বইটি আমি কেনার সিদ্ধান্ত নেই লেখকটির নাম মিহির সেন গুপ্ত বলেই। 'বিষাদবৃক্ষ' ছাড়া তাঁর আর কোন বই পড়িনি। ফলে বইটিকে নেহায়েত আরেকটি নতুন বই হিসেবে সংগ্রহ করি বিস্তারের বুকশেলফ থেকে। উল্লেখ্য যে আলম ভাই বছর দুয়েক আগে বইটির কথা উল্লেখ করেছিলেন এই আসরের একটি আলোচনাতে, বই কেনার সময় কথাটি আমার মনে ছিল না।
মিহির সেন গুপ্তের স্মৃতিচারণমূলক বই 'চলার পথের চলনদার' বইটিতে আমি তাঁর লেখক হয়ে ওঠার বিচিত্র কাহিনী পড়তে পড়তে আবিষ্কার করতে থাকি এক একজন লেখককে যাঁদের প্রেরণায় তিনি লেখক হয়ে উঠেছিলেন। যার একজন তাঁর অগ্রজ অভিজিত সেন। যাঁর 'রহু চণ্ডালের হাড়' পড়া শেষ করার কয়েকদিন পর্যন্ত আমি আবিষ্ট হয়ে ছিলাম। এক বাজিকরের কয়েক প্রজন্মের বিস্তৃত বিচিত্র কাহিনী উপন্যাসটির মূল উপজীব্য। অভিজিত সেন যে মিহির সেনের অগ্রজ এই তথ্যটি আমার জানা ছিল না। তথ্যটি জেনে আমি বেশ চমৎকৃত হই কেননা আমার পঠিত কয়েকটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে এই দুই সহোদরের পুস্তকের নাম উপস্থিত থাকবে সবসময়।
এই চমকপ্রদ তথ্যের পরে যে আরো বড় বিস্ময়টি অপেক্ষা করছিল সেটি জানার পর কয়েক সেকেণ্ডের জন্য থমকে গিয়ে মনে মনে বললাম, ভাগ্যিস বইটি কিনেছিলাম!
বিস্ময়টি হলো, মিহির সেনগুপ্তের লেখক হবার পথে অন্যতম চলনদারের ভূমিকা পালন করেছিলেন আমাদের প্রিয় ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
হ্যাঁ, এই বইটির বিশাল একটা অংশ জুড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জীবনের অজানা একটা অধ্যায়কে তিনি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় তুলে এনেছেন। এই স্মৃতিচারণটুকুর কারণে আমার কাছে বইটির মূল্য কয়েকগুন বেড়ে গেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যের সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের তেমন কিছুই জানা ছিল না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে কথোপকথনের সুযোগ পেয়েছিলাম একবারই, সেটা আশির দশকের শেষভাগে এবং অতি সংক্ষিপ্ত ছিল সেই সাক্ষাতপর্বটি। মিহির সেনগুপ্ত চমৎকারভাবে তাঁর শেষ জীবনের কিছু অজানা ঘটনা বিবৃত করেছেন ব্যক্তিগত স্মৃতির অংশ হিসেবে। তাঁর সাথে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পরিচয় ঘটেছিল ১৯৮৮ সালে, সেটি ঘনিষ্টতায় রূপ নিয়ে অব্যাহত ছিল জীবনের প্রায় শেষ পর্ব পর্যন্ত।
দুজনের মধ্যে এই সম্পর্কের প্রধান একটি সুত্র ছিল অভিজিত সেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন অভিজিত সেনের একজন মুগ্ধ পাঠক। তাঁর সব বই ইলিয়াসের পড়া ছিল। 'রহু চণ্ডালের হাড়' নিয়ে তিনি চমৎকার একটি আলোচনা করেছিলেন একটি সাহিত্য পত্রিকায়। 'গল্পপাঠ'এর সৌজন্যে সেই আলোচনাটির সন্ধান পাই। মিহির সেন গুপ্ত প্রথম সাক্ষাতে নিজেকে অভিজিত সেনের ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। অভিজিতের ভাই হিসেবে পরিচয় হলেও দুজনের সম্পর্কটা ব্যক্তিগত হতে দেরী হয়নি। মজার ব্যাপার হলো অভিজিতের সাথে ইলিয়াসের ব্যক্তিগত কোন পরিচয় ছিল না। ইলিয়াসের জীবনের শেষাংশে(১৯৯৬) কোলকাতায় দুজনের দেখা হয় খুব অল্প সময়ের জন্য যখন ইলিয়াস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে একটি পা হারিয়েছিলেন।
মিহির সেনগুপ্ত বিয়ে করেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরের বছর। তাঁর শ্বশুরবাড়ি বরিশাল। ১৯৭২ সালে বিয়ে করলেও শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত বিরতিতে যাতায়াত শুরু করেন ১৯৮৬ সাল থেকে। সেই যাতায়াতকালের এক পর্যায়ে পরিচয় ঘটেছিল ইলিয়াসের সাথে। কাকতালীয়ভাবে মিহির সেনগুপ্তের স্ত্রী ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্ত্রী পরস্পরের বন্ধুও ছিলেন। যারা একসাথে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্পর্কটা সেদিক থেকেও পারিবারিকভাবে যুক্ত ছিল।
দুজনের মধ্যেকের চমৎকার স্মৃতিগুলো পড়তে পড়তে থমকে যেতে হয় শেষাংশে এসে। মিহির সেন গুপ্ত এই পর্বে এসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আকাশের সমান বড় করে তোলেন আমাদের চোখে। ১৯৯৬ সালে হঠাৎ করে ইলিয়াসের হাড়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে তিনি চিকিৎসার জন্য কোলকাতা যান। কোলকাতায় চিকিৎসা চলাকালে তাঁর জন্য আনন্দ পুরস্কার দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তিনি বরাবরই আনন্দবাজার গোষ্ঠির বিপক্ষ শিবিরের মানুষ। তাই তিনি কিছুতে পুরস্কার নিতে রাজী হচ্ছিলেন না।
সেই সময়টি তাঁর জন্য চরম একটি ক্রান্তিকাল। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর চিকিৎসকরা তাঁর পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর পরিবার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। শারিরীক মানসিক আর্থিক সংকটে জর্জরিত পরিবার। অথচ অনেক বিখ্যাত সাহিত্যিকের বহুল কাংখিত এই আনন্দ পুরস্কার(তখনকার আর্থিক মুল্যে পাঁচ লাখ টাকা) তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন এই বলে যাদের বিরুদ্ধে তিনি চিরকাল লিখে গেছেন তাদের কাছ থেকে তিনি পুরস্কার গ্রহন করলে তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না, পাঠকরাও ক্ষমা করবে না।
সেই সংকটপূর্ণ অবস্থায় তাঁকে রাজী করানোর জন্য কোলকাতায় অবস্থানরত ড.আনিসুজ্জামান মিহির সেনগুপ্তকে অনুরোধ করেন তপন রায় চৌধুরীর মাধ্যমে। অনেক চাপে পড়ে পরিবারের দিকে তাকিয়ে তিনি হয়তো শেষ পর্যন্ত রাজী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে অবস্থায় এত বড় একটি পুরস্কারের লোভ সামলাতে পারেন সেটুকু ভেবে আমার চোখ ভিজে যায় এই ২২ বছর পরেও। মনে মনে বলি - এই আমাদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, যাকে আমরা কি এখনো সঠিক মূল্য দিতে পেরেছি?
চিকিৎসকদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে তার এক বছর পরেই ৪ঠা জানুয়ারী ১৯৯৭ তারিখে তিনি পৃথিবীকে বিদায় জানান। যে দুটো উপন্যাস দিয়ে তিনি বিশ্বজয় করার মতো শক্তি অর্জন করেছিলেন সেই সুত্রে আমরা এখনো সগর্বে বলতে পারি আমাদেরও একজন মার্কেজ ছিলেন।
মিহির সেনগুপ্তের কাছে আমি কৃতজ্ঞ তিনি বইটিতে নিজের লেখক হয়ে ওঠার বিবরণের পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অজানা অধ্যায়গুলো আমাদের সামনে হাজির করেছেন বলে। আমরা দেখলাম দুজন লেখক কিভাবে পরস্পরকে আগলে রেখে বড় হয়ে উঠতে পারে। দুই প্রিয় লেখক আমাদের চোখের সামনে প্রেরণা হয়ে থাকতে পারে একই সঙ্গে। বড় বেদনার সাথে বড় আনন্দও জেগে থাকে এখানে।
[বিস্তার সাহিত্য চক্রে প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment