১.
একটি বহুমূখী বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে বইটি সমাপ্ত হলো। প্রচণ্ড ক্রোধ, গর্ব, আক্ষেপ, বিষাদের রাজত্ব সেই অনুভূতি জগতজুড়ে। হাসান মোরশেদের প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে লেখা মুক্তিযুদ্ধের এক পরিশ্রমী উপাখ্যান 'দাস পার্টির খোঁজে'। ছোট্ট একটা মুক্তিযোদ্ধা দল দাস পার্টি। শহীদ জগতজ্যোতি দাস যার নেতা। মাত্র একুশ বছর বয়সের অসমসাহসী এই বীর যোদ্ধা ৩৬ জনের গেরিলা দল নিয়ে হাজার পাকিস্তানী-রাজাকার বাহিনীর বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বৃহত্তর সিলেটের হাওড় অঞ্চলে। এবং রাজাকার ও পাকবাহিনীর সাথে এক অসম যুদ্ধে নির্মমভাবে প্রাণ দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ বীরত্বের গৌরব বহন করে। যথারীতি বাংলাদেশ সেইসব অনন্য বীরত্বগাঁথা ভুলে এগিয়ে গেছে আরো সাড়ে চার দশক। বেঁচে থাকা গেরিলারা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ খোঁজ করে না। সেইসব 'নিখোঁজ' গেরিলার সন্ধানে ছড়িয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী এক তরুণের অনুসন্ধানী অভিযান, জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী এবং গেরিলাদের মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকার সমন্বয়ে রচিত হয়েছে দাস পার্টির খোঁজে।
২.
জগতজ্যোতি দাস এবং দাস পার্টি বিষয়ে আরো কয়েকটি বই প্রকাশিত হলেও তাদের সাথে এই বইয়ের মৌলিক পার্থক্য হলো দেখার নৈকট্য এবং দূরত্বে। অন্য বইগুলো শুনে শুনে দূরে বসে লেখা হয়েছে। আর হাসান মোরশেদ দাস পার্টির যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে নিজের পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে অভিযানের বিবরণ সংগ্রহ করেছেন জ্যোতির সহযোদ্ধাদের মুখ থেকে, সেই বিবরণ ভিডিওবন্দী করেছেন, অক্ষরবন্দী করেছেন। একাত্তরে ক্ষতবিক্ষত হওয়া মানুষগুলোর প্রত্যক্ষ বিবরণ আমাদের থমকে দেয়, অশ্রুসজল করে, আমরা বিক্ষুব্ধ হই।
৩.
বইটি পড়ে আমাদের আরেকটি অভিজ্ঞান হয়। একাত্তরে যাদের বীরত্ব গাঁথা পড়ে আমরা আবেগে আপ্লুত হই, সেই মানুষগুলো এমনকি স্বগোত্রের কাছেও কতটা অনাদৃত অবহেলিত সেটা জেনে আমাদের মাথা নুইয়ে যায় মাটির দিকে। আমরা এক অকৃতজ্ঞ জাতি। হাসান মোর্শেদের সাথে আমাদের ঘুরতে হয় সদরপুর থেকে আজমিরীগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ থেকে মাকালকান্দি, মাকালকান্দি থেকে জলসুখা, জলসুখা থেকে দিরাই। আমরা হাওড় বাওড় নদী নালা কাদা পেরিয়ে একেকজন গেরিলাকে আবিষ্কার করি, একেকজন বীরাঙ্গনার সাক্ষাত পাই, আর থমকে দাঁড়াই। যে সাক্ষাতের সবগুলো বর্ননা আমাদের সুখী করে না, অনেক বর্ণনা আমাদের স্তব্ধ করে, মর্মাহত করে। আমরা আরো আবিষ্কার করি, একাত্তরের অনেক দালাল হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ শক্তির ক্ষমতার অংশীদার। সময় পাল্টে গেলে রাজাকার হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দল বলে বিবেচিত আওয়ামীলীগের নেতা। কোথাও কোথাও এখনো প্রবলভাবে বঞ্চিত নিপীড়ত হচ্ছেন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ যাঁর সব কেড়ে নিয়েছে, স্বাধীন দেশেও তিনি সর্বহারাই থেকে যান। জগতজ্যোতির মতো বীর যোদ্ধা নিজ গ্রামেই থেকে যায় প্রায় অপরিচিত।
৪.
আমরা হুজুগে জাতি। মাত্র চার দশকেই এদেশের অনেক সর্বত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার নাম আমরা ভুলতে বসেছি। ভুলতে বসেছি অমানুষিক জান্তব বর্বরতার মুখোমুখি হয়েও বুকের রক্ত দিতে দ্বিধা করেননি এদেশের একেবারে নির্বিবাদী সাধারণ মানুষটি পর্যন্ত। কোন রকম বিনিময় মূল্যের আশা না করে অকাতরে ধন প্রাণ সব দিয়ে লাল সবুজ পতাকাটি আমাদের দিয়ে গেছে যারা, সেই মহান সর্বত্যাগী হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর নামটি যেন ইতিহাসে ঠাঁই পায় সেই চেষ্টাটা আমাদের উপর অর্পিত একটি দায়িত্ব। 'দাস পার্টির খোঁজে' মাঠে নেমে হাসান মোরশেদ সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করেছেন।
৫.
জগতজ্যোতি দাস নেই, কিন্তু তাঁর সহযাত্রীদের মধ্যে ইলিয়াসের মতো অনেকে এখনো জীবিত আছেন, বুকের এফোড় ওফোড় হয়ে যাওয়া গুলির আঘাত সয়ে। কেউ বা বুকের মধ্যে চার দশকের বুলেটের সীসার টুকরো বহন করে। জীবনের প্রবল প্রতিকূলতার স্রোতে মাথা উঁচু করে রেখেছেন তাঁরা। কিন্তু সত্যি কি মাথা উঁচু? এত অবহেলা, এত বঞ্চনা, জীবন যাপনের এত অসঙ্গতি নিয়ে তাঁরা কিভাবে আয়ুষ্কাল অতিক্রম করছেন আমরা অনেকেই জানি না। মুক্তিযুদ্ধের সুফল ভোগ করা ব্যক্তিরা কী একবার তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন না? জগতজ্যোতি স্মৃতির অংশ হয়ে গেলেও তাঁর জীবিত সহযাত্রীদের কাছে আমাদের কিছু ঋণ পরিশোধের সুযোগ আছে। সেই সুযোগ কী নেবো আমরা?
একটি বহুমূখী বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে বইটি সমাপ্ত হলো। প্রচণ্ড ক্রোধ, গর্ব, আক্ষেপ, বিষাদের রাজত্ব সেই অনুভূতি জগতজুড়ে। হাসান মোরশেদের প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে লেখা মুক্তিযুদ্ধের এক পরিশ্রমী উপাখ্যান 'দাস পার্টির খোঁজে'। ছোট্ট একটা মুক্তিযোদ্ধা দল দাস পার্টি। শহীদ জগতজ্যোতি দাস যার নেতা। মাত্র একুশ বছর বয়সের অসমসাহসী এই বীর যোদ্ধা ৩৬ জনের গেরিলা দল নিয়ে হাজার পাকিস্তানী-রাজাকার বাহিনীর বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বৃহত্তর সিলেটের হাওড় অঞ্চলে। এবং রাজাকার ও পাকবাহিনীর সাথে এক অসম যুদ্ধে নির্মমভাবে প্রাণ দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ বীরত্বের গৌরব বহন করে। যথারীতি বাংলাদেশ সেইসব অনন্য বীরত্বগাঁথা ভুলে এগিয়ে গেছে আরো সাড়ে চার দশক। বেঁচে থাকা গেরিলারা কে কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ খোঁজ করে না। সেইসব 'নিখোঁজ' গেরিলার সন্ধানে ছড়িয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী এক তরুণের অনুসন্ধানী অভিযান, জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী এবং গেরিলাদের মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকার সমন্বয়ে রচিত হয়েছে দাস পার্টির খোঁজে।
২.
জগতজ্যোতি দাস এবং দাস পার্টি বিষয়ে আরো কয়েকটি বই প্রকাশিত হলেও তাদের সাথে এই বইয়ের মৌলিক পার্থক্য হলো দেখার নৈকট্য এবং দূরত্বে। অন্য বইগুলো শুনে শুনে দূরে বসে লেখা হয়েছে। আর হাসান মোরশেদ দাস পার্টির যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে নিজের পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে অভিযানের বিবরণ সংগ্রহ করেছেন জ্যোতির সহযোদ্ধাদের মুখ থেকে, সেই বিবরণ ভিডিওবন্দী করেছেন, অক্ষরবন্দী করেছেন। একাত্তরে ক্ষতবিক্ষত হওয়া মানুষগুলোর প্রত্যক্ষ বিবরণ আমাদের থমকে দেয়, অশ্রুসজল করে, আমরা বিক্ষুব্ধ হই।
৩.
বইটি পড়ে আমাদের আরেকটি অভিজ্ঞান হয়। একাত্তরে যাদের বীরত্ব গাঁথা পড়ে আমরা আবেগে আপ্লুত হই, সেই মানুষগুলো এমনকি স্বগোত্রের কাছেও কতটা অনাদৃত অবহেলিত সেটা জেনে আমাদের মাথা নুইয়ে যায় মাটির দিকে। আমরা এক অকৃতজ্ঞ জাতি। হাসান মোর্শেদের সাথে আমাদের ঘুরতে হয় সদরপুর থেকে আজমিরীগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ থেকে মাকালকান্দি, মাকালকান্দি থেকে জলসুখা, জলসুখা থেকে দিরাই। আমরা হাওড় বাওড় নদী নালা কাদা পেরিয়ে একেকজন গেরিলাকে আবিষ্কার করি, একেকজন বীরাঙ্গনার সাক্ষাত পাই, আর থমকে দাঁড়াই। যে সাক্ষাতের সবগুলো বর্ননা আমাদের সুখী করে না, অনেক বর্ণনা আমাদের স্তব্ধ করে, মর্মাহত করে। আমরা আরো আবিষ্কার করি, একাত্তরের অনেক দালাল হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধ শক্তির ক্ষমতার অংশীদার। সময় পাল্টে গেলে রাজাকার হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দল বলে বিবেচিত আওয়ামীলীগের নেতা। কোথাও কোথাও এখনো প্রবলভাবে বঞ্চিত নিপীড়ত হচ্ছেন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ যাঁর সব কেড়ে নিয়েছে, স্বাধীন দেশেও তিনি সর্বহারাই থেকে যান। জগতজ্যোতির মতো বীর যোদ্ধা নিজ গ্রামেই থেকে যায় প্রায় অপরিচিত।
৪.
আমরা হুজুগে জাতি। মাত্র চার দশকেই এদেশের অনেক সর্বত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার নাম আমরা ভুলতে বসেছি। ভুলতে বসেছি অমানুষিক জান্তব বর্বরতার মুখোমুখি হয়েও বুকের রক্ত দিতে দ্বিধা করেননি এদেশের একেবারে নির্বিবাদী সাধারণ মানুষটি পর্যন্ত। কোন রকম বিনিময় মূল্যের আশা না করে অকাতরে ধন প্রাণ সব দিয়ে লাল সবুজ পতাকাটি আমাদের দিয়ে গেছে যারা, সেই মহান সর্বত্যাগী হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর নামটি যেন ইতিহাসে ঠাঁই পায় সেই চেষ্টাটা আমাদের উপর অর্পিত একটি দায়িত্ব। 'দাস পার্টির খোঁজে' মাঠে নেমে হাসান মোরশেদ সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করেছেন।
৫.
জগতজ্যোতি দাস নেই, কিন্তু তাঁর সহযাত্রীদের মধ্যে ইলিয়াসের মতো অনেকে এখনো জীবিত আছেন, বুকের এফোড় ওফোড় হয়ে যাওয়া গুলির আঘাত সয়ে। কেউ বা বুকের মধ্যে চার দশকের বুলেটের সীসার টুকরো বহন করে। জীবনের প্রবল প্রতিকূলতার স্রোতে মাথা উঁচু করে রেখেছেন তাঁরা। কিন্তু সত্যি কি মাথা উঁচু? এত অবহেলা, এত বঞ্চনা, জীবন যাপনের এত অসঙ্গতি নিয়ে তাঁরা কিভাবে আয়ুষ্কাল অতিক্রম করছেন আমরা অনেকেই জানি না। মুক্তিযুদ্ধের সুফল ভোগ করা ব্যক্তিরা কী একবার তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন না? জগতজ্যোতি স্মৃতির অংশ হয়ে গেলেও তাঁর জীবিত সহযাত্রীদের কাছে আমাদের কিছু ঋণ পরিশোধের সুযোগ আছে। সেই সুযোগ কী নেবো আমরা?