Thursday, June 17, 2021

মধ্য পঞ্চাশের দুই প্রজন্মের দুই পিতা

মধ্য বয়সে এসে আমি জীবনকে পরিপূর্ণভাবে দেখতে পাচ্ছি। পুরোনো অনেক উপলব্ধির রূপান্তর ঘটেছে। একটা বয়সে না পৌঁছালে মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারে না।

বাবা হিসেবে আমি সন্তানদের বেড়ে ওঠা দেখতে দেখতে একটা নতুন আনন্দের সন্ধান পেয়েছি। জানি না সব বাবা এই আনন্দকে উদযাপন করে কিনা। সেই সাথে একটা দুঃখবোধও কাজ করে। আমার আশঙ্কা এই সুখের মেয়াদ বেশিদিন থাকবে না। আমার চেনাজানা অনেক পরিবারে দেখেছি জ্বলে ওঠার পর দপ করে নিভে গেছে কোন না কোন একটা ঘটনায়। আমার ছেলেটা যখন অসুস্থ হলো করোনার সময়, আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমি জীবনের সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি সারারাত জেগে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার বাবাও আমার ছেলেবেলায় এরকম ঘাবড়ে গিয়ে ডাক্তারকে ধরে মার দিয়েছিল শুনেছিলাম। আমি প্রায় মরে গিয়েছিলাম। একদম শেষ প্রান্ত থেকে ফিরে এসেছিলাম। আমরা চার ভাই হবার কথা ছিল। টিকেছি শুধু আমি একা। 

আজকাল আমার ভাবতে ভালো লাগে এই বয়সে বাবা কী করেছিলেন, কেমন ছিলেন ইত্যাদি। এরকম বয়সে বাবা বিদেশ থেকে ফিরে আসেন। আমি তখন কলেজে পড়ি। পঞ্চাশ পার হবার পর থেকে বাবা খুব বেশি স্বচ্ছল ছিলেন না। ৫৫ বছরে পৌঁছে বাবা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলাম। অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি। 

সেদিক থেকে তুলনা করলে আমার মধ্য পঞ্চাশে আমি এখনো স্বচ্ছল আছি। কিন্তু আমার সন্তানেরা এখনো স্কুলে পড়ছে। আমি দেরিতে বিয়ে করেছি, দেরিতে বাবা হয়েছি, তাই আমার বাবার তুলনায় পিছিয়ে আছি অন্তত ৮ বছর। এই ঘাটতি কখনো পুরণ হবে না। আমাকে যদি এই মাঝপথে চলে যেতে হয়, তাহলে আমার সন্তানেরা অসহায় হয়ে পড়বে। তাদের বেড়ে ওঠার পর্বটা অনিশ্চয়তায় ডুবে যাবে। এই ভাবনটা আমাকে মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে।

তবু একটা তৃপ্তি আছে আমার। আমার বাবার চেয়ে আমি সন্তানদের বেশি কাছে পেয়েছি। আমার যখন বেড়ে ওঠার বয়স বাবা তখন বিদেশে। দীর্ঘ ৮ বছর বিদেশে থাকার কারণে বাবাকে আমি অনেকটা সময় কাছে পাইনি। যখন দেশে ফিরে এসেছে, তখন আমি বড় হয়ে গেছি, ওই বয়সে কেউ বাবার ন্যাওটা হয়ে থাকে না। প্রেস্টিজজ্ঞান বেড়ে যায়। আমি বাবার কাছ থেকে সযত্ন দূরত্ব বজায় রাখতাম। কিছুদিন পর আমার ছেলেও হয়তো প্রেস্টিজজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে পড়বে তখন সেও আমার কাছ থেকে দূরে থাকবে। তবু এখনো আনন্দ যে আমি দীর্ঘ সময় ওদের কাছে পেয়েছি। আমার কর্মক্ষেত্র বাসার মধ্যে আছে বলে। স্কুলের সময় বাদ দিলে সারাক্ষণই আমরা একসাথে কাটাই। আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে আমার দুই সন্তান। ওদের ছাড়া আমার এক দিনও চলে না। 

ছেলেবেলার কথা ধরলে আমার তুলনায় আমার সন্তানেরা একটা জায়গায় পিছিয়ে আছে। ওদের বয়সে আমি অনেক বেশি বহির্মুখী ছিলাম। বাইরের খেলাধুলার একটা জগত ছিল। আমাদের কলোনীতে সেই সুযোগটা বেশি ছিল। এখন ওরা পুরোপুরি গৃহবন্দী জীবনযাপন করে। শহরের কেন্দ্রস্থলে থাকি, ঘর থেকে বের হলেই সদর রাস্তা গাড়িঘোড়া হৈ হুল্লোড়। আমাদের সেই নিরিবিলি জীবন ওরা পায়নি।

ওরা এগিয়ে আছে অন্য জায়গায়। আমার ছেলেবেলায় আমরা অতি সাধারণ নিন্মবিত্ত জীবনযাপন করতাম। ছোট একটা বাসায় আমরা এতগুলো ভাইবোন মিলে থাকতাম। অভাব অনটন না থাকলেও তেমন একটা উন্নত জীবন কাটাতাম বলা যায় না। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত এক রুমের বাসাতেই থাকতাম আমরা। এখন ভাবলে অবাক হই। ওদেরকে সেই গল্পগুলো করলে ওরা অবিশ্বাসীর চোখে তাকায়। ওরা জন্ম থেকেই শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা আধুনিক ফ্ল্যাটে বাস করছে ওরা। যেখানে বিদ্যুত পানির অবাধ সরবরাহ আছে। লিফট, জেনারেটর, সিকিউরিটি সার্ভিস সবকিছু প্রথম শ্রেণীর। আমরা এখনো মধ্যবিত্ত, কিন্তু জীবনযাত্রার মান অনেকটা উচ্চবিত্তদের মতো। ঘরে আধুনিক সব গ্যাজেট মজুদ আছে। শৈশব থেকে বাসায় দু চারটা ল্যাপটপ দেখে বড় হয়েছে, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট ফোন, ডিএসএলআর ক্যামেরা থেকে শুরু করে সবকিছুই বাসায় আছে। কোনদিন অভাব দেখেনি। বাসায় আইপিএস, জেনারেটর সব আছে, আজকাল বেশি লোডশেডিং মাঝে মাঝে জেনারেটর থাকে না। তাই কখনো কারেন্ট চলে গেলে ওরা অবাক হয়। আমি বলি, দেশের বেশিভাগ মানুষ এভাবেই আছে। তোমাদেরও সেরকম অবস্থায় থাকার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। বলি ঠিকই, কিন্তু জানি কখনো এই সুবিধাগুলো চলে গেলে ওদের খুব কষ্ট হবে। আমার ছেলেবেলায় এসবের কানাকড়িও দেখিনি। তাই আমাদের অসুবিধা হয়নি। আমরা ধীরে ধীরে বড় হয়েছি। ওরা জন্মের সাথে সাথে সবকিছু পেয়ে গেছে। যদি আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তখন ওদের খুব কষ্ট হবে। এটা ভেবে আমার খারাপ লাগে। কিন্তু জীবন তো চিরকাল একরকম থাকে না। আমরা গত ২৮ বছর এক নাগাড়ে যে স্বচ্ছলতার জীবন কাটাচ্ছি, সেটা খুব দুর্লভ একটা বিষয়। আমার বাবা দাদা কেউ এতদিন সুখ করেনি।

আমার কন্যাকে নিয়ে খানিক দুশ্চিন্তা আছে। সে পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী না। নিজের ভাল বোঝে না। সুযোগ পেলেই ফাঁকি দেয়। শুধু পড়ায় নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে ফাঁকি দেবার সুযোগ খোঁজে। এই প্রবণতা খুব খারাপ। এটা ওর ভবিষ্যতকে অনেক জটিল করে ফেলবে। আমি অনেক চেষ্টা করেও কাজ না করার বদভ্যাসটা দূর করতে পারিনি। ফাঁকির হাতে সে বন্দী হয়ে আছে। কিছুদিন পর কলেজে পড়তে শুরু করবে। তখন জীবনটা নিজের হাতে চলে যাবে। সেই জীবনকে নিয়ন্ত্রণে রেখে যদি চলতে না পারে, তাহলে পুরো ভবিষ্যত হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে। নিজেকে ফাঁকি দিলে জীবন ক্ষমা করে না। আমার অনেক বন্ধুর জীবন থেকে আমি এই শিক্ষাই নিয়েছি। সেই হিসেবে ছেলেটা এখনো ভালো আছে। তার মধ্যে ফাঁকিবাজির চেষ্টা নেই। সে নিজে নিজে অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টাগুলো আমাকে অবাকও করেছে। যদি ওর সুযোগ থাকে তাহলে সে উন্নতি করতে পারবে। টেকনোলজিতে ওর বেশ আগ্রহ। টেকি জিনিসপত্র নিয়ে একদম ছেলেবেলা থেকেই নাড়াচাড়া করে। আমি তেমন কিছু শেখাইনি, তবু সে কম্পিউটারে আমার চেয়ে ভালো। আমি যেসব পারি না, সে ওসব পারে। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর সে আমাকে কম্পিউটার বিদ্যা শেখানোর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এটা ভালো লেগেছে আমার। আমি প্রোগ্রামিং এর পও জানি না। সে আমাকে ল্যাঙ্গুয়েজ শেখায়। বেসিক ওয়েব পেজ ডিজাইন, ওয়েব টুলস তৈরি করা, জাভা, এইসটিএমল, সিএসএস এসব আমি বুঝি না। সে আমাকে ওসব নিয়ে জ্ঞান দেয়। শেখার এই আগ্রহটা জরুরী। ভাইবোন দুজনই যদি একরকম করে কাজ শিখতো। দুজনেরই ভাল হতো। কিন্তু দুজন খোঁচাখুঁচি করে বেশি। এটাই মুশকিল। আমি তাই দুজনকে দুপাশে নিয়ে মিলেমিশে গল্প করতে ভালোবাসি। তখন ওরা ভাল থাকে পোষা বেড়ালের মতো। মধ্য পঞ্চাশ বয়সে আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ওদের সাথে সময় কাটাতে। বন্ধুদের আড্ডার চেয়েও আমি ওদের আড্ডা উপভোগ করি। কারণ এখন ওরা পড়াশোনা বিষয়ক কথাবার্তাগুলো বোঝে। আমি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করি সেগুলোর গল্প করতে পারি ওদের সাথে। আগে দিশার সাথে করতাম, এখন ওদের সাথে করি।





সাহিত্যিক দলাদলি: পাষণ্ড পীড়ন ১৮৪৬

সাহিত্যিক দলাদলির এই বেরসিক ঘটনাটি ঘটেছিল বাংলা পত্রিকা প্রকাশনার আদিযুগে- উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত শিক্ষিত সমাজের বিনোদনের জন্য একটা পত্রিকা চালাতেন। সাথে ছিলেন সাহিত্যিক বন্ধু গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ।
১৮৪৬ সালে প্রকাশিত ‘পাষণ্ড পীড়ন’ নামের মাসিক পত্রিকাটি সমাজের পাষণ্ডদের কতটা পীড়া দিতে পেরেছিল তা জানা না গেলেও কারো কারো বুদ্ধিতে আগুন ধরাতে পেরেছিল নিঃসন্দেহে। সেই আগুনের তাপে দুই বন্ধুর মধ্যে দড়ি টানাটানি শুরু হয়। দুজনে কুৎসাপূর্ণ কবিতার মাধ্যমে পরস্পরকে আক্রমণ শুরু করেন। দেশের লোক সেই লড়াই দেখে আমোদিত হতো।
.
প্রকাশক সীতানাথ ঘোষ তখন একটা অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। এক রাতে সম্পাদককে কিছু না জানিয়ে ছাপাখানার মূল যন্ত্রটা নিয়ে ভেগে গেলেন তিনি। পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি ভেগে গিয়ে হারিয়ে যাননি। তিনি মূলত দলত্যাগ করেছিলেন। পত্রিকা প্রকাশের সেই যন্ত্রটা তাঁর প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
.
সুরসিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কয়েক বছর পর 'পাষণ্ডপীড়ন' বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে মনের দুঃখে লিখেছিলেন-
"১২৫৩ সালের আষাঢ় মাসের সপ্তম দিবসে প্রভাকর যন্ত্রে পাষণ্ডপীড়নের জন্ম হইল। ইহাতে পূর্ব্বে কেবল সর্ব্বজন-মনোরঞ্জন প্রকৃষ্ট প্রবন্ধপুঞ্জ প্রকটিত হইত। পরে ৫৪ সালে কোন বিশেষ হেতুতে পাষণ্ডপীড়ন, পাষণ্ডপীড়ন করিয়া, আপনিই পাষণ্ড হস্তে পীড়িত হইলেন। অর্থাৎ সীতানাথ ঘোষ নামক জনেক কৃতঘ্ন ব্যক্তি যাহার নামে এই পত্র প্রচারিত হয়, সেই অধার্মিক ঘোষ বিপক্ষের সহিত যোগ দান করতঃ ঐ সালের ভাদ্র মাসে পাষণ্ডপীড়নের হেড চুরি করিয়া পলায়ন করিল। সুতরাং আমাদিগের বন্ধুগন তৎপ্রকাশে বঞ্চিত হইলেন। উক্ত ঘোষ পত্র ভাস্করের করে দিয়া পাতরে আছড়াইয়া নষ্ট করিল।"**
.
আদিযুগের এই বাংলা বুঝতে অনেকের অসুবিধা হলেও এ যুগের সাহিত্যিক দলাদলির সাথে ঐতিহাসিক মিল খুঁজে পেতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
.
[**সূত্র: সংবাদ প্রভাকর, ১ বৈশাখ ১২৫৯]

Wednesday, June 16, 2021

তোমাকে....

তোমাকে এখনো ভালোবাসতে পারি। প্রতিদিন তোমার সাথেই থাকি আমি। যেদিন তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না সেদিন আমার আয়ুষ্কাল শেষ। তুমি আছো বলেই সবুজকে সবুজ দেখি, নীলকে নীল। তুমি বিদ্যমান বলেই হলুদ বেগুনী লাল কমলা সবগুলো রঙ নিজ নিজ উজ্জ্বলতায় সমুন্নত আমার চোখের রেখায়।

জানতে পারিনি তুমি কখনো আমাকে বেসেছো কিনা। আমাকে আদৌ চেনো কিনা, তাও জানা হয়নি। প্রতিদিন তোমার হাতে হাত রেখে কাটাই, অথচ কেমন নির্জীব অক্ষরে তুমি আমাকে দেখো। তুমি জড়, তুমি কাগজ, তুমি বিট বাইটের সংখ্যারহস্য। তোমার প্রাণ নেই, অথচ আমার প্রাণ তোমার হাতে বন্দী।

তুমি প্রেম নও, স্মৃতি নও, প্রেয়সী নও, বাংলা ভাষার কোন অলংকার নও, মাত্র দুই শব্দের তৈরী নাম বই!



Tuesday, June 15, 2021

ধরাশায়ী

ধরা কাহিনী সবারই আছে। জীবন মাত্রেই মরণশীল, মানুষ মাত্রেই ধরাশীল। ধরা খাওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নাই, কোলেষ্টেরোলও নাই। তবে ধরা কাহিনী নগদের চেয়ে বাসীই মজাদার। তাই গতকাল যে ধরাটা খেয়েছি সেটা এখন না বলে পুরোনো গুলিই বলছি।

মোবাইল 'ধরা': একটেল

দশ-বারো বছর আগেও ভোররাত থেকে লাইন ধরে হুড়োহুড়ি ধাক্কাধাক্কি করে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করে মিনিটে ৭ টাকায় কথা বলার সুবর্ণ সুযোগ পাবার জন্য যে কোম্পানীর কানেকশান কিনতো মানুষ, তার নাম গ্রামীণ ফোন। ক্রেতা সামলানোর জন্য পুলিশ ডাকতে হয়েছে সেরকম কোম্পানী পৃথিবীতে খুব বেশী নেই। গ্রামীণের ক্রেতাভাগ্য ঈর্ষনীয় ছিল।

আমি গ্রামীনের লাইনে দাঁড়াইনি কখনো। মোবাইল ফোন বড়লোকের জিনিস, বাসার ল্যান্ডফোনই যথেষ্ট, এই ধারনাটা এক বন্ধু এসে নাড়িয়ে দেয় যখন সে বিদেশ যাবার আগে তার একেটেল মোবাইলটা আমাকে বন্ধুসুলভ দামে 'উপহার' দিয়ে যেতে চাইল।

'উপহারে' আমার আপত্তি নেই জেনে 'মাত্র' আট হাজার টাকায় দূর্লভ একটেল পোষ্টপেইড সিম আর সাথে বোনাস হিসেবে সাড়ে তিন হাজার টাকার দুমাসের বকেয়া বিল বুঝিয়ে দিয়ে সে বিদেশে চলে গেল। একটেলের ওই সিমটা তখন মহার্ঘ ছিল 'ইনকামিং ফ্রি' ছিল বলে।

মেঘ পাহাড় বৃষ্টি বনাম ঘটমান অতীতের গল্প

১.
দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। জানালা দিয়ে অনেক দূরের কিছু পাহাড় সারির ধোঁয়াশা। ধোঁয়াশাটা বৃষ্টির পর্দা। পাহাড়গুলো নদীর ওপারে। মাঝে মাঝে দেহবহির্ভূত হয়ে মনটা ওই পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নেয়। একদিন নদীটা পার হয়ে সোজা ওই পাহাড়গুলোর দিকে চলে যাবো। অফিসে আসার পথে প্রতিদিন নদী পারাপারের খেয়াঘাট পেরিয়ে আসি। কখনো সখনো দেখি সারিবদ্ধ মানুষ নৌকা থেকে নেমে শহরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে ঘাট, সেখানেই বাসস্টপ। সন্ধ্যের আগে কাজ সেরে সবাই ফিরে যাবে ওই পাড়ে।

নদীর এই ঘাটলাটা বড় সুন্দর। আধুনিক খেয়াঘাট। কাঠের সুন্দর পাটাতন মহাসড়ক থেকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে নৌকার কাছে। শহরের মধ্যখানে এমন সুন্দর একটা ঘাট আছে ভাবতে ভালো লাগে। ঘাট থেকে মূল নদী কয়েকশো গজ দূরে। নদী ছেড়ে একটা সরু খাল শহরের পেট চিরে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে, সেই খালের মধ্যেই এই ঘাট। এই দূরত্বটাই এই ঘাটের সৌন্দর্য। খালটি নদীতে প্রবেশের আগে কয়েকশো গজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পেরিয়ে আসে। ঘাটের ছাউনি বরাবর বিশাল একটা অশ্বথ গাছ ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। গ্রামের হাটবাজারে কিংবা নদীর ঘাটেও এই গাছগুলিই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মহানগরের এই দালানকোঠার ভিড়ে কেউ খেয়াল করে ওকে? এরকম গাছগুলো কেউ লাগায় কিনা জানি না, মনে হয় এরা পাখির ঠোঁট থেকে পতিত বীজ থেকে জন্মায়, তারপর অযত্নে বেড়ে ওঠে একসময় মহীরূহ হয়ে যায়। এই গাছের ছায়ায় বসে মানুষ যাত্রার ক্লান্তি দূর করে, আয়েশ আড্ডাবাজি করে, আর বৃষ্টির সময় এই গাছগুলো হয়ে ওঠে নিদারুন আশ্রয়। আহ্ আমারো তেমন একটা আশ্রয় বৃক্ষ ছিল গ্রামের বাঁশবনটায়।

বই আছে, সময় নেই

কত কত বই জমে আছে! এত বই পড়ার সময় কই? সীমিত আয়ুষ্কালে এতসব বই কী পড়া শেষ করা যাবে? পড়তে পড়তে প্রায়ই এই দুশ্চিন্তাটা মাথাচাড়া দেয় পড়ুয়াদের। বিশেষ করে সেই পড়ুয়া যারা 'বেঁচে থাকার জন্য পড়ে' কিংবা 'পড়ার জন্য বেঁচে আছে'। পড়াশোনা ব্যাপারটা তাদের কাছে বেঁচে থাকার অক্সিজেনের মতো। বইয়ের কাছে না থাকলে এরা রীতিমত হাঁসফাস করে। 


সময় কম, বই বেশী। কম সময়ে বেশী বই পড়ে এগিয়ে থাকার যুদ্ধে চাপটা এসে পড়ে দৃষ্টিশক্তির উপর।  লক্ষ্য যদি হয় বেশীদিন পড়া, তাহলে চোখকে বাঁচাতে হবে। অন্য যেসব কাজে আমাদের চোখ ব্যবহার করতে হয় সেসব কাজ কমিয়ে বইয়ের খাতে বেশী বরাদ্দ রাখতে হবে। সেটা কী আদৌ সম্ভব?  ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমাদের চোখ গড়ে ৮ ঘন্টা বন্ধ থাকে ঘুমের জন্য। কমপক্ষে ৮ ঘন্টা জীবিকার কাজে লাগে। বাকী থাকে ৮ ঘন্টা। এই ৮ ঘন্টার মধ্যে স্নাহাহার, যাতায়াত এসবে ৪ ঘন্টা (ঢাকা শহরে যাতায়াত বাবদ আরো বেশী খরচ হয়)। বাকী থাকলো ৪ ঘন্টা। এই চারঘন্টা ভাগাভাগি করতে হবে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, অতিথি, আড্ডা, ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদির মধ্যে। সবাইকে সময় দিতে গেলে বই পড়ার জন্য দৈনিক আধঘন্টা সময়ও কি মিলবে? গাণিতিক হিসেবে বই পড়ার জন্য কোন সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।