১.
অনেক কিছু আগের মতো থাকবে না। সময়, জীবন, পৃথিবী। বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন। একটু একটু করে। আগামী কালের কথা জানি না। আজকের দিনেই থাকি। আজকের সম্পূর্ণ দিনটাও হাতে নেই। আছে কেবল এই মুহুর্তটা। এখন ঘড়িতে সময় ১১টা বেজে ১৯ মিনিট। আমি যে টেবিলে কাজ করছি সেখানে একটা কম্পিউটার একটা টেলিফোন দুটো কলম, একটা ক্যালকুলেটার, একটা টেলিফোন, একটা মোবাইল, কিছু ফাইলপত্র, একটা কার্ডহোল্ডার, একটা ডেস্ক ক্যালেণ্ডার, একটা চশমার খাপ, একটা সিডি, দুটো ডায়েরী একটা পত্রিকা আছে। এদের প্রত্যেকে আমার বর্তমান সঙ্গী। নীরব সঙ্গী বলা চলে। কেননা আমার টেলিফোনটা দৈনিক মাত্র কয়েকবার বাজে। কোন কোনদিন একবারও বাজে না। বাইরের কোন ফোন আসে না তেমন। যা আসে সব অফিসেরই ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ইন্টারকম। আমার মোবাইল এই অফিসের সবচেয়ে নিষ্ক্রিয় যন্ত্র। এটা আমার কাছে সবসময় থাকে ঠিকই কিন্তু ব্যবহার সবচেয়ে কম। আমাকে খুব বেশী মানুষ ফোন করে না। আমিও করি না। খুব ঘনিষ্ট বন্ধু বা পরিবারের বাইরে কোথাও কল আসা যাওয়া করে না। আমি আগে হাতে ডায়েরী লিখতাম এখন লিখি কম্পিউটারে। বাংলা শিখেছিলাম বলে তৃপ্ত এখন। আমি আজকের দিনে এই মুহুর্তের কথা জানি। আমি বিকেলের কথা জানি না, দুপুরের কথা জানি না, মাঘ নিশীথের কথা জানি না। আমি এই মুহুর্তে বসে বসে লিখছি, আমার টেবিলের সামনের সাদা টাইলসে এক ঝলক শীতের রোদ্দুর, জানালা দিয়ে দূরের পাহাড়ের ধোঁয়াশা আর বন্দরে নোঙর করা বিদেশী জাহাজ দেখতে দেখতে ভাবি আজকেও প্রতিদিনের মতো একটা দিন। আমি একটু একটু করে মানবিক গুনাবলী হারিয়ে পথের ধুলোয় বসে পড়ার জন্য দিন গুনছি।
২.
প্রযুক্তির সাথে দৌড়ে পারা যায় না। বই ছাড়া অন্য সবকিছু প্রযুক্তির আওতায় চলে এসেছে। গান শোনা, ছবি তোলা, মুভি দেখা। শখের মধ্যে এই কটা। গান মোবাইলে চলে এসেছে, ছবিও। তবে মোবাইল ছবি পছন্দ না। পছন্দ না হলেও সুযোগটা দেয়া আছে মোবাইলে। কথা বলা ছাড়া মোবাইলে আমি শুধু গানই শুনি। আর মাঝে মাঝে গুগল ম্যাপ। ক্যামেরাও প্রযুক্তির চরমে। দশ বছর আগে যে ক্যামেরা কল্পনাতীত ছিল। অনেক দামী ক্যামেরায় যা ছিল না তা অনেক সস্তা ক্যামেরায় চলে এসেছে। ছবি তোলা নয় কেবল, ভিডিও করাও সম্ভব। এবং দেখা গেছে ভিডিও কোয়ালিটি সাধারণ হ্যাণ্ডিক্যামের চেয়ে অনেক ভালো। এবং সেটা ৩২ ইঞ্চির এলসিডি মনিটরে হাই ডেফিনিশানের ঝলকানিতে প্রকাশ করে। এলসিডিও পুরোনো প্রযুক্তি হয়ে যাচ্ছে এলইডি আসার পর। তবু দামের পার্থক্যের কারণে এলসিডির দিকেই গেলাম। আমার দরকার ছিল বড় পর্দায় মুভি দেখা। ল্যাপটপে মুভি দেখতে দেখতে চোখটা ঘষা কাঁচ হয়ে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল একটা প্রজেক্টর কেনার। কিন্তু প্রজেক্টরের দাম যতটা মাথাব্যথা দিচ্ছিল তার চেয়ে প্রজেক্টরের সুযোগহীনতা আরো বেশী। মানে আমি যেরকম চাইছিলাম সেরকম প্রজেক্টর বাজারে নেই। আমি চাইছিলাম ছোট্ট একটা প্রজেক্টর যেটায় পেন ড্রাইভ থাকবে, যেটায় স্পীকারও থাকবে। ফলে আমি সরাসরি পেনড্রাইভ থেকে মুভি দেখতে পাবো। আমার একটা ইউএসবি হার্ডড্রাইভ আছে যেখানে কয়েকশো মুভি জমা। অদেখা মুভিগুলো বড় পর্দায় দেখার জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম। Sony Bravia আমাকে সব ঝামেলা থেকে মুক্তি দিল। এটায় সবকিছু আছে যা যা আমি এতদিন ধরে খুঁজছিলাম। এখন আর ডিভিডি, ল্যাপটপ কিছুই লাগে না। মুভি দেখার জন্য এর চেয়ে আরামদায়ক যন্ত্র আর হতেই পারে না। তবে ইউএসবি না থাকলে এই টিভি আমার কোন কাজেই আসতো না। এটাতে আমি টিভির কোন অনুষ্ঠান দেখি না। শুধুই মুভি। সেদিন একজন বললো, কিনলাম যখন ইন্টারনেট টিভি কিনলাম না কেন। একসাথে ইউটিউবও দেখার সুযোগ পেতাম। দরকার নাই অত সুযোগের। সরকার তো ইউটিউবে তালা লাগিয়ে রেখেছে। তার চেয়ে আমার হার্ড ড্রাইভের মুভিগুলোই চলুক। চলছেও তাই।
৩.
ফ্রেমে বাঁধা একেকটা দিন। ফ্রেমে বাঁধা একেকটা মানুষ। ফ্রেমে বাঁধা একেকটা জীবন। কেউ কেউ ফ্রেম বিচ্যুত হয়। আমার ফ্রেমে গিয়ে বসে। কেউ কেউ ফ্রেমে গিয়ে বসতে পারে না। নিজেকেই তখন অচেনা লাগে। ছাদের আকাশে কয়েকটা নক্ষত্রের সাথে একটা উপগ্রহ। ঘুমোবার আগে চোখ মেলে দেখে তারাগুলো পাহারা দিচ্ছে। একদিন উপগ্রহ চাঁদ খসে পড়লো আলগা হয়ে। সেদিন থেকে জ্যোৎস্নার বদলে মোমের আলো। মোমের আলোয় কবিতা পাঠ হয়, মোমের আলোয় মানুষ চেনা যায়। মোমের আলো জ্যোৎস্নার অভাব ঘোচাতে পারে না, ভুলিয়ে রাখতে পারে। ভোলাটাই দরকার। অন্ধকার দিখণ্ডিত হয় তখন।
No comments:
Post a Comment