Saturday, December 2, 2023

স্মার্ট ফোনের জনক এবং নতুন শিক্ষা পদ্ধতি

স্টিভ জবসকে সবাই স্মার্ট ফোনের জনক হিসেবে চিনলেও সেটা পুরোপুরি সঠিক নয়। স্মার্ট ফোনের জনক হলেন মার্ক পোরাট। ১৯৯৩ সালে মার্ক পোরাট যখন স্মার্ট ফোনের ডিজাইন করেন তখন পৃথিবী সেই প্রযুক্তি গ্রহন করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তাঁর পরিকল্পনার সাথে সনি, মোটোরোলা, ফিলিপসের মতো কোম্পানি যুক্ত থেকেও সেই প্রযুক্তি বাজারে চালু করতে পারেননি। মার্ক পোরাট দেউলিয়া হয়ে সব ছেড়ে একটা নির্জন দ্বীপে বনবাসে চলে গিয়েছিলেন। দেড় দশক পর স্টিভ জবস মার্ক পোরাটের সেই অসমাপ্ত কাজটা নতুন করে শুরু করে বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রযুক্তি ব্যবসায়ী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। তখন থেকে আমরা স্টিভ জবসকে স্মার্ট ফোনের জনক হিসেবে চিনি।


মার্ক পোরাট কেন ব্যর্থ হয়েছিলেন, স্টিভ জবস কেন সফল হয়েছিলেন?


উত্তর হলো - সময়। মার্ক পোরাট যখন ওই প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন তখনো ইন্টারনেট চালু হয়নি বিশ্বব্যাপী। পৃথিবী চলতো এনালগ প্রযুক্তিতে। ইন্টারনেট ছাড়া ওই প্রযুক্তি অচল। স্টিভ জবস যখন মাঠে নামলেন, তখন পৃথিবীতে ইন্টারনেট ছড়িয়ে পড়েছে। ওয়্যারলেস প্রযুক্তি সবার হাতে হাতে। বিশ্বব্যাপী প্রয়োজনীয় সকল অবকাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। মার্ক পোরাটের ব্যর্থ স্বপ্নটাকে তাই সফলতায় রূপান্তর করতে পেরেছিলেন স্টিভ জবস।


আমাদের নতুন শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যে বিতর্কটা চলমান, সেটার ক্ষেত্রেও এই উদাহরন প্রযোজ্য। আইডিয়াটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো। কিন্তু মুশকিল হলো আমরা এইরকম একটা ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য প্রস্তুত কিনা। আমার মনে হয়, আমরা প্রস্তুত নই। আমাদের দেশ এই ব্যবস্থা গ্রহন করার মতো উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের দেশে স্কুল কলেজের যে মৌলিক অবকাঠামো, সেটা ন্যূনতম মানও অর্জন করেনি। গ্রামের কথা বাদই দিলাম, আমাদের চট্টগ্রাম শহরে কয়টা স্কুল আছে যেটাকে আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার মতো অবকাঠামো আছে? দুয়েকটা প্রাইভেট স্কুল বাদে বাকী ৯৯ ভাগ স্কুলের যথেষ্ট শিক্ষক, ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি কিছুই নেই। যেসব শিক্ষক আছে তাদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই। 


এখন হুট করে কিছু ভাল ভাল বই ছাপিয়ে যদি রাতারাতি শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে দেবার স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্নটা সফল হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। 


দুঃখজনক হলেও এটা অপ্রিয় একটা বাস্তবতা হলো আমাদের শহরে গত পঞ্চাশ বছর আগে যেসব স্কুল ছিল তার বাইরে আর পাঁচটাও স্কুল হয়নি। কলেজ হয়নি। আমরা যেসব স্কুলে পড়েছি সেসব স্কুলেই আমাদের ছেলেমেয়েরা দুই তিন শিফট করে ঠেলাঠেলি করে পড়ছে। কিছু কিছু স্কুলে আবার জোর করে কলেজও ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এই যে অবকাঠামোগত কোন উন্নতি হলো না, তার জন্য দায়ী কে? উত্তর নিশ্চয়ই সবার জানা।


তাহলে কী করতে হবে? অযথা মুখস্থ বিতর্ক না করে যৌক্তিক ভাবে চিন্তা করতে হবে। এটা রাজনীতির মতো ভোটের খেলা নয়। একটা নতুন সিস্টেম প্রয়োগ করার আগে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হয়। এখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা যেটুকু করা হয়েছে সেখানে কাজের কাজ কিছু করা হয়নি। কেন হয়নি সেটা বলছি। 


এই ব্যবস্থাটি প্রয়োগ করার জন্য গত বছর থেকে একটা পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। আমার সন্তান সেই পাইলট প্রকল্পে পড়াশোনা করেছে। আমি অভিভাবক হিসেবে সেই পাইলট প্রকল্পের ভালমন্দ দেখেছি। পাইলট প্রকল্পের লক্ষ্য হলো এটা ভালো কিংবা মন্দ সেটা নিয়ে আলাপ করা। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উচিত ছিল আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো জানতে চাওয়া। এখানে শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক, এই তিনটা পক্ষ আছে। কিন্তু এই বিষয়ে ছাত্র এবং অভিভাবক এই দুপক্ষের কারো মতামত নেয়া হয়নি বলে আমি জানি। শিক্ষকদের মতামত নেয়া হয়েছে কিনা জানা নেই।


এক বছর পাইলট প্রকল্প চালিয়ে পরের বছর থেকে সারা দেশে চালু করে দেয়া হয়েছে ব্যবস্থাটি। এটা মোটেও উচিত হয়নি। আমার সন্তান এই প্রকল্পের অধীনে পড়াশোনা করেছে বলে আমি জানি এখানকার দুর্বলতাগুলো কী কী।


গত বছর যখন আমার পুত্র এই প্রকল্পের অধীনে শিক্ষা গ্রহন করতে শুরু করে, প্রথমে আমি খুশী হয়েছিলাম সুন্দর সুন্দর বইপত্র দেখে। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে যখন পড়াশোনা ভালমতন শুরু হলো তখন দেখতে লাগলাম, তার সমস্ত পড়াশোনার ধরণ বদলে গেছে। সে এখন বই পড়ার সময় পায় না। খাতায় অংক করার সময় পায় না। ইংরেজি শেখার সময় পায় না। তাকে সবগুলো বিষয় পড়তে হয় কাগজ কেটে কেটে। খাতা কলমের বদলে তাকে আমার কিনে দিতে হয় কাঁচি, আর্টপেপার, চার্টপেপার, গাম, রঙপেন্সিল ইত্যাদি। সে বীজগণিতের সূত্র লেখে কাগজ কেটে। তাকে কবিতার লাইন লিখতে হয় কাগজ কেটে বোর্ডে সাঁটিয়ে, তাকে বিজ্ঞান পড়তে হয় সেও কাগজ কেটে, গাম দিয়ে রঙিন বোর্ডে লাগিয়ে। এগুলো করতে যে পরিমান খরচ হয় সেটার কথা বাদই দিলাম, কিন্তু প্রতিদিন রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত সে ঘুমাতে যেতে পারে না এসব করতে গিয়ে। আমি অসহায় হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি সে গলদঘর্ম হয়ে এসব করছে। শুধু কী ছাত্র, ছাত্রের মা বাবা দাদা দাদী সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হয় এসব সামলাতে গিয়ে। 


কিছুদিন আগে এক রাতে দেখলাম সে কাঁদো কাঁদো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।


কারণ তাকে হোমওয়ার্ক দেয়া হয়েছে একটা ফসিল তৈরি করতে হবে। বইতে ফসিল তৈরির নিয়ম বলে দেয়া হয়েছে। তাকে নরম কাদা যোগাড় করতে হবে, গাছের পাতা এনে সেই কাদায় চুবিয়ে রাখতে হবে কয়েকদিন, তারপর সেটা শুকিয়ে ভেতরে যে ছাপ পড়বে, সেটা একটা ফসিলের চেহারা নেবে। তারপর কাদা সহ সেই ফসিল স্কুলে নিতে হবে। 


আমি ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। বাড়ির কাজ এমন হতে পারে। তখন সে বই খুলে দেখালো বাড়ির কাজ। এখন একটা ফসিল কিভাবে তৈরি হয় সেটা শেখানোর জন্য ঘরে ঘরে যদি কয়েক কোটি ফসিল তৈরির কারখানা করা হয় সেটা কী একটা সুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থা? এরকম অসংখ্য পাগলামি উদাহরণ আছে। সবটা লিখতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।


আরেকটা উদাহরণ দেই। কাগজ কিভাবে আবিষ্কার হয়েছে সেটা বোঝাতে গিয়ে বাচ্চাদের বলা হয়েছে ঘরে বসে পুরোনো বইপত্র ছিড়ে সেই কাগজ ভিজিয়ে মণ্ড তৈরি করে কাগজ বানিয়ে নিয়ে যেতে। সেই কাগজে আবার গাছের বীজও বুনে দিতে বলা হয়েছে। যেন কাগজ নষ্ট হয়ে গেলে সেটা ফেলে দিলে সেখান থেকে গাছ ওঠে। পৃথিবীটা নাকি এভাবে সবুজ হয়ে যাবে, পরিবেশ রক্ষা পাবে। সেই কাগজ তৈরির হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে আমার বাসায় তিনদিন ধরে কত কী কাণ্ড হয়েছে সেটা লিখতে গেলে ছোটখাট বই হয়ে যাবে। 


যাদের সন্তান এবার সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে তাদের সবাই জানে এই দুর্বলতার বিষয়টা। আমার মনে হয় যারা এই ব্যবস্থার বিরোধীতা করছে সবাই এই ব্যবস্থার ভুক্তভোগী। কিন্তু সমালোচনার বিষয়টা আমলে নেয়া হচ্ছে না। অথচ বিষয়টা মোটেও অবহেলা করার মতো নয়। এটা জাতীয় স্বার্থের একটা ব্যাপার। এর আগে সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়েও তাই হয়েছে। হচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে সৃজনশীল পড়াশোনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেটা পুরোপুরি ব্যর্থ। শিক্ষার্থীরা এখন সৃজনশীলতার নামে আরো গৎবাধা পড়াশোনা করছে। ছাত্রদের কাছে সৃজনশীলতার অর্থ হলো, চার ধরনের চারটা প্রশ্ন থাকবে। প্রতিটা প্রশ্নের সাইজ ঠিক করা আছে। একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এক লাইনে, আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দুই লাইনে, আরেকটার উত্তর চার লাইনে, আরেকটা দশ লাইনে। এখানে ছাত্রকে আগেই রশি দিয়ে বেঁধে বলা হচ্ছে এটার উত্তর এভাবেই লিখতে হবে। তাহলে এখানে তার সৃজনশীলতা বিকাশ হবার সুযোগ কোথায়? সৃজনশীলতা মানে তো সৃষ্টিশীলতা। এখানে তার কিছুই নেই। তারপর আরেকটা অদ্ভুতুড়ে হাস্যকর বিষয় হলো -উদ্ভট প্রশ্নের আবির্ভাব। কোন কোন স্কুলে কোন কোন পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা হয় কে কত বেশি উদ্ভট প্রশ্ন করতে পারে যেন ছাত্র ছাত্রী কোন তল খুঁজে না পায়। সেসব নিয়ে পত্রিকায় অনেকবার লেখা হয়েছে। এখানে প্রশ্নকর্তার সৃজনশীলতার দেখা পাওয়া গেলেও ছাত্রদের সৃজনশীলতার কোন সুযোগ নেই।


নতুন শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে যারা মতামত দিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই এই বিষয়ে অনেকাংশে অজ্ঞ। অর্থাৎ পক্ষ বা বিপক্ষে যারা লিখছে তাদের কারোরই ব্যাপারটা নিয়ে পুরো ধারণা নেই। তাই ব্যাপারটা অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো হয়ে গেছে।


বাঙালী ক্ষ্যাপাটে একটা জাতি। এখানে যে কোন ইস্যু নিয়ে সবাই উত্তেজিত হয়ে যেতে পছন্দ করে। সরকার কিছু বললে বিরোধী মতের পাবলিক ক্ষেপে যায়। আবার পাবলিক সরকারে কোন নীতির সমালোচনা করলে তাকে বিরোধীদল মনে করে। দুই পক্ষের এই ক্ষ্যাপাটে মনোভাব ছাড়তে হবে। অন্তত জাতীয় স্বার্থের ইস্যুগুলোতে কথাবার্তা বলার সুযোগ থাকতে হবে দুই পক্ষে।


এই শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা ব্যয়বহুল। আমার সন্তান যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করার সব ব্যবস্থা আছে। তাদের ভাল শিক্ষক, ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি সব আছে। ওই প্রতিষ্ঠান এ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বিশেষ ভাবে পারদর্শী। তবু আমি নতুন শিক্ষাপদ্ধতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। কারণ বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত নয়। আমাদের পুরো দেশ নিয়ে ভাবতে হবে।  বুঝতে হবে এই ধরণের শিক্ষাপদ্ধতি চালু করার জন্য পুরো বাংলাদেশ এখনো তৈরি কিনা। 


আমার চোখে বাংলাদেশ এরকম একটা ব্যবস্থার জন্য মোটেও তৈরি নয়, ভবিষ্যতে তৈরি হবার মতো কোন লক্ষণ এখনো দেখছি না। এদেশে অধিকাংশ স্কুল শিক্ষকের বেতন গার্মেন্টস শ্রমিকের চেয়েও কম। অধিকাংশ স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের বসার জায়গা পর্যন্ত হয় না। খেলার মাঠ, লাইব্রেরি, ল্যাব, এসবের কথা বাদই দিলাম। চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে সেরা পাঁচটি স্কুলকে দিয়েও এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে মনে করি না। এই নাজুক অবকাঠামো নিয়ে এমন একটা আধুনিক ব্যবস্থা সফল করার স্বপ্ন দেখা অবান্তর বিষয়।  একজন সাবেক মন্ত্রী যেমন বাংলাদেশে ম্যাগলেভ ট্রেনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, এটা সেরকম একটা ব্যাপার মনে হয়েছে।


দয়া করে ইউরোপ আমেরিকার সাথে তুলনা করবেন না। সেখানকার স্কুলের শিক্ষকদের মান মর্যাদা প্রশিক্ষণ বেতন এগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে মন্তব্য করবেন। আমাদের তুলনা করার দৌড় বড়জোর ভারত এবং শ্রীলঙ্কা। সেখানকার সাধারণ কোন স্কুলে এরকম কারিকুলাম নাই। পৃথিবীর কোন দেশেই হাইস্কুলের সাধারণ কারিকুলাম এরকম হয় না।


অনেকে বলছে কোচিং সেন্টারের ব্যবসায়ীরা এটার বিপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। আমার তা মনে হয় না। এই শিক্ষাব্যবস্থায় কোচিং সেন্টার ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। সৃজনশীল পদ্ধতি নামের যে কিম্ভুত পদ্ধতি চালু হয়েছে দেশে, সেটা কোচিং ব্যবসাকে কমানোর বদলে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এই নতুন পদ্ধতির কারণে আরো কিছু নতুন কোচিং সেন্টার খোলা হবে।  বিদ্যমান কোচিং সেন্টারগুলোর নতুন শাখা প্রশাখা বাড়বে। তাতে  শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা সফল হবে জানি না, কিন্তু নতুন কোচিং সেন্টারগুলোর ব্যবসা রমরমা হবে তাতে সন্দেহ নেই। 


অসময়ের একটা ভুল সিদ্ধান্ত পুরো জাতিকে পিছিয়ে দিতে পারে অনেক বছর। তবু আলোচনা হোক। আমার মতো অন্য যারা এই বিষয়ের ভুক্তভোগী তারা প্রত্যেকে যার যার অভিজ্ঞতা লিখুক। অভিজ্ঞতার আলোতেই সিদ্ধান্তের ভালোমন্দ বিচার


No comments: