Thursday, May 3, 2018

পৌষের বৃষ্টিতে দূর সীমান্তের চা বাগানে

পথ যতটা দীর্ঘ হবার কথা ছিল তারও চেয়ে অনেক দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। বিকেলের আগে পৌঁছে যাবার কথা থাকলেও সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শেষ লোকালয় ছেড়ে এসেছি ঘন্টাখানেক আগে। ছোট ছোট টিলার ফাঁক থেকে বুনো ঘ্রাণ আসছে। অচেনা পতঙ্গেরা সঙ্গীত উৎসব শুরু করেছে। জঙ্গলের শেষ মাথায় ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত। এখানে কেবলই চা বাগান। মাইলের পর মাইল সবুজ। অন্ধকার হয়ে আসলেও ধূসর সবুজ আলো জেগে আছে চারপাশে। সেই ধূসরতার মাঝখানে একাকী দাড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ একটি বাড়ি।

বাড়ির সামনের বারান্দায় একটা টিমটিমে বাতি জ্বলছে। টর্চ হাতে মাফলারে চোখমুখ ঢাকা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।  এই বিশাল বাংলো বাড়ির একমাত্র দেখাশোনাকারী।

আমরা ছজন। তিনটি ঘর খুলে দেয়া হলো। সুসজ্জিত সুরুচির ছাপ সম্পন্ন বাড়ি। যে তিনটি ঘর দেয়া হয়েছে সেগুলো ছাড়া আরো বেশ কটি ঘর আছে। সবগুলো ঘরের মাঝখানে একটা গোলাকার হলঘর। এই হলঘরে শ খানেক লোক অনায়াসে বসে যেতে পারবে। ছোট করে শব্দ করলেও গমগম করে ছড়িয়ে পড়ে। এত বিশাল হলঘরের তুলনায় বাতিগুলো কেমন ম্লান। সবটুকু অন্ধকার তাড়াতে পারছে না বিদ্যমান বাতিগুলো। মনে হচ্ছে অন্ধকারের সাথে পেরে উঠছে না। আলো গ্রাসকারী নিস্তব্ধ বুনো অন্ধকার। অন্তত মাইল দশেকের মধ্যে কোন জনপদ নেই। বিপুল বিপুল অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই  বনভূমিতে আমরা কজন নিতান্তই একা।

এদিকে নিরাপত্তা নিয়ে কোন সমস্যা নেই বলে জানানো হয়েছে চা বাগানের পক্ষ থেকে। বলা হয়েছে রাতটা কাটুক, ভোরের আলো ফোটার আগেই কোলাহল মুখর হয়ে উঠবে চারদিক। এখন চা বাগান পরিষ্কার করার সময়। গাছের আগাগুলো কেটে কেটে আগামী বর্ষার আগেই নতুন পাতা জন্মানোর জন্য প্রস্তুত করা হবে।

আমাকে যে ঘর দেয়া হয়েছে সেখানে গিয়ে ব্যাগটা রেখে জুতো পাল্টে স্যান্ডেল পরে নিলাম। লাগোয়া বাথরুম। দরোজা খুলে দেখলাম আধুনিক সুযোগ সুবিধা সব বিদ্যমান। নতুন তোয়ালে, সাবান, শ্যাম্পু, কনডিশনার। হলরুমে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। আমি বাথরুম সেরে আড্ডায় যোগ দেবো। আরো মজার কি কি করা যায় রাতে সেটা ভাবতে ভাবতে বাথরুমের দরোজা করে দিলাম। এমন একটা নির্জন বাংলোতে থাকার স্বপ্ন ছিল অনেকদিন ধরে। আজকে সেটা পুরণ হয়ে গেল অভাবিতভাবে। ছুটির কটা দিন এখানেই কাটাবো। আড্ডা, খাওয়া, ঘুরাঘুরি ইত্যাদিতে সময় কেটে যাবে দেখতে দেখতে। রাতচরা পাখি ডাকছে কোথাও। বাথরুমের ছোট্ট ফোকর দিয়ে শীতল বাতাস ঢুকছে।

বের হতে গিয়ে দরোজাটা আটকে গেল। লক ধরে মোচড়ামুচড়ি করছি কিন্তু খুলছে না। বাইরে থেকে কেউ বন্ধ করে দিয়েছে নাকি। অদ্ভুত কাণ্ড। অটোলক হবার কথা না। বাইরে থেকে বন্ধ করার সিস্টেম নেই এইসব লকে। আবারো ধাক্কাধাক্কি করলাম। কাছে কেউ নেই যে ডাক দেবো। হলঘরটা একটু দূরে। তাছাড়া ডাক দেবার মতো কোন বিপদ না এটা। দরোজা আটকে যেতেই পারে। যে কোন কারণে। কী কারণ? বন্ধ করতে তো সমস্যা হয়নি। খুলতে কেন? আরেকটু টানাটানি করার পর খেয়াল করলাম দরোজার পায়ার দিকে একটা ছোট্ট ছিটকিনি। ওটা লাগানো। ওটায় টান দিতে দরোজা খুলে গেল। আশ্চর্য। ওই ছিটকিনি কে লাগালো। ওটা লাগাতে হলে উপূড় হতে হবে। আমি তো মনে পড়ে মাঝখানের লক লাগিয়ে ঢুকেছি। খানিকটা বিস্মিত হয়ে হাত মুখ মুছে হলঘরের আড্ডায় যোগ দিলাম।

আড্ডায় বসে বাথরুমে আটকে যাবার কথাটা বলতেই সবাই হেসে উঠলো মজা পেয়ে। আমি খুব জব্দ হয়েছি ভুতের হাতে। বলা হলো আমাকে যে ভুতে নাগাল পেয়েছে তার মাউচ্ছা দেও। আমি খানিক নাকাল হয়ে ধরে নিলাম ভুল আমারই হয়েছে কোথাও।

বাংলোর পেছনে একটা লেক আছে। সেই লেকের ঘাটে বাঁধা আছে ছোট্ট একটা নৌকা। কাল সকালে নৌকা ভ্রমণ করা যেতে পারে। লেকের ওপারে জঙ্গলে আছে অনেক বানর আর নানা জাতের পাখপাখালি। রাতে খাবার আগে একটা চা পর্ব হলো, তারপর ধুমপায়ীরা তামাকের খোঁজে গেল। খানিক পর একজন ফিরে এসে বললো, সে তার সিগারেট বক্স খুঁজে পাচ্ছে না। এত দামী রূপার সিগারেট কেস, কোথায় গায়েব হয়ে গেছে। সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। শুধু লাইটার আছে। তখন তাকেও পরিহাসের শিকার হতে হলো। ভুতের আগুন ভয় পায় তাই লাইটার নিয়ে যায়নি। শুকনো তামাক নিয়ে গেছে। চুপ হয়ে গেল নকীব।

রাতের খাবার সময় খুব হৈ চৈ করে লেকের তাজা মাছ ভাজা খাওয়া হলো। গরুর মাংসের ঝোল। দেশী মুরগীর সুগন্ধী রান্না, সবজি, সালাদ, দইসহ নানান উপাদেয় খাবার। তৃপ্তির সাথে খাবার পর এক দফা চা-ও হয়ে গেল। সবার মেজাজ ভালো। গুনগুন করে গান ধরা হলো। একজন গাইতে গিয়ে একে একে সবাইকে গাইতে হলো। গানপর্বটা মন্দ হলো না। গান চলতে চলতেই কেউ কেউ শোবার প্রস্তুতি নিতে চাইছে।

নাজমুল এসে জানালো ওর ব্রাশ পাওয়া যাচ্ছে না। কারো কাছে বাড়তি ব্রাশ থাকলে দিতে পারে। বাড়তি কারো কাছে নেই। আবারো ভালো করে খুঁজে দেখতে বলা হলো অথবা আজ দাঁত না মেজে ঘুমাতে উপদেশ দিলো জামিল। নাজমুল ফিরে গেলো খুঁজতে। আমরা আরেক কাপ চা খেলাম। চা খাওয়া শেষ না হতে নাজমুল হাতে ব্রাশ নিয়ে কাছে এলো। বললো, ব্রাশটা পাওয়া গেছে, তবে যেখানে রেখেছিলাম সেখানে না। ব্যাগের বাইরের পকেটে ব্রাশট্রাশ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু এটাকে পাওয়া গেছে একদম ভেতরের চেইন দেয়া একটা পকেটে যেখানে শুধু টাকাপয়সা বা মূল্যবান জিনিস রাখা হয়। এই ব্রাশ ওখানে কিভাবে ঢুকলো সেটা সে বুঝতে পারছে না। তাছাড়া ব্রাশটা কাভারের ভেতর থাকা সত্ত্বেও দুমড়ে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে গেছে। চোখের সামনে ধরতেই বুঝলাম ব্রাশটার উপর একটা ঝড় বয়ে গেছে।

এমন সময় শীতল একটা হাওয়া এসে আমাদের হাড়ে একটা কম্পন তুলে গেল। নকিব, আমি, নাজমুল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাসির এসে হাত  নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বললো তোদের যত ইয়ে। আমি কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলেছি, এখানে সে একা থাকে। কখনো ভুতুড়ে কিছু ঘটেনি। বলে সেও উঠে গেল ব্রাশ খুঁজতে। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই দুদ্দাড় শব্দ শোনা গেল। নাসির পড়ি কি মরি করে ছুটে আসলো পেছনের আঙিনায়।

'রুমের ভেতর কুকুর ঢুকিয়েছে কোন ব্যাটা? অ্যাঁ?'

সে কুকুর ভয় পায়। আমরা লা জওয়াব। কুকুর আসবে কোথা থেকে। এবার সে যা বলল তাতে সবাই নড়ে চড়ে বসলো।

নাসির এখান থেকে উঠে গিয়ে নিজের ঘরের দিকে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুতে ঘরের দরোজাটা খুঁজে পায় না। যে ঘরেই ঢুকে দেখা যায় সেটা অন্য একটা ঘর। এই বাংলোটা গোলাকার। সবদিকের চেহারা একই। কিন্তু তবু নিজের রুম চিনবে না এমন কি করে হয়। একের পর এক ঘরে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে, কোনটাই তার রুম না। একটা রুমে ঢুকে দেখে সেদিকটা আসলে কোন রুম না। রুমের মতো খোলা একটা চত্ত্বর। পরে অনেক খুঁজে নিজের রুমটা পেল, ওখানে ঢুকে দেখে কালো একটা কুকুর বসে আছে  মাঝখানে। দেখেই পালিয়ে চলে এসেছে সাথে সাথে।

নাসিরের সাথে জামিল গেল ব্যাপারটা দেখতে। আমরাও একটু দূরত্ব রেখে পেছন পেছন গেলাম। এবার সত্যি একটু অস্বস্তির মতো লাগছে। কথা ছিল খাওয়া সেরে সবাই জঙ্গলে অন্ধকার খুঁজতে যাবো। বহুদিন হয় ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখা হয়নি। শহর গ্রাম সব জায়গা এখন বিদ্যুতময়। কোথাও নিকষ কালো অন্ধকার নেই। এই জঙ্গলে সেই সুযোগ পুরোদমে আছে। শীতকাল বলে সাপ জোঁকের উৎপাত নেই। নিশ্চিন্তে হাঁটা যাবে। সাপ জোঁকের ভয় না থাকলেও অন্য একটা ভয় দানা বাঁধতে শুরু করেছে সবার ভেতরেই।

নাসিরের রুমে গিয়ে দেখা গেল কুকুরটি নেই। জামিল ওকে ধমকালো চোখে ভুল দেখার জন্য।

কিন্তু রুম থেকে ফিরে আসার সময় আমি জানালার বাইরে দুটো লাল চোখের ছায়া দেখলাম যেন। কাউকে বললাম না ভয় পেতে পারে বলে।

বাইরে কুয়াশায় ছেয়ে গেছে। আর বসা যাবে না। এবার হলরুমে  বসে আড্ডা। কেয়ারটেকার চলে গেছে খানিক আগে। যাবার আগে আমাদের আর কিছু লাগবে কিনা, সকালে কী খাবো ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে গেছে। আমরা এবার হলরুমে আড্ডা বসালাম, ঘরের ভেতর একটু উষ্ণতা আছে। গল্পগুজব চলছে নানান বিষয়ে। কালকে সকালে কোথায় যাওয়া হবে তার পরিকল্পনা হচ্ছে। হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল ঘর জুড়ে।

কারেন্ট চলে গেছে। অন্ধকার দেখার জন্য আর জঙ্গলে যাবার দরকার নেই। ঘরেই এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। আশপাশে কোথাও আলোর উৎস নেই বলে অন্ধকার এতই তীব্র যে আমরা দিক হারিয়ে ফেললাম প্রায়। ভাগ্যিস মোবাইলে টর্চ আছে। জ্বলে উঠলো অন্ধকার ফুঁড়ে। কিন্তু কতক্ষণ। মনে পড়লো সারাদিন কারো মোবাইলে চার্জ দেয়া হয়নি। রাতে শোবার সময় দেবার জন্য সবাই বসে ছিল। এখন রাত তো অন্ধকার। টর্চ জ্বালিয়ে কতক্ষণ চলবে?

এসব আলাপ করতে করতে কোথাও থেকে গুমগুম শব্দ শোনা যেতে লাগলো। শব্দটা বাড়ছে। মাথার উপরে চলে এসেছে। এখানে কোথাও ট্রেন লাইন আছে? লাউয়াছড়ার ট্রেন লাইন এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে, এত শব্দ হবার কথা নয়। তাছাড়া ট্রেন তো মাথার উপর দিয়ে চলে না। এই শব্দের রহস্য কী। ভুতুড়ে অন্ধকারে এই শব্দ আমাদের সবার মধ্যে একটা কাঁপুনির সৃষ্টি করলো।

ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। হঠাৎ বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো। চারদিক আলোকিত হয়ে উঠলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এই পৌষ মাসে? তখনি গুমগুম শব্দের উৎস সম্পর্কে বোঝা গেল। বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে। বজ্র সহকারে বৃষ্টি। এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। পৌষ মাসে এমন বৃষ্টি কখন কে দেখেছে। এই নির্জন বনভূমিতে বৃষ্টি উপভোগ করার সুযোগ ইহজনমে শহুরে লোকদের জন্য দুর্লভ বিষয়।

এক ছুটে সবাই দরোজা খুঁজে অন্ধকার বারান্দায় চলে আসলাম। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝাপসা অন্ধকার ছাপিয়ে তুমুল বৃষ্টি। তারই গুমগুম শব্দ শোনা যাচ্ছিল উপরের টিনের চালে। হলঘরে শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে অন্যরকম লেগেছিল। ভয়ডর সব কেটে গেল এবার। বিশাল খোলা বারান্দায় গলায় মাফলার পেঁচিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে উপভোগ করছি বৃষ্টি।

তখন একটা থপথপ শব্দ জঙ্গলের দিক থেকে। শব্দটা এগিয়ে আসছে বাইরে। চমকে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক জন্তু ঢুকে পড়েছে বারান্দায়। কারো হাতে মোবাইল নেই। টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে পাচ্ছি না। ভয়ে সিটিয়ে গেছে সবাই। হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে কোন বুনো জন্তু আশ্রয়ের খোঁজে এখানে উঠে গেছে। জন্তুটা বারান্দা ছেড়ে দরোজা ঠেলে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যেতেই ভয়ের একটা স্রোত নামলো শিরদাঁড়া বেয়ে। এখন কী হবে? ওটা কী আসলে? আকারে কয়েক মানুষের সমান হবে। জন্তুটা দুপেয়ে মনে হলো। কেউ বললো গরিলা বা শিম্পাঞ্জি হতে পারে। আমরা কখনো ওসব জন্তু সামনাসামনি দেখিনি। টিভিতে দেখে কী আকার বোঝা যায়? কিন্তু সিলেটের জঙ্গলে গরিলা আসবে কোথা থেকে। অন্য কিছু হবে। যেটাই হোক, ওটাকে তাড়াতে হবে। নইলে এখানে থাকবো কী করে।

ভয়ানক এক সংকটে সবাই। ভুতের চেয়েও মারাত্মক এটা। বাইরে তুমুল বৃষ্টি, ভেতরে অচেনা জন্তু। আমরা বারান্দায়। শীতে কাঁপছি, ভয়েও। একটা লাঠিও নেই এদিকে কোথাও। বোকার মতো মোবাইলগুলো ফেলে বৃষ্টি দেখতে ছুটে এসেছি। অন্ধকারে কোন দিকে পা দেবো তাও বুঝতে পারছি না। জন্তুটাও কোন শব্দ করছে না। অন্ধকারে কোথায় ঘাপটি দিয়ে বসে আছে কে জানে।

আজ রাতে ঘুম তো গেলই, জানটাও যায় কিনা। এখন কারো মুখে ঠাট্টার সুর নেই। সবাই সতর্ক। সবচেয়ে দুঃসাহসী জামিলও জড়োসড়ো হয়ে আমার পাশে দাঁড়ানো। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে, তাতে ভেসে উঠছে ছটি অনিশ্চিত চেহারার মানুষ। ছজন মিলে ঝাপটে ধরে একটা জন্তুকে কাবু করা কঠিন না। কিন্তু  দীর্ঘকাল মারামারি করার অভ্যেস ছেড়ে সবাই সাহেবসুবোর জীবনযাপন করছি। তাছাড়া পরিস্থিতি অনুকুল না। অন্ধকার। হাতে কিছু নেই। ঘরের ভেতরে যে প্রথম পা দেবে তাকেই জন্তুটা হামলা করবে না কে জানে। বনের পশুরা অন্ধকারে দেখতে পায়, আমরা পাই না। সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

বারান্দায় দাঁড়ানো যাচ্ছে না। রাজ্যের মশা এসে আশ্রয় নিয়েছে বারান্দায়। অনেক দিনের খিদে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে রক্তচোষন করছে মহানন্দে। ভয়ে আমরা ঘরের ভেতরে যেতে পারছি না বলে মশাদের পোয়াবারো।

মাঝরাত পেরিয়ে যাবার পর বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। সবাই আলাপ করে ঠিক করলাম বৃষ্টি ধরে আসুক কাছের জঙ্গল থেকে লাঠিসোটা কিছু জোগাড় করে আনতে হবে। অথবা ঘরের আশপাশে খুঁজতে হবে দা ছুরি কিছু মেলে কিনা। রান্নাঘরে নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু রান্নাঘরে যেতে হলে হলঘরের মাঝখান দিয়ে যেতে হবে। জন্তুটা তো ওখানেই ঢুকে বসে আছে।

তখনি আলো জ্বলে উঠলো। কারেন্ট চলে এসেছে। বুকটা স্বস্তিতে ভরে উঠলো। আলো ছাড়া মানুষ অসহায়। বারান্দায় স্টিল পাইপের কয়েকটা চেয়ার আছে। জামিল বললো সবাইকে একটা করে চেয়ার নিতে। জন্তুটাকে চেয়ার দিয়ে মেরে তাড়ানো যাবে। এ ছাড়া উপায়ও নাই। চেয়ার হাতে হল ঘরে ঢুকে পড়লাম সবাই। কিন্তু কই? কেউ নেই। নিশ্চয়ই কোন রুমে ঢুকে বসে আছে। একটার পর একটা রুমে ঢুকে চেক করা হলো। কোথাও কিছু নাই। হলঘরের একপাশে কিছু ফার্নিচারের পরিত্যক্ত কাঠের টুকরো পড়ে আছে। চেয়ার রেখে ওগুলো হাতে নিলাম সবাই। পেছনের দরোজাটা খোলা দেখা যাচ্ছে। ওদিকে বেরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। তাহলে দরোজাটা বন্ধ করে দিলেই হয়। দরোজা বন্ধ করতে গিয়ে নাসির ডাক দিল আমাদের।

পেছনের দরজা দিয়ে বেরুলে একটা চত্বর  পেরিয়ে আলাদা একটা রান্নাঘর। সেখানে বাতি জ্বলছে। বাতির আলোয় দেখা গেল একটা তোষক গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে কেউ।

কাছে গিয়ে দেখলাম রান্না ঘরের বুড়ো রাঁধুনী লোকটা। যার মজার রান্না খেয়ে আহা উহু করেছিলাম সেই নান্নু মিয়া রাতে বাড়ি ফেরার সময় শীতের জন্য গায়ে পুরোনো তোষক জড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল। বৃষ্টিতে বাধা পেয়ে ফিরে এসেছিল এবং বারান্দা দিয়ে ছুটে এসে রান্নাঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। তোষকে মাথা পর্যন্ত আবৃত থাকাতে অন্ধকারে অমন বড় জন্তুর মতো লাগছিল।

নান্নু মিয়াকে ডেকে জানতে চাইলাম ওই বিপুল আকারের তোষক মাথায় দিয়ে সে কেন বাড়ি ফিরছিল? নান্নু মিয়া জানালো তার শীতের জামা নেই। সকালে কুয়াশার মাঝে এটা মাথায় দিয়ে কাজে আসে, রাতেও ফেরে এটা মাথায় দিয়ে। ঘরে ফিরে এটা জড়িয়েই ঘুমোয়।

নান্নু মিয়ার কথা শোনার পর আমাদের সব ভয়-কল্পনা-রোমান্টিক ভাবনা উধাও হয়ে ধূসর একটা অপরাধবোধ ভেসে থাকলো।

No comments: