অনেককাল আগে আমরা প্রতিটা বিকেল আড্ডা দিয়ে কাটাতাম। সকালেও হতো না তেমন না। কোন কোনদিন এমনও গেছে সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা এভাবে রাত এগারোটা পর্যন্ত ম্যারাথন আড্ডা দিয়েছি। মাঝে শুধু খাওয়ার বিরতি ছিল। সবচেয়ে প্রিয় ছিল বিকেলের আড্ডা। বিকেলের আড্ডা গড়িয়ে সন্ধ্যে পার করে দিলেও আমেজ শেষ হতো না। কলোনীর একটা মাঠের কোনায় আমাদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। নয় নম্বর মাঠ। কি সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকতো সেই মাঠ! ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসতাম। খোলা মাঠের চারপাশে বাউণ্ডারী ওয়ালের মতো লম্বা সারিবদ্ধ সরকারী কোয়ার্টার। একেকটা বিল্ডিং লম্বায় কয়েকশো ফুট। হলুদ রঙের সরকারী দালানগুলো বিকেলের আলোতে সোনালী বরনে ঝরমল করতো। দালানগুলোর সামনে ঘাসে ঢাকা চত্তর, সেখানে ছোট ছোট বাগান, নারিকেল গাছের সারি, শৈশব থেকে দৃশ্যগুলো আমাদের অভ্যস্ত চোখে নতুন কোন সুন্দর মেলে না ধরলেও এখন টের পাই ওরকম বিকেল, ওরকম সোনাঝরা দিন সবার জীবনে আসে না। আজকালকার বাচ্চাদের শৈশব ঘুপচি ঘরে কার্টুনবন্দী। সেই দিনগুলি স্মৃতির প্রিয় আশ্রয়। মন খারাপের সময়গুলোতে আমি ওই সময়গুলোতে ফিরে যাই। আমি আঠারো বছর পার হবার পর কলোনী ছাড়লেও আরো প্রায় অর্ধযুগ বারবার ফিরে গিয়েছি আড্ডার লোভে। একসময় আমরা বড় হয়ে গেলাম, আমাদের হাতে আড্ডার সময় ফুরিয়ে গেল। তবু এই মধ্যবয়সেও যদি কখনো পুরোনো বন্ধু কজনকে জড়ো করতে পারি, তখন হেঁটে আসি বর্তমানের বিবর্ন সময়েও। সেই আড্ডাগুলোতে অনেক মজার দার্শনিক আলাপও হতো। বন্ধু জামান বলতো মানুষের জীবনে তিনটে প্রয়োজন। খাওয়া ঘুম পায়খানা্। এই তিনটা জিনিস ঠিক থাকলে মানুষ সুখী এবং সুস্থ। এখনো কথাটা বিশ্বাস করি। আরেকজন বলতো বলতো, 'পেট, চেট, মন, এই তিনটারে সুখী রাখতে পারলে সে দুইন্যার সবচেয়ে সুখী'। সে আবার তার ব্যাখ্যাও দিত। তার ব্যাখ্যা - পেটের সুখ হলো অন্ন বস্ত্র বাসস্থান অর্থাৎ স্বচ্ছলতা। চেটের সুখ বলতে প্রেম ভালোবাসা যৌনজীবনে সুখ। মাথার সুখ হলো গান বাজনা সিনেমা বইপড়া এরকম যত সাংস্কৃতিক সুখ। আমরা এই দার্শনিক সুখটা তখন বুঝতাম না। কেননা তখনো আমাদের অনেক দূর যাওয়া বাকী। আরো অনেক বছর পর টের পেয়েছি কথাটা কত সত্য।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ওই কলোনীর অনেক ঘটনা আমি এত বছর পর জানতে পারছি। অপারেশান জ্যাকপট নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি আমাদের সেই আড্ডা দেয়া জায়গাগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় কত ঘটনার স্বাক্ষী ছিল। কলোনীর একটা বাসা থেকে অপারেশানের পরিকল্পনার একাংশ বাস্তবায়িত হয়েছিল ভেবে গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে। আগ্রাবাদের অনেকগুলো বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের শেলটার ছিল। যারা শেলটার দিয়েছে তাদের অনেকে ঠিকমতো মূল্যায়িত হয়নি সুবিধাবাদী লোকদের তাণ্ডবে। কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের যুগে সেরকম অনেক নীরব মুক্তিযোদ্ধার নাম হারিয়ে গেছে। আমি কিছুদিন ধরে তাদের খুঁজে বের করার কাজ নিয়েছি। এটা আমার একার কাজ। নিজের কৌতুহলে। মুক্তিযুদ্ধের যে কোন তুচ্ছ ঘটনাও আমাকে আলোড়িত করে, কেন করে, কিভাবে করে এটা কাউকে বোঝানো যায় না। আমি এরকম কাজগুলো করার জন্যই চাকরী ছেড়েছি, অন্ততঃ এটা একটা কারন, এটা বললে আমাকে পাগলেরও অধম বলে অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দেবে। এই কাজটা আমি নিঃশব্দে করতে চাই। আমি এমনকি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও বলিনি। সবাই জানে আমি জীবিকার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু আমি নিজের কাছ থেকে সময় চুরি করে কাজটা করতে চাই। যদি শেষ করতে পারি তাহলে একটা বই প্রকাশের ইচ্ছে আছে শেষ বয়সে। শেষ বয়স কথাটা লিখে হাসি পেয়ে গেল। আমি কি জানি আমার শেষ বয়স কোনটা? যদি কালকেই মরে যাই তাহলে আজকের দিনটা হবে শেষ বয়স। আজকের লেখাটাই শেষ লেখা। যদি আরো দশ বছর কায়ক্লেশে টিকে যাই, তাহলে আগামী দশ বছর যে কাজগুলো করবো সেগুলো হবে শেষ বয়সের লেখা।তাছাড়া আমার জ্ঞানের পরিধি এত কম যে আমি জ্ঞানী লোকদের সাথে এ্টা নিয়ে আলাপ করতেও ভয় পাই। এটা এক ধরনের হীনমন্যতা। কিছুদিন ধরে পাবলিক লাইব্রেরীতে যাওয়া শুরু করেছি সকালবেলা। দুপুর পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে আসি। সবগুলো বই নেই ওখানে, তবু যতটা পাওয়া যায়। লাইব্রেরীতে ল্যাপটপ নেয়া যায় না। হাতে নোট করে কাজ করতে হয়। আজকাল হাতে লেখার অভ্যেস নেই বলে ক্লান্তি লাগে এক পাতা লিখলেই। তবু প্রতিদিনের প্রিয় কাজের অংশ হিসেবে সেই ক্লান্তিকেও আমি আনন্দদায়ক মনে করি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ওই কলোনীর অনেক ঘটনা আমি এত বছর পর জানতে পারছি। অপারেশান জ্যাকপট নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি আমাদের সেই আড্ডা দেয়া জায়গাগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় কত ঘটনার স্বাক্ষী ছিল। কলোনীর একটা বাসা থেকে অপারেশানের পরিকল্পনার একাংশ বাস্তবায়িত হয়েছিল ভেবে গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে। আগ্রাবাদের অনেকগুলো বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের শেলটার ছিল। যারা শেলটার দিয়েছে তাদের অনেকে ঠিকমতো মূল্যায়িত হয়নি সুবিধাবাদী লোকদের তাণ্ডবে। কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের যুগে সেরকম অনেক নীরব মুক্তিযোদ্ধার নাম হারিয়ে গেছে। আমি কিছুদিন ধরে তাদের খুঁজে বের করার কাজ নিয়েছি। এটা আমার একার কাজ। নিজের কৌতুহলে। মুক্তিযুদ্ধের যে কোন তুচ্ছ ঘটনাও আমাকে আলোড়িত করে, কেন করে, কিভাবে করে এটা কাউকে বোঝানো যায় না। আমি এরকম কাজগুলো করার জন্যই চাকরী ছেড়েছি, অন্ততঃ এটা একটা কারন, এটা বললে আমাকে পাগলেরও অধম বলে অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দেবে। এই কাজটা আমি নিঃশব্দে করতে চাই। আমি এমনকি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও বলিনি। সবাই জানে আমি জীবিকার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু আমি নিজের কাছ থেকে সময় চুরি করে কাজটা করতে চাই। যদি শেষ করতে পারি তাহলে একটা বই প্রকাশের ইচ্ছে আছে শেষ বয়সে। শেষ বয়স কথাটা লিখে হাসি পেয়ে গেল। আমি কি জানি আমার শেষ বয়স কোনটা? যদি কালকেই মরে যাই তাহলে আজকের দিনটা হবে শেষ বয়স। আজকের লেখাটাই শেষ লেখা। যদি আরো দশ বছর কায়ক্লেশে টিকে যাই, তাহলে আগামী দশ বছর যে কাজগুলো করবো সেগুলো হবে শেষ বয়সের লেখা।তাছাড়া আমার জ্ঞানের পরিধি এত কম যে আমি জ্ঞানী লোকদের সাথে এ্টা নিয়ে আলাপ করতেও ভয় পাই। এটা এক ধরনের হীনমন্যতা। কিছুদিন ধরে পাবলিক লাইব্রেরীতে যাওয়া শুরু করেছি সকালবেলা। দুপুর পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে আসি। সবগুলো বই নেই ওখানে, তবু যতটা পাওয়া যায়। লাইব্রেরীতে ল্যাপটপ নেয়া যায় না। হাতে নোট করে কাজ করতে হয়। আজকাল হাতে লেখার অভ্যেস নেই বলে ক্লান্তি লাগে এক পাতা লিখলেই। তবু প্রতিদিনের প্রিয় কাজের অংশ হিসেবে সেই ক্লান্তিকেও আমি আনন্দদায়ক মনে করি।
No comments:
Post a Comment