Wednesday, March 18, 2015

হবে না

হবার কথা ছিল সময় জগতে অখণ্ড অবসর, কাজের জগতে অবাধ স্বাধীনতা, তরতর করে বয়ে চলবে সবকিছু। সবকিছু ঠিক আছে, যেমন চেয়েছি তেমনি। তবু গতিটা কেমন অমসৃন, যতটা দ্রুততর হবার ততটা হচ্ছে না। ক্লান্তি এসে পিছিয়ে দিচ্ছে বারবার। ক্লান্তির কাছে হেরে যেতে চাই না। অনেক পথ বাকী। সময় খুব কম। এক বিষয়ে তিন থেকে পাঁচ বই, দুটো বিষয়েই আগাতে হবে। সাহিত্য পাঠের অবসর নেই, সিনেমা দেখার ফুরসত নেই। শুধু মনুষ্যত্বের দর্শনটা মাঝে মাঝে খোঁচা দেয়। মানুষ ভুলে বসেছে সে কেন বাঁচে। হঠাৎ মনে পড়লে তাকে অস্বাভাবিক মনে হয়। একটা মানুষের কতটা ধর্ম? একটা সমাজের ধর্ম, একটা ব্যক্তি ধর্ম, একটা জীবিকা ধর্ম, একটা চরিত্র ধর্ম, এরকম কত রঙ্গ রকমের ধর্ম নিয়ে একেকটা মানুষের বাস। তবু শেষমেষ সবাই মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।

লেখাটা অর্ধেক এসে থেমে গেল গতরাতেই। এরকম মাঝপথে থেমে যাওয়া লেখার সংখ্যা অগণিত। মুছে যাওয়াও। হাতের আঙুলে ক্লান্তি, মগজে মননে সবখানেই বিবশ ক্লান্তি এসে দখল করে নিয়েছে শরীরের উপনিবেশ।

অক্ষরগুলো আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করছে- তোকে দিয়ে হবে না। হয়নি!

Sunday, March 8, 2015

বসন্ত ভাবালুতা

কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে
বসন্ত-বাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেই ক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের প্রানে-; বিস্মৃতি প্রদোষে
হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা স্বপ্নের মুরতি।
তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সবচেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়-
সে আমার প্রেম,
তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে।
======================================
আরে..........এ যেন আমারেই বলা......যখন তুমি কর্ম ছাড়িয়া বেকার হইয়া বসন্ত বাতাস উদযাপন করিতে বসিবা অতীতের তীর হইতে যে রাতে বসন্ত বাতাস উড়িয়া আসিবে, ঝরা বকুলের কান্নায় আকাশও ব্যথিত হইয়া যাইবে, তখন তুমি পিছনে ফিরিয়া দেখো কিছু ফেলিয়া আসিয়াছেন কী জনাব? কিন্তু প্রাণের প্রানে কেন? প্রাণ এবং প্রান দুটো আলাদা শব্দ? যা খুশী হোক। পরের লাইনে যাই... এরপর বিস্মৃতির প্রদোষে মানে শেষ বেলায় এসে হয়তো সে দেবে জ্যোতি মানে আলো। সবকিছু শেষ হবার পর শেষবেলার আলো? হয়তো কখনো নামহীন কোন সপ্ন দেখাবে, এটাও আজব কথা। স্বপ্নের তো নামও থাকে নাকি। তবু সে স্বপ্ন নয়, আহ। যদি সবচেয়ে সত্য হতো? সে আমার প্রেম হতো। হতোই তো। বসন্তকাল বলে নয়, বর্ষাকালে বৃষ্টি মাথায় নিয়েও একই স্বপ্ন। তারে আবার আমি রাখিয়া আসলাম, কেন? অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশ্যে? কে তুমি? বুড়ো কি শেষবেলায় এই কবিতা আবারো পড়ে দেখছিল? নাহ। মনে হয় না।

কাজের ফাঁকতালে কবিতাগুলো এক ঝলক বসন্ত বাতাসের মতো। এক কাপ চায়ের সাথে একটা গরম সিঙ্গাড়া। বসন্ত বাতাসে এখনো শীতলতা। চায়ের পরে ধোঁয়ার উৎসবে সন্ধ্যেটা ভীষণ মায়াময়। ভাগ্যিস রোবোট হয়ে জন্মাইনি। মানুষের আর কিছু না থাকলেও একটা আকাশ আছে, কিছু সবুজ আছে, কিছু প্রাণ আছে। আছে কিছু অর্থহীন ভাবালুতা। নইলে কাজ কাজ কাজ করে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতাম অর্থহীন একটা জীবন শেষে। যা চেয়েছি সব পেয়ে যাওয়ার পর আর কিছু চাইতে হয় না। যা পেয়েছি তাকে যা চেয়েছির পাল্লায় তুলে দিয়ে ভারসাম্য রক্ষাকেও একেবারে ব্যর্থ বলা যায় না। ভাঙেনি আমার কাঁচের আয়না!

[কবিতা কৃতজ্ঞতা: রবিঠাকুর]

Wednesday, March 4, 2015

জীবন আমাদের ক্লান্ত করে, তবু অক্লান্ত থাকার কাজ থাকে

অনেককাল আগে আমরা প্রতিটা বিকেল আড্ডা দিয়ে কাটাতাম। সকালেও হতো না তেমন না। কোন কোনদিন এমনও গেছে সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা এভাবে রাত এগারোটা পর্যন্ত ম্যারাথন আড্ডা দিয়েছি। মাঝে শুধু খাওয়ার বিরতি ছিল। সবচেয়ে প্রিয় ছিল বিকেলের আড্ডা। বিকেলের আড্ডা গড়িয়ে সন্ধ্যে পার করে দিলেও আমেজ শেষ হতো না। কলোনীর একটা মাঠের কোনায় আমাদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। নয় নম্বর মাঠ। কি সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকতো সেই মাঠ! ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসতাম। খোলা মাঠের চারপাশে বাউণ্ডারী ওয়ালের মতো লম্বা সারিবদ্ধ সরকারী কোয়ার্টার। একেকটা বিল্ডিং লম্বায় কয়েকশো ফুট। হলুদ রঙের সরকারী দালানগুলো বিকেলের আলোতে সোনালী বরনে ঝরমল করতো। দালানগুলোর সামনে ঘাসে ঢাকা চত্তর, সেখানে ছোট ছোট বাগান, নারিকেল গাছের সারি, শৈশব থেকে দৃশ্যগুলো আমাদের অভ্যস্ত চোখে নতুন কোন সুন্দর মেলে না ধরলেও এখন টের পাই ওরকম বিকেল, ওরকম সোনাঝরা দিন সবার জীবনে আসে না। আজকালকার বাচ্চাদের শৈশব ঘুপচি ঘরে কার্টুনবন্দী। সেই দিনগুলি স্মৃতির প্রিয় আশ্রয়। মন খারাপের সময়গুলোতে আমি ওই সময়গুলোতে ফিরে যাই। আমি আঠারো বছর পার হবার পর কলোনী ছাড়লেও আরো প্রায় অর্ধযুগ বারবার ফিরে গিয়েছি আড্ডার লোভে। একসময় আমরা বড় হয়ে গেলাম, আমাদের হাতে আড্ডার সময় ফুরিয়ে গেল। তবু এই মধ্যবয়সেও যদি কখনো পুরোনো বন্ধু কজনকে জড়ো করতে পারি, তখন হেঁটে আসি বর্তমানের বিবর্ন সময়েও। সেই আড্ডাগুলোতে অনেক মজার দার্শনিক আলাপও হতো।  বন্ধু জামান বলতো মানুষের জীবনে তিনটে প্রয়োজন। খাওয়া ঘুম পায়খানা্। এই তিনটা জিনিস ঠিক থাকলে মানুষ সুখী এবং সুস্থ। এখনো কথাটা বিশ্বাস করি। আরেকজন বলতো বলতো, 'পেট, চেট, মন, এই তিনটারে সুখী রাখতে পারলে সে দুইন্যার সবচেয়ে সুখী'। সে আবার তার ব্যাখ্যাও দিত। তার ব্যাখ্যা - পেটের সুখ হলো অন্ন বস্ত্র বাসস্থান অর্থাৎ স্বচ্ছলতা। চেটের সুখ বলতে প্রেম ভালোবাসা যৌনজীবনে সুখ। মাথার সুখ হলো গান বাজনা সিনেমা বইপড়া এরকম যত সাংস্কৃতিক সুখ। আমরা এই দার্শনিক সুখটা তখন বুঝতাম না। কেননা তখনো আমাদের অনেক দূর যাওয়া বাকী। আরো অনেক বছর পর টের পেয়েছি কথাটা কত সত্য। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ওই কলোনীর অনেক ঘটনা আমি এত বছর পর জানতে পারছি। অপারেশান জ্যাকপট নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছি আমাদের সেই আড্ডা দেয়া জায়গাগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় কত ঘটনার স্বাক্ষী ছিল। কলোনীর একটা বাসা থেকে অপারেশানের পরিকল্পনার একাংশ বাস্তবায়িত হয়েছিল ভেবে গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে। আগ্রাবাদের অনেকগুলো বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের শেলটার ছিল। যারা শেলটার দিয়েছে তাদের অনেকে ঠিকমতো মূল্যায়িত হয়নি সুবিধাবাদী লোকদের তাণ্ডবে। কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের যুগে সেরকম অনেক নীরব মুক্তিযোদ্ধার নাম হারিয়ে গেছে। আমি কিছুদিন ধরে তাদের খুঁজে বের করার কাজ নিয়েছি। এটা আমার একার কাজ। নিজের কৌতুহলে। মুক্তিযুদ্ধের যে কোন তুচ্ছ ঘটনাও আমাকে আলোড়িত করে, কেন করে, কিভাবে করে এটা কাউকে বোঝানো যায় না। আমি এরকম কাজগুলো করার জন্যই চাকরী ছেড়েছি, অন্ততঃ এটা একটা কারন, এটা বললে আমাকে পাগলেরও অধম বলে অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দেবে। এই কাজটা আমি নিঃশব্দে করতে চাই। আমি এমনকি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও বলিনি। সবাই জানে আমি জীবিকার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু আমি নিজের কাছ থেকে সময় চুরি করে কাজটা করতে চাই। যদি শেষ করতে পারি তাহলে একটা বই প্রকাশের ইচ্ছে আছে শেষ বয়সে। শেষ বয়স কথাটা লিখে হাসি পেয়ে গেল। আমি কি জানি আমার শেষ বয়স কোনটা? যদি কালকেই মরে যাই তাহলে আজকের দিনটা হবে শেষ বয়স। আজকের লেখাটাই শেষ লেখা। যদি আরো দশ বছর কায়ক্লেশে টিকে যাই, তাহলে আগামী দশ বছর যে কাজগুলো করবো সেগুলো হবে শেষ বয়সের লেখা।তাছাড়া আমার জ্ঞানের পরিধি এত কম যে আমি জ্ঞানী লোকদের সাথে এ্টা নিয়ে আলাপ করতেও ভয় পাই। এটা এক ধরনের হীনমন্যতা। কিছুদিন ধরে পাবলিক লাইব্রেরীতে যাওয়া শুরু করেছি সকালবেলা। দুপুর পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে আসি। সবগুলো বই নেই ওখানে, তবু যতটা পাওয়া যায়। লাইব্রেরীতে ল্যাপটপ নেয়া যায় না। হাতে নোট করে কাজ করতে হয়। আজকাল হাতে লেখার অভ্যেস নেই বলে ক্লান্তি লাগে এক পাতা লিখলেই। তবু প্রতিদিনের প্রিয় কাজের অংশ হিসেবে সেই ক্লান্তিকেও আমি আনন্দদায়ক মনে করি।


Sunday, March 1, 2015

পুরোনো সেই বেয়াদব

রিপনকে নিয়ে হোটেলে বসে চা নাস্তার অর্ডার দেয়া শেষে দেখি পাশের টেবিলে তাহের ওরফে তাইজ্জা বসা। পাড়ার ঝুপড়ি হোটেল, অনেক বছর পর এখানে আসলাম। সেই তাইজ্জা এখনো আছে! বয়স বেড়েছে, মুখে খোঁচাখোঁচা কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ, চোয়াল ভাঙ্গা, কপালে কাটা দাগ, চোখে সেই কুৎসিত চাউনি। এরকম বিদঘুটে ভয়ংকর চেহারা আমি খুব বেশী দেখিনি। এক নজরে্‌ই বলে দেয়া যাবে অপরাধজগতেই তার বিচরণ।

প্রায় বিশ বছর পর দেখছি ওকে, বয়স বাদে এখনো তার স্বভাব চরিত্র বদলায়নি মনে হচ্ছে। আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালো। চিনতে পেরেছে নিশ্চয়ই। আমি তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মনে পড়লো কী ভয়ংকর দুর্ধর্ষ অপরাধী এই লোকটা। পাড়ার একটা বাড়িও শান্তিতে ঘুমাতে পারতো না। কোন মেয়েই নিরাপদ ছিল না ওর কাছ থেকে। সে কোন বাড়ির সামনে গিয়ে গলা চড়িয়ে ডাক দিলে সেই বাড়ির লোক ভয়ে কাঁপতে থাকতো। টাকা দিবি, নাকি মেয়েটারে তুলে নিবো? যে কেউ বাড়ি করতে মালপত্র আনলে সাথে সাথে হাজির। টাকা দিবি না কি নালায় ফেলে দেবো? তখন এলাকা আরো নির্জন ছিল, কেউ থানা পুলিশের ঝামেলা করলে তার উপর মহাদুর্যোগ নেমে আসতো।

আমার সাথে শুধু একবার ঝামেলা হয়েছিল। সচরাচর সে আমাকে ঘাঁটাতো না, আমিও তাকে কিছু বলতাম না। তার কাজে বাধা দেবার মতো দুঃসাহসও ছিল না আমার। মনে মনে রাগ পুষে সয়ে নিতাম।

একদিন আর পারা গেল না। আমি ভার্সিটি থেকে ফিরে শুনলাম, সে আমাদের ঠিক সামনের বাসায় এসে হামলা করেছে, ওদের মালপত্র ফেলে দিয়েছে, বাধা দিতে গেলে আমার বাবার সাথেও বেয়াদবী করেছে। বলেছে আমাদেরকেও দেখে নেবে। রাতে এটাক করবে। ঘরের সবাই দুশ্চিন্তায়।

নাহ আর বাড়তে দেয়া যায় না। সেই রাতে এক ক্যাডার বন্ধুকে ডেকে এনে দুজনে দুটো রিভলবার নিয়ে মুখোশ পরে রাস্তায় নামলাম। ওদের দলটা আমাদের দেখলো। আমরা অস্ত্র দুটো টর্চের আলোয় দেখিয়ে দিলাম। তারপর ওদের দিকে আগাতে থাকলাম। আমাদের দুজনের মাথায় কালো দুটো মাংকিক্যাপ। মুখোশের মতো এঁটে হাঁটতে লাগলাম। রাতের বেলা দুজনকে ভয়ংকর লাগছিল। ওরা উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলো। আমরা ওদের পিছন পিছন হাটছি। ওরা আরো দ্রুত এলাকা ছাড়িয়ে চলে গেল। আমরা ঘরে ফিরে এলাম। নাক ডেকে ঘুমোলাম। সকালে দুই গালে হাসলাম। খেলনা রিভলবার দিয়ে এতটা দাবড়ানি দেয়া যাবে নিজেরাই বুঝিনি। বুঝলাম সাহসটাই সব, বাকী সব প্রদর্শনীর খেলা।

সেই তাইজ্জা। তার সবকিছু ছাপিয়ে একটাই মনে পড়লো। বেয়াদব। ওর মতো চরম বেয়াদব আমি আর একটাও দেখিনি জীবনে। আমি অনেক কিছু সহ্য করতে পারলেও বেয়াদব লোক দুচোখে দেখতে পারি না। তাইজ্জাকে ঘেন্না করার অনেক কারণের মধ্যে তার বেয়াদবীটাই মনে থাকবে অনেক কাল।

আমরা চা নাস্তা শেষ করলাম। তারপর উঠলাম। তাইজ্জা তখন সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে আর কিছু একটা ভাবছে। মুখে তার কুৎসিত হাসি। হাসি দিয়েই সে কিভাবে যেন বেয়াদবী করতে জানে। আমাকে দেখেই হাসলো কিনা বুঝলাম না। আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলেও কিছু বললাম না। রিপনকে বললাম, চল উঠি।