Tuesday, September 30, 2014

ছুটির গন্ধে ঘুম আসে না

এই সময়গুলো তবু ভালো। একটা দিন ভালো গেলে, একটা সপ্তাহ ভালো গেলে সাফল্যজনক এক আনন্দ ভর করে। মাঝে মাঝে সেই সাফল্যের উপর চুনকালি দেয়া দিনও এসে হাজির হয়। তখন সময় কঠিন। বলতে না পারা কষ্ট, বোঝানো যায় না তেমন বেদনা, অসহায়ত্ব সবকিছু একসাথে ঘিরে ধরে। যে ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আমাদের এই সমস্ত সুখ, সেই ভিত্তি কোথাও কেঁপে গেলে সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। যেখানে আমার শান্তির আশ্রয় সেটাকেও নিতান্ত অকার্যকর মনে হয় তখন। প্রিয় সময়গুলোও অবান্তর হয়ে যায়।

এখন সময় ভালো, তবু সেই কঠিনকে ভুলতে পারি না। মাঝে মাঝেই কঠিন দিনগুলো আসে। আবারো আসবে। সবকিছু ছেড়ে তখন পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। আসলে পালানো হয় না। পিছুটান থাকলে ফিরে আসতে হয়। সবগুলো ভুল, পাপ, গ্লানি পুরোনো রুমালে মুছে ফিরে আসতে হয়। যদি ভূমিকম্প না থামে, তাহলে কি ফেরার পথ থাকে? কোন কোন ভূমিকম্প অগ্ন্যুৎপাতের সূচনা করে, তখন তো সকল ভিত্তি ভারসাম্যহীন। আমি দাঁড়াবো কোথায়?

এই সময়গুলো তবু ভালো, আজকের দিনটা ভালো, গতকালের দিনটাও ভালো, তার আগের দিনও। আমি স্বাধীনতা উদযাপন করেছি। মানুষ মাত্রেই স্বাধীন হতে পছন্দ করে। কিন্তু কোথাও কোথাও পরাধীনতা চায় কেন সেই একই মানুষ? এ এক অবোধ্য স্ববিরোধীতা।

প্রেরণার শক্তি অনেক। প্রেরণার অন্য নাম হতে পারে জ্বালানী। প্রেরণা থেকে অসম্ভব শক্তি নির্গত হতে পারে। সেই শক্তি সৃষ্টি করতে পারে, ধ্বংস করতে পারে, জন্ম দিতে পারে শিল্পের শ্রেষ্ঠতম সজ্জা। কিন্তু সব প্রেরণায় ধারাবাহিকতা থাকে না। প্রেরণা নিজেই হারিয়ে যায় মাঝে মাঝে। তখন শিল্প পড়ে বিপদে আর জ্বালানীর অভাবে শিল্পকর্তা ধ্বংস করতে পারে নিজের শিল্পকর্মও। এটা একটা ট্র্যাজেডি এবং এই ট্র্যাজেডির কোন প্রতিকার নেই।

একটা সম্ভাব্য কাজে সময়, অর্থ এবং শক্তি বিনিয়োগ করতে শুরু করেছি। কাজটার সাফল্য আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। আমি পরিপূর্ণভাবে আত্মবিশ্বাসী। কাজটা হবে, কতটা সুন্দর হবে তা নিশ্চিত নই। কিন্তু আর সব কাজের মতো এই কাজের শুরুতেও আমি বিপরীত প্রতিক্রিয়াগুলো নিয়ে ভাবছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে আমি অহেতুক ঋণাত্মক বিষয় নিয়ে চিন্তাগ্রস্থ হই। অভিযোগের সত্যতা মেনেও আমি আমার ভাবনা অব্যাহত রাখি। এটা আমার ধাক্কা সামলানোর মানসিক প্রস্তুতি। আমি খুব বড় কোন ধাক্কা খাইনি মানুষের কাছে, কিন্তু ছোট ছোট প্রচুর ধাক্কা খেয়েছি। যেখানে খাবার ছিল না সেখানেও। সেই ধাক্কাগুলো সামলেছি শুরুতেই একটা সংশয় রেখেছিলাম বলে। পুরোনো অভ্যেস, ছাড়ানো কঠিন।

দুদিন বাদেই দীর্ঘ ছুটি। পুজা আর ঈদ মিলে ৮ দিনের ছুটি। আমার জন্য অকাজের ছুটি। এবার ছুটিতে কোথাও যাবো না। যথারীতি সামাজিক কর্মে ব্যস্ত। পড়াশোনার কাজ, লেখালেখির অনেক কাজ পড়ে আছে, প্রতিবার ছুটিতে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুই হয় না। আমি বরং কর্মস্থলে অনেক বেশী কাজ করতে পারি। গত বছরের সাথে এবছরের একটা পার্থক্য আছে। আকাশে, বাতাসে, অনুভবে। অনেক কিছু যেন বদলে গেছে। বদলানো উচিত হয়েছি কিংবা হয়নি সেই বিচারে আমি অক্ষম। তবু সময় নিজস্ব গতিতে চলে, নিজস্ব পরিকল্পনায়। আমরা সময়ের অনিবার্য দাসত্ব মেনে বেঁচে থাকি।

আমাকে তুমি ছুটি দিয়েছো, অথচ আমি সেই ছুটি অনুভব করতে পারি না। ছুটির কী নিদারুণ অপচয়।

বৃষ্টির দিন শেষ, আশ্বিনের কুয়াশায় ভোর হয়, তিন শালিকের ঝগড়ায় ঘুম ভাঙ্গে। একলা রাত জাগার কথা তখন আর মনে থাকে না। কেন জাগি, জিজ্ঞেস কোরো না।




Thursday, September 11, 2014

আলো ছায়ার গদ্য

১.
এক সময় রুটিন বদলে যাবে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। একসময় পৃথিবী বদলে যাবে স্বেচ্ছায়। খোদ সময় বলে সে চলে না কারো ইচ্ছায়। একসময় একা থাকলেও খারাপ লাগবে না। সবকিছু থেকেও তো মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। সবকিছু পেয়েও শূন্যতা বুকে বাজে। নির্ভরশীলতার দায় নেই। তবু স্বেচ্ছা নির্ভরশীলতার দায় চাপিয়ে দেই ফাঁকা জানালায়। যে জানালা আকাশ মেঘ বৃষ্টি আর ঝোপ জঙ্গলের আদিম সুঘ্রাণ বয়ে আনে, সেই জানালা কখনো কখনো দুঃস্বপ্নের অনাদরও বয়ে আনে। আমি কি সব জানি, আমি কি সব জানি? আমাদের যতটা জানানো হয় ততটা জানি। সংবাদে প্রকাশিত অংশটুকুই। না জানা অংশটা চমকে যাবার মতো। কখনো না জানাই ভালো। সবটুকু বলা হয় না, শোনার সময় থাকে না, কিংবা ধৈর্য। একসময় রুটিন বদলে যাবে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। স্মৃতি তখন পুরাকীর্তি। সময় হয়তো কীর্তিনাশা। নাটকের একাংশে সাজানো স্ক্রিপ্ট, অসমাপ্ত বই, ভুল গানের অনাচার, দীর্ঘশ্রুত মিথ্যা, অসময়ের ছেদবিন্দু, প্রতিটি সম্পর্কহীন দৃশ্য, অপাত্রের ফুটো দিয়ে গড়িয়ে হারিয়ে যায়। বিস্মরণ যখন অনন্ত আশ্রয়,তখন তোমার বিলম্বিত উপস্থিতি। শেষ কথাটি বকেয়া থেকেই যাবে।

২.
একটা সত্যি প্লেনের বায়না ধরেছো। আগের প্লেনটি বাতাস ভর্তি শুধু। ভেতরে কিছু নেই, মাকাল ফলটি। দেখতে বড়ো, উড়তে অক্ষম। এখন একটি সত্যি প্লেন আসছে। সত্যি সত্যি, তিন সত্যি। দেখতে ছোট, উড়তে পারে। অনেক দূরে নেবে তোমায়। শুধু রিমোট সামলে রেখো। যাবার আগে আগের প্লেনের বাতাস ছেড়ে ভাঁজটি করে দেরাজে ঢুকিয়ে রেখো। কখনো যদি বিনা বাধায় স্বাধীন কোথাও উড়তে ইচ্ছে করে, ভাজটি খুলে গ্যাস বেলুনের বাতাস ভরে আকাশ জুড়ে পাখা মেলো।

৩.
ওটা এক চিরচেনা ঠাঁই। এই কিছুকাল আগেও। ওখানে শুধুই সবুজ। ভেতরে বাইরে সবখানে। ছিল ছায়া, এলোমেলো ডালপালা জঙ্গল, তরতাজা ভোরের শিউলি, মাধবী লতায় রোদের ঝিলিক। পথিকের মেঠোপথ। মহাসড়ক সুদূর স্বপ্ন। ঘাসের গালিচায় আলোর বিকেল। রাত্রিসজ্জায় জ্যোৎস্নার নকশা। ছায়াপথের আলোয় ঘুমের আয়োজন। এক বাড়ি নিঝুম। ওই ঠাঁই, এই নির্জনতা আমার খুব চেনা। আমি তাদের কখনোই ভুলি না। আমি রাখলেও মহাকাল এসব কিছুই মনে রাখবে না।

৪.
বইটা যথেষ্ট ভালো, কিন্তু মলাট ভালো না। শুধু মন্দ মলাটের জন্য একটা ভালো বই নষ্ট হয়ে যাবে।


Wednesday, September 10, 2014

হাসির কথা না

১.
আমার এক স্প্যানিশ বন্ধু ছিল পেরুতে। মাঝে মাঝে এমএসএন চ্যাটে কথা হতো তার সাথে। কোন কোন আড্ডায় মজার কথা শুনে সে "যা যা যা যা... করতো"। আমি প্রথমে ভাবতাম সে আদর করে যাহ দুষ্টু টাইপ কিছু বলছে। পরে মনে হলো সে তো বাংলা জানে না, তাহলে? ইংরেজিতে 'যা যা...' করার মানে কি?

আরো অনেক পর স্প্যানিশ শিখতে গিয়ে বুঝলাম আসলে ওটা ছিল হাহাহাহাহা। ইংরেজিতে আমরা লিখি hahahaha, ওরা লেখে jajajajaja স্প্যানিশে h উচ্চারণ হয় j দিয়ে। ভাগ্যিস এই গাধামিত্ব কেবল নিজের ভেতরেই ছিল।

২.
নানান কাজে দীর্ঘদিন ধরে শহরের একটা নামকরা অফিসে যেতাম মাঝে মাঝে। কয়েকবার টয়লেট ব্যবহারও করেছি সেই অফিসের। অফিস বড়, তাই তাদের টয়লেট কমপ্লেক্সও বড়সড়। মজার ব্যাপার ছিল টয়লেটে লাগানো স্টিকারগুলো। এগুলো  মাঝে মাঝেই বিবর্তিত হয় বছরখানেক পরপর। প্রতিটা পরিবর্তনের পর আমি বুঝতে পারি ওই অফিসের লোকেরা কি চরিত্রের।  যতটা মনে আছে শুরু থেকে স্টিকারগুলো  সময়ক্রম অনুসারে সাজিয়ে লিখেছি এবং ব্র্যাকেটে আমার তাৎক্ষণিক ভাবনাগুলো লিখেছি।

- কমোডে পা রাখিবেন না (তার মানে তখন কিছু লোক হাই কমোডে পা রেখে বাথরুম সারতো)
- দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করিবেন না (তার মানে এখানে কিছু লোক দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করে)
- ব্যবহারের পর কল বন্ধ করুন (তার মানে এখানে কিছু লোক বাথরুমের কল বন্ধ না করে চলে আসে)
- ইউরিন প্যানে টিস্যু ফেলিবেন না। (তার মানে এখানে কিছু লোক ইউরিন প্যানে টিস্যু ফেলে)
- দেয়ালে প্রশ্রাব করিবেন না (তার মানে এখানে কিছু লোক দেয়ালে প্রশ্রাব করে!!!)
- বাথরুম ব্যবহারের পর ফ্ল্যাশ করুন (তার মানে এখানে কিছু লোক ফ্ল্যাশ করে না)
- প্রশ্রাব করলে বদনার পানি ব্যবহার করুন। পায়খানা করলে ফ্লাশ ব্যবহার করুন (এবার সাফ ফেল্টু খেলাম। আমার কোন ভাবনাই তল পেলো না)

আমি কৌতুহল চাপতে না পেরে ওই অফিসের একজনকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, ঘটনা কি ভায়া?
সে বললো, হঠাৎ করে কোম্পানীর পানি সংকট দেখা দিয়েছে। ফ্ল্যাশ আইন হবার পর থেকে সবাই কথায় কথায় ফ্ল্যাশ করে পানি শেষ করে ফেলতো। এক ছটাক পেশাব করেও বিশ লিটার পানি ঢেলে দিত ফ্ল্যাশ করে। পানি সংকট নিরসনে বাধ্য হয়ে কতৃপক্ষ  বদনা আইন জারি করেছে এবং ফ্ল্যাশ ব্যবহার সীমিত করেছে।

ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম, এরপর কি ওই কোম্পানী সিসিটিভি লাগাবে বাথরুম কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে?


Monday, September 8, 2014

অসম্পূর্ণ গল্পের ভূমিকা

১.
তোমার অনিন্দ্য সুন্দর চোখ দুটি মেলো।
এদিকে চোখ তোলো।
এই দেখো-
তাকিয়ে দেখো খুব ভালো করে
তোমার পাশে একজোড়া নতুন হাত।
তোমার বাঁধানো সুখের শস্যখেত থেকে
কষ্টের আগাছাদের উপড়ে ফেলতে প্রস্তুত সেই দুটি হাত।
তোমার মাথার চুলে বিলি কাটছে যে দুটো হাত।
তার সেই বেদনার্ত বুক ক্ষতি ভুলে আগলে রাখছে তোমার যত কষ্ট।
লুকিয়ে ফেলো তোমার অঝোর কান্না সেই আড়ালে।
আর কোন কষ্ট তোমাকে কুঁকড়ে খাবে না।
যতদিন সে জীবিত আছে
এই সময়, সেই সময়,
সে আছে তোমার পাশেই!
দেখো, তোমার অনিন্দ্য সুন্দর চোখ মেলে দেখো, আমি আছি!


তারিখটা বোধহয় ১৭ জুলাই ২০১০। এটিকে পদ্য মনে হলেও এটি আসলে সংলাপ সিঁড়ি। যার জন্য লেখা সে যোজন যোজন দূরে। তার সাথে কখন দেখা হবে সে জানে না। আদৌ হবে কিনা। প্রতিদিন তবু অনুভুতির প্রজাপতিরা বাগানে উড়ে উড়ে নিঃশব্দে স্মৃতি এঁকে যায়।

২.
তবু কোথাও থেকে এক অচেনা ভাবনা এসে জুড়ে বসে। 

"শুরুই তো নেই, শেষ কি করে হবে। আসলেই কী তাই? আমি এভাবে ভাবি না। শুরুর তারিখটা আমার জানা নেই তবে শেষ যে হয়নি সে আমি জানি। আমার কাছে তাই ব্যর্থতার কোন হাহাকার নেই। বরং আছে সফলতার আনন্দ। দুজন মানুষ যুগ যুগ ধরে সফলভাবে একটা পবিত্র সুন্দর অনুভুতিকে লালন করেছে পৃথিবীর কোন অনিষ্ট না করে। এই সাফল্যের কথা আমি অস্বীকার করি কি করে? পাওয়া কি সবসময় শুধু দৈহিক পাওয়াই হয়? আমার কাছে তার চেয়ে আত্মিক পাওয়া যে অনেক বড়। আমি যে আত্মিক সফলতা অর্জন করেছি এটা তো আমার পৃথিবীর অন্যতম সুখের বিষয়। আমার বুকে তাই হারিয়ে ফেলার হাহাকার বাজে না। আমি যখন পথ হাঁটি তখন মাথার অনেক উপরে ভেসে থাকা মেঘের মধ্যে আমি দেখতে পাই সেও আমার সাথে সাথে উড়ে যাচ্ছে। আমি একটা নক্ষত্রগামী ফড়িং এর মতো ওর পাশে পাশে উড়তে থাকি হাওয়ায় হাওয়ায়। মেঘেরা আমাদের ছায়া দিয়ে পথ দেখায়। ওই আকাশের বিশালতায় ছড়ানো আছে আমাদের প্রাপ্তি। যে পথে সে একদিন হেঁটেছিল আমি এখনো সেই পথে হেঁটে যাই। তার পদস্পর্শ পৃথিবীর যতগুলো ধুলো ছুয়েছে তার সবকিছুই আমি যেন ছুঁতে পাই। আর সেই সাথে পেয়ে যাই তাকেও। তুমি কখনো হারাবে না আমার কাছ থেকে। সেই রূপে আমাদের কখনো দেখা হবে না হয়তো আর, কিন্তু তোমার স্মৃতির ছায়াগুলো আমার সঙ্গী হয়ে থাকবে সারাজীবন। এ আমার অনুপম আনন্দ। কাছে থাকা মানে পাশে বসে থাকা না। অনেক দূর থেকেও পাশে থাকা যায়। আমি জানি আমি জানি। আমি তো অনুক্ষণ পাশে থাকি অদৃশ্য মায়ায়।"

৩.
পাল্টে যাওয়া সময়ে এসে সেই গানটা আবারো হাজির হয়।

"অমরত্বের প্রত্যাশা নেই নেই কোন দাবী দাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া
মুহূর্ত যায় জন্মের মতো অন্ধ জাতিস্মর
গত জন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি বিস্মৃত অক্ষর
ছেঁড়া তাল পাতা পুঁথির পাতায় নিঃশ্বাস ফেলে হাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া

কাল-কেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি
বেহুলা কখনো বিধবা হয় না এটা বাংলার রীতি
ভেসে যায় ভেলা এবেলা ওবেলা একই শবদেহ নিয়ে
আগেও মরেছি আবার মরবো প্রেমের দিব্যি দিয়ে

জন্মেছি আমি আগেও অনেক মরেছি তোমারই কোলে
মুক্তি পাইনি শুধু তোমাকে আবার দেখবো বলে
বার বার ফিরে এসেছি আমরা এই পৃথিবীর টানে
কখনো গাঙর কখনো কোপাই কপোতাক্ষর গানে
গাঙর হয়েছে কখনো কাবেরী কখনো বা মিসিসিপি
কখনো রাইন কখনো কঙ্গো নদীদের স্বরলিপি
স্বরলিপি আমি আগেও লিখিনি এখনও লিখিনা তাই
মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে শুধু তোমাকেই চাই

তোমাকে চেয়েছি ছিলাম যখন অনেক জন্ম আগে
তথাগত তার নিঃসঙ্গতা দিলেন অস্তরাগে
তারই করুনায় ভিখারিনী তুমি হয়েছিলে একা একা
আমিও কাঙাল হলাম আরেক কাঙালের পেতে দেখা
নতজানু হয়ে ছিলাম তখন এখনো যেমন আছি
মাধুকরী হও নয়নমোহিনী স্বপ্নের কাছাকাছি

ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড কর প্রেমের পদ্যটাই
বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই

আমার স্বপ্নে বিভোর হয়েই জন্মেছ বহুবার
আমি ছিলাম তোমার কামনা বিদ্রোহ চিৎকার
দুঃখ পেয়েছ যতবার জেনো আমায় দিয়েছো তুমি
আমি তোমার পুরুষ আমি তোমার জন্মভূমি
যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা
কতো সন্তান জ্বালালো প্রেয়সী তোমার আমার চিতা

বার বার আসি আমরা দুজন বার বার ফিরে যাই
আবার আসবো আবার বলবো শুধু তোমাকেই চাই"


আমার প্রিয় বেশ কিছু গানের মধ্যে কোন না কোন সময়ের স্মৃতি জড়িত। এই গানটা যখন প্রথম শুনি তখন খুব মন দিয়ে মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করিনি। গানের সুর এবং গায়কীর দিকেই মনোযোগ ছিল বেশী। কিন্তু আরো বিশ বছর পর যখন গানটা শুনলাম, তখন ভিন্ন একটা সময়। পৃথিবীর অনেক কিছু বদলে গেছে। বদলে গেছে আমার নিজের জীবনটাও। ঠিক তখন এই গানটা সিনেমার মধ্যে শুনলাম আবার এবং আবিষ্কার করলাম এই গানটা কার জন্য লেখা। এত বছর পর গানের সমস্ত কলি লাইন লাইন ধরে শুনে বুঝলাম এটা কেবলই তোমার জন্য। জাতিস্মর সিনেমায় দেখার পর প্রিয় গানের মধ্যে এই গানটা নতুন মাত্রা নিয়ে আরো প্রিয় হয়ে গেল। শুনে খুব ছেলেমি হয়ে যাচ্ছে বলবে তাই না? আমি জানি। তবু এই গানে আমি তোমাকে খুঁজবো। আমার না পাওয়া সুখ, না হওয়া প্রেম সবকিছুর অস্তিত্ব এই গানের প্রতিটা ছত্রে লুকিয়ে আছে। তোমাকে পাওয়া হবে না বলে যে আক্ষেপ ছিল সেই আক্ষেপের ক্ষতের উপর মলম হয়ে গানের কলিগুলো আমাকে শান্ত্বনা যোগাবে।

আমি আসলে একটি চিঠি লিখতে চেয়েছিলাম কোন অনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে। চিঠিটা লেখা হলো না। কেননা-
Time passes slowly up here in the mountains
We sit beside bridges and walk beside fountains
Catch the wild fishes that float through the stream
Time passes slowly when you're lost in a dream

Thursday, September 4, 2014

এনায়েত মওলার 'কাকলী' এবং একাত্তরে চট্টগ্রামের অবস্থা নিয়ে ইতিহাসপাঠ

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মিথ্যাচার নতুন কিছু না। এতে ইতিহাস লেখক, গবেষক, রাজনীতিবিদ, সবারই কিছু না কিছু দায় আছে। সরল মনে পড়লে যখন যার বই পড়ি তার তথ্যই সঠিক বলে ভাবতে ইচ্ছে করে, আবার ক্রিটিকাল মুডে পড়তে বসলে কাউকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। এটা একটা সমস্যা। তাছাড়া কোনটা ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচার কোনটা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাচার সময়ের সাথে তা ঝাপসা হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের অনেক লেখক জীবিত নেই। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যাও কমে আসছে। আগামী বিশ বছর পর হয়তো একদম শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। তখন মিথ্যার বেসাতি খুলে বসতে সুবিধা হবে মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ীদের। বলতে খারাপই লাগে এদেশে ধর্মব্যবসায়ী যেমন আছে তেমনি মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ীও আছে। এরা প্রত্যেকে নিজ নিজ পছন্দের ব্যাপারে খুব স্বার্থপর। লিখিত বইপত্রে যার প্রতিফলন ঘটে কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের মাধ্যমে।

এই বেসাতি বন্ধের জন্য বর্তমান প্রজন্মকে সতর্কতার সাথে ইতিহাস পড়তে হবে। গল্প আর ঘটনার মধ্যে ফারাক করার ক্ষমতা থাকতে হবে। সেই ক্ষমতা অর্জনের জন্য অল্পবিস্তর পড়াশোনা করা দরকার। ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার বন্ধ করা অসম্ভব জেনেও আমি চেষ্টা করছি অন্ততঃ চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাগুলোর একটা সমন্বয় ঘটাতে। একই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন লেখক তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখেছেন, সেই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সঠিক তথ্য বের করাই এই সমন্বয় প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য।

সেই লক্ষ্যে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইপত্র সংগ্রহ করার আরেকটি চেষ্টা করছি। আমার সংগ্রহে যা আছে তা যথেষ্ট নয় বলে মনে হচ্ছে। যত বেশী প্রত্যক্ষদর্শীর বই পাওয়া যাবে তত বেশী তথ্যসুত্র মিলবে। লেখক জীবিত থাকলে সরাসরি কথা বলতেও আগ্রহী। ক্রস চেকিং এর মাধ্যমে অনেক ঘটনার সত্যমিথ্যা যাচাই করা যাবে। এসব বই থেকে ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে, তৎকালীন অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।

বুঝতেই পারছেন চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের তালিকা করার ব্যাপারে সাহায্য চাইছি। বইয়ের নাম, এমনকি কেউ স্ক্যান বা পিডিএফ ডকুমেন্ট/বই দিলেও বাধিত থাকবো।


========================

উপরের লেখাটা স্ট্যাটাস আকারে ফেসবুকে বইপড়ুয়াতে দিলাম। কিছু বইয়ের খোঁজ দরকার জরুরী ভিত্তিতে।

ঘটনা হলো, গতকাল এনায়েত মওলা নামে এক অচেনা ভদ্রলোকের লেখা বই "মুক্তিযুদ্ধের ভিন্নছবি- চট্টগ্রামের কাকলী" পড়ে গতরাতে আমি ছটফট করেছি। বইটাকে বিশ্বাস করলে অনেক কিছুর উপর অবিশ্বাস আসে, আবার বইটা নিয়ে বিভিন্ন রেফারেন্স পড়ে অবিশ্বাসও করতে পারছি না। কে কতটা সত্যি বলছে সেটা নির্ভর করে ব্যক্তির রাজনৈতিক অবস্থানের উপর। যদিও ভদ্রলোক বলেছেন তিনি রাজনৈতিক নিরপেক্ষ লোক, কিন্তু আসলে সেটা কি সম্ভব? বইটার মধ্যে মাথাব্যথা হবার মতো বেশ কিছু উপাদান আছে যার সত্যতা যাচাই করার জন্য আমার অনেক বই পড়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চট্টগ্রামের এত বই পড়েও এনায়েত মওলার কোন হদিস পাইনি, ঘটনা বুঝলাম না। কিন্তু কাকলী যে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ছিল সেটাও সত্যি। অপারেশান জ্যাকপটে নৌকমাণ্ডোরা ওই বাড়িতে উঠেছিল। ওই বাড়ির মালিক এনায়েত মওলা। ভদ্রলোক পাকিস্তানীদের ফাঁকি দিয়ে পুরো সময়টা কিভাবে কাটিয়ে দিলেন সে এক রহস্য। বইতে যদিও লিখেছেন কিভাবে কি করেছেন, তবু প্রশ্ন থেকে যায়। একাত্তরে এরকম অলস অবসরে কাটিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে গেছেন, ব্যাপারটা প্রায় অবিশ্বাস্য।

যদি তাঁর দাবী মতে একাত্তরের ওই ভূমিকা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তাকে অরাজনৈতিক মহত্বে ভূষিত করতে হয় একাত্তরের অবদানের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তখন দুটো দল। ফ্রিডম ফাইটার বা এফ এফ, বাংলাদেশ লিবারেশান ফোর্স বা বিএলফ। শেষোক্তটি চার খলিফার তত্ত্বাবধানে চলতো, আর প্রথমোক্ত চলতো সেক্টর কমাণ্ডারদের নির্দেশনা অনুযায়ী। এই দুই দলে আবার বিবাদও ছিল, পরস্পর খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে। এনায়েত মওলা সেই বিভেদগুলোর কথা বলেছেন স্পষ্টভাবে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা যেসব বই লিখেছেন তাতে এই দ্বন্দ্বের উল্লেখ থাকতে দেখি না। এসব ব্যাপার পড়ে এনায়েত মওলার রাজনৈতিক অবস্থান জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠেছি। কিন্তু ভদ্রলোক এখন বেঁচে আছেন কিনা জানি না। কোথায় থাকতেন তাও জানি না। তাঁর বইটা প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে আজ থেকে ২১ বছর আগে। আমি অন্ততঃ চাই তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে তেমন কারো সাথে কথা বলতে। রেডিওর একজন নাজমুল আলমের কথা উল্লেখ করেছেন, তিনিও বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আমাকে তথ্য যাচাইয়ে পথে নামতে হবে মনে হচ্ছে।

Wednesday, September 3, 2014

আই লাভ মাই chum

আমি নিশ্চিত কমপক্ষে ৯৫% পাঠক শিরোনামের ইংরেজী শব্দটার সাথে পরিচিত নন। ডিকশেনারী না খুলে শব্দটার অর্থ বলতে পারবেন খুব কম মানুষ। যারা পারবেন আমি প্রায় নিশ্চিত তাদের ঘরে নার্সারি কেজি পড়ুয়া বাচ্চা আছে।

শব্দটির সাথে আমিও পরিচিত ছিলাম না দুদিন আগেও। এই শব্দটা না জানার কারণে সারাজীবন আমার কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। আমার ধারণা এই chum শব্দটার অর্থ একজন মানুষ সারাজীবন না শিখলেও কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু ক্লাস টুতে পড়ুয়া বাচ্চাটি এই শব্দ না জানার কারণে স্কুলে বকুনি খাবে হয়তো নাম্বারও পাবে না। আমার কন্যা একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। আমাকে তাই শব্দটা ডিকশেনারী খুঁড়ে বের করতে হয়েছে। 

এটি একটা মাত্র তুচ্ছ উদাহরণ। এরকম আরো ডজনে  ডজনে অপ্রয়োজনীয় শব্দ স্কুলের ইংরেজী বইগুলোতে গিজগিজ করে। সবাই জানি আমরা, তবু কেউ প্রশ্ন করছি না, কেন এই অপ্রয়োজনীয় ইংরেজী শব্দ আমাদের শিখতে হবে? কেন ওসব বই আমাদের সন্তানদের পড়াতে হবে। বাচ্চা লেভেলের ইংরেজী শেখার জন্য একটা বই লিখতে পারে না সেদেশে এত ইংরেজী স্কুল অনুমতি পায় কি করে?

এই chum শব্দের মানে দোস্ত বা বন্ধু। Radiant Reader বইতে শব্দটা পেয়েছি। আরো অনেক ইংরেজী বইয়ের মতো Radiant Reader নামের বইটার আদি প্রকাশও ইংল্যাণ্ডের কোন প্রকাশনী থেকে, সেটি এখন ভারত ঘুরে বাংলাদেশের স্কুলে বাচ্চাদের পড়ার টেবিলে ঠাঁই নিয়েছে। এসব বইতে অদ্ভুতুড়ে সব শব্দ আছে। যেসব শব্দ সতেরো শতকে ইংল্যাণ্ডের কৃষকেরা ব্যবহার করতো সেসব শব্দ আজো কেন বাংলাদেশের ছাত্রদের পড়তে হবে, আমার মাথায় আসে না।

স্কুলগুলোকে বলছি, আমাদের দেশে শিক্ষিত লোকের এত অভাব যে বাচ্চাদের ইংরেজী শেখার বইও আমদানী করে পড়াতে হবে? যে ইংরেজী বই আপনারা লেখার ক্ষমতা রাখেন না, সেটা বাচ্চাদের পড়াতে দেন কোন মুখে?

সরকারকে বলছি, আপনারা দেশে যেখানেই গণতন্ত্রের চাষবাস করুন না কেন অন্ততঃ শিক্ষা ক্ষেত্রে এসব গণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন। পড়াশোনা ভালো জিনিস হলেও অপ্রয়োজনীয় বইপত্র মেধা, অর্থ সময়ের প্রচুর অপচয় করে।