Tuesday, December 8, 2015

নিঃসঙ্গ সৈকতের প্রান্তে দাঁড়ানো শতাব্দীর বাতিঘর

পর পর দুই শুক্রবারের ব্যর্থতার পর তৃতীয় শুক্রবারে যাত্রার জন্য যখন চুড়ান্ত মনস্থির করা হলো অমনি বিষুদবার সকালে আকাশের মুখ ভার হয়ে গেল এবং বিকেল হতে হতে এই শীত ডিসেম্বরেও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামতে শুরু করলো।

যে দ্বীপে যাবো সেখানে যাবার জন্য বঙ্গোপসাগরের ছোট্ট একটা চ্যানেল পাড়ি দিতে হয় ছোট ডিঙ্গি নৌকায় এবং ঝড়বাদলার দিনে চ্যানেলটায় বড় বড় ঢেউ যাত্রাপথকে কিঞ্চিৎ বন্ধুর করে তোলে। বিষুদবারের গুড়িবৃষ্টির মেঘলা সন্ধ্যাকে উপেক্ষা করে দ্বীপ যাত্রা অক্ষুন্ন রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিশ বছর আগে সেন্ট মার্টিন যাত্রার সময়েও এরকম বাধা এসেছিল এবং উপেক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম বিক্ষুব্ধ সমুদ্র পেরিয়ে।

আমরা অভিযাত্রী নই, ছাপোষা মানুষ মাত্র। তাই সামান্য সমুদ্র চ্যানেল পেরোতেও শংকা পোহাতে হয় না জানি পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটার উপর কোন হামলা আসে। যা হোক, পরদিন ভোরে গৃহত্যাগ করার পর পর দেখি কুয়াশা মেঘ সরে গেছে, পুবাকাশ রাঙিয়ে হাসছে রবির কিরণ।

কর্ণফুলী সেতুর কাছে বাসস্ট্যান্ড নামক কুরুক্ষেত্রে গিয়ে নির্ধারিত কাউন্টার খুঁজে পাওয়া গেলেও বাসের চিহ্নমাত্র নেই। সমগ্র স্ট্যান্ডজুড়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে ভয়ানক সব ভেঁপুর তাণ্ডব চলছে দক্ষিণমুখী বাসগুলোর। হেলপার কন্ডাকটরদের চিৎকারে সয়লাব। একটার পেছনে আরেকটা বাস তেকোনা হয়ে রাস্তায় জ্যাম লাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের বাস আসবে বহদ্দারহাট থেকে যাত্রী বোঝাই হয়ে, আমাদের জন্য তিনখানা আসন খালি রেখে আসার কথা।

বাস আসলো। যেমনটি আশা করেছিলাম তার চেয়ে খারাপ দশা।  ওই রুটে এর চেয়ে ভালো বাস চলে না। একদম পেছন দিকে আমাদের জন্য তিনখানা সিট রাখা। একখানা সিট আমার পাশে খালি পড়ে থাকলে পেছন থেকে এক সহযাত্রিনী জিজ্ঞেস করলেন ওই আসনে আমি বসবো কিনা, বসলে হেলান দেয়া যাবে না বলে সতর্ক করলেন কেননা ওই সিটের হেলান ভেঙ্গে গেছে। সেই সিটের টিকেট বিক্রি হয়নি বলে আমরা তিনজন ওখানে আমাদের ব্যাগগুলোকে আশ্রয় দিলাম। এবার পেছনের যাত্রী নিশ্চিন্ত বোধ করলেন, কেননা লাগেজ ব্যাগ মানুষের মতো মোচড়ামুচড়ি করে না, যেভাবে রাখা হয় সেভাবে চুপচাপ বসে থাকে।

আমি আমার সিটে হেলান দিলাম, এবং ঘুমিয়ে পড়লাম শীঘ্রই। আকাশযান বা বিলাসবহুল বাসে আমার ঘুম না আসলেও লোকাল  বাসে আমার ঘুমটা বেশ দ্রুততর।

পটিয়া, চন্দনাইশ, দোহাজারী, আমিরাবাদ পেরিয়ে চকরিয়ার আগে বড়ইতলী নামক জায়গায় বাসটা  ডানদিকে ঢুকে গেল। এই পথে মাইল দশেক গেলে পেকুয়া, তারপর মগনামা ঘাট। সেই ঘাট থেকে ডিঙ্গি নৌকায় কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বড়ঘোপ ঘাট।

বাস থেকে নামার সময় পেছনের যাত্রী জানালেন তিনিও ওই পথের যাত্রী। একসাথে যাবার প্রস্তাবে সায় দিতেই আনন্দিত চিত্তে আমাদের পথ দেখিয়ে এগোতে লাগলেন। ঘাটে গিয়ে নৌকায় ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, যাত্রীতে পরিপূর্ণ। দ্রুতগামী এক নৌযান এলে তাতে উঠতে গেলাম। কিন্তু সহযাত্রীদের উঠতে দিয়ে দেখা গেল আর কোন সিট খালি নাই। সেই যাত্রী উঠে গিয়ে ফিরে দেখলো আমরা উঠতে পারিনি। আক্ষেপ করে লাভ নেই। নৌকা ছেড়ে দিলে পরবর্তী রেসের জন্য আমরা তিনজন তৈরী হতে লাগলাম। লেবু দেয়া লাল চা খেয়ে আবারো ঘাটের সিঁড়িতে দাড়ালাম। সেই যাত্রাসঙ্গী নৌকা থেকে ফোন করলেন, তিনি পৌঁছে গেছেন, আমরা যেন পরের নৌকায় দ্বীপে পৌঁছে যাই। তিনি বিকেলে আমাদের সাথে দেখা করবেন। এতটা আতিথ্য আশা করিনি এই পরিচয় বিবর্জিত এলাকায়।

পরের নৌকায় আমাদের ঠাঁই হয়ে গেল খানিকটা কৌশল খাটিয়ে। ওপারে পৌঁছে রিকশা। রিকশা চললো দ্বীপের সরু কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে। ভরদুপুরে লোক চলাচল কম। শুক্রবার। মাইকে মসজিদের আওয়াজ আসছে। রাস্তাঘাট কিছু চিনি না। রিকশাওয়ালাকে বলেছি নির্ধারিত হোটেলে নিতে। এই দ্বীপে একটাই আবাস অতিথিদের জন্য। জেনেছি পত্রিকা থেকে।

পৌঁছে গেলাম বড়ঘোপ বাজার। হোটেল সমুদ্র বিলাস বাজারের মাঝখানেই। চারতলা দালানটির একশো গজের মধ্যেই সমুদ্র সৈকত দেখে উচ্ছ্বসিত। বিশ বছর আগের সেন্টমার্টিনের কথা মনে পড়লো। যদিও সেন্টমার্টিনে একদম কিছুই ছিল না তখন। আগে খাওয়া সেরে ফেললাম পাশের একটা রেস্টুরেন্টে। হোটেল নিউ মদিনা। দারুণ এক তাজা মাছ খেলাম, সাথে দেশী মুরগীর সালুন। অসাধারণ রান্না। ভরপেট খেয়ে হোটেলে চেক ইন করলাম। চারতলায় হোটেলের রুমে পৌঁছে সামনের আদিগন্ত সমুদ্র দেখে তাকিয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম। জানালা খুললেই সমুদ্রের হাওয়া এসে গায়ে লাগবে। বিছানায় শুয়ে সমুদ্রের ঢেউ গোনা যাবে। এই দ্বীপে এমন একটা আনকোরা সৈকত আছে, কেউ কখনো বলেনি কেন?

তবু শুনে ভীষণ স্বস্তি পেলাম, এই দ্বীপে তেমন কোন পর্যটক আসে না। সমগ্র দ্বীপে আজকে আমরা তিনজনই তথাকথিত পর্যটক আজ। আমরা নতুন একটা দ্বীপ আবিষ্কার করার তৃপ্তি নিয়ে সৈকতে পা রাখলাম। দুদিনে দেখা হয়ে গেল অনাবিষ্কৃত সৈকত, বাতিঘর, বায়ুবিদ্যুত, শুটকির বাগান, মানুষের মুখের সারল্য, আহারে তৃপ্তি, রাত্রির নির্জনতা, গর্জনহীন সমুদ্র। .

......আর যখন সমগ্র আকাশ নিয়ে রাত জেগে ছিল.... তুমি ছিলে খুব খুব কাছে!

তোমার দু'চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে ।
আলো –অন্ধকারে
তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি !
নিকটে – নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন,-
আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি এই দূর সমুদ্রের জলে!
যে-নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন , দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে !
সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে
বালকের মতো এক,- তারপর,- গিয়েছি হারায়ে
সমুদ্রের জলে ,
নক্ষত্রের তলে !
রাত্রে,- অন্দজকারে !
-তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ,- জানি আমি,-
আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে !

তোমার শরীর ,-
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার;- তারপর,- মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন দিকে জানিনি তা,- হয়েছে মলিন
চক্ষু এই;- ছিঁড়ে গেছি- ফেড়ে গেছি ,- পৃথিবীর পথ হেঁটে হেঁটে
কত দিন রাত্রি গেছে কেটে !
কত দেহ এল,- গেল, - হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব;- সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
নক্ষত্রের তলে
ব'সে আছি,- সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
তুমি কি আসিবে কাছে....

[ধূসর পাণ্ডুলিপি - জীবনানন্দ দাশ]

Thursday, December 3, 2015

অচল মুদ্রার জীবনযাপন

জগতে কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে কথা বলতে গেলে শুধু 'আচ্ছা' 'আচ্ছা' করতে হয়। তারা এর বাইরে আর কোন শব্দ সহ্য করতে পারে না। তারা যাই বলবে, শুধু হ্যাঁ বলতে হয়। তারা তোমাকে মতামত নেবার জন্য একটা প্রস্তাবের কথা জানাবে, সেই প্রস্তাবে তুমি যদি সহমতের বাইরে সামান্যতম বিচ্যুতও হও, তাহলে মহাযুদ্ধ সম্ভাবনা। এরা হলো বাংলাদেশের সংসদের মতো, যেখানে তোমাকে সরকারী দলের সদস্য হিসেবে আশা করে। আপন মানুষের মধ্যে এই চরিত্রের লোক থাকাটা একটা বিব্রতকর অবস্থা। এরকম মানুষগুলো যখন কথা বলতে আসে আমার রীতিমত আতংক হয়, তাদের মতকে মেনে নিতে হবে সেজন্য না। ক্রমাগত হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ানোর ফলে আমার মাথা ধরে যায়, সেটা নামাতে গিয়ে রীতিমত বুকে ব্যথা শুরু হয়।

বুকের ব্যথাটা নিয়েও বিব্রত আছি। বুকের বাঁ দিকে ব্যথা মানেই হার্টের অসুখ নয়। নানান পদের ব্যথা আছে। তবু চল্লিশোর্ধ মানুষদের আশংকা, বাম দিকের যে কোন ব্যথা হৃদযন্ত্রের আর্তনাদের শব্দ। কয়েক  বছর আগে এরকম ব্যথা ট্যাথা হলে কাউকে না কাউকে বলতাম। কিন্তু ক্রমাগত দেখা গেল কদিন বাদেই ব্যথা সেরে গেছে, কিছুই ঘটেনি। চেক আপ করেও কিছুই পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে এসব বলা ছেড়ে দিয়েছি। বলতে গেলে মনে হয় সহানুভুতি আদায় করার চেষ্টা করছি। যখন যা ঘটার ঘটবেই, খামাকা নিজের জন্য অন্যকে বিব্রত করে রাখাল বালক হবার কী দরকার!

বছর দুয়েক আগে মে মাসের এক সকালে আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হলো বিশাল এক ঘুর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে চট্টগ্রামের দিকে। দুপুরের পরপরই আঘাত হানবে। সকল জাহাজ, উড়োজাহাজ সরিয়ে নেয়া হলো, পতেঙ্গা থেকে লোক সরে গেল, সমগ্র ইপিজেড এলাকা ছুটি দেয়া হলো। আমরা তড়িঘড়ি করে বাইরের কাজ সেরে ঘরে এসে ঢুকলাম। দুপুরে খেয়েদেয়ে বারান্দায় বসে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে আছি, ঝড়ের আগমন পথ ওই দিকে, বাতাস হচ্ছে কিন্তু আকাশভর্তি রোদ, কেমন একটা ব্যাপার। এবার রোদেলা আকাশেই ঝড় আসবে? বাতাস প্রচুর ধুলো ওড়াচ্ছে, লোকজনের চোখমুখে ঝাপটা মারছে, রিকশাওয়ালা টেনে টেনে চলছে। সমস্ত রাস্তা ফাঁকা হয়ে আসছে।

দুপুর গড়ালো, বিকেল নামলো, অবশেষে সন্ধ্যাও। সেই ঝড় আর এলোই না। সন্ধ্যার পর টেলিভিশনে বলা হলো ঝড় নাকি দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাই আঘাত হানেনি। কিন্তু বিপদমুক্ত হবার আনন্দের বদলে আমি মনে মনে যেন হতাশ হলাম। এত বড় প্রস্ততি সব মাঠে মারা গেল? কী লজ্জার কথা! অফিসের বড় সাহেবও তো বলছিল, কিচ্ছু হবে না, তোমরা কাজ করতে থাকো। মরলেও কাজ করতে করতে মরবা। কর্মশহীদ হবার সুযোগ অর্জন করবা। তাকে অমান্য করে, প্রায় বিদ্রোহ করে অফিস ছেড়েছি আমরা। এখন তো তার কথাই সত্য হলো।

মৃত্যুকে নিয়েও কি আমি এমন হতাশায় ভুগবো? রোগীর টেস্টে গুরুতর সমস্যা না পেলে কি ডাক্তারও হতাশ হয়? এই প্রশ্নগুলো কাউকে করা শোভন তো নয়, সুস্থতারও লক্ষণ নয়। আমরা অনেকে নিজেদের অজান্তেই অসুস্থ জীবনযাপন করি।

Wednesday, December 2, 2015

অপারেশান জ্যাকপট নিয়ে


অপারেশান জ্যাকপট নিয়ে বেশ কিছু বইপত্র পড়লেও এই অপারেশানের নেতৃত্বে থাকা এ.ডব্লিউ. চৌধুরীর কোন লেখা পড়া হয়নি। আজকের দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ তাঁর লেখা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। লেখাটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আর্কাইভ করে রাখলাম ভবিষ্যত রেফারেন্সের জন্য। লেখক এবং দৈনিক উভয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা। দৈনিক সুপ্রভাতের প্রতিবেদনের লিংক:

দুঃসাহসিক অভিযানের আদ্যোপান্ত

লিখেছেন কমডোর (অব.) এ. ডব্লিউ চৌধুরী
http://suprobhat.com/5831-2/