পথ যতটা দীর্ঘ হবার কথা ছিল তারও চেয়ে অনেক দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। বিকেলের আগে পৌঁছে যাবার কথা থাকলেও সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শেষ লোকালয় ছেড়ে এসেছি ঘন্টাখানেক আগে। ছোট ছোট টিলার ফাঁক থেকে বুনো ঘ্রাণ আসছে। অচেনা পতঙ্গেরা সঙ্গীত উৎসব শুরু করেছে। জঙ্গলের শেষ মাথায় ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত। এখানে কেবলই চা বাগান। মাইলের পর মাইল সবুজ। অন্ধকার হয়ে আসলেও ধূসর সবুজ আলো জেগে আছে চারপাশে। সেই ধূসরতার মাঝখানে একাকী দাড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ একটি বাড়ি।
বাড়ির সামনের বারান্দায় একটা টিমটিমে বাতি জ্বলছে। টর্চ হাতে মাফলারে চোখমুখ ঢাকা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। এই বিশাল বাংলো বাড়ির একমাত্র দেখাশোনাকারী।
আমরা ছজন। তিনটি ঘর খুলে দেয়া হলো। সুসজ্জিত সুরুচির ছাপ সম্পন্ন বাড়ি। যে তিনটি ঘর দেয়া হয়েছে সেগুলো ছাড়া আরো বেশ কটি ঘর আছে। সবগুলো ঘরের মাঝখানে একটা গোলাকার হলঘর। এই হলঘরে শ খানেক লোক অনায়াসে বসে যেতে পারবে। ছোট করে শব্দ করলেও গমগম করে ছড়িয়ে পড়ে। এত বিশাল হলঘরের তুলনায় বাতিগুলো কেমন ম্লান। সবটুকু অন্ধকার তাড়াতে পারছে না বিদ্যমান বাতিগুলো। মনে হচ্ছে অন্ধকারের সাথে পেরে উঠছে না। আলো গ্রাসকারী নিস্তব্ধ বুনো অন্ধকার। অন্তত মাইল দশেকের মধ্যে কোন জনপদ নেই। বিপুল বিপুল অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই বনভূমিতে আমরা কজন নিতান্তই একা। সে কুকুর ভয় পায়। আমরা লা জওয়াব। কুকুর আসবে কোথা থেকে। এবার সে যা বলল তাতে সবাই নড়ে চড়ে বসলো।
নাসিরের রুমে গিয়ে দেখা গেল কুকুরটি নেই। জামিল ওকে ধমকালো চোখে ভুল দেখার জন্য।
কিন্তু রুম থেকে ফিরে আসার সময় আমি জানালার বাইরে দুটো লাল চোখের ছায়া দেখলাম যেন। কাউকে বললাম না ভয় পেতে পারে বলে।
বাইরে কুয়াশায় ছেয়ে গেছে। আর বসা যাবে না। এবার হলরুমে বসে আড্ডা। কেয়ারটেকার চলে গেছে খানিক আগে। যাবার আগে আমাদের আর কিছু লাগবে কিনা, সকালে কী খাবো ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে গেছে। আমরা এবার হলরুমে আড্ডা বসালাম, ঘরের ভেতর একটু উষ্ণতা আছে। গল্পগুজব চলছে নানান বিষয়ে। কালকে সকালে কোথায় যাওয়া হবে তার পরিকল্পনা হচ্ছে। হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল ঘর জুড়ে। কিন্তু রুম থেকে ফিরে আসার সময় আমি জানালার বাইরে দুটো লাল চোখের ছায়া দেখলাম যেন। কাউকে বললাম না ভয় পেতে পারে বলে।
কারেন্ট চলে গেছে। অন্ধকার দেখার জন্য আর জঙ্গলে যাবার দরকার নেই। ঘরেই এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। আশপাশে কোথাও আলোর উৎস নেই বলে অন্ধকার এতই তীব্র যে আমরা দিক হারিয়ে ফেললাম প্রায়। ভাগ্যিস মোবাইলে টর্চ আছে। জ্বলে উঠলো অন্ধকার ফুঁড়ে। কিন্তু কতক্ষণ। মনে পড়লো সারাদিন কারো মোবাইলে চার্জ দেয়া হয়নি। রাতে শোবার সময় দেবার জন্য সবাই বসে ছিল। এখন রাত তো অন্ধকার। টর্চ জ্বালিয়ে কতক্ষণ চলবে?
এসব আলাপ করতে করতে কোথাও থেকে গুমগুম শব্দ শোনা যেতে লাগলো। শব্দটা বাড়ছে। মাথার উপরে চলে এসেছে। এখানে কোথাও ট্রেন লাইন আছে? লাউয়াছড়ার ট্রেন লাইন এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে, এত শব্দ হবার কথা নয়। তাছাড়া ট্রেন তো মাথার উপর দিয়ে চলে না। এই শব্দের রহস্য কী। ভুতুড়ে অন্ধকারে এই শব্দ আমাদের সবার মধ্যে একটা কাঁপুনির সৃষ্টি করলো।
ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। হঠাৎ বিকট শব্দে বজ্রপাত হলো। চারদিক আলোকিত হয়ে উঠলো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এই পৌষ মাসে? তখনি গুমগুম শব্দের উৎস সম্পর্কে বোঝা গেল। বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে। বজ্র সহকারে বৃষ্টি। এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। পৌষ মাসে এমন বৃষ্টি কখন কে দেখেছে। এই নির্জন বনভূমিতে বৃষ্টি উপভোগ করার সুযোগ ইহজনমে শহুরে লোকদের জন্য দুর্লভ বিষয়। এক ছুটে সবাই দরোজা খুঁজে অন্ধকার বারান্দায় চলে আসলাম। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝাপসা অন্ধকার ছাপিয়ে তুমুল বৃষ্টি। তারই গুমগুম শব্দ শোনা যাচ্ছিল উপরের টিনের চালে। হলঘরে শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে অন্যরকম লেগেছিল। ভয়ডর সব কেটে গেল এবার। বিশাল খোলা বারান্দায় গলায় মাফলার পেঁচিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে উপভোগ করছি বৃষ্টি।
তখন একটা থপথপ শব্দ জঙ্গলের দিক থেকে। শব্দটা এগিয়ে আসছে বাইরে। চমকে তাকিয়ে দেখি বিশাল এক জন্তু ঢুকে পড়েছে বারান্দায়। কারো হাতে মোবাইল নেই। টর্চ জ্বালিয়ে দেখতে পাচ্ছি না। ভয়ে সিটিয়ে গেছে সবাই। হঠাৎ বৃষ্টির মধ্যে কোন বুনো জন্তু আশ্রয়ের খোঁজে এখানে উঠে গেছে। জন্তুটা বারান্দা ছেড়ে দরোজা ঠেলে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যেতেই ভয়ের একটা স্রোত নামলো শিরদাঁড়া বেয়ে। এখন কী হবে? ওটা কী আসলে? আকারে কয়েক মানুষের সমান হবে। জন্তুটা দুপেয়ে মনে হলো। কেউ বললো গরিলা বা শিম্পাঞ্জি হতে পারে। আমরা কখনো ওসব জন্তু সামনাসামনি দেখিনি। টিভিতে দেখে কী আকার বোঝা যায়? কিন্তু সিলেটের জঙ্গলে গরিলা আসবে কোথা থেকে। অন্য কিছু হবে। যেটাই হোক, ওটাকে তাড়াতে হবে। নইলে এখানে থাকবো কী করে।আজ রাতে ঘুম তো গেলই, জানটাও যায় কিনা। এখন কারো মুখে ঠাট্টার সুর নেই। সবাই সতর্ক। সবচেয়ে দুঃসাহসী জামিলও জড়োসড়ো হয়ে আমার পাশে দাঁড়ানো। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে, তাতে ভেসে উঠছে ছটি অনিশ্চিত চেহারার মানুষ। ছজন মিলে ঝাপটে ধরে একটা জন্তুকে কাবু করা কঠিন না। কিন্তু দীর্ঘকাল মারামারি করার অভ্যেস ছেড়ে সবাই সাহেবসুবোর জীবনযাপন করছি। তাছাড়া পরিস্থিতি অনুকুল না। অন্ধকার। হাতে কিছু নেই। ঘরের ভেতরে যে প্রথম পা দেবে তাকেই জন্তুটা হামলা করবে না কে জানে। বনের পশুরা অন্ধকারে দেখতে পায়, আমরা পাই না। সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
তখনি আলো জ্বলে উঠলো। কারেন্ট চলে এসেছে। বুকটা স্বস্তিতে ভরে উঠলো। আলো ছাড়া মানুষ অসহায়। বারান্দায় স্টিল পাইপের কয়েকটা চেয়ার আছে। জামিল বললো সবাইকে একটা করে চেয়ার নিতে। জন্তুটাকে চেয়ার দিয়ে মেরে তাড়ানো যাবে। এ ছাড়া উপায়ও নাই। চেয়ার হাতে হল ঘরে ঢুকে পড়লাম সবাই। কিন্তু কই? কেউ নেই। নিশ্চয়ই কোন রুমে ঢুকে বসে আছে। একটার পর একটা রুমে ঢুকে চেক করা হলো। কোথাও কিছু নাই। হলঘরের একপাশে কিছু ফার্নিচারের পরিত্যক্ত কাঠের টুকরো পড়ে আছে। চেয়ার রেখে ওগুলো হাতে নিলাম সবাই। পেছনের দরোজাটা খোলা দেখা যাচ্ছে। ওদিকে বেরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। তাহলে দরোজাটা বন্ধ করে দিলেই হয়। দরোজা বন্ধ করতে গিয়ে নাসির ডাক দিল আমাদের।
পেছনের দরজা দিয়ে বেরুলে একটা চত্বর পেরিয়ে আলাদা একটা রান্নাঘর। সেখানে বাতি জ্বলছে। বাতির আলোয় দেখা গেল একটা তোষক গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে কেউ।
কাছে গিয়ে দেখলাম রান্না ঘরের বুড়ো রাঁধুনী লোকটা। যার মজার রান্না খেয়ে আহা উহু করেছিলাম সেই নান্নু মিয়া রাতে বাড়ি ফেরার সময় শীতের জন্য গায়ে পুরোনো তোষক জড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল। বৃষ্টিতে বাধা পেয়ে ফিরে এসেছিল এবং বারান্দা দিয়ে ছুটে এসে রান্নাঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। তোষকে মাথা পর্যন্ত আবৃত থাকাতে অন্ধকারে অমন বড় জন্তুর মতো লাগছিল।
কাছে গিয়ে দেখলাম রান্না ঘরের বুড়ো রাঁধুনী লোকটা। যার মজার রান্না খেয়ে আহা উহু করেছিলাম সেই নান্নু মিয়া রাতে বাড়ি ফেরার সময় শীতের জন্য গায়ে পুরোনো তোষক জড়িয়ে বাড়ি ফিরছিল। বৃষ্টিতে বাধা পেয়ে ফিরে এসেছিল এবং বারান্দা দিয়ে ছুটে এসে রান্নাঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। তোষকে মাথা পর্যন্ত আবৃত থাকাতে অন্ধকারে অমন বড় জন্তুর মতো লাগছিল।
নান্নু মিয়াকে ডেকে জানতে চাইলাম ওই বিপুল আকারের তোষক মাথায় দিয়ে সে কেন বাড়ি ফিরছিল? নান্নু মিয়া জানালো তার শীতের জামা নেই। সকালে কুয়াশার মাঝে এটা মাথায় দিয়ে কাজে আসে, রাতেও ফেরে এটা মাথায় দিয়ে। ঘরে ফিরে এটা জড়িয়েই ঘুমোয়।
নান্নু মিয়ার কথা শোনার পর আমাদের সব ভয়-কল্পনা-রোমান্টিক ভাবনা উধাও হয়ে ধূসর একটা অপরাধবোধ ভেসে থাকলো।
No comments:
Post a Comment