আমাদের দেশের অধিকাংশ আইনকানুনগুলো ব্যর্থ হয় প্রয়োগ পদ্ধতির কারণে। কিছু আইন ব্যর্থ হয় অবাস্তব সিদ্ধান্তের কারণে। আমি একটা বেআইনী জিনিসের উদাহরণ দেবো যেটা চাইলে নিয়ন্ত্রণ করা যেতো, কিন্তু প্রয়োগের ফাঁক গলে আরো বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। দেশে নাকি পলিথিন নিষিদ্ধ। বাজারে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের ব্যাপার ঘটেছে আরো বিশ বছর আগে। কিন্তু আসলে কী ঘটেছে? পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার দশগুন বেড়েছে। বেড়েছে ওই আইনটার কারণেই। খুলে বলছি।
সত্তর আশির দশকে ছালা কিংবা চটের ব্যাগ পাওয়া যেতো বাজারে। একটা ব্যাগ কিনলে গোটা বছর পার। খুব বেশি হলে বছরে দু তিনটা ব্যাগ কিনতো লোকে। নব্বই দশকে পলিথিন ব্যাগ আসলো। বাজারে গিয়ে এক টাকা দিয়ে একটা পলিথিন ব্যাগ কিনে বাজার করতো লোকে। এক ব্যাগ দিয়ে একদিনের বাজার। কখনো দুটো তিনটা ব্যাগও লাগতো মাছ মাংস আলাদা কেনার জন্য। প্রথমদিকে ওই পলিথিনগুলো একটু পুরু ছিল। বারবার ব্যবহার করা যেতো। ওই ব্যাগগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর চটের ব্যাগের কদর কমে যায়। চটের ব্যাগ উঠে যায় পুরোপুরি। পলিথিনের রাজত্বে অতিষ্ট হয়ে সরকার আইন করে, ধরপাকড় করে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। আসলে কী ঘটলো? পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধ করার পর বাজারে সাদা পলিথিনের আমদানী ঘটলো। নানান সাইজের। আস্তে আস্তে ওটা বাজার দখল করে ফেলল। এমনভাবে দখল করলো আপনি বাজারে গেলে প্রতিবার কমপক্ষে দশটা পলিথিন নিয়ে ফেরত আসেন। আপনাকে প্রতিটি জিনিস আলাদা আলাদা পলিথিনে দেয় দোকানী। আগে একটা পলিথিনে আপনি বাজার করে আনতেন, এখন আপনি দশটা পলিথিনে বাজার করেন। এটা নিয়ে সরকারের কোন আপত্তি আছে মনে হয় না। আপত্তি না থাকার কারণ বোধহয় এগুলো শুধু পলিথিন ঠোঙ্গা। শপিং ব্যাগ নয়। শপিং ব্যাগ ধরার জন্য যে ফুটোটা থাকে সেটা এখানে নেই। এটাকে শপিং ব্যাগ সংজ্ঞায়িত করা যায় না। জিনিসটা কী এটার কোন সংজ্ঞাই নেই আসলে। এই সংজ্ঞাহীনতার কারণে সারা দেশ পলিথিনে সয়লাব হয়ে গেছে। এখন আমার মনে হয় আগের পলিথিন শপিং ব্যাগের যুগই ভালো ছিল। একটা ব্যাগ নিয়ে বাজার থেকে ফিরতাম। এখন আমরা দশটা পলিথিন নিয়ে ফিরি। পলিথিন নিষেধাজ্ঞা এভাবেই ব্যর্থ হলো।
পলিথিন নিয়ন্ত্রণ সীমিতভাবে হলেও কিভাবে সফল হতে পারে সে ব্যাপারে আমার একটা পরামর্শ আছে। পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও পলিথিন শিল্প তো নিষিদ্ধ হয়নি। বাজারে পলিথিন ধরার জন্য মাঝে মাঝে এলোমেলো ধরাধরি না সরকার বরং তাদের একটা নিয়মের আওতায় আনতে পারে। তাদের বলতে পারে বাবারা ঠোঙ্গা পলিথিন বাদ দিয়ে মানসম্পন্ন পলিথিন শপিং ব্যাগ বানাও, যে ব্যাগটা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে। দোকানে দোকানে সেই পলিথিন থাকবে। সেই পলিথিনের দাম হবে কমপক্ষে দুই টাকা। এই দুই টাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দোকানদার চাইলে পলিথিন ব্যাগের দাম বাবদ দুই টাকা নিতে পারে, চাইলে দুই টাকা মাফ করে দিতে পারে। দুই টাকার ফজিলত হলো, অপচয় রোধ। যে কোন জিনিস বিনামূল্যে পেলে মানুষ যত্রতত্র ব্যবহার করে, যেখানে সেখানে অপচয় করে। এখন দুই টাকা খরচের ব্যাপার আসলে দোকানীরা আগের মতো প্রতিটা আইটেমের জন্য একটা করে পলিথিন দেবে না। একটা পলিথিনেই সব জিনিস ভরে দেবে। ক্রেতাও একটা পলিথিন পাবে কাজে লাগানোর জন্য। টুনিপ্যাকের মতো সেগুলো বাসায় নিয়ে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলবে না। আমার মনে হয় পলিথিনের টুনিপ্যাকগুলো বন্ধ হলে পলিথিন ব্যবহারের পরিমান এক পঞ্চমাংশ কমে যাবে। পলিথিনজাত পরিবেশ বিপর্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে। পৃথিবীতে তেলাপোকা যেন নির্মূল হয়নি তেমনই পলিথিন নির্মূল হবে না। থাকবেই যখন তখন কমপক্ষে পাঁচ কেজি সাইজের শপিং ব্যাগ থাকুক। সারা পৃথিবীতে কমবেশি পলিথিন শপিং ব্যাগ আছে। কিন্তু আমাদের মতো কোটি কোটি টুনিব্যাগ নাই। প্রতিদিন বাংলাদেশে কয়েক কোটি পলিথিন ব্যাগ অপচয় করা হয় শুধুমাত্র বিকল্প ব্যবস্থা না থাকার কারণে।
No comments:
Post a Comment