছিল ইন্দ্রলোকের, মর্তের দুষ্যন্তেরা মাঝে মাঝে নিমন্ত্রিত হয়ে অন্তরীক্ষে পাড়ি দিতেন-- আমারও সেই দশা। এ কালের বিমান যারা বানিয়েছে তারা আর-এক জাত। শুধু যদি বুদ্ধির জোর এতে প্রকাশ হত তা হলে কথা ছিল না। কিন্তু চরিত্রের জোর-- সেটাই সব-চেয়ে শ্লাঘনীয়। এর পিছনে দুর্দম সাহস, অপরাজেয় অধ্যবসায়। কত ব্যর্থতা, কত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একে ক্রমে সম্পূর্ণ করে তুলতে হচ্ছে, তবু এরা পরাভব মানছে না। এখানে সেলাম করতেই হবে।
এই ব্যোমতরীর চারজন ওলন্দাজ নাবিকের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখি। বিপুল বপু, মোটা মোটা হাড়, মূর্তিমান উদ্যম। যে আবহাওয়ায় এদের জন্ম সে এদের প্রতিক্ষণে জীর্ণ করে নি, তাজা রেখে দিয়েছে। মজ্জাগত স্বাস্থ্য ও তেজ কোনো একঘেয়ে বাঁধা ঘাটে এদের স্থির থাকতে দিল না। বহু পুরুষ ধরে প্রভূত বলদায়ী অন্নে এরা পুষ্ট, বহু যুগের সঞ্চিত প্রচুর উদ্বৃত্ত এদের শক্তি। ভারতবর্ষে কোটি কোটি মানুষ পুরো পরিমাণ অন্ন পায় না। অভুক্তশরীর বংশানুক্রমে অন্তরে-বাহিরে সকল রকম শত্রুকে মাশুল দিয়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত। মনে প্রাণে সাধনা করে তবেই সম্ভব হয় সিদ্ধি, কিন্তু আমাদের মন যদি-বা থাকে প্রাণ কই? উপবাসে ক্লান্তপ্রাণ শরীর কাজ ফাঁকি না দিয়ে থাকতে পারে না, সেই ফাঁকি সমস্ত জাতের মজ্জায় ঢুকে তাকে মারতে থাকে। আজ পশ্চিম মহাদেশে অন্নাভাবের সমস্যা মেটাবার দুশ্চিন্তায় রাজকোষ থেকে টাকা ঢেলে দিচ্ছে। কেননা, পর্যাপ্ত অন্নের জোরেই সভ্যতার আন্তরিক বাহ্যিক সব রকম কল পুরোদমে চলে। আমাদের দেশে সেই অন্নের চিন্তা ব্যক্তিগত, সে চিন্তার শুধু যে জোর নেই তা নয়, সে বাধাগ্রস্ত। ওদের দেশে সে চিন্তা রাষ্ট্রগত, সে দিকে সমস্ত জাতির সাধনার পথ স্বাধীনভাবে উন্মুক্ত, এমন-কি, নিষ্ঠুর অন্যায়ের সাহায্য নিতেও দ্বিধা নেই। ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তার দৃষ্টি হতে আমরা বহু দূরে, তাই আমাদের পক্ষে শাসন যত অজস্র সুলভ অশন তত নয়।
এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল, এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারে নি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল আজ, কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।
Tuesday, December 19, 2023
রাজনীতির কাঁচামাল - ক্রমশ........
সময়কে চিনতে না পারা মানুষের অন্যতম বড় ব্যর্থতা। বাংলার মানুষ প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। একদল অতিবড় ধূর্ত, অন্যদল অতি মহাসরল। এর মাঝামাঝি কিছু আছে যারা দুই নৌকাতে পা রাখতে পারদর্শী। তারা বিচক্ষণ বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক তোষক। ধূর্তদের সংখ্যা যদি ৫ জন হয়, সরল মানুষের সংখ্যা হবে ৮০ জন। বাকী ১৫ জনের মধ্যে আছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী, বিচক্ষণ বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিক তোষক যারা সময়মতো পল্টি দিতে পারে। যারা ধূর্ত তারা দেশ শাসন করে। ধূর্তরা শক্তিশালী হয়। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের সামনে মুলা ঝুলিয়ে দিনের পর দিন ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করে। এরাও জানে পতন অনিবার্য। কিন্তু সেই অনিবার্য পতন ঠেকিয়ে রাখার জন্য দিনের পর দিন নতুন নতুন ফন্দী ফিকির করে। ভারতবর্ষ কিংবা বঙ্গদেশের অধিকাংশ ইতিহাস ধূর্ততার ইতিহাস। ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। যুগ যুগ ধরে এর মধ্য দিয়ে টিকে আছে ওই ৮০ জন বোকা মানুষ।
সাধারণ মানুষের অংশ হিসেবে আমার দায়িত্ব কী? আমি যাদের সমর্থন করি তাদের সকল অন্যায়কেও সমর্থন করে যাওয়া? সেটা তো নির্বোধের কাজ। আমার বাবা মা ভাই বোন কিংবা আমার সন্তানেরা আমার খুব আপনজন। কিন্তু তাদের যে কোনও অন্যায় আচরণকে আমি সমর্থন করে যাবো? আপনজনের স্বার্থ রাখতে গিয়ে আমরা গোটা জাতির ক্ষতি করি। এই অঞ্চলে শত শত বছর ধরে এমন অন্যায় কাণ্ড চলে আসছে বলে পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাদপদ একটা রাষ্ট্র হিসেবে বেড়ে উঠেছে দেশটা। এখানে আমরা প্রিয়জনের অন্যায়কে প্রশ্রয়ের চোখে দেখি। আমাদের চশমাটা প্রায়ই ভুল থাকে। ভুল চশমা পরে আমরা ন্যায় অন্যায় পক্ষপাতিত্ব বিচার করি। অন্ধতার ভিত্তিতে রায় দেই। ফলে একটা অন্যায় যুগ শেষ হবার পর আরেকটা অন্যায় যুগ আসে। আমরা যুগ যুগ ধরে অন্যায় রাজত্বে বসবাস করতে করতে কখনো শিখতে পারিনি, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। যদি আমি ক্ষমতাবান হই, তখন ভালোমন্দ বিচার করতে পারে এমন লোকদের আমরা কোণঠাসা করে রাখার দায়িত্বও পালন করি।
এখন একটা অন্যায় চলছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি। ক্ষমতার চাপে আমাদের অনেকে সত্য বলছে না। কিন্তু যখন ক্ষমতার বাটি উল্টে যাবে তখন আমরা বলবো, আমি আগেই জানতাম এরা ভুল করেছে। এখন যারা ক্ষমতার স্বার্থে জিব নাড়ছে, তখন তাদের জিব অসাড় হয়ে যাবে। অন্যদলের অন্যায় নিয়ে তখন সরব হবে এরাই। যে অন্যায়কে একসময় সমর্থন করেছিল, সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ানোর আন্দোলন করবে। এদেশে যুগ যুগ ধরে এই দুষ্টচক্রটা টিকে আছে। টিকে থাকবে ওই ১৫ জনের নির্বুদ্ধিতার জন্য। চালাকির জন্য। ধূর্ততার জন্য। মূর্খতার জন্য।
আধুনিক পৃথিবীতে রাজনীতির স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান হলো নিরীহ মানুষের লাশ। কোন পক্ষ না হয়েও বিনা কারণে, নিজের অজান্তে মরে যাওয়া মানুষের লাশ রাজনৈতিক ক্ষমতায় ওঠা নামার কাঁচামাল হিসেবে জনপ্রিয়। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, বাংলাদেশ কোথাও ব্যতিক্রম নেই।
আমরা সময়কে চিনতে পারছি না। আমরা অচেনা সময়ের মুখোমুখি হবো শিগগির।
[আপডেট: ১৫.৭.২৪]
Sunday, December 17, 2023
সুখের নাম 'স্মৃতির সেভিংস ব্যাংক'
কতবার কত আনন্দের ঘটনা ঘটেছে আমাদের জীবনে, কিছু মনে আছে,কিছু ভুলে গেছি। ভুলে যাওয়া ঘটনাগুলো কেউ মনে করিয়ে দিলে স্মৃতিতে ফিরে আসে। সেই আনন্দস্মৃতিগুলো সেলুলয়েডের ফিতায় বারবার চালিয়ে পুরোনো আনন্দের নির্ঝাস আবারো উদ্ধার করা যায়। আনন্দের মুহূর্তগুলো স্মৃতির গাড়িতে চড়ে আবারো উপভোগ করা যায়। মানুষ এভাবেই সুখী হতে পারে অনেকবার। কিন্তু আমাদের অধিকাংশই সুখী হতে পারি না কারণ প্রতিবার আমরা নতুন নতুন আনন্দের ঘটনার খোঁজ করি। নতুন আনন্দ সবসময় পাওয়া সম্ভব নয়। তাই পুরোনো আনন্দের ঘটনা থেকে আমাদের সুখ খুঁজে নিতে হবে। আনন্দের ঘটনার চর্বিতচর্বনও আনন্দদায়ক। শৈশব থেকে সেরকম আনন্দের কত ঘটনা আমাদের মগজের ভেতর লুকিয়ে আছে। সেইসব ঘটনার চর্বিত চর্বন করে পঞ্চাশ বছর বয়সী একজন মানুষ নতুন কোন সুখের ঘটনা ছাড়াও তার বাকী জীবন কাটিয়ে দিতে পারে অনায়াসে। এইসব সুখের নাম স্মৃতির সেভিংস ব্যাংক।
[বলাবাহুল্য, এটা শুধু গড়পড়তা সুখী লোকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যারা জীবনের অধিকাংশ সময় দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পার করেছেন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।]
Wednesday, December 13, 2023
স্মৃতিস্মারক
আমার অসংখ্য স্মৃতিস্মারক ঘরের আনাচে কানাচে, বুকশেলফে, শোকেসে, আলমারীতে ছড়িয়ে আছে। জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার স্মৃতি জড়িত প্রতিটি জিনিসের সাথে। নিয়মিত মুছে মুছে সেই স্মারকগুলো আগলে রেখেছি যুগ যুগ ধরে। গত চল্লিশ বছরের সঞ্চয়। একদিন এইসব স্মারকের ওপর ধুলো জমতে জমতে অন্ধকার হয়ে যাবে। আমার মতো করে সেগুলো আর কেউ ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করবে না। কারণ ওই জিনিসগুলোর মধ্যে যে স্মৃতির যত্ন সেটা আমার একারই ছিল। আর কেউ সেটা জানে না। ওরা শুধু প্রচ্ছদ দেখবে।
প্রচ্ছদ দেখে একটা বইয়ের কতটা আর বোঝা যায়?
Tuesday, December 12, 2023
চাঁটগাইয়া ভাষার মিল অমিল
Saturday, December 2, 2023
স্মার্ট ফোনের জনক এবং নতুন শিক্ষা পদ্ধতি
স্টিভ জবসকে সবাই স্মার্ট ফোনের জনক হিসেবে চিনলেও সেটা পুরোপুরি সঠিক নয়। স্মার্ট ফোনের জনক হলেন মার্ক পোরাট। ১৯৯৩ সালে মার্ক পোরাট যখন স্মার্ট ফোনের ডিজাইন করেন তখন পৃথিবী সেই প্রযুক্তি গ্রহন করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তাঁর পরিকল্পনার সাথে সনি, মোটোরোলা, ফিলিপসের মতো কোম্পানি যুক্ত থেকেও সেই প্রযুক্তি বাজারে চালু করতে পারেননি। মার্ক পোরাট দেউলিয়া হয়ে সব ছেড়ে একটা নির্জন দ্বীপে বনবাসে চলে গিয়েছিলেন। দেড় দশক পর স্টিভ জবস মার্ক পোরাটের সেই অসমাপ্ত কাজটা নতুন করে শুরু করে বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রযুক্তি ব্যবসায়ী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। তখন থেকে আমরা স্টিভ জবসকে স্মার্ট ফোনের জনক হিসেবে চিনি।
মার্ক পোরাট কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন, স্টিভ জবস কেন সফল হয়েছিলেন?
উত্তর হলো - সময়। মার্ক পোরাট যখন ওই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন তখনো ইন্টারনেট চালু হয়নি বিশ্বব্যাপী। পৃথিবী চলতো এনালগ প্রযুক্তিতে। ইন্টারনেট ছাড়া ওই প্রযুক্তি অচল। স্টিভ জবস যখন মাঠে নামলেন, তখন পৃথিবীতে ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়্যারলেস প্রযুক্তি সবার হাতে হাতে। বিশ্বব্যাপী প্রয়োজনীয় সকল অবকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। মার্ক পোরাটের ব্যর্থ স্বপ্নটাকে তাই সফলতায় রূপান্তর করতে পেরেছিলেন স্টিভ জবস।
আমাদের নতুন শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যে বিতর্কটা চলমান, সেটার ক্ষেত্রেও এই উদাহরন প্রযোজ্য। আইডিয়াটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো। কিন্তু মুশকিল হলো আমরা এইরকম একটা ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য প্রস্তুত কিনা। আমার মনে হয়, আমরা প্রস্তুত নই। আমাদের দেশ এই ব্যবস্থা গ্রহন করার মতো উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের দেশে স্কুল কলেজের যে মৌলিক অবকাঠামো, সেটা ন্যূনতম মানও অর্জন করেনি। গ্রামের কথা বাদই দিলাম, আমাদের চট্টগ্রাম শহরে কয়টা স্কুল আছে যেটাকে আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার মতো অবকাঠামো আছে? দুয়েকটা প্রাইভেট স্কুল বাদে বাকী ৯৯ ভাগ স্কুলের যথেষ্ট শিক্ষক, ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি কিছুই নেই। যেসব শিক্ষক আছে তাদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই।
এখন হুট করে কিছু ভাল ভাল বই ছাপিয়ে যদি রাতারাতি শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে দেবার স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্নটা সফল হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না।
দুঃখজনক হলেও এটা অপ্রিয় একটা বাস্তবতা হলো আমাদের শহরে গত পঞ্চাশ বছর আগে যেসব স্কুল ছিল তার বাইরে আর পাঁচটাও স্কুল হয়নি। কলেজ হয়নি। আমরা যেসব স্কুলে পড়েছি সেসব স্কুলেই আমাদের ছেলেমেয়েরা দুই তিন শিফট করে ঠেলাঠেলি করে পড়ছে। কিছু কিছু স্কুলে আবার জোর করে কলেজও ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এই যে অবকাঠামোগত কোন উন্নতি হলো না, তার জন্য দায়ী কে? উত্তর নিশ্চয়ই সবার জানা।
তাহলে কী করতে হবে? অযথা মুখস্থ বিতর্ক না করে যৌক্তিক ভাবে চিন্তা করতে হবে। এটা রাজনীতির মতো ভোটের খেলা নয়। একটা নতুন সিস্টেম প্রয়োগ করার আগে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হয়। এখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা যেটুকু করা হয়েছে সেখানে কাজের কাজ কিছু করা হয়নি। কেন হয়নি সেটা বলছি।
এই ব্যবস্থাটি প্রয়োগ করার জন্য গত বছর থেকে একটা পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। আমার সন্তান সেই পাইলট প্রকল্পে পড়াশোনা করেছে। আমি অভিভাবক হিসেবে সেই পাইলট প্রকল্পের ভালমন্দ দেখেছি। পাইলট প্রকল্পের লক্ষ্য হলো এটা ভালো কিংবা মন্দ সেটা নিয়ে আলাপ করা। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উচিত ছিল আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো জানতে চাওয়া। এখানে শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক, এই তিনটা পক্ষ আছে। কিন্তু এই বিষয়ে ছাত্র এবং অভিভাবক এই দুপক্ষের কারো মতামত নেয়া হয়নি বলে আমি জানি। শিক্ষকদের মতামত নেয়া হয়েছে কিনা জানা নেই।
এক বছর পাইলট প্রকল্প চালিয়ে পরের বছর থেকে সারা দেশে চালু করে দেয়া হয়েছে ব্যবস্থাটি। এটা মোটেও উচিত হয়নি। আমার সন্তান এই প্রকল্পের অধীনে পড়াশোনা করেছে বলে আমি জানি এখানকার দুর্বলতাগুলো কী কী।
গত বছর যখন আমার পুত্র এই প্রকল্পের অধীনে শিক্ষা গ্রহন করতে শুরু করে, প্রথমে আমি খুশী হয়েছিলাম সুন্দর সুন্দর বইপত্র দেখে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে যখন পড়াশোনা ভালমতন শুরু হলো তখন দেখতে লাগলাম, তার সমস্ত পড়াশোনার ধরণ বদলে গেছে। সে এখন বই পড়ার সময় পায় না। খাতায় অংক করার সময় পায় না। ইংরেজি শেখার সময় পায় না। তাকে সবগুলো বিষয় পড়তে হয় কাগজ কেটে কেটে। খাতা কলমের বদলে তাকে আমার কিনে দিতে হয় কাঁচি, আর্টপেপার, চার্টপেপার, গাম, রঙপেন্সিল ইত্যাদি। সে বীজগণিতের সূত্র লেখে কাগজ কেটে। তাকে কবিতার লাইন লিখতে হয় কাগজ কেটে বোর্ডে সাঁটিয়ে, তাকে বিজ্ঞান পড়তে হয় সেও কাগজ কেটে, গাম দিয়ে রঙিন বোর্ডে লাগিয়ে। এগুলো করতে যে পরিমান খরচ হয় সেটার কথা বাদই দিলাম, কিন্তু প্রতিদিন রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত সে ঘুমাতে যেতে পারে না এসব করতে গিয়ে। আমি অসহায় হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি সে গলদঘর্ম হয়ে এসব করছে। শুধু কী ছাত্র, ছাত্রের মা বাবা দাদা দাদী সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হয় এসব সামলাতে গিয়ে।
কিছুদিন আগে এক রাতে দেখলাম সে কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কারণ তাকে হোমওয়ার্ক দেয়া হয়েছে একটা ফসিল তৈরি করতে হবে। বইতে ফসিল তৈরির নিয়ম বলে দেয়া হয়েছে। তাকে নরম কাদা যোগাড় করতে হবে, গাছের পাতা এনে সেই কাদায় চুবিয়ে রাখতে হবে কয়েকদিন, তারপর সেটা শুকিয়ে ভেতরে যে ছাপ পড়বে, সেটা একটা ফসিলের চেহারা নেবে। তারপর কাদা সহ সেই ফসিল স্কুলে নিতে হবে।
আমি ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। বাড়ির কাজ এমন হতে পারে। তখন সে বই খুলে দেখালো বাড়ির কাজ। এখন একটা ফসিল কিভাবে তৈরি হয় সেটা শেখানোর জন্য ঘরে ঘরে যদি কয়েক কোটি ফসিল তৈরির কারখানা করা হয় সেটা কী একটা সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা? এরকম অসংখ্য পাগলামি উদাহরণ আছে। সবটা লিখতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
আরেকটা উদাহরণ দেই। কাগজ কিভাবে আবিষ্কার হয়েছে সেটা বোঝাতে গিয়ে বাচ্চাদের বলা হয়েছে ঘরে বসে পুরোনো বইপত্র ছিড়ে সেই কাগজ ভিজিয়ে মণ্ড তৈরি করে কাগজ বানিয়ে নিয়ে যেতে। সেই কাগজে আবার গাছের বীজও বুনে দিতে বলা হয়েছে। যেন কাগজ নষ্ট হয়ে গেলে সেটা ফেলে দিলে সেখান থেকে গাছ ওঠে। পৃথিবীটা নাকি এভাবে সবুজ হয়ে যাবে, পরিবেশ রক্ষা পাবে। সেই কাগজ তৈরির হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে আমার বাসায় তিনদিন ধরে কত কী কাণ্ড হয়েছে সেটা লিখতে গেলে ছোটখাট বই হয়ে যাবে।
যাদের সন্তান এবার সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে তাদের সবাই জানে এই দুর্বলতার বিষয়টা। আমার মনে হয় যারা এই ব্যবস্থার বিরোধীতা করছে সবাই এই ব্যবস্থার ভুক্তভোগী। কিন্তু সমালোচনার বিষয়টা আমলে নেয়া হচ্ছে না। অথচ বিষয়টা মোটেও অবহেলা করার মতো নয়। এটা জাতীয় স্বার্থের একটা ব্যাপার। এর আগে সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়েও তাই হয়েছে। হচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে সৃজনশীল পড়াশোনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেটা পুরোপুরি ব্যর্থ। শিক্ষার্থীরা এখন সৃজনশীলতার নামে আরো গৎবাধা পড়াশোনা করছে। ছাত্রদের কাছে সৃজনশীলতার অর্থ হলো, চার ধরনের চারটা প্রশ্ন থাকবে। প্রতিটা প্রশ্নের সাইজ ঠিক করা আছে। একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এক লাইনে, আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দুই লাইনে, আরেকটার উত্তর চার লাইনে, আরেকটা দশ লাইনে। এখানে ছাত্রকে আগেই রশি দিয়ে বেঁধে বলা হচ্ছে এটার উত্তর এভাবেই লিখতে হবে। তাহলে এখানে তার সৃজনশীলতা বিকাশ হবার সুযোগ কোথায়? সৃজনশীলতা মানে তো সৃষ্টিশীলতা। এখানে তার কিছুই নেই। তারপর আরেকটা অদ্ভুতুড়ে হাস্যকর বিষয় হলো -উদ্ভট প্রশ্নের আবির্ভাব। কোন কোন স্কুলে কোন কোন পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা হয় কে কত বেশি উদ্ভট প্রশ্ন করতে পারে যেন ছাত্র ছাত্রী কোন তল খুঁজে না পায়। সেসব নিয়ে পত্রিকায় অনেকবার লেখা হয়েছে। এখানে প্রশ্নকর্তার সৃজনশীলতার দেখা পাওয়া গেলেও ছাত্রদের সৃজনশীলতার কোন সুযোগ নেই।
নতুন শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে যারা মতামত দিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই এই বিষয়ে অনেকাংশে অজ্ঞ। অর্থাৎ পক্ষ বা বিপক্ষে যারা লিখছে তাদের কারোরই ব্যাপারটা নিয়ে পুরো ধারণা নেই। তাই ব্যাপারটা অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো হয়ে গেছে।
বাঙালী ক্ষ্যাপাটে একটা জাতি। এখানে যে কোন ইস্যু নিয়ে সবাই উত্তেজিত হয়ে যেতে পছন্দ করে। সরকার কিছু বললে বিরোধী মতের পাবলিক ক্ষেপে যায়। আবার পাবলিক সরকারে কোন নীতির সমালোচনা করলে তাকে বিরোধীদল মনে করে। দুই পক্ষের এই ক্ষ্যাপাটে মনোভাব ছাড়তে হবে। অন্তত জাতীয় স্বার্থের ইস্যুগুলোতে কথাবার্তা বলার সুযোগ থাকতে হবে দুই পক্ষে।
এই শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা ব্যয়বহুল। আমার সন্তান যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করার সব ব্যবস্থা আছে। তাদের ভাল শিক্ষক, ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি সব আছে। ওই প্রতিষ্ঠান এ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বিশেষ ভাবে পারদর্শী। তবু আমি নতুন শিক্ষাপদ্ধতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। কারণ বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত নয়। আমাদের পুরো দেশ নিয়ে ভাবতে হবে। বুঝতে হবে এই ধরণের শিক্ষাপদ্ধতি চালু করার জন্য পুরো বাংলাদেশ এখনো তৈরি কিনা।
আমার চোখে বাংলাদেশ এরকম একটা ব্যবস্থার জন্য মোটেও তৈরি নয়, ভবিষ্যতে তৈরি হবার মতো কোন লক্ষণ এখনো দেখছি না। এদেশে অধিকাংশ স্কুল শিক্ষকের বেতন গার্মেন্টস শ্রমিকের চেয়েও কম। অধিকাংশ স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বসার জায়গা পর্যন্ত হয় না। খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, ল্যাব, এসবের কথা বাদই দিলাম। চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে সেরা পাঁচটি স্কুলকে দিয়েও এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে মনে করি না। এই নাজুক অবকাঠামো নিয়ে এমন একটা আধুনিক ব্যবস্থা সফল করার স্বপ্ন দেখা অবান্তর বিষয়। একজন সাবেক মন্ত্রী যেমন বাংলাদেশে ম্যাগলেভ ট্রেনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, এটা সেরকম একটা ব্যাপার মনে হয়েছে।
দয়া করে ইউরোপ আমেরিকার সাথে তুলনা করবেন না। সেখানকার স্কুলের শিক্ষকদের মান মর্যাদা প্রশিক্ষণ বেতন এগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে মন্তব্য করবেন। আমাদের তুলনা করার দৌড় বড়জোর ভারত এবং শ্রীলঙ্কা। সেখানকার সাধারণ কোন স্কুলে এরকম কারিকুলাম নাই। পৃথিবীর কোন দেশেই হাইস্কুলের সাধারণ কারিকুলাম এরকম হয় না।
অনেকে বলছে কোচিং সেন্টারের ব্যবসায়ীরা এটার বিপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। আমার তা মনে হয় না। এই শিক্ষাব্যবস্থায় কোচিং সেন্টার ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। সৃজনশীল পদ্ধতি নামের যে কিম্ভুত পদ্ধতি চালু হয়েছে দেশে, সেটা কোচিং ব্যবসাকে কমানোর বদলে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই নতুন পদ্ধতির কারণে আরো কিছু নতুন কোচিং সেন্টার খোলা হবে। বিদ্যমান কোচিং সেন্টারগুলোর নতুন শাখা প্রশাখা বাড়বে। তাতে শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা সফল হবে জানি না, কিন্তু নতুন কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যবসা রমরমা হবে তাতে সন্দেহ নেই।
অসময়ের একটা ভুল সিদ্ধান্ত পুরো জাতিকে পিছিয়ে দিতে পারে অনেক বছর। তবু আলোচনা হোক। আমার মতো অন্য যারা এই বিষয়ের ভুক্তভোগী তারা প্রত্যেকে যার যার অভিজ্ঞতা লিখুক। অভিজ্ঞতার আলোতেই সিদ্ধান্তের ভালোমন্দ বিচার
Friday, December 1, 2023
জীবনানন্দ দাশ নিয়ে রচিত উপন্যাসসমূহ সম্পর্কে
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে গল্প- উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছেন অনেকেই। গত কয়েক বছর ধরে প্রবণতাটা শুরু হয়েছে। দুই বাংলাতেই চেষ্টাটা চলছে। ট্র্যাজিক উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে জীবনানন্দের কোন তুলনা হয় না। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন চেষ্টাই সফলভাবে জীবনানন্দকে তুলে ধরতে পারেনি। আমি জীবনানন্দকে নিয়ে এ যাবত প্রকাশিত প্রায় সবগুলো বই পড়েছি খুব আগ্রহ নিয়ে। জীবনানন্দ দাশ আমার বহুকালের রহস্য চরিত্র। তাঁকে জানার জন্য যতটুকু সম্ভব ততটুকু পড়ার চেষ্টা করি। এ পর্যন্ত যতটুকু পড়েছি, তাঁর জীবনকে যতটা জেনেছি তাতে ওই গল্প উপন্যাসগুলোকে মেলাতে পারিনি। মনে হয়েছে অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো প্রকাশিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশ। যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে একেকটা ভিন্ন ভিন্ন জীবনানন্দ দাশ নির্মাণ করার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেরকম গ্রহনযোগ্য কোন কাজ হয়নি। কারো কারো কাজ এত সস্তা হয়েছে যে, পড়ে মনে হবে এত দুর্বল সাহিত্যিক যোগ্যতা নিয়ে জীবনানন্দ দাশের মতো একজনের মহাকাব্যিক জীবনকে ধারণ করার চেষ্টা করা উচিত হয়নি।