Wednesday, May 16, 2018

মিহির সেন গুপ্তের 'চলার পথের চলনদার' এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্মৃতিপর্ব


বইটি আমি কেনার সিদ্ধান্ত নেই লেখকটির নাম মিহির সেন গুপ্ত বলেই। 'বিষাদবৃক্ষ' ছাড়া তাঁর আর কোন বই পড়িনি। ফলে বইটিকে নেহায়েত আরেকটি নতুন বই হিসেবে সংগ্রহ করি বিস্তারের বুকশেলফ থেকে। উল্লেখ্য যে আলম ভাই বছর দুয়েক আগে বইটির কথা উল্লেখ করেছিলেন এই আসরের একটি আলোচনাতে, বই কেনার সময় কথাটি আমার মনে ছিল না।

মিহির সেন গুপ্তের স্মৃতিচারণমূলক বই 'চলার পথের চলনদার' বইটিতে আমি তাঁর লেখক হয়ে ওঠার বিচিত্র কাহিনী পড়তে পড়তে আবিষ্কার করতে থাকি এক একজন লেখককে যাঁদের প্রেরণায় তিনি লেখক হয়ে উঠেছিলেন। যার একজন তাঁর অগ্রজ অভিজিত সেন। যাঁর 'রহু চণ্ডালের হাড়' পড়া শেষ করার কয়েকদিন পর্যন্ত আমি আবিষ্ট হয়ে ছিলাম। এক বাজিকরের কয়েক প্রজন্মের বিস্তৃত বিচিত্র কাহিনী উপন্যাসটির মূল উপজীব্য। অভিজিত সেন যে মিহির সেনের অগ্রজ এই তথ্যটি আমার জানা ছিল না। তথ্যটি জেনে আমি বেশ চমৎকৃত হই কেননা আমার পঠিত কয়েকটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে এই দুই সহোদরের পুস্তকের নাম উপস্থিত থাকবে সবসময়।

এই চমকপ্রদ তথ্যের পরে যে আরো বড় বিস্ময়টি অপেক্ষা করছিল সেটি জানার পর কয়েক সেকেণ্ডের জন্য থমকে গিয়ে মনে মনে বললাম, ভাগ্যিস বইটি কিনেছিলাম!

বিস্ময়টি হলো, মিহির সেনগুপ্তের লেখক হবার পথে অন্যতম চলনদারের ভূমিকা পালন করেছিলেন আমাদের প্রিয় ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।

হ্যাঁ, এই বইটির বিশাল একটা অংশ জুড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জীবনের অজানা একটা অধ্যায়কে তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় তুলে এনেছেন। এই স্মৃতিচারণটুকুর কারণে আমার কাছে বইটির মূল্য কয়েকগুন বেড়ে গেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের তেমন কিছুই জানা ছিল না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে কথোপকথনের সুযোগ পেয়েছিলাম একবারই, সেটা আশির দশকের শেষভাগে এবং অতি সংক্ষিপ্ত ছিল সেই সাক্ষাতপর্বটি। মিহির সেনগুপ্ত চমৎকারভাবে তাঁর শেষ জীবনের কিছু অজানা ঘটনা বিবৃত করেছেন ব্যক্তিগত স্মৃতির অংশ হিসেবে। তাঁর সাথে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পরিচয় ঘটেছিল ১৯৮৮ সালে, সেটি ঘনিষ্টতায় রূপ নিয়ে অব্যাহত ছিল জীবনের প্রায় শেষ পর্ব পর্যন্ত।

দুজনের মধ্যে এই সম্পর্কের প্রধান একটি সুত্র ছিল অভিজিত সেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন অভিজিত সেনের একজন মুগ্ধ পাঠক। তাঁর সব বই ইলিয়াসের পড়া ছিল। 'রহু চণ্ডালের হাড়' নিয়ে তিনি চমৎকার একটি আলোচনা করেছিলেন একটি সাহিত্য পত্রিকায়। 'গল্পপাঠ'এর সৌজন্যে সেই আলোচনাটির সন্ধান পাই। মিহির সেন গুপ্ত প্রথম সাক্ষাতে নিজেকে অভিজিত সেনের ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। অভিজিতের ভাই হিসেবে পরিচয় হলেও দুজনের সম্পর্কটা ব্যক্তিগত হতে দেরী হয়নি। মজার ব্যাপার হলো অভিজিতের সাথে ইলিয়াসের ব্যক্তিগত কোন পরিচয় ছিল না। ইলিয়াসের জীবনের শেষাংশে(১৯৯৬) কোলকাতায় দুজনের দেখা হয় খুব অল্প সময়ের জন্য যখন ইলিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে একটি পা হারিয়েছিলেন।

মিহির সেনগুপ্ত বিয়ে করেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরের বছর। তাঁর শ্বশুরবাড়ি বরিশাল। ১৯৭২ সালে বিয়ে করলেও শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত বিরতিতে যাতায়াত শুরু করেন ১৯৮৬ সাল থেকে। সেই যাতায়াতকালের এক পর্যায়ে পরিচয় ঘটেছিল ইলিয়াসের সাথে। কাকতালীয়ভাবে মিহির সেনগুপ্তের স্ত্রী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্ত্রী পরস্পরের বন্ধুও ছিলেন। যারা একসাথে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্পর্কটা সেদিক থেকেও পারিবারিকভাবে যুক্ত ছিল।

দুজনের মধ্যেকের চমৎকার স্মৃতিগুলো পড়তে পড়তে থমকে যেতে হয় শেষাংশে এসে। মিহির সেন গুপ্ত এই পর্বে এসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আকাশের সমান বড় করে তোলেন আমাদের চোখে। ১৯৯৬ সালে হঠাৎ করে ইলিয়াসের হাড়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে তিনি চিকিৎসার জন্য কোলকাতা যান। কোলকাতায় চিকিৎসা চলাকালে তাঁর জন্য আনন্দ পুরস্কার দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তিনি বরাবরই আনন্দবাজার গোষ্ঠির বিপক্ষ শিবিরের মানুষ। তাই তিনি কিছুতে পুরস্কার নিতে রাজী হচ্ছিলেন না।

সেই সময়টি তাঁর জন্য চরম একটি ক্রান্তিকাল। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর চিকিৎসকরা তাঁর পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর পরিবার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। শারিরীক মানসিক আর্থিক সংকটে জর্জরিত পরিবার। অথচ অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকের বহুল কাংখিত এই আনন্দ পুরস্কার(তখনকার আর্থিক মুল্যে পাঁচ লাখ টাকা) তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন এই বলে যাদের বিরুদ্ধে তিনি চিরকাল লিখে গেছেন তাদের কাছ থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহন করলে তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না, পাঠকরাও ক্ষমা করবে না।

সেই সংকটপূর্ণ অবস্থায় তাঁকে রাজী করানোর জন্য কোলকাতায় অবস্থানরত ড.আনিসুজ্জামান মিহির সেনগুপ্তকে অনুরোধ করেন তপন রায় চৌধুরীর মাধ্যমে। অনেক চাপে পড়ে পরিবারের দিকে তাকিয়ে তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত রাজী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে অবস্থায় এত বড় একটি পুরস্কারের লোভ সামলাতে পারেন সেটুকু ভেবে আমার চোখ ভিজে যায় এই ২২ বছর পরেও। মনে মনে বলি - এই আমাদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যাকে আমরা কি এখনো সঠিক মূল্য দিতে পেরেছি?

চিকিৎসকদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে তার এক বছর পরেই ৪ঠা জানুয়ারী ১৯৯৭ তারিখে তিনি পৃথিবীকে বিদায় জানান। যে দুটো উপন্যাস দিয়ে তিনি বিশ্বজয় করার মতো শক্তি অর্জন করেছিলেন সেই সুত্রে আমরা এখনো সগর্বে বলতে পারি আমাদেরও একজন মার্কেজ ছিলেন।

মিহির সেনগুপ্তের কাছে আমি কৃতজ্ঞ তিনি বইটিতে নিজের লেখক হয়ে ওঠার বিবরণের পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অজানা অধ্যায়গুলো আমাদের সামনে হাজির করেছেন বলে। আমরা দেখলাম দুজন লেখক কিভাবে পরস্পরকে আগলে রেখে বড় হয়ে উঠতে পারে। দুই প্রিয় লেখক আমাদের চোখের সামনে প্রেরণা হয়ে থাকতে পারে একই সঙ্গে। বড় বেদনার সাথে বড় আনন্দও জেগে থাকে এখানে।

[বিস্তার সাহিত্য চক্রে প্রকাশিত]

Sunday, May 13, 2018

অভিজিত সেনের 'রহু চণ্ডালের হাড়' নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবন্ধ

অভিজিত সেনকে চেনার আগেই তাঁর দুটো উপন্যাস পড়ে ফেলেছিলাম বছর দুয়েক আগে। 'রহু চণ্ডালের হাড়' এবং 'মৌসুমী সমুদ্রের উপকূল' পড়ে মুগ্ধ হয়েও আমার কাছে অচেনা থাকা এই লেখকের সুলুক সন্ধান করিনি। কয়েকদিন আগে কেনা মিহির সেনগুপ্তের আত্মজীবনীমূলক লেখা 'চলার পথের চলনদার' পড়তে গিয়ে জানতে পারলাম অভিজিত সেন তাঁরই অগ্রজ। চমকপ্রদ এই তথ্যটি আমার ভেতরে আনন্দদায়ক অনুভূতির সঞ্চার ঘটায় এবং আমি অভিজিত সেনের আরো বই সংগ্রহ করতে উদগ্রীব হই। সেই অনুসন্ধানে গিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই লেখাটি পেয়ে যাই গল্পপাঠের সৌজন্যে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অভিজিত সেন সম্পর্কে যা লিখেছেন তাতে আমার আরেকটা আকাংখা পূরণ হয়, আমি চেয়েছিলাম রহু চণ্ডালের হাড় দিয়ে কিছু লিখতে, কিন্তু সাধ্যে কুলোয়নি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখাটা পড়ে আমার না লেখার অতৃপ্তি অনেকটা ঘুচেছে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গদ্য : অভিজিৎ সেনের হাড়তরঙ্গ

কোরক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক আমাকে একজন অগ্রজ লেখক বিবেচনা করে অভিজিৎ সেনের সাহিত্যকীর্তির ওপর লিখতে বলায় আমি গর্ব বোধ করি, তার চেয়ে বিব্রত হই অনেক বেশি। অভিজিৎ সেনের প্রকাশিত সব বই পড়েছি, কিন্তু তাঁর সমসাময়িক পশ্চিম বাংলার অন্যান্য লেখকের, ঠিক করে বললে, 'অন্য' ধারার লেখকদের রচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ এখানে কম। ঢাকার বইয়ের দোকানগুলোর সারি সারি শেলফ যাঁদের বই দিয়ে ঝকমক করে তাঁরা পশ্চিম বাংলার সব জাঁদরেল লেখক।

অভিজিৎ সেন কিংবা ঐ বিরল প্রজাতির লেখক পাঠকের মনোরঞ্জন করা যাঁদের কায়মনবাক্যের সাধনা নয়- তাঁদের বই এখানে পাওয়া মুশকিল। আবার গত শতাব্দীর কোম্পানির কাগজের মতোই দামি কলকাতার সব বড় বড় 'হৌস'- এর রংবেরঙের ঢাউস পত্রিকার তোড়ে এখানে শাহবাগ, মতিঝিল, স্টেডিয়ামের ফুটপাথে পা রাখা দায়, সেখানে কী পশ্চিম বাংলা কী বাংলাদেশের ঐসব লিটল ম্যাগাজিনের ঠাঁই কোথায়, যেখানে ব্যক্তিতে সমাজে ও ইতিহাসে ব্যাপক ও গভীর খোঁড়াখুঁড়ির কাজে নিয়োজিত লেখকদের রক্তাক্ত চেহারা দেখতে পাওয়া যায়? কলকাতার কথা জানি না, তবে ঢাকায় পশ্চিম বাংলার এসব লেখক ঘোরতরভাবে অনুপস্থিত। তো এঁদের অধিকাংশের লেখার সঙ্গে পরিচিত না-হয়ে কেবল দুটো বছর আগে লিখতে শুরু করেছি বলে এঁদের বড়দার মেকআপ নেওয়ার মতো বুকের পাটা আমার নেই।

না, অগ্রজ লেখক হিসেবে কিছুতেই নয়, অভিজিৎ সেনের লেখা নিয়ে কথা বলার ভরসা করি অন্য বিবেচনা থেকে। প্রিয় লেখকের বই পড়ে প্রতিক্রিয়া জানাবার এখতিয়ার নিশ্চয়-ই যে-কোনো পাঠকের আছে।

অভিজিৎ সেনের রহু চণ্ডালের হাড় অপ্রত্যাশিতভাবে পাই ১৯৮৭ সালে, কলকাতা থেকে আমার বন্ধু দিলীপ পাঠিয়ে দিয়েছিল। পড়তে শুরু করেই বইটি দারুণ মনোযোগ দাবি করল, পড়তে হয়েছিল আস্তে আস্তে। একটানা পড়বার মতো বই নয়, পাঠককে গ্রাহক ঠাউরে নিয়ে সেঁটে রাখার ফন্দি এখানে প্রয়োগ করা হয়নি। পড়তে পড়তে কাহিনীর সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়া এখানে অসম্ভব, বরং বইটিকে যত্নের সঙ্গে অনুসরণ করতে হয়। এদিকে প্রধান চরিত্রের নামও বারবার ভুলে যাচ্ছিলাম, তাঁকে খুঁজতে একটু কষ্টই হচ্ছিল। পরে বুঝতে পারি প্রধান চরিত্র বলতে যা বুঝায় সেরকম একজণ পুরুষ বা একজন মহিলা এখানে খোঁজা নিরর্থক। না, নায়ক খুঁজিনি। উপন্যাস থেকে নায়ককে বহিস্কার করা হয়েছে সে তো অনেকদিন আগে। লেখকের লাই পেয়ে ধাড়ি সাইজের ছিঁচকাদুনে একটি শিশু সারা বই জুড়ে প্যানপ্যান করলে তাকে জলজ্যান্ত নায়ক বলে শনাক্ত করা সাহিত্যের গোয়েন্দাবিভাগে কর্মরত সমালোচক ডেজিগনেশনধারী কর্মকর্তা ছাড়া আর কারও সাধ্যি নয়।কিন্তু এই রহু চণ্ডালের হাড় বইতে নায়ক পাওয়া গেল, চোখের জলে নাকের জলে গলে-যাওয়া-মাংসপিণ্ডের প্রধান চরিত্র নয়, খটখটে হাড্ডির নায়ককে এখানে বেশ হাড়ে-হাড়ে ঠাহর করা যায়। কিন্তু এই নায়ক কোনো একজন ব্যক্তি নয়, সে ব্যক্তি নয়, একবচন নয়। সে হল বহুবচন। তার নাম কী?

- নাম বাজিকর। বাজিকর একটা গোষ্ঠী।

- নিবাস?

-তামাম দুনিয়া।

ঘর নেই বলে দুনিয়া জুড়ে তার নিবাস। ঘর হারাবার পর থেকে তারা ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে দিনের পর দিন। কোনো এককালে তারা ছিল গোরখপুরে। ভূমিকম্পে সেখান থেকে উৎখাত হয়ে ঘুরে ঘুরে গিয়েছিল রাজমহল। সেখান থেকে মণিহারিহাট, হরিশ্চন্দ্রপুর, সামামি হয়ে মালদা। পূর্বের দিকে তাদের যাত্রা। পূর্বদিকে সূর্য ওঠে, তাদের পূর্বপুরুষ বলেছিল পূর্বেই যেন থিতু হয় তারা। তাই মালদা হয়ে রাজশাহী, তারপর পাঁচবিবি। সেখানে মার খেয়ে ফের যেতে হয় পশ্চিমের দিকে। তা ঘর তো আরও কারও কারও থাকে না। কিন্তু তাদের গন্তব্য থাকে। ইহুদিরা হাজার হাজার বছর ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু তাদের জন্য ছিল প্রতিশ্রুত দেশ, ঈশ্বর তাদের পছন্দ করেন, পছন্দের বান্দাদের জন্য তিনি খাস জায়গা রেখে দিয়েছিলেন। তাদের পয়গম্বররা সবাই ঈশ্বরের প্রতিনিধি, পয়গম্বররা জানত ইহুদিদের ঘর একদিন-না-একদিন মিলবেই। কিন্তু এই বাজিকরদের কোনো দেশ তাদের জন্য অপেক্ষা করে না, নিজেদের দেশ তাদের নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হবে।

-বেশ তো, নিবাস ঠিকানাহীন। তবে তাদের ধর্ম কী? কী জাতি?

বাজিকর এবার লা-জওয়াব। নিজেদের ধর্ম যে কী তা তাদের জানা নেই। প্রচলিত ধর্মগুলোর কোনোটিকেই তারা সচেতনভাবে গ্রহণ করেনি, আবার ধর্মও তাদের রেহাই দিয়েছে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেনি। তারা ধার্মিক নয়, আবার এই কারণেই বকধার্মিক হওয়াও তাদের সাধ্যের বাইরে। এতে বাজিকর যে আরামে দিন কাটায় তা নয়, তার কাছে আল্লা ভগবান নামে এমন কোনো পাত্র নেই যার ভেতর তার বিবেচনা, অভিজ্ঞতা সব ঢেলে দিয়ে সে নিশ্চিত হতে পারে।

-তাহলে তার ভাষা কী?

এরকম একটি মূলোৎপাটিত গোষ্ঠীর ভাষার পরিচয় দেওয়া কি সোজা? তার যা আছে তাকে বড়জোর বুলি বলা যায়। তার যেখানে রাত সেখানে কাত, তেমনি দেখা যায়, কিছুদিন থাকতে থাকতেই সেখানকার বুলি সে জিভে তুলে নেয়। পায়ের মত জিভও তার বড় পিচ্ছিল, কোনো জায়গার বুলিই তার মুখে ভাষা হওয়ার সময় পায় না, দেখতে-না-দেখতে বাজিকর চলে যায় অন্য কোথাও, সেখানে গিয়ে সে নতুন বুলি রপ্ত করে।

রহু চণ্ডালের হাড়-এর এই গৃহহীন, ভূমিবঞ্চিত, ধর্মমুক্ত বাজিকর গোষ্ঠী একটি স্থায়ী ঠিকানার খোঁজে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, এক শতাব্দী পেরিয়ে আরেক শতাব্দী জুড়ে এবং গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, এক নদী পেরিয়ে অন্য নদীর তীরে, পাহাড় পাড়ি দিয়ে আরেক পাহাড়ের উপত্যকায় তাঁবু গাড়ে, জমি পেলে লাঙল চষে, মাঠের জানোয়ার পোষ মানায়, গৃহস্থের পশু হাতাতেও তাদের জুড়ি নেই, সেখানকার বুলি তুলে নেয় মুখে। কিন্তু আসন পেতে বসা তাদের কপালে নেই, অভিশপ্ত পূর্বপুরুষের পাপে (?) তারা ঠিকানাবিহীন মানুষ।

কিন্তু এই পরম অনিশ্চিত বেপরোয়া জীবনযাপন সত্ত্বেও এদের বেঁচে থাকবার সাধে এতটুকু চিড় ধরে না। এদের সংগঠিত রাখার জন্য ঢিলেঢালা আয়োজন করত এদেরই কোনো সরদার, তাদের চেহারা ও ব্যক্তিত্ব অনেকটা সেমেটিক পয়গম্বরদের মতো। দনু, পীতেম, জামির- নিজেদের লোকজন সম্বন্ধে এদের ভাবনা ও উদ্বেগ, দায়িত্ববোধ ও মনোযোগ পয়গম্বরদের চেয়ে কম কী? মাঝে মাঝে এদের মধ্যে যে- হিংস্র আচরণ দেখি কিংবা যেভাবে প্রবল হিংসার শিকার হয় তাতেও বাইবেলের কথাই মনে পড়ে বইকী! এরা বারবার মনে করে : রহু এদের সহায়, কিন্তু রহু একেবারেই মানুষ। জেহোভা কী ট্রিনিট কী আল্লার মহামহিম অলৌকিক শক্তি এদের কোথায়? সর্বশক্তিমান কোনো দেবদবেী এদের নেই। সমাজের মূলধারায় ধর্মবোধ-নিয়ন্ত্রিত নৈতিকতা কী অনৈতিকতা কিংবা রাষ্ট্র পরিচালিত শৃঙ্খলা কী বিন্যস্ত বিশৃঙ্খলা এদের গোষ্ঠীজীবনে অনুপস্থিত। দেবদেবী কী আল্লারসুলের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার কী সঁপে দেওয়ার সুযোগ নেই বলে নিজেদের ভালোমন্দ এদের ঠিক করতে হয় নিজেদেরই। একদিকে তাই অবাধ স্বাধীনতা, অন্যদিকে কঠিন দায়িত্ববোধ। স্থায়ী ঠিকানা পেতে হলে কঠিন কাঠামোর কাছে আত্মসমর্পন করতে হয়, স্বাধীনতা তখন বিসর্জন না-দিয়ে উপায় থাকে না। সমাজের মূলধারার মানুষের মতোই থিতু হবার বাসনা এদের প্রবল, অথচ গোরখপুরের ভূমিকম্পে উৎখাত হওয়ার অনেক আগেই অস্পষ্ট অতীতকালেও কিন্তু এরা ছিল কোন মরু এলাকার মানুষ, সেখানেও তো যাযাবর হয়েই জীবনযাপন করেছে। এই এত দীর্ঘকালের পদযাত্রার লক্ষ্য স্থায়ী ঠিকানা। তারা চেয়েছে গৃহস্থ হতে : মোষ থাকবে, হাল লাঙল থাকবে, আর থাকবে জমি। পথে পথে দেবদেবী জোগাড় করলেও কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। সম্মানিত ও দাপটের দেবদেবীর কাছে আত্মসমর্পণ করেও এরা অচ্ছুৎই রয়ে যায়। এদের একটি অংশ কলেমা পড়ে ঠাঁই মাগে আল্লারসুলের দরবারে। আখেরাতে রহমানুর রহিম তাদের জন্য কী বরাদ্দ করেছে অতদূর ভাববার শক্তি তাদের নেই, তাই নিয়ে মাথাও ঘামায় না। কিন্তু কলেমা পড়লেও ভদ্দরলোক মুসলমানদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান আগের মতোই রয়ে যায়। বৃহত্তর সমাজে মিশে যাওয়ার এই প্রচণ্ড ইচ্ছা থেকেই একদিন-না-একদিন তারা মূলধারায় বিলীন হবে, এজন্য দাম দিতে হয় খুব চড়া। নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়, কিন্তু মর্যাদা পায় না। বাজিকরের ব্যক্তির অভিমান ও গোষ্ঠীর গর্ব বাঁধা থাকে একই তারে, যেখানে যায় সেখান থেকেই উচ্ছেদ হবার গ্লানি এবং ঠিকানা যোগাড় করার সংকল্প প্রত্যেকটি ব্যক্তি ও এই গোষ্ঠীর মধ্যে এমনভাবে প্রবাহিত যে ব্যক্তি ও সমষ্টির আলাদা পরিচয় পাওয়া মুশকিল। প্রেম, কাম, ক্রোধ, হিংসা, বাৎসল্য, ঈর্ষা, ক্ষোভ, লোভ এবং সাধ এই উপন্যাসে এসেছে এক-একজন মানুষের ভেতর দিয়েই, কিন্তু তা কখনোই আলাদা হয়ে থাকে না, একই সঙ্গে পরিণত হয় বাজিকরের গোষ্ঠীর সাধারণ অনুভূতিতে। কিন্তু মূলধারায় লীন হলে কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে বিলীন হলে এই চেহারা ধ্বংস হয়ে যায়, ব্যক্তি ও সমাজের একাত্মতা সেখানে নষ্ট হতে বাধ্য।

মূলধারার মানুষ বিচ্ছিন্ন মানুষ। ব্যক্তিস্বাধীনতার ডঙ্কা পিটিয়ে বু্র্জোয়া সমাজের উদ্ভব, অন্যের শ্রমের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই সমাজ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির এই বহুঘোষিত স্বাধীনতা রূপ নেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে এবং পুঁজির সর্বগ্রাসী ক্ষুধার মুখে সর্বাঙ্গ ঢুকিয়ে দিয়ে আজ এর পরিণতি ঘটেছে আত্মসর্বস্বতায়, এখন ঐ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নাম করা যায় ব্যক্তিসর্বস্বতা। ব্যক্তিসর্বস্বতা দিয়ে চিহ্নিত সমাজও যে-শিল্প সৃষ্টি করে তা দিনদিন স্যাঁতসেঁতে হয়ে আসছে রুগ্‌ণ ও রোগা ব্যক্তির কাতরানিতে। এই রুগ্‌ণ লোকটির ভেতরটা ফাঁকা ও ফাঁপা। অভিজিৎ সেন এই ফাঁকা ও ফাঁপা লোকের গল্প ফাঁদতে বসেননি। তিনি যে-শক্তির ইঙ্গিত দেন তা কোনো ব্যক্তির নয়, কেবল একটি গোষ্ঠীর নয়, বরং তা হল মানুষের শক্তি। মূলধারার সঙ্গে বিলীন হতে উদগ্রীব গোষ্ঠী সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে হতে শক্তি হারায়, তার স্বাধীনতা লোপ পায়। আগেই বলেছি, বাজিকরদের দীর্ঘ পদযাত্রা তাদের ঘর দিলেও দিতে পারে, কিন্তু সেই ঘরে মর্যাদা নেই, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্ষমতাবানদের কবজার ভেতর নিষ্পিষ্ট হওয়াই এদের পরিণতি। এই সমাজের যারা মালিক মানবিক বিকাশের সমস্ত পথ কিন্তু তাদের জন্যও বন্ধ, একটি মস্ত চাকার কাঁটা হয়ে তারা সমাজকে বিঁধতে থাকে, কিন্তু চাকা ঘোরে তাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবে, চাকা এগিয়ে নেওয়ার সৃজনক্ষমতা থেকে তারা বঞ্চিত অথবা সে-অধিকারও তাদের থাকে না।

রহু চণ্ডালের হাড়-এর কাহিনী এসে ঠেকেছে এই শতাব্দীর ষাটের দশকে। দেশ তখন স্বাধীন ও বিভক্ত। প্রশাসনকে নতুনভাবে সাজাবার উদ্যোগ চলছে। কিন্তু সমাজকাঠামোর বদল না-ঘটিয়ে প্রশাসনের সংস্কার শোষণব্যবস্থায় ভাঙন তো দূরের কথা, এতটুকু চিড়ও ধরাতে পারে না। কোনো ব্যক্তি কী কয়েকজন ব্যক্তির সদিচ্ছা ও সংকল্প থাকা সত্ত্বেও এই রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে থেকে শোষণব্যবস্থার ওপর কোনো আঘাত হানতে পারে না, প্রোথিত প্রতিষ্ঠানকে টলানো তার কিংবা তাদের পক্ষে অসম্ভব। এমনকী প্রশাসনের একটি অংশ হলেও পারবে না। অন্ধকারের নদী উপন্যাসে অশোক হল প্রশাসনের একটি খুঁটি, স্তম্ভ নয়, নিচের দিকের খুঁটি। তবু রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে তার একটি ভূমিকা রয়েছে।

অশোক একজন সৎ মানুষ এবং নিষ্ঠাবান প্রশাসক। রাষ্ট্রের সংবিধানের নিয়মকানুন ব্যবহার করেই সামাজিক প্রতারণা ও শঠতা থেকে মানুষকে রেহাই দেওয়ার জন্য সে উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন প্রয়োগে সে বেশ শক্ত হয়। কিন্তু এই শক্তি তো রাষ্ট্রের শক্তি। রাষ্ট্রের কাজ সামাজিক শোষণকে সুসংগঠিত পদ্ধতির ভেতর রেখে পরিচালনা করা। পদ্ধতির ভেতরে মাঝে মাঝে ঢিল দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, এর উদ্দেশ্য হল শিকারকে একটু বিচরণ করতে দিয়ে তাকে নিয়ে খেলা যাতে হঠাৎ করে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সে দড়ি ছেঁড়ার কাজে না-মাতে। রহুর উত্তরপুরুষরা যে মূলধারার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সেই ধারাটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, সমাজের স্থিতিশীলতাকে ঠিক রাখা অর্থাৎ শোষণব্যবস্থার শরীরটিকে হৃষ্টপুষ্ট রাখার জন্য প্রণীত আয়োজনকে সুষ্ঠুভাবে রূপ দেওয়াই হল অশোকের সরকারি দায়িত্ব। এই বিশাল আয়েজনকে পণ্ড করার জন্য তো আর অশোককে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটি ছোট নাটবল্টু হল আমাদের অশোক সাহেব। নাটবল্টু থাকবে নাটবল্টুর মতো, তার নড়াচড়া রাষ্ট্র সহ্য করবে কেন? করেওনি। রাষ্ট্রের কয়েকটি নিয়ম অনুসরণ করতে গিয়ে পদেপদে বাধা পায় এবং রাষ্ট্রেরই আরও সুক্ষ্ম নিয়মে তাকে শাস্তিপ্রদানের আয়োজন চলে।

প্রশাসনে তৎপর না-হয়ে নিষ্ক্রিয় থাকলে রাষ্ট্রের গায়ে ঝড়ঝাপটা লাগার সম্ভাবনা কম। তৎপর হতে গিয়ে অশোক ভুল করে। তৎপর মানুষের প্রতিক্রিয়াও চাপা থাকে না, বরং তা প্রকাশ করাও তৎপরতার প্রধান অংশ। যে যারা রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কবজা করেছে তার পাণ্ডারা ঘটনা ঘটায়, আবার এর প্রতিকার চায় যারা, তাদের হাতেও একই ঝাণ্ডা। অশোক এই ধাপ্পাবাজির শিকার। এই ধাপ্পাবাজিতে ক্রুদ্ধ হন অভিজিৎ সেন নিজেও।

আমার বন্ধু মাহবুবুল আলম অন্ধকারের নদীতে পড়ে একটি মন্তব্য করে; মাহবুব লেখার ব্যাপারে অলস বলে ওর কথাটা আমিই লিখি : অন্ধকারের নদীতে উনিশ শতকের বাংলা নকশাজাতীয় রচনার কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। উপন্যাসের কাহিনী-রচনার চেয়ে লেখক অনেক বেশি মনযোগী সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরার কাজে। তবে প্যারীচাঁদ মিত্র কী কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজেদের সময়কে তুলে ধরেন অতিরঞ্জন ও হাস্যবিদ্রুপ দিয়ে, অভিজিৎ সেখানে সামাজিক অন্যায়কে প্রকাশের সময় নিজের প্রবল ক্রোধ প্রকাশ না-করে পারেন না। এই ক্রোধ তাঁর পূর্বসূরিদের শ্লেষের চেয়ে অনেক তীব্র। তবে একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে লেখকের কান্না লুকোবার চেষ্টা লক্ষ করা যায়।

আমার কাছে কিন্তু অন্ধকারের নদী উপন্যাস। এর কোথাও অসামঞ্জস্য নেই, টুকরো টুকরো ঘটনা দিয়ে কাহিনী সাজাবার চেষ্টাও অভিজিৎ করেননি। তবে হ্যাঁ, বইটির আগাগোড়া ক্রোধ বড় স্পষ্ট। তাঁকে রাগ কমাতে বলা মানে নিরপেক্ষ হতে বলা। না, অভিজিৎ সেনকে নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য মিনতি করা হচ্ছে না। এখন কোনো সৎ মানুষের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নয়। এখন নিরপেক্ষ লেখক জন্মান না, জন্মিয়া কাজ নাই। কিন্তু অভিজিতের ক্রোধ তাঁকে উত্তেজিত করেছিল, ফলে ওই উপন্যাসের অনেক জায়গায় তিনি অস্থির। বাজিকরদের দেড়শো বছরের দীর্ঘ পর্যটন তিনি অনুসরণ করেছেন পরম ধৈর্য নিয়ে। অভিশপ্ত রহু পয়গম্বরের বংশধরদের জীবনকে তিনি এমনভাবে দেখেন যে তাদের প্রকাশ করার জন্য তারাই যথেষ্ট, অভিজিৎকে সেখানে গায়ে পড়ে আসতে হয় না। কিন্তু অন্ধকারের নদীতে উত্তেজিত অভিজিৎ এসে পড়েন নিজেই। তাই অশোককে উপচে ওঠে তার উপস্থিতি। ফলে জ্যান্ত মানুষের রক্তমাংস থেকে অশোক মাঝে মাঝে বঞ্চিত হয় বইকী! অভিজিৎ তাঁর সৃষ্ট মানুষকে স্বাধীনভাবে চলতে দেবেন তো! অশোকের চিন্তাভাবনা, তার সংকট ও সংশয়, তার সংকল্প ও তৎপরতা প্রকাশের কাজ অভিজিৎ নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এতে অশোকের প্রতি তাঁর সহানুভূতি যতটা উদ্ভাসিত হয়, একজন আস্ত মানুষ সৃষ্টিতে মনোযোগ সেভাবে প্রকাশিত হয় না।

তার ঊনপঞ্চাশ নৌকার সাঁইয়ের প্রতি হাঁক বরং ধামানের নিজস্ব। উপন্যাস পড়া শেষ হলেও এই ডাক কানে গমগম করে বাজে। বইটির প্রচ্ছদে গণেশ পাইনের দি কল ছবিটি উপন্যাসের শেষভাগে এসে এমন অস্থির ও সর্বগ্রাসী আহ্বানে পরিণত হয়েছে যে, অশোকের দূর্বল চেহারা আর মনে থাকে না। একই বইতে দুজন মানুষকে দুইভাবে নির্মাণের পেছনে কি অভিজিতের এই বোধ কাজ করেছে যে প্রশাসন- ব্যাপারটির মধ্যে একটি ত্বরিতগমনের ভাব থাকে এবং মানুষের মুক্তির আহ্বান সবসময় দীর্ঘ ও অচঞ্চল? কিন্তু, বিষয় যা-ই হোক কিংবা চরিত্র যে-স্বভাবেরই হোক, মানুষকে স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে না-দিলে সন্দেহ হয় যে তার সমস্যাটিকে লেখক উপযুক্ত মর্যাদা দিচ্ছেন না।

বালুরঘাটের বিবর্ণ মুখোস পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ইন্টারভিউতে অভিজিৎ সেন তাঁর লেখার ব্যাপারে একটি কৈফিয়ত দিয়েছেন। সোচ্চারভাবে মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য তাঁর রচনার সাহিত্যিক মূল্য ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না সে-সম্বন্ধে একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি তাঁর রচনার ঐসব অংশ বাদ দিয়ে পড়বার পরামর্শ দিয়েছেন। এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করা উচিত। যে-কোনো লেখা পাঠকের হাতে পড়লে তার প্রতিটি বর্ণই পাঠের যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। অভিজিতের রচনার কোনো অংশ বাদ দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বরং, পাঠক তাঁর কাছে যা দাবি করেন তা হল এই : ঐসব জায়গায় উপযুক্ত রক্তমাংস প্রয়োগের সুযোগ তাঁর করে নেওয়া উচিত। তা হলে চরিত্র গড়ে ওঠার স্বাধীনতা পাবে আরও বেশি। শক্তিশালী চরিত্র উপন্যাসের শরীরে রক্ত চলাচলের ইন্ধন।...

যেমন দেখি দেবাংশী উপন্যাসে লোহার সারবান। সে কিন্তু আগাগোড়া নিজের পায়েই দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে ঠেকা দেওয়ার জন্য লেখককে এগিয়ে আসতে হয়নি। লোকটি দৈবী ক্ষমতা পেয়ে সত্যি দেবতা হয়ে উঠেছিল, লেখক একবারও তথাকথিত বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেননি, তাকে দেবতা হতে কোথাও কিছুমাত্র বাধা দেননি। তারপর দিন যায়, অল্প কয়েক পৃষ্ঠাতেই দিন যায়, কিন্তু লেখক সময়কে ঠেলে দ্রুত পার করিয়ে দেন না, লোকটি খেরা খেলার কলাগাছে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকে, শরীরের কাঁপুনি তার আস্তে আস্তে কমে, কমতে কমতে লোপ পায়, নিজের দৈবী ক্ষমতায় তার সন্দেহ হয়, রাতে তার ঘুম হয় না। তাকে জাগিয়ে রাখার জন্য কী জাগিয়ে তোলার জন্য অভিজিৎকে গান গাইতে হয় না। ফের দেবাংশীর ঐ আসন বর্জন করার বল সে জোগাড় করে নিজে নিজেই। এই গল্পে ব্যবহৃত স্থানীয় সংস্কার আর শ্লোক আর প্রবাদ যেন হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হয়ে দেবাংশীকে নির্মান করে তুলেছে। মনে হয় গল্পটি কাল নিরপেক্ষ। এই গল্প হাজার বছর আগেরও হতে পারত। হিউ-এন-সাঙ যখন এসেছিলেন, পুন্ড্রবর্ধন আর সোমপুরের বিহার নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফাঁকে ফাঁকে আশেপাশের গ্রামগুলোতে উঁকি দিলে তিনি এই দৃশ্য দেখতে পেতেন। কাহ্ন পা, লুইপার আমলেও দেবাংশী ছিল। কবিকঙ্কন, কাশীরাম, কৃত্তিবাস, আলাওল, ভারতচন্দ্রের সময় দেবাংশী সশরীরে উপস্থিত। কৈবর্ত বিদ্রোহে দেবাংশীরা কী করেছিল? বল্লাল সেন এদের মানুষ বলে গণ্য করেনি, নইলে এমন বিধান একটা ছাড়ত মশামাছি-পঙক্তিভুক্ত হয়ে ওদের আস্তাকুঁড়ে ঠাঁই নিতে হত। কিন্তু তখন ওরা ছিল। তারপর গঙ্গা, ব্রক্ষ্মপুত্রে, তিস্তায়, করতোয়ায় কত জল গড়াল, বখতিয়ার খিলজি, হোসেন শাহ, শায়েস্তা খাঁ, আলিবর্দি, সিরাজদৌল্লা মাটির সঙ্গে মিশে গেল, দেবাংশীরা মাটির ওপরেই বিচরণ করে। সমুদ্রের ওপার থেকে সায়েবরা এল, সায়েবরা গেল, নতুন সায়েবরা চেপে বসল, দেবাংশীদের বিনাশ নেই। বাংলা জুড়ে কতকালের শয়তানি, জোচ্চুরি আর হারামিপনা চলে আসছে, প্রতিবাদও হচ্ছে আবহমানকাল ধরে। এসবের এই সর্বকালীন চেহারাটি অভিজিৎ নিয়ে এসেছেন অসাধারণ শক্তির সাহায্যে। কাহিনীর শেষে দেখি থিকথিক করছে ক্রুদ্ধ ও প্রতিবাদী মানুষের ভিড়। শয়তান এসে তাড়া-খাওয়া-কুত্তার মতো আশ্রয় নিয়েছে খেরা থানের গণ্ডিতে। ঐ জায়গাটা তখন পর্যন্ত ফাঁকা। এখনও ওটা ফাঁকাই রয়েছে। ঐটা দখল করার জন্য অভিজিৎ কোনো উপদেশ দেন না, জায়গাটা কেবল দেখিয়ে দিলেন। এর বেশি ইঙ্গিত কি কোনো শিল্পী দিতে পারেন? এরকম লেখায় অভিজিৎ যে-সংযম দেখাতে পারেন তা কিন্তু কোনো অলৌকিক শক্তি থেকে নয়, বরং দেশের, সমাজের ও ইতিহাসের ভেতরকার স্রোতটি বুঝতে পারেন বলেই এখানে বড় মাপের শিল্পী হয়ে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে।

এই হাজার বছরের শোষণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য নিয়েজিত রাষ্ট্র এই কাজে ব্যবহার করে চলেছে সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতি। কিন্তু তাতেই কি শেষরক্ষা হয়? দেবাংশীর মতো শাশ্বত রঙ আইনশৃঙখলা গল্পে নেই, রাষ্ট্র এখানে সশরীরে বিদ্যমান, সাম্প্রতিক পশ্চিম বাংলায় শোষণের জন্য ব্যবহৃত আধুনিক কায়দাকানুন এই গল্পে উপস্থিত। ব্যুরোক্র্যাট-টেকনোক্র্যাটের মনকষাকষি, মন্ত্রীদের এর ওর পেছনে লাগা, এসবে গুরুত্ব যা-ই হোক, এ থেকে শৃঙ্খলা, ন্যায় ও নিয়মকানুনের পোজ-মারা-প্রশাসনের ভেতরটা একটু দেখা যায়। এই প্রশাসনকে কবজা করার কাজে সতত সক্রিয় রাজনীতিকেও অভিজিৎ ঠিকঠাক শনাক্ত করেন। সমাজতন্ত্রের নাম করে যে-কমরেডরা ভোটের সুড়ঙ্গপথে ক্ষমতায় আসীন হয় তাদের পূর্বসূরিদের মতো তাদেরও একমাত্র লক্ষ সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাকে জলাঞ্জলি দেওয়ার পর কংগ্রেসের ষণ্ডা-পাণ্ডাদের সঙ্গে এই কমরেডদের আর পার্থক্য থাকে না। প্রশাসনের উন্নয়নের একটি ভূমিকা ইদানীং অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এই উন্নয়নের পথে শোষণব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কীভাবে আসছে তার ইঙ্গিত রয়েছে আইনশৃঙখলা গল্পে। সাম্রাজ্যবাদের শোষণস্পৃহা ও চালিয়াত রাজনীতির বাস্তবায়নের হাতিয়ার প্রশাসন, কিন্তু স্থির ও অচঞ্চল কোনো অমোঘ শক্তি নয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় শোষণের শিকার নিহত টুইনার বিধবা স্ত্রী কুশলী খোদ হাকিম সাহেবের ঘরে প্রসব বেদনায় কাঁপে। কুশলী তার শিশুকে জন্ম দেবে বলে হাকিম সাহেব তাঁর সমস্ত লোকলস্কর নিয়ে তাঁর এজলাস ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। রাষ্ট্রকে বাইরে ঠেলে দিয়ে কুশলী তার নিহত স্বামীর জ্যান্ত রক্তপিণ্ডকে পৃথিবীতে অবতরণের উদ্যোগ নেয়। নবজাতকের চিৎকারে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা চালাবার ঘরের দেওয়াল ও কাচ থরথর করে কাঁপে। আমরা সবাই টের পাই যে কুশলীর ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙে পড়েছে। এবার চরম আঘাতের জন্য প্রতীক্ষা। চরম আঘাতে অভিজিৎ সেনের বিশ্বাস অবিচল। সত্তরের দশকে ভারতে যে-আন্দোলন সবকিছুর ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার ভেতর তিনি মানুষ। মহাবৃক্ষের আড়াল গল্পের অনুপমও একদিন অভিজিতের সহযাত্রী ছিল। বিস্ফোরণ ঘটানো সেই আন্দোলন এখন আড়ালে পড়ে গেছে, অনুপম চাকরি করে সেইসব প্রতিষ্ঠানের একটিতে যাদের বিরুদ্ধে একদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল সমস্ত পিছুটান ঝেড়ে ফেলে দিয়ে। সত্তরের দশক একেবারে নিভে যায়নি। ভিয়েতনাম থেকে চালান হয়ে আসা বিশাল বৃক্ষের ভেতর থেকে বেরুনো বুলেটের সিসে হাতে নিয়ে অনুপম তার ধমনীতে আবার রক্তচলাচলের সাড়া পায়। মৃত বুলেট লুপ্ত বারুদের গন্ধে তাকে ফের চঞ্চল করে তুলতেও তো পারে। পতন হওয়ার পরেও এই বৃক্ষ দুটো করাত ভেঙে ফেলেছে। এর সম্ভাবনা তা হলে বিনাশ করবে কে?
...

বাজিকরদের দীর্ঘ পদযাত্রায়, ধামান সাঁইয়ের ডাকে, দেবাংশীর আহবানে, কুশলীর নবজাতক সন্তানের প্রবল চিৎকারে, করাতের কাছে মহাবৃক্ষের নত হতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনে অভিজিৎ সেন হাজার বছরের বন্দি মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহাকে ঘোষণা করেন। মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ চেতনায় এই স্পৃহা সুপ্ত রয়েছে, এই মানুষের ভাষায় এর খোঁজ পাওয়া যায়, তার গানে, তার শ্লোকে, তার প্রবাদে এরই প্রকাশ। তার সংস্কার ও সংস্কার ভাঙা, তার বিশ্বাসে ও বিশ্বাস ঝেড়ে ফেলা- এসবের ভেতরে যে-দ্বন্দ্ব তার মূলে মানুষের মুক্তির কামনা। অতীত থেকে, বর্তমান থেকে, ভাষা থেকে, গান থেকে, শ্লোক থেকে ও পুরাণ থেকে, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব থেকে মানুষ অবিরাম শক্তিসঞ্চয় করে চলেছে। এই শক্তি-অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত শিল্পী অভিজিৎ সেন। এই অনুসন্ধানের কাজটি সুখের নয়, পাঠককে স্বস্তি দেওয়ার পুণ্যও এখান থেকে অর্জন করা অসম্ভব। রহুর যে-হার বাজিকররা হাতে তুলে নিয়েছিল তারা তা-ই বাজিয়ে সবাইকে ডাক দিয়ে চলেছে। তাদের বহুকাল আগেকার দেশের পাশ দিয়ে বয়ে-যাওয়া পবিত্র নদী ঘর্ঘরার উত্তাল ঢেউ এই বাজনার সঙ্গে সংঘাত করলেও এর আওয়াজ মিঠে নয়। গঙ্গা ও ব্রক্ষপুত্র এবং পদ্মা, মেঘনা যমুনার মতো ঘর্ঘরাও বিশাল ও প্রাচীন সব তীরভূমি ভেঙে একাকার করে ফেলে। হাড়ের বাজনায় যে-তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তাতে ভাঙনের নিশ্চিত আওয়াজ শোনা যায়।

Thursday, May 3, 2018

পৌষের বৃষ্টিতে দূর সীমান্তের চা বাগানে

পথ যতটা দীর্ঘ হবার কথা ছিল তারও চেয়ে অনেক দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। বিকেলের আগে পৌঁছে যাবার কথা থাকলেও সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শেষ লোকালয় ছেড়ে এসেছি ঘন্টাখানেক আগে। ছোট ছোট টিলার ফাঁক থেকে বুনো ঘ্রাণ আসছে। অচেনা পতঙ্গেরা সঙ্গীত উৎসব শুরু করেছে। জঙ্গলের শেষ মাথায় ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত। এখানে কেবলই চা বাগান। মাইলের পর মাইল সবুজ। অন্ধকার হয়ে আসলেও ধূসর সবুজ আলো জেগে আছে চারপাশে। সেই ধূসরতার মাঝখানে একাকী দাড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ একটি বাড়ি।

বাড়ির সামনের বারান্দায় একটা টিমটিমে বাতি জ্বলছে। টর্চ হাতে মাফলারে চোখমুখ ঢাকা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।  এই বিশাল বাংলো বাড়ির একমাত্র দেখাশোনাকারী।

আমরা ছজন। তিনটি ঘর খুলে দেয়া হলো। সুসজ্জিত সুরুচির ছাপ সম্পন্ন বাড়ি। যে তিনটি ঘর দেয়া হয়েছে সেগুলো ছাড়া আরো বেশ কটি ঘর আছে। সবগুলো ঘরের মাঝখানে একটা গোলাকার হলঘর। এই হলঘরে শ খানেক লোক অনায়াসে বসে যেতে পারবে। ছোট করে শব্দ করলেও গমগম করে ছড়িয়ে পড়ে। এত বিশাল হলঘরের তুলনায় বাতিগুলো কেমন ম্লান। সবটুকু অন্ধকার তাড়াতে পারছে না বিদ্যমান বাতিগুলো। মনে হচ্ছে অন্ধকারের সাথে পেরে উঠছে না। আলো গ্রাসকারী নিস্তব্ধ বুনো অন্ধকার। অন্তত মাইল দশেকের মধ্যে কোন জনপদ নেই। বিপুল বিপুল অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই  বনভূমিতে আমরা কজন নিতান্তই একা।

এদিকে নিরাপত্তা নিয়ে কোন সমস্যা নেই বলে জানানো হয়েছে চা বাগানের পক্ষ থেকে। বলা হয়েছে রাতটা কাটুক, ভোরের আলো ফোটার আগেই কোলাহল মুখর হয়ে উঠবে চারদিক। এখন চা বাগান পরিষ্কার করার সময়। গাছের আগাগুলো কেটে কেটে আগামী বর্ষার আগেই নতুন পাতা জন্মানোর জন্য প্রস্তুত করা হবে।

আমাকে যে ঘর দেয়া হয়েছে সেখানে গিয়ে ব্যাগটা রেখে জুতো পাল্টে স্যান্ডেল পরে নিলাম। লাগোয়া বাথরুম। দরোজা খুলে দেখলাম আধুনিক সুযোগ সুবিধা সব বিদ্যমান। নতুন তোয়ালে, সাবান, শ্যাম্পু, কনডিশনার। হলরুমে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। আমি বাথরুম সেরে আড্ডায় যোগ দেবো। আরো মজার কি কি করা যায় রাতে সেটা ভাবতে ভাবতে বাথরুমের দরোজা করে দিলাম। এমন একটা নির্জন বাংলোতে থাকার স্বপ্ন ছিল অনেকদিন ধরে। আজকে সেটা পুরণ হয়ে গেল অভাবিতভাবে। ছুটির কটা দিন এখানেই কাটাবো। আড্ডা, খাওয়া, ঘুরাঘুরি ইত্যাদিতে সময় কেটে যাবে দেখতে দেখতে। রাতচরা পাখি ডাকছে কোথাও। বাথরুমের ছোট্ট ফোকর দিয়ে শীতল বাতাস ঢুকছে।

বের হতে গিয়ে দরোজাটা আটকে গেল। লক ধরে মোচড়ামুচড়ি করছি কিন্তু খুলছে না। বাইরে থেকে কেউ বন্ধ করে দিয়েছে নাকি। অদ্ভুত কাণ্ড। অটোলক হবার কথা না। বাইরে থেকে বন্ধ করার সিস্টেম নেই এইসব লকে। আবারো ধাক্কাধাক্কি করলাম। কাছে কেউ নেই যে ডাক দেবো। হলঘরটা একটু দূরে। তাছাড়া ডাক দেবার মতো কোন বিপদ না এটা। দরোজা আটকে যেতেই পারে। যে কোন কারণে। কী কারণ? বন্ধ করতে তো সমস্যা হয়নি। খুলতে কেন? আরেকটু টানাটানি করার পর খেয়াল করলাম দরোজার পায়ার দিকে একটা ছোট্ট ছিটকিনি। ওটা লাগানো। ওটায় টান দিতে দরোজা খুলে গেল। আশ্চর্য। ওই ছিটকিনি কে লাগালো। ওটা লাগাতে হলে উপূড় হতে হবে। আমি তো মনে পড়ে মাঝখানের লক লাগিয়ে ঢুকেছি। খানিকটা বিস্মিত হয়ে হাত মুখ মুছে হলঘরের আড্ডায় যোগ দিলাম।

আড্ডায় বসে বাথরুমে আটকে যাবার কথাটা বলতেই সবাই হেসে উঠলো মজা পেয়ে। আমি খুব জব্দ হয়েছি ভুতের হাতে। বলা হলো আমাকে যে ভুতে নাগাল পেয়েছে তার মাউচ্ছা দেও। আমি খানিক নাকাল হয়ে ধরে নিলাম ভুল আমারই হয়েছে কোথাও।

বাংলোর পেছনে একটা লেক আছে। সেই লেকের ঘাটে বাঁধা আছে ছোট্ট একটা নৌকা। কাল সকালে নৌকা ভ্রমণ করা যেতে পারে। লেকের ওপারে জঙ্গলে আছে অনেক বানর আর নানা জাতের পাখপাখালি। রাতে খাবার আগে একটা চা পর্ব হলো, তারপর ধুমপায়ীরা তামাকের খোঁজে গেল। খানিক পর একজন ফিরে এসে বললো, সে তার সিগারেট বক্স খুঁজে পাচ্ছে না। এত দামী রূপার সিগারেট কেস, কোথায় গায়েব হয়ে গেছে। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। শুধু লাইটার আছে। তখন তাকেও পরিহাসের শিকার হতে হলো। ভুতের আগুন ভয় পায় তাই লাইটার নিয়ে যায়নি। শুকনো তামাক নিয়ে গেছে। চুপ হয়ে গেল নকীব।

রাতের খাবার সময় খুব হৈ চৈ করে লেকের তাজা মাছ ভাজা খাওয়া হলো। গরুর মাংসের ঝোল। দেশী মুরগীর সুগন্ধী রান্না, সবজি, সালাদ, দইসহ নানান উপাদেয় খাবার। তৃপ্তির সাথে খাবার পর এক দফা চা-ও হয়ে গেল। সবার মেজাজ ভালো। গুনগুন করে গান ধরা হলো। একজন গাইতে গিয়ে একে একে সবাইকে গাইতে হলো। গানপর্বটা মন্দ হলো না। গান চলতে চলতেই কেউ কেউ শোবার প্রস্তুতি নিতে চাইছে।

নাজমুল এসে জানালো ওর ব্রাশ পাওয়া যাচ্ছে না। কারো কাছে বাড়তি ব্রাশ থাকলে দিতে পারে। বাড়তি কারো কাছে নেই। আবারো ভালো করে খুঁজে দেখতে বলা হলো অথবা আজ দাঁত না মেজে ঘুমাতে উপদেশ দিলো জামিল। নাজমুল ফিরে গেলো খুঁজতে। আমরা আরেক কাপ চা খেলাম। চা খাওয়া শেষ না হতে নাজমুল হাতে ব্রাশ নিয়ে কাছে এলো। বললো, ব্রাশটা পাওয়া গেছে, তবে যেখানে রেখেছিলাম সেখানে না। ব্যাগের বাইরের পকেটে ব্রাশট্রাশ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু এটাকে পাওয়া গেছে একদম ভেতরের চেইন দেয়া একটা পকেটে যেখানে শুধু টাকাপয়সা বা মূল্যবান জিনিস রাখা হয়। এই ব্রাশ ওখানে কিভাবে ঢুকলো সেটা সে বুঝতে পারছে না। তাছাড়া ব্রাশটা কাভারের ভেতর থাকা সত্ত্বেও দুমড়ে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে গেছে। চোখের সামনে ধরতেই বুঝলাম ব্রাশটার উপর একটা ঝড় বয়ে গেছে।

এমন সময় শীতল একটা হাওয়া এসে আমাদের হাড়ে একটা কম্পন তুলে গেল। নকিব, আমি, নাজমুল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাসির এসে হাত  নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বললো তোদের যত ইয়ে। আমি কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলেছি, এখানে সে একা থাকে। কখনো ভুতুড়ে কিছু ঘটেনি। বলে সেও উঠে গেল ব্রাশ খুঁজতে। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই দুদ্দাড় শব্দ শোনা গেল। নাসির পড়ি কি মরি করে ছুটে আসলো পেছনের আঙিনায়।

'রুমের ভেতর কুকুর ঢুকিয়েছে কোন ব্যাটা? অ্যাঁ?'

সে কুকুর ভয় পায়। আমরা লা জওয়াব। কুকুর আসবে কোথা থেকে। এবার সে যা বলল তাতে সবাই নড়ে চড়ে বসলো।

নাসির এখান থেকে উঠে গিয়ে নিজের ঘরের দিকে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুতে ঘরের দরোজাটা খুঁজে পায় না। যে ঘরেই ঢুকে দেখা যায় সেটা অন্য একটা ঘর। এই বাংলোটা গোলাকার। সবদিকের চেহারা একই। কিন্তু তবু নিজের রুম চিনবে না এমন কি করে হয়। একের পর এক ঘরে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে, কোনটাই তার রুম না। একটা রুমে ঢুকে দেখে সেদিকটা আসলে কোন রুম না। রুমের মতো খোলা একটা চত্ত্বর। পরে অনেক খুঁজে নিজের রুমটা পেল, ওখানে ঢুকে দেখে কালো একটা কুকুর বসে আছে  মাঝখানে। দেখেই পালিয়ে চলে এসেছে সাথে সাথে।

নাসিরের সাথে জামিল গেল ব্যাপারটা দেখতে। আমরাও একটু দূরত্ব রেখে পেছন পেছন গেলাম। এবার সত্যি একটু অস্বস্তির মতো লাগছে। কথা ছিল খাওয়া সেরে সবাই জঙ্গলে অন্ধকার খুঁজতে যাবো। বহুদিন হয় ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখা হয়নি। শহর গ্রাম সব জায়গা এখন বিদ্যুতময়। কোথাও নিকষ কালো অন্ধকার নেই। এই জঙ্গলে সেই সুযোগ পুরোদমে আছে। শীতকাল বলে সাপ জোঁকের উৎপাত নেই। নিশ্চিন্তে হাঁটা যাবে। সাপ জোঁকের ভয় না থাকলেও অন্য একটা ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে সবার ভেতরেই।

নাসিরের রুমে গিয়ে দেখা গেল কুকুরটি নেই। জামিল ওকে ধমকালো চোখে ভুল দেখার জন্য।

কিন্তু রুম থেকে ফিরে আসার সময় আমি জানালার বাইরে দুটো লাল চোখের ছায়া দেখলাম যেন। কাউকে বললাম না ভয় পেতে পারে বলে।

বাইরে কুয়াশায় ছেয়ে গেছে। আর বসা যাবে না। এবার হলরুমে  বসে আড্ডা। কেয়ারটেকার চলে গেছে খানিক আগে। যাবার আগে আমাদের আর কিছু লাগবে কিনা, সকালে কী খাবো ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে গেছে। আমরা এবার হলরুমে আড্ডা বসালাম, ঘরের ভেতর একটু উষ্ণতা আছে। গল্পগুজব চলছে নানান বিষয়ে। কালকে সকালে কোথায় যাওয়া হবে তার পরিকল্পনা হচ্ছে। হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল ঘর জুড়ে।

কারেন্ট চলে গেছে। অন্ধকার দেখার জন্য আর জঙ্গলে যাবার দরকার নেই। ঘরেই এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। আশপাশে কোথাও আলোর উৎস নেই বলে অন্ধকার এতই তীব্র যে আমরা দিক হারিয়ে ফেললাম প্রায়। ভাগ্যিস মোবাইলে টর্চ আছে। জ্বলে উঠলো অন্ধকার ফুঁড়ে। কিন্তু কতক্ষণ। মনে পড়লো সারাদিন কারো মোবাইলে চার্জ দেয়া হয়নি। রাতে শোবার সময় দেবার জন্য সবাই বসে ছিল। এখন রাত তো অন্ধকার। টর্চ জ্বালিয়ে কতক্ষণ চলবে?

এসব আলাপ করতে করতে কোথাও থেকে গুমগুম শব্দ শোনা যেতে লাগলো। শব্দটা বাড়ছে। মাথার উপরে চলে এসেছে। এখানে কোথাও ট্রেন লাইন আছে? লাউয়াছড়ার ট্রেন লাইন এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে, এত শব্দ হবার কথা নয়। তাছাড়া ট্রেন তো মাথার উপর দিয়ে চলে না। এই শব্দের রহস্য কী। ভুতুড়ে অন্ধকারে এই শব্দ আমাদের সবার মধ্যে একটা কাঁপুনির সৃষ্টি করলো।

ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। হঠাৎ বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো। চারদিক আলোকিত হয়ে উঠলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এই পৌষ মাসে? তখনি গুমগুম শব্দের উৎস সম্পর্কে বোঝা গেল। বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে। বজ্র সহকারে বৃষ্টি। এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। পৌষ মাসে এমন বৃষ্টি কখন কে দেখেছে। এই নির্জন বনভূমিতে বৃষ্টি উপভোগ করার সুযোগ ইহজনমে শহুরে লোকদের জন্য দুর্লভ বিষয়।

এক ছুটে সবাই দরোজা খুঁজে অন্ধকার বারান্দায় চলে আসলাম। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝাপসা অন্ধকার ছাপিয়ে তুমুল বৃষ্টি। তারই গুমগুম শব্দ শোনা যাচ্ছিল উপরের টিনের চালে। হলঘরে শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে অন্যরকম লেগেছিল। ভয়ডর সব কেটে গেল এবার। বিশাল খোলা বারান্দায় গলায় মাফলার পেঁচিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে উপভোগ করছি বৃষ্টি।

তখন একটা থপথপ শব্দ জঙ্গলের দিক থেকে। শব্দটা এগিয়ে আসছে বাইরে। চমকে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক জন্তু ঢুকে পড়েছে বারান্দায়। কারো হাতে মোবাইল নেই। টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে পাচ্ছি না। ভয়ে সিটিয়ে গেছে সবাই। হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে কোন বুনো জন্তু আশ্রয়ের খোঁজে এখানে উঠে গেছে। জন্তুটা বারান্দা ছেড়ে দরোজা ঠেলে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যেতেই ভয়ের একটা স্রোত নামলো শিরদাঁড়া বেয়ে। এখন কী হবে? ওটা কী আসলে? আকারে কয়েক মানুষের সমান হবে। জন্তুটা দুপেয়ে মনে হলো। কেউ বললো গরিলা বা শিম্পাঞ্জি হতে পারে। আমরা কখনো ওসব জন্তু সামনাসামনি দেখিনি। টিভিতে দেখে কী আকার বোঝা যায়? কিন্তু সিলেটের জঙ্গলে গরিলা আসবে কোথা থেকে। অন্য কিছু হবে। যেটাই হোক, ওটাকে তাড়াতে হবে। নইলে এখানে থাকবো কী করে।

ভয়ানক এক সংকটে সবাই। ভুতের চেয়েও মারাত্মক এটা। বাইরে তুমুল বৃষ্টি, ভেতরে অচেনা জন্তু। আমরা বারান্দায়। শীতে কাঁপছি, ভয়েও। একটা লাঠিও নেই এদিকে কোথাও। বোকার মতো মোবাইলগুলো ফেলে বৃষ্টি দেখতে ছুটে এসেছি। অন্ধকারে কোন দিকে পা দেবো তাও বুঝতে পারছি না। জন্তুটাও কোন শব্দ করছে না। অন্ধকারে কোথায় ঘাপটি দিয়ে বসে আছে কে জানে।

আজ রাতে ঘুম তো গেলই, জানটাও যায় কিনা। এখন কারো মুখে ঠাট্টার সুর নেই। সবাই সতর্ক। সবচেয়ে দুঃসাহসী জামিলও জড়োসড়ো হয়ে আমার পাশে দাঁড়ানো। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে, তাতে ভেসে উঠছে ছটি অনিশ্চিত চেহারার মানুষ। ছজন মিলে ঝাপটে ধরে একটা জন্তুকে কাবু করা কঠিন না। কিন্তু  দীর্ঘকাল মারামারি করার অভ্যেস ছেড়ে সবাই সাহেবসুবোর জীবনযাপন করছি। তাছাড়া পরিস্থিতি অনুকুল না। অন্ধকার। হাতে কিছু নেই। ঘরের ভেতরে যে প্রথম পা দেবে তাকেই জন্তুটা হামলা করবে না কে জানে। বনের পশুরা অন্ধকারে দেখতে পায়, আমরা পাই না। সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

বারান্দায় দাঁড়ানো যাচ্ছে না। রাজ্যের মশা এসে আশ্রয় নিয়েছে বারান্দায়। অনেক দিনের খিদে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে রক্তচোষন করছে মহানন্দে। ভয়ে আমরা ঘরের ভেতরে যেতে পারছি না বলে মশাদের পোয়াবারো।

মাঝরাত পেরিয়ে যাবার পর বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। সবাই আলাপ করে ঠিক করলাম বৃষ্টি ধরে আসুক কাছের জঙ্গল থেকে লাঠিসোটা কিছু জোগাড় করে আনতে হবে। অথবা ঘরের আশপাশে খুঁজতে হবে দা ছুরি কিছু মেলে কিনা। রান্নাঘরে নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু রান্নাঘরে যেতে হলে হলঘরের মাঝখান দিয়ে যেতে হবে। জন্তুটা তো ওখানেই ঢুকে বসে আছে।

তখনি আলো জ্বলে উঠলো। কারেন্ট চলে এসেছে। বুকটা স্বস্তিতে ভরে উঠলো। আলো ছাড়া মানুষ অসহায়। বারান্দায় স্টিল পাইপের কয়েকটা চেয়ার আছে। জামিল বললো সবাইকে একটা করে চেয়ার নিতে। জন্তুটাকে চেয়ার দিয়ে মেরে তাড়ানো যাবে। এ ছাড়া উপায়ও নাই। চেয়ার হাতে হল ঘরে ঢুকে পড়লাম সবাই। কিন্তু কই? কেউ নেই। নিশ্চয়ই কোন রুমে ঢুকে বসে আছে। একটার পর একটা রুমে ঢুকে চেক করা হলো। কোথাও কিছু নাই। হলঘরের একপাশে কিছু ফার্নিচারের পরিত্যক্ত কাঠের টুকরো পড়ে আছে। চেয়ার রেখে ওগুলো হাতে নিলাম সবাই। পেছনের দরোজাটা খোলা দেখা যাচ্ছে। ওদিকে বেরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। তাহলে দরোজাটা বন্ধ করে দিলেই হয়। দরোজা বন্ধ করতে গিয়ে নাসির ডাক দিল আমাদের।

পেছনের দরজা দিয়ে বেরুলে একটা চত্বর  পেরিয়ে আলাদা একটা রান্নাঘর। সেখানে বাতি জ্বলছে। বাতির আলোয় দেখা গেল একটা তোষক গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে কেউ।

কাছে গিয়ে দেখলাম রান্না ঘরের বুড়ো রাঁধুনী লোকটা। যার মজার রান্না খেয়ে আহা উহু করেছিলাম সেই নান্নু মিয়া রাতে বাড়ি ফেরার সময় শীতের জন্য গায়ে পুরোনো তোষক জড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল। বৃষ্টিতে বাধা পেয়ে ফিরে এসেছিল এবং বারান্দা দিয়ে ছুটে এসে রান্নাঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। তোষকে মাথা পর্যন্ত আবৃত থাকাতে অন্ধকারে অমন বড় জন্তুর মতো লাগছিল।

নান্নু মিয়াকে ডেকে জানতে চাইলাম ওই বিপুল আকারের তোষক মাথায় দিয়ে সে কেন বাড়ি ফিরছিল? নান্নু মিয়া জানালো তার শীতের জামা নেই। সকালে কুয়াশার মাঝে এটা মাথায় দিয়ে কাজে আসে, রাতেও ফেরে এটা মাথায় দিয়ে। ঘরে ফিরে এটা জড়িয়েই ঘুমোয়।

নান্নু মিয়ার কথা শোনার পর আমাদের সব ভয়-কল্পনা-রোমান্টিক ভাবনা উধাও হয়ে ধূসর একটা অপরাধবোধ ভেসে থাকলো।