মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিথ্যাচার নতুন কিছু না। এতে ইতিহাস লেখক, গবেষক, রাজনীতিবিদ, সবারই কিছু না কিছু দায় আছে। সরল মনে পড়লে যখন যার বই পড়ি তার তথ্যই সঠিক বলে ভাবতে ইচ্ছে করে, আবার ক্রিটিকাল মুডে পড়তে বসলে কাউকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। এটা একটা সমস্যা। তাছাড়া কোনটা ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচার কোনটা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাচার সময়ের সাথে তা ঝাপসা হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের অনেক লেখক জীবিত নেই। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যাও কমে আসছে। আগামী বিশ বছর পর হয়তো একদম শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। তখন মিথ্যার বেসাতি খুলে বসতে সুবিধা হবে মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ীদের। বলতে খারাপই লাগে এদেশে ধর্মব্যবসায়ী যেমন আছে তেমনি মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ীও আছে। এরা প্রত্যেকে নিজ নিজ পছন্দের ব্যাপারে খুব স্বার্থপর। লিখিত বইপত্রে যার প্রতিফলন ঘটে কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের মাধ্যমে।
এই বেসাতি বন্ধের জন্য বর্তমান প্রজন্মকে সতর্কতার সাথে ইতিহাস পড়তে হবে। গল্প আর ঘটনার মধ্যে ফারাক করার ক্ষমতা থাকতে হবে। সেই ক্ষমতা অর্জনের জন্য অল্পবিস্তর পড়াশোনা করা দরকার। ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার বন্ধ করা অসম্ভব জেনেও আমি চেষ্টা করছি অন্ততঃ চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাগুলোর একটা সমন্বয় ঘটাতে। একই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন লেখক তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখেছেন, সেই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সঠিক তথ্য বের করাই এই সমন্বয় প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য।
সেই লক্ষ্যে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইপত্র সংগ্রহ করার আরেকটি চেষ্টা করছি। আমার সংগ্রহে যা আছে তা যথেষ্ট নয় বলে মনে হচ্ছে। যত বেশী প্রত্যক্ষদর্শীর বই পাওয়া যাবে তত বেশী তথ্যসুত্র মিলবে। লেখক জীবিত থাকলে সরাসরি কথা বলতেও আগ্রহী। ক্রস চেকিং এর মাধ্যমে অনেক ঘটনার সত্যমিথ্যা যাচাই করা যাবে। এসব বই থেকে ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে, তৎকালীন অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।
বুঝতেই পারছেন চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের তালিকা করার ব্যাপারে সাহায্য চাইছি। বইয়ের নাম, এমনকি কেউ স্ক্যান বা পিডিএফ ডকুমেন্ট/বই দিলেও বাধিত থাকবো।
========================
উপরের লেখাটা স্ট্যাটাস আকারে ফেসবুকে বইপড়ুয়াতে দিলাম। কিছু বইয়ের খোঁজ দরকার জরুরী ভিত্তিতে।
ঘটনা হলো, গতকাল এনায়েত মওলা নামে এক অচেনা ভদ্রলোকের লেখা বই "মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নছবি- চট্টগ্রামের কাকলী" পড়ে গতরাতে আমি ছটফট করেছি। বইটাকে বিশ্বাস করলে অনেক কিছুর উপর অবিশ্বাস আসে, আবার বইটা নিয়ে বিভিন্ন রেফারেন্স পড়ে অবিশ্বাসও করতে পারছি না। কে কতটা সত্যি বলছে সেটা নির্ভর করে ব্যক্তির রাজনৈতিক অবস্থানের উপর। যদিও ভদ্রলোক বলেছেন তিনি রাজনৈতিক নিরপেক্ষ লোক, কিন্তু আসলে সেটা কি সম্ভব? বইটার মধ্যে মাথাব্যথা হবার মতো বেশ কিছু উপাদান আছে যার সত্যতা যাচাই করার জন্য আমার অনেক বই পড়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চট্টগ্রামের এত বই পড়েও এনায়েত মওলার কোন হদিস পাইনি, ঘটনা বুঝলাম না। কিন্তু কাকলী যে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ছিল সেটাও সত্যি। অপারেশান জ্যাকপটে নৌকমাণ্ডোরা ওই বাড়িতে উঠেছিল। ওই বাড়ির মালিক এনায়েত মওলা। ভদ্রলোক পাকিস্তানীদের ফাঁকি দিয়ে পুরো সময়টা কিভাবে কাটিয়ে দিলেন সে এক রহস্য। বইতে যদিও লিখেছেন কিভাবে কি করেছেন, তবু প্রশ্ন থেকে যায়। একাত্তরে এরকম অলস অবসরে কাটিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে গেছেন, ব্যাপারটা প্রায় অবিশ্বাস্য।
যদি তাঁর দাবী মতে একাত্তরের ওই ভূমিকা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তাকে অরাজনৈতিক মহত্বে ভূষিত করতে হয় একাত্তরের অবদানের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তখন দুটো দল। ফ্রিডম ফাইটার বা এফ এফ, বাংলাদেশ লিবারেশান ফোর্স বা বিএলফ। শেষোক্তটি চার খলিফার তত্ত্বাবধানে চলতো, আর প্রথমোক্ত চলতো সেক্টর কমাণ্ডারদের নির্দেশনা অনুযায়ী। এই দুই দলে আবার বিবাদও ছিল, পরস্পর খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। এনায়েত মওলা সেই বিভেদগুলোর কথা বলেছেন স্পষ্টভাবে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা যেসব বই লিখেছেন তাতে এই দ্বন্দ্বের উল্লেখ থাকতে দেখি না। এসব ব্যাপার পড়ে এনায়েত মওলার রাজনৈতিক অবস্থান জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠেছি। কিন্তু ভদ্রলোক এখন বেঁচে আছেন কিনা জানি না। কোথায় থাকতেন তাও জানি না। তাঁর বইটা প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে আজ থেকে ২১ বছর আগে। আমি অন্ততঃ চাই তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে তেমন কারো সাথে কথা বলতে। রেডিওর একজন নাজমুল আলমের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনিও বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আমাকে তথ্য যাচাইয়ে পথে নামতে হবে মনে হচ্ছে।