জগতে কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে কথা বলতে গেলে শুধু 'আচ্ছা' 'আচ্ছা' করতে হয়। তারা এর বাইরে আর কোন শব্দ সহ্য করতে পারে না। তারা যাই বলবে, শুধু হ্যাঁ বলতে হয়। তারা তোমাকে মতামত নেবার জন্য একটা প্রস্তাবের কথা জানাবে, সেই প্রস্তাবে তুমি যদি সহমতের বাইরে সামান্যতম বিচ্যুতও হও, তাহলে মহাযুদ্ধ সম্ভাবনা। এরা হলো বাংলাদেশের সংসদের মতো, যেখানে তোমাকে সরকারী দলের সদস্য হিসেবে আশা করে। আপন মানুষের মধ্যে এই চরিত্রের লোক থাকাটা একটা বিব্রতকর অবস্থা। এরকম মানুষগুলো যখন কথা বলতে আসে আমার রীতিমত আতংক হয়, তাদের মতকে মেনে নিতে হবে সেজন্য না। ক্রমাগত হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ানোর ফলে আমার মাথা ধরে যায়, সেটা নামাতে গিয়ে রীতিমত বুকে ব্যথা শুরু হয়।
বুকের ব্যথাটা নিয়েও বিব্রত আছি। বুকের বাঁ দিকে ব্যথা মানেই হার্টের অসুখ নয়। নানান পদের ব্যথা আছে। তবু চল্লিশোর্ধ মানুষদের আশংকা, বাম দিকের যে কোন ব্যথা হৃদযন্ত্রের আর্তনাদের শব্দ। কয়েক বছর আগে এরকম ব্যথা ট্যাথা হলে কাউকে না কাউকে বলতাম। কিন্তু ক্রমাগত দেখা গেল কদিন বাদেই ব্যথা সেরে গেছে, কিছুই ঘটেনি। চেক আপ করেও কিছুই পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে এসব বলা ছেড়ে দিয়েছি। বলতে গেলে মনে হয় সহানুভুতি আদায় করার চেষ্টা করছি। যখন যা ঘটার ঘটবেই, খামাকা নিজের জন্য অন্যকে বিব্রত করে রাখাল বালক হবার কী দরকার! বছর দুয়েক আগে মে মাসের এক সকালে আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানানো হলো বিশাল এক ঘুর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে চট্টগ্রামের দিকে। দুপুরের পরপরই আঘাত হানবে। সকল জাহাজ, উড়োজাহাজ সরিয়ে নেয়া হলো, পতেঙ্গা থেকে লোক সরে গেল, সমগ্র ইপিজেড এলাকা ছুটি দেয়া হলো। আমরা তড়িঘড়ি করে বাইরের কাজ সেরে ঘরে এসে ঢুকলাম। দুপুরে খেয়েদেয়ে বারান্দায় বসে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে আছি, ঝড়ের আগমন পথ ওই দিকে, বাতাস হচ্ছে কিন্তু আকাশভর্তি রোদ, কেমন একটা ব্যাপার। এবার রোদেলা আকাশেই ঝড় আসবে? বাতাস প্রচুর ধুলো ওড়াচ্ছে, লোকজনের চোখমুখে ঝাপটা মারছে, রিকশাওয়ালা টেনে টেনে চলছে। সমস্ত রাস্তা ফাঁকা হয়ে আসছে।
দুপুর গড়ালো, বিকেল নামলো, অবশেষে সন্ধ্যাও। সেই ঝড় আর এলোই না। সন্ধ্যার পর টেলিভিশনে বলা হলো ঝড় নাকি দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাই আঘাত হানেনি। কিন্তু বিপদমুক্ত হবার আনন্দের বদলে আমি মনে মনে যেন হতাশ হলাম। এত বড় প্রস্ততি সব মাঠে মারা গেল? কী লজ্জার কথা! অফিসের বড় সাহেবও তো বলছিল, কিচ্ছু হবে না, তোমরা কাজ করতে থাকো। মরলেও কাজ করতে করতে মরবা। কর্মশহীদ হবার সুযোগ অর্জন করবা। তাকে অমান্য করে, প্রায় বিদ্রোহ করে অফিস ছেড়েছি আমরা। এখন তো তার কথাই সত্য হলো।
মৃত্যুকে নিয়েও কি আমি এমন হতাশায় ভুগবো? রোগীর টেস্টে গুরুতর সমস্যা না পেলে কি ডাক্তারও হতাশ হয়? এই প্রশ্নগুলো কাউকে করা শোভন তো নয়, সুস্থতারও লক্ষণ নয়। আমরা অনেকে নিজেদের অজান্তেই অসুস্থ জীবনযাপন করি।
No comments:
Post a Comment