Sunday, July 24, 2011

একটি চাল-চিনি বিষয়ক গাল-গল্প

[i]কোথাও ভাত নেই। সাদা কালো লাল হলুদ কোন রকমের চাল বাজারে নেই। মানুষ রাস্তায় রাস্তায় হন্যে হয়ে ঘুরছে একমুঠো ভাতের জন্য। কেউ পকেটে টাকা নিয়ে, কেউ হাতে ভিক্ষার থালা নিয়ে। ধনী-দরিদ্র-ফকির-মিসকিন সব এক হয়ে গেছে, কেউ ভাত খেতে পারছে না। চালের আড়ত থেকে উধাও হয়ে গেছে চালের বস্তাগুলো। চাল বণিক আড়ত বন্ধ করে বাড়ি চলে গেছে।

এরকম আজগুবি কান্ড দেশের লোক কখনো দেখেনি। রাজার হুকুম অমান্য করা! কিন্তু সত্যি রাজার হুকুমেই ক্ষেপে গেছে বণিক। রাজা বলেছে হয় সুলভ মূল্যে চাল বিক্রি করো, নয়তো পাজামা খুলে শুলে চড়ো। চাল বণিক বলেছে উচ্চমূল্যে চাল আমদানি করে সুলভ মূল্যে ভাত খাওয়াতে পারবে না ওরা। শূলে চড়ার ভয়ে চালই রাখলো না আড়তে।

রাজার মোটা চামড়ায় একটু গোস্বা লাগলেও কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কারণ বনিকের টাকা রাজার শান শওকতের উৎস। তাছাড়া দেশে গণতন্ত্র, যার যা কিছু ইচ্ছা করার স্বাধীনতা। এবং সবচেয়ে বড় কথা রাজা-উজিরের চাল কিনতে হয় না। বণিক দিনের বেলা ঝগড়া করেও রাতের বেলা তাদের বাড়ি বাড়ি চালের বস্তাগুলো পৌঁছে দেয়।

চাল বিক্রি বন্ধ হওয়াতে রাজা বরং মনে মনে খুশী। এক মাস ভাত বন্ধ রাখতে পারলে অনাহার অপুষ্টিতে দেশের কয়েক লাখ লোক মরে ঠেসে যাবে, জনসংখ্যার বাড়তি চাপটা কমবে। কিন্তু দোষটা হবে বণিকের।

রাজা তৃপ্তির সাথে আরো ভাবলো, এই মড়াগুলো বরং জীবিতগুলোর চেয়ে সুখে থাকবে। যারা অনাহারে মরে তারা শহীদের মর্যাদা পায়, পরকালে গিয়ে তারা পোলাও-কোর্মা-রোষ্ট-রেজালার সাথে স্বর্গীয় দই-হালুয়া-মিঠাই-মণ্ডা খাবে। আর জীবিতগুলা ঠাসাঠাসি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে একটু হাত পা নেড়ে বাঁচতে পারবে।

চাল সংকটে পৌর কতৃপক্ষও বিশেষ আনন্দিত। কারণ এত এত লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলতে কদিন পরিশ্রম হলেও আজীবন তাদের গু-মুত নিয়ে ভাবতে হবে না। অনাহারী মানুষেরাই নগরের সবচেয়ে নোংরা বিষয়, সৌন্দর্য-হানির প্রধান কারণ।

সুতরাং অনাহারী জনতার ব্যাপক মরণাপন্ন হাহাকার দেখেও বেয়াড়া বণিকের শাস্তির ব্যাপারে কোতোয়ালকে কিছুই বললেন না রাজামশাই।[/i]

....................................................................................................................................................

দিন পনেরো আগে ফিরিঙ্গি বাজার ব্রীজঘাটার কাছে দেলু মিয়ার চায়ের দোকানে বসে একটা নিমকি ভেঙে চায়ের কাপে চুবিয়ে খেতে খেতে অচেনা পরিব্রাজকের কাছে এই গল্পটা শুনে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল রহিম শেখ। ঘরে গিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ভেবেছে, এমন আজব দেশও দুনিয়াতে আছে! ভাগ্যিস সেরকম দেশে তার জন্ম হয় নাই। আবার ভাবলো, নাহ এরকম হতেই পারে না। ব্যাটা নিশ্চয়ই মস্ত চাপাবাজ। তাকে মূর্খ ভেবে যা তা গল্প করে গেছে।

গতকাল সন্ধ্যায় এক পোয়া চিনি কিনতে বেরিয়ে সারা বাজার ঘুরে একটা দোকানেও চিনি পেল না। দোকানীরা জানালো ওরা আর চিনি বিক্রি করবে না। কারণ সরকার চিনির ন্যায্য মূল্য বেঁধে দিয়েছে। ওই দামে চিনি বিক্রি পোষাবে না, বিক্রির অপরাধে শাস্তি মেনে নিতে পারবে না। তাই চিনি বাজার থেকে উধাও।

রহিম শেখের মাথাটা চক্কর মারলো হঠাৎ। দেলুমিয়ার চায়ের দোকানে শোনা গল্পটা এতদিন বাদে পুরোপুরি বিশ্বাস হতে শুরু করেছে।

Saturday, July 23, 2011

প্র-ভা-ত

প্রভাতের অপেক্ষায় থাকা শিশিরকণাটি শুকিয়ে যায় ভোরের সূর্যের তাপেই, পরবর্তী শিশিরকণা তবু প্রতীক্ষা করে আরেকটি ভোরের।

Sunday, July 17, 2011

গাচ্ছাতা

বাস থেকে নেমে পূব দিকে যে পাকা রাস্তাটা চলে গেছে, সেদিকে মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে মাইল দুয়েক গেলেই বন্য হাতির এলাকা। কয়েকশো বর্গমাইল জুড়ে আদিম অরণ্য, বন্যপ্রানীদের স্বাধীন বিচরণ। পাহাড় থেকে এঁকেবেঁকে নেমে এসেছে স্বচ্ছ জলের ঝরনা। একদা হরিণের পদচারণা ছিল ঝরনার কিনারে। এখন তারা আরো গহীনে হারিয়ে গেছে। তার বদলে কেবল ক্ষুধার্ত হাতির দলই নেমে আসে মাঝে মাঝে। এই পথটা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষদের। আমি নিরাপদ অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় লোক হলেও এই বরষায় ওদিকটায় যেতে ভরসা পাচ্ছি না। আজ বরং উল্টোদিকে যাই, যেদিকে দুপেয়ে সভ্য মানুষের বসতি।

প্রধান সড়কে খরনা রাস্তার মাথায় নেমে পশ্চিমদিকে যে ইট বিছানো পথটা গেছে সেদিকে হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে তিনশো গজের মতো গেলেই লোকালয়, মানুষের কাঁচাপাকা ঘরবসতি, নিকোনো উঠোন, খড়ের গাদা, ধানের গোলা, টলমলে জলের পদ্মপুকুর, পুকুর থেকে মাঝে মাঝে লাফ দিচ্ছে রুই কাতলা মৃগেলের বাচ্চাগুলো।

এই পাড়ায় আমাদের পূর্বপুরুষের বাস ছিল, এখনো বাস করে অনেক ঘর উত্তরপুরুষ আত্মীয়। আমরা গ্রামে ঢুকবো না এই অসময়ে, দুপুরের ভাতঘুমে নিথর পাড়াগাঁ লোক। আমরা বরং পা টিপে টিপে পাড়াকে বাঁয়ে রেখে খরনা খালের ধার নিয়ে হেঁটে পাড়ার পেছন দিকটায় চলে যাই।

মানুষের ঘরবাড়ী থেকে একটু তফাত জায়গার এখানে সবুজ ঘন একটা বাঁশবন, তার মাঝ দিয়ে বালির পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পাহাড়ী ছড়া, পুবদিকের অরণ্যঘেরা যে পাহাড় থেকে এই জলধারা নেমে আসছে সেই অপরূপ সবুজ পাহাড়গুলো দেখা যাবে বাঁশবনের ফাকে একটু উঁকি দিলেই। বাঁশবনের সেই ফিসফিস নির্জনতার মাঝে মাঝে মাঝেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশছোঁয়া শিরীষ গাছ, আম, জাম, গাব, তুলা সহ আরো নানান জাতের চেনা অচেনা প্রাচীন বৃক্ষ। নির্জন দুপুরে মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে বউ কথা কও কিংবা বিষন্ন কোন ঘুঘু। বিশাল সেই ছায়ার রাজ্যে গা এলিয়ে বসলেই আবেশে চোখদুটো মুদে আসবে পরম সুখে।

বেলা দুপুর। আকাশে মেঘের ছাতা। বাতাসে গতরাতের বৃষ্টির সোঁদা মিষ্টি গন্ধে তখনো ম ম চারপাশ। পুরো বাঁশবন জুড়ে বালিয়াড়ি। সাদা ঝুরঝুরে বালিতে পায়ের তালু ডুবে যাবে। দুপায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে শুকনো বালি। হাঁটতে হাঁটতে বনের শেষ প্রান্তে এসে থমকে দাঁড়াবো আমরা। আরো সামনে যেতে হলে হাটু জলের ছড়াটা পার হতে হবে। স্বচ্ছ জলধারায় ভালো করে খেয়াল করলে দেখবে অসংখ্য মলা পুটি চিংড়ির পোনা খেলতে খেলতে চলে যাচ্ছে ভাটির দিকে। পানি আরেকটু বাড়লে বিশাল বড় বোয়াল মাছও দেখা যাবে। বর্ষাজুড়ে মাছ ধরার উৎসব চলে এই খালের ধারে। এখান থেকে সোজা পশ্চিমে তাকালে একটা দীঘির নির্জন পাড়। দীঘির পাড়ে সারি সারি প্রাচীন বৃক্ষ সটান দাঁড়িয়ে।

ওই পাড়ে যাবো না আমরা। কারণ হঠাৎ করে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। মাথার উপর বড় বড় গাছ, তাই টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঝুমঝুমিয়ে কুকুর-বিড়াল নামতে শুরু করবে, তখন আশ্রয়ের খোঁজ করতে হবে। এরকম নির্জন বনে আশ্রয় কই? ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরতে হবে ভেবে মনটা দমে যাচ্ছে?

না! মোটেও হতাশ হবে না। আরেকটু এগিয়ে হাতের ডানে তাকালেই চোখে পড়বে সেই গাছটি। বিশাল একটা তুলাগাছ। অদ্ভুত চেহারার কান্ডটা। গোড়ার দিকে দুটো দেয়ালের মতো চ্যাপটা দেয়াল বেড়িয়ে একটা গুহার সৃষ্টি করেছে। ওখানে অনায়াসেই বড়সড় একজন মানুষ হারিয়ে যেতে পারে। পাতলা শরীরের দুজনও হারাতে পারবে। যতই বৃষ্টি হোক, ওখানে কেউ ভিজবে না। এক ছুটে নিরাপদ ওই আশ্রয়ে গিয়ে দাঁড়াবো আমরা। এখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখার সুখ অতুলনীয়। যত বৃষ্টিই হোক সরাসরি জল ঝরবে না মাথার উপর। শীতল বাতাসের ঝাপটায় গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাবে। আনন্দ শিহরন। চকচকে পাতার উপর টুপটুপ করে ঝরতে থাকা দুপুরিয়া বৃষ্টিটা দেখতে থাকো। বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে ওদিকে দেখা যাবে কল কল করে বয়ে চলা ঝরনার জলও।

একটু পরেই বৃষ্টি থেমে যাবে। বৃষ্টি থামলেও বেরুতে ইচ্ছে করবে না সেই আশ্রয় ছেড়ে। বেরিও না। দাঁড়িয়ে থাকো। আর একেকটা দমে বুক ভরে নাও বিশুদ্ধ বাতাস, প্রতিটা নিঃশ্বাসে তুমি হয়ে যাবে আপাদমস্তক শুদ্ধ মানুষ। বিশ্বাস করো এখানে দাঁড়িয়ে তুমি অতীতের সকল গ্লানি দুঃসময়কে ক্ষমা করে দেবে অবলীলায়।

ছেলেবেলায় আমার অনেক নিটোল দুপুর কেটেছে এই গাছের আশ্রয়ে! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর গাছটির কাছে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কারণ তুমি এই গ্রামটিকে খুব ভালোবাসো। সেই গাছটার নীচে তোমাকে একটিবার দাঁড় করিয়ে বৃষ্টির ঘ্রান নেবার সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম।

আরেকটা অপূর্ণ স্বপ্ন। তোমাকে ওই স্বপ্নময় ভ্রমণের লোভ দেখানোর জন্য আমি খুবই দুঃখিত, ব্যথিত। মাত্র কদিন আগে গ্রামে গিয়ে দেখে এসেছি সেই গাছটির জায়গায় আকাশটা বড় রকমের উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এত মানুষকে এত বছর আশ্রয় দিয়েও গাছটির জীবন হেরে গেছে জ্বালানী কিংবা আসবাবের দৈনন্দিন প্রয়োজনের কাছে।

আমার ছেলেবেলার গাচ্ছাতাটি আমি আর কখনোই ফিরে পাবো না।

Saturday, July 16, 2011

বিকিকিনি

সিকোটা দিয়ে ক্যাসিও নিয়ে এক্সট্রা সাড়ে তিনশো পকেটে পুরে ডায়মন্ডে এসে মোগলাই পরোটার অর্ডার দিয়ে পাশের টেবিলে এক এফ ফরটিন হাতের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপের পরিবর্তে আত্মবিশ্বাস জেগে উঠলো। কাঁটাচামচ দিয়ে ডিম পরোটার একাংশ টমেটো সসে চুবিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বামহাতের এফ সিক্সটিনের দিকে তৃপ্ত দৃষ্টি মেলে সময় দেখে খেয়াল করার চেষ্টা করলো হাতের এই গৌরবোজ্জল পরিবর্তনে কারো চোখের মনোযোগ কাড়লো কিনা। বেয়াড়াটা চায়ের কাপটা বিনীত নামিয়ে রেখে পেছনে হটলে ক্যাসিও ক্যারিশমার প্রকাশ ঘটলো। সিকো দিয়ে ক্যাসিও পেয়েছি, পকেটে নগদ সাড়ে তিনশো। মোগলাই পরোটার স্বাদটা মুখে থাকতে থাকতেই বাড়ি পৌছে যেতে চাই। আমি জিতেছিইইইইইইইইইইইইইইইইইইই।

Thursday, July 14, 2011

শূণ্যতাবোধ

শূণ্যতাবোধ ব্যাপারটা কিরকম? মস্তিষ্কে যখন রক্তসরবরাহ কমে যায় সেটাকে বলে, নাকি ফুসফুসে অক্সিজেনের সংকট দেখা দিলে? মানসিক শূণ্যতাবোধের কোন জৈবিক কারণ আছে? অকস্ম্যৎ কোন দুসংবাদে কিংবা প্রচন্ড হতাশা থেকে এই শূণ্যতাবোধের জন্ম হতে পারে। মানসিক চাপ বা ডিপ্রেশান থেকেও।

প্রেম ভালোবাসার ক্ষেত্রে শূণ্যতাবোধটা আসে রোমান্টিক সময়ের হঠাৎ মৃত্যু ঘটলে। তখন ব্যক্তিভেদে একেকজন একেক আচরণ করে। মেয়েটা ঘরে দোর দিয়ে একা একা বালিশ ভিজিয়ে কাঁদে,আড়াইবেলা খিদে নেই বলে না খেয়ে থাকে, দুদিন পর বান্ধবীদের আড্ডায় গিয়ে কষ্ট ভুলে যায়। বান্ধবীর নতুন কেনা মোবাইল দেখে খিলখিল হাসিতে মেতে ওঠে।

আর ওদিকে ছেলেটা সিগারেটে আগুন দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বেহুদা ঘুরে,এই জীবন লইয়া কি করিব ভাবতে থাকে, হাটতে হাটতে মোড়ের দোকানে কাবাবের গন্ধ পেলে খিদে চনমনিয়ে উঠে। তারপর আগে পেটপুজো, তারপর প্রেম ভালোবাসা, এই চিন্তা নিয়ে ভরপেট তন্দুরি কাবাব খেয়ে রাস্তায় বেরুতেই পৃথিবীটা সুন্দর দেখায়। একটা রিকশা ডেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে বৃষ্টিভেজা তাজা বাতাসে ঘ্রান নিতে নিতে ভাববে, আহ, মেয়েটা বুঝলো না, কাবাবটা ওকে নিয়েই খাবার কথা ছিল।

প্রেম ভালোবাসায় কেউ কারো জন্য বেশীদিন শূণ্য থাকে না।

কিন্তু যে পিতামাতা সন্তান হারায়। সন্তানকে টিফিনবক্স হাতে স্কুলে পাঠিয়ে বাসায় তার প্রিয় মাছভাজা প্লেটে সাজিয়ে অপেক্ষারত মা যখন কলিংবেলের শব্দ শুনে দরোজা খুলে অচেনা একজনের কাছে শোনে, তার সন্তান স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রাকচাপা পড়ে এখন হাসপাতালের মর্গে, তখন তার কেমন শূণ্যতাবোধের সৃষ্টি হয়? এই শূণ্যতাবোধ কখনো শেষ হবে না।

Monday, July 4, 2011

বিচ্ছু

১.
একদম ছেলেবেলা থেকেই আমি যাকে বলে আন-এসমাট। সাদাসিদে জামাকাপড়ে সাদাসিদে চালচলন। ফটফটাং করে ফ্যাশান করা হয়নি কখনো। এশমাট শব্দটার উৎপত্তি বলা যাক। আমার পৌঁনে পাঁচ বছরের কন্যা এখনো 'স্মার্ট' শব্দটা উচ্চারণে হিমশিম খায়। এশমাটই চলতে হয়। ওকে শুদ্ধ করতে গিয়ে আক্রান্ত হবার চেয়ে ওর অশুদ্ধ উচ্চারণগুলো আমি চর্চা করি নিরাপত্তার স্বার্থে। এ বয়সী বাচ্চাদের চড়চাপড়খামচিগুলো প্রাণঘাতি না হলেও চেহারার মানচিত্র সাময়িক বদলে দিতে পারে।

বাড়িতে নিজের আর বোনদের সব মিলিয়ে গন্ডাখানেক বাচ্চার সাথে আমার নিয়মিত উঠবস করতে হয়। তাতে দেখেছি। সুবোধ শিশু শব্দটা সোনার পাথরবাটি হয়ে গেছে আজকাল। সবগুলো সাধ্যমতো ইচড়ে পাকা।

সেদিন আমার কন্যা হঠাৎ করে বলে বসলো, "বাবা, তুমি তো ভাইয়ার বউয়ের শ্বশুর হবা, তাই না? মা হবে শাশুড়ি, আর আমি ননদ।" আমার হেঁচকি ওঠার দশা ওর কথা শুনে। ওর ভাইয়া, মানে আমার কনিষ্ঠ সন্তানের বয়স এখনো দুবছর হয়নি, তার বিয়েশাদি সংসার নিয়ে চিন্তা করছে তার তিন বছরের বড় বোনটা।

এই বিচ্ছুগুলোর আগ্রাসী তৎপরতার কারণে বাসায় আমাকে চেহারাটা কঠিন ব্যক্তিত্বের মুখোশে ঢেকে রাখতে হয়। ল্যাপিতে কোন কমেডি ছবি দেখছি, প্রবল হাসি পাচ্ছে, কিন্তু বিচ্ছুগুলো আশেপাশে থাকলে মোটেও হাসিটা বাইরে আনা যাবে না। তলপেটের প্রবল কাঁপুনিতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। নইলে ওরা বুঝে যাবে আমি হালকা মুডে আছি, এসে গলায় ঝুলে একটা খামচি দিয়ে সৌজন্য বিনিময় করবে।

এরকম আপ্যায়ন আমাকে প্রায়ই করে বলে কৃত্রিম ব্যক্তিত্বের দেয়াল তুলে রাখতে হয় সময় সময়। তবু ওরা বিশ্বাস করে না। মাঝে মধ্যেই এসে কেউ না কেউ পেটে একটা খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। এটা হলো উস্কানি টেস্ট। আমাকে চেয়ার থেকে তুলে ওদের পেছনে ছোটার ফাঁদ। কিন্তু আমি ফাঁদে পা দেই না। সাবধানে থাকি। যখন ভাবি ছবিটা না দেখে ওঠা যাবে না, তখন বিরাট ঝাড়ি, যা ভাগ, আমি অফিসের কাজ করছি।

সবচেয়ে ফাজিল হলো আমার কন্যা। একথা শুনে ও গিয়ে বাকীদের কানে কানে বলবে, বাবা অফিসের কাজ না, মুভি দেখছে কিন্তু।
এরপর বাকী দলবল মিছিল করে পেছনে দাড়িয়ে বলবে, আমাদের জন্যও মুভি ছাড়ো, আমরাও দেখবো।
আমাকে তখন ল্যাপির ডালা নামিয়ে বলতে, হয়, টিভিতে কার্টুন নাই? ওখানে গিয়ে দেখ। ত্যাঁদড়গুলো তবু যাবে না। তারপর আমাকে খরখর কন্ঠে ঝাড়তে হয়, ঐ গেলি!!! এরকম ঝাড়ির পর মুভি দেখার মুড থাকে আর?

নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন শিশুদের প্রতি আমি মোটেও দয়াশীল না, তবু বিচ্ছুগুলো আমাকে পাত্তা দেয় না। প্রায়ই ছোটখাট যুদ্ধ লেগে থেকে। ওরা ভাবে আমি লোকটা আসলে ততটা নির্মম না। সমস্তটাই ভাণ। আমার কানটা মুচড়ে দিলে ব্যক্তিত্বের রোগ সেরে যাবে। একদম কনিষ্ঠজন এসে সত্যি সত্যি কানটা মুচড়ে ধরে।

২.
কিন্তু দিন এরকম ছিল না চিরকাল। শিশুরা একসময় সত্যি সুশীল ছিল। বড়দের প্রতি দয়ালু ও সহনশীল ছিল। আমি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসা পেয়েছি শিশুদের কাছ থেকেই। আমি যখন ইন্টার শেষ করেছি, তখন আমার সবচেয়ে কনিষ্ঠ বোন দিশার জন্ম। ওর মতো বুদ্ধিমতি অথচ সুবোধ শিশু খুব কমই দেখেছি। বোনদের মধ্যে একদম ছেলেবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত ও আমার সবচেয়ে প্রিয়। সেদিনের পিচ্চি দিশাটা এই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দেবে, ভাবা যায়? আমাদের বয়সের ব্যবধান ১৮ বছরের। কিন্তু পিচ্চিকাল থেকে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব। আমি যখন প্রথম চাকরিতে ঢুকি, অফিসে খুব কষ্টকর সময়। প্রায় চোদ্দ পনের ঘন্টা ডিউটি শেষ করে ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম, ওকে দেখে সব ক্লান্তি উধাও। ও তখন ক্লাস থ্রীতে পড়ে। আমি অফিস থেকে ফেরার পর গোসল খাওয়া সেরে ওকে অফিসের গল্প শোনাতে হতো। ও খুটিয়ে খুটিয়ে সব জেনে নিত, তারপর মাকে রিপোর্ট করতো।

একদিন বাসায় ফিরে দেখি, দিশা নেই। কোথায়? মামার বাসায় বেড়াতে গেছে। রাতে ফিরবে না। সমবয়সী মামাতো বোনের সাথে থাকবে। কাছেই মামার বাসাটা, এক কিলোমিটারের মধ্যে। রাত দশটা বাজে তখন। কথা শেখার পর থেকে ওর সাথে গল্প না করে, ওকে না দেখে ঘুমোইনি কোনদিন। সেদিন ও না থাকাটা কেমন লাগলো। আমি খেয়েই মামার বাসায় ছুটি। দুভাইবোন দশ মিনিট গল্প করে, ফিরে এলাম আমি। দিশার কল্যানে আশেপাশে যত পিচ্চিপাচ্চি ছিল সবগুলোর কমন ভাইয়া ছিলাম আমি। রাস্তায় বেরুলে ভাইয়া, ভাইয়া বলে চিৎকার করছে হরেক শিশু, এই দৃশ্যটা খুব স্বাভাবিক ছিল। শিশুদের ভালোবাসা আমি বরাবর পেয়ে আসছি।

এই ৪২ বছর বয়সেও সেই ভাগ্যটা ছাড়েনি আমাকে। কর্মক্ষেত্রে স্যার বলার নিয়ম থাকলেও সেটা স্বচ্ছন্দে লংঘন করে অনেকেই ভাই সম্বোধন করে। ব্লগেও আমাকে ভাইয়া হিসেবে নিয়েছে অনেকেই। পিচ্চি এক সহব্লগার সেটাকে রীতিমতো শিল্পের কাতারে নিয়ে গেছে। কেবল দোকানী ছোকরাগুলো ভাইয়া বদলে আংকেল ডাকা শুরু করেছে কিছুদিন আগে থেকে। নইলে দুনিয়াশুদ্ধ আমি ভাইয়া। এই ভাইয়া ডাকটাকে আমি সম্মান হিসেবে গ্রহন করি। মজা হয়েছিল একবার।

একবার সপরিবারে একটা ব্লগার আড্ডায় গেলাম। সেখানে নতুন পরিচয় হয়েছে এক ব্লগারের সাথে। সে বললো, আপনার লেখা পড়ে আপনাকে অনেক কম বয়সী ভেবেছিলাম। এখন দেখি আপনার বয়স অনেক। কানাকে কানা বললে যেমন লাগে, আমার তেমন লাগলেও করার কিছু নাই। তবু বললাম, কতো ভেবেছিলে আমাকে? সে বললো, ভেবেছিলাম বিশ বাইশ বছরের তরুন। ভয়ে ভয়ে জিগাই, এখন কতো লাগে? সে বললো, আপনি কমপক্ষে ত্রিশ বছর, দুবছর বেশীও হতে পারি অসম্ভব না। উপস্থিত পূর্বপরিচিত ব্লগারগন হেসে খুন হলো শুনে। আমার কলিজায় পানি আসলো, বললাম, আমার কাছ থেকে আপনার এক প্লেট বিরিয়ানী পাওনা হলো। আপনার মুখে ফুলচন্দন। বউকে ডেকে বললাম, আজম কি বলেছে শুনে নাও আবার।

সেদিন এক আত্মীয়বাড়ি গেছি দাওয়াতে। গিয়ে দেখি একপাল ছেলেপেলে। সব এই যুগের। আমি সাবধান হয়ে গেলাম। ব্যক্তিত্বের মুখোশে ঢুকে গেলাম। পিচ্চিপাচ্চিগুলো সব দুষ্টুমিতে ব্যস্ত। আমাকে তেমন গুনছে না দেখে স্বস্তি পেলাম। ভদ্র আছে বাচ্চাগুলো। হয়তো সম্পর্কে আমি ওদের আংকেল বলেই। ওদের বাবা মায়ের সাথেই আড্ডা হচ্ছে আমার। কিন্তু দাওয়াত শেষে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠছে ওরা, এমন সময় পিচ্চি গুলো সম্মিলিত ভাবে চিৎকার করে আমার নাম ধরে ছড়া কাটতে শুরু করলো,

আবুল হোসেন ভাইয়া!!
কেমন আছেন খাইয়া?
বাই বাই, খোদা হাফেজ,
এবার আমরা যাইগা!

Sunday, July 3, 2011

দুষ্টচক্র

বাংলাদেশের দুরারোগ্য রাজনৈতিক ব্যধি আবারো চাড়া দিয়েছে। ভুল করার জন্যই আমরা নির্বাচিত করেছি গণতান্ত্রিক সরকারকে। ভুল করা গণতন্ত্রের স্বাভাবিক আচার। রাজনীতিবিদগন যুগযুগ ধরে ভুল আচরণ করে যাবে, আর দারিদ্রকে আমাদের নিয়তি বলে মেনে নেবো। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে ৪০ বছরে নিরংকুশ স্বস্তিকর কোন বছর আমরা পাইনি। ১/১১ এর আগে যে নির্বাচন পরিকল্পনা হয়েছিল তাতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনীতি ক্ষমতাবান হতো, কিন্তু অপ্রত্যাশিত একটা তৃতীয় পক্ষের বাগড়ার কারণে পরিকল্পনাটা সফল হলো না। যথারীতি নির্বাচন হলো, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ জয়ী হলো। একটা স্বস্তি এবং আশংকাজনক ফলাফল ছিল। কারণ এত বেশী আসন দেশের ইতিহাসে কোন দল পায়নি। অতি আত্মবিশ্বাস একটা দলকে চুর্ন করে দেয়। সেই সাথে দেশকেও। বর্তমানে আশংকারই বাস্তবায়ন ঘটছে। আওয়ামীলীগ একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশকে সংঘাতের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিচ্ছে। আমরা এই দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারলাম না। গত বিশ বছরের গনতন্ত্রের ইতিহাসে একই চিত্র ঘুরে ফিরে আসছেই।

-জঙ্গী মৌলবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটেছে দেশে। আগাছার মতো বাড়ছে জঙ্গীবাদী ধর্মীয় সংগঠনগুলো।
-যুদ্ধাপরাধীর বিচার আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে ঘোর সংশয় দেখা যাচ্ছে। সরকার অপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে দেশকে উত্তপ্ত করছে
-অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা আংশকাজনক। আইনশৃংখলা, দ্রব্যমূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতি প্রতিযোগিতামূলক উর্ধগতিতে আছে।
-গণতন্ত্র নামক সোনার হরিন বাংলাদেশ কখনোই দেখেনি। আমাদের কাছে গণতন্ত্র অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো।

Saturday, July 2, 2011

এলোকথা

১. একটা কথা চুপ করে বসে ছিল আলজিবের নীচে। জিব দাঁত পেরিয়ে ঠোঁটের ফোকরে পৌঁছানোর আগেই আকাশে ঘন মেঘ দেখে টুপ করে ডুব দিয়ে হারিয়ে গেল।

২. দীঘিটায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী জল জমেছিল। সামান্য বৃষ্টিকেও তার উগরে দিতে হলো বেনো জলে।

৩. মনে মনে বলেছিলাম, চাও। সে শুনলো, যাও। চলে গেল অক্লেশে।

৪. ফার্স্ট ক্লাস টিকেট কেটে লোকাল স্টেশানে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। ট্রেনটা তার চোখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল। সে ভুলে গিয়েছিল এক্সপ্রেস ট্রেন লোকাল স্টেশানে থামে না।

৫. শীর্ষস্থানে আমার ভয়, কারন ওখান থেকে কেবল পতনই সম্ভব।