Tuesday, July 9, 2013

আকালের রূপকথা

পশুসমাজে শিয়ালের স্থান খুব একটা সম্মানজনক না হলেও রাত বিরাতে তাদের হুক্কাহুয়ার চিৎকার শুনলে মনে হবে এই বনে একটাই মাত্র প্রাণী -তার নাম শিয়াল। অথচ এই বনে শিয়াল ছাড়াও অগুনতি পশু আছে। হাতি, ঘোড়া, বাঘ ভাল্লুক সিংহ বানর গরু ছাগল সব রকমের পশু বাস করে শান্তিপূর্নভাবে।

শক্তির দিক থেকে সিংহের চেয়ে বড় কেউ নেই, কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে গরু এক নম্বর। এর কারণ হলো গরু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিশ্বাসী নয়। গরুদের মধ্যেও নানান ভাগ, বলদ, ষাঁড়, গাভী, বকনা বাছুর।

এই বনে গণতন্ত্রের জয়জয়কার। তাই বনের রাজা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি সবকটাই গরু। এটা নিয়ে সিংহেরা মনে মনে খুব অসন্তুষ্ট। কিন্তু গনতান্ত্রিক সভ্য সমাজে শক্তি বেশী হলেও তা সমাজের নেতা হবার ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আবশ্যক।

গরুদের সাথে সবারই সুসম্পর্ক থাকলেও শেয়ালদের সাথে নেই। কারণ শেয়ালের দল একাধিকবার বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছে। এই বসতি গড়ে ওঠার সময় থেকেই। এদের সব শাখা প্রশাখা বিদেশে। এরা বনসমাজের নিয়মনীতির বিরুদ্ধে কাজ করেও অজুহাত দেয় বনদেবতার নির্দেশের। এদের তেমন কিছুতে নৈপুন্য না থাকলেও দুইটা কাজে এদের নিপুনতা তুলনাবিহীন-

এক- রাতের সম্মিলিত হুক্কাহুয়া,
দুই- জামাতের সাথে মলত্যাগ।

এরা সকালে উঠে জামাতের শৃংখলার সাথে মলত্যাগ শুরু করলে তীব্র দুর্গন্ধে বনের সব পশুপাখীকে ওই এলাকা ছেড়ে সরে যেতে হয়। এটার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না কারণ এটা তাদের গনতান্ত্রিক অধিকার। এমনকি সংখ্যাগুরুরা গরুর দলও মেনে নেয় এই শৃংখলাবদ্ধ দুষ্কর্ম।

কিন্তু ব্যাপারটা খেয়াল করে একদিন সিংহের মাথায় অন্যরকম বুদ্ধি খেলে যায়। সিংহ ভাবতে থাকে এত শক্তি থাকা সত্ত্বেও বনের সকল নিয়মনীতির মালিক গরু সমাজ, এটা কিছুতে মেনে নেয়া যায় না। একটা কিছু করতে হবে। এবং সেটার জন্য শেয়ালদের কাজে লাগাতে হবে। সিংহ গোপনে শেয়ালদের ডেকে বললো তার উদ্দেশ্যের কথা। সফল হলে শিয়ালদের পুরস্কারের কথা বলতেও ভুললো না। শিয়াল সমাজ কাজে লেগে গেল। গরুদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করলো বাকী পশুদের।

কিন্তু ছাগলসমাজ বাদে আর কেউ সাড়া দিল না শিয়ালের প্রস্তাবে। ফলে শিয়ালদের একা একাই মতলব হাসিলের কাজ করতে হয়। যে সাহস তাদের আগে ছিল না, সিংহের আশ্বাসে তারা অতি সাহসে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা রাতের বেলা হুক্কাহুয়া আর দিনের বেলা মলত্যাগের পরিমান বাড়িয়ে দেয়। দৈনিক একবারের জায়গায় চারবার লাদি ছাড়ে। এই গনতান্ত্রিক অধিকার মেনে নিয়ে বনের শান্তিপ্রিয় পশুরা বিপদে পড়লো। এমনকি সর্বোচ্চ গন্ধ সহনশীল বলদরাও তীব্র গন্ধে অতিষ্ট হয়ে গেল।

সিংহ বাস করে অনেক দূরে, ওখানে কোনরূপ গন্ধ পৌঁছায় না। কিন্তু বাকী সব পশু দুর্গন্ধের দাপটে নিজেদের আস্তানা ছেড়ে দূরের পাহাড়ে আশ্রয় নিল।

পশুদের মধ্যে গাধাকে সবচেয়ে বুদ্ধিহীন ভাবা হতো। বুদ্ধিহীন হলেও সে শক্তির মাত্রা বোঝে। তাই গরুর চেয়ে সিংহের উপর ভরসা বেশী তার। গাধা ভাবলো শেয়ালের এই নিদারুণ অত্যাচারের কথা সিংহের কাছে বলে আসি। সিংহ এসে তিন হুংকার দিলে শিয়ালের দল পালাবার রাস্তা খুঁজে পাবে না। একদিন সে চুপিচুপি চলে গেল সিংহকে ডেকে আনতে।

দূর থেকে গাধাকে আসতে দেখে সিংহ বুঝে গেছে সময় এসে গেছে। দেরী না করে সিংহ দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বনের কেন্দ্র অভিমূখে। বনের কেন্দ্রে হাজির হয়ে সে এসে একটা হুংকার দিতে না দিতেই শেয়ালের দল চুপ। তারপর সিংহ ঘোষনা করলো,

"ভাইসব, আজ এই বন মরুভূমি হয়ে গেছে নানান চক্রান্তে। এই মরুভুমিকে আবারো বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হবে। জাতির ক্রান্তিকালে তাই আমাকে হাল ধরতে হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বনে আর কোন পশু নেই, কেবল সিংহ, শিয়াল ছাগল আর গাধা। সুতরাং জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখি -কে হবে নতুন রাজা?

শিয়াল? না! শিয়ালের বুদ্ধি আছে ঈমান নাই।
ছাগল? না! ছাগলের দাড়ি আছে সাহস নাই।
গাধা? না! গাধার মাথা আছে মগজ নাই।

সুতরাং আমি- পশুজাতির এই নগণ্য কাণ্ডারী বাধ্য হয়ে আজ থেকে বনের সকল দায়িত্ব নিজের হেফাজতে নিলাম। বনের সকল পশু দীর্ঘজীবি হোক।"

শিয়ালের দল তখন হুক্কাহুয়া করে সমস্ত বন বাদাড় কাঁপিয়ে জিন্দাবাদ দিল সিংহের নামে।

ফেসবুকিং

মধ্য বয়সে এসে এমন একটা ক্যাচালে জড়িয়ে পড়বেন স্বপ্নেও ভাবেননি খবিরউদ্দিন। বিশ বছর ধরে সরকারী চাকুরী করে যা কামিয়েছিলেন তা দিয়ে শহরে দুইটা বাড়ি তৈরী করে বউ বাচ্চা নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। আরো দশ বছর এই চাকরীতে আরাম করে কাটানো যাবে।

কিন্তু একদিন খবির উদ্দিনের টেবিলে একটা কম্পিউটার বসানো হলো ইন্টারনেট সহকারে। তিনি জীবনে কোনদিন কম্পিউটার ধরেননি, ভাবতেন এটা কেবল অপারেটরের কাজ। বুড়ো বয়সে কম্পিউটার নিয়ে কাজ কি? তিনি না জানেন টাইপ, না চেনেন প্রোগ্রাম। কিন্তু সরকারের হুকুম। দেশটা ডিজিটাল হচ্ছে, টেবিলে টেবিলে কম্পিউটার এখন। খবিরউদ্দিনের টেবিল কেমনে খালি থাকে? মুশকিলে পড়ে গেলেন খবিরউদ্দিন। কম্পিউটার বসলো। তবে কম্পিউটার বসানোর পর থেকে ওটা বসেই থাকতো। ওটায় কোন কাজই নাই তাঁর। কালো বোরকা পরে টেবিলের উপর জড়োসড়ো।

একদিন বড় সাহেব অফিসে উঁকি দিতে আসলেন। সবাই তটস্থ, যার যার টেবিলের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে দ্রুত। খবিরুদ্দিনের তেমন কাজ থাকে না, বসে বসে পত্রিকা পড়েন সারাদিন। পত্রিকা পড়ে খবরাখবর সংগ্রহ করে সময় সময় বড় সাহেবের কাছেও গালগল্প করেন। বড় সাহেবের পত্রিকা পড়ার সময় নাই। মন্ত্রী সচিবের গুঁতো সামলাতে হিমশিম। বলা চলে বড় সাহেবের জন্য খবিরউদ্দিনই দেশের সবগুলো হট নিউজের সুত্র। তাই বড় সাহেবকে আসতে দেখে পত্রিকার গভীরে ডুবে যায় আরো। বড় সাহেব সমস্ত অফিসে চক্কর দিয়ে তার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়-

-খবিরউদ্দিন সাহেব
-জী স্যার!
-কি করেন?
-স্যার, মিচ্যুয়াল ফাণ্ডের ইন্টারেস্ট রেটে বড় একটা ছাড় দিয়েছে, এইমাত্র পড়লাম
-কোথায় পড়লেন?
-এই তো স্যার, এই পত্রিকায়
-আপনার কম্পিউটার কি নষ্ট?
-না স্যার, একদম নতুন এখনো, আমি তো ব্যবহার করি না তেমন
-ব্যবহার করেন না কেন? টেবিলে কম্পিউটার দেয়া হয়েছে কি জন্য?
-স্যার.....মানে.. ওখানে তো আমার কাজ নেই...তাই
-পত্রিকা পড়াও তো আপনার একটা কাজ
-জী স্যার
-পত্রিকা কম্পিউটারে পড়েন না কেন?
-কম্পিউটারে স্যার, কি করে পত্রিকা পড়ে আমি ঠিক জানি না
-জানার চেষ্টা করলেই জানবেন
-আচ্ছা স্যার
-কাল থেকে অফিসে পত্রিকা নেয়া বন্ধ। কম্পিউটারে বিনামূল্যে পত্রিকা পড়া যায়।
-জী স্যার

বিপদে পড়ে গেলেন খবিরউদ্দিন। কম্পিউটারে পত্রিকা পড়া শিখতে তো তার বছরখানেক লেগে যাবে। এত জটিল সব বোতাম, সারা জীবনেও মনে হয় এতসব মুখস্থ হবে না। তিনি তাঁর জুনিয়র সহকারীকে ডেকে কম্পিউটারে পত্রিকা খোলার ব্যবস্থা করতে বললেন। সহকারী এসবে চটপটে। সে দুমিনিটে হাজির করে দিল পত্রিকাটা। আশ্চর্যের আশ্চর্য খবির উদ্দিন। এত কামেল জিনিস তার টেবিলে আছে অথচ তিনি ব্যবহারই করেননি এতদিন! সেদিন থেকে খবির উদ্দিন উঠে পড়ে লাগলেন কম্পিউটার নিয়ে। কয়েক মাস পরে তো রীতিমত সিদ্ধহস্ত হয়ে গেলেন কম্পিউটারে ইন্টারনেট খোলাখুলিতে। পত্রিকার পাশাপাশি তিনি অন্যন্য সাইটগুলো ভিজিট করেন, এমনকি ইউটিউব আর ফেসবুকের মতো জিনিসও খবিরউদ্দিনের আয়ত্বে চলে আসে।

মেয়েটার সাথে ফেসবুকেই পরিচয়। বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও মেয়েটার সাথে ঘনিষ্টতায় জড়িয়ে যান। সুখ দুঃখের যাবতীয় আলাপ করেন। একদিন দেখা গেল খবিরউদ্দিন তার জীবনের গোপনতম কথাটিও মেয়েটাকে বলতে শুরু করেছেন। যা কোনদিন তার বউয়ের কাছেও ফাঁস করেনি। অবশ্য পুরাতন প্রেমের কাহিনী বউয়ের কাছে শেয়ার করার মতো সাহস সব পুরুষের থাকে না। কিন্তু মেয়েটা কেন যেন তাঁর গোপন জগতের অধিকারী হয়ে গেল। মেয়েটারও কাহিনী আছে। সেও অবলীলায় তার কাহিনী খবিরউদ্দিনের কাছে বলতে থাকে। দুজনের গোপন কথা শেয়ার করতে গিয়ে খবিরউদ্দিনের মনে হঠাৎ করে রোমাঞ্চ খেলে যায়। তিনি মনে মনে ভাবতে থাকেন মেয়েটা তার সাথে পরকীয়া করছে। পরকীয়া মানে নিষিদ্ধ ক্রিয়া। যে কোন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের দুর্বার আগ্রহ। খবিরউদ্দিনেরও তাই হলো। তিনি পত্রিকা পড়া ভুলে এখন ফেসবুকে পড়ে থাকেন। সারাদিন চ্যাট করেন। মেয়েটাও প্রতিদিন তাঁর জন্য বসে থাকে। এতকিছু হলেও মেয়েটার ছবি দেখেননি কখনো। ছবি দেখার কথা মাথায় আসেনি তার। তার ছবিও মেয়েটা কোনদিন দেখতে চায়নি। এরকম অসম বয়সে ছবি দেখাদেখি ব্যাপারটা কেমন যেন। তবু একদিন মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। ছবি পাঠালো মেয়ে। অপূর্ব মেঘলা চুলের একটা মেয়ে। দেখেই বুকের ভেতর রিনিঝিনি বৃষ্টি শুরু হলো। নস্টালজিক হতে হতে অনেক পেছনে চলে গেলেন খবিরউদ্দিন। আরো বছর বিশেক আগে........। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর বুক চিরে।

প্রতিদিন কাজের চেয়ে মেয়েটার সাথে গোপন আড্ডায় বেশী সময় ব্যয় হতে থাকে খবির উদ্দিনের। মনে মনে অপরাধবোধ কাজ করে। এমন একটা মেয়েকে নিয়ে তিনি কেন এত আবেগ দেখাচ্ছেন। মেয়েটাকে প্রতিদিন না দেখলে কেমন যেন লাগে বুকের মধ্যিখানে। ছুটির দিনগুলো তাঁর সময় কাটে না। বাজারে গেলে ইচ্ছে করে মাছ সবজির থলেটা ছুড়ে ফেলে কাজের ছুতোয় অফিসে ছুটে যান। কিন্তু খোলার দিনেই তাঁর কাজ থাকে না, ছুটির দিনে কেমনে যায় অফিসে? তবু বাজারের থলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে মাছ তরকারী কেনার সময়ও মন পড়ে থাকে মেয়েটার কাছে। বুড়ো বয়সের প্রেম বড় জ্বালা দেখি। তাঁর আবারো তরুণ হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে।

একদিন ফোন নাম্বার বিনিময় হয়। ফোনের কন্ঠ শুনে খবিরউদ্দিনের বুকের জ্বালা ক্রমশঃ উর্ধমূখী হতে থাকে। এবার শায়লাকে মুখোমুখি দেখার তৃষ্ণা জাগে তার। হ্যাঁ মেয়েটার নাম শায়লা শারমিন। সে আদর করে শাশা ডাকেন আজকাল। খবিরউদ্দিন অনেক জোরাজুরি করেন দেখা হবার জন্য কিন্তু শাশা বলে সেটা ঠিক হবে না। ওরা একই শহরে বাস করে, অথচ কেউ কাউকে দেখবে না, এটা মানতে পারেন না খবিরউদ্দিন। কিন্তু জোর করার সাহসও পান না। যদি শায়লা ভুল বোঝে?

বড় সাহেবের সাথে বড়লোকী এক দাওয়াতে যেতে হলো বিষুদবার সন্ধ্যায়। অথচ প্ল্যান ছিল বড় সাহেব চলে গেলে অফিসে বসে শায়লার সাথে কিছুক্ষণ ফোনপ্রেম করবে। কিন্তু নাছোড় লোকটা তাকে নিয়েই পার্টিতে গেল। পার্টিটা বিশাল একটা জায়গা জুড়ে। মেরিনার্স ক্লাবের লনটা যেন একটা সবুজ পার্ক। সেখানে নানান গাছের ঝোপঝাড়ের পাশে টেবিল সাজানো। বাগানজুড়ে আলোক সজ্জা। বড় সাহেব পার্টিতে ঢুকে জুটে গেল বড় সাহেবদের সাথে। খবিরউদ্দিন একটা মাঝারি এক্সিকিউটিভ ধরনের লোকের টেবিলে বসলেন। বিশাল গোলাকার টেবিল। এক টেবিলে বারো জনের বসার ব্যবস্থা। সেখানে আরো কয়েকজন বসে গল্প করছে। খাবার দিতে দেরী আছে কিন্তু সবাই আগেভাগে টেবিলগুলো দখল করে বসে গেছে। খবিরের খুব বোরিং লাগছে, এখানে তার পরিচিত কেউ নেই। হঠাৎ ইচ্ছে হলো শায়লার সাথে কথা বলতে। ফোন করলো শায়লার মোবাইলে।

মিউজিক বাজছে মৃদুলয়ে। অচেনা পশ্চিমা কোন সঙ্গীত। এসব ভালো বোঝেন না খবিরউদ্দিন। মিউজিকের পাশাপাশি মোবাইল টোনও যুক্ত হয়েছে। এদিক সেদিন বেজে উঠছে টুংটাং মোবাইল রিংটোন। কোনটা মোবাইল কোনটা মিউজিক আলাদা করা যাচ্ছে না সবসময়। এই টেবিলেও বাজছে কোন একজনের মোবাইল। খারাপ লাগছে না শুনতে। কি ব্যাপার ফোন ধরছে না কেন শায়লা। অনেকক্ষণ পর ধরলো।

প্রায় ফিসফিস করে খবির বললো- হ্যালো!
ওপাশ থেকেও ফিসফিস শব্দ এলো-হ্যালো!
খবির ফিসফিস করে বললো- আই মিস ইউ শাশা!
ওপাশ থেকে বললো-আমি একটা পার্টিতে এসেছি, পরে কথা বলি?
এপাশ থেকে খবির বললো- আমিও একটা পার্টিতে
ওপাশ থেকে বললো- তাহলে তুমিও পার্টি শেষ করো, তারপর কথা বলবো
এপাশ থেকে খবির বললো-পার্টিতে আমার কাজ নেই, তাই তোমার সাথে কথা বলি
ওপাশ থেকে বললো-কাজ আমারো নেই, কিন্তু এরকম ফিসফিস করে কথা বলতে পারবো না। বিশ্রী লাগে। আমার টেবিলের উল্টোদিকে এক হাঁদারাম মোবাইল নিয়ে প্রায় টেবিলের নীচে ঢুকে যাচ্ছে।

খবিরউদ্দিন খেয়াল করলেন ফিসফাস করতে করতে মাথাটা তিনি একটু বেশীই নীচে করে ফেলেছিলেন। কিন্তু শায়লার সামনের লোকটাও একই ভঙ্গি করলো? ব্যাপার কি? হঠাৎ চোখে পড়লো খবিরউদ্দিনের সোজা টেবিলের উল্টোদিকে বসা মোবাইল কানে মাঝবয়েসী মহিলাটাও ফিসফিস করে কথা বলছে। চোখ বড় বড় করে মহিলার দিকে তাকালো খবির। শায়লা ওপাশ থেকে বললো- হ্যালো রাখছি, বুড়ো হাঁদাটা এখন আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। খবির দেখলো মহিলা কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো।

জমে গেলেন খবির উদ্দিন। ফেসবুকের তরুণী শায়লা আর এই মাঝবয়েসী মহিলা একই মানুষ? মহিলার দশাসই চেহারার সাথে কন্ঠের কোন মিল নেই। খবিরউদ্দিন ঢোক গিলতে লাগলেন এবং ধরা পড়ার আগেই টেবিলটা ছেড়ে পালাবার পথ খুঁজতে থাকলেন। বড় সাহেবের গাছে গিয়ে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে পার্টি থেকে কেটে পড়লেন।

পরদিন থেকে খবিরউদ্দিনকে ফেসবুকে দেখা গেল না আর। সবকিছুর জন্য সরকারের ডিজিটাল প্ল্যানটাকে শাপশাপান্ত করে দায়ী করলেন খবিরউদ্দিন। বড় সাহেবকে বললেন কম্পিউটারে পত্রিকা পড়ে পড়ে তার চোখের বারোটা বেজে যাচ্ছে। বড় সাহেব ব্যাপারটা আমলে নিলেন। অতএব কম্পিউটারটা আবারো বোরকার আড়ালে চলে গেল। খবিরউদ্দিন চলে গেলেন কাগুজে পত্রিকার আড়ালে।

আসল কথা: নকল কথা

নকল কথা:
মানুষ কেন লেখে? এই ভাবনার যে উত্তরটা আমি নিজের কাছ থেকে পাই তা হলো - মানুষের চুলকায় বলে লেখে। কথা কি অশ্লীল হলো? চুলকানি কি অশ্লীল হতে পারে? যেমন চুদুরবুদুর? চুদুরবুদুর অশ্লীল নয় বলে ঘোষণা এসেছে। আমার পড়াশোনা কম, ডিকশেনারি উল্টাই না বহুদিন। তাছাড়া দিনরাত যেসব শব্দ নিয়ে কারবার তা কেউ ডিকশেনারীতে খোঁজে না। তবে বুঝি চুলকানি শব্দটা কখনো কখনো সেমি অশ্লীল। ধরেন কারো কথা শুনে আমার ইচ্ছে হলো তার পাছায় একটা গদাম লাথি দিতে, অথচ ভদ্রতার খাতিরে দিতে পারছি না, সেক্ষেত্রে বলি- "কি রে ভাই, চুলকায় নাকি?"

আসলে সবারই কোন না কোন চুলকানি আছে, এই চুলকানি শরীরের না, মগজের। মানুষের মগজের গ্রে এরিয়াতে হরকে কিসিমের চিন্তাভাবনায় ভরপুর। যার যখন যে চিন্তা চুলকায় সে তখন ওই বিষয়ে লেখে। যার চুলকানীর সাথে কীবোর্ডের সম্পর্ক ভালো, তার লেখা তত ভালো হয়। কীবোর্ডের সাথে মগজের সম্পর্কটা ভালো না আমার, তবু লিখি হাত চালু রাখার জন্য। হাত চালু রাখা মানে হলো বাংলা টাইপের স্পীড ধরে রাখা। স্কুল বয়সে যেরকম হাতের লেখা ঠিক রাখার জন্য প্রতিদিন দুই পাতা লিখতে হতো, সেরকম।

মগজের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে না পারলেও আঙুলের সাথে কীবোর্ডের একটা ভালো বোঝাপড়া হয়েছে গত পাঁচ বছরে। ফলে ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে আর অসুবিধা হয় না। দেশে কোনদিন যদি মোল্লারা ক্ষমতায় আসে, আফগান স্টাইলে আমাকেও ধরে নিয়ে সিলিং এর সাথে পা বেঁধে জিজ্ঞেস করা হবে, কেন ব্লগ লিখিস? জ্ঞান হারাবার আগে আমার প্রথম উত্তর হবে - চুলকায় বলে লিখি।

আমাদের পাড়ায় এক বক্তা ছিল যিনি মঞ্চে উঠে প্রথমেই বলে নিতেন, "ভাই আমি কম কথার মানুষ, বেশী কথা পছন্দ করি না। আমার বক্তব্য অতি সংক্ষিপ্ত হবে, আজে বাজে কথা বলে আমি আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। মাত্র দুটি বাক্যে আমার বক্তৃতা শেষ করবো। আজকাল কেউ কেউ মাইকের সামনে দাড়ালে থামতেই চাই না। মানুষের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে তাদের কোন চিন্তা ভাবনা নাই। তাই আমি আপনাদের বেশীক্ষণ বিরক্ত করবো না। অতি সামান্য কথায় আমার বক্তৃতা শেষ করে দিব..........." কমসে পনেরো মিনিট ত্যানা পেঁচানোর পর তিনি তার 'সংক্ষিপ্ত' বক্তৃতা শুরু করতেন। আমিও চামে কয়েকটা চাপা মেরে দিলাম। এবার আসল কথায় আসি।

আসল কথা:
আমি ধর্মভীরু মানুষ। মানে ধর্মকে ডরাই, তার চেয়ে বেশী ডরাই যারা ধর্মের ডাণ্ডা হাতে নিয়ে ঘুরে। ক্লাস নাইনে থাকতে কলোনীর মিল্লাত ভাই বললেন, "এসো নামাজ পড়ি"। তারপর আমি টুপি নিয়ে মিল্লাত ভাইয়ের সাথে মসজিদে যাতায়াত শুরু করলাম। আমাদের দলের সবাই মোটামুটি মসজিদে হাজির। খেয়াল করলাম নামাজের পর দোতলায় আরেকটা আসর বসতে শুরু করেছে যেখানে যাবার জন্য মিল্লাত ভাই ব্যাপক জোরাজুরি করতেন। এত সুন্দর মানুষ, অনুরোধ ফেলতে ইচ্ছে করে না। তাই আছরের পর মিলাদে দাওয়াত দিলে ঠিক মোনাজাতের সময় হাজির হয়ে জিলিপিগুলো সংগ্রহ করে আবার মাঠে খেলতে চলে আসি। আমাদের মসজিদে যাতায়াতে মিল্লাত ভাই খুশী হলেও তাদের দোতলার সেশানে আগ্রহ সৃষ্টি করাতে না পেরে তিনি হতাশ। এবং হতাশা বিরক্তিতে রূপান্তরিত হলো যখন দেখলো মসজিদে যাওয়া দলের চেয়ে জিলাপি সংগ্রহের দলে লোক ভারী হয়ে গেছে দেখে। একদিন জুমার নামাজে প্রকাশ্যে বলে ফেললেন, এই ব্যাটা মসজিদে আসে ঠিক, কিন্তু সে হলো 'কমিনিষ্ট'। তখনো আমি ঠিক জানতাম না 'কমিনিষ্ট' কি জিনিস। কলেজে ওঠার পর বুঝেছি ওই শব্দটা হবে কমিউনিষ্ট। আরো বড় হয়ে বুঝেছি কমিউনিষ্ট হওয়া কত শক্ত কাজ। আদতে আমি কখনোই কমিউনিষ্ট ছিলাম না, তবু কেন জানি মোল্লারা আমাকে কমিউনিষ্ট ডাকতে পছন্দ করতো। তিনটা উল্লেখযোগ্য 'কমিনিষ্ট' অভিজ্ঞতার কথা লিখবো আজ-

১.
আমার এক বন্ধুর সাথে মেসে থাকতো পাড়ার মসজিদের ব্যাচেলর ইমাম। আমি বন্ধুর সাথে আড্ডা মারতে গেলে কোন কোন সময় হুজুরও অংশগ্রহন করতো তাতে। একবার কথা উঠলো সাইক্লোন নিয়ে। নানা কথার পর দুয়েক পাতা বিজ্ঞান পড়া আমি দুম করে জ্ঞান জারি করলাম, "আজকাল আমেরিকা রাশিয়া চেষ্টা করতেছে বোমা মেরে সাইক্লোন ধ্বংস করে দিতে"।

আমার কথা শেষ করা মাত্র হুজুর লাফ দিয়ে উঠে বললেন, "নাউজুবিল্লাহ!!! তুমি এসব কি কথা বলতেছো, সাইক্লোন-ঝড়-তুফান এগুলো আল্লাহর কুদরত, এগুলোয় বোমা মারবে মানুষ? কি রে মিজান তোর বন্ধু কি কমিনিষ্ট নাকি?"

২.
আরেকবার এশার নামাজ পড়তে গেছি হঠাৎ মুসল্লি হয়ে। বাদে এশা হুজুর কিছু বয়ান করতে চাইলেন মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে। বেশীরভাগ মানুষ এই সব শোনে না। কয়েকজন বাদে সবাই চলে গেল। আমিও কেন যেন রয়ে গেলাম শয়তানের প্ররোচনায়। হুজুর বলছেন, শ্রোতারা শুনছেন। এক পর্যায়ে কথা উঠলো ছবি নিয়ে। ছবি তোলা হারাম, ছবি রাখা হারাম, যে বাসায় ছবি থাকবে সে বাসায় ফেরেশতা ঢুকবে না।

শ্রোতারা সবাই মাথা নাড়ছেন ভক্তি ভরে, যদিও জানি তাদের প্রত্যেকের বাসার টিভিতে দিনভর নাচগান চলে।

হুজুর উত্তেজিত স্বরে বলছেন, "যাদের বাড়িতে ছবি থাকবে তাদের কোন ইবাদত আল্লাহর আরশে পৌঁছাবে না, কারণ ওই বাড়িতে ফেরেশতা ঢুকতে পারবে না। সুতরাং ওই বাড়ির বাসিন্দাদের নিশ্চিত দোজখের আগুনে জ্বলতে হবে!!!"

আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। আমার বাসায় বিশাল সব পোট্রেট ছবিতে দেয়াল ভর্তি। বছরে উনপঞ্চাশ বার জুমার নামাজ পড়েও যদি দোজখবাসী হতে হয়, তার আগে একটা প্রতিবাদ করে যাই।

বললাম, "হুজুর পত্রিকার ছবি দেখলেও কি ফেরেশতা ফিরে যাবে নাকি?"
হুজুর হুংকার দিয়ে বললেন, "আলবত!"

তখন আমি বললাম, "হুজুর তাইলে আপনার এত বছরের কোন ইবাদতই তাইলে আল্লাহর আরশে পৌঁছে নাই। বাকীদের কথা বাদই দিলাম, আপনারে তো প্রতিদিন পত্রিকা হাতে দেখি। এখানে কার বাসায় পত্রিকা নাই?"
কথা শেষ না হতেই একটা গুঞ্জন উঠে গেল তৎক্ষনাৎ। লোকজন পারলে আমার মুখে আইকা গাম লাগিয়ে দেয়। কথাটা বলে কেমন একটা বিমলানন্দ পেলাম। হুজুর বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। মনে মনে হয়তো আমার জন্য হাবিয়া দোজখে সিট বরাদ্দ চাইলো। তবে কথা আর বাড়ালেন না। বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে বসতে বসতে বিড়বিড় করে বলছিল ....কমিনিষ্ট কমিনিষ্ট।

৩.
পাড়ার এক আংকেল মারা গেছেন। তার বাসায় মিলাদে দাওয়াত। পাড়ার বিশ ত্রিশজন মুরব্বীর সাথে বসে আছি। হুজুর এলেন। পাশের মসজিদের হুজুর। মিলাদ শুরু করার আগে হুজুর বললেন, "আপনারা মান্যগন্য লোকেরা হাজির আছেন, মরহুম এ আহমদ সম্পর্কে কিছু কথা বলবো মিলাদের আগে।"
শুরু হলো কথা। মরহুমকে নিয়ে দুই কথার পর হুজুর চলে গেলেন বেগানা নারীদের দিকে, ডিশ দেখে দেখে কিভাবে লোকজন নেংটো হয়ে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে বেপর্দা নারী, ঘরের ছাদে ছাদে শয়তানের জাল। শান্তিচুক্তি করে সরকার দেশকে বিক্রি করে দিয়েছে, জেহাদ ছাড়া মুক্তি নাই, আমেরিকা মুতে ভাসিয়ে দিতে হবে ইত্যাদি জাতের কথাবার্তা।

আমার প্রায়ই ঝামেলা লেগে যায় হুজুরদের সাথে। তাই এবার সিদ্ধান্ত নিলাম মুখে টেপ লাগিয়ে বসে থাকবো। এত মুরব্বীর সামনে মুখ খারাপ করার কোন মানে হয় না। তাই দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে ঝিমাতে লাগলাম। বিছানায় ঘুম আসতে আমার ঝামেলা হলেও সভা-সমিতি-সেমিনার-মিলাদ-মাহফিল-খুতবা ইত্যাদিতে আমাকে মড়ার ঘুমে টানে এখানেও হেলান দেয়া মাত্র তলিয়ে যেতে থাকলাম। ভদ্রতার জন্য জোর করে চোখ খোলা রাখতে গিয়ে দেখি এই যাত্রায় আমি একা না, পাশের বিল্ডিং এর ইদ্রিস চাচাও ইতিমধ্যে নাক ডাকতে শুরু করেছে। ফলে আমি আরো ভরসা পেয়ে নিশ্চিন্তে ঢলে পড়লাম দেয়ালে মাথাটা রেখে। কিছুক্ষণ পর ধড়মড় করে জেগে উঠলাম ভয়ংকর এক হুংকারে।

হুজুর গর্জন করে বলছে, "যারা আল্লাহর মজলিসে এসে ঘুমিয়ে পড়ে তারা নিশ্চয়ই শয়তানের দোসর এবং কমিনিষ্ট!!!"

কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলেও আমি নির্লজ্জের মতো হেসে আঙুল দিয়ে দেখালাম ইদ্রিস চাচার দিকে, তিনি তখনো অবিরাম নাক ডেকে চলছেন আসর জমিয়ে। চাচা সম্ভবতঃ ঘুমের ডেল্টা লেভেল পার হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে।

ইদ্রিস চাচা পাড়ার সবচেয়ে জাদরেল মুরব্বী এবং এই মসজিদের সবচেয়ে নিয়মিত মুসল্লী। হুজুর ওনাকে না দেখে কেবল আমার দিকে নজর দিয়েছিল বলেই সেই গর্জন। এবার আর কথা না বাড়িয়ে টুপ করে বসে দোয়া দরুদ পড়া শুরু করলো। আর আমি আরেক দফা ঘুম যাবো কিনা ভাবতে লাগলাম।

দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছিল তখন

১.
দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। জানালা দিয়ে অনেক দূরের কিছু পাহাড় সারির ধোঁয়াশা। ধোঁয়াশাটা বৃষ্টির পর্দা। পাহাড়গুলো নদীর ওপারে। মাঝে মাঝে দেহবহির্ভূত হয়ে মনটা ওই পাহাড়ের আড়ালে আশ্রয় নেয়। একদিন নদীটা পার হয়ে সোজা ওই পাহাড়গুলোর দিকে চলে যাবো। অফিসে আসার পথে প্রতিদিন নদী পারাপারের খেয়াঘাট পেরিয়ে আসি। কখনো সখনো দেখি সারিবদ্ধ মানুষ নৌকা থেকে নেমে শহরের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। যেখানে ঘাট, সেখানেই বাসস্টপ। সন্ধ্যের আগে কাজ সেরে সবাই ফিরে যাবে ওই পাড়ে।

নদীর এই ঘাটলাটা বড় সুন্দর। আধুনিক খেয়াঘাট। কাঠের সুন্দর পাটাতন মহাসড়ক থেকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে নৌকার কাছে। শহরের মধ্যখানে এমন সুন্দর একটা ঘাট আছে ভাবতে ভালো লাগে। ঘাট থেকে মূল নদী কয়েকশো গজ দূরে। নদী ছেড়ে একটা সরু খাল শহরের পেট চিরে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে, সেই খালের মধ্যেই এই ঘাট। এই দূরত্বটাই এই ঘাটের সৌন্দর্য। খালটি নদীতে প্রবেশের আগে কয়েকশো গজের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পেরিয়ে আসে। ঘাটের ছাউনি বরাবর বিশাল একটা অশ্বথ গাছ ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। গ্রামের হাটবাজারে কিংবা নদীর ঘাটেও এই গাছগুলিই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু মহানগরের এই দালানকোঠার ভিড়ে কেউ খেয়াল করে ওকে? এরকম গাছগুলো কেউ লাগায় কিনা জানি না, মনে হয় এরা পাখির ঠোঁট থেকে পতিত বীজ থেকে জন্মায়, তারপর অযত্নে বেড়ে ওঠে একসময় মহীরূহ হয়ে যায়। এই গাছের ছায়ায় বসে মানুষ যাত্রার ক্লান্তি দূর করে, আয়েশ আড্ডাবাজি করে, আর বৃষ্টির সময় এই গাছগুলো হয়ে ওঠে নিদারুন আশ্রয়। আহ্ আমারো তেমন একটা আশ্রয় বৃক্ষ ছিল গ্রামের বাঁশবনটায়।

ঘাটের জায়গাটা ঘিরে অদ্ভুত সৌন্দর্য বিস্তার করেছে গাছটা। তবে এই গাছটা একেবারে নিঃসঙ্গ না, তার আরেকটা কনিষ্ঠ সঙ্গী খালের ওই পাশেও। ওদিকে ঘাট নেই, জাহাজ মেরামত কারখানা। এপাশের গাছের নীচে জিরোবার জন্য নগরকর্তারা চৌচালা টিনের ছাউনি বানিয়ে দিয়েছে। তার নীচে চারপাশ ঘিরে সিমেন্টের বাধানো বিশ্রামাসন। ওখানে বসে নদীর হাওয়া খেতে অপূর্ব লাগবে। আমি প্রায়ই কল্পনা করি ওখানে বসে প্রাণ জুড়ানো হাওয়া খাচ্ছি একা একা। সত্যিই একদিন সময় করে বসবো ওখানে। যেদিন খেয়া নৌকায় নদী পার হবো সেদিন।

২.
এই দেখো ভাবতে ভাবতে চা জুড়িয়ে জল। শেষ দুই চুমুকে চা শেষ করে আবারো জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ওমা, ওদিকে তো সব ঝাপসা। পাহাড়টা কখন দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেছে। ধুম বৃষ্টি পড়ছে মাইলখানেক দূরের নদীতে। এদিকে এখনো ঝিরিঝিরি। আমি অনেকদিন বৃষ্টিতে ভিজি না। একদমই যে ভিজিনি তা নয়। অফিস থেকে ফেরার পথে, বাজার করে আসার পথে টুকিটাকি বৃষ্টির ছাঁট লেগেছে। কিন্তু সেরকম আয়োজন করে ঝুপ ঝুপ করে ভেজা হয়নি অনেক দিন। আমাদের পুরোনো বাড়িটা ছেড়ে আসার পর বৃষ্টিতে ভেজার দুর্ভাগ্য কমে গেছে। ওই বাড়িতে অনেক ভিজেছি ইচ্ছায় অনিচ্ছায়। এখন সেই স্মৃতিগুলোই সম্বল। আজকাল ভিজতে চাইলেও পারি না। পকেট সম্পদ মোবাইল মানিব্যাগের চিন্তায় ভেজা হয়ে ওঠে না।

৩.
তোমার সাথে মেঘের যেমন মিল, বৃষ্টিরও। যখন অঝোর বৃষ্টিতে পৃথিবী ভেসে যায়, তখনো আমি তোমাকে খুঁজে পাই বৃষ্টির ছন্দে। তোমার মায়াগুলো বৃষ্টির ঘ্রান হয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেয়। বৃষ্টি আমার অনেক অনিষ্ট করেছে তবু তোমার জন্যই বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়।

৪.
-চলো একটা বিকেল দুজনে একসাথে কাটাই
-কিভাবে?
-বাইরে কোথাও বসবো
-যদি কেউ দেখে ফেলে?
-সেই রেস্তোঁরায় বসবো, ওদিকে কেউ যায় না তেমন।
-তবু ভয় করে
-ভয় আমারো, তবু একদিনও বসবো না আমরা, এ কেমন কথা?
-এখন বসে কি হবে?
-কিছুই হবে না। তবু মুখোমুখি নিরিবিলি কিছুটা সময় পাওয়া...
-যখন সময় ছিল তখন তো ডাকেননি
-তখন ডাকার সুযোগ ছিল না
-কেন?
-বলবো?
-বলেন
-পকেট ছিল গড়ের মাঠ, তোমাকে নিয়ে কোথায় বসতাম বলো?
-আমার পকেটে তো ছিল, আপনার সাহসটা থাকলেই হতো
-সাহস থাকে পকেট ভর্তি থাকলে
-আপনি কাপুরুষ ছিলেন
-এখন বসতে রাজী আছো কিনা বলো
-মাকে কি বলবো?
-সে তুমিই জানো
-আপনি একটা বুদ্ধি দেন
-তোমার বুদ্ধি আমার চেয়ে বেশী
-কচু
-সত্যি, মনে আছে অনেক বছর আগে তুমি আমাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলে মায়ের কাছ থেকে?
-হ্যাঁ খুব মনে আছে, সেই চিঠির উত্তরটা দেবার জন্য..
-যে উত্তরটা বহুবছর খুব কষ্ট দিয়েছিল
-যে উত্তরের অর্থ ভুল করেছিলেন বলে
-কেন অমন জটিল করে লিখেছিলে, আরেকটু সহজ ভাষায় বলা যেতো না?
-আমার রাগ হয়েছিল আপনার প্রশ্ন শুনে... তাই ওরকম লিখেছিলাম
-রাগ কেন?
-অত বছর পর কেউ অমন কথা জিজ্ঞেস করে?
-কত বছর?
-জানি না, তবে আমি জানতাম আমরা দুজনেই একই কাপে চা খাচ্ছি,  তবু আপনার মনে সেরকম অবান্তর একটা প্রশ্ন
-ওটা স্বাভাবিক প্রশ্ন
-না, মোটেও না, আপনি আমাকে অন্ততঃ ওই প্রশ্ন করতে পারেন না
-কেন?
-আপনি ভালো করেই জানতেন কেন আমি আপনার কাছে আসি, আপনার সঙ্গ কেন পছন্দ করি। আপনি জেনেও না জানার ভাণ করতেন
-সত্যি জানতাম না
-বিশ্বাস করি না, আমি সবাইকে সরিয়ে শুধু আপনার কাছে থাকতে চাইতাম...আর আপনি তা জানেন না সেটা কি করে বিশ্বাস করি?
-এখন বিশ্বাস করি, আগে করতাম না
-আপনি একটা ভীতুর ডিম

৫.
জোসেফিন অনেকদিন পর এই শহরে। ওকে নিয়ে আমি কখনো কোথাও বসিনি। সেদিন ওর কালো পোষাকে অপুর্ব লাগছিল। আমি জানি সে আমার জন্য সেজে বসেছিল। সাজলে ওকে অপূর্ব লাগে। ও সাজতে জানে। ওর এত কষ্ট বুকে, তা বোঝার উপায় নাই ওর সাজ দেখে। আমাকে দেখে কি যে উৎফুল্ল হয়েছিল সেদিন, সেটা কেবল আমিই বুঝেছি। সে পারছিল না আমাকে ধরে বসে থাকতে। যদি আর কেউ না থাকতো, তাহলে হয়তো আমাকে আসতেই দিত না।

-না যেতে দিব না, হোক দেরী
-বৃষ্টি আসবে তো
-আসুক বৃষ্টি
-এমন করে বসে থাকলে চলবে?
-আমি কিছু বুঝি না, আপনি বসে থাকবেন, আমি আপনাকে খাওয়াবো, তারপর যাবেন
-অনেক খেলাম তো, এত এত নাস্তা পানি
-না, আরো খেতে হবে, চুপ করে বসেন তো

আমার হাত ধরে বসিয়ে দিল। তারপর সেও বসলো। কাছাকাছি। চোখে চোখ রেখে। কাজল কালো চোখ। মায়াভরা দৃষ্টি। আকুল হয়ে দেখছে। আমি ওর হাত ধরলাম। সে আমার হাত দুটো চেপে ধরলো। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এল। মনে মনে বললো, এত দেরী করে এলেন কেন? আমি চোখ দুটো ওর চোখে রাখলাম। সে চোখ নামিয়ে আমার কাঁধে মাথা রাখলো। আমি ওর মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরলাম। এই প্রথম। এই প্রথম জোসেফিনকে আমি বুকে নিলাম। কতো বছর ধরে অপেক্ষা ছিল!!!! টের পেলাম বুকের কাছটা ভিজে যাচ্ছে। জোসেফিন কাঁদছে। অক্ষম কান্না।

আমি জোসেফিনের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললো, আই লাভ ইউ জোসেফিন!
জোসেফিন একটু কেঁপে উঠে আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। ফিসফিস করে বলছে, আপনাকে আমি যেতে দেবো না, কিছুতেই দেবো না।

কিন্তু আমি জানি আমাকে উঠতে হবে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাইরে ব্যাঙ ডাকছে তারস্বরে। জোসেফিনদের বাড়িটা নির্জন জায়গায়। আশেপাশে এখনো খোলা মাঠ, ফসলের ক্ষেত, পাহাড় আর বন। আমি এই বন পেরিয়ে হেঁটে রাস্তায় উঠবো। যদি কোন গাড়ি আসে উঠে পড়বো। আমাকে যেতে হবে বহুদুর।

কিন্তু জোসেফিন শক্ত করে ধরে রেখেছে আমাকে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এত বছর পর ওকে পেলাম, এই পাওয়া স্বপ্নের মতো। এখুনি শেষ হয়ে যাবে স্বপ্নটা।

৬.
অনেক রাত। আমার ঘুম আসছে না। খানিক পরেই ভোর হয়ে যাবে। জোসেফিনের কাছ থেকে ফেরার পর থেকে আমার বুকের ভেতরটা সুখের আবেশে ভরে আছে। গত তিন ঘন্টা ধরে অবিরাম স্মৃতির সেলুলয়েড ঘুরিয়েছি। জোসেফিন আর আমার কত কত স্মৃতি। দীর্ঘকালের আনন্দ বেদনার স্মৃতিচারণ। সেও কি ঘুমাতে পারছে না? ফোন করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সাহস হয় না। যদি কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায়! এটা বললে জোসেফিন খুব রাগ করে। ওর কাছে আমার যে কোন সময় ফোন করার অধিকার আছে। যে কোন সময়। তবে কেবল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই সুযোগ সীমিত। এটা বলে জোসেফেন হি হি হি করে হাসতে থাকে। জোসেফিনের হাসি আমার বুকে বাজতে বাজতে আমার দুচোখে ঘুম নামিয়ে দেয়। এখন আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবো।

Tuesday, July 2, 2013

Punishing Bangladesh

DHAKA, July 2: The US suspension of GSP facilities is to punish 'Mighty Bangladesh', American English-language international daily newspaper 'The Wall Street Journal' reports.


The report published on July 1 says, Obama Administration has finally found a nation it`s willing to punish—mighty Bangladesh. The U.S. suspended tariff-free access to the U.S. market for a small portion of Bangladesh`s exports last week. U.S. Trade Representative Michael Froman said the goal is "to see Bangladeshi workers in safe, appropriate work situations." But the real effect will be to hurt those workers and hand the AFL-CIO (American Federation of Labor and Congress of Industrial Organizations) a protectionist victory.


Big Labor has petitioned since 2007 to strip Bangladesh of its privileges under the Generalized System of Preferences (GSP), which allows lower tariffs for goods from developing countries. The collapse of the Rana Plaza textile factory building in April killed more than 1,100 people, while giving the Administration a political excuse to do the bidding of the AFL-CIO and its allies in Congress.


The decision defies economic or moral logic. First, the U.S. GSP program doesn`t include textiles, the industry that has attracted the labor movement`s ire. Garments account for more than 90% of Bangladesh`s exports to the U.S., and these goods will continue to pay an average tariff of 15%. Tariffs on clothes didn`t encourage better safety standards in the textile industry, and higher tariffs on other products will squeeze those factories` profit margins and possibly force them to cut corners on safety.


Textile tariffs merely slow the ability of Bangladesh and similar countries to get on the first rung of the development ladder. Sewing work is well suited to migrants from the countryside with few skills, and because it requires dexterity rather than strength, it gives opportunities to women.


So while Bangladeshi workers earn some of the lowest wages in the world, the experience of countries like China that have trod this ground suggests that on the current trajectory this is temporary. In the last two decades, the proportion of the Bangladeshi population living in poverty has fallen to less than 40% from 70%. As the pool of underemployed labor is exhausted, investment in technology and higher skills boosts productivity and wages.


The safety problems in Bangladesh are a tragic side effect of an industry growing quickly while government and society struggle to keep up. Dhaka needs help to improve its capacity to regulate industry and fight corruption. But that should not obscure the fact that the factories are fundamentally a blessing to be encouraged.


Washington could do more to help the developing world`s workers if it cut textile tariffs to zero by including them in the GSP program. Once countries like Bangladesh can export garments more easily, they will progress through this stage of industrialization faster. Slowing their progress only punishes them for the failures of their government, and rewards the backward thinking of the AFL-CIO.

http://stream.wsj.com/story/latest-headlines/SS-2-63399/SS-2-266584/